উপনিবেশবাদের ময়নাতদন্ত ।। এক

পৃথিবীখ্যাত বইয়ের একটি ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজম  (১৯৫৩)। লিখেছেন ফরাসি উপনিবেশ মারতিনিকের লেখক, রাজনীতিবিদ ও তাত্ত্বিক এইমে সিজার। জোয়ান পিংকহামের করা ইংরেজি অনুবাদ থেকে বইটি ধারাবাহিকভাবে বাংলায় অনুবাদ করবেন কবি ও অনুবাদক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম।

 

যে সভ্যতা তার নিজের জন্ম দেয়া সমস্যাগুলি সমাধানে অক্ষমতার প্রমাণ দেয়, সে অধঃপতিত সভ্যতা। যে সভ্যতা তার নিজের অধিকাংশ মারাত্মক সমস্যাকে দেখেও না দেখার ভান করে, সে বিকারগ্রস্ত। ধোঁকা ও ছলনাকে যে সভ্যতা মূলনীতি হিসেবে ব্যবহার করে, সে পচনশীল।

 

আসল কথা হচ্ছে, তথাকথিত ইউরোপীয় বা পশ্চিমী সভ্যতা যেহেতু দুশো বছরের বুর্জোয়া শাসনের মাধ্যমেই গঠিত, এই সভ্যতাই জন্ম দিয়েছে আরও দুটো প্রধান সমস্যার যেগুলোর সমাধানে সে নিজে অক্ষম। সমস্যাগুলো হচ্ছে, শ্রমিক শ্রেণির সমস্যা এবং ঔপনিবেশিক সমস্যা। যুক্তি বা বিবেকের মানদণ্ড কোনোটি দিয়েই ইউরোপ নিজেকে এ ব্যাপারে ন্যায্যভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি। তাই ক্রমবর্ধমানহারে ইউরোপ জঘন্য প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে ।

 

‘ইউরোপের শেষ রক্ষা হবে না’ — আমেরিকান কৌশলবিদরা হরহামেশাই এটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কানাকানি করে। ব্যাপারটা কিন্ত নিজে একটা বিশাল গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। বরং গুরুত্বের কথা হচ্ছে নৈতিক কিংবা আত্মিক দিক থেকে ইউরোপ এখন অরক্ষণীয়।

 

ইউরোপের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এখন শুধু ইউরোপের সাধারণ জনগণই করছে তা নয়, এটা করা হচ্ছে বৈশ্বিকভাবে। ইউরোপের দাসত্বের শিকল থেকে মুক্ত হয়ে দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ ইউরোপের অপকর্মের বিচারক হিসেবে হাজির হয়েছে। উপনিবেশবাদিরা ইন্দো-চিনে মানুষ হত্যা করেছে, মাদাগাস্কারে নির্যাতন করেছে, কৃষ্ণদেশ আফ্রিকায় বন্দি করেছে মানুষ, ওয়েস্ট ইন্ডিজে গণহত্যা চালিয়েছে। ফলে উপনিবেশিতরা ভালো করেই বোঝে উপনিবেশবাদীদের ওপর তাদের এক ধরনের প্রাধান্য রয়েছে। তারা (উপনিবেশিত) জানে যে তাদের ক্ষণস্থায়ী প্রভুরা মিথ্যা বলছে। আর, ঠিক এ কারণেই তাদের প্রভুরা নির্বল।

 

আমাকে অনুরোধ করা হয়েছে উপনিবেশবাদ ও সভ্যতা নিয়ে কিছু বলতে, তাই চলুন, প্রথমেই কথা বলি হাজারো মিথ্যার জন্মধাত্রী এক প্রধান মিথ্যা নিয়ে।

 

উপনিবেশবাদ এবং সভ্যতা (এগুলো কী জিনিস)?

এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে সবচেয়ে পরিচিত একটি বিপদ হচ্ছে সরল বিশ্বাসে একটি সামষ্টিক প্রতারণার শিকারে পরিণত হওয়া, যে প্রতারণা অত্যন্ত সুকৌশলে আসল সমস্যাকে ঢেকে মিথ্যা উপস্থাপনা করে, যাতে করে তাদের (উপনিবেশবাদীদের) হিংসাত্মক সমাধানগুলোকে নিজেদের জন্য বৈধ করে তুলতে পারে।

এই উপনিবেশবাদের খেলোয়াড় মূলত দুঃসাহসী জলদস্যু, পাইকারি বিক্রেতা, জাহাজের মালিক, স্বর্ণখোদক, ব্যবসায়ী শ্রেণি, ক্ষুধা ও পেশিশক্তি এবং সভ্যতার নামের চালিত এক বিধ্বংসী মহাপরিকল্পনা।

অন্যভাবে বলতে গেলে, এখানে সবচেয়ে মৌলিক বিষয়টি হচ্ছে প্রথমেই একটি  সহজ-সরল প্রশ্নকে পরিস্কারভাবে দেখা, ভালোভাবে চিন্তা করা (যেটি মারাত্মক হতে পারে) এবং তার সঠিক উত্তর দেয়া। প্রশ্নটি হচ্ছে, উপনিবেশবাদ আসলে কী?

 

আগে  দেখে নেয়া যাক এটি আসলে কি নয়; এটি খ্রিস্টধর্মের প্রচার নয়, কোনো মানবকল্যাণমূলক কাজ নয়, নয় অশিক্ষা, রোগব্যাধি কিংবা স্বৈরশাসনকে তাড়ানোর কোন বাসনাও, খোদার মহিমা প্রসারের পরিকল্পনাও নয়, এমনকি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্ঠা ও নয়। তাই পরিশেষে কোনো রকম ভণিতা ও সন্দেহ ছাড়াই সরল স্বীকারোক্তি হচ্ছে : এই উপনিবেশবাদের খেলোয়াড় মূলত দুঃসাহসী জলদস্যু, পাইকারি বিক্রেতা, জাহাজের মালিক, স্বর্ণখোদক, ব্যবসায়ী শ্রেণি, ক্ষুধা ও পেশিশক্তি এবং সভ্যতার নামের চালিত এক বিধ্বংসী মহাপরিকল্পনা। কেননা ইতিহাসের এক পর্যায়ে এসে ইউরোপীয় সভ্যতা নিজের অভ্যন্তরীণ কারণেই বাধার সম্মুখীন হয়, তাই নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে বাড়িয়ে দেয় শত্রুতাপূর্ণ অর্থনীতির এক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা।

 

এই ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি তলিয়ে দেখেছি আমাদের এই সময়ে চলমান প্রতারণাকে। করতেজ, মেক্সিকোতে যিনি প্রথম গিয়েছিলেন ইউরোপ থেকে, কিংবা পিজারোর আগেই কুজকো, কেউই নিজেকে একটি উন্নত ব্যবস্থার প্রথম উপস্থাপক বলে দাবী করেন নি। তবে তারা হত্যা, লুটতরাজ, অস্ত্রবাজি, লোলুপতা সবই করেছিল। কিন্ত দাস তৈরির বয়ান শুরু হয়েছে অনেক পরে। এই জায়গায় প্রধান অপরাধী হচ্ছে খ্রিস্টান পাণ্ডিত্য যারা একটি মিথ্যা কথা চালু করেছিল; খ্রিস্টানত্ব মানে হচ্ছে সভ্যতা এবং পৌত্তলিকতা মানে অসভ্যতা। এখানে থেকেই সূত্রপাত হয় যাবতীয় ঘৃণ্য ঔপনিবেশিক, বর্ণবাদী কুফলতা। যার শিকার হতে হয়েছে ভারতীয়, হলুদ মানুষ কিংবা কালো মানুষকে।

 

এত কিছুর পরেও আমার বলতে কোনো অসুবিধা নেই যে, বিভিন্ন সভ্যতা একে অন্যের সংস্পর্শে আসাটা ভালো। এবং বিভিন্ন বিশ্বের মিলন অনেক দারুণ একটা ব্যাপার। একটি সভ্যতা যতই উন্নত হোক না কেন, সে যদি নিজেকে গুটিয়ে রাখে নিজের ভেতরে তাহলে তার অবনতি অনিবার্য। সভ্যতার জন্য আদান-প্রদান হচ্ছে অক্সিজেনের মত। এটা ইউরোপের কপালের গুণ যে, সে এই আদান-প্রদানের যাত্রাপালায় সংযোগস্থল হিসেবে  সুযোগ পেয়েছিল, সে হয়েছিল সকল চিন্তাচেতনার প্রধান ভূমি, সব দর্শনের আধার, সকল ভাব-বিনিময়ের মিলনভূমি। ইউরোপ হয়ে ওঠে ছিল চেতনা ও উদ্দীপনা পুনরায় বণ্টনের প্রধান কেন্দ্র।

 

কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, উপনিবেশায়ন কি সভ্যতাগুলোকে কাছাকাছি আনতে পেরেছিল? অথবা এটা কি কাছাকাছি আনার অন্যান্য সকল মাধ্যমগুলোর চেয়ে ভালো উপায় ছিল?

আমি বলি, ‘না’। ছিল না।

আমি আরো বলি, উপনিবেশায়ন আর সভ্যতা প্রচারের মধ্যে রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব। তাই ঔপনিবেশিক সময়ে যত পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল, যত বিধি-বিধান করা হয়েছিল কিংবা মন্ত্রণালয়গুলো যত পদক্ষেপ নিয়েছিল, তার কোনোটির মধ্যেই ছিলনা নূন্যতম মানবিক মূল্যের কোন ছিটেফোঁটা।

(চলবে)

3 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব সুন্দর অনুবাদ হয়েছে। পাঠকালে একবারও মনে হয়নি বিদেশি কোনও বইয়ের অনুবাদ পড়ছি। লেখক আর সহজিয়াকে ধন্যবাদ ও ভালোবাসা অবিরাম।

  2. পড়ে ভালো লাগলো, স্যার। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here