কাশ্মীর মানেই কাউন্টার ও এনকাউন্টার, রক্তপাত ও লড়াই। কাশ্মীরের রুদ্ধশ্বাস রাতের এই গল্পে তরুণ গল্পকার শাব্বির আহমাদ মির চমৎকার ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন ভয়ার্ত সময়। ইংরেজি থেকে গল্পটি অনুবাদ করেছেন সুমন সাজ্জাদ।
এনকাউন্টার শুরু হয়েছিল রাত ৮:১৩-তে।
আমি কী করে এতোটা নিশ্চিত হচ্ছি?
অথবা প্রশ্নটা এমনও হতে পারে, কী করে একজন নির্ণয় করে ঠিক কখন এনকাউন্টার আরম্ভ হয়? আমি মনে করি, উত্তর নির্ভর করে আপনি কাকে প্রশ্নটা করছেন, তার ওপর। নিরাপত্তা দলের সদস্য — যিনি এনকাউন্টারে অংশ নেন — তিনি হয়তো বলবেন, সন্দেহভাজনরা আছেন জেনে তাঁরা যখন কোনো একটা এলাকা ঘিয়ে ফেলেন তখনই এনকাউন্টার শুরু হয়ে যায়। জঙ্গিদের জন্য — যাঁরা এনকাউন্টারের শিকার — এনকাউন্টারের আরম্ভ তখনই যখন তাঁরা বুঝতে পারে এটাই এনকাউন্টার — তাঁদের শেষ রক্ষা। আমাদের মতো যারা নিষ্ক্রিয় দর্শক, তাদের ক্ষেত্রে এনকাউন্টারের আরম্ভ তখনই যখন আমরা প্রথম রাউন্ড গুলির শব্দ শুনতে পাই। আমি যখন গুলির শব্দ শুনলাম, তখন ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম। কাঁটায় কাঁটায় ৮ : ১৩। আর তাই আমি নিশ্চিত।
যন্ত্রচালিতের মতো আমারা সবাই আমাদের গ্রাউন্ড ফ্লোরের করিডোরে গিয়ে জড়ো হই। আমাদের বাড়ির সবচাইতে নিরাপদ জায়গা। সে-সময় আমাদোর ক্লাউস্ট্রোফোবিয়ার জায়গা দখল করে ক্লাউস্ট্রোফিলিয়া। অর্থাৎ স্থান কম হওয়ার ভয় বদলে গিয়ে আরও সংকুচিত জায়গা খোঁজার মানসিকতা তৈরি করে। তৎক্ষণাৎ আমি মাথা গুনতে শুরু করি : আমি, আমার মেয়ে, আমার স্ত্রী, আম্মা, আব্বা। আল্লাহ ভরসা, সবাই এক সঙ্গেই আছি।
মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে এক কোনায় চোরের মতো লুকিয়ে আছে; তার পাশেই গুলির শব্দের মতো দ্রুততায় তাল মিলিয়ে আমার আম্মা উন্মত্তের মতো তসবির দানাগুলো গুণছেন। করিডোরের অন্য প্রান্তে হেলান দিয়ে বসে আছেন। দৈনন্দিন রুটিনে ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত। তিনি জানেন গভীর রাত পর্যন্ত এটা চলবে। সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন, খোদা জানে কী হবে। আমার পরবর্তী কাজ হলো এনকাউন্টার ঠিক কোথায় হচ্ছে, তা জানা। কার বাড়িতে আজ হচ্ছে? — এ-বিষয়ে সবিস্তার জানতে চাওয়ার কারণ আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, হয় বাড়িতেই থাকবো, নয়তো আরও নিরাপত্তার জন্য অন্য কোথাও ছুটে পালাতে হবে। আমি আমার চাচাত ভাই নাদিমকে ফোন করলাম। কাছেই ও থাকে, একই মহল্লায়।
‘হুম, এনকাউন্টারর শুরু হয়েছে…
পুরনো মহল্লায়…
লোকেরা বলছে হামিদ রাদারের বাড়ি…
সম্ভবত ২-৩ জন জঙ্গি…
আচ্ছা, তোমরা সাবধানে থেকো।’
ফোনের অন্য পাশে সে চুপচাপ অপেক্ষা করছে। এটা বিব্রতকর। দ্বিধা নিয়েই আমি রেখে দিলাম।
আমি শ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম। আমাদের বাড়ি ছাড়ার দরকার নেই। আমরা নতুন মহল্লায় থাকি। পুরনো মহল্লা আমাদের বাড়ির পাশের ধানখেতের অন্য প্রান্তে।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম ধানখেতের ভেতর একটা কালো ছায়ামূর্তি। রাত্রির রুপালি গালে একটা আঁচিল।
আমাদের গ্রাউন্ড ফ্লোরের করিডোরে অন্তত রাতের জন্য নিরাপদ আমরা। করিডোরের শেষ মাথার জানলা দিয়ে আমি উঁকি দিলাম। বাইরে আহত দানবের মতো চিৎকার করতে থাকা গুলির শব্দের বিপরীতে ধানখেতের ওপর স্বপ্নের মতো ছড়িয়ে আছে জোছনা। খেতেও অন্য পাশে হামিদ রাথারের বাড়িটা বোঝার চেষ্টা করলাম। তার বাড়ি ঘিরে থাকা প্রথম কর্ডন — যেখান থেকে সব চাইতে বেশি ভয়ানক শব্দ শোনা যাচ্ছে — আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে। অশেষ রহমত।
কিন্তু দ্বিতীয় একটা কর্ডনও আছে। বিরাট এক চক্রব্যূহ। আমার বাড়ির বাইরে এবং ধানখেতের ভেতর অস্ত্রধারীদের নীরব একটা চক্র গুলি করার জন্যে অপেক্ষমাণ, প্রথম কর্ডন থেকে যে-ই বের হয়ে আসবে তাকেই শেষ করে দেবে। আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু আমি জানি তারা আছে ওখানে। জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, ওদের হেলমেট অথবা বন্দুকের ওপর চাঁদের আলো পড়েছে কিনা। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম ধানখেতের ভেতর একটা কালো ছায়ামূর্তি। রাত্রির রুপালি গালে একটা আঁচিল। এটা যদি কোনো মানুষ হতো, তাহলে নিশ্চিত সে তার বাহু ছড়িয়ে দিতো — যেমটা দেখাচ্ছে এই মূর্তি, এই ছায়াটাকে। অনেক অনেক গুলির শব্দের ভেতর সবচেয়ে জোরালো আর কাছের শব্দটি আমার চিন্তারেখাকে ভেঙে দিল। মূর্তিটি ধসে পড়ল। আমি হাঁপানোর শব্দ শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখি আমার মেয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। আমি ওর হাত ধরে টেনে করিডোরের মাঝখানে নিয়ে এলাম। জানালা থেকে সরিয়ে নিরাপদ জায়গায়।
‘জানালা থেকে সরে দূরে থাকো। এলোপাথাড়ি গুলি ছুটছে।’
‘বাবা, কী হয়েছে ওখানে?’
‘কিছু না… কিছুই হয় নি…’
‘কিন্তু আমি একটা কিছু পড়ে যেতে দেখলাম।’
‘নাহ, তুমি দ্যাখো নি।’
‘কিন্তু আমি দেখেছি।’
‘চাঁদের আলোর ভেলকিবাজি, তোমার সঙ্গে চালাকি করেছে। ওখানে কেউ নেই। এনকাউন্টার হচ্ছে পুরনো মহল্লায়, কেমন?’
‘তুমিও তো দেখলে।’
‘নাহ, আমি দেখি নি।’
খুব ভয় পেয়েছে। আমি তাই নরম গলায় বললাম, ‘এ সময় কে বাইরে থাকবে?’
‘আমি জানি না। বোধ হয় গুল্লা কাক। উনি খেত থেকে দেরিতে ফেরেন।’
‘নাহ, সে আরও খাটো…’ বলতে বলতে ঠোঁট কামড়ালাম।
‘হুম… হয়তো অন্য কেউ হবে। কারণ ফেরান পরা সে। গুল্লা কাক ফেরান পরে মাঠে যায় না কখনো।’
‘না। ওখানে কেউ নেই। থাকলে আমি বুঝতাম।’
‘হতে পারে অন্য কেউ যাকে তুমি চেনো না।’
‘চুপ করো। তোমার মার কাছে যাও।’ আমার গলার তীব্রতা মেয়েকে আর আমাকেও চমকে দিলো। জড়োসড়ো হয়ে আমার কাছ থেকে সরে মায়ের কাছে গেলো। আমি তখনও শুনতে পেলাম ফিসফিস করে বলছে, ‘মা, হয়তো অন্য কেউ, যাকে আমরা চিনি না। চিৎকার করে সে সাহায্য চাইতে পারতো, তাই না?… অথবা হয়তো সে পড়ে গিয়েছিল সেখানে, ভয়ে দৌড়াচ্ছিল কিংবা কাঁদছিল… হতে পারে আহত হয়েছিল, হাসপাতালে নেয়ার দরকার ছিল…’
‘আল্লার দোহাই, ওকে চুপ করতে বলো।’ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম আমি।
‘হুস্স্…’ ওর মা মেয়েকে শান্ত করতে লাগলো, ‘চুপ কর মা, ওরা যেন শুনতে না পায়। ওরা যদি জানে আমরা এখানে, তখন কে আমার বাঁচাবে?’
আমার মেয়ে মায়ের যুক্তি মেনে নিল না, কিন্তু তার ভয়টা ঠিকই টের পেলো।
‘ঘুমাও মা, ঘুমাও।’
চোখ বন্ধ করলেও আমি জানি সে জেগে আছে।
হঠাৎ আমার বাবার স্থির দৃষ্টি চোখে পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, আমার বোঝার ইচ্ছে নেই, কেন ওভাবে তাকিয়ে আছেন। আমার বিব্রত লাগল, আমি তাই অন্য দিকে ঘুরলাম। আমি ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করলাম, আমার মেয়ের মতোই। মনে মনে নিজেকে বললাম, ওখানে কেউ নেই।
এনকাউন্টার শেষ হলো ২:৩৭-এ। কী করে নিশ্চিত হলাম? কারণ ২:৩৭-এই দুনিয়া কাঁপানো চূর্ণবিচূর্ণ করা গর্জন শুনতে পেলাম। কোনো এনকাউন্টারে এর একটাই অর্থ, যে-বাড়িটিতে জঙ্গিরা লুকিয়েছিল তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছে এবং মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। এর আগে জঙ্গিরা হয় মরে গেছে, নয়তো নিশ্চিতভাবেই ইট-পাথরের টুকরোর নিচে পড়ে আছে। আর সেখানেই এনাকাউন্টারের সমাপ্তি। আমরা এখন ঘুমাতে পারি। নিরাপত্তা বাহিনি তারপরও ওখানে থাকবে, ঘণ্টাখানেক বা তার বেশি সময় ধরে, এটা নিশ্চিত করার জন্য যে, এনকাউন্টার শেষ। কখনো কখনো জঙ্গিরা পালায়, তখন আরও গোলাগুলি আর বাড়ি ধ্বংস করার দরকার পড়ে। আশা করি আজ সেই রাত নয়। আমি ঘুমাতে চাই।
পর দিন সকালে, জেগে উঠে বাড়ি থেকে বের হলাম। লোকজন সব হামিদ রাথারের বাড়ির (= ইট-পাথরের টুকরো) দিকে ভিড় জমিয়েছে। আমিও যাচ্ছিলাম, কিন্তু আদিম প্রবৃত্তি আমাকে তাগিদ দিলো ধানখেতের দিকে তাকাতে। ওখানে কেউ একজন নড়ছেচড়ছে। আমি বুঝলাম সে কে। ‘না… দাঁড়াও।’ চিৎকার করে দৌড়তে লাগলাম। আমার মেয়ে। তাকে ধরার আগেই সে দৌড়ে ওখানে পৌছে গেলো। আমার দিকে তাকালো সে, তার ছোট্ট কোমল মুখটার ওপর ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তি, ‘চিন্তা করো না বাবা, এটা একটা কাকতাড়ুয়া।’
মনে হল, অনেক কাছ অনেক কিছু দেখলাম। অনুবাদক মহোদয়কে অশেষ ধন্যবাদ। লাইফ ইজ বিউটফুল সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল। যেভাবে এক পিতা তার সন্তানের কাছে যুদ্ধের ভয়াবহতা লুকিয়েছিলেন, এখানেও যেন তেমনই দেখলাম। জীবনের এই নিবিড় স্পর্শকাতর অনুভূতিগুলো আরও উন্মোচিত হোক সাহিত্যের মাধ্যমে।