সাহিত্যে গবেষণা ।। পর্ব ৩

মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম কবি, গবেষক এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। মূলত ইংরেজিতে লিখে থাকেন। বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন গবেষণা-পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য তিনি লিখবেন গবেষণা বিষয়ক ধারাবাহিক গদ্য। আজ প্রকাশিত হলো লেখাটির তৃতীয় পর্ব

 

এখন দৃষ্টি দেয়া যাক আপনি কেন বা কার জন্য গবেষণা করেন বা করবেন সেদিকে। প্রশ্ন করা স্বাভাবিক, আপনার গবেষণা কার জন্য?

 

বৃহৎ পরিসরে বললে গোটা মানবজাতির জন্য। কিন্তু গবেষণার কাজটি প্রথমত আপনার নিজের জন্য, তারপর আপনার সমাজ, আপনার দেশ ও জাতি, এবং সর্বোপরি গোটা মানবজাতি আপনার গবেষণার ফল ভোগ করে থাকে। আপনি হয়তো বুঝতেও পারবেন না আপনার একটি প্রবন্ধ সমাজে তথা একটা জাতিগোষ্ঠির জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকে। জাতি যদি গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং গবেষণার কাজকে উৎসাহিত করে, তাহলে ভালো ভালো গবেষক বেরিয়ে আসবে এবং ভালো গবেষণা দেশের জন্য মংগল বয়ে আনবে। আর দেশও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম অর্জন করবে।

 

এখানে গবেষণার ‘ইম্প্যাক্ট’ বলতে একটা ব্যাপার আছে। বিশ্বের নামিদামি প্রকাশনার ‘ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর’ থাকে। তবে হিউম্যানিটিজ তথা সাহিত্যের জার্নালগুলোর ‘ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর’ কম থাকে। সাইন্স বা এঞ্জিনিয়ারিং বা সোশ্যাল সাইন্সের বিভিন্ন বিষয়ের জার্নালগুলোর ইম্প্যাক্ট হাই হয়ে থাকে। এমনো আছে অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল, হাই কুয়ালিটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, কিন্তু দেখবেন সেগুলোরও ইম্প্যাক্ট খুব কম। এটা হিউম্যানিটিজ-এর জার্নালগুলোর ক্ষেত্রে হয়। যাহোক আপনি গবেষণা করছেন আপনার এরিয়াতে, এবং সেটা প্রচ্ছন্নভাবে আপনার সমাজে তথা গোটা মানবজাতির জন্য ভূমিকা রাখছে সেটা অনেক বড় ব্যাপার।

 

বলছিলাম গবেষণা আপনি আপনার নিজের জন্যও করে থাকেন। সেটা কীভাবে? প্রথমত, এটা আনন্দদায়ক কাজ হিসেবে পরিগণিত করতে পারলে, দেখবেন আপনার নিজস্ব জগতটা হয়ে উঠবে অন্যরকম। কোন একটা ভালো কাজ করে আনন্দ পাওয়ারতো আর তুলনা হয়না। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। একজন অভিজ্ঞ সার্জন যখন একজন মুমূর্ষু রোগী অপারেশন করেন এবং রোগী ভালো হয়ে যায়, সেটা ঐ ডাক্তারের জন্য অনাবিল আনন্দের ব্যাপার। অপারেশনের কাজটি জটিল, কিন্তু এর পজিটিভ ফল খুবই আনন্দদায়ক। গবেষণার কাজটিও জটিল, কিন্তু এর ইম্প্যাক্ট সুদূরপ্রসারী। আর অন্যভাবে বলতে গেলে, আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে গবেষণা এবং প্রকাশনা আপনার ক্যারিয়ারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অর্থাৎ একজন শিক্ষক তার অবস্থান থেকে গবেষণা না করলে পরবর্তী ধাপে পৌঁছতে পারেন না। আমি বলছি প্রমোশনের কথা। এ বিষয়ে প্রাসংগিকভাবে পরে বলতে হবে।

সাহিত্যে গবেষণার মাধ্যমেই ব্যাক্তির মানবিক সুস্থতার বা মানবিক স্বাস্থ্যের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব। আরো ব্যাপক পরিসরের কথা বলতে গেলে সাহিত্যে গবেষণা সমাজের অসংগতি নিরূপণ করে থাকে।

এখানে আরেকটি বিষয়ে কথা বলে নেয়া দরকার তা হলো প্রমোশনভিত্তক গবেষণা এবং প্রকাশনা। এখানকার প্রেক্ষাপট দেখলে বুঝতে পারবেন একজন পুরো ক্যারিয়ার পার করে দিতে পারেন সাধারণ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এবং সেগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের সাময়িকীতে প্রকাশ করে। সেক্ষেত্রে গবেষণার খুঁটিনাটি না জানলেও চলবে। আবার সারাজীবনে অল্প কয়েকটা হাই কুয়ালিটি প্রবন্ধও যদি প্রকাশ করতে পারেন (সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়ার থেকে) তা আপনাকে গবেষক হিসেবে স্বীকৃতি দিবে, আপনার অনুপস্থিতিতেও। সবচেয়ে বড়কথা মানসিক তৃপ্তি বা মনের আনন্দ সেটা অতুলনীয়। একটা ভালো, মানসম্পন্ন প্রকাশনা কী যে অনাবিল আনন্দের উৎস তা কেবল একজন ভালো গবেষক-ই অনুধাবন করতে পারেন। আপনিও বুঝবেন যখন দেখবেন আপনার গবেষণা বিখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্ণালে প্রকাশিত হচ্ছে, অন্যরা পড়ছে, আলোচনা করছে, সাইট করছে। আপনার লেখার ইম্প্যাক্ট সুদূরপ্রসারি হলে আপনার আনন্দও অন্তহীন।

 

একজন শিক্ষক হিসেবে আপনি ভালো গবেষণা করলে তার দ্বারা সরাসরি উপকৃত হয় আপনার ছাত্র-ছাত্রীরা, আপনার প্রতিষ্ঠান, আপনার দেশ ও জাতি। ছাত্র-ছাত্রীরা অনুপ্রাণিত হয় গবেষণা করার জন্য। এখন সে সুযোগ তারা পাচ্ছে। কোন বিশ্ববিদ্যালয় যদি গবেষণা বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে গবেষণার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারে এবং গবেষণার পজিটিভ কালচার তৈরি করতে পারে, তবে ঐ বিশ্ববিদ্যালয় তো অবশ্যই, সাথে সাথে পুরো জাতি উপকৃত হবে। আশার কথা হলো আমাদের দেশে এখন অনেক গবেষক নিজস্ব জায়গা থেকে ভালো ভালো কাজ করছে, করার চেষ্টা করেছে।

প্রথম দিককার কাজগুলোর মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। সুতরাং, চিন্তা করবেন কাজ করে যেতে, আর ভালো করতে, নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে।

আমরা পার করেছি এক ভিন্ন সময়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে শিক্ষকতা শুরু করার পর বুঝতে পেরিছেলাম গবেষণা করতে হবে। কোন ধরনের ওরিয়েন্টেশন ছিলনা, কোন ট্রেইনিং ছিলনা। তখনকার সিলেবাস এমন-ই ছিল। গবেষণার ব্যাপারে কিছু বলাও হতো না, গবেষণা করানো তো দূরে থাক। যাহোক, নিজ থেকে পড়ে পড়ে শেখার চেষ্টা করেছি তখন। ঐ সময় প্রায় সবার অবস্থা এমনই ছিল।

 

প্রথমদিকের কাজগুলোর কথা মনে পড়ে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করে করে এগুনোর চেষ্টা করেছি। প্রথম দিককার কাজগুলোর মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। সুতরাং, চিন্তা করবেন কাজ করে যেতে, আর ভালো করতে, নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে। প্রতিটা অবস্থান বিশ্লেষণ করে সামনে এগুনোর দৃঢ় প্রত্যয় রাখতে হবে। আপনার ভালো গবেষণা আপনার প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বের মাঝে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাবে। আমরা ‘র‍্যাংকিং’-এর কথা সবাই জানি।  ‘র‍্যাংকিং’-এ একটা বিশ্ববিদ্যালয় উপরের অবস্থানে উঠতে থাকে শিক্ষকদের ভালো, মানসম্মত প্রকাশনার মাধ্যমে। কোন প্রতিষ্ঠানে ৩০০ স্কোপাস-ইনডেক্সড পাবলিকেশন থাকলে ‘কিউ এস ওয়ার্লড র‍্যাংকিং’-এর আওতায় আসে। সুতরাং যত বেশি সংখ্যক শিক্ষক ভালো ভালো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করবে, প্রতিষ্ঠান তত বেশি অগ্রসর হতে থাকবে। আর জাতীয় এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট তো আছেই।

 

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাংকিঙের অবস্থা খুব ভালো নয়। আরো কঠিনভাবে বললে খুবই খারাপ অবস্থা। এ নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা আছে, চলছে। প্রকৃতার্থে আমাদের এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোনো শিক্ষক বা গবেষক তাদের নিজস্ব জায়গা থেকে, অল্প সুযোগ সুবিধার মধ্যে, অনেক পরিশ্রম করে গবেষণার কাজটি চালিয়ে যান, বিশ্বের ভালো সাময়িকীগুলোতে প্রকাশ করে থাকেন। এবং তাদের অবদানের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান উপরের দিকে উঠে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো এসব গবেষণা নীরবে, নিভৃতে হচ্ছে। সেরকম প্রাতিষ্ঠানিক বা জাতীয় কোন স্বীকৃতি নেই। অবস্থাটা এমন যেন গবেষক তার কাজটি করছেন, করে যাবেন। আর যারা করছেন না, তারাও যেন ঠিক কাজটি করছেন। সবার অবস্থা সমান। যে কাজটি জরুরি সেটা হলো সব বিষয়ে ভালো গবেষণাগুলো সামনে নিয়ে আসতে হবে, আলোচনা করতে হবে, গবেষকদেরকে নানাভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে, প্রণোদনার ব্যাবস্থা করতে হবে, এমনকি তারা যাতে গবেষণা করার জন্য সুন্দর একটা পরিবেশ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

 

অনেক সময় দেখা যায় একটি জাতি বিজ্ঞান, বিজনেস এবং এঞ্জিনিয়ারিং বিষয়গুলোতে গবেষণার জন্য অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। সেটা অবশ্যই করতে হবে; কিন্তু অন্যান্য বিষয়গুলো গুরুত্বহীন ভাবলে চলবে না। আবার দেখা যায় সাহিত্যে গবেষণা সামনে আসেই না। সাহিত্য শুধু পঠন-পাঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এরকম ধ্যান-ধারণা বা মানসিকতা ঠিক নয়। আমি সম্ভবত প্রথম দিকে বলেছিলাম সাহিত্যে গবেষণা কেন প্রয়োজন। সাহিত্যে গবেষণায় দৃষ্টত কোন ‘ইম্প্যাক্ট’ পরিলক্ষিত না হলেও সমাজ, ব্যাক্তি, বা জাতীয় পর্যায়ে এর প্রতিফলন ব্যাপক এবং গভীর। সাহিত্যে গবেষণার মাধ্যমেই ব্যাক্তির মানবিক সুস্থতার বা মানবিক স্বাস্থ্যের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব। আরো ব্যাপক পরিসরের কথা বলতে গেলে সাহিত্যে গবেষণা সমাজের অসংগতি নিরূপণ করে থাকে।

 

পড়ুন ।। কিস্তি : ২

সাহিত্যে গবেষণা ।। পর্ব ২

1 COMMENT

  1. পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি এরকম প্রবন্ধ রচনার প্রভাব সম্পর্কে জানার জন্য। আমিও এও আশা করছি শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বুঝতে পারবে সাহিত্য গবেষণার গুরুত্ব।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here