ভূমিকা
অম্বলিকা গুহ — ভারতের কলকাতাভিত্তিক একজন স্বাধীন গবেষক। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউজিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটন থেকে পড়ালেখা সম্পন্ন করেছেন। তিনি নিউজিল্যান্ড এশিয়া সোসাইটিরও একজন সদস্য। ২০১৮ সালে প্রকাশিত অম্বলিকা গুহের Colonial Modernities: Midwifery in Bengal, C.1860–1947 বইটি মূলত দেখাতে চেয়েছে, বাংলায় ১৮৬০ সাল থেলে ১৯৪৭ সালের ভেতর ধাত্রীবৃত্তি কীভাবে প্রচলিত দাইদের থেকে সরে গিয়ে পেশাদার ধাত্রী ও চিকিৎসকদের আধিপত্যপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছিল। একই সাথে মানবশিশু জন্মদানের মতো একটি প্রাকৃতিক বিষয়কে কিভাবে ঔপনিবেশিক শাসন একটি চিকিৎসার বিষয়ে পরিণত করেছিল, আর এই পরিণত করার পেছনে সেই সময়ের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকদের তৎপরতা, যার অন্যতম ছিল সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে লেখালেখি, তারই সামাজিক ইতিহাসকে তুলে ধরেছে এই বই। অম্বলিকার বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক শিবলী নোমান।
উপনিবেশ নিয়ে আমাদের বহুল প্রচলিত ডিসকোর্সগুলোর ভেতর এই বিষয় নিয়ে আলাপ সাধারণত হয় না। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এই গবেষণামূলক কাজটি থেকে দেখা যাবে যে, আমরা আমাদের যাবতীয় আধুনিকতার জন্য প্রায়শই ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতি ঋণস্বীকার করে থাকলেও, আদতে তারা এই অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে কমই ভেবেছে। এই সময়কালে বাংলায় ধাত্রীবৃত্তির ইতিহাস থেকে দেখা যাবে যে, এ সময় মূল কাজগুলো স্থানীয় মিউনিসিপাল কর্পোরেশন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছিলো, সরকারি উদ্যোগ খুব বেশি ছিল না। অর্থাৎ নীতিগত পর্যায়েই উপনিবেশের জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার বিষয়টি অনেকটাই অনুপস্থিত ছিল। তাছাড়া যেটুকু পরিবর্তন এসেছিল তার অনেকাংশই ছিল ইংল্যান্ডের অনুকরণ, সেক্ষেত্রে আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থাগুলোকে এক ধরনের বাতিল বা তামাদি হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার বাংলার শহরাঞ্চলগুলোতেই এই চিকিৎসাগত পরিবর্তনগুলো চলমান ছিল, সেক্ষেত্রে প্রান্তিক ও গ্রামাঞ্চলগুলো এসবের বাইরেই থেকে যায়। এ থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, ঔপনিবেশিক শাসকরা খুব স্বাভাবিকভাবে তাদের নিয়েই ভেবেছে ও সেখানেই অর্থ সরবরাহ করেছে যা নিয়ে না ভাবলে ও যেখানে অর্থ সরবরাহ না করলে তার ঔপনিবেশিক স্বার্থ বাধাগ্রস্ত হয়।
অধ্যায় : এক
বৈজ্ঞানিক মা ও স্বাস্থ্যবান শিশু : বাংলায় একটি ‘আধুনিক বৈজ্ঞানিক’ ডিসকোর্সের জন্ম
১৮৬০ এর দশক থেকে ১৯০০
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাগুলোকে আপনা-আপনি পরিবর্তন করার মতো ক্ষমতা কোন প্রযুক্তিই ধারণ করে না। এমনকি একটি ‘বৈজ্ঞানিক অগ্রগামীতা’-ও পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে না। আদর্শগতভাবে উর্বর একটি সামাজিক ক্ষেত্রের সাথে যুক্তকরণ কিংবা চারপাশে এমন একটি ক্ষেত্র তৈরি না করা পর্যন্ত কোন প্রযুক্তিই বিস্তৃত গ্রহণযোগ্যতা অর্জন ও সাংস্কৃতিক সংস্কারের ভিত্তিতে পরিণত হতে পারে না।১
পশ্চিমে পেশা হিসেবে ধাত্রীবিদ্যার বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উপরিউক্ত পর্যবেক্ষণটি দিয়েছিলেন প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ডব্লিউ. আর. আর্নি। নতুন বৈজ্ঞানিক ধারা ও সমাজের আশেপাশে জ্ঞানের গঠনকে স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে ঐ সমাজ যে মাত্রার প্রস্তুতি প্রদর্শন করে তার সাথে আর্নি সমাজে বৈজ্ঞানিক অগ্রগামীতার গতিকে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে বাংলায় ধীরগতির কিন্তু জটিল এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটছিল; এই রূপান্তর স্থানীয়/প্রাক-আধুনিক পর্যায় থেকে আধুনিকে যাওয়ার একমুখী স্পন্দন ছিল না, বরং ছিল স্থানীয়/ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিকের ভেতর বিদ্যমান অনেক বেশি জটিল এক ক্ষেত্র। তারপরও পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতির কোন কোন উপাদানকে প্রগতির প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করে সেগুলোকে নির্দ্বিধায় বাংলার সাংস্কৃতিক ভূমিতে অঙ্গীভূত করা হয়েছিল। পশ্চিমা বিজ্ঞানের উত্থান ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মন নির্মাণে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এই সত্যেরই চিত্রায়ন।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসের উপর জটিল এক সাহিত্য সম্ভারের আবির্ভাব এখন পশ্চিমা বিজ্ঞানকে ঔপনিবেশিক আধুনিকতার অবলম্বন হিসেবে সামনে নিয়ে আসছিল এবং একে ভারতে ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের বৈধতার ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরছিল। এটি আরও দেখাচ্ছিল যে বিজ্ঞান কীভাবে একটি কর্তৃত্বশীল সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং উপনিবেশিত অভিজাতদের দ্বারা ক্ষমতার প্রতি তাদের নিজস্ব হেজিমনিক আকাক্সক্ষাকে আওয়াজ দেয়ার জন্যে কীভাবে একে খুঁতখুঁতেভাবে ধরে রাখা হয়েছিল।২ কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠা ও এরই ফলে বাংলায় পশ্চিমা চিকিৎসা ধারার সূচনা হলো সেই গ্লানিময় উদাহরণ, যেখানে দেখা যায় কীভাবে বিদ্যমান জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারাকে প্রশ্ন করতে, কিংবা সময়ে সময়ে ধ্বংস করতে এবং চিন্তার নতুন কাঠামো তৈরিতে পশ্চিমা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে ব্যবহার ও বণ্টন করা হয়েছিল। ঔপনিবেশিক আধুনিকতার প্রতি সাড়াপ্রদানে উদ্ভূত ‘আদর্শিকভাবে উর্বর সামাজিক ক্ষেত্র’-র সীমানার ভেতর শিশুজন্মের আধুনিকায়নের ইতিহাসকে স্থাপন করা এই অধ্যায়ের লক্ষ্য। জন্মের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন বৈজ্ঞানিক ধারা ও পশ্চিমা চিকিৎসা ভাবনার সংস্থানকে পরিবর্তনশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ কতটা সুগম করেছিল তা বুঝতে পারাই এর উদ্দেশ্য। এটি করতে গিয়ে এই অধ্যায় খ্রিস্টান মিশনারিদের মতো বিদেশি প্রতিনিধিদের একপাশে সরিয়ে রেখে স্থানীয় পরিসরের ভেতর ধাত্রীবৃত্তি ও শিশুজন্মের চর্চাগুলোর সংস্কারকে স্থাপন করে, যা পরিচালিত হয়েছিল বাংলার আলোকিত অভিজাতদের দ্বারা।
এই অধ্যায় মূলত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভদ্রলোকদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ডিসকোর্সে আলোকপাত করায় আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে উনিশ শতকের শেষ দিকে স্বদেশীয় ম্যাগাজিনসমূহের লেখালেখির স্থানে ভদ্রলোকদের আত্ম-তৈরিকৃত প্রকল্পের উত্তরোত্তর দৃশ্যমানতা বৃদ্ধির বিষয়টি। ঔপনিবেশিকদের থেকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিনিয়ে নেয়ার লড়াইয়ে মধ্যবিত্তরা ঔপনিবেশিক আধুনিকতার প্রতিধ্বনি করা হঠাৎ করে একত্রে বন্ধ করে দেয় এবং এর স্থলে পুরো বিষয়টিকে নিজেদের মতো নির্ধারিত করাকেই পছন্দ করা শুরু করে। ‘জাতীয় কিন্তু আধুনিক সত্তা’৩-কে পুনরায় আকার দেয়ার আসন্ন সংগ্রামে এটি সামাজিক জীবনের সবচেয়ে ভিত্তিস্থানীয় পর্যায়, তথা পরিবার ও নারীদের বিষয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণভাবে ছুঁয়ে যায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবর্তিত অগ্রাধিকারের সাথে তাল রেখে গার্হস্থ্য জীবন, দাম্পত্য জীবন, স্বাস্থ্য, গর্ভধারণ ও সন্তান লালন-পালনের মতো বিষয়গুলো স¤পর্কে সচেতনতাও নতুনভাবে গঠিত হওয়া শুরু হয়েছিল। এই অধ্যায় দেখতে চায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি দ্বারা প্রভাবিত কতগুলো পরিবর্তন আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক সংবেদনশীলতা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, যেগুলো ১৮৩০ ও ১৮৪০ এর দশক থেকে ভদ্রলোকদের আদর্শকে সার্বিকভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং ১৮৬০ এর দশকের ক্রমবর্ধমান প্রিন্ট সংস্কৃতিতে আরও বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় প্রিন্ট সংস্কৃতির বিস্তারের ফলে এমন একটি ডিসকার্সিভ ফোরাম তৈরি হয়েছিল যেখানে নারীত্ব নিয়ে সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবনাগুলোর ভেতর বাদানুবাদ, আলোচনা ও পরিবর্তন সাধিত হতো। এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি সমর্পিতা মিত্র বাঙালি সাময়িকীপত্রগুলোর এক ক্রিটিক্যাল ভূমিকায় আলোকপাত করেছেন যা ‘‘বাঙালিত্বের ভাবনা, যা হলো নান্দনিক ও সাহিত্যিক ক্ষেত্রে পুঞ্জীভূত হওয়া পরিচিতির এক বিশেষ ধরণ, এবং যা নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক প্রকল্প সহযোগে গঠিত”, তা গঠনে সহায়তা করে।৪ ম্যাগাজিনসমূহের লেখালেখির স্থানে একটি ‘নারীদের অঞ্চল’ তৈরি করা এই বাঙালিত্বের আদর্শিক গঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বলেও মিত্র মনে করেন। নারীদের ম্যাগাজিনসমূহ মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে নারীত্বকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে মাতৃত্বের কেন্দ্রীয়তার বিষয়টি নজরে আসে। নারীদেরকে জননী ও গৃহিণী হিসেবে নিয়মের ভেতরে আনা, নিয়ন্ত্রণ করা ও আধুনিকায়িত করার পিতৃতান্ত্রিক চেষ্টাগুলোর কেন্দ্রেই মাতৃত্বের এই উত্থিত ধারাটি অবস্থান করছিল; প্রজনন স্বাস্থ্যসহ স্বাস্থ্যবিষয়ক অন্যান্য বিজ্ঞানে নারী সমাজকে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে এগুলো শক্তিশালী দোহাই হিসেবে সামনে এসেছিল।
প্রিন্ট সংস্কৃতি ও সাময়িকীগুলো নিয়ে করা সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে চিকিৎসা ভাবনা ছড়িয়ে দিতে, স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষাকে উৎসাহিতকরণে এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনমত নির্ধারণে স্বদেশীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক ম্যাগাজিনগুলোর কেন্দ্রীয়তাকে নজরে আনা হয় নি।৫ বৈজ্ঞানিক ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয়গুলোকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারী ও পুরুষ পাঠকদের আধুনিক ও যৌক্তিক সংবেদনশীলতার প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেই এসব ম্যাগাজিনের ভূমিকা প্রোথিত।৬ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণভাবে, এসব ম্যাগাজিন একটি জাতীয়তাবাদী লক্ষ্যকে বিবৃত করেছিল, যা হলো জাতীয় পুনরুত্থানের জন্য সূচক হিসেবে স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি আধুনিক ডিসকোর্স।৭ যদিও এসময়ের জাতীয়তাবাদ সমগ্র ভারতীয় জাতীয়তার মতো সমুচ্চ ভাবনার চেয়ে বাঙালিত্বকে নিয়েই বেশি কথা বলছিল।
নারীদের স্বদেশীয় ম্যাগাজিনগুলোতে ধাত্রীবৃত্তি ও নারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে লেখা প্রথমদিকের প্রবন্ধগুলোর লেখক পরিচিতি অনেকটাই অস্পষ্ট। সকল সম্ভাব্যতার হিসেবে এটুকু বলা যায় যে, এগুলো নারী চিকিৎসা স্নাতকদের দ্বারা লিখিত নয় যারা ১৮৮৫ সালের ডুফেরিন ফান্ডের স্থাপন ও আরও সষ্টভাবে ১৮৯১ সালের পরই পেশাজীবী দল হিসেবে উদ্ভূত হয়েছিল।৮ এর ফলে এই ধারণাই শক্তিশালী হয় যে এসব প্রবন্ধ আসলে বাঙালি পুরুষ সংস্কারকদের দ্বারাই রচিত হয়েছিল, যার ভেতর কলকাতা মেডিকেল কলেজের স্বদেশীয় স্নাতক ও অন্যান্য চিকিৎসা শিক্ষার্থীরাও ছিল। নারীদের ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এসব প্রবন্ধের ভেতর ধাত্রীবৃত্তির উপর বহুল প্রচারিত ব্রিটিশ বইসমূহ অথবা ড. জেমস সিম্পসনের মতো ব্রিটিশ ধাত্রীবিদদের বক্তৃতার সারাংশও অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হতো।৯ ১৮৭০ ও ১৮৯০ এর দশকে প্রকাশনায় আসা নারীদের দ্বারা ব্যবস্থাপিত যথাক্রমে ভারতী ও অন্তঃপুর-এর মতো ম্যাগাজিনগুলোর লেখক ছিল বাঙালি সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত স্তরের শিক্ষিত নারীরা।
পরিবারের পুনর্গঠন : একটি যৌক্তিক চর্চা
উনিশ শতকে বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট যে প্রধান সংস্কারমূলক ধারা দ্বারা গঠিত হয়েছিল তাতে পশ্চিমের অনুরণন ছিল। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নানারূপে দৃশ্যমান বাঙালিদের ‘আধুনিক’ ও ‘বৈজ্ঞানিক’ সংবেদনশীলতাসমূহের উদ্ভবে নতুন উপনিবেশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবর্তনশীল ধারণাগুলো সন্দেহাতীতভাবেই স্থান পেয়েছিল। যুক্তির রেটরিকে অবস্থান করা বৈজ্ঞানিক ভাবনাগুলো ঐ সময়ের কর্তৃত্বশীল সামাজিক প্রশ্নগুলোর প্রতি ভদ্রলোকদের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভালোভাবেই প্রভাবিত করেছিল। সমাজের পুনর্গঠনের ভিত্তিকে এটি শক্তিশালী করে। গার্হস্থ্য জীবন ও দাম্পত্য জীবনের ধারা দ্বারা বাহিত প্রাথমিক সামাজিক একক, তথা পরিবারকে পুনর্সংজ্ঞায়িত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদিসমেত পুনর্গঠনের চিন্তা করা হচ্ছিলো।
এই প্রক্রিয়ায়, গার্হস্থ্য ও দাম্পত্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গর্ভধারণ ও এ সম্পর্কিত চর্চাগুলো তপ্ত জনবিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। একে মূলত দেখা হতো দাপ্তরিক সূত্রে প্রকাশিত শিশুমৃত্যুর অমীমাংসিত প্রতিবেদনসমূহ দ্বারা যেখানে শিশুদের জীবন হারানোর বিষয়টিকে নারী সমাজের অবহেলা ও অযৌক্তিক চর্চাসমূহের সাথে সম্পর্কিত করা হতো। এ ধরনের ভাবনাগুলো ১৮৬০ এর দশক থেকে জনপ্রিয় ম্যাগাজিনগুলোতে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে প্রকাশিত হতে থাকে। বিশ শতকের যুদ্ধের মধ্যবর্তী বছরগুলোতে মা ও শিশুমৃত্যুর ক্রমবর্ধমান হার দ্বারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত জাতীয়তাবাদের প্রেসে স্থান পাওয়ার বহুকাল আগেই উনিশ শতকের উদার সংস্কারকদের দ্বারা বিদ্যমান ধাত্রীবৃত্তির চর্চাকে আধুনিকায়িত করার একটি অনভিজ্ঞ চেষ্টা হাতে নেয়া হয় এবং পরবর্তী শতকগুলোর শিশুজন্ম বিষয়ক জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সে এর আকর্ষণীয় অনুরণন ছিল।
ইংরেজি শিক্ষামূলক পাঠ্যবইগুলো আত্ম-ঘোষিত ‘যৌক্তিকতা’, ‘পুরুষত্ব’, ‘শারীরিক যোগ্যতা’ ও ‘প্রগতিশীলতা’-র মতো পশ্চিমা গুণাবলিকে ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’, ‘মেয়েলি’, ‘দুর্বল’ ও ‘অধঃপতিত’-র মতো আরোপিত ভারতীয় প্রবৃত্তির বিপরীতে প্রচার করছিলো ও গেঁথে দিচ্ছিলো।
উনিশ শতকে বিস্তারমান ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক চাহিদাসমূহ থেকেই ভদ্রলোক বা শিক্ষিত/পেশাজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব। ‘অর্থনীতি ও প্রশাসনের সংস্থা’ হিসেবে একটি আজ্ঞাবহ মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরির ঔপনিবেশিক লক্ষ্যপূরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা পাঠ্যক্রমে ইংরেজি শিক্ষার সূচনা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ কারণ এটিই ছিল ইউরোপিয় আদর্শগুলোকে উপনিবেশিতদের ভেতর ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যম। ১৮৫৪ সালের দ্য চার্লস উডস ডেসপ্যাচ স্থানীয় জনগণকে পুঁজি ও শ্রমের গুরুত্ব অনুধাবন করানো ও তাদের সৃজনশীল ক্ষমতাকে ঔপনিবেশিকদের রাজনৈতিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্যে জড়ো করার তুলনামূলক ¯পষ্ট সেক্যুলার লক্ষ্যের সাথে ইংরেজি শিক্ষাকে যুক্ত করে।১০ ইংরেজি শিক্ষামূলক পাঠ্যবইগুলো আত্ম-ঘোষিত ‘যৌক্তিকতা’, ‘পুরুষত্ব’, ‘শারীরিক যোগ্যতা’ ও ‘প্রগতিশীলতা’-র মতো পশ্চিমা গুণাবলিকে ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’, ‘মেয়েলি’, ‘দুর্বল’ ও ‘অধঃপতিত’-র মতো আরোপিত ভারতীয় প্রবৃত্তির বিপরীতে প্রচার করছিলো ও গেঁথে দিচ্ছিলো।১১ বেশ ভালো মাত্রায় উপহাসিত ভারতীয়দের এহেন ‘নারীত্ব’-র বিপরীতে ব্রিটিশ ‘পুরুষত্ব’-র এই কল্পিত ধারা ভারতীয় সংবেদনশীলতাসমূহকে গভীর মনস্তাত্ত্বিক তাড়না দিয়েছিল। যার ফলাফল হিসেবে আশিষ নন্দী আধুনিক পশ্চিমকে একটি ‘ভৌগলিক ও সাময়িক সত্তা’ হিসেবে চিন্তা না করে একটি ‘মনস্তাত্ত্বিক ধারা’ হিসেবেই স্থায়ী চিত্রায়নের বিষয়টি বর্ণনা করেছেন।১২
নতুন উদ্ভূত মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাকরি বা বেতনভোগী কাজের পেশাদার জগতে প্রবেশ সম্ভব হয়েছিল বাংলায় ১৮৩৫ সালের ইংলিশ এডুকেশন অ্যাক্ট-এর দ্বারা ইংরেজি শিক্ষা শুরুর মাধ্যমে।১৩ এই অ্যাক্ট ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয়দের ভেতর ইউরোপিয় নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ ছিল। ১৮৫৪ সালের চার্লস উডের বিখ্যাত ডেসপ্যাচ এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ইংরেজি শিক্ষাকে এর নৈতিক ও ধর্মীয় লক্ষ্য থেকে আলাদা করে এবং ব্রিটিশদের রাজনৈতিক অর্থনীতির উন্নতিসাধনের লক্ষ্যে একে ¯পষ্টভাবেই সেক্যুলার উদ্দেশ্যসমূহের সাথে যুক্ত করে।১৪ এক্ষেত্রে পুনর্সংজ্ঞায়িত লক্ষ্য ছিল “ভারতের স্থানীয়দের শ্রম ও পুঁজির নিয়োগের বিস্ময়কর ফলাফল স¤পর্কে শিক্ষা দেয়া এবং তাদের দেশের বিপুল সম্পদের উন্নতিসাধনে আমাদেরকে অনুকরণ করার জন্য তাদের জাগিয়ে তোলা।”১৫
ইংরেজি শিক্ষার সাথে সাথে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও ‘সময়ানুবর্তী’ ঔপনিবেশিক দপ্তরগুলোতে প্রবেশাধিকার পাওয়ায় ভদ্রলোকদের ভেতর আধুনিক সত্তার সচেতনতা সৃষ্টি হয়।১৬ একই সময়ে, দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডের ‘কার্যসূচি নির্ভর’ প্রকৃতি ঐতিহ্যবাহী পরিস্থিতি থেকে এক ধরনের বিচ্ছেদের আবহ তৈরি করে; ঔপনিবেশিক চাকরিদাতাদের অধীনস্থ থাকা এবং এ ধরনের চাকরির কারণে নিত্যদিনের অপদস্থ হওয়ার মতো ঘটনাগুলো থেকে পুরো বিষয়টি আরো জটিল আকার ধারণ করে। ঐতিহ্যবাহী সামাজিক ক্রমবিন্যাস সংরক্ষণের ক্ষেত্র হিসেবে পরিবারকে ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তার প্রতি সরবতা ছিল এই অবস্থার একটি ফলাফল। যদিও, উপনিবেশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভেতর একটি আধুনিক, বৈজ্ঞানিক সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে পশ্চিমা শিক্ষার প্রভাব সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল; আর এরই ফল হিসেবে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক চর্চাসমূহের কোন কোন অংশকে আদিম, অযৌক্তিক ও পিছিয়ে পড়া হিসেবে প্রশ্ন করা ও একপাশে সরিয়ে রাখা হয়েছিল।
বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জনের ক্ষেত্রে যুক্তি হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় বিষয়। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি সাড়াপ্রদান হিসেবে যে শিক্ষা কাঠামো গড়ে উঠেছিল তার সাথে এটি ছিল সম্পর্কিত; এই বিষয়টি সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছিল ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজের পাঠ্যক্রমে এবং একই সময়ে উঠে আসা সমধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এই পাঠ্যক্রমগুলোতে ‘শক্তিশালী যুক্তিবাদী প্রবণতা’ প্রতিফলিত হতো এবং ঐ শতকের অধিকাংশ সময় জুড়ে এগুলো ছিল ‘অনন্যভাবে সেক্যুলার’।১৭ এ প্রসঙ্গে জ্ঞান প্রকাশ বলেন :
একটি বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গঠনকে উৎসাহিত করার জন্য নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। আর বিদ্যমান সরকারি সংস্থাগুলো তাদের কর্মকাণ্ডে বিজ্ঞানকে উৎসাহিত করছিল। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ বা তা ব্যতিরেকেই বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণামূলক পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল; আর ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারগুলোকে দেখা হচ্ছিলো বিজ্ঞানের কর্তৃত্বপূর্ণ ‘দ্বিতীয় দৃষ্টি’ দিয়ে।১৮
ভারতের ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’ ও বিজ্ঞানবিষয়ক অধ্যয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিউক্লিয়াস হিসেবে ১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পর১৯ ব্রাহ্ম সমাজ, তত্ত্ববোধিনী সভা এবং দ্য সোসাইটি ফর দ্য অ্যাকুইজিশন অব জেনারেল নলেজ-এর মতো সামাজিক-ধর্মীয় সংস্কার ও বৈজ্ঞানিক সংঘ গড়ে উঠেছিল, আর এদের প্রায় সকলেই ‘চিন্তা ও জীবন যাপনের নতুন ধরন’-এর তাড়নাপূর্ণ উদ্দেশ্য দ্বারাই চালিত হচ্ছিলো।২০ ‘চিন্তা ও জীবন যাপনের নতুন ধরন’ স্বাস্থ্য, গার্হস্থ্য জীবন, দাম্পত্য জীবন, মাতৃত্ব, গর্ভধারণ ও সন্তান লালন-পালনে অঙ্গীভূত জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়কে ছুঁয়ে গিয়েছিল।
স্বাস্থ্যের সাথে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির নিবিষ্টতা ১৮৬০ ও ১৮৭০ এর দশকে উত্তরোত্তর স্পষ্ট হতে থাকে, আর ভারতের অন্যান্য অংশের চেয়ে বাংলায় এটি বেশি হয়েছিল। স্বাস্থ্যের প্রতি এই সচেতনতা আসলে বাঙালিদেরকে ‘মেয়েলি’ হিসেবে চিহ্নিত করা ঔপনিবেশিক অভিযোগের প্রতি এক দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া ছিল। তানিকা সরকার বাঙালিদের এই বলহীনতার ভাবনার শেকড় খুঁজে পেয়েছিলেন ১৮৩০ ও ১৮৪০ এর দশকের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির ভেতর। এই ‘মরোমরো’ গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের নিম্ন উৎপাদনশীলতা এবং খাদ্যের অপর্যাপ্ত যোগানের সাথে সাথে মহামারী, জীবননাশী জ্বর এবং দুর্ভিক্ষ যুক্ত হয়ে ‘মৃতপ্রায়’ বাঙালির চিত্র তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিল। ভঙ্গুর সত্তার প্রতি এমন সচেতনতা মেয়েলিপনার চিন্তাকে ভিত্তি দিয়েছিল; সরকার বলেন পুরুষত্ব স¤পত্তির সাথে নির্দিষ্ট ‘সম্পর্কের প্রকৃতি’-র উপর নির্ভর করতো।
১৮৪০ এর দশক থেকে ইউরোপিয় বাণিজ্য সংস্থা ও মারওয়ারিদের (উত্তর ভারতীয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী) দ্বারা বাঙালি উদ্যোক্তাদের প্রান্তিকীকরণ এবং ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্থাসমূহে ছোট ছোট করণিক পদে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাজ করার বাধ্যবাধকতা থেকেই বলহীনতার এই বোধ তৈরি হয়েছিল; আর এটি আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৮৫৯ ও ১৮৫৫ সালে রেন্ট অ্যাক্টস দ্বারা। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর প্রজাদের উপর জমিদারদের ক্ষমতা ও সুবিধাকে রেন্ট অ্যাক্টস অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল।২১ এ ধরনের পরিস্থিতি খুব স্বাভাবিকভাবেই ভূমির সাথে স্থায়ীভাবে স¤পর্কিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আত্মরূপ ও সম্মানকে আঘাত করেছিল। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কতিপয় বর্ণবাদী ও স্বাতন্ত্রবাদী নীতিমালার কারণে পুরো উনিশ শতক ধরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তাড়া করে বেড়ানো অবনতির বোধ আরো বর্ধিত হয়েছিল; বাঙালিদের পুরুষত্বে প্রশ্ন তুলে তাদের অস্ত্রবহনের অধিকার কিংবা ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক চাকরিতে উচ্চপদ গ্রহণকে বাধা দেয়ার মতো কাজ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়।২২
১৮৫০ ও ১৮৬০ এর দশকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ব্রিটিশদের দ্বারা ছাঁচিকৃত ‘মেয়েলি বাঙালি’ ধারণাকে ধারণ করেছিল এবং এই ধরে নেয়া আপজাত্য থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে পেয়েছিল শারীরিক সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের ভেতর।২৩ চিকিৎসা সম্মিলনী নামক প্রথম সারির একটি বাঙালি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘দ্য রিভাইভাল অব ন্যাশনাল ফিজিক্যাল হেলথ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, “অধিকাংশ বিদেশি ও কিছু কিছু ভারতীয় চিন্তক মনে করেন যে আমাদের দেশের মানুষের শরীর ভঙ্গুর ও তারা স্বল্পায়ুসম্পন্ন এবং এই ধারণা সত্যর থেকে আদতে খুব বেশি দূরে নেই”।২৪ এর সমাধান হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছিল :
যদি পুষ্টিকর খাবার দিয়ে শরীরকে যথাযথভাবে শক্তিশালী করতে হয়, তাহলে শারীরিক কর্মকাণ্ড ও যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে ফুসফুসে যথেষ্ট পরিমাণ বিশুদ্ধ বায়ু গ্রহণ করতে হবে…আমাদের দেশের সম্মানিত, শিক্ষিত ও ধনী মানুষরা যদি একজন ইংরেজ নারীর সমপরিমাণ শারীরিক উদ্যম অর্জনেও প্রস্তুত থাকে তাহলে তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের পথে অন্যতম একটি বাধা দূর হয়ে যাবে।২৫
কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠা ও বিদ্যায়তনিক পাঠ্যক্রমে অ্যানাটমি ও ফিজিওলজিকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে নতুন চিকিৎসা সংস্কৃতি তৈরির ফলে ভদ্রলোকদের স্বাস্থ্যবিষয়ক ডিসকোর্সে শারীরবৃত্তিক বিষয়গুলো আগ্রহের একটি ক্রিটিক্যাল এলাকায় পরিণত হয়।২৬ অ্যানাটমি অধ্যয়নের ফলে এমন এক নতুন জ্ঞানতাত্ত্বিক চর্চার শুরু হয়েছিল যেখানে শরীরকে চিকিৎসাজনিত পরীক্ষার একটি বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ভারতে বিদ্যমান চিকিৎসা শিক্ষা পদ্ধতির সাথে এটি ছিল খুবই পার্থক্যপূর্ণ। ভারতের আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল কবিরাজ বা শিক্ষকের থেকে শিক্ষার্থীদের কাছে চিকিৎসা জ্ঞানকে প্রবাহিত করা, সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ধ্রুপদী চিকিৎসা সংক্রান্ত রচনাগুলো শিক্ষার্থীদের আয়ত্তে আনা ও কবিরাজের নির্দেশনায় ঔষধ তৈরি করা।২৭ এ কারণেই মেডিকেল কলেজগুলোর চিকিৎসা পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে অ্যানাটমি অধ্যয়নের সূচনা করা হলে তা চিকিৎসা-বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ভদ্রলোকদের ভেতর স্বাস্থ্যবিষয়ক চিন্তাভাবনায় গভীর প্রভাব রেখেছিল।
১৮৬০ সাল পর্যন্ত উপনিবেশের দপ্তরগুলো মূলত সেসব রোগ নিয়েই চিন্তিত ছিল যেগুলো দ্বারা সেনাবাহিনী ও ইউরোপিয় নাগরিকরা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতো।
১৮৫৯ সালে আ রয়্যাল কমিশন টু এনকোয়্যার দ্য সেনিটারি স্টেট অব দ্য আর্মি ইন ইন্ডিয়া শীর্ষক কমিশন গঠিত হয়। তবে এই কমিশন স্থানীয় ভারতীয় জনগণের স্বাস্থ্য ও রোগ সম্পর্কেও অনুসন্ধান করেছিল।২৮ কলেরা, গুটিবসন্ত ও প্লেগের মতো মহামারীর সময়ে রাষ্ট্রের বাধ্য হয়ে হস্তক্ষেপ করা ছাড়া ঔপনিবেশিক স্বাস্থ্য নীতিমালায় ভারতীয় জনগণের স্বাস্থ্য বিষয়ে কিছু থাকতো না। বলহীনতার ধারণা দ্বারা তাড়িত ভদ্রলোক ও মেডিকেল কলেজ দ্বারা সূচিত নতুন ধরনের জ্ঞানকে ধন্যবাদ দিতে হয়, কারণ ১৮৬০ এর দশক থেকেই বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি শারীরবৃত্তিক কার্যক্রম পরীক্ষা ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করার পন্থা খুঁজে পেতে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা শুরু করেছিল। ১৮৮০ এর দশকে এই সচেতনতাকে পুনরায় সামনে নিয়ে আসে চিকিৎসা সম্মিলনী, তারা বাঙালিদের এমন এক অবস্থানের দিকে নির্দেশ করে যেখানে “ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও গলগণ্ডের মতো রোগ প্রসারমান, জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে রক্ত ও অস্থিমজ্জাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে শারীরিক শক্তি ও পুরুষত্ব বাধাগ্রস্ত হয়”।২৯
১৮৬০ এর দশকে বাংলায় চিকিৎসা বিষয়ক প্রকাশনা বৃদ্ধির ফলে এসব প্রিন্ট মাধ্যমে ভদ্রলোকদের ভেতর বিদ্যমান স্বাস্থ্যবিষয়ক চর্চাসমূহের পুনর্গঠন স্পষ্ট হয়ে উঠে, যা হচ্ছিলো ধীরে ধীরে। এই পুনর্গঠনগুলো পশ্চিমা চিকিৎসা ডিসকোর্সের সাথে স¤পর্ককে বর্জন করে এবং নিজেকে স্থানীয় আয়ুর্বেদের রূপান্তরিত ও সরলায়িত ধরন হিসেবে তুলে ধরে। এই সময়কালে প্রকাশিত বিপুল পরিমাণ চিকিৎসা বিষয়ক রচনার ভেতর এই লেখাগুলো ছিল একটি ভিন্ন ধরনের জনরার অন্তর্ভুক্ত।৩০ এক্ষেত্রে ১৮৬২ সালে প্রকাশিত শারীরিক স্বাস্থ্য বিধান নামক প্রথমদিকের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা সম্পর্কে বলা যেতে পারে। এর লেখকের মতে এই নির্দেশিকাটি বাংলা ভাষায় চিকিৎসা বিষয়ক সাহিত্যের অভাব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল যার মাধ্যমে সংস্কৃত ভিত্তিক ‘সমৃদ্ধ’ আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতিতে সাধারণ পাঠকদের প্রবেশগম্যতা তৈরি করা সম্ভব, অন্যথায় যেখানে তারা প্রবেশ করতে পারে না।৩১ তাই সহজ বাংলা ভাষায় লিখিত শারীরিক স্বাস্থ্য বিধান আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ডিসকোর্সের কাঠামোতে অবস্থান করে মানুষের স্বাস্থ্যবিষয়ক নিত্যচর্চাকে নিয়মের ভেতর আনতে নীতিমালা তৈরি করেছিল। ভারসাম্যপূর্ণ ও পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাসগ্রহণ, বিশুদ্ধ পানি পান ও শারীরিক অনুশীলনে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি এটি ঋতুস্রাবের সময় নারীদের জন্য অনুসরণীয় একটি ‘আচরণবিধি’-ও প্রণয়ন করেছিল।৩২ এসব নির্দেশনায় প্রকাশ্যভাবে কোনকিছুই পশ্চিমা না হলেও এর লেখকের নারী ও পুরুষদেরকে তাদের স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ে আলোকিত করার যে লক্ষ্য, তা আসলে শারীরবৃত্তিক বিষয়গুলোতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির গভীর থেকে গভীরতর হওয়ার আগ্রহকেই তুলে ধরে। আগে যেমন বলা হয়েছে, এটি ছিল মেডিকেল কলেজগুলোতে অ্যানাটমি অধ্যয়নের সূচনার মতো প্যারাডাইম শিফটের ফলাফল।
তথ্যসূত্র ও টীকা
১ W.R. Arney, Power and the Profession of Obstetrics, Chicago and London: Chicago University Press, 1982, 27.
২ Gyan Prakash, Another Reason: Science and Imagination of Modern India, Princeton, NJ: Princeton University Press, 1999; Dhruv Raina and S. Irfan Habib, Domesticating Modern Science: A Social History of Science and Culture in Colonial India, Tulika Books, New Delhi, 2004.
৩ Partha Chatterjee, ‘Our Modernity’, in Partha Chatterjee, ed. Empire and Nation: Selected Essays, New York: Columbia University Press, 2010.
৪ Samarpita Mitra, ‘The Literary Public Sphere in Bengal: Aesthetics, Culture and Politics, 1905–1939’, Unpublished PhD dissertation, University of Syracuse, 2009, 6l.
৫ সম্প্রতি সমর্পিতা মিত্র প্রসারমান প্রিন্ট সংস্কৃতি দ্বারা একটি সাহিত্যিক জগতের বিস্তৃতি নিয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন করেছেন যেখানে বাঙালিদের একটি ‘উপজাতীয়’ ও সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে কাজ হয়েছিল। যদিও এই অধ্যয়ন তার অনুসন্ধানের এলাকা থেকে স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিনগুলোকে বাদ দিয়েছে; জাতীয়তাবাদী পর্যায়ে বাঙালিদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও নান্দনিক সংবেদনশীলতার গঠনেই এর প্রাথমিক মনোযোগ ছিল। বিস্তারিত জানতে দেখুন, Samarpita Mitra, ‘The Literary Public Sphere’. আধুনিক বৈজ্ঞানিক ভাবনাসমূহ ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিষয়ক জার্নালগুলোর ভূমিকায় গুরুত্ব দেয়া একমাত্র পণ্ডিত হলেন প্রদীপ কুমার বসু। দেখুন, Pradip Kumar Bose, ed. Health and Society in Bengal: A Selection from Late 19th-Century Bengali Periodicals, New Delhi: Sage, 2006.
৬ আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই বিশাকদর্পন ও অনুবীক্ষণ-এর মতো চিকিৎসাবিষয়ক জার্নালগুলোকে এই অধ্যায়ের পরিধি থেকে বাদ দিয়েছি, কারণ এতে বিদ্যায়তনিক বিষয়ের আধেয় থাকতো এবং চিকিৎসার বিভিন্ন শাখায় পেশাদার জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্য নিয়েই এটি প্রকাশিত হতো। চিকিৎসাবিষয়ক পেশাজীবীদের দ্বারাই এগুলো পঠিত হতো এবং সাধারণ জনগণ খুব কমই এগুলো পড়তো।
৭ আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই বিশাকদর্পন ও অনুবীক্ষণ-এর মতো চিকিৎসাবিষয়ক জার্নালগুলোকে এই অধ্যায়ের পরিধি থেকে বাদ দিয়েছি, কারণ এগুলো বাংলার স্বাস্থ্য সমস্যাসমূহের সামাজিক-সাংস্কৃতিক শাখা-প্রশাখার চেয়ে রোগসমূহ ও এদের থেকে মুক্তি নিয়েই বেশি কাজ করতো।
৮ Geraldine Forbes, ‘Education to Earn: Training Women in the Medical Professions’, in Geraldine Forbes, ed. Women in Colonial India: Essays on Politics, Medicine and Historiography, New Delhi: Chronicle Books, 2005.
৯ প্রসব বেদনাকালীন সময়ে একজন ধাত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ডক্টর জেমস সি¤পসনের বক্তৃতাসমূহ থেকে ধাত্রীবিদ্যা বিষয়ে একটি প্রবন্ধ অনূদিত হয়েছিল। ১৮৪৭ সালে ক্লোরোফর্ম আবিষ্কারের কারণে উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে ডক্টর সিম্পসন খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিস্তারিত জানতে দেখুন, Patricia Branca, Silent Sisterhood: Middleclass Women in the Victorian Home, London: Croom Helm, 1978, 84.
১০ Gauri Viswanathan, Masks of Conquest: Literary Study and British Rule in India, New York: Columbia University Press, 1989, 146; John McGuire, The Making of a Colonial Mind: A Quantitative Study of the Bhadralok in Calcutta, 1857–1885, Canberra: Australian National University, 1983; S.N. Mukherjee, ‘The Bhadraloks of Bengal’, in Dipankar Gupta, ed. Social Stratification, Delhi: Oxford University Press, 1991; B.B. Misra, The Indian Middle Classes: Their Growth in Modern Times, London, New York and Bombay: Oxford University Press, 1961, 10; জে. এইচ. ব্রুমফিল্ডের সংজ্ঞানুযায়ী, ভদ্রলোকরা হলো “সামাজিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত ও সচেতনভাবে উচ্চতর একটি দল, অর্থনৈতিকভাবে ভূমির খাজনা এবং পেশাদার ও করণিক চাকুরির উপর নির্ভরশীল; বর্ণপ্রথা গ্রহণ ও শিক্ষার উপর দখলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্নতা রক্ষাকারী”। J.H. Broomfield, Elite Conflict in a Plural Society: Twentieth Century Bengal, Berkeley and Los Angeles: University of California Press, 1968, 13.
১১ Judith Walsh, ‘The Virtuous Wife and the Well-Ordered Home: The Reconceptualisation of Bengali Women and Their Worlds’, in Rajat Kanta Ray, ed. Mind, Body and Society: Life and Mentality in Colonial Bengal, Calcutta: Oxford University Press, 1995, 333.
১২ Ashish Nandy, The Intimate Enemy: Loss and Recovery of Self Under Colonialism, Delhi: Oxford University Press, 1988.
১৩ Gauri Viswanathan, Masks of Conquest: Literary Study and British Rule in India, New York: Columbia University Press, 1989, 44, 146.
১৪ প্রাগুক্ত
১৫ প্রাগুক্ত
১৬ Sumit Sarkar, Writing Social History, New Delhi: Oxford University Press, 1997.
১৭ Tapan Raychaudhuri, ‘The Pursuit of Reason in 19th-Century Bengal’, in Rajat Kanta Ray, ed. Mind, Body and Society: Life and Mentality in Colonial Bengal, Calcutta: Oxford University Press, 1995, 48–52.
১৮ Prakash, Another Reason, 52.
১৯ Deepak Kumar, ‘Calcutta: The Emergence of a Science City (1784–1856)’, Indian Journal of History of Science, Vol.29, No.1, 1994, 1–7. আরও দেখুন, Srabani Sen, ‘The Asiatic Society and the Sciences in India, 1784–1947’, in Uma Dasgupta, ed. Science and Modern India: An Institutional History, c.1784–1947, New Delhi: Centre for Studies in Civilisations, 2011.
২০ Prakash, Another Reason, 52.
২১ Tanika Sarkar, ‘Hindu Wife, Hindu Nation: Domesticity and Nationalism in Nineteenth-Century Bengal’, in Tanika Sarkar, ed. Hindu Wife, Hindu Nation: Community, Religion, and Cultural Nationalism, New Delhi: Permanent Black, 2001, 31–37.
২২ Mrinalini Sinha, Colonial Masculinity: The ‘Manly Englishman’ and the ‘Effeminate Bengali’ in the Late 19th Century, Manchester and New York: Manchester University Press, 1995.
২৩ John Rosselli, ‘The Self-Image of Effeteness: Physical Education and Nationalism in 19th Century Bengal’, Past and Present, Vol. 86, 1980, 121–148.
২৪ ‘The Revival of National Physical Health’, Cikitsa Sammilani, April–May, 1885 quoted in Pradip Bose, Health and Society, 105.
২৫ প্রাগুক্ত, ১০৮
২৬ Mel Gorman, ‘Introduction of Western Science into Colonial India: Role of the CMC’, Proceedings of the American Philosophical Society, Vol.128, No.2, 1988, 276–298.
২৭ Christian Hochmuth, ‘Patterns of Medical Culture in Colonial Bengal, 1835–1880’, Bulletin of the History of Medicine, Vol.80, No.1, 2006, 39–72.
২৮ David Arnold, ‘Medical Priorities and Practice in 19th British India’, South Asia Research, Vol.5, No.2, 1985, 167–183; Prakash, Another Reason.
২৯ ‘The Revival of National Physical Health’, 105.
৩০ Projit Bihari Mukharji, Nationalising the Body: Medical Market, Print and Daktari Medicine, London: Anthem Press, 2011.
৩১ Gourinath Sengupta, Sharirik Svasthya Bidhan (A Treatise on Physical Health), Calcutta: 1862, Introduction.
৩২ Sengupta, Sharirik Svasthya Bidhan.
চলবে