গীতা দাস একজন সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মী। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকায় তার কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ছোটগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখবেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে। আজ প্রকাশিত হলো কিস্তি ৫।
চাকমা নৃগোষ্ঠীর রচিত বাংলা উপন্যাস–১
কথাসাহিত্যিকদের আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহের বিষয় উপন্যাস লেখা, যেখানে নিজের সব অভিজ্ঞতা, চিন্তা, চেতনা, ভাবনা উজাড় করে দিতে চান। উপন্যাসিক নিজের সফলতা, অর্জন, ব্যর্থতা, তৃপ্তির, অতৃপ্তির কথকতার যত কথা আছে সব উপন্যাসে ঠাঁই দিতে চান। কথাসাহিত্যিক উপন্যাসে মানুষের জীবনের, সময়ের, সমাজের ও পরিবেশের মহাকাব্যিক দিকের চিত্রায়ণ করেন। বিভিন্ন সময়ে লিখিত অনেক উপন্যাসেই একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের কোন সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী সম্বন্ধে একটা সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায় এবং ঐ জনগোষ্ঠীর অতীত ও বর্তমান অবস্থা ও অবস্থানের পাশাপাশি ভবিষ্যতের রূপকল্পও অনুমান করা যায়। চাকমা নৃগোষ্ঠীর কথাসাহিত্যিকদের রচিত উপন্যাসেও এসব উপাত্তের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাদের রচিত তিন ধরনের উপন্যাস পাওয়া গেছে। প্রথমত, চাকমা ভাষায় ও চাকমা বর্ণমালায় লিখিত উপন্যাস; দ্বিতীয়ত, চাকমা ভাষায় কিন্তু বাংলা বর্ণমালায় লিখিত উপন্যাস; তৃতীয়ত, বাংলা ভাষায় ও বাংলা বর্ণমালায় লিখিত উপন্যাস। এ অনুসন্ধানে সব ধরনের উপন্যাসের নাম সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী শুধু দ্বিতীয় ভাষা বাংলায় সংখ্যালঘুর বিষয়কে কেন্দ্র করে লিখিত উপন্যাসের পর্যালোচনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। চাকমা জনগোষ্ঠী রচিত উপন্যাসের তথ্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো। (তালিকা সংগৃহীত)।
চাকমা ভাষায় ও চাকমা বর্ণমালায় লিখিত উপন্যাস
১। উপন্যাসের নাম: ফেবো, ঔপন্যাসিক: দেবপ্রিয় চাকমা, প্রকাশকাল: ২০০৪ প্রকাশনী: ফগদাঙ।
২। উপন্যাসের নাম: মেঘুলো দেবার আহঝি, ঔপন্যাসিক: সরোজ কান্তি চাকমা, প্রকাশকাল: ২০১৮, প্রকাশনী: কধা ফগদাঙি।
৩। উপন্যাসের নাম: আঝা পুরেবং, ঔপন্যাসিক: কে ভি দেবাশীষ চাকমা, প্রকাশকাল: ২০১৮, প্রকাশনী: কধা ফগদা।
৪। উপন্যাসের নাম: মোনবি, ঔপন্যাসিক: আর্য্য মিত্র চাকমা, প্রকাশকাল: ২০২০, প্রকাশনী: ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, খাগড়াছড়ি।
চাকমা ভাষায় কিন্তু বাংলা বর্ণমালায় লিখিত উপন্যাস
১। উপন্যাসের নাম: বেল্যা মাধান, উপন্যাসিক: কে ভি দেবাশীষ চাকমা, প্রকাশকাল: ২০০৭, প্রকাশনী: (ব্যক্তিগতভাবে ছাপিয়েছেন।)
অনুসন্ধানে উল্লিখিত চাকমা ভাষায় ও চাকমা বর্ণমালায় চারটি এবং চাকমা ভাষায় কিন্তু বাংলা বর্ণমালায় একটি উপন্যাসের নাম পাওয়া গেলেও বইগুলোর অস্তিত্ব পাণ্ডুলিপির মতো সংরক্ষিত। অনুসন্ধানের পরিসরে বইগুলোর পাঠক চিহ্নিত করা যায়নি। বইগুলো সম্পর্কে পাঠকের পাঠপ্রতিক্রিয়াসহ সাহিত্যমান জানতে অধিক অনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে।
বাংল ভাষায় ও বাংলা বর্ণমালায় চাকমা জনগোষ্ঠী কর্তৃক লিখিত উপন্যাস
১। উপন্যাসের নাম: কোচপানা দুগ (ভালোবাসার দুঃখ), ঔপন্যাসিক: কে ভি দেবাশীষ চাকমা, প্রকাশকাল: ২০০২, প্রকাশনী: রশীদ পাবলিকেশন।
২। উপন্যাসের নাম: অধিকার, ঔপন্যাসিক: কে ভি দেবাশীষ চাকমা, প্রকাশকাল: ২০০৭, প্রকাশনী: পরানী।
৩। উপন্যাসের নাম: মুই মত্যেই বা আমি আমার, ঔপন্যাসিক: কে ভি দেবাশীষ চাকমা, প্রকাশকাল: ২০১৩, প্রকাশনী: পার্ল পাবলিকেশন্স। (এখানে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, কে ভি দেবাশীষ চাকমা বাংলা ভাষায় লিখিত তাঁর তিনটি উপন্যাস নিজেই সরবরাহ করে অনুসন্ধানে সহাযোগিতা করেছেন।)
মুই মত্যেই বা আমি আমার বইটিতে আরও চারটি উপন্যাসের নাম লিখেছেন। উপন্যাসসমূহ হলো: এত ফোঁটা চোখের পানি, ব্যর্থ জীবনের কষ্টের কাহিনী, সুখে থেকো, তুই এবে। বিভিন্ন প্রকাশনার নাম উল্লেখ করলেও উপন্যাসগুলো ব্যক্তিগতভাবে ছাপিয়েছেন বলে উপন্যাসিক জানিয়েছেন। তবে কোন কপি এখন প্রচার করছেন না। ভবিষ্যতে কিছু সংশোধন করে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের পর প্রচার করার পরিকল্পনা আছে বলে জানা যায়।
৪। উপন্যাসের নাম: গ্রহণ লাগা ভোর, উপন্যাসিক: বিপম চাকমা, প্রকাশকাল: ২০১৮, প্রকাশনী: বেহুলা বাংলা, ঢাকা। এ উপন্যাসই চাকমা জনগোষ্ঠীর দ্বিতীয় ভাষা বাংলায় লিখিত প্রথম সার্থক উপন্যাস।
কে ভি দেবাশীষ চাকমা রচিত বাংলা ভাষায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় উপন্যাস যথাক্রমে কোচপানা দুগ (ভালোবাসার দুঃখ) (২০০২), অধিকার (২০০৭)এবং মুই মত্যেই বা আমি আমার (২০১৩)। চাকমাভাষী নৃগোষ্ঠীর রচিত দ্বিতীয় ভাষায় উপন্যাস রচনায় তাঁর বইগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। সমালোচনার বিচার-বিশ্লেষণে এর আঙ্গিক, শিল্পরূপ ও চরিত্র সৃষ্টি বিবেচনায় সার্থক উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি ব্যাহত হবে। অন্যদিকে, এসব উপন্যাসের নাম উল্লেখ না করলে চাকমাভাষী হিসেবে বাংলাভাষায় কে ভি দেবাশীষ চাকমার উপন্যাস লেখার উদ্যোগকে অমর্যাদা করা হবে। একজন অনুসন্ধাকারী হিসেবে কে ভি দেবাশীষ চাকমার উপন্যাস তিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব যেমন অস্বীকার করা সমীচীন নয়, তেমনি বইটির শিল্পগুণ নিয়ে নিশ্চুপ থাকাও গ্রহণযোগ্য নয়। প্রসঙ্গত, কে ভি দেবাশীষ চাকমার নিজের নামের বানান দুই রকম পরিলক্ষিত হয়। কে ভি দেবাশীষ চাকমা এবং কে.ভি. দেবাশীষ চাকমা। এ নিয়ে কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম প্রচ্ছদে চাকমা ভাষায় বাংলা হরফে কোচপানা দুগ এবং বন্ধনীতে লেখা ভালোবাসার দুঃখ। দ্বিতীয় বইটির নাম সরাসরি বাংলায় অধিকার লেখা। তৃতীয়টির নাম মুই মত্যেই বা আমি আমার । আমি আমার শব্দদ্বয়ে কোচপানা দুগ বইয়ের মতো বন্ধনী ব্যবহার করা হয়নি। কোচপানা দুগ (ভালোবাসার দুঃখ), অধিকার বইয়ের সংলাপ প্রায়শঃই চাকমা ও বাংলা দুটি ভাষায় লেখা হয়েছে। মুই মত্যেই বা আমার আমি বইটিতে প্রত্যেকটি সংলাপ চাকমা ও বাংলা উভয় ভাষাতে লেখা হয়েছে। বইয়ের নাম দুইভাষায় লেখা এবং বন্ধনী ব্যবহার করা ও না করা, সংলাপ লেখায় দুটি ভাষার ব্যবহার — এসব বিষয় বিবেচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, উদ্দিষ্ট পাঠক বাংলা না চাকমাভাষী হবে তা নিয়ে লেখক দোদুল্যমান ছিলেন। বইয়ের নাম ও সংলাপ কোন ভাষায় দিলে পাঠকপ্রিয়তা পাওয়া যাবে তা নিয়েও দ্বিধান্বিত ছিলেন। কে ভি দেবাশীষ চাকমার রচনায় আত্মবিশ্বাসের অভাব, সিদ্ধান্তহীনতা, দ্বিতীয় ভাষায় দক্ষতার সীমাবদ্ধতা, এমনকি নিজের সৃজনশীলতার প্রতি আস্থাহীনতা এবং পাঠকের উপর নির্ভরশীলতার অভাব ইত্যাদির ইঙ্গিতও রয়েছে।
কোচপানা দুগ এর কাহিনি জুম্ম জাতিকে মুক্তির শপথ নেয়া হিউয়েন নামক এক যুবকের প্রেমের কাহিনি। প্রেমিকা মনিকার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বিরহে প্রেমিকের মৃত্যুবরণে উপন্যাসের সমাপ্তি। আর অধিকার উপন্যাসও শান্তিবাহিনীর এক কমান্ডার মিন্টু চাকমার প্রেম কাহিনী। প্রেমিক ও প্রেমিকা পরস্পরের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু মিন্টুর তার প্রেমিকা জুনানের এলাকা থেকে বদলি হয়ে যাওয়ার ঘটনা দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি।
মুই মত্যেই বা আমি আমার একটি প্রেমের উপন্যাস। নায়িকার পক্ষ থেকে ভালবাসার একচেটিয়া অনুভুতির প্রকাশ। এটি সংখ্যালঘুর বিষয়কে কেন্দ্র করে লিখিত নয়। কোচপানা দুগ বইটিতে কোচপানা (ভালবাসা), কোপচাই (ভালবাসি) কোচপেয়েছো (ভাল্লোবাস?), কোচপেতে ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ প্রায় অর্ধ শতাধিক বার। অধিকার উপন্যাসেও অধিকার শব্দটির বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। মনে হয় যেন বই দুটির নামকরণের সার্থকতার জন্য সচেতনভাবে কোচপানা ও অধিকার শব্দ প্রয়োগের আধিক্য, যা পঠনকটূ লেগেছে।
কে ভি দেবাশীষ চাকমা কোচপানা দুগ এবং অধিকার গ্রন্থ দুটিতে লেখা সংখ্যালঘু জীবনের অসহায়ত্ব, স্বাধীন হবার জন্য যুদ্ধ, বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারমূলক কথাবার্তা দিয়ে যুক্তিহীনভাবে কিছু ঘটনা বলে গেছেন। তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতি জ্ঞান, পারিপার্শ্বিক সামাজিক ও রাজনৈতিক সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতাকে সম্পদ হিসেবে সাহিত্যে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হননি। নকশাল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতীয় বাংলা সাহিত্যে অবিস্মরণীয় উপন্যাস লেখা হয়েছে। কিন্তু কে ভি দেবাশীষ চাকমা শান্তি বাহিনীর ঘটনা ও কাহিনি অবলম্বনে উপন্যাস লেখায় তা পরিশীলিতভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর কোচপানা দুগ (ভালোবাসার দুঃখ) এবং অধিকার উপন্যাসে শান্তিচুক্তির আগের পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু জানা ইতিহাস নিয়েও কে ভি দেবাশীষ চাকমা দূরদর্শী হতে পারেননি। তিনি তাঁর উপন্যাসে ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করেছেন; পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সংখ্যালঘু জুম্ম জাতির নিপীড়নের শিকার হবার কথা বলেছেন; জুম্মল্যান্ডের স্বপ্নের কথা লিখেছেন। বিষয়, পটভূমি ও পরিস্থিতি জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তিনি অনালোকিত স্থানে সাহিত্যের আলো ফেলতে পারেননি।
অধিকার উপন্যাসের ভূমিকা লিখেছেন ভদন্ত সুমনালংকার মহাথের, সভাপতি, পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন এবং পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ-বাংলাদেশ। ভূমিকাটি কোনোভাবেই কোন সাহিত্যকর্মের জন্য লিখিত নয়, অনেক ভুল বানানে রাজনৈতিক ধারণার প্রকাশ বলেই প্রতীয়মান হয়। বানানের কয়েকটি নমুনা — শান্তি চুক্তি সাক্ষর, ব্যবসা-বানিজ্য, জুম্ম জাতীকে, আক্রমনকে, যৌদ্ধা ইত্যাদি। কে ভি দেবাশীষ চাকমার বাংলা লিখিত বইয়ে অধিক পরিমাণে চাকমা শব্দ ব্যবহারের দোষে দুষ্ট। যার ফলে পাঠকের একটানে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ে শেষ করার পাঠসুখ অনুভব করার সুযোগ নেই। এতো শব্দের ভিড়ে চাকমা ভাষা থেকে পাঠকের পক্ষে সুনির্দিষ্ট কিছু শব্দ চয়ন করে বোধগম্য ও আত্মস্থ করা সম্ভব নয়। তাঁর রচনায় সাহিত্য-সৃষ্টি ও ভাষার শৈল্পিক উপস্থাপনের চেয়ে জাতিগত বিদ্বেষ ও ক্রোধ অধিক প্রকাশমান। তাঁর বইয়ে অনুভূতির ক্ষুব্ধ প্রচার, রুদ্ধ আবেগের অবারিত ও শিল্পিত প্রকাশ নয়।
একজন সাহিত্যিকের ভাব আরও সংবেদনশীলভাবে প্রকাশিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ বইগুলোতে কিছু কিছু বাক্য সাম্প্রদায়িকতার রূপ নিয়েছে। যেমন: দাড়ি লম্বা, নাক লম্বা, কালো মানুষ, কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা ইত্যাদি না বলে অনায়াসে বাঙালি, সেটেলার ও কালো হিজাব পরিহিত নারী বলে পরিচিতি দেয়া যেত। অথবা এ শব্দগুলোই কোন চরিত্রের সংলাপে বা ভাবনায় হুবহু আরোপিত করে দিলে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটি উপস্থাপন করা যেত না। যেকোনো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অথবা যেকোনো সাহিত্যিকের লেখায় রাষ্ট্রের কাছে অসাম্প্রদায়িক আচরণ প্রত্যাশা, সহিংস আচরণের প্রতিবাদ এবং সমতার নীতি গ্রহণের দাবি উপস্থাপন করা স্বতঃসিদ্ধ বিষয়।
লেখা দিয়ে সংখ্যালঘুর স্বপক্ষে মতামত সংগ্রহ একটি চিরাচরিত প্রত্যাশিত বিষয়। কিন্তু একজন সাহিত্যিকের নিজের লেখায় সাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটানো কাম্য নয়। নিজে উগ্র সাম্প্রদায়িক হয়ে অন্যের কাছে অসাম্প্রদায়িকতা প্রত্যাশা করা যায় না; সে রাষ্ট্রের কাছে বা সরকারের কাছে হোক, অথবা জনসাধারণ কিংবা সাহিত্যের পাঠকের কাছে হোক। বিভিন্ন দেশে ও ভাষায় কথাসাহিত্যে অনেক লেখক নির্মোহভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িক ঘটনা ও বিষয়কে তাদের রচনায় সর্বজনীন করে উপস্থাপন করে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন, মানুষের মধ্যে সংবেদনশীলতা ও মানবিক বোধ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশী বাঙালিদের মধ্যেও এমন পাকিস্তানি বিদ্বেষ পরিলক্ষিত হয়। যেমন হুমায়ুন আজাদ তাঁর প্রবচনগুচ্ছের ১৯ নম্বরে লিখেছেন, “পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও।” (আজাদ, ২০০৮, তৃতীয় সংস্করণ, ২০০৪, ২৫)। বিশ্বয়ানের যুগে জাতীয়তাবাদের এ ধরনের অতি সরলীকরণ অচল। সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক নেতাদের রাষ্ট্রীয় দর্শন ও কৌশলের মাপকাঠি দিয়ে পাকিস্তানের সাধারণ জণগণকে পরিমাপ করা অযৌক্তিক এবং অনুচিত বলেই মানবাধিকার কর্মীরা মনে করে।
কে ভি দেবাশীষ চাকমার বাক্য গঠনে দ্বিতীয় ভাষী হিসেবে দুর্বলতার স্বাক্ষর স্পষ্ট। শুদ্ধভাবে বাংলা বাক্য লেখা প্রায়শঃই অনুপস্থিত। ঘটনার কোন সামঞ্জস্যতা নেই। কিছু কিছু জায়গায় পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ঘটনার কার্যকারণ, যোগসূত্র অস্পষ্ট এবং গোলমেলে। অতিরঞ্জিত প্রেমালাপে তার সৃষ্ট প্রেম যেন সেই লোক কাহিনির ‘পুকুরেতে জল নাই পদ্ম কেন ভাসে / যার সাথে দেখা নাই সে কেন হাসে’ অথবা ‘সাক্ষী থাইকো চন্দ্র সূর্য /আকাশেরও তারা’ জাতীয় প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া। বইগুলো মুদ্রণে অনভিজ্ঞতার ছাপ ও অযত্নের চিহ্নে ভরপুর। কোচপানা দুগ (ভালোবাসার দুঃখ) বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বরে কোন জোড় সংখ্যা নেই। তথ্য বিভ্রাট আছে। অসংখ্য বানান ভুল। কে ভি দেবাশীষ চাকমার উপন্যাসের বর্ণনা হলো এই করলো, ঐ করলো, আসলো, বসলো, দেখল, গেল।
এত সীমাবদ্ধতাসত্ত্বেও এ কথা বলা আবশ্যক যে, চাকামাভাষীদের মধ্যে কে ভি দেবাশীষ চাকমার কলমেই বাংলা ভাষায় উপন্যাস লেখার সূচনা। এদিক থেকে চাকামাভাষীদের দ্বিতীয় ভাষা বাংলায় উপন্যাস রচনার ইতিহাসে তাঁর নাম উচ্চারিত হবে। তিনিই শূন্যতা থেকে সৃষ্টিশীলতার মধ্যে সংযোগ বিন্দু (connecting dots) দেয়ার কাজটি সম্পন্ন করেছেন।
সাধারণভাবে উপন্যাস সৃষ্টির জন্য একজন কথা সাহিত্যিকের প্রস্তুতি ও আয়োজন প্রয়োজন। এ প্রস্তুতি ও আয়োজন বিষয় নির্বাচন, চরিত্র সৃষ্টি, পটভূমি মনোনয়ন, ঘটনা বিন্যাস, কাহিনি উপস্থাপন, ভাষা ব্যবহার, শব্দ ভাণ্ডার, সংলাপ প্রয়োগ, আঙ্গিকগত কৌশল ইত্যাদি ক্ষেত্রে। উপরন্তু, দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উপন্যাস লেখা বা সাহিত্যচর্চার জন্য এ প্রস্তুতি ও আয়োজন আরও গভীর ও ব্যাপকভাবে নেয়া অত্যাবশ্যক, যা কে ভি দেবাশীষ চাকমার অভিজ্ঞাতার বলয়ে ছিল না বলেই প্রতীয়মান হয়।
কে ভি দেবাশীষ চাকমার উপন্যাস দুটিতে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন আচার, রীতিনীতি ও কেয়াং প্রতিষ্ঠার করার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ চিত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের জনজীবনের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে সংযুক্ত। তিনি বিভিন্ন অলংকার, প্রবাদ ও লোকজ্ঞানের ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এ সবের সার্থক প্রয়োগের জন্য তাঁর সাহিত্যবোধ ও সৃজনশীলতা পরিচর্যার প্রয়োজন রয়েছে।
কোচপানা দুগ (ভালোবাসার দুঃখ) উপন্যাস থেকে উদাহরণ:
- ‘চিলে মুরগি ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো করে তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।’ (চাকমা, ২০০২, ৩১)
- ‘আশায় মানুষকে কতই এগিয়ে নিয়ে যায়। নদীর স্রোতের চেয়ে বেশি।’ (চাকমা, ২০০২, ৮৯)
- ‘আমার হৃদয় কেড়ে নিয়ে কোন জঙ্গলে ফেলে দিয়েছিস কে জানে, বুদ্ধ ছাড়া।’ (চাকমা, ২০০২, ১০৭)
- ‘কিন্তু মনিকা রাস্তায় না দাঁড়িয়ে একপাশে পাথরের টুকরার মতো করে থাকল, কোনো কথা না বলে।’ (চাকমা, ২০০২, ১২৭)
অধিকার উপন্যাস থেকে উদাহরণ:
- ‘সূর্য ডুবার সাথে সাথে মানুষ ঘরে ফিরে, চাষীরা কাল্লোঙ (ঝড়ি) পিঠে করে, রাখাল গরুর পিছনে পিছনে। চাকরিজীবিরা প্যান্ট শার্ট পোরে। শুধু যারা দেশ জাতির জন্য ঘর ছেড়েছে, তারা এখনো ফিরিছে না। তাদের জন্য সূর্য এখনো ডুবে যায়নি, ঘরে ফিরার জন্য। না জানি তাদের জন্য ঘরে ফিরতে কবে সূর্য ডুবে যাবে। মেয়েদের কতদিন পথ চেয়ে থাকতে হবে ছেলে আসবে আশায়।’ (চাকমা, ২০০৭, ৪৭-৪৮)
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের সূচনা করেছিলেন একজন অবাঙালি সুইস নারী হানা ক্যাথরিন মুলেন্স ১৮৫২ সালে ফুলমণি ও করুণার বিবরণ লিখে। উপন্যাসটিকে সার্থক উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। দ্বিতীয়টি ছিল ১৮৫৮ সালে প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর রচিত আলালের ঘরের দুলাল। কিন্তু বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ইতিহাসে সার্থক উপন্যাস হিসেবে ১৮৬৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত দুর্গেশনন্দিনীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তবে ফুলমণি ও করুণার বিবরণ এবং আলালের ঘরের দুলাল গ্রন্থদ্বয় বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন আলোচনায় ঐতিহাসিক গুরুত্বের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে।
চাকমাভাষীদের দ্বিতীয় ভাষা বাংলায় লিখিত কে ভি দেবাশীষ চাকমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত উপন্যাসসমূহও আঙ্গিকগত দিক থেকে মানসম্পন্ন নয়, প্রকাশনার মানও রক্ষিত হয়নি, তেমন প্রচারিত এবং পঠিতও নয়। বইগুলো সীমিত আকারে প্রকাশিত, প্রচারিত ও সংরক্ষিত। তাঁর বইগুলোতে আধুনিক মুদ্রণ শিল্পের মানসম্মত চিহ্ন অনুপস্থিত। এত সীমাবদ্ধতাসত্ত্বেও এ কথা বলা আবশ্যক যে, চাকামাভাষীদের মধ্যে কে ভি দেবাশীষ চাকমার কলমেই বাংলা ভাষায় উপন্যাস লেখার সূচনা। এদিক থেকে চাকামাভাষীদের দ্বিতীয় ভাষা বাংলায় উপন্যাস রচনার ইতিহাসে তাঁর নাম উচ্চারিত হবে। তিনিই শূন্যতা থেকে সৃষ্টিশীলতার মধ্যে সংযোগ বিন্দু (connecting dots) দেয়ার কাজটি সম্পন্ন করেছেন। ২০০২ সালের কোচপানা দুগ থেকে শুরু করে ২০১৮ সালে বিপম চাকমার গ্রহণ লাগা ভোর পর্যন্ত চাকমা ভাষীর উপন্যাস (উপরে শ্রেণিকৃত তিন ধরনের উপন্যাস) লেখার ইতিহাসে কে ভি দেবাশীষ চাকমা ক্রমাগত এই সংযোগ বিন্দুগুলো স্থাপন করেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কে ভি দেবাশীষ চাকমার মতো সাহিত্য সৃষ্টিতে সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী, উদ্যোগী ও আগ্রহী ব্যক্তিবর্গের জন্য সরকারীভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের মাধ্যমে লেখনি শিবির বা বিভিন্ন কর্মশালার ব্যবস্থা করতে পারে। সৃজনশীল ব্যক্তিবর্গের সন্ধান করে তাদের সৃজনশীল ক্ষমতাকে কর্ষণ করার ব্যবস্থা করতে পারে, সৃষ্টিশীল মেধা ও মনন প্রকাশ করার পথকে সুগম করতে পারে। এতে সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর সাহিত্যের ইতিহাস সমৃদ্ধশালী হবে।
(চলবে। পরবর্তী পর্ব – চাকমাভাষী বিপম চাকমার বাংলা উপন্যাস গ্রহণ লাগা ভোর )
তথ্যসূত্র
চাকমা, কে ভি দেবাশীষ। কোচপানা দুগ (ভালোবাসার দুঃখ), ২০০২। ঢাকা: রশীদ পাবলিকেশন।
চাকমা, কে ভি দেবাশীষ। অধিকার। ২০০৭। খাগড়াছড়ি: পরানী প্রকাশনী।
চাকমা, কে ভি দেবাশীষ। মুই মত্যেই বা আমি আমার,২০১৩। ঢাকা: পার্ল পাবলিকেশন্স।
আজাদ, হুমায়ুন। প্রবচন গুচ্ছ, ২০০৮। ঢাকা, আগামী প্রকাশ।
অত্যন্ত ভালো লাগল পড়ে।