সংকেত ভাষা : কী, কেন, কখন

সংকেত ভাষা কী? সাধারণ শব্দ ও শব্দগুচ্ছ যখন বিশেষ অর্থ ও ইঙ্গিত বহন করে, তখন তাকে সংকেত ভাষা বলে।

 

সংকেত ভাষা কেন? বিষয় ও বক্তব্যকে আড়াল করার জন্য কোনো গোষ্ঠী সচেতনভাবে এটি করে থাকে। তবে, সংকেত ভাষা আলাদা কোনো ভাষা নয়; রূপান্তরিত কিছু ভাষিক উপাদানমাত্র। জনগোষ্ঠীর একটি ছোট অংশ নিজেদের মধ্যে বিশেষ ক্ষেত্রে বা বিশেষ প্রয়োজনে সংকেত ভাষায় কথা বলে। যারা সংকেত ব্যবহার করে, তারা বৃহত্তর সাধারণ ভাষিক জনগোষ্ঠীরই অংশ; অর্থাৎ, তারা সময়ে সময়ে সংকেতের ব্যবহার করলেও তাদের নিজেদের পূর্ণ ভাষা রয়েছে।

এখন প্রশ্ন, সংকেত ভাষা কখন তৈরি হয়। সহজ উত্তর: যখন গোপন করার প্রয়োজন হয়।

কদিন আগেই সংবাদে দেখলাম, মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিক্ষোভকারীরা হাতে বানানো অস্ত্রের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে কিছু অভিনব সংকেত তৈরি করেছে। যেমন, ‘বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে’ মানে অস্ত্র তৈরি করা হচ্ছে; ‘অতিথিদের বিরিয়ানি দেওয়া হচ্ছে’ মানে সেনাদের লক্ষ্য করে বন্দুক ছোঁড়া হচ্ছে; ‘বিগ বিরিয়ানি’ মানে পালটা হামলা হিসেবে আগুন দেয়ার ঘটনা ইত্যাদি। এসব ‘বিরিয়ানি’ শব্দের অর্থ এতদিনে সামরিক জান্তাদেরও জানা হয়ে গেছে। ফলে আন্দোলনকারীরা এখন নতুন নতুন বিষয় বোঝানোর জন্য নতুন নতুন সংকেত তৈরি করবে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও নিজেদের অন্যান্য যোগাযোগে সেগুলো ব্যবহার করবে।

 

এখন প্রশ্ন, সংকেত ভাষা কখন তৈরি হয়। সহজ উত্তর: যখন গোপন করার প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন অ্যাকশনে যাওয়ার সময় সশস্ত্র বাহিনী সংকেত ব্যবহার করে। এমনকি সাধারণভাবেও পুলিশ-মিলিটারির কিছু সাংকেতিক শব্দ থাকে। বিমানবন্দরে যাঁরা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন, তাঁরাও যোগাযোগে সংকেত ব্যবহার করতে থাকেন সবসময়। মাদক কেনাবেচা, সোনা ও পণ্য চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের সাথে যারা জড়িত, তাদেরকেও সংকেত ব্যবহার করতে হয়। সংকেত ফাঁস হয়ে গেলে নতুন সংকেত নিয়ে কাজ করতে হয়।

 

একসময় সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে ব্যাপক হারে ফেনসিডাইল নামের কাশির সিরাপ আসতো। দামে সস্তা, সস্তা নেশাও হয়; অথচ এর বহন ও কেনাবেচা আইনত ছিল নিষিদ্ধ। ফলে এর একটা সংক্ষিপ্ত রূপ দাঁড়িয়ে গেল ‘ডাইল’। প্রায় প্রতিদিন ডাল-ভাত খেয়ে বেড়ে উঠেছে যে বাঙালি, সেই বাঙালি ডাইল বলতে যে ভিন্ন কিছু বোঝাবে, এটা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বুঝে উঠতেও সময় লেগেছে।

 

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার পর ওয়্যারলেসে জানানো হয়, ‘বিগ বার্ড ইন দ্যা কেজ’। এই ‘বিগ বার্ড’ বা বড় পাখি বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে, তা বোঝাই যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যে দুটি পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়, তাদের সংকেত নাম ছিল ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’।

 

রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও প্রয়োজনে সংকেত ব্যবহার করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিষয়কে আড়াল করার জন্য। বিভিন্ন পেশাজীবীর কিছু সংকেত তাদের প্রাত্যহিক কাজেকর্মে সাধারণ হয়ে ওঠে; গোপন করার ব্যাপারটি তখন মোটেও মুখ্য থাকে না। যেমন, ঢাকার রাস্তায় লোকাল বাসের হেলপাররা প্রাইভেট কারকে বলে ‘প্লাস্টিক’। বাসের একটু ধাক্কাতেই প্লাস্টিকের মতো দুমড়ে-মুচড়ে যায় প্রাইভেট কার; আবার ‘প্রাইভেট’ শব্দের সাথে ‘প্লাস্টিক’ শব্দের ধ্বনিগত সাদৃশ্যও আছে। ফলে, সংকেতটি ড্রাইভার-হেলপার মহলে জনপ্রিয় হতে সময় লাগেনি।

 

সংকেত ভাষা অপূর্ব সৃজনশীলতার পরিচয় দেয়। এখানে অপূর্ব শব্দটি ‘দারুণ’ এবং ‘পূর্বে ঘটেনি’ — দুটি অর্থেই বোঝাতে চাইছি। তবে, একটি স্বাধীন দেশে সাধারণ মানুষও যখন যোগাযোগের ভাষায় সংকেত ব্যবহার করতে থাকে, সেটি স্বাভাবিক অবস্থার ইঙ্গিত দেয় না। তখন এটিই নির্দেশ করে, সেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই।

1 COMMENT

  1. ধন্যবাদ বহুল প্রচলিত এ সংকেত ভাষাকে তুলে ধরার জন্য। এ বিষয়ে বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে অধিক তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। আমি ১৯৯৭ সালে প্যারিসে দেখেছি বাঙালি ছেলেরা অবৈধভাবে মেট্রো রেল স্টেশনে ছোট খাট হকারি করে । পুলিশ আসলে চিৎকার দিয়ে সাবধান করে মামু আসতাছে। মামু।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here