আজ রক্তাক্ত ফিলিস্তিন। ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে বরাবরই মুখর ছিলেন কবি মাহমুদ দারবিশ। ইমরান কামালের অনুবাদে পড়ুন দারবিশের একটি কবিতা।
ফিলিস্তিনি মেয়ে
তোমার চোখ এখনো কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে
বিষ-পুঁজ হায়! তারপরও তাকে আদরে মাখাই,
যত্নে ঢেকে রাখি যাতে বাতাসে শুকিয়ে না যায়,
তাকে লুকাই মাংসের ভিতর, বাঁচিয়ে রাখি রাত্রির যন্ত্রণা থেকে,
আর সে ক্ষতস্থান জ্বলে লণ্ঠন হয়ে
আগামী তার আমার আশা হয়ে থাকে,
আপন মনে হয়, আপন আত্মার চাইতেও বেশি
যদিও বা আজকাল ভুলে যাই, চোখে চোখ রেখে
কোনো এক কালে, আমরা দাঁড়িয়েছিলাম সেই ঘর… দরজার অন্তরালে।
তোমার শব্দেরা গানের মতো ছিল,
আমিও গাইতে চেয়েছি বহুবার,
কিন্তু…বেদনা যেন বসন্তের ঠোঁট চেপে ধরে,
অথচ তুমি…তোমার সাবলীল কথা…ভরতপাখির মতো…ডানা মেলে—চমৎকার যেমন।
আমাদের বাড়ির দরজাটা আর শরৎ-চৌকাঠ অভিবাসী এখন,
তাদের স্বপ্নগুলো তোমাকে অনুসরণ করে…এখনো;
আমাদের আয়নাগুলো ভেঙে চুরমার
আমরা কুড়িয়ে গেছি ভাঙনের স্প্লিন্টার
এতোদিন ধরে রপ্ত করেছি শুধুই সন্তপ্ত মাতৃভূমির বিকার!
এককালে, একসাথে, একতারে বাধা ছিল এক সুর,
কথা ছিল আমাদের মিলন বিয়োগের ছাদে…সুর বাজাবো কোনো দিন
ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ আর পাথরের নামে,
কিন্তু আজকাল মনে পড়ে না একদম…তোমার কণ্ঠ বিস্মৃত যেন এখন
তোমার চলে যাওয়াতেই কি সুর কেটে গেল নাকি আমার নীরবতায়?
গতকাল, দেখেছি তোমাকে বন্দরে
রসদহীন এক দীর্ঘ পথের যাত্রী,
এতিমের মতো ছুটে গেছি তোমার কাছে
পূর্বপুরুষের প্রজ্ঞা জানার প্রয়োজন ছিল ভীষণ:
জানার ছিল — কীভাবে চির-যৌবনা কোনো কমলালেবুর বাগান — টেনে হিঁচড়ে আনা যায়
জেলখানায়, নির্বাসনে, বন্দরে বন্দরে
আর ভীষণ ক্লান্তিকর সব যাত্রার পরও
লবণ আর আকাঙ্ক্ষার ঘ্রাণ পেরিয়ে
কীভাবে সে থেকে যায় চির যৌবনাই!
দিনলিপিতে লিখে যাই:
লেবু ভালোবাসি আমি, ঘৃণা করি বন্দর লিখি আরো:
ঘাটে
দাঁড়িয়ে পৃথিবীকে দেখেছি কথকের চোখে
বুঝেছি, কমলালেবুর খোলটুকু শুধু আমাদের, পেছনে হাঁ করে ভাগাড় মরুভূমি।
তোমাকে দেখেছি বনগোলাপের পাহাড়ে
মেষহীন এক পালক অসহায়,
এগিয়ে যাচ্ছো ক্রমশ, কোনো ধ্বংসাবশেষের দিকে
তুমিই তো বাগান ছিলে আমার, আমি আগন্তুক কোনো
দরজায় কড়া নেড়ে, হৃদয়…
কেবল দাঁড়িয়েছি হৃদয়ের ভরসায়
তোমার দরজায়, জানালা, সিমেন্ট, পাথরে।
তোমাকে দেখেছি জলের আধারে,
শস্যের ভাণ্ডারে ভগ্নপ্রায়,
রাতের আসরে গণিকাদের ভিড়ে দেখেছি তোমাকে
আমার আরেক ফুসফুস হয়ে তুমি
আমার ঠোঁটের ধ্বনি হয়ে তুমি
আমার জল, আমার আগুন…তুমি তুমি।
তোমাকে দেখেছি গিরিগুহার মুখে, কন্দরে;
ধুয়ে টাঙিয়ে রাখা তোমার এতিম চীরবাস,
কয়লার উনুনে, রাস্তার উজানে দেখেছি তোমাকে,
পোড়াদহে, সূর্যের খুনে দেখেছি তোমাকে,
অনাথ আর হতভাগাদের গানে তোমাকে দেখেছি,
দেখেছি তোমাকে সমুদ্র লবণে, বালুকার বনে
পৃথিবীর সমস্ত সুন্দরে ছিলে তুমি, ছিলে শিশুদের কোমল চোখে, ছিলে আরব জুঁইয়ের রূপে।
আমি কসম করেছি
আমার চোখের পাতা ঢেকে দেবো মখমল রুমালে
আর তার ওপর থাকবে তোমার চোখের নক্সা ক্রুশকাঁটা
আর থাকবে নাম, স্তবে স্তবে মিশে যাবে হৃদয়ের জলে
যা থেকে হবে নতুন কুঞ্জবনের শুরু
সেখানে বসে মধু আর চুমুর চাইতেও দামী একটি বাক্য লিখবো আমি —
‘ফিলিস্তিন ছিলো…ফিলিস্তিন আছে…ফিলিস্তিন থাকবে’
কোনো এক ঝড়োরাতে, দরজা জানালা খুলে দেই
দেখবো বলে অভিমানী রূঢ় চাঁদ,
রাতকে বলি: পালাও এখন
অন্ধকার দেয়ালের ওপারে,
আমাকে ওয়াদা নেভাতে হবে,
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমি শব্দ আর আলোদের কাছে,
তুমিই তো আমার কুমারীকানন
যতদিন আমাদের গান খুলে খাপ
খঞ্জর হয়ে থাকবে
আর যতদিন তুমি থাকবে বিশ্বস্ত—শস্য যেমন
ততদিন আমাদের গান
রাখবে জীবিত উর্বর বেলাভূমি।
ভিতর ভিতর তুমি মহাবৃক্ষ যেন,
ঝড় কুঠার পরোয়া নেই কিছুর,
শিকড়বন্ধে অটল অটুট বেণী,
শান্ত তপবন জীবনের আশ্রম,
নির্বাসিত যে আমি দেয়াল দরজার ওপারে,
তোমার চোখের ’পরে আমারও চাই আশ্রয়।
নিয়ে যাও আমায়, যেখানেই তুমি আছো
সঙ্গী করো, আছো যেমন দশায়,
তোমার উষ্ণতায় হোক আমার প্রত্যাবাসন,
বহ্নি হৃদয়, চোখের কসম;
রুটির লবণ, গানের কসম;
হৃদয়ের স্বাদ, মাতৃভূমির কসম;
তোমার চোখের ’পরে আমারও চাই প্রত্যাবর্তন।
আমাকে নিয়ে যাও, বাদাম কাঠের উঠানে, বেদনাকুটিরে
নিয়ে যাও, আমার বিয়োগগাঁথার চরণ থেকে চরণে
আমাকে নাও, খেলনা খেলার, নিতান্তে…পাথর মনে করে
আমার শরীরে যাতে প্রজন্ম খুঁজে পায়…
বাড়িফেরার পথ।
তোমার চোখ, হাতের উল্কি — ফিলিস্তিন…
তোমার নাম — ফিলিস্তিন…
তোমার স্বপ্ন, বেদনা — ফিলিস্তিন…
তোমার রুমাল, মখমল, তোমার আপাদশরীর — ফিলিস্তিন…
তোমার শব্দ, নৈঃশব্দ্য — ফিলিস্তিন…
তোমার কণ্ঠ — ফিলিস্তিন…
তোমার জন্ম, তোমার মৃত্যু — ফিলিস্তিন…
তোমাকে বয়ে চলেছি আমার জীর্ণ পুরোনো খাতায়,
আমার কবিতার আগুনে,
দীর্ঘ যাত্রার রিযিকে,
আমার কণ্ঠ ওড়ায় উপত্যকা থেকে উপত্যকায়, তোমার নিশান — ফিলিস্তিন।
বিজেন্তিনের ঘোড়াদের আমি চিনি,
যদিও এখন যুদ্ধটা অন্যরকম
খবরদার, হও সাবধান
স্ফটিকে আছড়ে পড়লে আমার গানের ঝংকার, চিড়ে যাবে;
বসন্তের ফুল, সিকান্দার আমি আমি বানিয়া আদর্শের মহাভুল,
আমিই এঁকে দেই সীমানা লেভান্তের,
সীমন্ত ঈগল মুক্ত হয় আমার কবিতার সাথে,
আমি জানি সাপের ডিম
সাপই ধারণ করে,
বিজেন্তিনের ঘোড়াদের আমি চিনি;
আমি জানি রক্ত ফুল বসন্তের
…ফিলিস্তিন…ফিলিস্তিন…ফিলিস্তিন।
সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৩
অনুবাদ : মে ১৫, ২০২১