বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।
২৪
কীসব কীসব স্বপ্নটপ্ন দেখে মাথা ভার হয়ে আছে। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। জ্বর। ঘুম ভেঙে দেখি ঘরে দাদি-মা-রিয়া সবাই। আমার অবস্থা আরও কাহিল। বাবা গেছে ডাক্তার আনতে। জ্বরের আজ তৃতীয় দিন। এই ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। ঘণ্টা খানেকও যায় না আবার কাঁপতে কাঁপতে জ্বর আসে। পেটও ঠিক হয়নি। চোখমুখ একদম বসে গেছে। মা ভয় পেয়ে গেছে। মার ধারনা, কী না কী হইলো কে জানে! বাবাকে পাঠাইছে ডাক্তার আনতে। বাবা ডাক্তার আনবে কোত্থেকে? ডাক্তার কি বাসায় আসবে নাকি? মাথায় জলপট্টিটা দাদি বদলে দিলো। দেওয়া মাত্র গরম হয়ে যায়। গোসল করতে হবে আজকে। ভালো লাগছে না। দাদি নাকি, এই কয়দিন, ভেজা তোয়ালে দিয়ে গা-মুছে দিয়েছে। কখন কবে দিলো, মনে নেই।
জ্বরের ঘোরে হুশ নেই। ভুলে গেছি। তালগোল পাকিয়ে গেছে সব। বাবা একজন কমবয়সী ডাক্তার ধরে এনেছেন। তার কোন এক ছাত্রের কীভাবে যেন ভাই। ৩৪ বিসিএস। জ্বর মাপলো, প্রেসার মাপলো আরও কী কী করলো। বললাম, ‘খাওয়ার দাওয়ার কারণেই হলো কিনা? জ্বর আসার আগের দিন খাবার-দাবারের খুব অনিয়ম হয়েছে। বেশি জাঙ্কফুড খাওয়া হয়েছে।’ ইয়ং ডাক্তার আমার কথাকে খুব একটা গুরুত্ব দিলো না। বললো, হতে পারে। কী কী ঔষধ লিখে দিলো। জিজ্ঞেস করলো, আজকে নিয়ে কয়দিন। বাবা বলার আগেই মা বললো, তিন দিন। সাতদিনের মধ্যে ভালো না-হলে কী কী টেস্ট করাতে হবে, ডাক্তার বাবাকে জানালো। বললো, ‘আশা করি ভালো হয়ে যাবে।’ মা খুব বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে শোনাল, জ্বর এই ভালো হয় আবার কাঁপতে কাঁপতে আসে। ডাক্তার খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। যেন মা’র কাছ থেকে সে-ই শিখছে। বললো, ‘ভালো হয়ে যাবে। সমস্যা নেই।’
আমি মারা গেলে বিভাস কি কাঁদবে? কাঁদবে না। ছেলেরা কাঁদে না। মন খারাপ করবে। না, মন খারাপও করবে না। বিভাস কখনো মন খারাপ করে না। ইমরান মন খারাপ করবে।
বাবা ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে গেলেন। ডাক্তার বাসা থেকে বিদায় নিতে না নিতেই আরেক কাণ্ড ঘটলো। শুরু হলো তীব্র পেট ব্যথা। আমি গোঙাতে শুরু করলাম। কেন পেট ব্যথা শুরু হলো কে জানে। রিয়া বাবাকে ফোন করলো। বললো, পেট ব্যথার কথা। রিয়ার কাছ থেকে মা ফোন কেড়ে নিল। আমার যে নতুন করে পেট ব্যথা শুরু হয়েছে, এই কথাটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, বারবার বললো বাবাকে। খুবই কষ্ট হচ্ছে আমার। অসুস্থতা মারাত্মক জিনিস। সুস্থ থাকার যে কী মজা তা কেবল অসুস্থ হলেই পাওয়া যায়।
বিকেল থেকে আর বাথরুমে যাওয়ার তাড়া বোধ করছি না। কিন্তু শরীর একই মাত্রায় দুর্বল। মাথা-ব্যথা আর জ্বর অপরিবর্তিত। শরবত-টরবত খেতে ভালো লাগছে। বমিভাবটা নেই। দাদি লেবু দিয়ে শরবত বানিয়ে দিতে বললো। নিজেই বানাতে গেলো। দাদিকে বসতে বলে, মা গেলো শরবত বানাতে। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। মাথায় তেল দিয়ে দিতে চাইলো দাদি। আমি মানা করলাম। ঘরের মধ্যে কেমন একটা অসুস্থতার গন্ধ। মনে হচ্ছে, আমি আর কোনোদিন সুস্থ হবো না। মারা যাবো। ফুপুর মত মারা যাবো। আমার নাক দিয়ে রক্ত আসবে। পচা রক্ত। চোখে পানি চলে এলো ভাবতে ভাবতে। আমি মারা গেলে মা কাঁদবে। অনেক কাঁদবে। আসলে মা-বাবার চেয়ে আপন কেউ নেই। আর আমি তো তাদেরই অংশ। আমি তো আমার মায়েরই আরেকটা ভার্সন। শরবত নিয়ে আসলো মা। মাকে দেখে চোখ দিয়ে পানি গড়াতে শুরু করলো আমার। আমার মা। মাকে কোনোদিন এতো মনোযোগ দিয়ে দেখিনি। আমার মা’র চেয়ে সরল ও সুন্দর মানুষ আমি দেখিনি। আমরা সবাই তার সঙ্গে শুধু রাগই দেখাই। বাবা, আমি, রিয়া এমনকি হিয়া। মা জানে এগুলো রাগ না। ভালোবাসা। চোখের পানি লুকানোর উপায় নেই। বললাম, আমার ভালো লাগছে না। খারাপ লাগছে। চোখের পানির একটা ভুল ব্যাখ্যা তৈরি করে দিলাম।
আমি মারা গেলে বিভাস কি কাঁদবে? কাঁদবে না। ছেলেরা কাঁদে না। মন খারাপ করবে। না, মন খারাপও করবে না। বিভাস কখনো মন খারাপ করে না। ইমরান মন খারাপ করবে। ও কেমন বাচ্চাদের মত। একটু হট টেম্পার। সবকিছুর প্রতি তার শুধু অভিযোগ। প্রথমদিকে তার কথার একদম গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু তার কথাগুলো তো মিথ্যা না। বলে, ‘তুমি বিশ্বাস করবে? স্কুল-কলেজ থেকে ঐ অর্থে আমি কিছুই শিখিনি। আমাদের দেশে সারা জীবনে একজন শিক্ষার্থী ঠিক কী শেখে? কিছুই না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কী শিখেছো তুমি? নিজেই ভাবো নিজেরটা। আমি অনেক ভেবেছি। তাহলে যে এই আমরা উচ্চশিক্ষা-উচ্চশিক্ষা করছি। এর মানে কী? দেশ কোন দিকে যাচ্ছে বলতে পারবে? কেন পারবে না? তুমি শিক্ষিত মানুষ না? তুমি না পারলে কে পারবে? আসলে কেউ জানে না। জোর করে একটা কিছু বিশ্বাস করে সবাই কাজ চালাচ্ছে। কাজ চালাতে হয়।’
ইমরান কেমন আছে? অনেকদিন তার খোঁজ নেই না। ফোনটা টেবিলে রাখা। মাকে বললাম ফোনটা দিতে।
: আজ কি বার মা?
: রবিবার।
আমি যখন স্কুলে পড়ি। এমনকি কলেজে পড়ার সময়ও। মাকে যদি জিজ্ঞাসা করতাম, মা আজ কী বার। মা উত্তর দিত আজ সারাদিন অমুকবার। আমার অসুস্থতার খবরে ইমরান দুঃখিত। তার নাকি খুব ইচ্ছা করতেছে আমার শিয়রের পাশে বসে থাকতে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। মাথায় পানি দিয়ে দিতে। বিভাস জানতে চেয়েছে, কেমন আছি। জীবনে নাকি অসুস্থ হওয়ারও প্রয়োজন আছে। লিখেছে — If you desire healing, let yourself fall ill। বলে, তার কথা নয়। রুমির কথা।
মানুষগুলোকে কত আপন মনে হয় আমার। অথচ এরা আমার কেউ না। অথচ এদের ঘিরেই আমি। আমার জীবন। এরা আমাকে সঙ্গ দেয়। এরা আমাকে চায়। আমাকে আশ্রয় করেই কর্ম সম্পাদন করবে এরা। শোভন আমাকে তছনছ করবে। বিভাস আমাকে দেবে গুছিয়ে। ইমরান আমাকে সঙ্গ দেবে। আমার জন্যে অপেক্ষা করছে সে। আমরা সবাই কি অপেক্ষা করছি না? কোনো না কোনো কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছি না? অপেক্ষাই কি জীবন নয়?
বিভাস বলেছিলো। একসময় সব পূর্ণ মনে হতো তার কাছে। জীবনকে সে পাত্তাই দেয়নি। পতিতালয়ে মানিব্যাগ রেখে দিয়েছিলো তার। সেই মানিব্যাগে ছিল তার ভোটার আইডি, এক্সট্রা সিমকার্ড। পেছনে ফিরে যায়নি সে। পেছনে ফিরতে সে শেখেনি। কিন্তু পেছনে তাকে ফিরতে হয়েছিলো। পেছনে ফিরতে হয়। প্রতিটি হিসাব তাকে চুকিয়ে আসতে হয়েছিলো। তাকে শোধ করতে হয়েছিলো অতীতের প্রতিটি দেনা। হারাতে হয়েছে জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। মাকে। বলেছিল, ‘জীবনের সঙ্গে আমি দাবা খেলতে শুরুই করেছিলাম মন্ত্রীবিহীন কোর্টে। খেলার মাঝপথে গিয়ে দেখলাম, এই খেলায় কোনো জয়-পরাজয় নেই। নেই কোনো প্রতিপক্ষ। নিজের সঙ্গেই নিজের খেলা।’ ইমরানের মধ্যে বিভাস তার দুলাভাইয়ের ছায়া খুঁজে পায়। মো. সাদিক হোসেন। মুরারিচাঁদ কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক। বিভাস ডাকে, সাদিক ভাই। সাদিক ভাই আর শিপ্রা আপুই তার বর্তমান অভিভাবক। বাসা বলতে বিভাস এখন সিলেটকেই বোঝায়। টিলাগড়। তাদের অরিজিনাল বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর। বিভাসের ভাষায়, ইমরান আরেক পিস সাদিক ভাই হয়ে উঠছে।
বিভাস কেমন আরামদায়ক। সবকিছুরই একটা আরামদায়ক ব্যাখ্যা তার কাছে রেডি। কিন্তু জীবন কি সত্যিই এত আরামদায়ক? আমি বুঝতে পারি না। ইমরান আবার ঠিক উল্টা। তার সঙ্গে কথা বললেই মনে হয়, দেশে যুদ্ধ লেগে আছে। আমাদের উচিত সব ছেড়ে ছুঁড়ে কালকেই যুদ্ধে চলে যাওয়া উচিত। ইমরানকে লিখলাম, তোমাকে মিস করছি, ইমরান। পরে এডিট করে লিখলাম, ‘তোমাদের মিস করছি, ইমরান। অবস্থা আগের মতই। তবে ভালোর দিকে।’ বিভাসকেও তাই লিখলাম।
এমডি স্যারকে বাবা ফোন করেছিলো। আমার অসুস্থতার খবর দিয়েছে। স্যার বলেছেন, তিনি জানেন বিষয়টা। দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে আর কোনো বিষয়ে দুশ্চিন্তা না-করতে। বিশ্রামেই আছি। শুয়ে থাকা আর বাথরুমে যাওয়া ছাড়া আপাতত আর কোনো কাজ নেই আমার। এরমধ্যে নতুন একটা উপলব্ধি হয়েছে আমার। বিছানা আর বাথরুম খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এগুলো সুন্দর হওয়া জরুরি। বাথরুম হওয়া উচিত বিশাল। বড় একটা রুমের মত। সেই তুলনায় আমাদের বাথরুমটা বেশ ছোটো। ভবিষ্যতে যদি নিজের একটা বাসা হয় বাথরুমগুলোকে বড়সড় করে বানাতে হবে। ভেতরে থাকবে লেবুর সুগন্ধি। চমৎকার। ভাবতেই ভালো লাগছে।
মানুষজনের আদিখ্যেতা খুব বিরক্ত লাগে। আরে বাবা সব কিছুই ফেসবুকে জানান দিয়ে করতে হবে নাকি! এই আমি অসুস্থ, এটাও কি ফেসবুকে দিতে হবে! লিখতে হবে — I am sick. Please, keep me in your prayer!
তনু নামের একটি মেয়ের ডেডবডি পাওয়া গেছে। টিউশনিতে গিয়েছিল পরে আর ফেরেনি। ফেসবুকে অনেকে নিউজ শেয়ার করেছে। হিজাব পরা মার্জিত একটা মেয়ে। আমাদের মতই মধ্যবিত্ত পরিবার। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। বহু মানুষ জমায়েত হয়েছে। বিচারের দাবিতে আন্দোলন চলছে। ভালো লাগে না। এক পক্ষ সরকারকে দুষছে। বিচার ব্যবস্থাকে দুষছে। আগে কোন কোন হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি, সেই সবের লম্বা ফিরিস্তি দিচ্ছে। কেউ কেউ লিখেছে, এখানে সরকারের কী করার আছে! উন্নত দেশেরও কী অপরাধ হয় না! অপরাধ সব দেশেই হয়। বিচার হয় না কে বলেছে। বিচার ঠিকই হয়। জনগণ অপরাধের খোঁজ যে পরিমাণ রাখে, বিচারের খোঁজ তেমন রাখে না। যত আগ্রহ নিয়ে অপরাধের খবর পড়ে, বিচারের খবর কয়জন পড়ে। কয়জন আলাপ করে! কথা অবশ্য ঠিক। যথারীতি লম্বা ও জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস দিয়েছে ইমরান। ভালো লিখেছে সে। তনু হত্যাকাণ্ড নিয়ে লিখলেও ফোকাস করেছে : রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক, আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার রাজনীতিকরণ নিয়ে।
চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলেই ভালো লাগে। ফোনের আলোতে চোখ ব্যথা করছে। ফেসবুকেও ভালো লাগে না। কিন্তু না ঢুকে থাকতে পারি না। দাঁতের ব্যথার মত চিনচিনে একটা হতাশা ও ভয় কাজ করছে। ধরলাম, সবার কথাই ঠিক। যার যার অবস্থান থেকে সবাই ঠিক কথাটাই বলছে। কিন্তু জঙ্গলে পড়ে থাকা মেয়েটার লাশটা তো সঠিক হতে পারে না।
সারা রাত আমার ঘুম হলো না। তনুর ঘটনাটাই চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। মনে হলো, কি অসভ্য একটা জাতি আমরা। জীবনের সকল কুৎসিৎ দিকগুলো উন্মুক্ত হয়ে গেলো আমার সামনে। রাতভর ভেঙচি কাটলো আমাকে। আতঙ্কিত করলো। একফোঁটা ঘুমাতে দিলো না। অনেকেই লিখেছে, হত্যার আগে রেইপ করা হয়েছে। রেইপ যে কী ভয়ংকর ঘুরে ফিরে এই চিন্তাটাই মাথায় আসলো। মনে হলো, এরচেয়ে কেটে পানিতে ভাসিয়ে দিলেও ভালো। অশান্তি আমার পিছু ছাড়লো না। তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে হলো সারা রাত। ইমরানের মতামত তো তার পোস্টেই জানা গেলো। এ-ব্যাপারে বিভাসের কী বক্তব্য হতে পারে? খুব জানার আগ্রহ হলো।
পড়ুন ।। কিস্তি : ২১