বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।
২২
মা জিজ্ঞাসা করলো, চাকরির যে পরীক্ষা দিলাম, ওটার রেজাল্ট কবে দেবে? বললাম, জানি না তো, কবে দেয় এখন! হিয়াকে ফিজিক্স পড়াচ্ছে রিয়া। যতটা না পড়ায় এরচেয়ে ধমকাধমকিই বেশি করে। দরজার সামনে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম। হিয়ার মুখে আরও কয়েকটা ব্রণ ওঠেছে। বলেছিলাম, হাত দিয়ে খুটবে না। কথা শুনে না। বলে চুলকায়।
‘দাদি, কী অবস্থা তোমার!’
‘আমার আর কী অবস্থা থাকবো’, দাদি উত্তর দেয়। ‘আজকের রান্নাবান্না কী মা?’ চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম। ‘যা গুসুল টুসুল কর। খাবার বইলেই দেকবি, কী রানছে। এত হুইন্যা কী করবি?’, দাদিই উত্তর দিল। মা হয়তো রান্নাঘরে। আমার ঘর থেকে রান্নাঘরে কথা ঠিকমত শোনা যায় না। দাদিকে কিছু একটা কিনে দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কী যে দিবো ভেবে পাই না। সবাইকেই আমার কিছু না কিছু দিতে ইচ্ছা করে। পরে আর দেওয়া হয় না। মনে হলো, ইমরানকেও একটা পাঞ্জাবি কিনে দেবো। তাকে দিবো নীল পাঞ্জাবি। না ইমরানকে হলুদ কিনে দেবো। বিভাসকে কিনে দেবো নীল। বিভাস কালো। তাকেই নীল রঙের কিনে দেবো। পারলে ময়ূরকণ্ঠী নীল। তাকে কৃষ্ণের মত দেখাবে। বিভাস বলে রাধা-কৃষ্ণের ঘটনা সাধারণ কাহিনি নয়। এর মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে গভীর রূপ। রাধা এখানে নারী আর কৃষ্ণ এখানে পুরুষ মাত্র নয়। রাধা একটা পজিশন। যে প্রেমে পড়ে সে-ই রাধা। হোক সে পুরুষ অথবা নারী। কৃষ্ণ এখানে জগতের নাথ। পরমাত্মার প্রতীক সে। রাধা হল জীবের প্রতিভূ। রাধারূপে কৃষ্ণের সাধনাই প্রেমের সাধনা।
বাবা খাচ্ছে। সঙ্গে রিয়া-হিয়া। সজিনার সঙ্গে ছোটো ছোটো গোল আলু দিয়ে চিংড়ির তরকারি। এই সময়ে সজিনা পেলো কোথায়! সিজনের সময় মা সিদ্ধ করে ডিপে রেখে দেয়। স্বাদ অবশ্য আগের মত পাওয়া না। এর আগে খেয়েছি একদিন। নোনা ইলিশ দিয়ে রান্না করেছিল। খেতে যেমনই হোক তরকারিতে চিংড়িগুলোকে বেশ মানিয়েছে। বললাম, আমি একটু পরে খাবো। দাওয়াত ছিলো একটা।
আমার পেট ভরা। তবু বসলাম। চুলগুলো শুকাক। দাদি বলে, ‘হুদাই বইয়া থাহিস না। খায়া হালা। খাইলেই খাবার পাবি।’ সবার খাওয়া শেষ। বললাম, ‘তাইলে দেও। খায়া ফেলি।’
রাতে মা রুমে আসলো। বলল, ভালো একটা জায়গা থেকে সম্বন্ধ এসেছে। বাবা নাকি বলেছে, আমার সঙ্গে কথা বলতে। আমি হ্যাঁ বললে, বাসায় আসতে বলবে। ছেলে সরকারি চাকরিজীবী। খাঁটি বাংলায় আমি ‘না’ বলে দিলাম। বললাম, ‘আমি একজনকে পছন্দ করি। তোমরা চাইলে বাসায় তারা প্রস্তাব পাঠাবে।’ মা খুশি কি দুঃখিত হলো বুঝলাম না। জীবন জটিল না। জীবন সহজ। ভালো থাকতেই হবে কেন? সুখে থাকতেই হবে কেন? যা হবার হবে। গোছানো সিকিউরড জীবনের কথাই তো ভেবেছিলাম। গোছানো তো হয়নি। ভাবতাম, শোভন কোথাও জয়েন করলেই বিয়ে। শোভনের ফ্যামিলি, ফ্যামিলির স্ট্যাটাস কোনোকিছুতেই তো সমস্যা ছিলো না। তাই সবটাতেই সমস্যা ছিলো। বিভাস বলে, মানুষ যখন জীবন নিয়ে পরিকল্পনা করে ভগবান নাকি তখন হাসেন। বলে, মানুষের যে-কোনো পরিকল্পনাই ঈশ্বরের পরিকল্পনার পরিপন্থী।
গোসল করার সময় আজ একটা অদ্ভুত ফিলিংস হলো। শরীরটাকে মনে হলো সামান্য মাংসপি-। এ-নিয়ে এতোকিছু কেন! আয়নায় নিজেকে দেখলাম। নগ্ন। নগ্ন মনে হলো না। নগ্নতা মানে পোশাকহীনতা নয়। নগ্নতা একটা দৃষ্টি। প্রকৃতির সবকিছুই নগ্ন। তাদের তো নগ্ন মনে হয় না। খুবই স্বাভাবিক লাগলো নিজেকে। চুল-কপাল-চোখ-ঠোঁট-মুখ-গলা আদ্যোপান্ত আমি দেখলাম। নিজেকে দেখলাম। এভাবেই জন্মেছিলাম আমি। এখানে কোনো সৌন্দর্য বা অসৌন্দর্য নেই। এটাই ঐশ্বরিক সৌন্দর্য। ঐশ্বরিক সৌন্দর্য মূলত সৌন্দর্যহীনতা।
: বিভাস? তোমার কথাই ভাবছিলাম। এখন দেখি তুমিই ফোন করলে। জানো? ইদানিং খুব সুন্দর সুন্দর চিন্তা আসে মাথায়।
: তাই? ভালো তো! চিন্তাকে আহ্বান করতে জানতে হয়। চাইলেই সে সাক্ষাৎ করতে আসে না। উপযুক্ত হৃদয় তৈরি করা চাই। একটি কলস বুকে যতটুকু শূন্যতা ধরে ঠিক ততটুকুই তার ধারণ ক্ষমতা। যে জানতে চায় সে জানতে পারে।
: তোমার কথা আর ইমরানের কথা ইদানিং আমার কাছে একই রকম লাগে।
: একই তো হবে। সবই এক। সবই সেই একই প্রবাহের ভিন্ন স্রোতধারা। সামঞ্জস্য আর বৈপরীত্য বা দুইয়ের কোনোটাই নয়। একের সঙ্গে অপরের যোগ তো থাকবেই। এই সম্পর্কের নাম তুমি যা-ই দাও না কেন!
যে প্রেমে পড়ে সে-ই রাধা। হোক সে পুরুষ অথবা নারী।
হাসল সে। জিজ্ঞাসা করলো, আমি জানি কিনা, মাজহার ভাইয়ের মা যে অসুস্থ! হাসপাতালে ভর্তি আছে। ‘তাহলে তো অবস্থা বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে’, আমি বললাম। বললো, এত সিরিয়াস না। বললো তো, এখন ভালোর দিকে। আগে থেকেই নাকি প্রেসার ছিলো। ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক হয়েছে। টের পায়নি।
: আমি যখন ফোর্থ ইয়ারে মা’র তখন ক্যান্সার ধরা পড়ে। ক্যান্সারকে আমার অন্যান্য রোগের মতই মনে হয়েছিলো। ক্যান্সার যে মারাত্মক রোগ তখনও এটা আমার কাছে ছিলো শোনা ঘটনা। মনে করলাম, যুবরাজ সিং, সাবিনা ইয়াসমিন এদেরও তো ক্যান্সার হয়েছিলো। তো কী হয়েছে? মা’রটাও ভালো হয়ে যাবে। তারপর কত অভিজ্ঞতাই যে হলো। সাদিক ভাই-ই সামলেছে সব। আমি তার সঙ্গে ছিলাম মাত্র। শুধু দেখে গেছি। এখন মনে হয়, দেখে যাওয়াটাই ছিলো আমার কাজ। ডাক্তারদের দেখলাম। নার্সদের দেখলাম। আত্মীয় স্বজনদের দেখলাম। নিজেকে দেখলাম। জন্মকে দেখলাম। মৃত্যুকে দেখলাম। জগতের সমস্ত কিছু দেখলাম, দিয়া। বিশ্বরূপ দর্শন করলাম আমি। এতদিন চর্ম-চক্ষুতে যা আমি দেখিনি। যা দেখতে জ্ঞান-চক্ষু লাগে। ভগবান আমাকে সেই জ্ঞান-চক্ষু দিলেন। আমার গর্ভধারিনী মাকে আমি ক্ষয়ে যেতে দেখলাম। সেদিন জিজ্ঞাসা করলে না! আমি সবসময় এমন ছিলাম কিনা! না, ছিলাম না। মাকে আমি আট-দশটা ছেলের মতই হেলাফেলা করতাম। ঠিক হেলাফেলা নয়। ভালো তো বাসতামই। ভাবতাম আছেই তো। নিজেই টের পেতাম না, সেই ভালোবাসা। মা মারা যাওয়ার পরেই কেবল মাকে আমি আপন করে পেলাম। মা আমার নিজের মা হয়ে ওঠলো। তাকে নিয়ে জীবন যাপন শুরু করলাম আমি। মা আমার কাছে হয়ে ওঠলো ব্রহ্মা-ের দরজা। মা’র মধ্যে প্রবেশ করে আমি নিজেকে পেলাম। নিজের মধ্যে প্রবেশ করে আমি আর কূল পেলাম না, দিয়া। এ-কোনো সাধারণ জায়গা নয়। গভীর থেকে গভীরতম জায়গা। তার থেকেও গভীরতম জায়গা। সমস্ত বিশেষণের ঊর্ধ্বে তার বিশেষণ। আমি হারিয়ে গেলাম।
: এসব কথা শুনতে তোমার কেমন লাগে আমি বুঝতে পারি না। খারাপ লাগছে না তো?
: আরেকবার এই কথা জিজ্ঞেস করলে কিন্তু আমি ফোন রেখে দেবো?
: নিজের তল পেলে নাকি ভগবানের তল পাওয়া যায়। আমি নিজেকে চিনতে শুরু করলাম। নতুন করে পড়তে শুরু করলাম জীবনটাকে। আমার নতুন জন্ম হলো। সবকিছুকে আবার চিনতে শুরু করলাম নতুনভাবে। প্রতিটি সত্তার সঙ্গে আবারও নতুন করে পরিচিত হলাম আমি। আমি পেলাম আমার মাকে। আমি আমার মায়েরই অংশ। আমার মধ্যেই রয়ে গেছে আমার মা। প্রেমিকাকে পেলাম। গলিত স্বর্ণকে সংহত করতে চাইলাম আমি। তার সমস্ত কিছুকে স্বর্ণে রূপ দিতে পরশ পাথর হতে চাইলাম আমি। আমি বদলে যেতে শুরু করলাম, দিয়া। দারুণ এই পথ। যারা এই পথের পথিক, গরল ভক্ষণ করে তারা অমৃতের স্বাদ নেয়। আমি সামান্য শিক্ষানবিশ মাত্র।
: এটা তোমার বিনয়।
: এই কথা বলো না। এটা আমার বিনয় তো নয়ই। বলতে পারো ঔদ্ধত্য।
: তোমার মা’র কথা বল। আরও বল। শুনতে খুব ভালো লাগে। আমার এক ফুপু ছিল। মারা গেছেন। তোমার মা’র কথা বললে আমার সেই ফুপুর কথা মনে হয়।
: মা তখন হাসপাতালে ভর্তি। পুরনো দিনের কথা তুলতো মা। আমার জন্মের সময়ের কথা। একবছরের সময় কেমন ছিলাম। দুই বছরের সময় কেমন ছিলাম। আব্বুর কোন স্বভাবগুলো আমি পেয়েছি। এসবই থাকতো তার আলাপের বিষয়। রোমানাকে একদিন মার সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। মা তাকে জিজ্ঞাসা করলো, তার বাবা কেমন আছে, মা কেমন আছে।
: রোমানার সঙ্গে তোমার দেখা হয়?
: না। ও নেদারল্যান্ডে থাকে। পরে তার এক ক্লাসমেটকে বিয়ে করে দুজনেই নেদারল্যান্ড চলে যায়। পড়তে। ও ভালো আছে। আমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে তার।
: অদ্ভুত তো! পুরাই দেখি সিনেমার মত।
বিভাস হাসলো। বললো, ‘সিনেমা কোনো ঘটনা নয়, দিয়া। সিনেমা হলো দেখার একটা ভঙ্গি। সিনেমা দেখার চোখ দিয়ে সমস্ত জগৎ তুমি দেখতে পারবে।’ সে যোগ করলো, ‘তোমার নিজের জীবনটাই কি একটা সিনেমা নয়?’ হ্যাঁ, তাই তো? এরচেয়ে সিনেম্যাটিক আর কী হতে পারে?
: কিছুই একরকম থাকে না, দিয়া। আবার বদলায়ও না। এ-এক সূক্ষ্ম বোধ। জীবন এবং জগৎ এই সূক্ষ্ম বোধেরই এক লীলাক্ষেত্র। আমার সঙ্গে পরিচয়ের আগে এবং পরের তুমি কি এক? এক না। আবার দেখো পৃথকও না।
: হ্যাঁ তাই! সবকিছু এমন অদ্ভুত কেন বিভাস?
: সবকিছু অদ্ভুত নয়। অদ্ভুত তোমার দৃষ্টি।
প্রসঙ্গ বদল করলাম আমি। বললাম, ‘মা রাতে রুমে এসেছিল।’ মা কী কী বললো, আর জবাবে আমি কী বলেছি, সবই বললাম তাকে। জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা কি প্রস্তাব পাঠাবে? সে হাসলো। পাল্টা জিজ্ঞাসা করলো, আমি কেন তাকে বিয়ে করতে চাই? বললাম, প্রশ্নের উত্তর তো প্রশ্ন দিয়ে হয় না, বিভাস।
: কে বললো, হয় না?
: এই যে আমি বললাম। আমার কথার দাম নেই?
বললো, ‘অবশ্যই আছে।’ বললাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই আমি তোমাকে এবং তোমাকেই বিয়ে করতে চাই।’ চুপ করে গেলো সে। ‘কথা বলছো না কেন?’, আমি জিজ্ঞাসা করলাম। বলল, ‘আমি যা ভাবছি তা জেনে তোমার হয়তো ভালো লাগবে না।’ বললাম, ‘ভালো না-লাগুক। বলো। আমি শুনতে চাই।’
: আসলে আমার মধ্যে তুমি এক বিশেষকে খুঁজছো? আমাকে তুমি মনে করছো বিশেষ। বিশেষ বলে কিছু নেই, দিয়া। বিশেষের সঙ্গে জীবনযাপন করা যায় না। বিশেষ একটা কারাগার। বিশেষকে তুমি কোথাও খুঁজে পাবে না। বিশেষ একটা বিভ্রম। যে ফিলিংসটাকে তুমি আমার প্রতি ভালোবাসা মনে করছো, তা আসলে তোমার প্রতিই তোমার ভালোবাসা। আমাকে তুমি চেন না। আমাকে তুমি বুঝতেছ তোমার মত করে। হ্যাঁ, তাই। আমার কথার তুমি অর্থ করতেছ তোমার নিজস্ব অর্থ দিয়ে। তাই আমার সৌন্দর্য মূলত তোমারই সৌন্দর্য। তুমি আমাকে সুন্দররূপে দেখছো। আমি তাই সুন্দর। এই দেখা কুৎসিতরূপেও দেখতে পারতে। তখন ভিন্ন হয়ে যেতো সকল কিছু।
শরীরটা ভালো লাগছে না। গা টা মনে হচ্ছে গরম। জ্বর আসবে নাকি। ফোন রেখে দিলাম। বিভাস হয়তো ভাবলো, আমি মন খারাপ করেছি। কিন্তু না, মন খারাপ হয়নি আমার। তার কথাগুলোকে নাকচ করা সহজ নয়। তবে মনটা ঠিকই ফাঁকা হয়ে গেলো। কী অদ্ভুত সবকিছু। ঘরের লাইট বন্ধ। রিয়া হয়তো জেগে আছে। হঠাৎ হঠাৎ টিভির ফিসফাস কানে আসছিলো। হালকা আলো আসছে বাইরে থেকে। ফ্যানের ছায়া পড়ে একটা হেলিকপ্টারের শেইপ নিয়েছে। একদম হেলিকপ্টারের মত। এখনকার সময়টাই খারাপ। ফ্যান চালু রাখলে শীত লাগে। আবার বন্ধ থাকলে গরম লাগে হালকা। এখন কী শরৎ না হেমন্ত? কী জানি! দুর্গাপূজা তো চলে গেছে। দুর্গাপূজা হয় শরতে। জেসমিন দি’ নাড়ু-তক্তি এনেছিলো। আমি বলাতেই এনেছিলো। নারকেলের তক্তি আমার খুব প্রিয়। তাহলে হেমন্ত চলছে। ইংরেজি কী মাস এটা? অক্টোবর। অক্টোবরের তেরো তারিখ। সারাবছর আমি কাঁথা গায়ে দেই। কিছু একটা গায়ে না দিলে ঘুম আসে না। নেংটা নেংটা লাগে। কিছুদিন আগে পাতলা কম্বলটা বের করেছি। ফ্যান চালিয়ে রেখে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাই। ভোরে তবু শীত লাগে। ফ্যান বন্ধ করে দিতে হয়। একসময় রুমের ছিটকিনি লাগাতাম না। এখন লাগিয়ে দেই। বিভাসের সঙ্গে রাতে কথা বলার সময় থেকেই লাগিয়ে দেই। অবশ্য কেউ আসেও না। আর আসলে নক করার অপশন তো আছেই।
কোনো একটা ছাদে উঠার চেষ্টা করছি। কে জানি আমাকে হেল্প করছে। তাকে চিনতে পারছি না। কিন্তু সে আবার আমার পরিচিতও। ছাদে রেলিং নেই। এতো পিচ্ছিল। সবুজ সবুজ শ্যাওলা জমে আছে। পা পিছলে যাচ্ছে আমার। ছাদটা নড়তে শুরু করেছে। আমার শরীরের ভার নিতে পারছে না। আমি পড়ে যাচ্ছি। পড়ে যাচ্ছি আমি। আমার সমস্ত শরীরে এক মারাত্মক শিহরণ বয়ে গেলো।
ঘুম ভেঙে গেলো আমার। কেমন অস্বস্তি লাগছে। মনে হলো বাথরুম হবে। হলো না। ভালো লাগছে না। গা গরম নয়। কিন্তু জ্বরের ভাবটা আছে। ব্রাশ করিনি রাতে। বিশ্রী লাগছে। ভাবলাম, ব্রাশটা করে ফেলি। যেই না জিভ পরিষ্কার করতে গেলাম বমি শুরু হলো। এমন বমি শুরু হলো। একদম বেসিন ভাসিয়ে ফেলা যাকে বলে। বমির পর বমি করতে লাগলাম আমি। সামলাতে পারছি না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে পানিতে। বাথরুমের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম। কথা বলতে পারছি না। মুখ দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। এতো দুর্বল লাগছে নিজেকে। মনে হচ্ছে বেরোতে পারবো না আমি। চোখ বন্ধ করে কতক্ষণ বসে ছিলাম কে জানে। মনে হচ্ছিলো আমাকে কেউ বিছানা পর্যন্ত নিয়ে যাক।
বমির গন্ধ আসছিল নাকে। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে দেয়াল ধরে ধরে ওঠে দাঁড়ালাম। নিজেকে কেমন অসহায় লাগছে। মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। আমি একা। আমি শুধুই আমার। একদিন মরে যাবো। মরার কথা মনে হলো আমার। একদিন সত্যিই মরে যাবো। সত্যিই। আমি কাঁদতে শুরু করলাম।
চারটা বাজে। চারটা পঁচিশ। দরজাটা খুলে দিলাম আমি। ফ্যান ছেড়ে দিলাম হালকা করে। আলজিহ্বাটা নিচের তালুতে এসে ঠেকেছে। নরম হয়ে আছে একদম। পানি খেতেও ভয় লাগছে আমার। কোনোরকমে পানি খেয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসলো না, শুয়েই ছিলাম। কেমন একটা আচ্ছন্নতা নিয়ে শুয়ে ছিলাম। কষ্ট ভোগ করার ভেতরেও কোথাও যেন লুকানো একটা আরাম আছে। প্রচণ্ড জ্বর এলো আমার। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো। এই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। ঘাম দিয়ে আবার নেমে যায়। শরীর ঘেমে অস্থির। সারা বাড়িতে ছুটাছুটি পড়ে গেলো। অস্থির হয়ে উঠলো মা। কী কী সব ঘটতে শুরু করলো। আমি দেখলাম। বুঝলাম না। দেখলাম না। বুঝলাম।
পড়ুন ।। কিস্তি : ১৯