ফিলিস্তিনি গ্রাম বিরোহাতে ১৯৪১ সালে কবি মাহমুদ দারবিশ জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তার জন্মের সাত বছর পরেই দখলদার ইসরাইলি বাহিনি গ্রামটি ধ্বংস করে দেয়। কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র রাকার সম্পাদক, অনুবাদক হিসেবে কাজ করার সময় অসংখ্যবার কারাবরণ করেন এবং ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ দ্বারা বিড়ম্বনার শিকার হন।
মাহমুদ দারবিশের জীবনকাল যেন অনন্ত দুঃখগাঁথার সঙ্গে জড়িত। আর কবিতা — বিশেষত যখন তা আবৃত্তি করা হয় তখন দুঃখগাথা ও সুখ — মানুষের ভাগ্যলিপি হয়ে ফুটে উঠে এবং তার কণ্ঠস্বর ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণের অদম্য সাহসকে ফুটিয়ে তুলে। মৃত্যুবোধের সঙ্গে দারবিশের বোঝাপড়া অনন্য; ২০০৮ সালে জুলাই মাসে আরলিজ শহরে যখন তিনি তার শেষ কবিতা “একটি প্রস্তুতকৃত দৃশ্য” আবৃত্তি করেন তখন সেখানে কী অসাধারণভাবে বর্ণনা করেন শত্রুর সঙ্গে একই গর্তের মধ্যে আটকা পড়ার এক বিরল অনুভূতিকে।
মাহমুদ দারবিশ তার প্রজন্মের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য, অপূর্ব তার শব্দচয়ন। ফিলিস্তিনি তো বটেই এমনকি সমগ্র আরব বিশ্ব এবং সম্ভবত তার বাইরেও ব্যাপকভাবে তিনি জনপ্রিয়। এর একটি বড় কারণ ফিলিস্তিনি জনগণের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তিনি ছিলেন সরাসরি সম্পৃক্ত । অধিকৃত ফিলিস্তিনের অধিবাসী হয়েও বহিষ্কৃত হয়েছেন, জেল খেটেছেন, ঘর হারিয়েছেন এবং সেটা খুব ছোটবেলা থেকেই।
গ্যালিলিতে উদ্বাস্তু হিসাবে বড় হয়েছেন। ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু হিসাবে বড় হওয়া শিশু হিসেবে দেখেছেন মানবিক বিপর্যয়। মাত্র বার বছর বয়সেই ইসরাইলের জাতীয় দিবসে কবিতা পাঠ করে সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক হুমকির শিকার হন যদিও তাকে কখনো আগ্রাসী শক্তি থামাতে পারেনি। ইসরাইলের সামরিক শাসন, ইসরায়েলের কারা অভ্যন্তরে ফিলিস্তিনি সামরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতার সঙ্গে তার পরিচয় ফুটে ওঠে তার কবিতাগুলোয়। তিনি লেখেন তার বিখ্যাত কবিতা “সাজ্জিল আন্না আরাবি” অর্থাৎ “ নথিভুক্ত কর, আমি আরব” — যেটা ইংরেজিতে “Identity Card” হিসেবে প্রকাশিত ও আত্মজৈবনিক ডকু ফিল্ম হিসেবে রূপান্তরিত হয়।
তারপর স্বদেশ থেকে বহিষ্কৃত হন। দশ বছরের জন্য আশ্রয় নেন বৈরুতে। পিএলও নেতৃত্বের সঙ্গে নির্বাসিত জীবন ছেড়ে যখন রামাল্লায় বসবাসের অনুমতি পান তখনই সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে তার পরিচিতি ঘটে এবং পিএলও নেতৃত্বের আপোসকামিতার জন্য ১৯৯৩ সালে পিএলও-এর এক্সিকিউটিভ কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন।
দারবিশ একমাত্র কবি ব্যক্তিত্ব যিনি কিনা ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে ইজরাইলিদের অসম্মতিতে বড় হয়ে উঠেছেন। ইসরাইলের শাসনাধীন এলাকায় বড় হওয়া অন্যান্য লেখকদের মধ্যে থেকে সংস্কৃতি ও রাজনৈতিকভাবে দারবিশের অবস্থান অনন্য। কেননা তিনি কেবল শ্রদ্ধাভাজন কবি বা বুদ্ধিজীবীই ছিলেন না, ছিলেন ফিলিস্তিনের একজন প্রধান সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক ব্যক্তিত্ব।
তার কবিতা সাধারণ ফিলিস্তিনিদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। দারবিশ সবসময় ফিলিস্তিন ও ইসরাইল সমস্যার মানবিক সমাধান চাইতেন যার জন্য তিনি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা দলিল রচনা করতেও পিছপা হননি। যদিও ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের জন্য এটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তার কবিতার ভিত্তি হচ্ছে ধারালো রাজনৈতিক শব্দাবলি এবং ইসরাইলের অভ্যন্তরীন রাজনীতিও তার বোঝাপড়ার মধ্যে থাকতো বলে ইসরাইলের সাংস্কৃতিক মহলেও তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল।
দারবিশ গ্রীষ্মকে যেমন শরতের আবহে দেখতে ভালোবাসেন কবিতাতেও তিনি গদ্যের সঙ্গে পদ্যের মিশেল দেন। অনূদিত কবিতাগুলো “তৃষ্ণায় মরে যাওয়া একটি নদী” (A River Dies of Thirst) নামক কাব্য-জর্নাল থেকে নেয়া হয়েছে। Catherine Cobham কবিতাগুলো মূল আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন । ফিলিস্তিনিদের উপর নৃশংস হামলায় মাহমুদ দারবিশের কবিতা আমাদের জন্য শোকের মাতম — এক ফোঁটা অশ্রুপাত।
সবুজ মাছিগুলো
দৃশ্যটি আগে যেরকম ছিল, সেরকমই আছে,
গ্রীষ্ম ও ঘাম এবং কল্পনার অগম্য দূর সীমান্তরেখা, অধরা ।
আজকের দিনটি আগামীদিনের থেকে হয়তো ভালো,
কেবল মৃত্যুগুলোই আজ নতুন ।
প্রতিদিনই জন্ম নেয় যে নতুন শিশুরা
তারা ঘুমোতে যাওয়ার আগেই ঘুমজড়তা অবস্থা থেকেই
তাদেরকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়,
ঘুমের আগেই শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ে, মৃত্যুতে ।
তাদের গণনা করা মূল্যহীন ।
তারা — মৃত শিশুরা কেউ কারো কাছে কোনো সাহায্য চায়নি
সারা দেশজুড়ে কণ্ঠগুলো শব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছে
এবং তার প্রতিধ্বনি আহতদের আর্তচিৎকার হয়ে ফিরে আসছে :
‘এখানে কেউ নেই’
কিন্তু ওখানে কে যেন বলে উঠছে :
‘খুনির খুনের ক্ষুধা মেটাবার অধিকার আছে’
খুন হওয়া ব্যক্তি দীর্ঘ স্বরে বলে ওঠে,
‘খুন হওয়া ব্যক্তিরও অধিকার আছে জোরে চিৎকার করার’।
অবিচ্ছিন্ন চলতে থাকা শেষকৃত্যানুষ্ঠানে জড়ো হয় শত প্রার্থনার হাত;
কফিনগুলো ক্ষিপ্রগতিতে শূন্যে উত্থিত হয় এবং দ্রুতই মাটি চাপা পড়ে,
এখানে আর অন্য কোন আচার পালনের কোন সুযোগ নেই ।
আবার কোথাও হয়তো আক্রমণ হয়েছে
সেখানে ব্যক্তি অথবা গোটা একটি দল হয়তোবা কারো পুরো পরিবার
যাতে কেউ অনাথ হিসেবে বেঁচে না থাকে, একজনও না — এমন আয়োজন হয়
পিতা-মাতাসহ তাদের অসংখ্য লাশ উত্থিত হয় আর মাটিতে নেমে যায়,
উত্থিত হয় আর মাটিতে নেমে যায় ।
আকাশ ধূসর হয়ে আসছে, সমুদ্র নীল
কিন্তু অসংখ্য সবুজ মাছির কারণেই রক্তের রংগুলো ক্যামেরায় ধরা পড়ল না !
যদি কেবল কিছু পাথর হতাম
আমি যদি একদম কিছুই না হতাম
আমার কোনো গতকাল না থাকত
আগামীকালও না আসতো
এবং আমার বর্তমান অগ্র কিংবা পশ্চাদগামী কিছুই না হতো ।
যদি আমি কেবল কিছু পাথর হতাম
তাহলে বলতাম —
স্বচ্ছ জলের নিচে সবুজ হলুদ পাথরগুলো আমি হলে
প্রবহমাণ ঝর্ণা আমাকে চকচক করে তুলতো।
আমি হয়তো কারো কক্ষে কোনো আশ্চর্য ভাস্কর্য
কিংবা অপ্রয়োজনীয় থেকে প্রয়োজনীয় কোন ধাতব এ রূপান্তরিত হতে পারতাম ।
যদি আমি কিছু পাথর হতাম
তাহলেও হয়তো আমি কিছু পেতাম ।
শত্রু
তিনমাস আগে আমি সেখানে ছিলাম
এক বছর আগে আমি সেখানে ছিলাম,
এখন যা হচ্ছে একই ঘটনা যা ১৯৮২-তে ঘটেছিল ।
আমরা অবরুদ্ধ ছিলাম, মৃত্যুবরণ করেছিলাম,
এবং সেই নরকের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিরোধ তৈরি করেছিলাম;
আহত বা নিহতরা পরস্পর থেকে পৃথক
প্রত্যেকের মনোভাব, দৈহিক কাঠামো, চোখ,
ভিন্ন ভিন্ন নাম এমনকি বয়সেও আলাদা,
কিন্তু হত্যাকারীরা ঠিক একই রকম দেখতে,
তাদের একটিমাত্র সত্তা
একই যান্তব কাঠামোর ভিন্ন ভিন্ন অংশ তারা,
আসে ইলেকট্রনিক বোতাম চেপে
হত্যা করে মিলিয়ে যায় হাওয়ায় ।
সে আমাদের দেখতে পায়
কিন্তু আমরা তাদের দেখিনা ।
এটা এজন্য নয় যে তারা কোন ভূত কিংবা প্রেত
সেটা বরং এ জন্য যে
সে তার চিন্তাকে ইস্পাতের মুখোশে ঢেকে রেখেছে ;
সে অবয়বহীন,
চক্ষুবিহীন, বয়সহীন এমনকি নামবিহীন –
তাকে একটিই মাত্র নামে ডাকা যায়
— শত্রু —
বিধ্বস্ত বসতঘর
মাত্র এক মিনিটেই গোটা একটি বসতঘরের পরিসমাপ্তি ঘটেছে ।
ঘরকে ধ্বংস করাও একটি খুন,
সেখানে বসতি থাকুক আর নাই থাকুক ।
অসংখ্য কাঁচামালের সমাহারে একটি অর্থপূর্ণ এই কাঠামোটি তৈরি হয়
যেমন একটি কবিতা — যুদ্ধের সময় যেন তার কোনো গুরুত্ব নেই;
ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতঘরের সাথে তার অন্যান্য জিনিসপত্র
নাম ও অনুভূতির বিয়োগ-বিচ্ছেদ তৈরি হয়।
গৃহ সামগ্রীগুলোর বিয়োগ — ব্যথার মতই বাজে,
প্রতিটি গৃহ সামগ্রীর একটি বেদনা আছে —
একটি স্মৃতি, গন্ধ অথবা ইমেজ আছে।
একটি বসতভিটা ধ্বংস তার অধিবাসীকে হত্যার মতোই
এবং তার গৃহসামগ্রী পাথর, আয়না, লোহা ও কংক্রিট
বিধ্বস্ত করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হত্যা, হত্যাই তো।
সুতি, সিল্ক, কিংবা লিলেন, কাগজ ও বইপত্র
শতছিন্ন করা হয় যা নিন্দিত শব্দের মত।
বাসনপত্র, চামচ, খেলনা, গানের রেকর্ড, টেপ
পাইপ, দরজার হাতল, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, ফুলদানি
অলিভ কিংবা ভিনেগারের বৈয়ম, টিনজাত খাবার
সবকিছুই ছিন্নভিন্ন তার মালিকের মত!
লবণ, চিনি, মসলা, দিয়াশলাই বাক্স, ঔষধ
জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, বিষন্নতার ঔষধ, রসুনের ঝুড়ি
টমেটো, চাল-ডাল
সবকিছু তার মালিকের মতই ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে ।
ভাড়ার রশিদ, বিবাহের কাবিননামা, জন্মসনদ,
পানি ও বিদ্যুৎ বিল, পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, প্রেমপত্র
ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে আছে তার মালিকের হৃদয়ের মতো ।
ছবি, টুথব্রাশ, চিরুনি, কসমেটিক্স, জুতো ও আন্ডারওয়ার
সর্বত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে পরিবারের সব গোপনীয়তা জানিয়ে দিচ্ছে ।
এইসব জিনিসগুলো তাদের স্মৃতিকে জানান দিচ্ছে
যারা আর তাদের সাথে নেই ;
এবং এই জিনিসগুলোও আর তাদের নেই
এক মিনিটেই সব শেষ!
আমাদের জিনিসগুলো আমাদের মতই মৃত্যুবরণ করে
কিন্তু তাদেরকে আমাদের মত কবর দেয়া হয় না মাত্র।