আমার বেশ কিছু বছরের সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা এবং কয়েক বছরের সাহিত্য পড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় আমি নিশ্চিত বুঝেছি যে, কাকে সফল কবিতা বলে এবং তা নির্ণয়ের পদ্ধতি কী, এর চেয়ে দুরূহ প্রশ্ন সাহিত্য মূল্যায়নের জগতে আর হয় না। সাধারণত কবিতার সফলতা বিষয়ক যে আলাপ হয়, তা খুবই বায়বীয়। সম্ভবত বিষয়টি বায়বীয় হিসেবেই আমরা ধরে নিয়েছি। কিন্তু অন্তত কিছু দৃশ্যমান মানদণ্ড না থাকলে এই বিষয়ে কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্তেই আমরা পৌঁছাব না বা পৌঁছাই না। জীবনানন্দ দাশ কেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি, তা অবশ্যই আমাদের বলতে পারতে হবে। তা না হলে যেকোনো কবি যদি নিজেকে জীবনানন্দের সমান বলে দাবি করে, তাহলে তা আমাদের মেনে নেয়া ব্যতীত উপায় থাকবে না। অথবা সে তর্কের কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান সম্ভব হবে না।
কবিতার মূল্য নির্ণয় করতে আমরা বাধ্য। আর এই বাধ্যবাধকতা কেবল বায়বীয়তার উপর নির্ভর করতে পারে না। এর মানে অবশ্য এমন নয় যে, কবিতাকে পদার্থ বিজ্ঞানের কোনো সূত্র বা সিদ্ধান্তের মতো মূল্যায়ন করা সম্ভব। পদার্থ এবং কবিতা খুবই ভিন্ন শ্রেণির দুইটি বিষয়। কিন্তু যৌক্তিক মূল্যায়ন সম্ভব উভয়েরই।
কবিতা মূল্যায়নের পথে প্রথম বাধা হচ্ছে কবিতা কী জিনিস — এই বিষয়ে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারা। আসলে কবিদের সৃষ্টিশীলতা এ ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। যে জীবনানন্দ দাশ বললেন, ‘উপমা-ই কবিত্ব’, সেই জীবনানন্দই যখন লিখলেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতাটি, তখন সে কবিতায় একটাও উপমা ব্যবহার করলেন না এবং তা কবিতা হয়ে উঠল। হাংরি জেনারেশনের কবিরা নানান উদ্ভাবনা চালিয়ে দেখালেন, যাকে কবিতার আবশ্যিক শর্ত ভাবা হয়, তা মোটেও আবশ্যিক শর্ত নয়। সেসব ছাড়াও কবিতা হয়। ‘প্রতিকবিতা’ হিসেবেও অনেক কবিতা লেখা হয়েছে কবিতার প্রচলিত শর্তসমূহ প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে এবং তাকে আমরা শেষ পর্যন্ত কবিতা হিসেবেই চিহ্নিত করি। ফলে কবিদের সৃষ্টিশীলতাকে অনুসরণ করে কবিতার সংজ্ঞায়নের স্থিতিস্থাপকতা প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে নিতে হয়। কবিদের সৃষ্টিশীলতা যেমন কবিতার সংজ্ঞায়নের স্থিতিস্থাপকতার উপর চাপ ফেলে, তেমনই চাপ ফেলে ভাষার সীমার উপর। অভাবিত শব্দজোড়, অভাবিত ধারণা, বিপর্যয় সৃষ্টিকারী অনুভূতি, অনন্য দোলা, শব্দের গঠনগত পরিবর্তন — এই সবই ভাষার সীমানায় চাপ সৃষ্টি করে। ভাষার সীমানাকে প্রসারিত করে।
আমি এই অসুবিধাগুলো মাথায় রেখে কবিতার তুল্যমূল্য নির্ণয়ে আরেকটি পদ্ধতি প্রস্তাবে আগ্রহী। আমি মনে করি কবিতার মূল্য নির্ভর করে কবিতার ভাষার দখল করার ক্ষমতার উপর।
ভাষার সীমানা কবিরা কীভাবে সম্প্রসারিত করেন সেটাও একটা দারুণ কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়। রবীন্দ্রনাথ তার গানে/ কবিতায় শব্দের অজস্র পরিবর্তন করেছেন। ‘হরণ করা’ হয়ে গেছে ‘হরি’, ‘ভাবিয়াছিলাম’ হয়ে গেছে ‘ভেবেছিনু’, ‘দহিত হওয়া’ হয়ে গেছে ‘দহি’। রবীন্দ্রনাথ ক্রিয়াপদকে হরহামেশা ভিন্ন ভিন্ন আকৃতি দিয়েছেন। মূলত সংক্ষেপন বা সংকোচন করেছেন। এমনভাবে পরিবর্তন করেছেন, যা ভাষার সামগ্রিক অনুমোদনের বাইরে যায়নি। আবার প্রচলিতের ভেতরেও আটকে থাকেনি।
আসলে এটাই হচ্ছে কবির সৃষ্টিশীলতা ও ভাষায় তার অবদান। রবীন্দ্রনাথ অভিনব ব্যবহার করেছেন ‘বারেক’ ও ‘বকপাতি’ শব্দদ্বয়ের। শুভাশিস সিনহা সমাসনিষ্পন্ন করেছেন আপাত অসম্ভব কিছু শব্দের, যেমন : ‘মায়াচিড়াধান’। জীবনানন্দ দাশ অজস্র শব্দের পরিবর্তন করে নিজস্ব সুর তৈরি করেছেন, যেমন : ‘ঘুমিয়েছে’ জীবনানন্দীয় সুরে হয়ে গেছে ‘ঘুমায়েছে’। তাহলে কবিতা হচ্ছে ভাষার এক ধরনের অনুমোদন-ক্ষেত্র, যেখানে ভাষার সৃষ্টিশীল পরিবর্তনকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত না করে বরং স্বাগত জানানো হয়।
কবিতার এমন পরিবর্তনশীল চেহারায় একে চিহ্নিত বা সংজ্ঞায়িত করা কঠিন হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এরপরও সব কবিতারই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থেকেই যায়, যার ভিত্তিতে আমরা কোন লেখাকে কবিতা বলে চিহ্নিত করে উঠতে পারি। যেকোনো কবিতাই আসলে কোনো-না-কোন অর্থ প্রকাশ করে। একটা কবিতা কাগজে কবিতা হয়ে ওঠে না৷ একটা কবিতা শেষ পর্যন্ত কবিতা হয়ে ওঠে পাঠকের প্রতিক্রিয়ায়। অর্থাৎ পাঠকের মন হল ঐ প্রতিবেশ, যেখানে একটা লেখা কবিতা হিসেবে স্বীকৃত বা অস্বীকৃত হয়।
যেকোনো কবিতার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল : ভাষার সংক্ষেপণ। যেকোনেরা বাচাল কবিতাও ঐ বিষয়ে (কবিতাটি যে বিষয়ে লিখিত) অন্য কোনো মাধ্যমে বলা কথার চেয়ে লক্ষ্যনীয়ভাবে কম কথার সমষ্টি। কবিতার ভেতরে তাই স্বাভাবিকভাবেই বহু ভাঁজ থাকে, যা ব্যাখ্যার মাধ্যমে বা অভিজ্ঞতার সহযোগে খুলতে হয়। অনেকেই এই বাড়তি শ্রমের কারণে কবিতা পড়তে অনাগ্রহী হন এবং অনেকেই এই শ্রমটাকে ভালবেসেই কবিতা পড়েন।
বিষয়টা আসলে কেবল বাড়তি শ্রমের প্রতি অনুরাগ নয়। কবিতার পাঠপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত এই শ্রম পাঠককে একটা ‘অনন্য অভিজ্ঞতার’ (unique experience) মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। যা কেবল এবং কেবলমাত্র ঐ কবিতা-ই সুযোগ করে দেয়।
উৎপলকুমার বসুর কবিতার একটা চরণ এমন, ‘মরে গেলে হবে? তারও পরে খরচাপাতি আছে।’ এখন যিনি কবিতাটি পড়ছেন, তিনি যদি অর্থের প্রাচুর্যে থাকেন তার কাছে কবিতাটা এক ধরনের অভিজ্ঞতার সুযোগ দেবে, আর যিনি অর্থের দরুণ কষ্টে আছেন তার কাছে আরেক ধরনের অভিজ্ঞতার সুযোগ দেবে। কবিতার ভাষা অনেকটা ফ্রি সাইজ পোশাকের মতো। পাঠক তার যাপিত অভিজ্ঞতার মাপ অনুযায়ী একে পরতে পারেন এবং একটা নতুন নিজস্ব অনন্য অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে পারেন। এখন প্রশ্ন হল এই অনন্য অভিজ্ঞতাই কবিতার মূল্য নির্ধারণ করে কিনা? যেহেতু অভিজ্ঞতাটা অনন্য, সেহেতু এর তুল্যমূল্য নির্ণয় অসম্ভবই হওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে কবিতার মূল্য কেবল অভিজ্ঞতার অনন্যতা দিয়ে নির্ণয় সম্ভব নয়।
কবিতার মূল্য নির্ণয়ে দুইটা পদ্ধতি বেশ বহুল ব্যবহৃত : একটা হল কবিতার উপস্থাপনা এবং আরেকটা হল সময়ের পরীক্ষা। কবিতার উপস্থাপনা বিচার পদ্ধতির মূল কথা হলো, যা বলা হয়েছে এবং যেভাবে বলা হয়েছে, তা সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। অর্থাৎ ঐ কথাটা আর অন্য যেকোনোভাবে বলার চেয়ে উত্তম হয়েছে কিনা। ভাব ও ভাষার উপযুক্ত সম্মিলন হয়েছে কিনা। কিন্তু এই সম্মিলন নির্ণয় অসম্ভব না হলেও খুবই দুরূহ কাজ। কারণ কবিতা পড়ার সময় এর অন্য আর কী কী উপস্থাপনা সম্ভব ছিল তা চিন্তা করা খুবই মুশকিল এবং বিশেষত অনন্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে।
গানের ক্ষেত্রে পুরো গানের বিভিন্ন অংশের সম্মিলন তবু ভাবা যায়। যেমন অনেক সময় পুরনো গান কেউ রিমেক করলে আমরা বুঝি রিমেক করা গানটা আদি গানের চেয়ে ভাল নাকি মন্দ হয়েছে। এর কারণ হল সুর ও মিউজিকের ভিন্ন সন্নিবেশ। কিন্তু কবিতার মুশকিল হল কবিতা কেবলমাত্র ভাষানির্ভর মাধ্যম। এর কোনো পরিবর্তন করতে চাইলে তাই ভাষা পালটাতে হবে। সেক্ষেত্রে কবিতাও পালটে যাবে কারণ ভাব ও ভাষা একটা সাদা পৃষ্ঠার দুই পিঠের মতো একটা আরেকটার সাথে অস্তিত্বগতভাবেই যুক্ত। তাই রিমেক গান সম্ভব হলেও রিমেক কবিতা সম্ভব হয় না।
এখন ভাব ও ভাষা যদি অস্তিত্বগতভাবে যুক্ত বিষয় হয় তাহলে আমরা উপযুক্ত সন্নিবেশ বলতে যা বুঝব তা হল থিম এবং স্টাইলের সন্নিবেশ। কিন্তু ফাঁদটা আবারও একই। সেক্ষেত্রে কবিতার মূল্য নির্ণয় করতে ঐ কবিতার বাইরে সম্ভাব্য কবিতাসমূহ কল্পনা করতে হবে। ফলে কবিতার মূল্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি খুব বেশি উপযোগী না। যদিও স্টাইল বিবেচনা কবিতার সামগ্রিক অনন্যতা চিহ্নায়নে একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
এবার আসি সময়ের পরীক্ষায়। সময়ের পরীক্ষা এক হিসেবে খুবই অব্যর্থ। কারণ মানুষ খুবই বিস্মৃতিপ্রবণ। প্রয়োজনীয় বিষয় মনে রাখতেই সে হিমশিম খায়। সেখানে অপ্রয়োজনীয় বিষয় মনে রাখার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আমাদের স্মৃতি সংরক্ষণের হিসেব এত সোজাও নয়। প্রেমিকার মুখ স্মৃতি ধরে না রেখে, ধরে রাখতে পারে তার হাতব্যাগের গায়ে লেগে থাকা কোনো ডিজাইন, যা তার নিতান্তই অপছন্দের ছিল। আমাদের স্মৃতি এমন অজস্র অমূল্যবান বিষয় ধরে রাখে। কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দ স্মৃতির সাথে জড়িত একটা বিষয়। স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ছন্দের ব্যবহার অনেক পুরনো কাল থেকেই প্রচলিত। প্রাচীন কালে উপদেশসমূহ এই কারণে ছন্দে গেঁথে দেয়া হতো।
এই ছন্দের কারণে কোনো কোনো লেখা সময়ের পরীক্ষায় উতরে যেতে পারে, কিন্তু সেই উতরানো লেখাকে কী আমরা শুধু সময় উতরে যাওয়ার কারণে ভাল লেখা বলব? আমার বক্তব্য হল, অনেক কারণেই অনেক লেখা সময় উতরে যেতে পারে। কিন্তু সময় উতরানো মানেই কালজয়ী নয়, অর্থাৎ শিল্পোত্তীর্ণ নয়। সিকদার আমিনুল হকের ‘শৈশব আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল প্রেমের দস্তানা’ কি বিহারীলাল বা গোলাম মোস্তফার চেয়ে দুর্বল কবিতা? ঠিক কত সময় গেলে আমরা কোন কবিতাকে সময় উতরানো কবিতা বলব? সময় উতরানো কিন্তু আরেকটা বিষয়ের সাথেও যুক্ত। সেটা হল বিষয় বা অনুভূতির সার্বজনীনতা। বিরহের মতো সার্বজনীন অনুভূতি সময় ও স্থানের বাধাকে যত সহজে অতিক্রম করে, রাজনৈতিক সংকটের অভিজ্ঞতা তত সহজে সময় ও স্থানের বাধা অতিক্রম করতে পারে না। কারণ রাজনৈতিক সংকটের ধরন অপেক্ষাকৃত দ্রুত পরিবর্তনশীল। সেক্ষেত্রে কবিতার বিষয়ও সময় উতরানোর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।
আমি এই অসুবিধাগুলো মাথায় রেখে কবিতার তুল্যমূল্য নির্ণয়ে আরেকটি পদ্ধতি প্রস্তাবে আগ্রহী। আমি মনে করি কবিতার মূল্য নির্ভর করে কবিতার ভাষার দখল করার ক্ষমতার উপর। কবিতা তো অনন্য অনুভূতি দেয়ই এবং পাঠককে ঐ সুযোগও দেয় যে সে তার যাপিত অভিজ্ঞতার সাথে মিশেল ঘটিয়েই সে অনন্য অভিজ্ঞতা নিজে তৈরি করে নেবে। এমনকি যাপিত অভিজ্ঞতা পাল্টালে সে একই কবিতার ভিন্ন অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে নিতে পারে। এই কারণে দশ বছর আগে পড়া একটা কবিতা দশ বছর পরে আরো ভিন্নতর অভিজ্ঞতা বা অর্থ নিয়ে হাজির হতে পারে। এখন প্রশ্ন হল কবিতার ভাষার দখলবাজি বলতে আমি কী বুঝাচ্ছি?
ধরা যাক, আমি নিজেকে একজন জটিল চিন্তায় অভ্যস্ত মানুষ হিসেবে কল্পনা করি। কিন্তু খুব একান্তে দেখতে পাই আসলে আমার চাওয়াসমূহ খুবই সরল। এই আপাত অন্তর্গত দ্বন্দ্ব যখন নিজের কোনো স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরিতে বাধা তৈরি করে, তখন যদি আমি এমন কোনো কবিতার লাইনের মুখোমুখি হই যে, ‘গভীর জলের মাছ বলে গালি দিও — আমি ভাসমান এক সরল পুঁটির জ্বর’, তাহলে এটা আমার পূর্বতন চিন্তাকে এই প্রকাশের সাথে একাত্ম করে। আমি বলি উঠি, হ্যাঁ এটাই আমি। কবিতায় প্রকাশিত অনুভূতি আমার ব্যক্তিগত প্রকাশের ক্ষেত্রকে দখল করে।
কখনো কখনো এমন হয় যে, কবিতায় যা পড়লাম, যে অভিজ্ঞতা জন্ম হল তার সাথে মিশেল ঘটানোর মতো অভিজ্ঞতা আমার নাই। সেক্ষেত্রে ঐ কবিতাই পরবর্তী সময়ে প্রাসঙ্গিক বাস্তবতা জন্ম দিতে পারে। যেমন : ‘ক্ষত সেরে গেলেই আবার বিব্রত হয়ে উঠি’ — এই লাইন পড়ার আগে ক্ষত সেরে বিব্রত হওয়ার কোনো অভিজ্ঞতা আমার ছিল না বা থাকলেও খুব অস্পষ্ট ছিল। বরং এই লাইন পড়ার পর আমার বেশ কয়েকবার ক্ষত সেরে উঠে বিব্রত হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে।
আসলে বড় অর্থে আমাদের ভাষার সীমায়ই আমাদের অভিজ্ঞতা নিয়ন্ত্রণ করে। অভিমান শব্দটি শিখি বলেই পরবর্তী কালে আমরা অভিমান করতে শিখি। প্রেমিকার প্রশংসায় খুব অল্প কিছু বাক্যই আমরা ঘুরেফিরে ব্যবহার করি। প্রেমিকাকে গোপন নামে ডাকতে যেয়ে আমরা সাধারণত ফুল, পাখি বা প্রকৃতির এমন কোনো অনুষঙ্গের নামই বেশি ব্যবহার করি। চরম ব্যক্তিক প্রকাশের সময়ও যে আমরা ভাষার দাসমাত্র — তা প্রায়ই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়; কারণ ভাষার অনুমোদিত সীমা ব্যাপক। যেখানে সম্ভাব্য অসীম সংখ্যক বিন্যাস ও সমাবেশ সম্ভব। কোনো একটা বিশেষ কবিতার ক্ষেত্রে ভাষার এই দখলকারী বৈশিষ্ট্য বেশ ভালভাবেই চোখে পড়ে।
আমরা যখন খবরের কাগজ পড়ি তখন ভাষার কোন অস্পষ্টতা থাকে না। কেবলমাত্র খবরটাই আমাদের মনে থাকে; কিন্তু কবিতায় ভাষা-সংগঠন বিশেষ। এই সংগঠন পাঠকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা বা সুযোগ রাখে। পাঠকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে মিশেলের মাধ্যমে অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরির প্রক্রিয়ায় কবিতার ভাষা অনেক সময় পাঠকের ব্যক্তিগত ভাষা ও অভিজ্ঞতাকে প্রতিস্থাপন করতে পারে৷ আমি এই প্রতিস্থাপনসক্ষম ভাষাকেই দখলকারী ভাষা বলতে চাই। প্রেম করতে গেলে মানুষ শখ করে তার দশা বর্ণনায় কবিতার ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু শক্তিশালী কবিতা পাঠকের নিজস্ব ভাষা উৎপাদনকে ঠেকিয়ে দিয়ে সেখানে কবিতার ভাষাকে প্রতিস্থাপিত করে।
একটা সফল কবিতা যে বিস্ময় ও আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে তা মূলত নিজেকে ঐ কবিতা দ্বারা দখল বা আক্রান্ত হতে দেয়ার আনন্দ। যে কবিতা যত বেশি দখলবাজ, সে কবিতা তত শক্তিশালী। উপন্যাস বা ভাবনাও আমাদের দখল করে কিন্তু কবিতা একটা বিশেষ ভাষিক দোলা তৈরি করে যা মনে রাখার জন্য বেশি উপযোগী। অন্যদিকে, কবিতা চিন্তার খুবই সংক্ষেপিত এবং ঘন রূপ বলে তা সবসময় সোজা ব্যাখ্যাযোগ্য নয়। ফলে কবিতার ভাষা প্রায় অটুট চেহারা নিয়ে আমাদের চিন্তা দখল করে। তাই কবিতার দখলবাজি একটু বেশিই প্রকট। এই দখলের যেহেতু মাত্রাভেদ আছে তাই এটা বিচারের মানদণ্ড হিসেবে কাজ করার উপযোগী। তবে এই বিচার পদ্ধতির একটা বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এটা প্রায় পুরোপুরি ব্যক্তিনির্ভর। ব্যক্তিভেদে দখলের মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। তবে ব্যক্তির সমষ্টি বা গোষ্ঠী প্রতিক্রিয়া দেখে এর নৈর্ব্যক্তিকতা আঁচ করা যেতে পারে। কিন্তু বিদ্যায়তনে কবিতার সাহিত্যমূল্য নির্ণয়ে এই পদ্ধতির উপযোগিতা আরও ভাবনার দাবি রাখে।
লেখাটি নতুন ও সৌখিন কয়েকজন কবিদেরকে শেয়ার করবো। উপকৃত হবে।