আমরা বাংলায় অনুবাদ সাহিত্য কেন পড়ি? বহুকাল ধরেই আমাদের সাহিত্যক্ষুধা কেবল বাংলা সাহিত্য দিয়ে মেটে না। ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে পৃথিবীর আনাচে কানাচে আমাদের মন জীবনসত্য খুঁজে বেড়ায়। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা বুদ্ধদেব বসু, কে যাননি এই সত্যের খোঁজে! আসলে আমরা বুঝতে চাই, মানুষ কোন পরিবেশে কেমন করে কী উপলব্ধি করে। ভিন দেশের মানুষের ভিন ভাষার সাহিত্য — তবু সেই মানুষের সত্য যেন আমরা যাপন করি অনূদিত সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে আমরা যেমন দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে ব্যক্তি শকুন্তলা, মিরান্দা আর দেসদিমোনাকে চিনি, তেমনি নজরুলের অনুবাদে পাওয়া ওমর খৈয়ামের দর্শন প্রয়োগ করি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। ভাবতে হয়, অনুবাদ না হলে সাহিত্যচর্চা বা জাতিগঠনের জায়গায় সাধারণ পাঠক বা বুদ্ধিজীবী সমাজের স্বরূপ কী হতো! পেছনে তাকালে বোধ হয়, গতি ধীর হয়ে আসতো।
সাহিত্যের সাধারণ পাঠক হিসেবে অন্য ভাষার সাহিত্য পড়তে গিয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা হলো, বাংলার বাইরে একাধিক ভাষার উপর দখল না থাকা। ফলে অবধারিতভাবেই আমরা অনুবাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। তাহলে যে বিপুল সংখ্যক সাধারণ পাঠক আছেন, তাঁদেরকে একটি বিদেশি সাহিত্য সম্পর্কে পরিচয় করাতে চাইলে আমরা কি তাঁদের নতুন ভাষা শেখানোর জন্য নতুন কোন উদ্যোগ নেবো? কি এক দুঃসাধ্য কাজ! তাছাড়াও, দীর্ঘ বারো বছরের ইংরেজি ভাষা শিক্ষা যেখানে প্রায় ব্যর্থ, তখন এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে নতুন করে নতুন ভাষা শেখানোর কথা চিন্তা করাও তো প্রায় অসম্ভব! তবে উপায়? অনুবাদ। তাই আজও ব্যক্তিগত উৎসাহে বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে বিদেশী ভাষার সাহিত্যের প্রবেশ দেখতে পাই।
কীভাবে করা হয় অনুবাদ?
বর্তমানে অনুবাদের নানা প্রকার পদ্ধতি প্রচলিত আছে। যেমন, শব্দ-থেকে-শব্দ অনুবাদ, স্বাধীন অনুবাদ ইত্যাদি। কেউ ব্যবহার করেন পুনর্লিখন পদ্ধতি; কেউবা ব্যবহার করেন রূপান্তর প্রক্রিয়া। শব্দগুলোর আপাত অর্থ প্রায় কাছাকাছি হলেও, প্রয়োগ বা পদ্ধতির দিক দিয়ে এগুলো কিন্তু মোটেই এক নয়। যেমন ধরুন, পুনর্লিখন। নজরুল যেভাবে ওমর খৈয়াম অনুবাদ করেছেন, মূলত সেটিই হল বাংলা ভাষায় বিদেশি ভাষা থেকে পুনর্লিখনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কারণ তিনি অনেক ব্যাখ্যা এবং টীকা-টিপ্পনী ব্যবহার করে মূল কবিতা ভাষান্তর করেছেন। পুনর্লিখনের একটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো, একে রূপান্তরিত ভাষার একটি স্বতন্ত্র কর্ম হিসেবে বিবেচনা করা যায়। পুনর্লিখনের আরেকটি বহুল প্রচলিত উদাহরণ আছে। হায়াৎ মামুদের তৈরি করা মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যের গদ্যরূপ। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থী খুব কমই আছেন যারা এই প্রকাশনা সম্পর্কে জানেন না। এটি বাংলা ভাষার ভেতরেই কাব্যরূপ থেকে গদ্যরূপে রূপান্তর। ক্ষেত্রগুপ্তের সম্পাদনায় মেঘনাদবধ কাব্যকেও পুনর্লিখন হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
আবার, শব্দ-থেকে-শব্দ অনুবাদ বা স্বাধীন অনুবাদ এসবের কিছু প্রতিশব্দ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। যেমন, শব্দ-থেকে-শব্দ অনুবাদকে বলা হয় আক্ষরিক অনুবাদ। স্বাধীন অনুবাদ কিছুটা ‘ভাবার্থ অনুবাদ’ জাতীয় পরিভাষার মাধ্যমে বোঝানো হয়ে থাকে। প্রকৃত অর্থে, এ হলো, ভাষা নিয়ে ভাষার খেলা। এক ভাষা থেকে অন্য ভাষা। এক ভাষার মধ্যেই একই সাহিত্যের একাধিক রূপের চর্চা। একাধিক ভাষার ভেতরেও রূপান্তর ঘটতে পারে। এসমস্তকে ইংরেজি ইন্টারলিঙ্গুয়াল ( Inter-lingual, সহজ কথায় দুই ভাষার ভেতর অনুবাদ) কিংবা ইন্ট্রালিঙ্গুয়াল (Intra-lingual, একই ভাষার ভেতর রূপান্তর) এ ধরনের পরিভাষা দিয়ে বোঝা যেতে পারে। তবে কি অনুবাদ চর্চা কিংবা অনুবাদ অধ্যয়ন (Translation Studies) কেবল একটি শাখার মধ্যে বিচরণ করে? ভাষা? কিংবা ভাষাবিজ্ঞান? না। অনুবাদ চর্চা আন্তর্বিদ্যা অধ্যয়নের (Interdisciplinary, এক বিদ্যার সঙ্গে আরেক বিদ্যার সম্পর্ক অনুসন্ধান প্রক্রিয়াকে সহজভাবে আন্তর্বিদ্যা অধ্যয়ন বলা যেতে পারে) সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত হতে পারে।
অভিযোজন করতে হবে খুব সতর্কতার সঙ্গে। নিজেরা যেন পশ্চিমার ‘মানস-সন্তান’ না হই। এই অভিযোজনের মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয় ও অস্তিত্বকে সমকালের সংস্কৃতি মিশ্রণের যুগে তুলে ধরতে হবে।
অধুনা বিশ্বে কিছু বিদ্যাক্ষেত্র বেশ চর্চিত হচ্ছে। সংস্কৃতি অধ্যয়ন, জেন্ডার স্টাডিজ, পোস্টকলোনিয়াল স্টাডিজ, তুলনামূলক সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য প্রভৃতি। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশই বিদ্যায়তনিক শাখার মর্যাদা পেয়েছে। আবার কিছু বিষয় বহু আগে থেকেই আমরা বিদ্যাক্ষেত্র হিসেবে চর্চা করছি। যেমন, দর্শন, ইতিহাস, ভাষা অধ্যয়ন (এটি ঠিক ভাষাবিজ্ঞান নয়, বিভিন্ন ভাষা সম্পর্কিত জ্ঞানের অধ্যয়ন) ইত্যাদি। তুলনামূলক সাহিত্যের কথাই ধরি। তুলনামূলক সাহিত্য অধ্যয়ন করতে হলে শিক্ষার্থী বা গবেষককে একাধিক ভাষায় পারদর্শী হতে হয়। কমপক্ষে দুইটি বা তিনটি ভাষার উপর দখল থাকা জরুরি। এ শাখার জন্য অনূদিত সাহিত্য একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয়।
বলা যায়, অনূদিত সাহিত্য, ভাষান্তরে অনুবাদ সাহিত্য, তুলনামূলক সাহিত্য শাখার জন্য অপরিহার্য বিষয়। অনুবাদ চর্চার মাধ্যমে যদি লক্ষ্যভাষার পাঠ্যের প্রকৃতি পূর্বেই পরিমিত করা না হয়, তবে গবেষককে বিদেশি ভাষার পাঠ্য নির্বাচনে বেগ পেতে হবে। অনুবাদ চর্চার লক্ষ্যই হল, পদ্ধতিগতভাবে অগ্রসর হয়ে সম্ভাব্য অনুবাদকে একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নিয়ে আসা। অনুবাদ চর্চা আসলে ভাষা-সংশ্লিষ্ট যেকোন ক্ষেত্র অধ্যয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও তত্ত্বের চর্চা এবং প্রয়োগ ছাড়া কিছুই নয়। এই তত্ত্বই হয়ে উঠে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের যে কোন বিষয়কে জানার একমাত্র প্রক্রিয়া।
অনুবাদচর্চা ও অনুবাদ সাহিত্য কিন্তু মোটেই এক নয়। অনুবাদচর্চা পশ্চিমের নির্বাচিত ‘ট্রান্সলেশন স্টাডিজ’ এর বাংলা প্রতিশব্দ। পশ্চিমা জ্ঞান বলেই আমরা তা গ্রহণ করব কেন? মূল জ্ঞানটুকু নিয়ে একে আমরা নতুনভাবে নতুন পথে এগিয়ে নিতে পারি। অভিযোজন আমাদের বেঁচে থাকার সবচেয়ে প্রাচীন প্রবৃত্তি। জ্ঞানের ক্ষেত্রেও তাই। বহু আগে থেকেই নিজেদের জ্ঞানের সঙ্গে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন তাত্ত্বিকের জ্ঞান গ্রহণ করে আমরা আজ এখানে দাঁড়িয়ে আছি; নিজেদের ভিত তৈরি করেছি। অভিযোজন করতে হবে খুব সতর্কতার সঙ্গে। নিজেরা যেন পশ্চিমার ‘মানস-সন্তান’ না হই। এই অভিযোজনের মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয় ও অস্তিত্বকে সমকালের সংস্কৃতি মিশ্রণের যুগে তুলে ধরতে হবে। বাংলা সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত হতে পারে এর পদ্ধতিগুলো।
মূলত ইংরেজি ‘ট্রান্সলেশন স্টাডিজ’ অনেক বিস্তৃত পরিসরে ব্যবহৃত হয়। প্রায়োগিক অনুবাদ চর্চা, অডিও-ভিডিও অনুবাদ, দর্শনের অনুবাদ, ইতিহাসের অনুবাদ, গণিতের অনুবাদ, বিজ্ঞানবিষয়ক অনুবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই বৃহত্তর অনুবাদ চর্চার ভেতরে ক্ষুদ্র অংশ হলো ‘সাহিত্যিক অনুবাদ অধ্যয়ন’। খুব ছোট পরিসরে সাহিত্যিক অনুবাদ নিয়ে কাজ করা হয়। ঠিক এখান থেকেই শুরু হতে পারে বাংলা ভাষার অনুবাদচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা। বাংলা সাহিত্যের বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী সাহিত্য অনুবাদ করতে গিয়ে সম্ভাবনা–অসম্ভাবনা নিয়ে কী আবিষ্কার করছেন, তাই হতে পারে বাংলায় অনুবাদ সাহিত্য অধ্যয়নের তত্ত্ব।
যেমন ধরুন, অনলাইন সাময়িকী সহজিয়া পত্রিকায় প্রকাশিত সুমন সাজ্জাদ অনূদিত কাশ্মীরি কবি ও গল্পকার শাব্বির আহমাদ মীর-এর ইংরেজি গল্পের অনুবাদ ‘কাকতাড়ুয়ার সঙ্গে লড়াই’। আমরা প্রতিনিয়তই জানতে পাই কাশ্মীরের সংকট সম্পর্কে, সংবাদ মাধ্যগুলোতে। অথচ, সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য আর সাহিত্যে চিত্রিত সংগ্রাম আমাদের একই রকম অনুভব দিতে সক্ষম নয়। এখানেই সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু যখনই পাঠক অনূদিত সাহিত্যের মাধ্যমে সেই সর্বক্ষণ জ্বলতে থাকা রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পর্কে জানবেন, তখনই সক্রিয় হয়ে ওঠে অনুবাদের ভূমিকা। পাঠক যখন সেই জ্বলন্ত শিখার লড়াইয়ে রক্তক্ষরণের সত্যতা অনুসন্ধান করতে শুরু করবেন, তখনই কার্যকর হবে অনুবাদচর্চা ও সংস্কৃতি অধ্যয়নের সম্পর্ক। অনুবাদ চর্চা হয়ে উঠল আন্তর্বিদ্যা অধ্যয়ন (এক বা একাধিক বিদ্যাশাখার ভেতর বিচরণমূলক অধ্যয়ন)। যিনি উৎস ভাষার সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিত জানেন না; তিনি লক্ষ্যভাষার যথার্থ শব্দ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হবেন। ফলে উৎস ভাষার বা উৎস সাহিত্যের সংস্কৃতি অধ্যয়ন করতেই হবে।
এবার আসি প্রস্তাবিত অনুবাদচর্চার (সাহিত্য) প্রায়োগিক ফল কেমন হতে পারে সেদিকে। মনে করি, একজন শিক্ষার্থী ভাষা বা সাহিত্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। শিক্ষকতা, সম্পাদনা ছাড়া আর কী হতে পারে? একজন পেশাদার অনুবাদক। কেউ যদি অনুবাদ চর্চার (সাহিত্য) মৌলিক পদ্ধতিগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মোটামুটি রপ্ত করে থাকে; তবে তার একজন পেশাদার অনুবাদক হয়ে উঠতে কেবল ব্যক্তিগত চর্চার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সে অনায়াসেই ব্যক্তিগতভাবে নিজের পরিচর্যার মাধ্যমে পেশাদার অনুবাদক হয়ে উঠতে পারে অনুবাদের বৃহত্তর জগতে। কোথায় পাবে সে এই প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান? বাংলাদেশে এখনও অনুবাদ চর্চাকে একটি বিদ্যায়তনিক শাখা হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয় না। সাহিত্যচর্চা যেখানে নিজেই অপ্রধান হয়ে পড়ে তখন অনুবাদ চর্চার মত ব্যাপার প্রায় নগণ্যই বলা চলে। পশ্চিমের কথা বাদ দিয়েও কেবল এশিয়ার প্রতিবেশী দেশেগুলোর বিবেচনায় বলা যায় যে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। যেমন, কোরিয়াতেই দেখতে পাবেন, International Association for Translation and Intercultural Studies (2002) কিংবা চীনে দেখুন। তাদের আছে Asia-Pacific Forum on Translation and Intercultural Studies (2011)। বাংলা একাডেমি খুব ক্ষুদ্র পরিসরে একটি অনুবাদ শাখা আছে। কিন্তু এখানে বলছি একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান এর কথা।
কেন লাগবে এধরনের একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে?
মনে করুন, আপনি জানতে চান, গত ৫ বছরে বাংলাদেশে সংস্কৃতির আদান-প্রদান কেমন হয়েছে। সংস্কৃতি একটি এতই বিস্তৃত শব্দ যে পরিমাপক খুঁজতে বেগ পেতে হবে। বিনোদনের মাধ্যমগুলোকে এক্ষেত্রে গ্রহণ করা যেতে পারে। সমস্যা হল, বিনোদনের অনুষ্ঠানগুলোর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদীও হতে পারে আবার স্বল্পমেয়াদীও হতে পারে। আরও সহজলভ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবক কী হতে পারে? অনূদিত বই। কেবল বিদেশী ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় নয়, বাংলা ভাষার সাহিত্যও অন্যভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে সম্প্রসারিত হল কিনা সেটিও বিবেচনার বিষয়। মনে করুন, যদি জানা যায় যে গত ৫ বছরে ১০০টি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য বাংলায় অনূদিত হয়েছে এবং গ্রহণযোগ্য মাত্রায় বিক্রিও হয়েছে; তাহলে এটা ধরে নেয়া যেতে পারে যে জাতি সংস্কৃতি আদান-প্রদানের জায়গায় গড় মানে এগোচ্ছে। এবং সেই অনূদিত বইগুলোর ১০ভাগও যদি উঠতি তরুণ-তরুণীদের পাঠ্যাভ্যাস উন্নয়নের জন্য বই নির্বাচন করে ই-বুক বানিয়ে তাদের হাতে দেয়া হয়; তাতে যে ফল আমরা পাব তা অভাবনীয়। যারা পড়বে তাদের ভেতর থেকে শতকরা ১০জনও যদি প্রতিবছর পেশাদার অনুবাদকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে; তারাই পরবর্তী বছরের লক্ষ্যমাত্রা ১০ ভাগ বাড়িয়ে দিতে পারে। কি এক বিশাল সম্ভাবনা! প্রশ্ন উঠতে পারে, সংস্কৃতি আদান-প্রদান এর প্রয়োজন কী? আগ্রহী পাঠক সংস্কৃত ভাষাকে কেন মৃত ভাষা বলা হয়, সেই কারণ খুঁজে দেখতে পারেন।
আবার, যদি এখন মোটামুটি যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী খুঁজতে বসে কোন প্রতিষ্ঠান, যিনি প্রতিষ্ঠানের হয়ে অনুবাদ করবেন, সেখানেও দেখবেন, বিশাল এক মরুভূমি! দেশের এত কর্মদ্যোম তরুণ-তরুণীর ভেতর থেকে সদ্য-স্নাতক কোন প্রার্থী, যার অনুবাদচর্চা সম্পর্কে জ্ঞান এবং অনুবাদ কর্ম আছে, তেমন কাউকে খুঁজে পাওয়া খড়ের গাদায় সুঁই পাওয়ার মত ব্যাপার হয়। তখন স্বাভাবিকভাবেই খুঁজতে হয় গুণী অধ্যাপকবৃন্দকে। অবশ্যই তাঁরা সে স্থান নিতে পারেন। কিন্তু তাঁরা তো এই সমস্ত কর্মপদ ছাড়াও অনুবাদের কাজ করে যাচ্ছেন দায়িত্ব মেনে নিয়ে। বাস্তবতা হলো, নতুনের স্থানে নতুনকেই দায়িত্ব নিতে হয়। নতুনের স্থানে যদি কর্তৃপক্ষকে পুরনোকে বসাতে হয়, তাতে দেশের কর্মোদ্যম তরুণ-তরুণীর ভেতর যে সম্ভাবনা ছিল, তাকেই কি উপেক্ষা করা হয় না? এই কি পরিষ্কার হয় না যে, নতুন যোগ্য নাগরিক তৈরিতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি? কাজেই, তাদের প্রস্তুত করতে হবে। প্রস্তাবিত ‘সাহিত্যিক অনুবাদ অধ্যয়ন’ এর জন্য স্বতন্ত্র স্থান তৈরি করে। তাদের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে যেন তাদের উদ্যম আর দক্ষতা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে চর্চিত হয়। সাহিত্যের ব্যবহারিক এই প্রয়োগ হতে পারে রাষ্ট্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল ক্ষেত্র।
সারবার্তা
একুশ শতকের তৃতীয় দশকে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। কখনও না কখনও আমাদের এই পদক্ষেপ নিতে হবে। এখনই সবচেয়ে শক্তিশালী জোয়ার দেশের দ্বারপ্রান্তে। প্রয়োজন সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান। আমরা বিশ্বকে জানব আমাদের তরিকায়; বিশ্বও আমাদের জানুক আমাদের তরিকায়। তরিকা ‘সাহিত্যিক অনুবাদ অধ্যয়ন’। বিশ্বকে বাংলা ভাষীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আর বাংলার সম্পদকে তুলে ধরতে হবে বিশ্ব সমুদ্রে। একজন রবার্ট বা উইলিয়ামের অনুবাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পুরস্কার আমাদের ঝুলিতে আসলে, সেটি মোটেই রাষ্ট্রের জন্য গর্বের ব্যাপার হতে পারে না। বিশ্বের সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের এই সাহিত্যিক সম্পর্কই একুশ শতকে হয়ে উঠুক দেশ ও রাষ্ট্রকে স্বতন্ত্র মহিমায় উদ্ভাসিত করার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।
(চলবে)
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ভাবনা। ইনফরমেটিভ লেখা।
চমৎকার আলোচনা। ভালো লাগলো।
লেখাটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিভাবে বিশ্বের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সাহিত্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে যা দেশ ও রাষ্ট্রকে স্বতন্ত্র পরিচয় এনে দিতে পারে, সেই সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরেছেন প্রাবন্ধিক।
চিন্তা জাগানিয়া লেখা। লেখাটির পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়।
যাহোক, “যারা পড়বে তাদের ভেতর থেকে শতকরা ১০জনও যদি প্রতিবছর পেশাদার অনুবাদকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে; তারাই পরবর্তী বছরের লক্ষ্যমাত্রা ১০ ভাগ বাড়িয়ে দিতে পারে। কি এক বিশাল সম্ভাবনা! ” নিঃসন্দেহে বিশাল সম্ভাবনা। তবে শতকরা ১০ জনকে আশা করা বিলাসিতা বলে মনে হয়।