প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ চর্চায় বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ নয়। লেখা হয়েছে যৎসামান্য, তাৎক্ষণিক দাবী মেটাতে, ফরমায়েশি ঢঙে। আর আছে আজগুবি, আবোল-তাবোল লেখার প্রবণতা। তথ্যের বিভ্রাট ও বিকৃতি তো আছেই, সেন্টিমেন্টাল ও বানোয়াট কেচ্ছা ফাঁদার প্রবণতাও প্রকট। শিরোনাম আপাত বিভ্রান্তিকর হলেও খসরু চৌধুরীর সুন্দরবনের বাঘের পিছু পিছু উপর্যুক্ত ত্রুটি মুক্ত। বইটি শিকার কাহিনি নয়, নয় বাঘের পরিচিতিমূলক গাইডবই, কিংবা সুন্দরবন-কেন্দ্রিক বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থ। বয়ানটি ট্রান্সজানরাঁ গোছের এক কম্পেডিয়াম—সাহিত্যিক বর্গসমূহ (শিকার কাহিনি, নেচার রাইটিং, ভ্রমণ, জার্নাল, স্মৃতিকথা, ব্যক্তিগত প্রবন্ধ ইত্যাদি) ও ন্যারেটিভ স্টাইলের (সিক্লিক্যাল ও ফ্রেমড্ ন্যারেশন) মিশ্রণে সৃষ্ট অনন্য এক রচনা, বিষয় ও ব্যাপ্তির নিরিখে যা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন রূপে বিবেচিত হবে। স্মর্তব্য, বৈজ্ঞানিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ, নৈর্ব্যক্তিক তথ্য ও সংহত আবেগের মেলবন্ধনে প্রকৃতি বিষয়ে রচিত লেখা বাংলা ভাষায় আক্ষরিক অর্থেই দুর্লভ; বাংলাদেশে পিটার মেথিইসেন কিংবা রাস্কিন বন্ডের মত নেচার রাইটার নেই।
খসরু চৌধুরীর বইটি সে ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ করেছে। বাংলা ভাষায় সুন্দরবন নিয়ে লিখিত বইগুলোর মধ্যে খসরুর বইটি সর্বোৎকৃষ্ট। সুন্দরবন নিয়ে নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত বাঙালির আহাজারি আক্ষরিক অর্থেই ক্ষণস্থায়ী ও বায়বীয়—বাজারি ফ্যাশন। সে আহাজারিও আবার একান্ত বাঘকেন্দ্রিক; বাঘ ছাড়াও সুন্দরবনে যে প্রাণ ও প্রকৃতির অস্তিত্ব আছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বাদার যে অভূতপূর্ব ভূমিকা বিদ্যমান, অধিকাংশ পাঠক সে সত্যটি অনুধাবনে অক্ষম। ফলে তাত্ত্বিক কিংবা নান্দনিক দৃষ্টিতে সুন্দরবন নিয়ে জানাশোনার আগ্রহ নেই, প্রচেষ্টাও নেই। লেখাজোখার পরিমাণ হাতেগোনা, দু-একটি ফিকশনে সীমিত।
সুন্দরবন নিয়ে কী প্রকৃতিবিদের, কী বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য লেখা তেমন হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের টাইগার প্রজেক্টের কর্তা কল্যাণ চক্রবর্তীর লেখাগুলো এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সার্ভে জাতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে মূলত পেশাজীবীদের প্রয়োজনে—সরকারী নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে। অথচ, বাঙালি সংস্কৃতি ও মানসে সুন্দরবনের স্থান প্রাণ-ভোমরার সাথে তুলনীয়। আর কোন অরণ্য বাঙালি মানসে, বাঙালির সাংস্কৃতিক অস্মিতা গঠনে অমন গভীর ছাপ ফেলেনি। ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে জাতীয় মানসে সুন্দরবনের অবস্থান তর্কাতীতভাবে অদ্বিতীয়। বৃহৎবঙ্গের বনাঞ্চলগুলোর অবস্থান সীমানা নির্ধারকরূপে বাংলার ভূ-প্রান্তে। বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্তর্ভুক্তি সাম্প্রতিক এক প্রক্ষিপ্ত অধ্যায় হওয়ায় বাঙালির মানস-মুকুরে এ সকল অরণ্য প্রান্তিক। সংকীর্ণ ব্যাপ্তির জন্যে মধুপুরগড় জনমানসে ছাপ ফেলেনি। ফলে সুন্দরবনের উপস্থিতি আজো অপ্রতিরোধ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
জাতীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক অস্মিতা নির্মাণে বাংলাভাষায় সুন্দরবন কেন্দ্রিক ন্যারেটিভের জন্ম হয়নি, অথচ বাঙালি মানসে বাদার আবেদন মার্কিনি মানসে ইয়োলো স্টোন ন্যাশনাল পার্ক কিংবা রুশ মননে তৈগার একমেবাদ্বিতীয়ম অবস্থানের সাথে তুলনীয়।
খসরুর বইটি ব্যতিক্রম মূলত দু’টি কারণে। বইটি প্রথমত, বাংলা ভাষায় মার্কিনী প্যাস্টোরাল ঘরানার ডিপ ইকোলজি ধাঁচের পরিবেশ সাহিত্যের পত্তন করেছে। ভৌগোলিক সীমানায় অরণ্যের উপস্থিতি এবং পালামৌ এর মত রচনার উদাহরণ সত্ত্বেও বাংলা ভাষায় অন্তর্দর্শী দৃষ্টিসম্পন্ন নন-ফিকশন প্যাস্টোরাল সাহিত্যের ধারা গড়ে ওঠেনি। জাতীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক অস্মিতা নির্মাণে বাংলাভাষায় সুন্দরবন কেন্দ্রিক ন্যারেটিভের জন্ম হয়নি, অথচ বাঙালি মানসে বাদার আবেদন মার্কিনি মানসে ইয়োলো স্টোন ন্যাশনাল পার্ক কিংবা রুশ মননে তৈগার একমেবাদ্বিতীয়ম অবস্থানের সাথে তুলনীয়। খসরুর সন্দর্ভটির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য লেখাটির ডিসকার্সিভ সম্ভাবনা। তাত্ত্বিক কাঠামোর ছকে সহজে ফেলা যায় বাদার এমন সুনির্দিষ্ট এক মেটান্যারেটিভ উপস্থাপনের মাধ্যমে সাহিত্য ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে খসরু বাংলা ভাষায় প্রতীচ্য ধারার নন-ফিকশনাল নেচার রাইটিং-এর ভিত্তি স্থাপন করেছেন। উভয়বিধ তাৎপর্যের কারণে খসরুর রচনাটি কন্টিনেন্টাল ধাঁচের ক্রিটিক—ডিসকোর্সের পদ্ধতিগত আলোচনা দাবী করে। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে বাদার মেটান্যারেটিভ বয়ানের জাতীয়তাবাদী স্বরূপ উদঘাটন করে আমি খসরু উপস্থাপিত বয়ানের স্বকীয়তা ও এর হেজেমনিক বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করব।
এক
নিসর্গের উপস্থিতি মাত্রই কোন লেখা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবেশ সাহিত্যভুক্ত হয় না। পরিবেশ সাহিত্য গণ্য হতে, টেক্সটকে, লরেন্স বুয়েল জানাচ্ছেন, আবশ্যিকভাবে চারটি শর্ত পূরণ করতে হবে। রচনায় পরিবেশের প্রাইমেসিকে পরিবেশ সাহিত্যের আবশ্যিক লক্ষণ চিহ্নিত করছেন বুয়েল। প্রাইমেসির বৈশিষ্ট্য ব্যাখায় বুয়েল জানাচ্ছেন :
the nonhuman environment is present not merely as a framing device but as a presence that begins to suggest that human history is implicated in natural history; the human interest is not understood to be the only legitimate interest; human accountability to the environment is part of the text’s ethical orientation; some sense of the environment as a process rather than as a constant or a given is at least implicit in the text. (Buell 1995: 7-8)
বুয়েল প্রদত্ত শর্তসমূহ খসরুর বইটি কমবেশি পূরণ করেছে। খসরু প্রকৃতিকে লেখার প্রেক্ষাপট করেননি, সম্মুখপট করেছেন; বাদা খসরুর উপজীব্য, বয়ানের প্রধান ফোকাস; বাদাকে খসরু দেখেছেন দর্শকের চোখে, হাতে-কলমে, নৈর্ব্যক্তিকতা ও এম্প্যাথি মিশিয়ে। বাদার বস্তুগত ও ইন্ট্রিন্সিক ভ্যালুকে লেখায় প্রাইমেসি দিয়েছেন, মনুষ্যস্বার্থ খসরুর লেখায় সমগ্রের অংশ মাত্র। বাদার প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা, বাদাবন সংরক্ষণের অপরিহার্যতা বইটির অন্তর্নিহিত সুর। সর্বোপরি, বাদারবনের সদা পরিবর্তনশীল পরিবেশ এবং পরিবর্তনশীলতার সূত্র খসরুর আরেকটি ফোকাস।
সন্দর্ভটি পরোক্ষভাবে কালচারাল স্টাডিজের আঙ্গিকে বিধৃত। খসরু তাত্ত্বিক নন, তত্ত্ব তৈরির সচেতন প্রচেষ্টাও তিনি করেননি। তথাপি কাজটি কমবেশি বার্মিংহাম কালচারাল স্টাডিজ স্কুলের অনুসৃত পদ্ধতিতে লিখিত। কালচারাল স্টাডিজ ট্রান্সডিসিপ্লিনারি এক স্কুল। ঘরানার মুখ্য তাত্ত্বিকগণ—রিচার্ড হোগার্ট, স্টুয়ার্ট হল, রেমন্ড উইলিয়ামস্, পল গিলরয় প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত বহু জ্ঞানশাখা যেমন সাহিত্য সমালোচনা, সমাজতত্ত্ব, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক ভূগোল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, মিডিয়া স্টাডিজ, যোগাযোগবিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতির ডিসকোর্স ও মেথোডোলজি মিশ্রণে পদ্ধতিগত আলোচনা করে থাকেন। খসরুও অনেকটা তাই করেছেন। সুন্দরবনের রক্তাক্ত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এনেছেন সমকালের মানবিক বিপর্যয় আলোচনায়। বাদার বনজ, জলজ ও প্রাণীজ সম্পদের হিস্যায় স্থানীয় ও বহিরাগত, প্রাতিষ্ঠানিক (বন বিভাগ, পোর্ট অথরিটি) ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বৈধ-অবৈধ প্রাইভেট ইন্টারেস্ট গ্রুপের যে সম্পৃক্ততা, দ্বন্দ্ব, ও ঐক্য পরোক্ষে ছুঁয়েছেন। বাদার কাঠচোর বা দস্যু যে স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে চলে, লাইসেন্স-পারমিট-তোলার ব্যবসায় সরকারি-বেসরকারি-বৈধ-অবৈধের পার্থক্য যে নেই পরিহাসে, ইঙ্গিতে খসরু সেটা যথেষ্ট বলেছেন। আলোচনা করেছেন ডাকাত দলের আভ্যন্তরীন কোন্দলে বনবিভাগের সম্পৃকক্ততা—উস্কানি ও স্বার্থ হাসিলের আশ্চার্য কাহিনি।
কালচারাল অবজেক্টস্ অধ্যয়ন থেকে শুরু করে সামাজিক মূল্যবোধ, সময়, স্থান, পরিসর, ও প্রকৃতির ধারণা কালচারাল স্টাডিজের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। খসরুর এপ্রোচও তদ্রূপ। বনপ্রশাসন, প্রশাসনিক বিভাজন ও প্রশাসন পদ্ধতি আলোচনা করেছেন। কালচারাল স্টাডিজ তাত্ত্বিকের অনুসরণে ম্যাথু আর্নল্ডকৃত উচ্চ ও নিম্নকোটি আর্টের পৃথকীকরণের বিরোধিতা খসরুর কাজেও লক্ষ্যণীয়। সুন্দরবন নিয়ে পেশাজীবী গবেষক, নগরকেন্দ্রিক শৌখিন পর্যবেক্ষক, কিংবা উচ্চবর্গীয় প্রশাসনিক ভাষ্যের পাশাপাশি নিম্নবর্গীয় পেশাজীবী—পাহারাদার, বনরক্ষী, আর্দালি, নিকারী, বড়িয়াল, ঘাসুরে, চোরা-শিকারী, ও সাধারণ মানুষের বাদা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা, প্রত্যয় ও ফোকলোর লিপিবদ্ধ করেছেন—উৎপাদন, বিতরণ ও কনজামশন থেকে টেক্সট আলাদা বিবেচনা করেননি। অনুসন্ধিৎসার পদ্ধতি হিসেবে সার্ভে, সাক্ষাৎকার, ক্ষেত্রসমীক্ষা, ও অডিয়েন্স স্টাডি করেছেন। বলাবাহুল্য, কালচারাল স্টাডিজে এগুলো অনুসৃত পদ্ধতি।
বয়ানের কাঠামো ও কনটেন্টের বিচারে বইটির ব্যাপ্তি মহাকাব্যিক; বইটি নাতিদীর্ঘ অনেকগুলো পরিচ্ছদে বিন্যস্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ, আন্তঃসম্পর্কিত বয়ানের সমাহার। প্রাণ, প্রকৃতি ও সুন্দরবনের যোগসূত্রে গ্রথিত বয়ানের সমাহারে নিহিত আছে লেখকের সুন্দরবন সংক্রান্ত মেটান্যারেটিভ। একক কিংবা একাধিক বয়ানের বিশ্লেষণাত্মক বয়ান উত্তর-কাঠামোবাদে মেটান্যারেটিভ টার্মে অভিহিত হয়; প্রদত্ত সংজ্ঞার আলোকে খসরুর কাজটি বাদার মেটান্যারেটিভ আখ্যা লাভের যোগ্য। বাদার সাথে প্রত্যক্ষ্য ও পরোক্ষে জড়িত গণ-মানুষের ব্যক্তিগত ন্যারেশন ও প্রাতিষ্ঠানিক (সরকারি বনবিভাগ) ভাষ্যগুলো খসরু চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণে মিলিয়ে দেখেছেন। উত্তর-কাঠামোবাদী তরিকায় বাদার অর্থ অর্থাৎ বাদার মিনিং অনুধাবনে বাদাবনকে টেক্সট হিসেবে পাঠ করেছেন। পাঠান্তে উত্তর-কাঠামোবাদ থেকে কাঠামোবাদে প্রত্যাবর্তন করে খসরু বাদার নিজস্ব ভাষ্য তৈরি করেছেন। বাদা সম্পর্কিত খসরুর সিনথেটিক দৃষ্টিভঙ্গি উচ্চকন্ঠী নয়, তবে নির্ণেয়। খসরুর সিনথেটিক ভাষ্যটি সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে প্রকৃতির সংজ্ঞার্থ ও প্রকৃতির ধারণা সম্পর্কিত তত্ত্বের ঐতিহাসিক বিকাশের পরিপ্রেক্ষিত অনুধাবন জরুরি।
প্রকৃতিকে প্রথমত, আর্টিফিস (Artifice) ও প্রযুক্তির (Technology) প্রতিপক্ষে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এ সংজ্ঞায় প্রকৃতি হচ্ছে মনুষ্য বলয় বা ডোমেইনের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত। আবার, মানুষের প্রযত্নে উৎপন্ন বা কর্মতৎপরতায় উৎপন্ন ফলরূপেও প্রকৃতি কল্পনা করা হয়। পদার্থবিজ্ঞান কিংবা রসায়নের অপ্রাণ জগতের বিপরীতে প্রাণবিজ্ঞানের চৌকাঠে প্রাণের প্রকাশ সীমাবদ্ধ বিধায় প্রাণের চিহ্ন হিশেবেও প্রকৃতি চিহ্নিত হয়ে থাকে। ক্যাটাগরিক্যালি শুধু প্রাণধারী সত্তার, অর্থাৎ ইনঅর্গানিক নয়, অর্গানিকের বিন্যাসকেও প্রকৃতি বলা হয়। অতিপ্রাকৃতের বিপরীত—দেবদেবী বা ভূত-প্রেতের সুপার-ন্যাচেরাল জগতের বিপরীত চাক্ষুষ পৃথিবীও প্রকৃতির সংজ্ঞায় ধৃত।
সুপার-ন্যাচেরাল জগতের প্রতিপক্ষে নৈরাজ্য, বিশৃংখলা ও মৃত্যুর সাথে প্রকৃতিকে এক করে দেখার ঐতিহ্য আছে—খৃষ্টধর্মের মধ্যযুগীয় স্কলাস্টিক ঐতিহ্য এ প্রত্যয়কে সার্বজনীন গ্রাহ্যতা দিয়েছে। দার্শনিক থমাস হবস্ও প্রকৃতিকে জরা, মৃত্যু ও জিঘাংসার সাথে সমীকৃত করেছেন। প্রকৃতির কোলে নৈসর্গিক মনুষ্য জীবন হবসে্র ভাষায় ন্যাস্টি, ব্রুটিশ ও শর্ট। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে প্রকৃতিকে ফের র্যাশনাল আইন ও প্রক্রিয়া হিসেবে দেখার প্রবণতা শুরু হয়। নিষ্পাপ (Innocence) ও পুনরুদ্ধারের (Recuperation) উৎস হিসেবে প্রকৃতিকে দেখার প্রবণতা রোম্যান্টিসিজমের প্রভাবে শুরু হয়। প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র রক্ষার পক্ষে প্রদত্ত যুক্তিগুলোর মধ্যে আধুনিক ইকোলজিক্যাল চিন্তায় আপাত-নান্দনিক (Quasi-aesthetic) এবং নৈতিক (ethical) স্কুলের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। আপাত-নান্দনিক চিন্তাধারা প্রাণ ও প্রকৃতিকে অভীষ্ট (End) রূপে—উপায় (Means) রূপে দেখে না। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য, বৈচিত্র ও প্রিস্টিননেসের নিরিখে এ স্কুল প্রকৃতিকে রক্ষায় আগ্রহী। নৈতিক যুক্তির স্কুল মানুষের মননে নৃ-কেন্দ্রিক (Anthropocentric) যুক্তির প্রভাব কমিয়ে প্রকৃতির ওপর মানুষের শাসন শিথিলে আগ্রহী (During 2005: 208-110)। প্যাস্টোরাল ও সাবলাইম অনুভূতি মিশ্রিত খসরুর প্রকৃতিচিন্তা ধ্রুপদী রোম্যান্টিকতায় আক্রান্ত। সুন্দরবন সুরক্ষার পক্ষে ওর ইঙ্গিতপূর্ণ সূক্ষ্ম যুক্তিগুলো আপাত-নান্দনিক স্কুল ঘেঁষা প্রতিভাত হলেও উপযোগবাদীর লজিকে জাতীয় জীবনে বাদার উপযোগিতা তুলে ধরেছেন খসরু।
দুই
বাদাবনের কম্পেডিয়াম হলেও বইটিতে সবচেয়ে বেশি আছে নিসর্গে একাকী জাগরণের, শিরদাঁড়ায় শিহরণ অনুভবের অন্তর্ভেদী গথিক রসের অনুপুঙ্খ বর্ণনা। নিকষ কৃষ্ণ আঁধার কী কোজাগরী পূর্ণিমা মাদক অনুভূতির জন্ম দেয়। মনের মুকুরে বাঘের সদা সতর্ক উপস্থিতি আনক্যানি (Uncanny) ও এরিঈ (Eerie) ফিলিংস তৈরি করে। এ রকম একাধিক অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন খসরু। আইনী সমস্যার কারনে রাত্রে আশ্রয় প্রদানে গৃহকর্তা অপারগতা জানালে সদলবলে পদব্রজে লঞ্চঘাটে ফেরেন খসরু। বেড়িবাঁধ অবধি মেঠো পথে সব্বাই নিশ্চুপ—যে কোন মুহূর্তে বড়মিয়াঁর সাথে মুখোমুখির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। লঞ্চঘাটে শীতের কনকনে নিশুতি রাতে গড়ানের বেড়ার দুয়ারহীন মাছের এক খটিতে আশ্রয় নিলেন খসরু। সিদ্ধান্ত হলো, পালা করে পাহারা দেবেন। পাহারায় বসে খসরু দেখছেন জোস্নায় ভেসে যাচ্ছে ঘন সবুজ বন, শুনছেন স্কপস্ পেঁচার ডাক। অতি ভোরে, বড় মিয়াঁর শিকারের সময় শুনছেন পাশের খালে সশব্দে ঝাঁপ দেবার গা হিম করা ভেসে আসা শব্দ (১০২-৪)।
স্নায়ুর চাপে নিশ্চিত মৃত্যুমুখে হেটে যাওয়াকে আটপৌরে গ্রাম্য ভাষায় নিশিতে পাওয়া বলে। বাদার আধিভৌতিক পরিবেশ মনকে সহজেই হিপ্নোটিক করে তোলে। সম্মোহিত হয়ে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বিপদ ডেকে আনে মানুষ। কটকাপর্বে সুবেহ সাদিকের দিকে মাচা থেকে নেমে বালিয়াড়ির দিকে হেঁটে জীবন প্রায় বিপন্ন করেছিলেন খসরু। বালিয়াড়ি পৌছা মাত্র ত্রস্ত হয়ে ওঠে গহিন ঝোপ। হরিণের উৎকণ্ঠিত সচল প্রস্থান চরম মুহূর্তের সৃষ্টি করে। বালিয়াড়ির খাঁজে শুয়ে প্রাণ রক্ষা করেন খসরু। সশস্ত্র গার্ড এসে উদ্ধারের আগে, খসরু জানাচ্ছেন, সর্বদা মনে হচ্ছিলো—কেউ বুঝি তাকে দেখছে, এসে মুখে তুলে নেবে (৩৫২)। আনক্যানি ফিলিংস অবশ্য খসরুর আরো হয়েছিলো। টিপটিপ বৃষ্টির দিনে দুবলার পুকুরে একাকী স্নানের সময় অস্বস্তি বোধ করেন। খসরু পরে জেনেছেন, জলপানকারী প্রাণীর খোঁজে প্রায় রোজ রাতেই সে পুকুরঘাটে বাঘ আসতো (৩৯৭-৮)।
চাপা ভয়াল পরিবেশ যে তীব্র স্নায়ুচাপ তৈরি করবে, অস্বাভাবিক নয়। স্নায়ুচাপ অবশ্য সহনীয় হয়ে আসে, অবলীলায় বিপদের সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করে মানুষ। বহির্গতরা বাদায় যখন ভয়ে কাতর, স্থানীয় মানুষ সম্পূর্ণ নির্বিকার। অনেক উদাহরণ দিয়েছেন খসরু। সহযাত্রীর দল ডাঙায় উঠলে নিরস্ত্র খসরু নৌকায় অসহায় বোধ করেন। বাঘের আনাগোনা প্রসঙ্গে খসরুর প্রশ্নে পাহারাদারের নির্বিকার উত্তর, “ও আসলি আর মতলব থাকলি জেইগে বসে বন্দুক দিও কিছু কত্তি পারবা না” (৩৫)। অসহায়ত্ব থেকেই এখানকার মানুষের মনে হয়ত দৈবে আস্থা হয়েছে দৃঢ়। মধ্যরাতে বৈদ্যমারী বাজারের খোলা চত্বরে দেখা মেলে শায়িত এক ভবঘুরের। এলাকায় তখন বাঘের আনাগোনা। নিরাপত্তার প্রশ্নে ভবঘুরের নির্বিকার উত্তর, “ও বাঘের কাজ গরু-ছাগল ধরা, আমি তো কিছু করছি না, বাঘ আমারে ধরবে ক্যান” (২৭৯)? মানুষের পক্ষে যদি এ মাত্রায় নির্বিকারত্ব অর্জন সম্ভব হয়, “সারাক্ষণ মৃত্যু আতঙ্ক মগজে নিয়ে প্রাণীকুলের” ক্ষেত্রে কী ঘটে, খসরুর তোলা প্রশ্ন (৩৪২) অবান্তর। তা না হলে, নৌকা থেকে বাদার জমিনে ওঠা ফুল মিঞার ছেলে ও ফুল মিঞা কী করে ঘণ্টাতক বাঘের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলো? গর্জন উপেক্ষা করে পালটা চিৎকার করেছিলো? নিত্য স্নায়ুচাপ মানুষের স্ট্রেস নেবার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, অনুভূতিকে স্থূল করে দেয়।
তিন
স্নায়বিক চাপ বাদার একমাত্র চিত্র নয়। বিপরীত চিত্রও আছে অবারিত। বনরাজির লাস্যে বাদার রয়েছে সুখদ প্রভাব। ভয়ংকর সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি বাদার প্যাস্টোরাল সৌন্দর্য্য বর্ণনায় খসরু অক্লান্ত। ধ্রুপদী রোম্যান্টিকতায় আচ্ছন্ন খসরু উপাচারে দিয়েছেন সুন্দরবনের দৃষ্টিনন্দন খাল, নালা, আর সোঁতার ক্যাটালগিক বিবরণ। খসরুর প্যাস্টোরাল চেতনা একিউমুলিটিভ (Accumulative) বিধায় প্যাস্টোরালের কমবেশি সকল সংজ্ঞার্থ ওর লেখায় প্রযোজ্য। প্যাস্টোরাল সংক্রান্ত সাহিত্যতত্ত্ব বিশ্লেষণ করে এলপার্স জানাচ্ছেন, “নিষ্পাপ ও সুখে প্রত্যাবর্তনের দ্বৈত আর্তি,” “স্বর্ণযুগ সম্পর্কে সার্বজনীন প্রত্যয়,” “শিল্পকলা ও প্রকৃতির দ্বন্দ্ব,” “নগরজীবনের প্রতি বৈরিতা,” “গ্রামীণ জগতের মাধ্যমে সাধারণ অভিজ্ঞতার প্রকাশ,” ইত্যাকার ভাবনা প্যাস্টোরালের সংজ্ঞায় বিধৃত হয়েছে। প্যাস্টোরাল ধারণার বহুগামিতা, বহুমাত্রিকতা সংজ্ঞার ক্ষেত্র তৈরি করেছে (Alpers 1982:437-8)। খসরুর কলমে বাদার নান্দনিক বর্ণনায় উল্লেখিত ভাবনাগুলোর সমাহার লক্ষ্যনীয়। খসরু জানাচ্ছেন, কচিখালী বা টাইগার পয়েন্টের শুকপাড়া খাল, সুপতি নদী থেকে বের হয়ে দক্ষিনে বয়ে যাওয়া খাল, কটকা অভয়ারণ্যের সন্নিকটের জামতলা খাল, সুন্দরার খাল, হারবাড়িয়া খাল, কিংবা দাসের ভারানীর খাল পরিভ্রমণে দেখা মেলে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপাচার (১৮০-১)। এখানে আছে কুমির, বার্কিং ডিয়ার, চিত্রল হরিণ সহ রাজ্যের যত পাখ-পাখালী। কপাল গুনে বড় মিয়াঁর সাথেও চোখাচোখি হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
পুষ্প ও সুগন্ধের প্রাচুর্য্য বাদার আরেক রূপ। বাদায় মেলে গর্জন, গরান, কেওড়া, হ্যাতাল, পশুরসহ হরেক গাছ-গাছালির ফুল। দর্শনার্থীকে তবে আসতে হবে এপ্রিল-মে মাসের তীব্র দাবদাহ ও আর্দ্রতা উপেক্ষা করে। এ সময়—বর্ষায় ফোটে ছয়লা, ওড়া, গেউয়া, গর্জন, ঝানা, কাকড়া গাছের ফুল (১৪১)। সময়টি সুগন্ধের জন্যে বিখ্যাত। কারণ ব্যাখ্যা করেছেন খসরু। জানাচ্ছেন, সুন্দরবন আদতে সুগন্ধযুক্ত এলাকা নয়—কোন ম্যানগ্রোভই সুগন্ধের জন্যে খ্যাত নয়। জংগলে সবসময় উদ্ভিদ ও প্রাণী মারা যাচ্ছে, মরদেহ পচছে—উৎপন্ন হছে প্রচুর মিথেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড। পচনশীল জৈবপদার্থের আধিক্যহেতু খাল-নালায় সালফার বা গন্ধকযুক্ত গ্যাস ওঠে, দুর্গন্ধ ছড়ায়। কিন্তু এপ্রিল-মে মাসে পশুর ও অন্যান্য গাছের ফুল এত তীব্র সৌরভ ছড়ায় যে, খলসে ফুলের সুগন্ধ মিশ্রিত সম্মিলিত এ ফ্র্যাগর্যান্স বনের দুর্গন্ধকে ছাপিয়ে যায়। খসরুর অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বাদার দৃশ্য-শ্রাব্য-গন্ধের ত্রিমাত্রিক চিত্র রচনাটিকে নেচার রাইটিং ও প্যাস্টোরালের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক দৃঢ়ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
নেচার রাইটিং এর টিপিক্যাল ফর্মের স্বরূপ বর্ননায় শিসি জানাচ্ছেন, নেচার রাইটিং হচ্ছে “first person nonfiction account of an exploration, both physical (outward) and mental (inward), of a predominantly nonhuman environment, as the protagonist follows the spatial movement of pastoralism from civilization to nature”। প্রাকৃতিক শক্তির সাথে ইন্টারএকশনে ব্যক্তির মানসিক সমৃদ্ধি ও ম্যাচুরিটি অর্জনের ইতিহাস বিবৃত হয় বিধায় (Scheese 1996:6) নেচার রাইটিং শিসির দৃষ্টিতে এক অর্থে আধ্যাত্মিক আত্মজীবনী। শিসির বক্তব্য অনুসরনে আলোচ্য লেখাটি সে অর্থে খসরুর আত্মজীবনী। বইটির পাতায় ধরা আছে ব্যক্তি খসরুর মানসিক বিবর্তন, প্রকৃতির সাথে নৈকট্য স্থাপনের ইতিহাস। রোম্যান্টিক সংবেদনশীলতার প্রভাবে খসরুর দৃষ্টিতে বাদা স্বর্গতুল্য, ইডেন গার্ডেনের মর্ত্যরূপ। বাদার রূপের কাব্যিক বর্ননায় খসরু যে ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাবশিষ্য, সচেতন পাঠকের দৃষ্টিতে সেটা অগোচর নয়। বাদার অনন্য অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে অবশ্য কষ্ট করতে হবে। ফুল ফোটার মৌসুম আবার কাল-বৈশাখীর সময়, প্রচণ্ড গরম আর মশার ভয়ানক আধিক্যের কাল এ সময় (২৩৩)।
জাত ভ্রমণকারী বা বনপ্রেমীদের কথা অবশ্য আলাদা। রোম্যান্টিকের জন্যে বাদার প্রতিটি ইঞ্চি পেতে রেখেছে প্রকৃতির উপাচার—থাকতে হবে শুধু দেখার চোখ। কটকার মাচায় বসে জ্যোৎস্নায় প্লাবিত বনের সৌন্দর্য্য দেখে খসরু লিখছেন, “জ্যোৎস্নায় বনের আনাচে কানাচে তাকাতে তাকাতে কেমন যেন বিভ্রান্তি” চলে আসে। আরো বলছেন, “আশপাশ…সুরিয়ালিস্টিক হয়ে” ওঠে, সামনের হরিণকে মনে হয় “সোনার হরিণ” (৩৪৯)। লক্ষনীয়, বাদার বর্ণিত সৌন্দর্য্য গিফোর্ড উল্লেখিত দ্বিতীয় ধাঁচের প্যাস্টোরালের উদাহরণ। বর্গের বিচারে তিন প্রকারের প্যাস্টোরাল চিহ্নিত করেছেন গিফোর্ড। প্রথম প্রকার মূলত সাহিত্যিক, নগর জীবন থেকে পশ্চাদপসারণের থিম এর মৌল বৈশিষ্ট্য। খসরুর লেখায় আমরা নাগরিক কোলাহল থেকে পলায়ন দেখেছি। দ্বিতীয় বর্গের প্যাস্টোরালে নগর ও গ্রামীণ সৌন্দর্য্যেকে বিপরীতভাবে দেখানো হয় (Gifford 1999:2)। খসরুর কলমে বাদার জ্যোৎস্নার বিবরণে, মনের ওপর সে জ্যোৎস্নার প্রতিক্রিয়া বর্ণনায় নগর ও বাদার বৈপরীত্যের প্রকাশ প্রকট। পুরো বইটিতে প্রকৃতিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার এমন অনেক বর্ণনা আছে।
পাখ-পাখালির বর্ণনাতেও খসরু অক্লান্ত। বিচিত্র প্রজাতির পাখির আবাস সুন্দরবনে। পাখি দেখারও মওসুম আছে। সব পাখির দেখা সব সময় মেলে না। কিছু পাখি পরিযায়ী, বছরের বিশেষ সময়েই মেলে। স্থানীয় পাখির দেখা মেলে সবসময়। কী পাখি আছে এ বনে? ক্যাটালগের মত খসরু কিছু নমুনা দিয়েছেন—দরজী টুনটুনি, এয়াবটস ব্যাবলার, কাল বুলবুল, ফটিকজল, শ্বেতাক্ষ, নটহ্যাচ; জলের ধারে আছে মাছরাঙা, শিকরা, শঙ্খচিল, বুকশাদা সমুদ্র ঈগল, ক্রেস্টেড্ সার্পেন্ট ঈগল; অতিথি পাখির মধ্যে আছে তীরখুটা, ইউরেশিয়ান কার্লু, হুইমরেল, গডউইট। দুর্লভ বাঁশঘুঘুও দেখেছেন খসরু। পেশাদারিত্বের সাথে খসরু এদের দৈহিক ও বায়োহ্যাবিটাটের বর্ননা দিয়েছেন; জানিয়েছেন এদের খাদ্যাভাস, মেটিং হ্যাবিট, কণ্ঠস্বর, প্রাণচাঞ্চল্য ও ঘর বাঁধার খুঁটিনাটি নিয়মকানুন (১৪৬-৭)।
চার
সুন্দরবন ভয়াল সুন্দর। অপার সৌন্দর্য্যের প্রতি পদে অবশ্য ছড়িয়ে আছে মৃত্যুর হিমশীতল বিভীষিকা। বাদায় মানুষ সবচেয়ে বেশি মরে বাঘের হাতে নয়, সর্প দংশনে। বিষধর বেশ কিছু জলজ ও ডাঙার সাপের বাস এ বনে। বিষধর সাপগুলো ইলাপিডি বা স্থায়ী দাঁতের—কেউটে, কালাজ, গোক্ষুর, শঙ্খচূড় (১৬৩); আছে জলবোঁড়া, পাইথন, ময়াল ইত্যাদি; অতিরিক্ত আরো আছে টিয়ে বোঁড়া, গ্রীন পিট ভাইপারের দুটি উপপ্রজাতি (১৪৯)। কাঁকড়া, শামুক, কামট, কুমিরের কথা না হয় বাদ দেয়া হলো। স্মর্তব্য, সুন্দরবনে কিং ক্র্যাবও আছে, জানাচ্ছেন খসরু।
সৌন্দর্য্য ও মৃত্যুর পারস্পরিক সহাবস্থানের কারণে সুন্দরবনকে খসরু উপস্থাপনা করেছেন ফেম ফ্যাটাল (Femme Fatale)—দীপ্ত পৌরুষ সংহারকারী, লাস্যময়ী সিডাকটিভ ললনার রূপে। প্রতিলোমী ভয়াল রূপ ও সৌন্দর্য্যের মিশ্রণে আমাদের হতবিহ্বল করে দেবার ক্ষমতার জন্যে নন্দনতত্ত্বের ক্যাটাগরি অনুসারে বাদার সৌন্দর্য্যকে সাবলাইম বলা চলে। হতবাক করে দেবার ক্ষমতা, দার্শনিক এডমন্ড বার্কের ভাষায় যা এস্টোনিস্ম্যান্ট, সাবলাইম সৌন্দর্য্যের মূল লক্ষণ। বার্কের ভাষায়,“the passion caused by the great and sublime in nature…is Astonishment; and astonishment is the state of the soul in which all its motions are suspended, with some degree of horror (Burke 1990:53)।
বার্ক বর্ণিত হরর বা ভীতি মিশ্রিত সাবলাইম বাদার সৌন্দর্য্য সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা। বাদার দ্বৈতস্বরূপ ছাপ ফেলেছে স্থানীয় মানুষের মনের গড়ন তৈরিতেও। বাদার ও বাদার আশেপাশে বৈপরীত্যে ভরা আশ্চার্য সব মানুষের খোঁজ দিচ্ছেন খসরু। এদের কেউ প্রগাঢ় মিস্টিক তো কেউ চরম ভোগবাদী। শিকার শেষে খসরু একবার আবিষ্কার করেন নিহত হরিণটির চোখে ছানি পড়া—চোখের ছানির জন্যেই ঘায়েল হয়েছে প্রাণীটি। ফিরতি যাত্রায় খসরু শোনেন স্পীডবোট চালকের স্বগক্তি, “আমরা তো চললাম যার যার মোকামে, হরিণডা চলল তার এলাকা, চিনা জায়গা ছেড়ে। আর এদিকটা দেখতি পাবি না” (১৭৭)। মৃত হরিণের প্রতি এমন প্রগাঢ় এম্প্যাথিকে কী বলবেন আপনি? বিপরীত চিত্রও আছে। যাত্রায় সঙ্গী হতে অনুরোধে জনৈক ভোগবাদীর প্রতিউত্তর, “শিকার টিকার হলি যেতাম…ফাটানো গরমে বাদায় যায় কোন শালা” (১৩৮)।
পাঁচ
বাঘ আর হরিণ ছাড়া বাদার কাহিনি পূর্ণ হয়? চমৎকার কিছু লোমহর্ষক মানুষখেকোর শিকার শুনিয়েছেন খসরু। জিয়াউল হকের দুবলা ও জটাওয়ালা বাঘ (৬২, ৭১) হত্যা ছাড়া আছে পচাব্দী গাজীর উল্লেখযোগ্য কিছু শিকারের অনুপুঙ্খ বর্ননা। শিকার যদি পারফর্মিং আর্ট হয় তো গাজীবংশ হচ্ছে সে কলাচর্চার ঠাকুর পরিবার। প্রজন্ম ধরে এরা যেমন মেরেছে মানুষখেকো, মরেছেও তেমনি আকছার, বেঘোরে—বাঘের হাতে। পুরো একটি পরিচ্ছদে (২৪৩-৫) এদের বৃত্তান্ত আলোচনা করেছেন খসরু। এক্সক্লুসিভ হিসেবে দিয়েছেন পচাব্দীর দুবলার বাঘ হত্যার কেচ্ছা (২৪৬-৭)। বাঘ শিকারের আলোচনা ধরে এসেছে বাঘের সংখ্যা, প্রকারভেদ, হ্যাবিটাট, নিহত বাঘের দৈর্ঘ্যের মাপজোক সংক্রান্ত কিছু প্রচলিত বুজুরকি উন্মোচনকারী তথ্য।
খসরু জানাচ্ছেন, দু’ভাবে (ওভার দ্য কার্ভ এবং বিটুইন দ্য লেগ) বাঘের দৈর্ঘ্য মাপা হয়। অঘোষিত প্রতিযোগিতার কারণে মৃত বাঘকে বেঁধে টেনে দীর্ঘাঙ্গ করার চল আছে (২৪৯)। বিপন্ন প্রাণী বাঘের কিছু জনমিতিভিত্তিক তথ্যও দিয়েছেন খসরু। পৃথিবীতে প্রাকৃতিক পরিবেশে বাঘ আছে হাজার চারেকের মত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাতীত পৃথিবীর অন্যত্র চিড়িয়াখানা ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে বাঘ আছে আরো হাজার পাঁচেক। ওদিকে খোদ আমেরিকাতেই ব্যাক্তিগত সংগ্রহে বাঘ আছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার। অবিশ্বাস্য শোনালেও বাস্তবতা হচ্ছে উপমহাদেশের নিজস্ব প্রাণী হলেও যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে আছে সবচেয়ে বেশি চিত্রা হরিণ (২২৩)।
জাত্যাভিমান উদ্ভূত প্রচলিত কিছু অপবিশ্বাসকে প্রত্যাখান করেছেন খসরু। খসরু জানাচ্ছেন, সুন্দরবনের বাঘ উপমহাদেশ ও অন্যান্য অঞ্চলের বাঘের চেয়ে আকারে ছোট। সীমিত প্রাণীসম্পদের জন্যে এর ফুড বেইস বেশ সংকীর্ণ। বাদায় বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ বা শূকর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আকারে ছোট। বাঘকে এজন্যে ঘন ঘন শিকার করতে হয়। বছরে বিশ/ত্রিশটি শিকার পেলে যেখানে বাঘের বাৎসরিক খাদ্যেসংস্থান চলার কথা, সুন্দরবনের বাঘকে বছরে প্রায় আশিটির মত শিকার ধরতে হয়। প্রতি বিশটি প্রচেষ্টার মধ্যে একটিতে শিকার ধরতে সক্ষম হয় বাঘ (৪০০)। এনার্জি বাঁচাতে বেশ বুদ্ধিও বের করেছে বড় মিয়াঁ। শিকারী যখন কুই দিয়ে হরিণ শিকার করে, হরিণ ধরতে স্বয়ং হাজির হয় বাঘ (১৭৫)।
খাদ্যাভাসেও ততটা রাজকীয় নয় বাদার বাঘ, যতটা ভাবা হয়। নির্বিষ সাপও পাওয়া গেছে বাঘের পেটে। বানর, সজারু, ব্যাঙ, কাঁকড়াও খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। বাচ্চা তোলার সময় নিভৃতস্থান পছন্দ করে বটে, বনবিভাগের আশেপাশেই আবার অনেক সময় আঁতুর ঘর বানাতে দেখা যায়। বনকর্মীর তথ্যানুসারে ঘাসের জঙ্গলে বাঘ খুঁজতে গিয়ে বিরক্ত বাঘের শাসানী শুনেছেন খসরু (৩৫৯)। বাঘ আসলে মানুষখেকো হয় শারীরিক অক্ষমতায়—মাড়িতে পাইরিয়া কিংবা ত্বকে খোসপাঁচড়ার প্রাদুর্ভাবে। অক্ষম হয়েই মানুষের দিকে হাত বাড়ায়। দু’একটি বাঘ অবশ্য দুর্ঘটনাবশত মানুষখেকো হয়। হরিণও সর্বভূক প্রাণী। লতা-পাতা-উদ্ভিত তো আছেই, ক্যানটিনের কর্মচারী ইউনুস জানাচ্ছে, জেলেদের ফেলে দেয়া পঁচা তরকারি, চিংড়ির খোসা ও রাজ্যের আবর্জনাও পরম সুখে খায় হরিণ। মাছের শুটকি কিংবা কাঁকড়াও বাদ যায় না (৩৫৫)।
ছয়
সাহিত্যতত্ত্বের নিরিখে খসরুর রচনাটিকে কীভাবে পাঠ করা যায়? সন্দর্ভটির সাহিত্যমূল্য কিংবা সামাজিক উপযোগিতা নিরূপণের তৌলদণ্ড কী? আগেই বলেছি খসরুর লেখাটি কালচারাল স্টাডিজের আঙ্গিকে লিখিত। বিশুদ্ধ কোন ঘরানায় অবশ্য আবদ্ধ নন খসরু, লেখাটি যদিও ডিপ ইকোলজি (Deep Ecology) সাহিত্যের নিদর্শন। ডিপ ইকোলজি তত্ত্বের দাবী, প্রকৃতির মাঝে মানুষ ও না-মানুষী প্রাণের ভালমন্দ ও বিকাশ স্বতঃগুণেই গুরুত্বপূর্ণ, মনুষ্য সমাজের কাছে উপযোগিতা ছাড়াই মনুষ্যতর প্রাণের মূল্য বিদ্যমান; মনুষ্য জীবন ও সংস্কৃতি বিকাশে দরকার স্বল্পসংখ্যক টেকসই জনসংখ্যা; না-মানুষী প্রাণের বিকাশে প্রয়োজন সীমিত জনগোষ্ঠী (Sessions 1995: 68)।
অন্য কথায়, এন্থ্রোপোসেন্ট্রিক বা নৃ-কেন্দ্রিক মূল্যবোধ থেকে ইকোসেন্ট্রিক বা প্রকৃতি-কেন্দ্রিক মূল্যবোধের প্রতি নজর ঘোরানো ডিপ ইকোলজির অন্যতম বৈশিষ্ট্য (Garrard 2004: 21)। ডিপ ইকোলজিস্টের অনুসরণে খসরু সুন্দরবনের ইন্ট্রিন্সিক সৌন্দর্যকে রক্ষার পক্ষপাতী। মানুষ ও প্রকৃতির পার্থক্য বজায় রাখার প্রবক্তা ডিপ ইকোলজিস্টের মত বাদার প্রতি পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ের জনগোষ্ঠীর মানসিকতার ফারাক দেখিয়ে খসরু ইঙ্গিতে নিজস্ব পক্ষপাত দেখিয়েছেন। নিম্নকোটির মানুষ থেকে বাদা সংক্রান্ত তথ্য আহরণ করে রেমন্ড উইলিয়ামস্ সৃষ্ট হিস্ট্রি ফ্রম বিলো পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। আরোহী পদ্ধতি অবলম্বনের কারণে খসরুর তথ্যচয়ন প্রক্রিয়া কালচারাল স্টাডিজ ও ডিপ ইকোলজি উভয় ঘরানার পদ্ধতির ওভারল্যাপ করেছে। বইটির বড় শক্তি এখানে।
হোলিস্টিক এপ্রোচ সত্ত্বেও খসরুর সন্দর্ভে গভীর কিছু অপূর্ণতা দৃশ্যমান। বাদার প্রকৃতি পর্যালোচনায় খসরু বড্ড সিলেক্টিভ, প্রচ্ছন্ন হেজেমনিক। খসরুর রুচি মার্কিনি প্যাস্টোরাল ধাঁচের। জাতীয় অস্মিতা নির্মাণে প্যাস্টোরাল আইডিয়াল মার্কিনি ইতিহাসে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। মার্কিনি জনগোষ্ঠীর সিরিয়াস সাহিত্যরুচি গঠনে প্যাস্টোরালের প্রভাব লক্ষ্যনীয়। প্যাস্টোরাল ভাবনা ধ্রুপদী মার্কিনি সাহিত্যের অন্যতম মোটিভ—কুপার, থরো, মেলভিল, ফকনার, ফ্রস্ট, হেমিংওয়ে প্রমুখের ক্যাননগুলো এর সাক্ষী (Marx 1967: 3,6, 10)। ধ্রুপদী মার্কিনি সাহিত্যে, সামাজিক গণ্ডির বাইরে আদর্শায়িত ল্যান্ডস্কেপে আশ্রয় গ্রহণের প্রবণতার ফাঁকি উন্মোচনার্থে নাথানিয়েল হওথোর্নের এক লেখার খসড়া বিশ্লেষণ করেছেন লিও মার্ক্স। মার্ক্স দেখাচ্ছেন, প্রশান্ত নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের চিত্র আঁকতে হওথোর্ন তার খসড়ায় সামাজিক জীবনে টেনশনের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করেছেন। ন্যাথানিয়েল হওথোর্ন, মার্ক্সের ভাষায়, “…is describing a state of being in which there is no tension either within the self or between the self and its environment. Much of the harmonious effect is evoked by the delicate interlacing of sounds that seem to unify society, landscape, and mind (Marx 1967: 13)।
মার্কিনি নন-ফিকশনাল নেচার রাইটিং ফলে আধুনিক ইকোক্রিটিসিজমের প্রাণ-ভোমরার মর্যাদা পেয়েছে। বাদার কমনীয় সৌন্দর্য্যেকে অতিরিক্ত ফোকাসের কারণে খসরুর আদর্শায়িত বাদাবন মার্ক্স উল্লেখিত সামাজিক টেনশন মুক্ত ইউটোপিয়ান আর্কেডিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। অথচ ধ্রুপদী প্যাস্টোরাল সাহিত্যে মানবিক অভিজ্ঞতা লব্ধ বৈপরীত্যের উপজাত টেনশনের উপস্থিতি সহজেই নির্ণেয়, রেনেসাঁ যুগের সাহিত্যিক দলের হাতে যে টেনশন বর্জনের ঐতিহ্য শুরু হয়েছে (Williams 1973:18)।
বাদায় অব্যাহত আসা-যাওয়া, প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ, এপিফেনি অর্জন ও রিনিউয়ালের উৎস খসরুর প্রতীচ্য রুচির নির্দেশক। প্রতীচ্য রুচির গহনে নিমগ্নের কারণে খসরুর সন্দর্ভও উইলিয়ামস কথিত বৈপরীত্যের টেনশনমুক্ত। অথচ মার্কিনি প্যাস্টোরাল ঐতিহ্যের রয়েছে টেনশনপূর্ণ কৃষ্ণ অধ্যায়। অব্যাহত নগরায়ণ ও শিল্পবিপ্লবোত্তর নাগরিক জীবনের দ্বন্দ্ব ও কূটাভাসের অনুপস্থিতিহেতু সপ্তদশ শতক থেকে ইউরোপীয় প্যাস্টোরাল ঐতিহ্যে প্রান্তিক উপনিবেশগুলো প্যাস্টোরালের লোকেশনরূপে কল্পনা করা শুরু হয়।
প্রথমদিকে প্রান্তিক ভূখণ্ডগুলোর ইউরোপীয় আবিষ্কারক এবং পরে নয়া-ভূখণ্ডে বসতিকারী অভিবাসী সম্প্রদায় প্রত্যয়টি নতুন দেশের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের উপাদানে পরিণত করে (Buell 1995: 32)। অভিবাসীদের হাতে ভূখণ্ডগুলো চিত্রিত হয় কল্পরাজ্যের আর্কেডিয়া রূপে। মূলধারার সংস্কৃতিতে এমনতর ভাবকল্পনা গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে এসেছে শতাব্দী ধরে। সিভিল রাইটস আন্দোলনোত্তর সত্তর দশকে নারীবাদী (Buell 1995: 34) ও আদিবাসী তাত্ত্বিকের হাতে প্রথমবারের মত মার্কিনি প্যাস্টোরাল ঐতিহ্যের প্রত্যয়গুলো পুনঃমূল্যায়িত হয়। দাবী করা হয়, এমারসন-থরো-মুইয়ের কলমে পুষ্টিপ্রাপ্ত নেচার রাইটিং ঔপনিবেশিক ইডিয়লজি মুক্ত নয়।
রিভিশনিস্ট ঐতিহাসিকের দল প্রমাণ দাখিল করে যে, উপর্যুক্ত ত্রয়ীর লেখায় নারী, আদিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গ ও চিকানোর প্রতি ঐতিহাসিক অবিচার—অভিবাসী শ্বেতাঙ্গের স্থানীয়দের ভুমি দখলের (Buell 1995: 31) তথ্য অনুল্লেখিত থেকেছে; এদের লেখায় ল্যান্ডস্কেপ ও প্রকৃতির প্রতি মানসিকতায় ইরোটিসিজম ও মিসোজিনির মিশ্রণ ঘটেছে। সর্বোপরি এমারসন ও থরোর লেখা “consolidate the imperialist nostalgia that has always been at the heart of American pastoral—a sentimental masculine gaze at a feminized landscape and its creatures that masked the conquest and destruction of the ‘wild continent’” (Westling 1996: 52)। উপর্যুক্ত তাত্ত্বিকেরা মার্কিনি প্যাস্টোর্যাল চিন্তার সাথে আগ্রাসী ম্যাস্কুলিনিটি, নারী ও আদিবাসী বিরোধিতার যোগসূত্র আছে (Gerrrard 2004: 49) দাবী করেন।
খসরুর লেখাতেও ঔপনিবেশিক ভিক্টোরীয় টাইপের অবলোকন বা গেইজ (Gaze) লক্ষনীয়। বাদায় ও বাদার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নিম্নবর্গীয় আদিবাসীর উপস্থিত সম্পর্কে সচেতনতা এবং চাক্ষুষ পরিচয় সত্বেও খসরুর লেখায় বিচ্যুত প্রান্তিক মানুষ, আদিবাসী, বা নারীর উপস্থিতি নেই। অথচ, জোরাসিঙের যাত্রাপথে লঞ্চে স্থানীয় মুন্ডা সম্প্রদায় (৯৫) কিংবা পৌন্ড্রক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের আতিথ্য গ্রহণ করেছেন খসরু। লক্ষ্যনীয়, হেজেমনিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি খসরুর উপস্থিতি উভয়কে সন্ত্রস্ত করেছিলো, খসরু সেকথা নিজেই জানিয়েছেন। উল্লেখিত ত্রস্তভাব অসম শ্রেণি-সম্পর্ক নির্দেশ করে। রোম্যান্টিকতায় আচ্ছন্ন খসরুর কলমে শ্রেণিবৈষম্য ফোকাস পায়নি। রচনায় অন্তর্নিহিত উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে খসরুর লেখাটি গিফোর্ড কথিত তৃতীয় প্রকার প্যাস্টোরাল রচনার অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয় প্রকারের প্যাস্টোরাল, গিফোর্ডের ভাষায়, অবগুণ্ঠনের প্রকাশ ঘটায়, “in which ‘pastoral’ implies an idealization of rural life that obscures the realities of labor and hardship (Gifford 1999:2)। বাদার আদর্শায়ন এবং শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও টেনশনকে অনবলোকনের জন্যে সন্দর্ভটি মার্কসবাদী ইকোলজিস্টদের তুষ্ট করতে ব্যর্থ হবে।
সোজা কথায়, প্রান্তিক, নিম্নবর্গ ও আদিবাসীর উপস্থিতি সত্ত্বেও রচনাটি নিঃসঙ্গ লেখকের হৃদয়জ ক্ষরণের ফল, প্রকৃতি যে লেখকের কাছে নিঃসঙ্গ অভিসারের উপলক্ষ্য। লেখকের বুর্জোয়া রুচির আধিক্যহেতু রেমন্ড উইলিয়ামস্ কথিত “প্রকৃতির ইতিহাস মানুষের তৎপরতার ইতিহাস” (Williams 1980: 70-1) প্রত্যয়ের আলোকে রচনাটি সাব-অল্টার্ন সাহিত্যের বর্গভুক্ত হতে ব্যর্থ হয়েছে। লেখায় বাদা এসেছে অপর রূপে—পৌরুষদীপ্ত স্থৈর্য্য, প্রখর বুদ্ধি, উত্তঙ্গ সাহস, আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব যে বাদা জয় করে। সাবলাইম সৌন্দর্য্যের ভয়াল এ বাদাবন মুখরা রমণী—কিন্তু অজেয় নয়। জয়ী হতে চাই নিবেদিত রোম্যান্টিক এডভেঞ্চারী মন। বইটির অন্তর্নিহিত এই মিসোজিনি ইকোফেমিনিস্টদের উষ্মার কারণ হবে।
সবচেয়ে আশ্চার্য্যজনক, গ্রিন-হাউসের প্রভাবে বাদার অবক্ষয় প্রসঙ্গে লেখকের পর্যবেক্ষণ নেই। খসরু বাদা দেখছেন চার দশক ধরে। জলবায়ু পরিবর্তন, বনজ সম্পদের লুট কিংবা বনবিভাগের অব্যবস্থাপনার সিনারজেটিক ইফেক্টে বাদার অবক্ষয় তার অগোচর নয়। প্রকৃতি সচেতন খসরুর বাদার ক্রমানুগতিক অবক্ষয়ের প্রতি প্রকট নীরবতা যুক্তির অবোধ্য, একথা যখন সর্বজনসম্মত যে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ভিক্টিম সুন্দরবন। বাদার ব্যাপক সংহার বিশ্বব্যাপী চলমান ডিফরেস্টেশনের কারণে ঘটছে। প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ আহরণ, অপচয়, ও ধ্বংসের কারণে নৃ-কেন্দ্রিক যুগে (Anthropecene) পৃথিবীর প্রাণসম্পদ দ্রুতলয়ে ষষ্ঠতম বিলুপ্তির (Sixth Extinct) পথে এগুচ্ছে বলে তাবৎ বিজ্ঞানীকূল ঐকমত্য পোষণ করেন (Wilson 2016: 8-9)। সুন্দরবনের অবলুপ্তিও এর অন্যতম উদাহরণ—বাদার বিলয়ের হার সত্যি বলতে আরো লোমহর্ষক। ইফতেখার ও ইসলাম জানাচ্ছেন, ১৯৫৯ সালের বনজ ইনভেন্ট্রির পর বাদার সুন্দরী ও গেওয়া গাছ যথাক্রমে চল্লিশ ও পঁয়তাল্লিশ শতাংশ বিলুপ্ত হয়েছে। মাত্র দু’শ বছর আগেও সুন্দরবন সমগ্র খুলনা বিভাগে বিস্তৃত ছিলো, আজ তার আয়তন ৬০১৭ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে (Iftekhar and Islam 2004:140, 142)।
পরিবেশগত অবক্ষয় ও বাদার সংকোচন চলছে সমান্তরালে। ইফতেখার ও ইসলাম দেখাচ্ছেন বাদার বর্তমান বনজ সম্পদের পরিমাণ ১০.৬ মিলিয়ন ঘনমিটার। প্রজাতি হিসেবে সুন্দরী গাছ এককভাবে বনজ কাষ্ঠ সম্পদের মোট ১৮.২ শতাংশ, আর গেওয়াকে সাথে ধরলে ৬২.৪ শতাংশ। কিন্তু “ওপর থেকে মড়ক” রোগের প্রাদুর্ভাবে বাদায় সুন্দরী বৃক্ষের আধিক্য কমে আসছে। ২০০৪ সালে ১৯৮.৫ বর্গকিলোমিটার ব্যাপী অঞ্চলে সুন্দরী গাছ তীব্রভাবে মড়কে আক্রান্ত হয়, এখানে গাছের শেকড়েও পচন দেখা দেয়। সুন্দরী গাছের মড়ক বাদার সামগ্রিক পরিবেশে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। অন্যান্য বনজ ও প্রাণীজ সম্পদের ওপর মড়কের প্রভাব হবে সুদূর প্রসারী। স্মর্তব্য, শুমারি অনুসারে সুন্দরবনে ৪৫৩ প্রজাতির প্রাণীর বাস। বাদায় আছে ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৯০ প্রজাতির পাখী, ৪২ প্রজাতির ম্যামাল, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী। বাংলাদেশের ৩৬-৩৭ শতাংশ পাখী, ২৮-৩০ শতাংশ সরীসৃপ, এবং ৩৩-৩৪ শতাংশ ম্যামাল সুন্দরবনে বাস করে (Iftekhar and Islam 2004: 141)। প্রজাতিকূলের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কারণ এক প্রজাতির বিলুপ্তি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করবে, অন্যান্য প্রজাতির বিলুপ্তি তরান্বিত করবে।
প্রজাতির জনসংখ্যার ওপর ভিন্ন প্রজাতির প্রভাব এবং প্রজাতিকূলের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ডেনসিটি-ডিপেন্ডেন্ট রেগুলেশন (Density-Dependent Regulation) নামে খ্যাত। বাদায় এ রেগুলেশনের প্রভাব চমৎকারভাবে ব্যাখা করেছেন এডওয়ার্ড উইলসন। সুন্দরবনের গাছের সংখ্যা কী প্রকারে বাঘের সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল, তার ব্যাখায় উইলসন বলেন, “In the mangrove forest of the Sundarbans…tigers…preying on and thinning the population of spotted deer, wild boar, and macaques (and humans, unfortunately), promoting a lusher, more biologically diverse fauna and flora (Wilson 2016:14)। অর্থাৎ বাঘের সংখ্যাধিক্য তৃনভোজী প্রাণী নিয়ন্ত্রণ করে, বাদার গাছ-গাছালির সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। খসরুর লেখায় চলমান এই বিপর্যয়ের ছিটেফোঁটা পর্যবেক্ষণ নেই। খসরুর নির্লিপ্ততার কারণ কী? খসরু কী তবে জেমস লাভলকের গায়া হাইপোথিসিসের (Lovelock and Margulis 1974) আদলে বাদার নিজস্ব সেলফ-রেগুলেটিং হোমিওস্টেসিসে (Homeostasis) বিশ্বাসী?
বনজ সম্পদের লাগামহীন লুট বিপর্যয়ের আরেক কারণ। বাদার সকলের বিশ্বাস, নির্ধারিত পরিমানের চেয়ে বেশী সম্পদ আহরণে বাদার পরিবেশ বিনষ্ট হয় না। নিজের স্বার্থ সর্বোচ্চকরনে সার্বজনীন মালিকানার অধীন সম্পদের ওপর ফ্রি রাইডিং ব্যক্তির ধর্ম। চূড়ান্ত বিচারে ফ্রি রাইডিং-এ সবাই সবাইকে ফাঁকি দেয়। শুভঙ্করের ফাঁকির জন্যে সিস্টেমের পতন ঘটে, হার্ডিনের ভাষায় ট্র্যাজেডি অব কমনের সূচনা হয় (Hardin 1968: 1244)। পাবলিক পলিসির দৃষ্টিতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে সুন্দরবন পাবলিক গুড্স সরবরাহ করে। বাদার পাবলিক গুড্সের রক্ষণাবেক্ষণে হার্ডিন কথিত ট্র্যাজেডি পরিহারের লক্ষ্যে রেগুলেটরি অথরিটির দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলো বনবিভাগ। কিন্তু বাদার রক্ষক নিজেই আজ ভক্ষক। অভিজ্ঞতা থেকে খসরু সেটা ভাল করেই জানেন, লেখাতে সে সব দূর্নীতি নিয়ে সারসংক্ষেপ লিপিবদ্ধও করেছেন, কিন্তু গভীরে প্রবেশ করেননি। ডিপ-ইকোলজির মতাদর্শ ধারণ করেও পরিবেশের প্রতি খসরুর এ নির্লিপ্তি অস্বাভাবিক। স্মর্তব্য, ডিপ-ইকোলজি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সমর্থন করে। জনসংখ্যার বিস্ফোরণে বাদার গভীরেও বসতির বিস্তার ঘটছে, খসরুর লেখায় সে প্রসঙ্গও অনুপস্থিত।
সাত
বুয়েল জানাচ্ছেন, প্যাস্টোরাল রচয়িতার জীবন যাপনের প্রধান দুই বৈশিষ্ট্য হচ্ছে “ভলান্টারী সিমপ্লিসিটি” ও “স্বেচ্ছাকৃত আত্মত্যাগ” (Buell 145, 156)। উপাদান দুটির উপস্থিতি সত্ত্বেও খসরুর পর্যবেক্ষন উপরতলের দেখা এবং দেখার উপস্থাপনার ধরণটি বর্ণনাত্মক। বাদার প্রভাব মানবমনে কী সাইকো-এন্যালিটিক্যাল পরিবর্তন ঘটায়, খসরুর দেখায় সে প্রসঙ্গ উহ্য। ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণে প্রকৃতি দেখা হয়েছে ঈডে্র (Id) লীলাক্ষেত্র রূপে। মানব মনের কাঠামো ফ্র্যয়েড নিচ থেকে ওপরে যথাক্রমে ঈড (Id), ইগো (Ego), এবং সুপারইগো (Super Ego), এ তিনস্তরে বিন্যস্ত করেছেন। মানুষের অবচেতন আদিম তাড়নার প্রতিভু ঈড; সেলফ-গ্র্যাটিফিকেশন নীতিতে চালিত ঈড, ফ্র্যয়েডের মতে, তাৎক্ষনিক ক্ষুণ্ণিবৃত্তি খোঁজে। শিক্ষা, বিবেক, ও নীতিবোধ তাড়িত সচেতন মন সুপার-ইগোর বলয়। ডিনায়াল প্রিন্সিপলে চালিত সুপার-ইগোর কাজ ঈডের প্রতিহতকরণ। ইগোর কাজ উভয়ের মাঝে ব্যালান্স এনে ভারসাম্য বজায় রাখা (Freud 1961)।
সাইকিক কাঠামোর নিরিখে ফ্রয়েডের দৃষ্টিতে বন্য প্রকৃতি আদিমতার ধারক এবং প্রবৃত্তির অনুঘটক। ফ্রয়েডের অভিমত, সামাজিক জীবনের বিপরীত কোটি প্রকৃতির কোলে আশ্রিত মানুষ নীতি বর্জিত আদিম প্রাণী মাত্র। ফ্রয়েডীয় চিন্তায় আচ্ছন্ন প্রতীচ্য আধুনিকতা মনুষ্য জীবন পর্যবেক্ষন করেছে সরিসৃপের শীতল ক্রূরতায়। ব্যক্তিসত্ত্বার গহন মন, আধুনিকতাবাদের দাবী, ক্লেদ আর ক্ষয়ের অতলস্পর্শী আধার। সৃষ্টিশীল সাহিত্যে ফ্রয়েড কথিত কৃষ্ণ-হৃদয়ের উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমরা পাই জোসেফ কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস উপন্যাসে। মানব চৈতন্যে ওয়াইল্ডারনেসের নিকষ গভীর প্রভাব খসরুর লেখায় অনুপস্থিত। কনরাডের সাথে তুলনা খসরুর বয়ানের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে।
কঙ্গোর অরণ্যের আদলে চিত্রিত বাদার বন্যতা মার্লো উল্লেখিত “ড্রিম-সেনসেশন” কিংবা “লাইফ-সেনসেশন” খসরুর লেখায় অনুভূত নয়। বাদার বয়ানে ব্যক্তিসত্তার আদিম স্তরে প্রত্যাবর্তনের বর্ননাতীত অসহনীয় অনুভূতির জাগরণ অনুপস্থিত। খসরুর বাদাবনে কনরাড বর্নিত মনের মুকুরে কুহেলিকাপূর্ন “নিঃশব্দ মন্ত্রের” নিক্ষেপ নেই (Conrad 1990: 24, 61)। খসরুর বাদা বড়জোড় স্বপ্নিল আকুতি জাগায়। বাদার সরুপথে খসরুর হেঁটে চলা মার্লোর মত হার্ট অব ডার্কনেসের অতল গভীরে প্রবেশের শিহরণ জাগায় না। অথচ, কূর্টযের সন্ধানে ইনার ষ্টেশনের অভিমুখের যাত্রাপথের ওয়াইল্ডারনেস মার্লোর কাছে ব্যক্তিসত্ত্বার নিকষ আঁধারে প্রবেশের শিহরণ এনেছিলো। যে শিহরণ মার্লোর ভাষায়, “The reaches opend before us and closed behind, as if the forrest had stepped lesisurely across ther water to bar the way for our return. We penetrated deeper and deeper into the heart of darkness (Conrad 1990: 31)।
তুলনায়, খসরুর বাদা বড্ড ঘরোয়া—আটপৌরে, পরিচিত, সৃষ্টির আদিমতা এখানে অনুপস্থিত, আসা যাওয়ায় পথ সদা উন্মুক্ত। কূর্টযের মত প্রবল ব্যাক্তিত্বের উপস্থিতি নেই বাদায়, খসরুও কনরাডের মার্লো নন। বাদাবনকে খসরু করেছেন একান্ত নিজস্ব, অন্তরঙ্গ। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে—মুক্তির খোঁজে—কল্পরাজ্যের আর্কেডিয়ায় খসরু প্রথম পদার্পন করেন। নির্জনতায় আউটলেট খুঁজে পান খসরু; আর উঠে আসা হয়নি। ক্রমান্বয়ে বাদা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সিগ্নিফায়ার। বাদার সুখদ প্রভাব খসরুর ক্ষতবিক্ষত হৃদয়কে প্রশমিত করেছে। চল্লিশ বছরে আত্মস্থ হয়েছেন খসরু—অভিসন্দর্ভটি সেই সাবলিমিনেশনের ফসল।
গৃহী খসরুর বাদা জীবন ও প্রকৃতি—মৃত্যু ও ক্ষয়—মার্কিনি প্যাস্টোরাল রচনার যা মৌল থিম, জাতীয় ইন্ট্রোস্পেকশন মনে চাগায় না। অবিনির্মাণবাদীর আদলে বাদাবনকে পাঠ করেছেন, বয়ান করেছেন রাইবোজোমিক ঢঙ্গে। লতায়-পাতায় এগিয়েছে খসরুর বর্ণনা, সুনির্দিষ্ট ফোকাস ছাড়াই। মতদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গী কিংবা ভূয়ো জীবনদর্শন উপস্থাপনের প্রয়াস নেই। (প্রকৃতি) পাঠের সুনির্দিষ্ট অর্থের অভাব রচনাটিকে দিয়েছে অবিনির্মানবাদের ভাবগত নৈকট্য। অবিনির্মাণবাদ দাবী করে, শব্দের (এবং ডেরিয়েভেটিভ অর্থে প্রত্যয়, যেমন বাদা সম্পর্কিত বয়ান) সুনির্দিষ্ট ও স্থায়ী অর্থ অর্থাৎ মিনিং নেই। কিন্তু ভাষা ইডিয়লজি নিরপেক্ষ নয়। ভাষাকে শাসন করে অধিবিদ্যা; অধিবিদ্যা মাত্রই ক্ষমতাকেন্দ্রিক চিন্তার সুপ্ত ফল্গুধারা—রাজনীতির সূতিকাগার।
আপাত নিরীহ প্রাতিষ্ঠানিক মতাদর্শের পরতে যে লুকিয়ে থাকে হেজেমনিক ক্ষমতার বিন্যাস, উত্তর-আধুনিক তত্ত্বের পুরোধা গ্রামসি, ফুকো, আর আলথুসার আমাদের আগেই স্মরণ করিয়েছেন। খসরুর রচনাটির অন্দরমহলেও দেখা মিলবে হেজেমনিক পাওয়ার রিলেশনের লীলাবিন্যাস, সুপ্ত প্রতিরোধী রাজনীতির সম্ভাবনা। সম্ভাবনার কারণ বাদাবনের বয়ান খসরুর হাতে হয়েছে রাজনৈতিক দর্শন, পরিবেশবাদী চিন্তা, ও সাংস্কৃতিক অস্মিতার হাতিয়ার। খসরুর অভিসন্দর্ভ সে অর্থে শতভাগ জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্স। বাদাকে সম্মুখপট করে প্রতীকে বাংলাদেশের মুখচ্ছবি তুলে এনেছেন খসরু। আর্কেডিয়ার চিত্র এঁকে ধ্রুপদী মার্কিনী প্যাস্টোরাল সাহিত্যের আদলে সৃষ্টি করেছেন লোকজ এক প্যাস্টোরাল।
তো খসরুর অধিবিদ্যা কী? বইটির সাবটেক্সটের অন্তর্নিহিত রাজনীতি কোথায়? উত্তর মিলবে উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যতত্ত্বে। হেজেমনিক প্রভু ও সাবজেক্টের দ্বন্দ্বের স্পেকট্রামে টেক্সট পর্যালোচনা উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যতত্ত্বের লক্ষণ। টেক্সটের পরতে নিহিত হেজেমনির উদ্ঘাটন উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকের অভীষ্ট। প্রত্যয়টি আত্মসাৎ করে মার্কিনি চিকানো সাহিত্যতত্ত্ব টেক্সটকে প্রতিরোধের অস্ত্র রূপে গণ্য করে থাকে। টেক্সট হয়ে ওঠে রেজিসস্ট্যান্ট লিটারেচর—প্রতিরোধের হাতিয়ার। চিকানো তাত্ত্বিক মনে করে মার্কিনী সমাজের মূলধারা এংলো হেজেমোনিক কালচারে মেক্সিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের অবস্থান আভ্যন্তরীন উপনিবেশ বা ইন্টার্নাল কলোনি সদৃশ্য (Tatum 2006: 28)। আত্মজৈবনিক রচনায় ব্যক্তিগত স্মৃতির সংরক্ষন চিকানো তাত্ত্বিকের দৃষ্টিতে আভ্যন্তরীন উপনিবেশে সম্প্রদায়গত অস্তিত্ব জানান দেয়ার সামিল, নিজস্ব কণ্ঠস্বর উচ্চারণের অব্যর্থ উপায়। আঞ্চলিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে, বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নখরে জর্জরিত বাংলাদেশের নাজুক অবস্থানের ছায়ায় খসরুর রচনাটির অন্তর্নিহিত সুরের ভিন্ন মাত্রার কারনে দক্ষিন-এশীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে রচনাটির উপস্থাপন অসম্ভব নয়।
নিয়োলিব্রেল জমানায় ক্ষমতা কাঠামোর পুনঃবিন্যাস ঘটছে। প্রান্ত-কেন্দ্র কুশীলবের ভূমিকায় উঠে আসছে নতুন মুখ। আবির্ভূত হচ্ছে নতুন খেলোয়াড়, পালটে যাচ্ছে পুরনো ছক। গতকালের মিত্র আজ প্রতিলোমীর ভূমিকায় আবির্ভূত, এর বিপরীত চিত্রও অদৃষ্ট নয়। বৈশ্বিক রাজনীতির বলয়ে যে শক্তি প্রান্তিকতায় চিহ্নিত, আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোয় সে আবার আগ্রাসী হেজেমনও বটে। বিশ্বায়ন, উদার বাণিজ্যনীতি, আর মার্কেন্টাইল বাণিজ্যনীতির সহবস্থানের প্রেক্ষিতে ভারতীয় উপমহাদেশর আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক নতুন বিশ্বব্যবাস্থার আলোকে পরিবর্তীত হচ্ছে। স্থানীয় হেজিমনির আগ্রাসী পুঁজির অনুপ্রবেশের হাত ধরে চলছে দেশজ রাজনীতির বলয়ে আঞ্চলিক বড় শক্তির প্রকাশ্য অনুপ্রবেশ। খেলাটি আপাতদৃষ্টিতে পূঁজির অবাধ বিচরণের পার্শপ্রতিক্রিয়া প্রতীয়মান হলেও সমীকরণের পশ্চাতে বৃহৎ রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক অভীষ্ট অবগুণ্ঠিত নয়। পুঁজি আর ভূ-রাজনীতির ডেডলি কম্বিনেশনের অন্যতম শিকার সুন্দরবন।
রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, সকল বিশেষজ্ঞের অভিমত, সুন্দরবনের মৃত্যু তরান্বিত করবে। কেন্দ্রটির স্থাপন প্রক্রিয়ার অনুমোদন নির্দেশ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রভুত্ব আজ কার অক্ষপুটে। অনেক অর্থেই বাংলাদেশ এখন তার বৃহত্তর প্রতিবেশীর আভ্যন্তরীণ কলোনি। আভ্যন্তরীন উপনিবেশ এ অর্থে যে, পরিবর্তীত বিশ্ব-রাজনীতির সমীকরণে বৃহৎ পরাশক্তি সমূহের কাছ থেকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে দিল্লী ছাড় আদায়ে সক্ষম হয়েছে। বৃহৎ শক্তিগুলো ঐক্যমতে উপনীত যে, আঞ্চলিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভারতীয় প্রভাব বলয়ের অংশ রূপে বাংলাদেশ বিবেচিত হবে। উদীয়মান বিশ্বশক্তি চীনের মোকাবেলায় ইউরোপ, আমেরিকা, ও জাপান অনুসৃত কন্টেইনমেন্ট নীতির অন্যতম অংশীদার ভারত। ফলে, আঞ্চলিক রাজনীতিতে দিল্লীর কর্তৃত্বের দাবী প্রতীচ্য মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাপারে দিল্লীর স্বার্থ, দিল্লির চাহিদা, দিল্লির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বিবেচিত হচ্ছে। উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত বৃটিশ রাজের ইম্পেরিয়াল ফরেন পলিসি দিল্লির আজ অনুসৃত আঞ্চলিক বিদেশনীতি। এ হচ্ছে মার্কিনি মনরো ডক্ট্রিনের ভারতীয় ভার্সান। সুন্দরবনের সন্নিকটে ভারতীয় পুঁজির অনুপ্রবেশ সে কারণে আর আজ শুধু পুঁজির খেলা নয়। সুন্দরবনের অস্তিত্বের প্রতি হুমকী, প্রকারান্তরে যা বাংলাদেশের পরিবেশগত অস্তিত্বের প্রতি হুমকী, আজ রূপান্তরিত হয়েছে ভারতীয় আগ্রাসী পুঁজি ও ভূ-রাজনৈতিক নীতির বিরুদ্ধাচারনে, বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের বাঁচা মরার প্রশ্নে।
বাঁচা মরা প্রশ্নের কারণটি প্রত্যক্ষ, বৈজ্ঞানিক, ও তথ্যভিত্তিক। সুন্দরবন শুধুমাত্র নান্দনিক প্রত্যয় নয়। পরিবেশ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস। বাদার বিলয় হাজার বছরে গড়ে ওঠা দক্ষিণবঙ্গের প্রকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করবে—সমুদ্রসৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে নারকীয় তান্ডবের মুখোমুখি হবে সমগ্র বাংলাদেশ। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন সে অর্থে বাংলাদেশের জৈব-অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন। খসরুর অভিসন্দর্ভটি সে আন্দোলনের অন্যতম বাইবেল হবার সম্ভাবনা রাখে। লেখাটি বাদাবনের আবেগঘন ন্যারেটিভ, জাতিয়াতাবাদী ডিস্কোর্সের প্রাণসঞ্চারী ভাষ্য। বাংলা ভাষী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব উচ্চারণে, জাতির সামুস্টিক অস্মিতা নির্মানে, সম্প্রদায়গত সামুস্টিক কণ্ঠস্বর ধারনের সম্ভাবনার কল্যাণে পোলিফোনিক ভয়েসের নিদর্শনে রূপান্তরিত হয়েছে রচনাটি। তাত্ত্বিকতার সম্ভাবনা উপস্থাপন করে অর্গানিক বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব খসরু পালন করেছেন। বইটি বাংলাদেশের তারুন্যকে বাদার নৈসর্গিক ও বস্তুগত মূল্য অনুধাবনে সাহায্য করবে।
সূত্র
খসরু চৌধুরী, সুন্দরবনের বাঘের পিছু পিছু , ঢাকা : সময় প্রকাশন, ২০১৬।
Alpers, Paul. “What is Pastoral?” Critical Inquiry 8:3 (Spring 1982): 437- 460. Print.
Buell, Lawrence. The Environmental Imagination: Thoreau, Natural Writing, and the Formation of American Culture. Cambridge, MA: The Belknap Press of Harvard UP, 1995. Print.
Burke, Edmund. A Philosophical Inquiry into the Origin of Our Ideas of the Sublime and the Beautiful. London: Oxford UP, 1990. Print.
Conrad, Joseph. Heart of Darkness. New York: Dover Publications, 1990. Print.
During, Simon. Cultural Studies: A Critical Introduction. New York: Routledge, 2005. Print.
Freud, Sigmund. “The Ego and the Id” in The Complete Psychological Works of
Sigmund Freud. Vol. XIX. Trans and Ed. James Strachey. London: The Hogarth
Press & The Institute of Psycho-Analysis, 1961. Print.
Garrard, Greg. Ecocriticism. New York: Routledge, 2004. Print.
Gifford, Terry. Pastoral. London: Routledge, 1999. Print.
Hardin, Garrett. “The Tragedy of the Commons” Science New Series. Vol. 162. No. 3859
(December 13, 1968): 1243-1248. Print.
Iftekhar, M.S. and M. R. Islam. “Managing Mangroves in Bangladesh: A Strategy Analysis.”Journal of Coastal Conservation 10: 1 & 2 (2004): 139-146. Print.
Lovelock, James and Lynn Margulis. “Atmospheric Homeostasis by and for the Biosphere: the gaia hypothesis” Tellus XXVI (1974): 1-9. Print.
Scheese, Don. Nature Writing: The Pastoral Impulse in America. New York: Twayne Publishers, 1996. Print.
Sessions, George. (Eds.). Deep Ecology for the Twenty-First Century: Readings on the Philosophy and Practice of the New Environmentalism. Boulder, CO: Shambhala, 1995. Print.
Tatum, Charles M. Chicano and Chicana Literature. Tucson, AZ: The U of Arizona Press, 2006. Print.
Marx, Leo. The Machine in the Garden: Technology and Pastoral Ideal in America. New York: Oxford UP, 1967. Print.
Westling, Louise H. The Green Breast of the New World: Landscape, Gender and American Fiction. Athens, GA: University of Georgia Press, 1996. Print.
Williams, Raymond. Problems in Materialism and Culture. London: Verso, 1980. Print.
———. The Country and the City. New York: Oxford UP, 1973. Print.
Wilson, Edward O. Half-Earth: Our Planet’s Fight for Life. New York: Liveright Publishing
Corporation, 2016. Print.