আল্লামা জালালুদ্দিন রুমির বিখ্যাত গদ্য রচনা ফিহি মা ফিহি। ফারসি গদ্যসাহিত্যে মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত হয় তেরো শতকে রচিত এই গদ্য। বইটি ইংরেজিতে Discourse of Rumi নামে পরিচিত। সহজিয়ায় এটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন সায়মন আলী।
আমির বললেন, “আমার হৃদয় ও আত্মা দিনরাত সর্বক্ষণ আল্লাহর সেবায় নিয়োজিত থাকতে চায়, কিন্তু মোঙ্গলদের আক্রমণ রুখতে ব্যস্ত থাকায় আমি সে অনুযায়ী আল্লাহর সেবা করার সময় পাচ্ছি না।”
প্রত্যুত্তরে রুমি বললেন, “আপনি যে কাজ করছেন তাতেও আল্লাহর সেবা করা হয়ে যাচ্ছে। কেননা, আপনার উক্ত কাজের দ্বারা দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে। আপনি সে কাজের জন্য নিজেকে, নিজের সম্পদকে, নিজের সময়কে উৎসর্গ করছেন। আর আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী এমন উৎসর্গকারী কয়েকজনই শান্তিপূর্ণভাবে পরপারে চলে যাবেন। সুতরাং আপনার কাজটিও উত্তম কাজসমূহের একটি। আল্লাহতায়ালা আপনাকে তেমন একটা কাজের দিকেই ঝুঁকতে বলেছেন। আর আপনি যা করছেন তার প্রতি আপনার সর্বোচ্চ নিবেদন প্রমাণ করে যে, এটির উপর আল্লাহর রহমত রয়েছে। তবে আপনার কাজের প্রতি যদি কোনো রূপ দুর্বলতা থাকতো তবে সেটা আল্লাহর রহমতকে অস্বীকার করার মতো ধৃষ্টতা হতো। কারণ, ঐশ্বরিক অনুগ্রহ অর্জনের জন্য যারা সঠিক নিয়ত ও মনোভাবের অধিকারী আল্লাহ তাদেরকেই নেতৃত্ব দেন।
উষ্ণ স্নানের কথাই ধরা যাক। শুকনো খড়, গোবর, কুটো ইত্যাদির মতো জ্বালানী পুড়িয়ে এর উত্তাপটা পাওয়া যায় এবং পরিশুদ্ধি ঘটে। একইভাবে ঈশ্বর হয়তো কোনো কিছু অশুভ ও খারাপ হিসেবে দৃশ্যমান করতে চাইলেন করলেন কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সেটা পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতার অবয়ব। উষ্ণ স্নানের মতোই মানুষের পরিশুদ্ধি ঘটে তার যাবতীয় কর্মকাণ্ডের প্রচেষ্টার উত্তাপ দ্বারা, যার মাধ্যমে পরবর্তী সকলে বিশেষভাবে উপকৃত হয়।“
এই পর্যায়ে রুমির কয়েকজন অতিথি এলেন, রুমি ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক বললেন, “আমি প্রার্থনারত থাকার ফলে যদি আপনাকে আপ্যায়ন করতে না পারি এবং আপনাকে স্বাগত জানাতে না পারি অথবা আপনার কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে না পারি তবে এটা সত্যিকার অর্থেই আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। কারণ, সম্মান নির্ধারিত হয় উপযুক্ত উপলক্ষ মেনে। যখন কেউ প্রার্থনারত থাকে তখন প্রার্থনা থামিয়ে তার পিতা অথবা ভাইকে সম্ভাষণ জানানো উচিত নয়। প্রার্থনারত থাকার জন্য যদি বন্ধুবান্ধবদের সম্ভাষণ জানানো না হয় এবং এর ফলে যদি তাদের অসম্মান হয় তবে সেই অসম্মানই তাদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান। আপাত দৃষ্টির সেই অসম্মান প্রকৃত অর্থে তাদের প্রতি সর্বোচ্চ সৌজন্য প্রকাশ। কারণ সেই ব্যক্তি তার প্রিয়জনদের জন্যই ঈশ্বরের প্রতি নিমগ্নতা থেকে সরে আসেন নি। এই আপাত অসম্মান প্রদর্শন সেই প্রিয়জনদেরকে ঈশ্বরের বিরাগভাজন হওয়া থেকে রক্ষা করে। সুতরাং সত্যিকারের সম্মান কখনো সামাজিকতা রক্ষার বা মনোরঞ্জনের বিষয় নয় বরং একের অপরের প্রতি আত্মিকভাবে সংস্রবের বহিঃপ্রকাশ।”
কেউ একজন জিজ্ঞেস করল: “ঈশ্বরের সান্নিধ্যে পৌঁছতে পারার জন্য প্রার্থনা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় আছে কি?”
রুমি বললেন, “হ্যাঁ আছে। তবে সেটাও একরকম প্রার্থনা। তবে এই প্রার্থনার কোন বাহ্যিক রূপ নেই। প্রার্থনার বাহ্যিক রূপ বলতে প্রার্থনার পুরো ভাষাটাকে বোঝায়; কেননা, এর একটা শুরু আর একটা শেষ আছে। যেকোনো কিছুই একটা শুরু আর শেষ নিয়ে গঠিত। সমস্ত উক্তি এবং বচনের একটি শুরু আর শেষ রয়েছে এবং এই শুরু আর শেষ নিয়েই একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ গঠিত হয়। কিন্তু প্রার্থনার অভ্যন্তরীণ রূপ হচ্ছে শর্তহীন এবং অসীম। এর কোন শুরুও নেই, শেষও নেই।
এবার মুহম্মদের কথা বলি, যিনি ইসলামী মতবাদের প্রবর্তক। তিনি বলেছিলেন,“ঈশ্বরের সাথে আমি একান্তে কিছু সময় কাটাই যেখানে কোন নবি-পয়গম্বরের অবস্থান নেই, এমনকি নেই কোন ফেরেশতার অবস্থানও। অথচ গুরুত্বের দিক থেকে ঈশ্বরের ঠিক পরেই ফেরেশতাগণের স্থান।“ সুতরাং আমরা বুঝতে পারি, প্রার্থনার সারবস্তু ও প্রার্থনা একে অপর থেকে আলাদা নয়। বরং এটি সম্পূর্ণরূপে এক ধরণের নিবিষ্টতা, ধ্যান। প্রার্থনার সকল বাহ্যিক রূপের জন্য এটি একটি ভূমিহীন রাজ্য। জিব্রাইল (আ:) এর মতো খাঁটি বাস্তবতাকেও সেখানে পাওয়া যাবে না।”
মুহম্মদ একসময় কড়াভাষায় তাঁর এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি তোমাকে ডাকলাম তবু তুমি আসো নি কেন?” উত্তরে বন্ধুটি বললেন, “আমি ধ্যানে মজে গেছিলাম।”
এ সম্পর্কে একটি ঘটনা বলা যাক। একদিন আমার বাবার কিছু বন্ধু আমার বাবাকে সম্পূর্ণ ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখতে পান। প্রার্থনার সময় হয়ে গেলে তারা বাবাকে বললেন, “নামাজের সময় হয়েছে।” বাবা তাঁদের কথা শুনতে পান নি, তাই তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেই ছিলেন। তাই তাঁরাও আর দেরি না করে উঠে পড়লেন এবং নামাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। সকলে উঠে গেলেও দুজন বন্ধু বাবার সাথেই রয়ে গেছিলেন, নামাজের জন্য উঠে যান নি।
যাঁরা বাবার সাথে রয়ে গেছিলেন তাঁদের একজনের নাম খোয়াজগি। তাঁর নিকট পরিষ্কার দৃষ্ট হয়েছে এবং তিনি তাঁর গভীর মর্মবোধ থেকে দাবি করেন যে, যাঁরা মুহম্মদের পিছনে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছিল তাঁরা সকলেই মক্কার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেও পরে তাঁরা মক্কামুখী হয়ে পড়েন একই সময়ে সেই দুজন যাঁরা আমার বাবার সাথে থেকে গেছিল তাঁরা মক্কার দিকে মুখ করেই ছিলেন। যদিও আমার বাবা তখন সমস্ত ব্যক্তি পরিচয়ের উর্ধ্বে চলে গেছেন, তিনি তখন আর এ জগতে নেই, তখন তিনি যেন ঈশ্বরের আলোতে মিশে গেছেন, পরিণত হয়ে গেছেন ঐশ্বরিক দ্যুতিতে।
যারা ঐশ্বরিক আলোকের দিকে ঘুরে গেল আর মেহরাবের দেয়ালে মুখ করে দাঁড়ালো তারা নিশ্চয়ই মক্কার দিকেই মুখ করে দাঁড়ালো কেননা ঐশ্বরিক আলোকরশ্মি মক্কামুখী হয়েই বিকীর্ণ হচ্ছিল।
মুহম্মদ একসময় কড়াভাষায় তাঁর এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি তোমাকে ডাকলাম তবু তুমি আসো নি কেন?” উত্তরে বন্ধুটি বললেন, “আমি ধ্যানে মজে গেছিলাম।” নবিজি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “বেশ, কিন্তু আমি কি তোমাকে আল্লাহর জন্যই ডাকছিলাম না?” প্রত্যুত্তরে বন্ধুটি বললেন, “আমি অসহায়।”
প্রতি মুহূর্তে অসহায় বোধ করা একটি ভালো দিক। নিজের ব্যর্থতায় যেমনটা অসহায় বোধ করেন ঠিক তেমনই নিজের সফলতায়ও নিজেকে অসহায় ভাবা উচিৎ। আপনার সাফল্য বা ব্যর্থতাই চূড়ান্ত নয় কারণ, আপনার ক্ষমতার উপরে একটি বৃহত্তর ক্ষমতা আছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনার ইচ্ছা সেই বৃহত্তর ক্ষমতাশালীর ইচ্ছার অধীন। এই সমর্থ তো এই অসমর্থ — এমন দ্বিধাভক্ত আপনি না। বরং আপনি সর্বদাই অসহায়, পার্থক্য হচ্ছে সেটা কখনো আপনার মনে থাকে কখনও মনে থাকে না। যখন আপনার মনে থাকে তখন ঐ মুহূর্তে আপনার মন-অন্তর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এবং আপনি তৈরি হবার আগেই আপনার উপায় তৈরি হয়ে যায়। বস্তুত, যেখানে বাঘ-সিংহ-কুমির ইত্যাদি সবই অসহায় এবং আল্লাহর ইচ্ছার সামনে কম্পমান সেখানে আমদের অবস্থাটাই বা কী? এমনকি স্বর্গ-মর্ত্যও পর্যন্ত তাঁর ইচ্ছার অধীন।
আল্লাহ এক মহাশক্তিমান শাসক। তাঁর আলোক চন্দ্র, সূর্য বা অন্যান্য আলোক উৎসের মতো সাধারণ আলোক নয়। যখন সে আলোক নিজ উৎস থেকে উৎসারিত হয়ে সবকিছু উদ্ভাসিত করে দেয় তখন সেখানে স্বর্গ-মর্ত্য কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকে না। অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে চন্দ্র-সূর্য-তারকারাজি সহ সবকিছু। সেই মহান আলোকের বাস্তবতার কাছে আর সবই অবাস্তব হয়ে পড়ে।
একজন রাজা এক দরবেশকে বললেন, “মহান আল্লাহর আদালতে যখন আপনি তাঁর আরশ ও নৈকট্য লাভ করবেন তখন আমাকে স্মরণ করতে ভুলবেন না।” দরবেশ প্রত্যুত্তরে বললেন, “আমি যদি তেমন অবস্থায় উপনীত হই তো তখন সূর্য আমার মাথার খুব কাছে জাজ্জ্বল্যমান থাকবে, তখন আমি আমার নিজেকেই স্মরণ করতে পারব না; আপনাকে কীভাবে স্মরণ করবো?”
তাই আপনাদের এমন দরবেশের সন্ধান করা উচিত যিনি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকেন এবং তাঁর কারণে আল্লাহর কাছে আপনার কিংবা আপনাদের প্রয়োজনের কথা উল্লেখ না করেও পূর্ণ হয়। এমনকি তিনি আপনার বা আপনাদের জন্য কোন সুপারিশ না করলেও যেন আল্লাহ আপনার তথা আপনাদের প্রার্থনা কবুল করেন।
একদা এক রাজার একজন ভৃত্য ছিল। ভৃত্যটি রাজার খুবই পছন্দের এবং বিশ্বস্ত ছিল। যখন ভৃত্যটি রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে রওনা হতো তখন লোকজন তার কাছে নিজেদের সমস্ত কথাবার্তা, চাহিদা, প্রয়োজন ব্যক্ত করতো; তাকে কিছু চিঠি-দরখাস্ত দিতো; আর অনুরোধ করতো যেন সে তাদের বক্তব্য, চাহিদা, প্রয়োজন ইত্যাদি রাজার কাছে ব্যক্ত করে আর সে চিঠিগুলো যেন রাজার কাছে পৌঁছে দেয়। সে তখন তাদের দেয়া সমস্ত, দাবিদাওয়া নিজের ঝুলির ভিতর রেখে দিতো। একদিন রাজার সামনে উপনীত হওয়ামাত্র ভৃত্যটি রাজার মাহাত্ম্য ও সৌন্দর্যের ছটা সহ্য করতে না পেরে সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে গেল। রাজা তখন খুবই সৌহার্দ্যের সাথে ভৃত্যটির ঝুলিতে হাত ঢুকিয়ে বললেন, “দেখি তো আমার এই ভৃত্যটির ঝুলিতে এমন কী আছে? যে কিনা আমার উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না সে এই ভারি ঝুলি কীভাবে সহ্য করে?”
আর তখনই মানুষের যাবতীয় আবেদন, চাহিদা, প্রয়োজন রাজার নজরে এলো। তিনি সব কিছু দেখে আবার ভৃত্যটির ঝুলিতে আগের মতো সুন্দর করে ঢুকিয়ে রাখলেন। তারপর রাজা সকলের সমস্ত চাহিদা পূরণ করলেন, প্রয়োজন মেটালেন, সমস্যার সমাধান করলেন। সেই ভৃত্যটি রাজাকে কিছু না জানালেও লোকেদের সমস্ত চাহিদা পূরণ হচ্ছিল। উপরন্তু তারা তাদের চাহিদার তুলনায় রাজার কাছ থেকে বহুগুণে বেশি পাচ্ছিল। অপরদিকে, রাজার যেসকল ভৃত্য প্রতিনিয়ত রাজার কাছে লোকেদের সমস্যা তুলে ধরতো, সমাধান চাইতো, রাজার কাছে সাহায্য চাইতো তাদের সমস্ত চাহিদা বা প্রয়োজনের মধ্যে খুব হলে বড়জোড় একটা চাহিদা পূরণ হতো।
(চলবে)
পড়ুন ।। কিস্তি ২
অনবদ্য।অনেক শুভকামনা।