আসুন মাসিক নিয়ে কথা বলি

আজ বিশ্ব মিনস্ট্রুয়াল হাইজিন ডে। মাসিক স্বাস্থ্যসচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা নারীস্বাস্থ্য শুধু নয়, পারিবারিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্যই জরুরি। এ বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে কথা বলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সাদিয়া আফরীন

‘মা তুমি কি ডায়াপার পর?’

হঠাৎ ছেলের এ-প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই খেয়াল করলাম আমার হাতে প্যাড।

‘হ্যাঁ। পরি তো। তবে আমার ডায়াপারকে প্যাড বলে’, আমি উত্তর দিলাম।

 

অন্য আরেকদিন বাবার সাথে ছেলের আলাপ।

‘বাবা তুমিও ডায়াপার পর?’

‘না, বড়দের ডায়াপার পরতে হয় না।’

‘মা তো বড় কিন্তু মা ডায়াপার পরে। মার ডায়াপারকে প্যাড বলে।’

 

গত সপ্তাহে কাপড় গুছাতে গিয়ে কখন প্যাডের প্যাকেটটা বিছানার উপর রেখেছি। ছেলে দেখতে পেয়ে খুলে ভিতর থেকে রঙিন প্যাডগুলো বের করে একের পর এক রঙের নাম বলছে। প্রথমে আমি খেয়াল করিনি হঠাৎ ফোনকল আসায়। কথা বলার এক পর্যায়ে লক্ষ্য করে ফোনের ওপারে থাকা বন্ধুকে বলতেই ও আৎকে উঠলো।

‘এমা ছেলের সামনে এগুলো রাখিস কেন?’ ততধিক আৎকে উঠে বললাম, ‘রাখলে কি সমস্যা?’

‘না কখন কার সামনে বলে ফেলে। এমব্যারাসিং সিচুয়েশনে পড়বি।’

আমি হাসলাম। বললাম, ‘আমি এমব্যারাসড হলে না এমব্যারাসিং সিচুয়েশনে পড়বো। পিরিয়ডকে আমি এভাবে দেখিনা।’

মাসিক নিয়ে হাসাহাসি, লজ্জা, খোলামেলা কথা না বলা কিংবা সামাজিক রাখঢাক এ-সবকিছুই মাসিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবাকে অস্বাস্থ্যকর চর্চা ও বিধিনিষেধের মধ্যে আটকে রেখেছে।

যে জন্য উপরের ঘটনাগুলো বলা। মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে লজ্জা, সংকোচ খুবই সাধারণ ঘটনা। কিন্তু  আদতে মাসিক নিয়ে লজ্জার কিছু নেই। এটি অস্বস্তিতে পড়ার মত বিষয়ও নয়। একটা সময় ঘরের কোনায় আলনার পেছনে অন্ধকার জায়গায় মাসিকের ভেজা কাপড় শুকাতে দিতাম। বাবা বা ভাইয়ের নজরে যাতে না পড়ে এজন্য বাইরে রোদে দেয়ার কথা ভাবতেই পারতাম না। এরপর প্রতি মাসে কষ্টকর দিনগুলোতে ব্যাথায় যখন ছটফট করতাম তখন ভাইয়া এসে খেলার জন্য ডাকলে বলতাম, ‘আমার পেট খারাপ।’ ভাইয়া ক্ষ্যাপাতো। বলতো, ‘এত পেট খারাপ কেন হয় তোমার? কি হাবিজাবি খাও?’ কিশোরী আমি ব্যাথা চেপে হাসতাম। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও কাপড় দিয়েই মাসিক সামলাতাম। এই নিয়ে ঢাকার বন্ধুরা হাসতো। হাতখরচের টাকা থেকে প্যাড কেনা তখনও বিলাসিতা। আস্তে আস্তে কিনতে শুরু করি কিন্তু একটা প্যাড যাতে অনেক সময় পর্যন্ত ব্যবহার করা যায় সেটা মাথায় রাখতাম। তারপর বহুদিন পর বহু বর্ণিল প্যাড কভার দেখে ছেলে একদিন জানতে চায় ‘মা তুমি কি ডায়াপার পর?’

 

আমি এখন আর মিথ্যা বলিনা। যে মিথ্যা প্রতিনিয়ত ভাইকে বলেছি। ‘হ্যাঁ পরি। তবে সবসময় না। যখন আমি ব্লিড করি।’ ছেলে বোঝে কি বোঝেনা তবে খুশী হয়। মা’ও ডায়াপার পরে কিন্তু মা’র ডায়াপারকে প্যাড বলে।

 

কেন ছেলেকে মাসিক নিয়ে বলি আমি? কারণ মাসিক নিয়ে হাজারো রকম ট্যাবু আছে। আমি এই ট্যাবুগুলোকে আমি ভাঙি। অস্বীকৃতি জানাই। মাসিক মানেই লজ্জা। মাসিক মানেই নারীর গোপন ব্যাথা। পুরুষ জানবে না। জানলে বরং নারীরই লজ্জা, নারীরই অস্বস্তি! শুধু লজ্জা বা সংকোচ না এসময় খাওয়াদাওয়ার উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যেমন, আঁশটে গন্ধ হবে সেজন্য মাছ খেতে না দেয়া। কিংবা রক্ত সাদা হয়ে যাবে ভেবে দুধ খেতে না দেয়া ইত্যাদি। অথচ এসময় পুষ্টিকর খাবার খাওয়া দরকার কারণ এসময় মেয়েদের শরীর থেকে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ বেড়িয়ে যায়। খাবারদাবারে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি আমাদের সংস্কৃতিতে নারীর বিচরণের উপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। যেমন, এসময় বাড়ির বাইরে না যাওয়া। ঘরে থাকা।

 

কিশোরীবেলায় অনেককেই দেখেছি মাসিক হবার কারণে স্কুল কামাই দিতে। তাছাড়া আমাদের স্কুলের টয়লেটগুলো এত নোংরা, অপরিচ্ছন্ন থাকতো যে সেখানে গিয়ে মাসিকের কাপড় বদলানো ছিলো ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা। আমরা অনেকেই এই জন্যেই স্কুলে যেতাম না কিংবা মাসিকের শেষের দিনগুলোতে যেতাম এবং গেলেও প্রস্রাব আটকে রাখতাম সারাদিন।

 

তবে সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো আমরা মাসিক নিয়ে খোলামেলা আলাপ করতাম না। যদিও সবারই মাসিক হতো কিন্তু সেটি কেবল ঘনিষ্ঠ বন্ধুটিই জানতো এবং একমাত্র সে-ই হদিস দিতে পারতো কেন তার সহচরী স্কুলে অনুপস্থিত। বাকীরা অনুমান করতো এবং ফিসফাসের এক ফাঁকে এ-কান থেকে ও-কানে যেত। আর স্কুল চলাকালীন কারও মাসিক হয়ে গেলে কিংবা কারও স্কুলড্রেসের উপরে রক্ত দেখা গেলে খুবই অস্বস্তি নিয়ে তাকে স্কুল ত্যাগ করতে হতো। আমরা তখন অনেকেই লুকিয়ে হাসতাম। যেন হঠাৎ মাসিক হওয়া খুব অন্যায়!

 

এই যে মাসিক নিয়ে হাসাহাসি, লজ্জা, খোলামেলা কথা না বলা কিংবা সামাজিক রাখঢাক এ-সবকিছুই মাসিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবাকে অস্বাস্থ্যকর চর্চা ও বিধিনিষেধের মধ্যে আটকে রেখেছে। আশার কথা হলো সরকারী, বেসরকারী বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে এ-বিষয়ক সচেতনতা বাড়ছে। কিশোরীরাও নিজেদের মধ্যে এ-নিয়ে আলাপ আলোচনা করছে, প্রচারমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত প্রচারণা চলছে এবং এভাবেই একদিন মাসিক নিয়ে সামাজিক ট্যাবুগুলো দূর করা সম্ভব হবে বলে মনে করি। তাই আসুন লজ্জা, সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মাসিক নিয়ে কথা বলি।

1 COMMENT

  1. সময়োপযোগী অত্যন্ত জরুরি লেখা। অভিনন্দন লেখককে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here