বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য ।। কিস্তি : ৭

গীতা দাস একজন সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মী। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকায় তার কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ছোটগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখবেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে। আজ প্রকাশিত হলো কিস্তি ৭

 মারমা নৃগোষ্ঠীর কথাসাহিত্য

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ছাড়াও এগারোটি নৃগোষ্ঠীর বসবাস রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তিতে এ এগারটি নৃগোষ্ঠীর উল্লেখ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ মোট ২২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত। তন্মধ্যে উপজাতীয়  (শান্তিচুক্তিতে উপজাতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে) ১২ জন পুরুষ সদস্য। প্রতীয়মান হয় যে, নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যার অনুপাত বিবেচনা করে জেলা পরিষদের পুরুষ সদস্যদের প্রতিনিধিত্ব করার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। “পুরুষ সদস্যের মধ্যে ৫ জন নির্বাচিত হইবেন চাকমা উপজাতি হইতে, ৩ জন মার্মা উপজাতি হইতে, ২ জন ত্রিপুরা উপজাতি হইতে, ১ জন মুরং ও তনচৈঙ্গ্যা উপজাতি হইতে এবং ১ জন লুসাই, বোম, পাংখো, খুমী চাক, খিয়াং উপজাতি হইতে।”[i] নৃগোষ্ঠীদের জনসংখ্যার অনুপাতে ক্ষমতার এ বলয় বিবেচনা করে চাকমা নৃগোষ্ঠীর পর মারমা নৃগোষ্ঠীর বাংলা দ্বিতীয় ভাষায় রচিত কথাসাহিত্য নিয়ে আলোচনার পরিকল্পনা করা হয়। তবে জনসংখ্যার অনুপাত এবং ক্ষমতা কাঠামোতে অবস্থানের সঙ্গে শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, এক কথায় সংস্কৃতিগতভাবে অগ্রসরতার বিষয়টিকে সাংঘর্ষিক বা সমর্থিত কোনভাবেই বিবেচনা করা হচ্ছে না।

 

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যেকটি নৃগোষ্ঠী নিজেদের স্বতন্ত্র, স্বকীয় ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলে দাবি করে তা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অবধারিতভাবেই সাহিত্য সৃষ্টি একটি। যেকোনো জাতি বা নৃগোষ্ঠীর মধ্য ছন্দোবদ্ধ কাব্য সৃষ্টির মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা শুরু করা একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বাংলা ভাষার মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমাসহ অন্যান্য নৃগোষ্ঠীদের ভাষায়ও এর ব্যতিক্রম নয়; তবে মারমাদের কাব্য ও প্রবন্ধ রচনার মতো যুগপৎভাবে কথাসাহিত্যের উন্মেষ ঘটেনি।

 

মারমাদের বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য পর্যালোচনায় প্রবন্ধ, কবিতা, রূপকথা, লোক সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার রচনা প্রকাশের বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন সাহিত্য সংকলনসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংকলনে কিছু ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টেস কাউন্সিলের বিভিন্ন শাখা কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত চেদনা, মো লাং নিং, পাইং অমুঙ, আখিং চাগাহ ইত্যাদি সংকলনে কোনো কোনো লেখকের দুয়েকটা গল্প রয়েছে। কিন্তু মারমা নৃগোষ্ঠীর রচিত মারমা বা বাংলা ভাষায় কোনো ছোটগল্পের বই এবং উপন্যাসের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমন কি কোনো একজন লেখকের সন্ধান পাওয়া যায়নি যিনি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সংকলন বা পত্র পত্রিকায় কথাসাহিত্য চর্চা করেছেন বা করছেন। এ বিষয়টি ভবিষ্যত অনুসন্ধানকারীর জন্য সংরক্ষিত রইলো।

 

মারমা ও রাখাইন সংশয়াতীতভাবে আলাদা জাতিসত্তা হলেও মারমা কথাসাহিত্যের বই অনুসন্ধান করতে গিয়ে এ দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে নাম বিভ্রাটজনিত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ভবিষ্যতে এ নিয়ে কোন অনুসন্ধাকারীর বিভ্রান্তি দূর করতে শ্রম, মেধা ও সময় সাশ্রয় করার জন্য বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক। মারমাভাষীদের রচিত মাতৃভাষায় বা বাংলা ভাষায় কথাসাহিত্যের কোন বইয়ের অস্তিত্ব নেই বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পর মং চান সুইম্যা নামে একজন লেখকের নাম এবং তাঁর রচিত সবুজ দেবী নামে একটি উপন্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। ২০০৮ সালে প্রকাশিত এ বইয়ের লেখক ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। বান্দরবানের সাংবাদিক উসিথোয়াই মারমার মাধ্যমে বইটি সংগ্রহ করা হয়। এরপর নতুন প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে — মং চান সুইম্যা মারমা না রাখাইন? শুরু হলো আরেক অনুসন্ধান। ফলাফল পাওয়া গেল — উনি রাখাইন নৃগোষ্ঠীর, উনার পরিবার বান্দরবানে বসবাস করলেও আদিনিবাস পটুয়াখালী। উপন্যাসের বিষয়বস্তু হলো — নায়কের প্রেমিকার পরিবার মায়নমারে উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করে। পরে নায়কের মায়ানমারের কোনো এক গহিন বন থেকে পান্না সংগ্রহের দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনি ও নায়ক ধন সম্পদের মালিক হয়ে মায়ানমার থেকে প্রেমিকাকে নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে পটুয়াখালীর খেপুপাড়া রওনা দেয়।

 

এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, চাকমা রাজপরিবারের সদস্যরা নিজেরা বাংলা সাহিত্য চর্চা করতেন এবং এ চর্চাকে সমৃদ্ধ  করতে পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বোমাং ও মং রাজ পরিবারের  মারমা বা বাংলায় সাহিত্যচর্চার বা পৃষ্ঠপোষকতার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, মারমা উন্নয়ন সংসদের সহযোগিতায় অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী এবং উ ক্য জেন এর যৌথভাবে রচিত মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি বইটি প্রকাশিত হলেও সাহিত্য চর্চা নিয়ে তাদের কোনো পদক্ষেপের উদাহরণ পাওয়া যায়নি।

 

সুতরাং, মারমা নৃগোষ্ঠীর কথাসাহিত্য চর্চায় উল্লেখ করার মতো কোনো উদাহরণ পাওয়া যায়নি বলে অনুসন্ধানের গতিপথ পরিবর্তন করা হয়; তাঁদের কথাসাহিত্য চর্চায় অনগ্রসরতার কারণ অনুসন্ধানের জন্য বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেন মারমা নৃগোষ্ঠীর এমন কয়েকজনের  সঙ্গে কথোপকথন ও আলোচনা করা হয়। আলোচনার মূল বিষয় ছিল মারমাদের মাতৃভাষায় বা বাংলা ভাষায় কথাসাহিত্যে চর্চা।

 

উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক ঞ্যোহ্লা মং ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে,  জনসংখ্যার বিচারে মারমারা পাহাড়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হলেও লেখালেখি আর গবেষণায় উল্লেখ করার মতো অবদান রাখছেন তেমনটি বলতে পারি না। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে (নাচ, গান-বাজনা) কিছু দৃশ্যমান কার্যক্রম দেখা গেলেও সৃজনশীল সাহিত্যকর্মে তাদের সম্পৃক্ততা নগণ্য। জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলসমূহে মারমা কর্মী ও নেতা থাকলেও সামাজিক নেতৃত্বে শূন্যতা লক্ষ্যণীয়। দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাবে মারমাদের সাহিত্য, বিশেষ করে কথাসাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ ঘটেনি। তাছাড়া, মং রাজ পরিবার মারমা জনগোষ্ঠীর সাহিত্য চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করা তো দূরের কথা মারমা জনগোষ্ঠীর সাধারণ লোকজনের লেখাপড়া শেখার বিরোধিতা করার অনেক নেতিবাচক উদাহরণ রয়েছে। একটা জনগোষ্ঠীর মানসিক বিকাশে যে সাহিত্য চর্চা প্রয়োজন, মারমাদের মধ্যে আগে এ বোধ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমাসহ অন্যান্য সকল জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনযাপনে কালজয়ী সাহিত্য রচনা করার মতো অনেক অনেক উপাদান বিদ্যমান। কিন্তু মারমা জনগোষ্ঠী লেখাপড়া করে জীবিকার জন্য। পাঠ্যবইয়ের বাইরে তাদের অন্য কোনো পাঠাভ্যাস নেই। সাহিত্যচর্চা করতে পাঠ্য বইয়ের বাইরে সাহিত্য বিষয়ক বই পড়া ও সাহিত্যচর্চার জন্য পরিকল্পনা ও সুযোগ সৃষ্টি করা আবশ্যক।

 

মারমা জনগোষ্ঠীর লেখক মংক্য শোয়েনু নেভীর মন্তব্য হলো, মারমা নৃগোষ্ঠীর কথাসাহিত্য চর্চায় অনগ্রসরতার কারণ বহুবিধ। প্রথমত, মারমা সমাজে আধুনিক শিক্ষার বিস্তৃতি না ঘটানো অর্থাৎ পড়তে ও লিখতে জানা শিক্ষার হার কম; দ্বিতীয়ত, মারমা ভাষার বর্ণমালার কোন মুদ্রণ ব্যবস্থা না থাকায় কিছু গান, বন্দনা গাঁথা, স্মারক পত্র হস্তলিখিত কপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ; তৃতীয়ত, সমাজে অধিকাংশ লোক পাড়া গাঁয়ের কৃষিজীবী হওয়ায় তাদের যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-আবেদন, মনের সুকুমার প্রবৃত্তি সবই আচরিত অনুষ্ঠানে কিংবা জুম ক্ষেতে কর্মের ফাঁকে ফাঁকে কাপ্যা গানের সুরে প্রকাশ এবং বিকাশ; চতুর্থত, তাদের মনে সুপ্ত অনুভূতির স্পন্দন আকুতি ছন্দ শুধু মুখের ভাষায় একে অপরের কাছে বিনিময় বা  আদান প্রদান হয়েছে। কিন্তু এসব কালের চেতনা-উৎসারী হিসেবে আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধির অভাবে হয়তো নিজেদের ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হয়ে ওঠেনি।

 

মারমা নৃগোষ্ঠীর তরুণ প্রজন্মের সাহিত্য চর্চায় অং মারমা ইতোমধ্যে একটি পরিচিত নাম। তিনি ওয়েথু নামে একটি মারমা লোকগল্প সংকলন সম্পাদনা করেছেন এবং চাকমা, গারো ও মণিপুরি প্রান্তিক আরও তিন তরুণ কবির সঙ্গে যৌথভাবে সমকালীন কবিতার বই প্রান্তিক স্বর  প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, মারমা ভাষায় দক্ষতা অর্জনে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মতো কোন বৈষয়িক মূল্য নেই। তাছাড়া, মারমাদের মধ্যে মারমা এবং বাংলা দুটো ভাষাতেই দক্ষতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং এজন্য কথাসাহিত্য চর্চায় আগ্রহী নয়। এ বিষয়ে অং মারমা তাঁদের কথাসাহিত্য বিকাশের আগে পুরানো মৌখিক সাহিত্যকে লিখিত রূপে আনা, পাঠ্যবইয়ে অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর সাথে মারমা রূপকথা অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন।

তাঁদের মনোজগত এখনও জীবনধর্মী কথাসাহিত্য সৃষ্টির জন্য পরিপক্ব নয়; আধুনিক ছোটগল্প বা উপন্যাস লেখার জন্য জাতিগতভাবে প্রস্তুতি প্রয়োজন এবং মাতৃভাষা বা দ্বিতীয় ভাষায় পরিণত জ্ঞান ও সৃজনশীল দক্ষতা আবশ্যক।

মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি বইয়ের যৌথ গবেষকের একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী্র মতামত হলো, একটা সময়ে বৌদ্ধ বিহারগুলোতে গ্রামের শিশুদের বাল্যশিক্ষার আদলে মারমা ভাষায় শিশু পাঠ্যবই পড়ানো হতো। ঐ লেখাপড়ায় মাতৃভাষায় কথাসাহিত্য চর্চা করা যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জন হয় না। আর মারমা ভাষায় লেখাপড়া করা কোন অর্থকরী বিদ্যার্জন নয়। আর মারমা জনগোষ্ঠীর বাংলা ভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেছে ১৯৬০ সালের দিকে। তাও সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা। তারা জীবিকার জন্য লেখাপড়া শিখেছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বাংলা ভাষায় গ্রহণ করলেও মারমা জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, সামাজিক ভাষা মারমা। তাদের চিন্তা, চেতনা, ভাবনা, স্বপ্ন দেখা — অর্থাৎ সমগ্র সত্তায় মিশে আছে মাতৃভাষা। উপরন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আবার লেখাপড়ায় একটা বিপর্যয় নেমে আসে। তখন পঙ্গু প্রজন্ম সৃষ্টি হয়েছে। এতো প্রতিবন্ধকতায় সাহিত্য সৃষ্টি বা সৃজনশীল কর্মকাণ্ড সম্ভব হয়নি।

 

মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি বইয়ের যৌথ গবেষকের আরেকজন বাংলাদেশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব উ ক্য জেন মনে করেন, পী পাতায়, তালপাতায় ও হলুদ রঙ করা এক ধরনের  বিশেষ কাগজে মারমা জনগোষ্ঠীর হাতের লেখা লোকসাহিত্যের অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভান্ডার রয়েছে। কিন্তু মারমারা তাদের মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে লেখালেখিতে ব্যাঘাত ঘটে। বিশেষ করে আদিবাসীদের মাতৃভাষা শিক্ষার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিচারে গুরুত্ব কমে যাওয়ায়  এ ভাষা শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চা কমতে থাকে।  মারমা জনগোষ্ঠী ষাটের দশক থেকে বাংলা ভাষায় শিক্ষার জগতে প্রবেশ করে এবং বাংলাভাষা শিখতে গিয়েও মাতৃভাষার চর্চা কমতে থাকে। মাতৃভাষার চর্চা ব্যতিরেকে নিজের ও আরেকটি ভাষায় সৃজনশীল সাহিত্যচর্চা করা সম্ভব নয়। কাজেই  মারমা জনগোষ্ঠীর কথাসাহিত্য সৃষ্টির জন্য মাতৃভাষা ও বাংলা উভয় ভাষা উত্তমরূপে আত্মস্থ করা প্রয়োজন।

 

মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করার সময় মারমা নৃগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করে এমন বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথোপকথনে অনুসন্ধানকারীর এটা মনে হয়েছে যে, তাঁরা নিজেদের সৃষ্ট সাহিত্য বলতে কবিতা, লোকগাঁথা ও রূপকথা বুঝে থাকে। তাঁদের মনোজগত এখনও জীবনধর্মী কথাসাহিত্য সৃষ্টির জন্য পরিপক্ব নয়; আধুনিক ছোটগল্প বা উপন্যাস লেখার জন্য জাতিগতভাবে প্রস্তুতি প্রয়োজন এবং মাতৃভাষা বা দ্বিতীয় ভাষায় পরিণত জ্ঞান ও সৃজনশীল দক্ষতা আবশ্যক। সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে মানসিক দিক থেকে তারা মাং (রাজা), ফুলু (রাক্ষস), ফুলুমা (রাক্ষসী), খোব্রোক (কুনোব্যাঙ), ফা (ব্যাঙ) ইত্যাদি নিয়ে রূপকথার জগতে বসবাস করে। Fantasy Literature সৃষ্টির ক্ষেত্র থেকে সৃজনশীল জীবনধর্মী সাহিত্য জগতের চৌকাঠে পা রাখার কোন উদ্যোগ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক বলয়ে নিজেদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বাস্তবতার চিত্রণ কথাসাহিত্যে চিরন্তন করে রাখার মতো কোনো ভাবনাই মারমা নৃগোষ্ঠীর চেতনায় আলোড়ন তুলে না। অথচ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকট থেকে উত্তরণের একটি কার্যকরী মাধ্যম হলো সাংস্কৃতিক চর্চা; যার মূল উপাদান সাহিত্যচর্চা।

 

অধিকন্তু মারমা নৃগোষ্ঠীর পিতৃভূমি মায়ানমার এবং ঐ দেশে রচিত সাহিতচর্চায় নিজেদের মনোজগতের নৈকট্য খোঁজে; নিজেদের মাতৃভাষায় বা বাংলায় কথাসাহিত্য রচনার সীমাবদ্ধতাকে বাংলা ভাষার আগ্রাসন বলে সান্ত্বনার আশ্রয় নেয়। কিন্তু কোনো নৃগোষ্ঠীর ভাষার স্বীকৃতির সাথে সাহিত্যচর্চার বিষয়টি যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তা অনুধাবন করা প্রয়োজন।

 

মারমা নৃগোষ্ঠীর অনেকেই লেখাপড়া শিখে ব্যক্তিগতপর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক। নিজেরা অর্থনৈতিক উন্নতির বলয়ে আবর্তিত এবং তারা ‘সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’ জাতীয় অবস্থায় ভাসমান; নিজ পেশা বা চাকরি অথবা ব্যবসায়িক কিংবা রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনস্রোতে বিলীন হয়ে বসবাস করতে অভ্যস্ত। সমষ্টিগত উন্নয়ন বা নিজের সমাজ ও জাতিসত্তার পরিচয় নিয়ে ভাবিত নয় এবং মারমা নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে কোনো বিশেষ সাংস্কৃতিক পরিচিতি সৃষ্টিতে নিষ্ঠার অভাব প্রতীয়মান হয়েছে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তারিক মনজুর ‘ভাষার মৃত্যুকে মেনে নিন’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ভাষার প্রয়োগকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে ভাষাকেও বাঁচিয়ে রাখা যায় না। কোনো ভাষার যদি দীর্ঘ চলার ইতিহাস থাকে, তবে ভাষার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরও অনেক কিছুর অবসান হয়। যেমন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ওই ভাষার জাতিগত ও ঐতিহ্যগত জ্ঞানেরও পরিসমাপ্তি ঘটবে। তবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাভ নেই।’[ii] ভাষার প্রয়োগের মাধ্যমেই কোনো নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তাকে টিকিয়ে রাখতে, নিজের অস্তিত্বকে প্রকাশমান দেখাতে সাহিত্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম; বিশেষ করে কথাসাহিত্য; ভাষাকে জীবন্ত রাখতে সাহিত্যচর্চার বিকল্প নেই।

 

মারমা নৃগোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের এ বিষয়ে মনোনিবেশ করা ও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব প্রয়োজনীয়। পদক্ষেপের পর্যায় হলো — প্রথমত, কথাসাহিত্য সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করা; দ্বিতীয়ত্ব, সাহিত্য চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিজেদের মধ্যে দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা; তৃতীয়ত, দায়িত্ববোধ থেকে সাহিত্য অধ্যয়ন ও চর্চার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা; চতুর্থত, সচেতনা থেকে সক্ষমতা অর্জনের জন্য পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করা। এভাবে সাহিত্য অধ্যয়ন ও চর্চা ব্যক্তির সুকুমার বৃত্তি জাগ্রত করতে সাহিত্য পঠন-পাঠন  অব্যাহত রাখা এবং নিজেদের ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে ও সমৃদ্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করা।

 

উল্লিখিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মারমা নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও বাংলায় কথাসাহিত্য সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি বিশেষ অভিযান। মারমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সৃষ্টিশীলতায় সম্পৃক্ত করতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

 

সূত্র ও টীকা

[i] (গ) পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ / ৩ । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সহিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির স্বাক্ষরিত চুক্তি। ২ ডিসেম্বর, ১৯৯৭ ।

[ii] তারিক মনজুর, “ভাষার মৃত্যুকে মেনে নিন”, সহজিয়া, ওয়েব ম্যাগাজিন, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১। লিংক: https://shahojia.com/2021/02/06/

 

পড়ুন ।। কিস্তি ৬

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য ।। কিস্তি : ৬

1 COMMENT

  1. মন্তব্যের কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না। অনেক অনেক ভেবেও পেলাম না। গবেষককে ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here