বিগত ৩ জুন ছিল বিখ্যাত বাঙালি ধ্বনিবিজ্ঞানী, প্রাবন্ধিক ও গবেষক মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের মৃত্যুদিন। ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগে মাদ্রাসা থেকে পৌঁছে গিয়েছিলেন উচ্চতর বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ধ্বনিবিষয়ক আলোচনায় তাঁর তুল্য দ্বিতীয় কোনো পুস্তক বাংলায় তৈরি হয় নি। তাঁকে নিয়ে গদ্যটি লিখেছেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক খন্দকার শামীম আহমেদ।
বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ও ধ্বনিবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের পুরো নাম আবুল বশার মুহম্মদ আবদুল হাই । অল্প কথায় তাঁর জীবনী এরকম : ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলার রাণীনগর থানার মরিচাগ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পূর্বপুরুষ ‘ওস্তাদ পরিবার’ নামে পরিচিত ছিলেন। আবদুুল গণি ও মায়মুন্নিসার দম্পতির কনিষ্ঠ পুত্র মুহম্মদ আবদুল হাই পরবর্তী সময়ে নিজেও একজন কৃতী শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শুরু হয়েছিল নিজ বাড়িতেই। মরিচা গ্রামের নিকটবর্তী বর্ধনপুর জুনিয়র মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষালাভ করেন। রাজশাহী হাই মাদ্রাসায় তিনি ভর্তি হন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী মাদ্রাসা থেকে উচ্চ মাদ্রাসা পরীক্ষায় (প্রবেশিকা) প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান দখল করেন। রাজশাহী থেকে তিনি এর পর পাড়ি জমান ঢাকায়, ‘ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজে ভর্তি হন।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। এরপর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অনুপ্রেরণায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে বি.এ.(অনার্স) শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বি.এ.(অনার্স) পাশ করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে পাশ করেন এম.এ.। উল্লেখ্য বাংলায় বি. এ.(অনার্স) ও এম. এ. উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পাওয়া প্রথম মুসলিম ছাত্র মুহম্মদ আবদুল হাই। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে তিনি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। প্রথম চাকরি হিসেবে তিনি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি চাকর করেছিলেন ২৮ জানুয়ারি ১৯৪৩ পর্যন্ত। ২৯ জানুয়ারি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা ইন্টামিডিয়েট কলেজে বাংলা ভাষার প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ পর্যন্ত চাকরি করে তিনি বদলিজনিত কারণে ১৬ ফেরুয়ারি ১৯৪৩ যোগদান করেন চট্টগ্রাম কলেজে। এরপর তিনি বদলী হন কৃষ্ণনগর কলেজে। ৫ মার্চ ১৯৪৩ যোগদান করে কৃষ্ণনগর কলেজে তিনি ৩০ আগস্ট ১৯৪৭ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ তিনি যোগদান করেন রাজশাহী কলেজে।
মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের কর্মজীবনের সবচেয়ে সফলতম অধ্যায়ের শুরু হয় ২ মার্চ ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করার মাধ্যমে। বাংলা বিভাগে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত যান। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ-এ জে. আর. ফার্থের অধীনে তুলনামূলক শব্দতত্ত্ব বা কম্পারেটিভ ফিলোলোজিতে সম্মানসহ এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন ১৮ ফেব্রয়ারি ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সহযোগী অধ্যাপক বা রিডার হন এবং ১৬ নভেম্বর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি হন বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ। এই পদে তিনি ছিলেন আমৃত্যু। ৩ জুন ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২
ছাত্রজীবনেই লেখার হাতেখড়ি হয় মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের। তিনি তাঁর ‘বাল্যস্মৃতি’ প্রবন্ধে নিজের প্রবন্ধ লেখার শুরুর কথা বলেছেন, ‘জুনিয়র মাদ্রাসায় ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই। আমার শিক্ষকেরা আমাকে খুব ভালবাসতেন। মওলবী আনোয়ারুল্লাহ ও জনাব ফজলে হক ছিলেন আমার অত্যলন্ত প্রিয় শিক্ষক। … এই সময় ‘কালো’ নামক একটা প্রবন্ধ লিখে আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। মওলবী সিরাজদ্দোহা ছিলেন আমার শিক্ষক। তিনি আমার মেধা দেখে আমায় বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তাঁদের উৎসাহ ও প্রেরণাই আমার মনে ছোটবেলা থেকে আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল।” পরবর্তী সময়েও দেখা যায় মুহম্মদ আবদুল হাই তাঁর শিক্ষকগণের কাছ থেকে এরকম স্নেহ পেয়েছিলেন। তাঁর মানস গঠনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, মোহিতলাল মজুমদার, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, গণেশ চরণ বসু, আশুতোষ ভট্টাচার্য প্রমুখের অবদান স্মরণীয়। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে শালিন্তনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর মনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৭ বছর বয়সে রাজশাহী মাদ্রাসা ম্যাগাজিনের গ্রীষ্ম সংখ্যায় ‘কালো’ নামক প্রবন্ধ লিখে মাদ্রাসা ছাত্র মুহম্মদ আবদুল হাই সাহিত্যচর্চার যে সূত্রপাত করেন, তার পঞ্চাশ বছরের জীবনে তা বহমান ছিল। এই প্রথম প্রবন্ধেই শক্তিশালী প্রাবন্ধিকের পরিচয় স্পষ্ট। নমুনা হিসেবে ‘কালো’ প্রবন্ধের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যায়:
জগতপাতার সীমাহীন গগনতল, নিখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত কোন বস্তু নিরর্থ ও নির্গুণভাবে সৃষ্টি হয়নি। প্রাণীজগৎ হতে জড় জগৎ পর্যন্ত জল ও স্থলভাগের প্রত্যেক অনু-পরমাণু এক একটি বিশেষগুণ ও রূপ নিয়ে স্পষ্ট।… রাজাধিরাজ, মহারাজ যার প্রতাপে এতদিন বিশ্ব ছিল টলায়মান সেও শেষে কালোর হাতে ধরা দিল। এখন বুঝতে পারি কালোর প্রতাপ, যে দিকে তাকাই শুধু দেখি কালো, কালোর রূপের ছড়াছড়ি; আলো তার কাছে হীন, নগণ্য। কালোই শ্রেয়, কালোই জগৎময়।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী মাদ্রাসা ম্যাগাজিনের গ্রীষ্ম সংখ্যায় তিনি লেখেন ‘ঈদ মাহ্ফেলে একরাত্রি’ নামক প্রবন্ধ। এই দুটি প্রবন্ধের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিলে দেখা যায় ‘কালো’ প্রবন্ধটি চিন্তামূলক; অন্যদিকে ‘ঈদ মাহ্ফেলে একরাত্রি’ প্রবন্ধটি স্মৃতিকথা জাতীয় রচনার পূর্বাভাষ দেয়। পরবর্তী সময়ে তাঁর সাহিত্যসাধনায় এই দু’ধারার লেখা পাওয়া যায়।
সাহিত্যচর্চার শুরুর দিকে তিনি প্রবন্ধ, ছোটগল্প, ভ্রমণ-কাহিনি প্রভৃতি লিখেছেন। সৃষ্টিধর্মী সাহিত্য সৃষ্টির দিকে তিনি বেশি মনোযোগ দেননি; বরং সাহিত্য-সমালোচনা ও প্রবন্ধ রচনায় মনোনিবেশ করেন। ঢাকার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বার্ষিকীতে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় ভ্রমণ-কাহিনি ‘শিলঙে মে মাস’; মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ/ ১৩৫১ সালের মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ছোটগল্প ‘ওস্তাদজী’ প্রভৃতি রচনা। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সৃষ্টিসম্ভারে আছে অনুবাদ, ভ্রমণ-কাহিনি, লোকসাহিত্য, ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক লেখা। এ ছাড়াও আছে ডজনখানেক গ্রন্থের সম্পাদনার কাজ। পাঠ্যপুস্তক হিসেবে তিনি লিখেছেন তিনটি গ্রন্থ। বিভিন্ন সংকলনে, পত্র-পত্রিকা, সাময়িকীতে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের বেশ কিছু রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। নয়া জামানা, আজাদ, মোহাম্মদী, জিন্দেগী, ঢাকা প্রকাশ প্রভৃতি পত্রিকায় ছিটিয়ে আছে তাঁর লেখার নিদর্শন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে প্রথম প্রকাশিত ষাণ্মাসিক সাহিত্য পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তিনি ।
৩
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে মুহম্মদ আবদুল হাই প্রবন্ধ লিখে অনন্য অবদান রেখেছেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতি (১৯৫৪), তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা (১৯৫৯), ভাষা ও সাহিত্য (১৯৬০) প্রভৃতি তাঁর প্রাবন্ধিক সত্তার পরিচয় বহন করছে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি (১৯৫৪) ও ভাষা ও সাহিত্য (১৯৬০) গ্রন্থ দুটি মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন। তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা (১৯৫৯) গ্রন্থটিতে সংকলিত হয়েছে তাঁর রম্যরচনা ও ভাষাবিষয়ক কিছু প্রবন্ধ। এছাড়া সৈয়দ আলী আহসান সহযোগে লিখিত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ) (১৯৫৬) তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। প্রবন্ধগ্রন্থগুলোর বিভিন্ন প্রবন্ধ খেয়াল করলে দেখা যায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নানা প্রালন্ত স্পর্শ করার মহৎ ইচ্ছা ছিল তাঁর।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত সাহিত্য ও সংস্কৃতি গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে ১৭ টি প্রবন্ধ সংকলিত ছিল। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে; কিছু পরিবর্তন নিয়ে। প্রথম সংস্করণে প্রকাশিত ‘ভাষা ও সমাজ-জীবন’ এবং ‘রবীন্দ্র কাব্যে মানবতা’ প্রবন্ধ দুটি দ্বিতীয় সংস্করণে বাদ দিয়ে নতুন চারটি প্রবন্ধ যুক্ত হয়। ‘ভাষা ও সমাজ-জীবন’ প্রবন্ধটি পরবর্তী সময়ে ভাষা ও সাহিত্য গ্রন্থভুক্ত হয়। সাহিত্য ও সংস্কৃতি গ্রন্থে সংকলিত মোট ১৯ টি প্রবন্ধ হল: ‘বিদ্যাপতি কাব্যপাঠ’, ‘বাংলা দেশে মুসলিম অধিকারের যুগ ও বাংলা সাহিত্য’, ‘কবি সৈয়দ সুলতান’, ‘কবিগুরু আলাওল’, ‘মানুষের প্রেম ও কবি আলাওল’, ‘আলাওলের সেকান্দার নামা’, ‘লালন শাহ ফকির’, ‘ভাষাতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ’, ‘নজরুল প্রতিভার বৈশিষ্ট্য’, ‘বাংলা কাব্যের নতুন ধারা ও নজরুল’, ‘কবি শাহাদাৎ হোসেন’, ‘বাংলা সনেটের পটভূমি’, ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’, ‘আমাদের ভাষা ও সাহিত্য’, ‘হিন্দু বাংলার ধর্মান্দোলন ও ঊনবিংশ শতাব্দী’, ‘ইসলামের বৈপ্লবিক ভূমিকা’, ‘ইসলামের শাসন সংহতি’, ‘মুসলিম ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থা’, ‘মুসলিম ভারতে স্ত্রী শিক্ষা’। গ্রন্থভুক্ত সব প্রবন্ধই প্রথম বিভিন্ন সাময়িকপত্র, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো বিভিন্ন সময়ে একাডেমিক প্রয়োজনে লিখেছিলেন মুহম্মদ আবদুল হাই। এজন্য প্রবন্ধগুলোর মধ্যে বিষয়গত ঐক্য/ শৃঙ্খলার ঘাটতি দেখা যায়। মনে রাখা জরুরি যে তখন প্রয়োজনের তাগিদটাই ছিল মুখ্য। বর্তমানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে উর্বর ক্ষেত্র দেখতে পাওয়া যায়, পূর্বে তা ঊষর ছিল। মুহম্মদ আবদুল হাই সাহিত্য ও সংস্কৃতি গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “আশা করি এ সংস্করণটি ছাত্র সমাজের বিশেষ কাজে লাগবে।” তিনি তাঁর লেখার পাঠকদের পাঠ করতে পেরেছিলেন ঠিকমতই।
সাহিত্য ও সংস্কৃতি গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো বুদ্ধিমান ও রসজ্ঞ পাঠকের মনের খোরাক জোগায়। প্রবন্ধগুলোর নিবিড় পাঠে অনুসন্ধানী, পরিশ্রমী প্রাবন্ধিক হাইকে চিনে নেওয়া যায়। গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ‘বিদ্যাপতি কাব্যপাঠ’কে তিনি পাঁচটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করেছেন : এক. বিদ্যাপতি ও বৈষ্ণবতত্ত্ব, দুই. ইসলাম ও শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্ম, তিন. বৈষ্ণব অনুভূতি ও সুফী মতবাদ, [চার.] বিদ্যাপতি-পদাবলীর রসবিশ্লেষণ, পাঁচ. বিদ্যাপতির প্রার্থনা। বিহারের কামেশ্বর রাজবংশের রাজসভা-কবি বিদ্যাপতির ব্যাপক আলোচনা এতে স্থান পেয়েছে। প্রাবন্ধিক সহজভাষায় মিথিলাবাসী কবি বিদ্যাপতির পরিচয় দিয়েছেন, “বিদ্যাপতি একাধারে বহুভাষাবিদ ও পণ্ডিত ছিলেন। তিনি ইতিহাস, ভূগোল, ন্যায়, স্মৃতি ও নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখিতেন এবং অলঙ্কার ও স্মৃতি-শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁহার রচিত ভূপরিক্রমা, কীর্তিলতা, পুরুষ-পরীক্ষা, কীর্তি-পতাকা, লিখনাবলী, শৈব-সর্বস্ব, গঙ্গাবাক্যাবলী, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী প্রভৃতি গ্রন্থই তাঁহার পাণ্ডিত্যের ও বিচিত্র বিষয়াভিজ্ঞতার সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু তাঁহার কবি-প্রতিভা তাঁহার পাণ্ডিত্যকেও অতিক্রম করিয়া গিয়াছে। তিনি সেকালের বিহারের বা পূর্ব-ভারতের নয়, সমগ্র ভারতেরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন।”
এমন তথ্যপূর্ণ বর্ণনাই শুধু নয় তিনি তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তাঁর বক্তব্যকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। ‘বিদ্যাপতি কাব্যপাঠ’ প্রবন্ধে তিনি বিদ্যাপতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলনামূলক আলোচনা করে যখন সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তখন পাঠকও যেন তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণে বাধ্য হন। তিনি লেখেন, “বিদ্যাপতি ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনায় দেখি উভয় কবির জীবন ও কাব্যাদর্শে যথেষ্ট পার্থক্য রহিয়াছে, এমনকি তাহাদের উভয়ের মধ্যে তুলনাও চলে না; তথাপি দেখিতে পাওয়া যায় কাব্যসাধনার প্রালন্তসীমায় পৌঁছিয়া উভয় কবির বাণী যেন একইভাবে একই সুরে ঝঙ্কৃত হইয়া উঠিয়াছে।”
‘বাংলা দেশে মুসলিম অধিকারের যুগ ও বাংলা সাহিত্য’ প্রবন্ধে বাংলাদেশে মুসলমান শাসকদের আগমন, এদেশে ইসলাম প্রচার, বাংলা সাহিত্যে মুসলমান শাসকদের বিভিন্ন অবদানের কথা বর্ণনা করেছেন। মুসলমান শাসকগণ ইরান তুরান যেখান থেকেই আসুন না কেন তাঁরা এদেশ জয় করে এদেশের সর্বসাধারণের মুখের ভাষাকে সম্মান করে নিজ ভাষায় সাহিত্য-চর্চার পথকে সহজ করেছিলেন; পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছিলেন। প্রাবন্ধিক উদাহরণস্বরূপ নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের প্রেরণায় মহাভারতের অনুবাদ; আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে তাঁর সেনাপতি পরাগল খাঁর আদেশে কৃত কবীন্দ্র উপাধিধারী পরমেশ্বর দাসের মহাভারতের অনুবাদ প্রভৃতির উল্লেখ করেন।
ইংরেজ শাসনামলে উনিশ ও বিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের যেমন বিভিন্নমুখী বিকাশ সাধিত হয়েছে; তেমনি মুসলমানদের দ্বারা এদেশ জয়ও মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ ও অভ্যুদ্যয়ের জন্য অশেষ কল্যাণের হয়েছে বলে হাই মনে করেন। তাঁর আলোচনা অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়, যখন তিনি তুলনামূলক আলোচনার আশ্রয় নিয়ে বলেন, “রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা কোন সাহিত্যের ইতিহাসে কতখানি তা যারা গ্রীসের পেরিক্লিসের যুগ আর ইংলণ্ডের এলিজাবেথের যুগের সঙ্গে পরিচিত আছেন তাঁদের কাছে নতুন করে বলতে হবেনা। বাংলা দেশে মুসলমান শাসনের প্রতিষ্ঠার ও বিস্তারের যুগে মুসলমান নবাব বাদশাহদের সুস্থ রাজনৈতিক ও ধর্মবুদ্ধি এদেশের জনসাধারণের জন্য যেমন প্রভূত কল্যাণের হয়েছিল তেমনি জনসাধারণের ভাষায় রচিত বাংলা সাহিত্যের নানাদিকে বৈপ্লবিক বিকাশ সম্ভবপর করে তুলেছিল।… সুতরাং আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁকে [হোসেন শাহ] ইংলণ্ডের এলিজাবেথ কি গ্রীসের পেরিক্লিসের সংগে তুলনা করলেও কোন অন্যায় হয় না।” প্রবন্ধের উপসংহারে হাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করার সময় গুণগ্রাহী নরপতি হোসেন শাহের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করার কথা বলেছেন।
‘কবি সৈয়দ সুলতান’ প্রবন্ধে তিনি প্রথমেই উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশের মুসলমান কবিদের মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছেন কবি সৈয়দ সুলতান। নবীবংশ, শবে মেয়েরাজ, হযরত মোহাম্মদ চরিত, ওফাতে রসুল, ইব্লিসের কিচ্ছা, জ্ঞান চৌতিশা ও জ্ঞান-প্রদীপ — প্রভৃতি গ্রন্থ-রচয়িতা সৈয়দ সুলতানের কবি প্রতিভার বিস্তারিত পরিচয় দিয়েছেন তিনি। কৃত্তিবাস, কাশীদাসকে বাংলায় রামায়ণ মহাভারত অনুবাদ করার জন্য ব্রাহ্মণরা যেমন ‘সর্বনেশে’ আখ্যা দিয়েছিল; রৌরব নরকেও তাদের ঠাঁই হবে না বলে তাদের উপর বর্ষণ করেছিল অভিসম্পাত; তেমনি কবি সৈয়দ সুলতান পেয়েছিলেন ‘মোনাফেক’ আখ্যা। প্রাবন্ধিক মুহম্মদ আবদুল হাই সৈয়দ সুলতানের কবিতা দিয়েই তাঁর বাংলা ভাষার প্রতি দরদ, তাঁর মনোবেদনা এবং তথাকথিত ভণ্ডদের মুখোশ উন্মোচনে প্রয়াস পেয়েছেন:
ক. যে সবে আপনা বোল না পারে বুঝিতে।
পঞ্চালী রচিলুম করি আছএ দোষিতে।।
মোনাফেক বলে মোরে কিতাবেতু পড়ি।
কিতাবের কথা দিলুম হিন্দুয়ানী করি।।
খ. যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন।
সেই ভাষ তাহার অমূল্য সেই ধন।।
পাপী সবে পেলে ছিদ্রি আল্লার প্রচারি।
ছৈয়দ ছোলতানে সব দিল ব্যক্ত করি।।
গ. মহিমা সে আল্লার দিলুম প্রচারিয়া।
মহিমার ছিদ্রি বোলে মনে না ভাবিআ।।
পয়গম্বর সবের মহিমা প্রচালিুম।
পাপমতি ইব্লিসের অযশ ষোষিলুম।।
ঘ. মোহোর মনের ভাব জানে করতারে।
জথেক মনের কথা কহিমু কাহারে।।
সৈয়দ সুলতানের দৃষ্টিভঙ্গির ত্রুটি নির্দেশ করে হাই বলেন যে তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শ্রীকৃষ্ণ প্রমুখ দেবতাদের যেমন নবী বলে স্বীকার করেছেন, তেমনি আমাদের নবীজীর প্রতি অবতারত্বের আরোপ করতে চেয়েছেন। শরীয়ৎ-পন্থী মুসলমানেরা এ কারণেই তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে থাকবেন বলে মন্তব্য করেন প্রাবন্ধিক। তবু সৈয়দ সুলতানের দূরদর্শিতা, সমাজ ও স্বধর্মের সেবার জন্য তিনি বাংলাভাষাভাষী মুসলমানের অশেষ শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র হয়ে থাকবেন বলে ভবিষ্যৎবাণী করেন মুহম্মদ আবদুল হাই।
সাহিত্য ও সংস্কৃতি গ্রন্থে আলাওল প্রসঙ্গে হাই প্রবন্ধ লিখেছেন তিনটি — ‘কবিগুরু আলাওল’, ‘মানুষের প্রেম ও কবি আলাওল’, ‘আলাওলের সেকান্দার নামা’। এগুলোতে তিনি রোসাঙ্গ রাজসভার কবি মহাকবি আলাওল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ‘কবিগুরু আলাওল’ প্রবন্ধে আলাওলের জন্মস্থান, পিতার কর্মস্থল, জলদস্যু দ্বারা আক্রালন্ত হওয়া, সৈনিক পদে চাকুরী গ্রহণ প্রভৃতি বিষয় বর্ণনা করে তাঁর পদ্মাবতী (১৬৫১) কাব্যের আলোচনা করেন। প্রাবন্ধিক পদ্মাবতী কাব্যকে আলাওলের শ্রেষ্ঠ সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা, তাঁর Masterpiece হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পদ্মাবতীকে আলাওলের প্রথম কাব্য হিসেবে স্বীকার করতে প্রাবন্ধিকের ‘সাধারণ বুদ্ধিতে খটকা’ লেগেছে। কারণ অলাওলের শ্রেষ্ঠ কাব্য লেখার আগে নিশ্চয়ই কিছু লেখালেখি করে হাত পাকিয়েছিলেন তিন। হাই তাঁর বক্তব্যের পক্ষে আলাওলের, ‘রচিলু বহু নামা আলা ঝালা’ — উক্তির উল্লেখ করেন।
আলাওলের দ্বিতীয় কাব্য সয়ফুলমুল্লুক বদিউজ্জামাল (১৬৫৯) গ্রন্থের নানা তথ্য উল্লেখপূর্বক সহজভাবে এর কাহিনি বর্ণনা করেন। হাই কত সহজ ও সংক্ষিপ্ত ভাষায় কাহিনি বর্ণনা করেছেন তার নমুনা হিসেবে নিম্নোক্ত উদ্ধৃতির উল্লেখ করা যেতে পারে:
সয়ফুল মুল্লুক বদিউজ্জামাল একখানা প্রেমকাব্য। কবির নিজের কথায় “প্রেমের পুস্তক এই সয়ফুল মুল্লুক।” এ কাব্যের নায়ক মানুুষ, নায়িকা পরী। পরী কথাটা বাদ দিয়ে রেখে মানব মানবীর প্রেম ও প্রণয়জনিত কাব্য হিসেবে ইহা সহজবোধ্য ও সুখপাঠ্য। কাব্যের নায়ক মিশরের বাদশাহ সিফুয়ানপুত্র সয়ফুল মুল্ক পরীবালা বদিউজ্জামালের চিত্র দেখে তাকে পাওয়ার জন্য আত্মহারা ও হতচৈতন্য হয়ে পড়েন। তার বন্ধুর কাছে বাদশাহ একথা অবগত হয়ে পরীবালার সন্ধানে দেশে দেশে লোক পাঠালেন; রাজার কোন চেষ্টাই যখন সফল হলো না তখন বদিউজ্জামাল তার প্রেমিক নাগরকে স্বপ্নে দেখা দিলেন। সয়ফুল ও তার বন্ধু পরীরাজ্যের উদ্দেশ্যে অভিসার করলেন। পথে নানা অঘটন ঘঠে। শেষ পর্যন্ত প্রেমের সাধনা ফুল হয়ে তাদের জীবনে ফুটে উঠে। সয়ফুল পরীবালা বদিউজ্জামালকে আর তার বন্ধু মল্লিকাকে বিবাহ করেন।
মুহম্মদ আবদুল হাই এই প্রবন্ধে আলাওলের হপ্তপয়কর (১৬৬০), তোহফা (১৬৬৪), সেকান্দারনামা (১৬৭৬) প্রভৃতি কাব্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে আলাওল বহু বৈষ্ণব খণ্ডগীতি বা পদাবলী রচনা করেছিলেন — যেগুলো ছিল মধুর রসের। আলাওলের শেষ জীবন সুখের ছিল না। হাই কবির এই কবিতা, মন্দকৃতি ভিক্ষা বৃত্তি জীবন কর্কশ।/ পুত্রহারা সঙ্গে অঙ্গ হৈল পরবশ।। — উদ্ধৃত করে তাঁর দুরবস্থার কথা প্রমাণ করেন। প্রাবন্ধিক আলাওলের শেষ জীবনের প্রসঙ্গে বাংলার কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র এবং কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের কষ্টকর অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন।
‘মানুষের প্রেম ও কবি আলাওল’ প্রবন্ধে আলাওলের কাব্যচর্চার প্রেক্ষাপট বর্ণনাপূর্বক তাঁর কাব্যে প্রেম, বিয়ে প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। আলাওলের, “প্রেম বিনে ভাব নাহি ভাব বিনে রস/ ত্রিভূবনে যত দেখ প্রেম হন্তে বশ।” — কবিতার পঙ্ক্তি উল্লেখ করে ‘অসাধারণ প্রেমিক ও রসিক কবি’ হিসেবে তাঁকে প্রমাণ করেছেন। সয়ফুলমুল্লুক বদিউজ্জামাল (১৬৫৯) গ্রন্থের উল্লেখ করে প্রাবন্ধিক বলেন যে এই কাব্যের নায়িকা পরী হলেও আলাওল তাকে চিরন্তন নারী হিসেবে এঁকেছেন :
আদি অলন্ত কুমারের যত বিবরণ।
শুনিল মল্লিকা মুখে হই একমন।
বদিউজ্জামালে শুনি হইল মুহিত
তথাপিও লাজে হেতু বলে বিপরিত।
প্রত্যয় না হয় ভগ্নি এসব কথন
এতো দুক্ষ মনুষ্যের রহিছে জীবন।
পদ্মাবতী কাব্যের বরাত দিয়ে প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন আলাওল সিংহলী পদ্মাবতীর বিয়ের যে বর্ণতা দিয়েছেন তা একান্তভাবে বাংলার। প্রাবন্ধিকের বর্ণনায়, “হতে পারে যুগ প্রভাবের বশে বাহ্যতঃ তিনি নিজের দেশের বর্ণনা করছেন না, কিন্তু মিলন বিরহের যে ছবি তিনি ফোটাচ্ছেন তা যে সম্পূর্ণ বাঙলাদেশ থেকেই সংগ্রহ করেছেন একথা অস্বীকার করার যো নেই।… পূর্ব বাঙলার কবি আলাওল সিংহলী পদ্মাবতীকে পতিসঙ্গে চিতোরে শ্বশুরালয়ে পাঠাতে গিয়ে নিজেও কেঁদেছেন, আত্মীয় স্বজন ও মঙ্গলাকাক্সক্ষী সকলের চোখেই অশ্রুর বন্যা বইয়েছেন :
গমনের কাল যদি নিকট হইল
পদ্মাবতী সব সখীগণ আনাইল
কন্যা ঘরে সিংহলের রমণী আসিয়া
কাঁদিতে লাগিল সব শোকাকুলী হৈয়া।
একে একে গলা ধরে কান্দে বরবালা
সকল ছাড়িয়া আমি যাইব একেলা।
মুহম্মদ আবদুল হাই আলাওলের আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসঙ্গ এনে আলোচনাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন। সয়ফুলমুল্লুক বদিউজ্জামালের নায়ক সয়ফুল নায়িকা বদিউজ্জামালকে উদ্দেশ্য করে যে বন্দনা করেছে তার সঙ্গে হাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সুরদাসের প্রার্থনা’র সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছেন। বহু যুদ্ধের পর প্রতিশোধপরায়ণ কুলসুম পরীর হাত থেকে যখন সয়ফুলকে উদ্ধার করা হয়, তখন বিরহিনী বদিউজ্জামালের সখীর কাছ থেকে সয়ফুল শোনে তার প্রিয়ার শোকবিগলিত অবস্থার কথা :
তবে সখী করজোরে লাগিল কহিতে
তোমার লাগিয়া বালা অনেক চিলিন্ততে,
তেজিল তাম্বুল তৈল ভোজন শয়ন
শয়ন হইলে বালা নিদ্রায় জাগন
অবিরত দহে চিত্ত মাংস নাহি মাসা
অল্প মাত্র আছয় ঘুষিতে দুক্ষ দসা।
এর সঙ্গে প্রাবন্ধিক হাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মেঘদূত’ কবিতার বিরহিনী যক্ষবধুর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন:
মনিহর্ম্মে অসীম সম্পদে নিমগনা
কাঁদিতেছে একাকিনী বিরহ বেদনা।
মুক্ত বাতায়ন হতে যায় তারে দেখা
শয্যা প্রালেন্ত লীন-তনু ক্ষীণ শশী রেখা
পূর্ব গগনের মূলে যেন অস্তপ্রায়।
আলাওলের হাতেই দেবদেবীর লীলাভিনয়পুষ্ট বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম মানবভাগ্যের শাশ্বত সত্য কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে করেন প্রাবন্ধিক।
‘আলাওলের সেকান্দার নামা’ প্রবন্ধে মুহম্মদ আবদুল হাই বলেন যে ষোল শতকের কবি মুকুন্দরাম এবং আঠার শতকের ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের যোগসূত্র হলেন আলাওল কবিত্বে, পাণ্ডিত্যে ও কাব্যিক উৎকর্ষে। এই প্রবন্ধে তিনি আলাওলের সেকান্দার নামা কাব্যের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মুহম্মদ আবদুল হাই আলাওল প্রসঙ্গে তাঁর কাব্যের যথাযথ আলোচনা, গ্রন্থ সহজলভ্য হওয়া প্রভৃতির বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে উপসংহারে বলেন যে আমাদের স্বার্থেই, আমাদের নিজেদের লজ্জা অপনোদনের জন্যেই আলাওলের সাহিত্যের সম্যক আলোচনা শুরু হবে।
মুহম্মদ আবদুল হাই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরীর লেখার একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর মনে ও মজ্জায়। এঁদের মথিত করে হাই একটি সাহিত্যিক ভাবমণ্ডল তৈরি করেছিলেন।
‘লালন শাহ ফকির’ প্রবন্ধে বাংলার বাউল কবিদের মধ্যে সুবিখ্যাত লালন শাহের (১৭৭৪-১৮৯০) জীবন ও কর্ম নিয়ে সুগভীর আলোচনা করেছেন। বাউল কবি লালন তার মনের মানুষ, আলেফের মানুষের খোঁজে গান রচনা করেন, “খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায় / ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।” আবদুল হাই লালনের এই অনুভুতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।” — এর মিল খুঁজে পেয়েছেন। গীতাঞ্জলি, গীতালি, গীতিমাল্য প্রভৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ, লালনের আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে তার ‘সগোত্রতা’র কথা বলেন আবদুল হাই। প্রাবন্ধিক অবশ্য একথাও সঙ্গে সঙ্গে বলে নেন যে এ সগোত্রতা প্রভাবজাত ততটা নয়, যতটা চিন্তা ও ভাবসাধনার ঐক্যজাত।
‘ভাষাতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে বিশিষ্ট ধ্বনিবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই যেন প্রাণখুলে বিশ্লেষণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। বিশ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক ভাষাতত্ত্বের সুগভীর পর্যালোচনা করেছেন। প্রাবন্ধিক তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব (Comparative Philology), ইতিহাসভিত্তিক ভাষাতত্ত্ব এবং বর্ণনাত্মক ভাষাবিজ্ঞান (Descriptive Linguistics) প্রভৃতির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, তুলনামূলক ও ইতিহাসভিত্তিক ভাষাতত্ত্বে ভাষার অতীত রূপের আলোচনা থাকে কিন্তু ভাষাবিশেষের ধ্বনি সমষ্টি থেকে শুরু করে শব্দগঠন, বাক্যরীতি এবং সমাজজীবনে তার প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়ের সামগ্রিক আলোচনা থাকেনা। এক্ষেত্রে বর্ণনাত্মক ভাষাবিজ্ঞানের উপযোগিতা বেশি বলে বিশ্বে বর্ণনাত্মক ভাষাবিজ্ঞানের কদর বেড়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশেই বর্ণনাত্মক ভাষাবিজ্ঞানের সূত্রপাত হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে যাস্ক, পাণিনি ও পতঞ্জলি প্রমুখ ধ্বনিবিদ এর সূত্রপাত করেছিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত কালক্রমে এ ধারার বিকাশ সাধিত হয়নি; এমনকি কালক্রমে এ দেশ থেকে ভাষা-আলোচনা তথা ভাষাবিজ্ঞানের সাধনা একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়। বিশ শতকে ইউরোপ ও আমেরিকায় বর্ণনাত্মক ভাষাবিজ্ঞান যখন দ্রুত প্রসার ও বিস্তৃতি লাভ করে তখন এ উপমহাদেশে ভাষার ইতিহাসভিত্তিক আলোচনাতে নিয়োজিত থাকেন কয়েকজন বিশিষ্ট মনীষী; বীম্স, রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর, স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন। বাংলাদেশে বিজয়চন্দ্র মজুমদার, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. সুকুমার সেনের নাম এক্ষেত্রে স্মরণ করেছেন হাই। এঁরা সবাই বাংলা ভাষার ইতিহাসভিত্তিক আলোচক।
বর্ণনাত্মক ভাষাবিজ্ঞানের আলোকে বাংলা ভাষার আলোচনা খুব একটা হয়নি বরে উল্লেখ করেন প্রাবন্ধিক। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কয়েকটি আলোচনা এক্ষেত্রে দিগ্দর্শন হিসেবে বর্তমান। মুহম্মদ আবদুল হাই এই প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে ‘বিস্ময়কর’ তথ্য পেশ করেন, ‘‘কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে যাঁকে আমরা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এবং বাংলা ভাষার অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ কবি বলে জানি, সেই কবি রবীন্দ্রনাথই বাংলা ভাষার বর্ণনাভিত্তিক আলোচনার জনক এবং পথিকৃৎ হয়ে রয়েছেন। ভাষাবিজ্ঞানের এ শাখায় আলোচনা বিজ্ঞান সাধনারই নামান্তর; অথচ কবিরা সাধারণতঃ বৈজ্ঞানিক হন না। তাই এ পথে রবীন্দ্রনাথকে নামতে দেখে বিস্ময়বিমুগ্ধ হয়ে উঠি।’’ এ প্রসঙ্গে হাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি গ্রন্থ শব্দতত্ত্ব (১৯০৯) ও বাংলা ভাষা পরিচয় (১৯৩৮)-কে অবিস্মরণীয় আখ্যায়িত করেন।
শব্দতত্ত্ব ও বাংলা ভাষা পরিচয় গ্রন্থের বিশদ আলোচনা করে ‘ভাষাতাত্ত্বিক’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় দিয়েছেন হাই। বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি উদ্ধৃত করে হাই বলেন যে বাংলা ভাষা বাংলা ব্যাকরণের নিয়মে চলে এবং সে ব্যাকরণ সম্পূর্ণরূপে সংস্কৃত ব্যাকরণের দ্বারা শাসিত নয়।
বর্ণনাত্মক ভাষাবিজ্ঞানে ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, বাক্যরীতি এবং বাগর্থ ইত্যাদি প্রকরণের সাহায্যে একটি ভাষার যে সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয় এবং এ পদ্ধতিতে প্রাপ্ত তত্ত্ব ও তথ্যাদির গবেষণাগারে যে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখায় তেমন খুঁটিনাটি বিচার বিশ্লেষণ করেন নি। হাই বলেন যে, সে শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল না এবং প্রয়োজনও ছিল না। সাহিত্যিক প্রয়োজনে বাংলা ভাষা নিয়ে সাধনা করতে গিয়ে প্রখর মনীষা এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে বাংলা ভাষার যে নিগূঢ় পরিচয় তিনি পেয়েছিলেন এবং প্রতিদিনের ব্যবহারে এ ভাষার রূপ তাঁর কাছে যেভাবে খুলে গিয়েছিল, তিনি তারই সহজ ও স্বাভাবিক বিবৃতি লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর এ শব্দতত্ত্ব ও বাংলা ভাষা পরিচয় গ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথের লেখা নিছক কবির লেখা নয়; তাঁর আলোচনা বর্ণনাত্মক এবং ক্ষেত্রবিশেষে ইতিহাসভিত্তিক ভাষাবিজ্ঞানের পথ ধরেই অর্থাৎ ভাষার ধ্বনি, তার শব্দগঠন, বাগ্বিধি, অর্থবিচার এবং প্রয়োগ মাধুর্যের আবিষ্করণের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে।
‘নজরুল প্রতিভার বৈশিষ্ট্য’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক এদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে সাহিত্যসৃষ্টির একটা মেলবন্ধন খুঁজে পেয়েছেন। তিনি মনে করেন এদেশের হাড়ে-মাংসে, অস্থি-মজ্জায় কারুণ্যের এবং কান্নার ছড়াছড়ি, কোমল মৃদুল আবহাওয়ারই বাড়; বীররস এদেশের ভেজা মাটিতে বিশেষ ফলেনি। তাই মহাকাব্য রচয়িতা মধুসূদন-হেমচন্দ্র-নবীন-কায়কোবাদের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ওপথে পা বাড়াননি। মুহম্মদ আবদুল হাই কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের ময়দানে আবির্ভাবকে দেখেছেন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে; তাঁর ভাষায়, “একথা অবিসংবাদিত সত্য যে নজরুল চিন্তালেশহীন-ভাস্বর-ললাট দুর্মদ চির তারুণ্যের কবি, যৌবনের কবি এবং যুদ্ধের কবি। নজরুল প্রতিভার এই বৈশিষ্ট্য সেকালের বাঙালিকে যেমন বিস্মিত ও মুগ্ধ কোরেছে, চিরকারের তরুণ-তরুণী ও যুবসমাজকে প্রানের অপরিসীম শক্তির আবেদনের জন্য তেমন ভাবেই মুগ্ধ কোরবে। নজরুল প্রতিভা তাই একটা বিস্ময়, ধূমকেতুর মতই তাঁর আবির্ভাব; চকিত ঝলকে সে প্রতিভা হঠাৎ তার পক্ষচ্ছটা বিস্তার কোরে বাঙলার আকাশের দিগদেশ উদ্ভাসিত কোরে পরক্ষণেই অলন্তর্হিত হোয়ে গেল। তাঁর প্রতিভার এই বিদ্যুদ্দীপ্তি ‘extra fire’ এর সঙ্গে বাঙালীর কবি মাইকেল মধুসূদনের প্রতিভার তুলনা হয়। উভয় কবিই তাঁদের কাব্যের উৎকর্ষের দিনে ঝড়ের বেগে চলেছিল। তাই দেখা যায় উভয়েই সেই ঝড়ের তান্ডব নৃত্যে আত্মধক্ষংসকারী প্রতিভার সেবা করতে গিয়ে ধক্ষংস ও সৃষ্টির মাঝখানে বসে যা কিছু দেওয়ার তা এক নিঃশ্বাসে দান কোরে দিয়ে উধাও হোয়ে গেছেন।” বীণার সুর ছেড়ে একজন বাঙালি কবি হঠাৎ ড্রামের ধক্ষনি-নির্ঘোষে বাঙালিদের আহ্বান জানিয়েছেন:
ওরে আয়
ঐ মহাসিন্ধুর পার হোতে ঘন রণভেরী
শোনা যায় —
ওরে আয়!
ঐ ইসলাম ডুবে যায়
যত শয়তান
সারা ময়দান
জুড়ি’ খুন তার নিয়ে হুঙ্কার দিয়ে
জয়গান শোন গায়।
এ যেন যুদ্ধের ময়দান থেকে যুদ্ধেরই ধ্বনি। এতে ভীত হলেও জীবন ও যৌবনের কাছে এর আবেদন কখনই অগ্রাহ্য হয় না। হাই বলেন যে নজরুলের এই আহক্ষানে সেদিন জাতিধর্মনির্বিশেষে কবিকে অকুণ্ঠচিত্তে বরণ করে নিয়েছে। একদিনেই নজরুল হয়ে উঠেছেন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার কবি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের জীবনে, চিন্তায় যে পরিবর্তন এসেছে; সাহিত্যও যেখানে গতানুগতিকতার পথ ছেড়ে স্বতন্ত্র পথে ছুটে চলছে; তখন হাইয়ের মনে প্রশ্ন জেগেছে এই প্রেক্ষাপটে নজরুল-প্রদর্শিত পথ কোনো সহায়তা করবে কী? নজরুল প্রতিভার যে বৈশিষ্ট্য বাঙালিকে নতুন প্রাণ দিয়েছে, সে প্রতিভা কি বাঙালির কাব্যে কোন স্থায়ী আঁচড়ই কাটবে না। ১৩৫৩ সালের মিল্লাত-এর ঈদ সংখ্যায় মুহম্মদ আবদুল হাই এই প্রবন্ধ লিখেছিলেন; তখন কবি নজরুল জীবিত; কিন্তু তিনি বাক্শক্তিহীন। সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যেমন অনেকদিন চুপ থেকে হঠাৎ তীব্র বেগে জ্বালামুখ খুলে লাভা নিঃসরণ করে, জীবন ফিরে পায়; তেমনি কবি নজরুলের সুপ্তাবস্থার অবসান হোক — প্রার্থনা মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের, “কবি বেঁচে আছেন। আমাদের বড় দুর্ভাগ্য তিনি জীবিত থেকেও দেশের বিক্ষুব্ধ পরিবেশে কোন সহায়তা কোরতে পারবেন না। যে ‘আগ্নেয়াদ্রি’ — বাড়ব-বহ্নিকালানল-কবি তার অগ্নিগর্ভ থেকে এত লাভানিঃসরণ কোরে এককালে বাঙলার আকাশ অত্যুজ্জ্বল কোরে তুলেছিলেন — দুঃখ হয়, তিনি কি তাঁর এই যোগ-প্রভাব মুক্ত হবেন না? তাঁর ঘুম কি আর ভাঙবেনা?”
‘বাংলাকাব্যের নতুনধারা ও নজরুল’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক নজরুল-সাহিত্যের স্থায়িত্বের বিষয়ে মন্তব্য করেন, “সর্বহর কালের নির্মম কবলে, নজরুল সাহিত্য কালজয়ী হবে কিনা সে প্রশ্নের মীমাংসা কালই করবে। আমাদের দিক থেকে তার বিধান দেওয়ার ধৃষ্টতা না থাকাই ভাল।’’ এ প্রবন্ধে নজরুলের মার্কসবাদী চিন্তাযুক্ত কবিতার বর্ণনা দিয়েছেন প্রাবন্ধিক।
কবি নজরুলকে হাই যুগ ও জাতির সমস্যা সম্বন্ধে সচেতনকারী, বাংলা কাব্য সাহিত্যের নতুন ধারার প্রবর্তক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নজরুলের হাতেই সর্বপ্রথম জীবন্তরূপ পেয়েছে বলে প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেন। মুসলিম জীবনের আশা আকাক্সক্ষার রূপায়ণেও বাংলা সাহিত্যে তিনি কারও অনুসারী নন বরং অভিযাত্রী কবি এবং সেখানেও তিনি নবযুগের প্রবর্তক। প্রাবন্ধিক কবি নজরুলের স্থায়িত্ব নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করেন, পরবর্তী সময়ে তা অভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে, ‘‘তাঁর পরবর্তী কয় বছরের বাঙলা কাব্য সাহিত্যের খতিয়ান নিলেই মনে হবে যে সেই পথ ধরেই বাঙলা কাব্য সাহিত্য এগুচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও এগুবে।”
ভাষা ও সাহিত্য গ্রন্থের দুটি প্রবন্ধে — ‘কবি নজরুল’, ‘ঔপন্যাসিক নজরুল’ — মুহম্মদ আবদুল হাই নজরুল প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। ‘কবি নজরুল’ প্রবন্ধে নজরুলকে বাংলাদেশের ক্রান্তিকালের কবি। তিনি এক বিশেষ যুগের চারণ কবি। কিন্তু যুগ শেষ হবার এবং উদ্দেশ্য সফল হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আবেদন শেষ হয়ে যায় না। এই প্রবন্ধে নজরুল ইসলামের সমগ্র কবিকর্মের ধারাবাহিক ও সুসম্পাদিত প্রকাশনার দাবী জানান প্রাবন্ধিক।
‘ঔপন্যাসিক নজরুল’ প্রবন্ধে ঔপন্যাসিক নজরুল ইসলামের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন হাই। বাঁধনহারা, কুহেলিকা, মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের উল্লেখ করেন যে এগুলো স্পষ্টই ব্যতিক্রম। সাহিত্য সমালোচনার মানদণ্ডে কাহিনি নির্মাণ, চরিত্র চিত্রণ, ঘটনা সংস্থান প্রভৃতি বিষয়ে যে ঐক্য ও বৈশিষ্ট্য উপন্যাসে থাকার কথা নজরুলের উপন্যাসে তা নেই বলে উল্লেখ করেন প্রাবন্ধিক। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন যে এই ‘ত্রুটি’ই তাঁর বৈশিষ্ট্য। ভাষার ওপরে নজরুলের অধিকার ছিল উল্লেখ করে হাই বলেন যে বাক্যবিন্যাসে কৃষ্ণনগরের বাগভঙ্গি, চটুলতা এবং ইডিয়ম অনায়াসে ব্যবহার করে ভাষার প্রাণশক্তি ও ধারণ-ক্ষমতা তিনি যেমন বাড়িয়েছেন তেমনি কাব্যিক বর্ণনায় ভাষাও হয়েছে অপরূপ ভাবে লীলায়িত। মুহম্মদ আবদুল হাই নজরুল-উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের পূর্ণ ব্যক্তিত্ব প্রস্ফুটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
‘কবি শাহাদাৎ হোসেন’ প্রবন্ধ ঔপন্যাসিক, কবি, নাট্যকার শাহাদাৎ হোসেনের সাহিত্যকৃতির আলোচনা। প্রাবন্ধিক শাহাদাৎ হোসেনকে মীর মশাররফ হোসেনের উত্তরসাধক আখ্যায়িত করেন। হাই সমালোচনা করে বলেন শাহাদাৎ হোসেন যতবড় শব্দকুশলী কবি ছিলেন, তার সৃষ্ট সাহিত্যে ততটা ব্যাপ্তি ও গভীরতা দেখা যায় না। বাংলা সাহিত্যে তিনি কতকাল টিকে থাকবেন ভাবী কালই তার বিচার করবে বলে উল্লেখ করেন প্রাবন্ধিক।
‘বাংলা সনেটের পটভূমি’ প্রবন্ধে সনেট সম্বন্ধে সবিস্তার আলোচনা স্থান পেয়েছে। সনেটের স্বরূপ কাব্যিকভাষায় বর্ণনা করেন হাই, “হৃদয় মথিত করিয়া প্রেমের যে মৃদুমধুর গুঞ্জন উত্থিত হয়, যে সূক্ষ্ম ব্যথা ও দীর্ঘ অনুরণন ধক্ষনিত হইয়া ওঠে এবং যাহার ফলে প্রাণের নিভৃত তন্ত্রীটি গভীরভাবে আলোড়িত হইয়া যায়, প্রতিভাশালী কবি হৃদয়ের সেই স্নিগ্ধ গম্ভীর ব্যথাবিহক্ষল মধুর ভাবটিকে বাধাহীন ভাষা ও ছন্দে ব্যপ্ত করিয়া না দিয়া সনেটের ক্ষুদ্র পরিসরে চাপিয়া ধরিয়া রাখিতে চাহেন। এই জন্যই বোধ হয়, প্রতিভাশালী কবিরা নিজের অতি গোপন, নিভৃত নিঃসঙ্গ বাসনা, অতি গভীর ও আলন্তরিক ভাবানুভ’তি প্রকাশের পক্ষে সনেটকেই বাহনরূপে গ্রহণ করিয়াছেন।” প্রাবন্ধিক সনেটকে moments monument আখ্যায়িত করেন।
পাকিস্তানি মান বাংলা তৈরির একটা পরিকল্পনা ছিল; মুহম্মদ আবদুল হাই এর বিরোধিতা করেন।
‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ প্রবন্ধে ইতিহাস, উপন্যাস প্রভৃতি স্পষ্ট বয়ান রেখে ঐতিহাসিক উপন্যাসের স্বরূপ চিত্রিত করেন প্রাবন্ধিক। ইতিহাস নাকি উপন্যাস — কোনটি পড়া বেশি প্রয়োজন? — এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি ধার করেন প্রাবন্ধিক. “দুই-ই পড়ো; সত্যের জন্য ইতিহাস পড়ো, আনন্দের জন্য উপন্যাস পড়ো, কেননা উপন্যাস বা কাব্যে ভুল শিখিলে ইতিহাসে সেই ভুলের সংশোধন হইবে। কিন্তু যে ব্যক্তি ইতিহাস পড়িবার সুযোগ পাইবে না, কাব্যই পড়িবে সে হতভাগ্য। কিন্তু যে ব্যক্তি কাব্য পড়িবার অবসর পােিব না, ইতিহাস পড়িবে, সম্ভবতঃ তাহার ভাগ্য আরও মন্দ।”
বাঙালি মুসলমানের ভাষা কেমন হয়া উচিত; সাহিত্যের ধরনটাও কেমন হবে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন প্রাবন্ধিক ‘আমাদের ভাষা ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে। তাঁর বক্তব্যের সারাংশ পাওয়া এই উদ্ধৃতিতে, “পূর্ববঙ্গের সাড়ে তিন কোটি মুসলমানের সাহিত্য আমাদেরই রচনা করতে হবে। কোরান হাদিস, ফেকা উসুল, শরাহ শরীয়ত মাফিক মুসলিম জীবন যে ভাবে নিয়ন্ত্রিত তার সাহিত্যকেও তদনুবিদ্ধ প্রাণধর্মে উজ্জীবিত হতে হবে। হিন্দুর রামায়ণ মহাভারতাদি, পুরাণ ও গীতা উপনিষদ যেমন তার সাহিত্যের অফুরন্ত উৎস হয়ে রয়েছে এবং হিন্দু যেমন অকাতরে সেখান থেকে ভাব সম্পদ আহরণ করে তার নব যুগের সাহিত্যকে একটা বিরাট মহনীয়তা দান করেছে আমাদের সাহিত্য-সৌধও তেমনি কোরান ও মুসলমানি উপকথার বিরাট চত্বরের উপরেই প্রতিষ্ঠিত হবে।”
‘হিন্দু বাংলার ধর্মান্দোলন ও ঊনবিংশ শতাব্দী’ প্রবন্ধে উনিশ শতকের বাঙালি হিন্দু সাহিত্যিক, ধর্মসংস্কারক ও ভাষাসংস্কারকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে জাতীয় পুনর্জাগরণ হয়েছিল তার আলোচনা স্থান পেয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে প্রাবন্ধিক বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, রামমোহন, রামকৃষ্ণ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের সাধনার কথা বলেছেন।
‘ইসলামের বৈপ্লবিক ভূমিকা’, ‘ইসলামের শাসন সংহতি’, ‘মুসলিম ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থা’, ‘মুসলিম ভারতে স্ত্রী শিক্ষা’ — এই চারটি প্রবন্ধে প্রাবন্ধিকের গভীর ইসলামী চিলন্তার পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে। সুস্থ মানবতাবোধ, মুক্তবুদ্ধি, নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কুসংস্কারহীনতা, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা, যুক্তিবাদ প্রভৃতি ইসলামের বৈপ্লবিকতার কারণ। তিনি আশা করেন: “যে শক্তিতে ইসলাম একদিন পৃথিবীতে বিদ্যুৎগতিতে বিস্তারিত হয়েছিল, পাকিস্তানের মুসলমানেরা সেই শক্তিতেই পাকিস্তানের সত্যকার দারুল ইসলামে পরিণত করুক।”
‘ইসলামের শাসন সংহতি’ প্রবন্ধে ইসলামের মহিমা ও উদারতা, মুসলমানের জীবনচর্চা ও চর্যার বৃত্তান্ত চমৎকার ভাষায় উপস্থাপন করেন। ওজু ও নামাজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:“প্রতিদিনের ওজু ও নামাজের মধ্যে যে শৃঙ্খলা রহিয়াছে, তাহাই মানুষকে যেমন বৃগত্তর শৃঙ্খল পরিবার জন্য প্রস্তুত করিয়া তোলে, তেমনিই বৃহৎ শৃঙ্খলের মধ্যে বৃহত্তর মুক্তির সন্ধানও দিয়া থাকে।” প্রাবন্ধিক ধর্ম ও শিল্পের মধ্যে সামঞ্জস্যের প্রসঙ্গে বলেন যে শিল্পের মধ্যে যে সংযত-শক্তি শিল্পকে বড় করে তোলে, ধর্মের মধ্যেও সেই কঠিন সংহত নিয়ম সংযম ধর্মের প্রাণশক্তিকে স্থায়ী ও অটুট রাখিতে এবং যুগাতীত করে তুলতে সাহায্য করে। প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে যে শৃঙ্খলা দেখা যায়, তা যেমন সংসার কর্মনিরত মানুষকে আত্মোন্মুক্তির সুযোগ দেয়, তেমনই সংসারও যেমন তাদের একেবারে মাটি হয়ে না যায়, তার প্রতি লক্ষ্য রাখে। রোজা প্রসঙ্গে হাই বলেন যে কঠিন পীড়ন, কৃচ্ছ্রসাধন ও নিয়মসংযমে মানুষের শরীর যেমন সুস্থ, সতেজ ও সবল হয়; তেমনি রোজার অতিরিক্ত শৃঙ্খলার জর্জরিত কষাঘাতে মানুষের আত্মা সুস্থ ও সবল হয়। হাই প্রবন্ধের উপসংহারে বলেন, “ইসলামের প্রত্যেক পার্বণ-পর্বে আমরা যে সৌন্দর্য, যে শৃঙ্খলা, শোভা, যে ঔজ্জ্বল্য প্রত্যক্ষ করি, তাহা বাহ্যিক নিয়ম শৃঙ্খলকে অতিক্রম করিয়া তাহার আভ্যলন্তরীণ সৌন্দর্যকে এমনি শালন্তভাবে প্রকাশ করিয়া থাকে।.. ইসলামকে জানিতে হইলে, তাহার প্রত্যেক পর্বের সেই আভ্যলন্তরীণ প্রশালন্তজ্যোতি ও স্থির মৌন গাম্ভীর্যের ভিতর দিয়াই তাহাকে জানিতে হইবে।”
ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে হাই যেন ‘জ্বলে উঠেছেন’। এই লেখাগুলোতে তাঁর স্বকীয়-চিন্তা ও ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে।
মুহম্মদ আবদুল হাই ‘মুসলিম ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থা’, ‘মুসলিম ভারতে স্ত্রী শিক্ষা’ প্রবন্ধে মুসলমানদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি, নারী শিক্ষা প্রভৃতি নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি তৎকালীন ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে এদেশের শিক্ষাপদ্ধতির তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতির সমালোচনা করে হাই বলেন যে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় এদেশে কয়েকজন ধনী সন্তান ও ভাগ্যবান ছাড়া সর্বসাধারণের ভাগ্যে কেরানি হওয়া ছাড়া উপায় নেই। অন্যদিকে পূর্বের মুসলমান আমলের শিক্ষা-পদ্ধতির শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে প্রাবন্ধিক নিঃসন্দেহ, “মুসলমান আমলে এমন জাঁকালো বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ত ছিলনা, অল্প খরচে এমনকি বিনা খরচে সাধারণ লোকের সন্তান সলন্ততি লেখাপড়া শিখিতে পারিত।এখনকার মত শিক্ষার নামে সরকারী চাকুরীরর আশায় উপাধি মুখে করিয়া শিক্ষায়তন হইতে হয়ত বাহির হইত না, কিন্তু যেটুকু লেখাপড়া শিখিত, তাহাতে তাহাদের জীবনে সর্ববিধ উপকার ও প্রয়োজন সাধিত হইত। দেশ ও কালের জন্য যেটুকু প্রয়োজন তাহা শিক্ষার্থীদিগকে শিখিতেই হইত। এমন পরীক্ষাও ছিল না এবং পরীক্ষা পাশের জন্য ব্যাঙের ছাতার মত নানারকমের ‘নোট’, ‘ডাইজেষ্ট’ও ছিল না, সেইজন্য শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় অনুশাসনে নৈতিক, মানসিক, সাংসারিক, আর্থিক ও ব্যবহারিক যাবতীয় উন্নতির জন্য অনুরূপ পাঠ্যতালিকা ও পঠন পাঠনের বিধান নির্ধারিত ছিল।” একটা বিষয় স্পষ্ট যে একালের শিক্ষা-পদ্ধতির অলন্তঃসারশূন্যতায় লেখকের ক্ষোভ প্রকাশ পেলেও তাঁর আলন্তরিকতার অভাব নেই; কোথাও তিনি ভাবাবেগ দ্বারা তাড়িত হননি।
‘মুসলিম ভারতে স্ত্রী শিক্ষা’ প্রবন্ধে মুসলিম-ভারতে নারী শিক্ষার অবস্থা কেমন ছিল তার আলোচনা করেছেন হাই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমাজের গুটিকয়েক মানুষ বিদ্যালাভ করে ; এতে সমাজের বৃহত্তম অংশের অংশগ্রহণ থাকেনা। ফলে পূর্ণ সুফল পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় সমাজের অর্ধেক অংশ/অঙ্গ নারীর যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকলে অবস্থা কত শোচনীয় হতে পারে তার কথা বলেন প্রাবন্ধিক। এ প্রসঙ্গে তিনি মুসলিম-ভারতে নারী শিক্ষার পরিচয় প্রদানের জন্য তিনি কিছু উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে ভারতের বাইরে মুসলিম নারীরা শিক্ষা ও সাহিত্যসাধনায় যে স্তরে পৌছেছিলেন, ভারতীয় নারীরা সে অবস্থায় পৌছাতে না পারলেও মুসলিম-শাসনামলে তাদের অবস্থান উন্নত ছিল। দিল্লির সুলতান এবং তাঁদের অধীনস্থ অনেকেই স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য প্রাণপন চেষ্টা করেছিলেন। অনেক বারিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। হীনওয়ার সুলতান, মালওয়ার সুলতান, সম্রাট আকবর প্রমুখের স্ত্রীশিক্ষার প্রতি অনুরাগের কথা বলেন হাই। আলাউদ্দীন জাহান সোজের দৌহিত্রী মাহ্মালিক, দাক্ষিণাত্যের প্রধানা নায়িকা চাঁদসুলতানা, সম্রাট বাবরের কন্যা গুলবদন বানু, সম্রাট হুমায়ুনের ভ্রাতুষ্পুত্রী সলিমা সুলতানা, সম্রাট আকবরের দুধ-মা আনকাহ, সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহান, সম্রাট সাজাহানের স্ত্রী মমতাজমহল, সম্রাট সাজাহানের কন্যা জাহানারা, জাহানারার শিক্ষয়িত্রী সাতিউ্ননেসা, সম্রাট সাজাহানের চতুর্থী কন্যা জাবিন্দা বেগম, সম্রাট আওরঙ্গজেবের কন্যা জেবুন্নেসা প্রমুখ সুশিক্ষিতা মহীয়সী নারীর কথা উল্লেখ করেন প্রাবন্ধিক।
ভাষা ও সাহিত্য (১৯৬০) গ্রন্থটিতে আছে ২৯ টি প্রবন্ধ। এর মধ্যে আটটি ভাষা বিষয়ক এবং একুশটি সাহিত্য বিষয়ক। ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলো হল: ‘ভাষা ও সমাজ-জীবন’, ‘আমাদের সাহিত্যের ভাষা’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যে ভাষার অনুশীলন’, ‘বাংলা ভাষা ও তার পঠন-পাঠন’, ‘আমাদের বাংলা উচ্চারণ’, ‘রোমান বনাম বাংলা হরফ’, ‘বাংলা সাহিত্যে পুরনো ধারার লেখক ও আরবী-ফারসী শব্দের ব্যবহার’, ‘সীমালেন্তর ভাষা ও সাহিত্য’। সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ: ‘পূর্ব পাকিস্তানের তামদ্দনিক সংগঠন’, ‘পুঁথি ও পুঁথির ভাষা’, ‘পুঁথি সাহিত্য ও কাসাসোল আম্বিয়া’, ‘ পুঁথি সাহিত্য ও আলেফ লায়লা’, ‘ভারতচন্দ্রের মানসিংহ’, ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’, ‘নদী বক্ষে’, ‘জমিদার দর্পণ’, ‘গিরিশ ঘোষ, ডি.এল রায় ও ক্ষীরোদ প্রসাদ’, ‘যুগচিত্ত ও গিরিশ-প্রতিভা’, ‘কবি কায়কোবাদ’, ‘কবি নজরুল’, ‘ঔপন্যাসিক নজরুল’, ‘কবি জসিমউদ্দীন’, ‘আমাদের নাট্য সাহিত্য’, ‘বৈষ্ণব কাব্যে প্রেম’, ‘বাংলা কাব্যে নৈরাশ্যবাদ’, ‘উর্দু কবিতার জন্মকথা ও কবি হালী’, ‘পাকি¯ানের জাতীয় কবি ইকবাল’, ‘ইকবালের মোমেন’, ‘ইকবালের বাণী’।
ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে হাই যেন ‘জ্বলে উঠেছেন’। এই লেখাগুলোতে তাঁর স্বকীয়-চিন্তা ও ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। গ্রন্থের ভূমিকাতেও প্রাবন্ধিক যেন ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলোর কথাই মনে করিয়ে দেন, “আমার লেখা ভাষা-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলো পাঠকেরা যাতে এক জায়গায় পেতে পারেন, সেজন্যে আমার পূর্বপ্রকাশিত ‘ভাষা ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থের ‘ভাষা ও সমাজ-জীবন’ শীর্ষক প্রবন্ধটি এখানে পুনর্মুদ্রিত হলো।” গ্রন্থের প্রবন্ধের সংখ্যা যখন ঊনত্রিশ; প্রাবন্ধিক ভাষা-বিষয়ক আটটি প্রবন্ধের কথা বলছেন বিশেষভাবে; তখন এগুলোর প্রতি তাঁর বিশেষ দরদের খবর গোপন থাকেনা। ‘ভাষা ও সমাজ-জীবন’ প্রবন্ধে সমাজজীবনে ভাষার বিভিন্ন ভূমিকার কথা বলে তিনি বলেন, “ ভাষাই মানুষের সমাজ জীবন স্থির করছে; সম্বন্ধ পাতানো, সম্বন্ধের লালন ও বৃদ্ধি এবং সমাজ জীবনের দৈনন্দিন নানা কায়কারবার সম্ভব হচ্ছে ভাষার মাধ্যমে। কোনো এক সমাজের পরিবেশ বিশেষ থেকে ভাষাকে এমনভাবে ধনংঃৎধপঃ বা আলগা করতে পারলে দেখা যাবে ভাষা যত না চিলন্তার বাহন তারও চেয়ে বেশী মানুষের সমাজ জীবন রচনার একমাত্র সহায়ক।
‘আমাদের সাহিত্যের ভাষা’ প্রবন্ধে মুহম্মদ আবদুল হাই বলেন যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি বিষয়ের কৌতূহল জাগে; সেটি হল আমাদের সাহিত্যের ভাষা কেমন হবে? হাই বলেন যে, দেশবিভাগের ফলে বাংলা ভাষার দু-অঞ্চলের মধ্যে বিভক্তি এমনকি বিকৃতি জন্মেছে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ভাষাকমিটি প্রচলিত আরবি, ফারসি শব্দকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দুর্বোধ্য ও দুরুচ্চারিত সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের পরওয়ানা জারি করেছে; পূর্ব পাকিস্তানেও তেমনি আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহারে কিছু অতিরেক ও অতিরঞ্জনের ঘটনা ঘটছে। হাই বাংলা ভাষার হিন্দুকরণ বা ইসলামিকরণ — উভয়ের বিরোধিতা করেন। কারণ তিনি মনে করেন ভাষার স্বাভাবিক গতিপথে এসব বাধা টিকবে না। তিনি রাজনৈতিক-রাজত্ব-মুক্ত স্বাধীন বাংলা ভাষার প্রার্থনা করেছেন।
বর্তমানে সাধুরীতি ও চলিতরীতি — দুটি মান বাংলা ভাষা চালু আছে। এ দুটিই সৃষ্টি হয়েছে কলকাতাকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানি মান বাংলা তৈরির একটা পরিকল্পনা ছিল; মুহম্মদ আবদুল হাই এর বিরোধিতা করেন। নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যে ভাষার অনুশীলন’ প্রবন্ধে বলেন যে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে কলকাতা ও তার পাশের অঞ্চলের উপভাষায় দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সব বাঙালি সাহিত্যিকই সাহিত্যচর্চা করে আসছেন। এই ভাষার বিস্তার লাভ করেছে উভয় অঞ্চলেই। বিভিন্ন উপভাষার ঐতিহ্যকে তিনি স্বীকার করেন। তিনি জানতেন নতুন মান বাঙলা সৃষ্টি শুভ নয়। তাই তিনি সিদ্ধালেন্ত পৌছান, “পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা গদ্যের রূপায়ণে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বহুকাল ধরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বহু লোকের অনুশীলিত সেই ষ্ট্যাণ্ডার্ড ডাইলেক্টকেই আমাদের সাহিত্যেরও নধংব তথা মূলভিত্তি হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া গত্যলন্তর দেখি না।” তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যে ভাষার অনুশীলন’ প্রবন্ধে প্রখ্যাত লেখক ও কবিগণের বিভিন্ন উদ্ধৃতি ব্যবহার করে আলোচনাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
‘আমাদের বাংলা উচ্চারণ’ প্রবন্ধ পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চারণের মানদণ্ড নিয়ে আলোচনা। বাংলা উচ্চারণ নিয়ে তাঁর দৃঢ় সিদ্ধান্ত, “চলিত উচ্চারণকে যাঁরা কলকাতা, শান্তিনিকেতন তথা পশ্চিমবাংলা ভিত্তিক বলে বর্জন করতে চান, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। এ উচ্চারণ পণ্ডিমবাংলা ভিত্তিক হলেও প্রাক্-আজাদী যুগের বহু জিনিসের মত আমরা এর উত্তরাধিকারী।”
বাংলা ভাষার হরফকে রোমান হরফে লেখার একটি প্রস্তাব উঠেছিল। বাংলা ভাষার জন্য তথা ভারতীয় অন্যান্য ভাষার জন্যও রোমান লিপি/হরফ প্রবর্তনের দাবী উঠলে মুহম্মদ আবদুল হাই এ বিষয়ে ‘রোমান বনাম বাংলা হরফ’-শীর্ষক প্রবন্ধটি রচনা করেন। দেশভাগের পর নতুন রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নতুন ভাষা প্রবর্তনের কথা ভাবতে গিয়ে কেউ কেউ রোমান লিপি প্রবর্তনের কথা বলেছিলেন। মুহম্মদ আবদুল হাই এ প্রবন্ধে তুলনামূলক ধ্বনিতত্ত্ব, লিপিতত্ত্ব পাঠজাত অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করে মতামত দেন যে বাংলার জন্য রোমান হরফ প্রবর্তন কোনো সুফল বয়ে আনবে না। প্রয়োজনে বাংলা লিপির সামান্য সংস্কার করা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। রোমান হরফের প্রবর্তনের পক্ষে প্রদর্শিত নয়টি যুক্তিকে তিনি খণ্ডন করে এর বিপক্ষে রায় দেন।
‘বাংলা ভাষা ও তার পঠন-পাঠন’ প্রবন্ধে তাঁর বক্তব্যের সারাংশ, “পরিভাষা সৃষ্টির পথে আমরা যদি মুক্ত মন নিয়ে এগুতে পারি তা হলে আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ হবেই। সময় এসেছে, বাংলা ভাষায় পঠন-পাঠন ও উন্নয়নের জন্য সুচিলিন্তত পরিকল্পনা নিয়ে এমনি ভাবে আজ আমাদের ইগয়ে যেতে হবে।” ‘বাংলা সাহিত্যে পুরনো ধারার লেখক ও আরবী-ফারসী শব্দের ব্যবহার’ প্রবন্ধে হাই বলেন যে ভাষা সমাজ-জীবনকে যতটুকু প্রভাবান্বিত করে, সমাজ ভাষাকে প্রভাবান্বিত করে তার চেয়েও বেশি। রাষ্ট্রের শাসন-ব্যবস্থার প্রভাবে ভাষার বিবর্তনের পথ নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। পাঠান মোগল আমলে তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির রূপায়ণে অগণিত আরবি, ফারসি ও তুর্কি শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ লাভ করে। প্রাবন্ধিক রামরাম বসুর প্রতাপাতিদ্য চরিত্র, প্যারিচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল, কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম পাঁচার নক্সা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায়ের প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলা থেকে উদাহরণ দিয়ে তাঁদের লেখায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার দেখান।
ভাষা ও সাহিত্য গ্রন্থভুক্ত সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত এবং এগুলোতে প্রাবন্ধিক পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেননি বলে মনে হয়। এ পর্যায়ের প্রবন্ধগুলির বিষয়ের দিকে তাকালে দেখা যায় পুঁথি সাহিত্য থেকে শুরু করে কাজী নজরুল ইসলাম, জসিমউদ্দীন পর্যলন্ত এর ব্যাপ্তি। উর্দু কবি ও কবিতার, ইকবাল প্রভৃতির আলোচনাও স্থান পেয়েছে এই গ্রন্থে।
তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা (১৯৫৯) গ্রন্থে স্থান পেয়েছে ২৩ টি রচনা। এর মধ্যে সাতটি ভাষা বিষয়ক: ‘ভাষার কথা’, ‘কথা শেখা’, ‘ধ্বনির ব্যবহার’, ‘ভাষা ও ব্যক্তিত্ব’, ‘সুভাষণ’, ‘তোষামোদের ভাষা’, ‘রাজনীতির ভাষা’। অন্যান্য রচনাগুলো হল: ‘সামনের মাস’, ‘ওরা ও আমরা’, ‘যুগস্রষ্টা জিন্নাহ’, ‘রস’, ‘এই জিন্দেগীর ঈদ’, ‘সুন্দরের নিমন্ত্রণ’, ‘সুন্দর লোকে’, ‘মহাভয় ও মহৎগুণ’, ‘কৈফিয়ৎ’, ‘সাহিত্যিকের জবানবন্দী’, ‘ওস্তাদজী’, ‘বেসুর’, ‘ভেলুয়া সুন্দরী ও আবু সওদাগর’, ‘তিস্তা’, ‘সুরমা’, ‘শিলংএ মে মাস’। গ্রন্থাকারে এটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু এখানে সংকলিত প্রবন্ধগুলির রচনাকাল ১৯৪০-১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।
ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলি মূলত ধ্বনি ও ভাষা বিষয়ক। মুহম্মদ আবদুল হাই বৈজ্ঞানিকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে ধ্বনি ও ভাষা ব্যবহারের প্রকরণ নির্ণয় করেছেন। গাম্ভীর্যপূর্ণ ও জটিল বিষয়বস্তু হওয়া সত্ত্বেও আলোচনার গুণে তা পাঠকের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পায়। ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই এখানে সরস ও প্রাঞ্জল ভাষায় তার গবেষণালব্ধ আলোচনা সুলিখিত আকারে পেশ করেছেন। সহজ উপমা দিয়ে তিনি দুরূহ বিষয়কে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাই ভাষা ও ধ্বনির আলোচনা কখনো কখনো খুবই সরস লাগে, যেন তিনি গল্প বলছেন।
‘ভাষার কথা’ প্রবন্ধে মানুষের জীবনে ভাষার স্থান নির্নয় করেছেন প্রাবন্ধিক। ভাষার মূলে আছে কতগুলো অর্থবোধক ধ্বনি। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মানুষ বিভিন্ন ধ্বনিসমষ্টি নিয়ে গঠিত এক একটি ভাষার সাহায্যে নিজেদের মনেরভাব প্রকাশ করছে। প্রাবন্ধিকের সহজ উচ্চারণ:“ আমি যে ধ্বনি সমষ্টিকে সাজিয়ে আমার কথা বলছি, তা যেমন দুনিয়ার সাত কোটি আমার ভাষা-ভাষী বাঙালী বুঝছেন এটা বাংলা ভাষা, তেমনি নানা দেশের নানা ধ্বনি মূলের সমষ্টি নানান ভাষা।”
বোবা, কালা ও তোতলা মানুষেরা আমাদের সমাজে উপহাস বা কৃপার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকে। ‘কথা শেখা’ প্রবন্ধে মুহম্মদ আবদুল হাই শারীরিক দিক থেকে অক্ষম ঐসব মানুষের কথা বলেছেন। উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি বলেন যে আমাদের দ্বারা অবহেলিত ঐ মানুষগুলো কতই না মনোকষ্টে ভোগে। কাউকে প্রশ্ন করা হলে ইচ্ছাকৃতভাবে যদি কেউ তার উত্তর না দেয়, তাহলে প্রশ্নকারী ব্যক্তির মনে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে। তাহলে যারা জন্মগতভাবে শুনতে ও বলতে পায়না, ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারেনা মনের কথা, তারা কতটা মনোবেদনায় ভোগে! — হাই এঁদের প্রসঙ্গ তুলে ধক্ষনির প্রয়োজনীয়তা, ধ্বনি-ব্যবহারের বিভিন্নতা ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করেন।
‘ধ্বনির ব্যবহার’ প্রবন্ধে ধক্ষনির ব্যবহারিক দিক নিয়ে আলোচনা করেন প্রাবন্ধিক। হাই তাঁর নিজের জীবনের দুটি সরস ঘটনার উল্লেখ করে মূল কথাকে ‘পরিষ্কার করে বুঝিয়ে’ বলেন যে, ধ্বনির মধ্যে, কথার মধ্যে নিয়মের তথা শৃঙ্খলার আবিষ্কারই ধ্বনিজ্ঞিানের প্রধান কাজ; আর এ কাজটি ধ্বনি বৈজ্ঞানিকের। তিনি বলেন, যাদের কথা স্পষ্ট হয়না অর্থাৎ তোতলা; গভীর সহানুভূতি ও ধৈর্যের সঙ্গে উপযুক্ত ব্যায়াম করিয়ে তাদের এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে তিনি ইউরোপ, আমেরিকার মনোবিজ্ঞান, ধ্বনিবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞান একযোগে কাজ করে বহু রোগীর রোগমুক্তির কথা উল্লেখ করেন। প্রাবন্ধিক চমৎকার আশা রেখে প্রবন্ধে রেখেন, “আমার মনে হয়, আমাদের দেশের অলন্ততঃ শিক্ষিতা মেয়েরা যদি এক একটি ক্ষুদে ধক্ষনিবৈজ্ঞানিক হতেন, তাহলে তাঁদের শিশুদের উচ্চারণ শুধরে দিতে পারতেন — আর সেরকম হলে বহুকাল ধরেই আমাদের মুখের ভাষার শ্রী, শালিনতা ও সৌন্দর্য বজায় থাকতো।”
‘ভাষা ও ব্যক্তিত্ব’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞায় বলেন, ব্যক্তিত্ব একটা চেতনা, যা একজন মানুষের জীবনের অতীত ও বর্তমানকে একসঙ্গে গ্রথিত করে। মানুষের আচার-ব্যবহার, চালচলন, পোশাক-আশাক, মুখভঙ্গি, চোখের চাহনিতে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালনে তার স্বকীয়তা ধরা পড়ে। এই স্বকীয়তাই তার ব্যক্তিত্ব নির্দেশ করে। মুহম্মদ আবদুল হাই বলেন এসবের মাধ্যমে একজন মানুষকে কিছুটা জানা গেলেও সবটা জানা সম্ভব নয়। প্রাবন্ধিকের ভাষায় সবটুকুর পরিচয় পাওয়া যাবে মানুষের ভাষায়, ভাষা ব্যবহারের ভঙ্গিতে, শব্দ চয়নে, তার শিক্ষাদীক্ষায়, তার কন্ঠস্বরের ওঠা নামায়, বাক্যের ছন্দস্পন্দনে — মোটকথা সে যে ভাবে কথা বলে তারই ভেতর দিয়ে।
‘সুভাষণ’ প্রবন্ধে তিনি অবস্থাভেদে পোশাক পরিচ্ছদের হেরফের হলে কেমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তার বর্ণনা করেছেন, “একটি ছবি কল্পনা করুন — এজলাসের হাকিম লুঙ্গি পরে, মালকোচা মেরে, মাথায় মাথল দিয়ে এজলাসে গিয়ে বসেছেন। এ অবস্থায় উকিল মুহুরী ও আসামী ফরিয়াদীরা তাদের আপন আপন কাজ করবে, না তার সং সাজা দেখে তার চার পাশ ঘিরে মউজ করবে।” তিনি বলেন সমুদ্রস্নানের পোশাক পরে অফিসে আসলে তা কতটুকু ভদ্রজনোচিত হবে? আসলে এ ধরণের সামাজিক বাধা নিষেধ (taboo) রুচি ও স্থান কাল পাত্র ভেদে প্রত্যেক সমাজেই আছে। সমাজ ও ভাষাভেদে এ বাধানিষেধগুলোর এক একটা ব্যবহারিক নাম আছে। কথার সাহায্যেই এ বাধা নিষেধগুলো প্রকাশ করা হয় বলেই ভাষার সঙ্গে এদের আণ্ডর্য সম্পর্ক আছে। সাধারণ মানুষ যেগুলোকে অনাচরণীয় আচরণ বলে মনে করে সেগুলো যখন আপন পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়, তখন নিতালন্ত নিরাবরণ ও নিরাভরণ রূপে প্রকাশ করে থাকে। এগুলোই যখন ভদ্র সমাজে উল্লেখ করতে হয় তখন ভদ্রভাবে তাদের নামকরণ করতে হয়। আপাত অভদ্র জিনিসগলোর ভদ্র প্রকাশের সাধারণ নাম দেওয়া যায় ‘ভদ্রভাষা’; হাই বলেন যে এগুলোর পারিভাষিক নাম “সুভাষণ’ (Euphemism)। ইংরেজ সমাজে ষধঃৎরহব এর নাম বিভিন্ন সুভাষণে অভিষিক্ত হয়ে হয়েছে প্রিভি, ওয়াটার ক্লোসেট, টয়লেট, রেস্টরুম; কখনো তা শুধুই Gentlemen বা ladies। বাংলাতে আমরা ব্যবহার করি ‘প্রাতঃক্রিয়াদি করা’, ‘প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া’, ‘বাইরে যাওয়া’, ‘বাইরে থেকে আসা’ কিংবা ‘ছোট’ কি ‘বড়’ কিংবা ‘ছোট হাজারী’, ‘বড় হাজারী’ ইত্যাদি। প্রাবন্ধিক বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন সুভাষণের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে কণ্ঠস্বরের ওঠানামায় একটি বাক্য সুভাষণ কিংবা ‘মারাত্মক’ হতে পারে।
‘তোষামোদের ভাষা’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বলেন যে তোষামোদ ও প্রশংসার ভাষার মধ্যে ব্যবধান খুব অল্প। এ ভাষার স্থূল প্রয়োগ যদি তোষামোদের হয়, তাহলে এর সূক্ষ্ম ও মধুর প্রয়োগ হবে প্রশংসা ও বন্দনার। সমাজজীবনে প্রতিদিনের ব্যবহারে যা স্থূল তাকে মার্জিত করে কাব্যে প্রয়োগ করলে তার সাহায্যে সুমধুর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে হাই মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যের প্রখম ও চতুর্থ সর্গ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আবেদন’, ‘সাধনা’ কবিতা, শেষের কবিতা প্রভৃতি থেকে উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করেন।
‘রাজনীতির ভাষা’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিকের বক্তব্য, “ভাষা মানুষের আশা আকাক্সক্ষার ও ভাবনাচিলন্তার বাহন। মানুষের চিলন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হলেই সেই চিলন্তার আধার তথা ভাষার গভীরতর রহস্য আমরা উদ্ঘাটন করতে পারি। রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য এক এক দেশে আমরা বহুরকম রাজনৈতিক চিলন্তাধারার বিকাশ দেখি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার জন্যে প্রত্যেকটি দলই দেশের অধিবাসীদের কাছে তাদের আদর্শ ও কর্মসূচী নিয়ে উপস্থিত হয় আর সাধারণকে তাদের মতে দীক্ষিত করার জন্যে ভাষার সাহায্যেই জোর প্রচারণা চালায়। অন্যকথায়, ভাষা রাজনৈতিকদের হাতের পুতুল হয়ে ওঠে। সে ভাষা দিয়ে তাঁরা তাঁদের নিজের বক্তব্য যেমন প্রচার করিয়ে নেন, তেমনি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অপপ্রয়োগ করতেও কুন্ঠিত হন না।” প্রাবন্ধিক উদাহরণ প্রদানের মাধ্যমে বিষয়টিকে স্পষ্ট করেন।
তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা (১৯৫৯) গ্রন্থে ভাষা বিষয়ক সাতটি প্রবন্ধ ছাড়াও সংকলিত হয়েছে কয়েকটি গল্প এবং বিচিত্র প্রসঙ্গে নানা কথা। রচনাগুলো হল: ‘সামনের মাস’, ‘ওরা ও আমরা’, ‘যুগস্রষ্টা জিন্নাহ’, ‘রস’, ‘এই জিন্দেগীর ঈদ’, ‘সুন্দরের নিমন্ত্রণ’, ‘সুন্দর লোকে’, ‘মহাভয় ও মহৎগুণ’, ‘কৈফিয়ৎ’, ‘সাহিত্যিকের জবানবন্দী’, ‘ওস্তাদজী’, ‘বেসুর’, ‘ভেলুয়া সুন্দরী ও আবু সওদাগর’, ‘তিস্তা’, ‘সুরমা’, ‘শিলংএ মে মাস’।
‘ওস্তাদজী’ গল্পটি এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের জীবের প্রতি দয়ার মহাবয়ান। নিঃসঙ্গ মানুষটি অসহায় মূক প্রাণীদের কষ্টকে ধারণ করে শুধু টিয়া, পাঁচটি বিড়ালের মন জয় করেননি; গল্পটির পাঠকমাত্রকেই ছুঁয়ে যায়। নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ, বৃদ্ধের জীবনের অবলম্বন সেই ফুটফুটে সাত বছরের মেয়েটি, কান কাটা-পা ভাঙা-লেজে আঘাত পাওয়া কয়েকটি বিড়াল এবং ‘পিরু’ নামের টিয়াপাখিটির জন্য পাঠকের মনে দয়ার উদ্রেগ হবে — একথা জোর দিয়ে বলা যায়। এর জন্য ‘ওস্তাদজী’ গল্পটির লেখক মুহম্মদ আবদুল হাই প্রশংসা পাবার যোগ্য। তিনি গল্প লেখায় যদি পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করতেন তাহলে ‘ওস্তাদ গল্পকার’ হিসেবে তিনি নিণ্ডয়ই প্রতিষ্ঠা পেতেন। ‘ওস্তাদজী’ গল্পটি জন গলস্ওয়ার্দির (১৮৬৭-১৯৩৩) (Ultima Thuleগল্পের ছায়া অবলম্বনে লিখিত হয়েছে। কিন্তু এই গল্পে হাই বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ‘পিরু’ যে শেষ পর্যলন্ত তার আশ্রয়দাতার মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান, শব্দের ওস্তাদিতে তা প্রকাশ করেছেন, “ঘরে গিয়া দেখিলাম তাঁহার শবদেহের উপরে একটা সাদা চাদর পাতা রহিয়াছে! আর তাঁহার বুকের উপর বসিয়া থাকিয়া সেই তোতাপাখীটি মৌনগাম্ভীর্যে তাঁহার মুখের উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ করিয়া রহিয়াছে। সেই রজতশুভ্র চুলগুলির মতো তাঁহার মৃত্যুকাতর মুখটিও পাংশুল, বিবর্ণ।” আবার গল্পের শেষে ‘পিরু’র মৃত্যুসংবাদ দিয়েছেন আয়োজন করে — প্রথমে তোতাপাখির শূণ্য খাঁচাটির কথা বলে পাঠককে উৎসুক করে তোলেন; এরপর বর্ণিত হয় শোকসংবাদটি, “কাল সকালে যখন ওগুলো আনতে পাঠাই তখন আমার লোকেরা গিয়ে দেখে মৃত্যুস্নাত আমার শিল্পীবন্ধুর বুকের উপরেই সেই পাখীটা মরে রয়েছে — নিঃস্পন্দ, নিঃসাড়। আশ্চর্য!”
মুহম্মদ আবদুল হাই ‘শিলংএ মে মাস’ রচনাটি লেখেন ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে। অল্পবয়সে (২১ বছর) লেখা এই বর্ণনামূলক লেখাটিতে আকাশ, আলোক, পৃথিবী অপরূপ হয়ে দেখা দেয় লেখকের চোখে। মুহম্মদ আবদুল হাই-এর ভ্রমণ-কাহিনি ধাঁচের অলন্তরঙ্গ রচনা লেখার অনুশীলন যেন এই রচনাটি। বিলেতে সাড়ে সাত শ দিন গ্রন্থে এই ধরনের লেখার পরিস্ফূটিত রূপ। ‘শিলংএ মে মাস’ রচনাটি একদিকে কবি কল্পনার সুরভী মাখানো এবং অন্যদিকে ভাষা ও শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগে সমৃদ্ধ। হাই শিলং পাহাড়ের স্বচ্ছ জলধারা প্রত্যক্ষ করে মনে যে অনাবিল আনন্দরস সঞ্চয় করেন তা হৃদয়গ্রাহী ভাষায় প্রকাশ করেন, “ভাবিলাম মানুষের মন ঝর্নার ‘মঞ্জুল’ ও হাসির বেলোয়ারী আওয়াজে’ আত্মভোলা না হইয়া পারেনা। সেই একই শব্দ অনন্তকাল ধরিয়া উত্থিত হইতেছে। পাষাণের স্নেহধারা শুভ্র ও সফেন তুষারের বিন্দুর মত নীরাকারে রামধনু ঝলকিত হইয়া উৎক্ষিপ্তা ও চঞ্চলা হইয়া উঠিয়াছে।”
‘কৈফিয়ৎ’ শীর্ষক প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক মুহম্মদ আবদুল হাই মানুষের অসীম শক্তির জয়গান গেয়েছেন। কিন্তু মানুষ অলসতায় তার মূল্যবান সম্ভাবনা নষ্ট করতে পারে। প্রাবন্ধিকের ভাষায় : “অসম্ভব শক্তির অধিকারী এই মানুষ যে যার কাজে সেই শক্তির প্রকাশ ঘটাতে পারে, তবু সকল সময়ে পারে না, না পারার কারণ হাল্কা তালে লঘু ছন্দে ভেসে যাওয়ার প্রীতিতে; এই আলস্য-প্রীতি … এর কবল থেকে মানুষের মুক্তি প্রয়োজন, নইলে উদ্ধার নেই।”
‘রস’ প্রবন্ধে লেখক রসের প্রকারভেদ সরস ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তিনি দুই প্রকার রসের কথা বলেন — মানুষের ব্যবহারিক রস ও সাহিত্যের রস। ব্যবহারিক জীবনে জিহ্বার দ্বারা তেতো, কটু, কষ, ঝাল, লবণাক্ত রসের স্বাদ গ্রহণ করে মানুষ। সাহিত্যের রস সম্পর্কে তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন যে শৃঙ্গার, বীবৎস, হাস্য, বীর, রুদ্র, ভয়, করুণ, অদ্ভুত ও শালন্ত — এই নয় প্রকার রস পাওয়া। উদাহরণসহ বিভিন্ন রসের আলোচনা তিনি করেছেন। “ক্ষণিক মিলনে ওগো পরম সুন্দর/ তোমারে লাগিল কেন এত মনোহর।” — উদাহরণের বরাত দিয়ে হাই বলেন যে শান্তরস হল শ্রেষ্ঠরস।
বাঙালি ছাপোষা কেরাণীর জীবনের এক করুণ চিত্র রূপায়িত হয়েছে ‘সামনের মাস’ রচনাটিতে। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও কেরাণীর অভাব ঘোচেনা। স্ত্রী-ছেলেমেয়ের প্রয়োজনকে মেটাতে না পেরে তাই তাকে সামনের মাসের অজুহাত দেখাতেই হয়। বিরক্ত গিন্নি তাই বলে ফেলে হায়রে তোমার সামনের মাস। আপাত দৃষ্টিতে একজন মানুষের জীবনের আখ্যান মনে হলেও মুহম্মদ আবদুল হাই-এর দৃষ্টি সমষ্টির সমস্যার দিকে; তিনি তাই বলেন: “বাংলার আজ দুর্দিন। সকল বাঙালীরই। যাদের নয় তারা ত সমাজের পরগাছা।… এ মাস ও এ দিন এই পরগাছাদের; কিন্তু সামনের মাস গরীবের।”
‘সুন্দরলোকে’, ‘সুন্দরের নিমন্ত্রণ’ প্রবন্ধদুটিতে সৌন্দর্যতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন প্রাবন্ধিক। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাশৈলীর সঙ্গে এর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ‘সুন্দরের নিমন্ত্রণ’ প্রবন্ধের শুরু হাই করেছেন এভাবে, “কি সুন্দর এবং কি সুন্দর নয়, এ নিয়ে প্রায় প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই মতভেদ দেখা যায়।” অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সুন্দর’ প্রবন্ধের প্রথম বাক্য এটি — “কি সুন্দর এবং কি সুন্দর নয় এ নিয়ে ভারি গোলমাল বাধে যে রচনা করছে এবং যারা রচনাটি দেখছে বা পড়ছে কিংবা শুনছে তাদের মধ্যে।”
৪
প্রবন্ধের ভাষা সাধারণত বিশ্লেষণ ও যুক্তির ভাষা। এজন্য প্রাবন্ধিককে মেদহীন গদ্যের চর্চা করতে হয়। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ভাষা পাণ্ডিত্যপূর্ণ, অথচ লালিত্যহীন নয়। তাঁর প্রবন্ধের ভাষায় রসবোধ ও পাণ্ডিত্যর সমন্বয় স্পষ্ট। কাজী আবদুল ওদুদের গদ্যের সঙ্গে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের গদ্যের একটা সাজুয্য দেখা যায়। উভয়ের গদ্যে রসবোধ ও মনীষার যুগলবন্দীতে বক্তব্য প্রাঞ্জল ও মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে। পাঠকের মনে যেন সহজেই জায়গা করে নেয় এমন গদ্য। পাঠক প্রাবন্ধিকের এমন জ্ঞানগর্ভ কথা শুনতে মোটেই বিরক্ত বোধ করেনা। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কাজী আবদুল ওদুদের প্রভাব মুহম্মদ আবদুল হাই সচেতনভাবেই গ্রহণ করেছিলেন, বলা যায়। তাঁর ভাষা কবিত্বপূর্ণ এবং অলংকারময়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তত্ত্বকথাকে পেলব রূপ দিতে পারেন। তবে স্বীকার করতে হবে তিনি দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সাহিত্যানুশীলন সত্ত্বেও গদ্যে একটা নিজস্ব ঢং (style) সৃষ্টি করতে তিনি সক্ষম হননি।
মুহম্মদ আবদুল হাই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরীর লেখার একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর মনে ও মজ্জায়। এঁদের মথিত করে হাই একটি সাহিত্যিক ভাবমণ্ডল তৈরি করেছিলেন। প্রাবন্ধিক, ভাষাবিজ্ঞানী ও ধ্বনিবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই যে সাহিত্যখ্যাতি লাভ করেছিলেন তার পেছনে ছিল তাঁর প্রয়াস, মমত্ব। বাংলা, বাঙালি, বাংলা ভাষা, বাঙালি মুসলমান — সবার প্রতি যে দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন তা অনন্য। বাংলা ভাষাকে সহজতর, সুন্দরতর ও সুললিত করার জন্য বিশেষ যত্নবান ছিলেন তিনি। তিনি বাঙালিকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন; বাঙালি মুসলমানকে বিভিন্ন ‘উপদ্রব’ থেকে বাঁচার, সতর্কভাবে পথ চলার পরামর্শ দিয়েছেন। সেদিন পথের প্রয়োজন ছিল, ছিল প্রয়োজন পথ-প্রদর্শকের। রাজনীতিকগণ যেমন তাদের কাজ করেছেন, সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেই কাজ করেছেন মুহম্মদ আবদুল হাই। বাংলা ভাষা এবং ভাষাভাষীর পথ ও পথ্যের অন্যতম যোগানদাতা মুহম্মদ আবদুল হাইকে বাঙালির স্মরণ রাখা কর্তব্য।