বীজ ।। কিস্তি : ১৯

বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।

২১

ভেন্টিলেটরের ফোঁকরে টিকটিকিটা নেই। একটু সময় নিয়েই খেয়াল করলাম। কিন্তু না-থাকার তো কথা নয়। এতদিন যদি থেকে থাকে তাহলে এখন থাকবে না কেন? নাকি এই সময়ে থাকে না? পরে আবার এসে বসবে। হয়তো কোথাও গিয়েছে পোকামাকড় খেতে। টিকটিকিরা খুব কৌশলে শিকার ধরে। প্রথমে একটা গা ছাড়া ভাব নিয়ে চুপিচুপি আগায়। তারপর খপ করে ধরে ফেলে। অনেকটাই কুমিরের মত। টিকটিকির সঙ্গে নাকি কুমিরের দূর সম্পর্কের প্রজাতিগত আত্মীয়তা আছে।

 

মাজহার ভাই আজ আসেনি। ছুটিতে আছেন। ময়মনসিং গেছেন। বাসায় নাকি কী কাজ। এছাড়া আন্টির শরীরটাও নাকি ভালো না। ইমরান বললো। গত মাস থেকে সে মাজহার ভাইয়ের মেসে ওঠেছে। শ্যামলী। ওভারব্রিজ থেকে নেমে ডানদিকে একটা গলি আছে। গলি ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই একেবারে বিল্ডিংয়ের সামনে। পাঁচ তলায়। আমি যাইনি। ইমরানের কাছ থেকে শুনতে শুনতে একদম মুখস্ত হয়ে গেছে।

 

অফিসটাকে কেমন যেন পর পর লাগে। বিশেষ করে স্কুলটাতে পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকেই। মনে হয় বেশিদিন আর এখানে নেই। ঠিক চলে যাবো। সবাই যে যার মত কাজ করছে ডেস্কে। লাঞ্চে টেংরা মাছের তরকারি আর একটা সবজি ছিলো। সবজিতে সম্ভবত মুলা দিয়েছে। মুলা আমি খাই না। খাবার দেখেই মুখ শুকিয়ে গেছে। মোজাম্মেল টেংরা মাছ খায় না। কোনোরকমে ঝোল দিয়ে খেয়ে নিল। মুলার কথা সে-ই বললো। ও-ই আমাদের খাদ্যবিশারদ। ভাত খেয়ে বলে দেয় কোন চালের ভাত এটা। ও গোয়েন্দা হলে খুব নাম করতো। সব খুঁটিনাটি কনস্পিরেসি থিওরি তার নখ দর্পণে। খাওয়ার সময় এক ফাঁকে বললো, কথা আছে। অফিস শেষে থাকতে বললো।

 

শান্তা আপু আবার আগের মুডে ফেরত এসেছে। সুযোগ পেলেই বিভাসের সঙ্গে চা খেতে নিচে চলে যায়। গতকাল খাসির মাংস রান্না করে এনেছিলো। সবসময় মজামাস্তির ওপরেই আছে। জোর করে তুলে দিলো বিভাসের প্লেটে। এখন আর মুখে তুলে খাইয়ে দিলেও কেউ কিছু মনে করবে না। কেই-বা মনে করবে। স্বাভাবিক হয়ে গেছে এসব। বিভাসকে খাতির করতে দেখলে আমার ভালোই লাগে। অফিসে বিভাসকে একদম আলাদা লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় ফোনে আমি হয়তো আরেকজনের সঙ্গে কথা বলি। সে এই বিভাস নয়। জেসমিন দি’র সঙ্গে আলাপচারিতায় বলা কথাগুলো ঠিকই আবার কমন পড়ে। বিভাস একটা বই এনেছে আজ। জেসমিন দি’র জন্য। সিদ্ধার্থ। লেখক হেরমান হেস। বইটা দেখে মনে হলো, আমি কেন বই নিই না! যদিও পড়তে আমার ভালো লাগে না। তবু বিভাসের কাছ থেকে আমার বই ধার নিতে ইচ্ছে করে।

 

জেসমিন দি’কে ইদানিং একটু মোটা মোটা লাগে। আর কেমন একটু উদাস উদাস। ঠোঁটগুলো শুকনা। কনসিভ করলো নাকি? কনসিভ করলে নাকি এমন হয়। শিবানি বলেছে। কনসিভ করলে কারো কারো নাকি গলা শুকিয়ে যায়। ঠোঁট শুকিয়ে যায়। যদি না-শুকায় তাহলে ছেলে হয়। শুকালে মেয়ে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোর কি গলা শুকিয়ে যেতো? বলে, হ্যাঁ শুকাতো। তাহলে তোর ছেলে হল কেমনে? বলে, কি-জানি! সব কথাই সে বানিয়ে বলে। যখন যা মনে আসে তাই বলে দেয়। আমাকে একসময় জ্বালিয়ে খেতো। এমন রসকষ মিশিয়ে বিয়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতো শুনে কান গরম হয়ে যাওয়ার দশা। বুঝতাম ও বানিয়ে বলছে। কিন্তু কেন বলে, বুঝতাম না? আজও বুঝি না। ওকে একদিন মেসেঞ্জারে নক দিতে হবে। জিজ্ঞাসা করতে হবে, ‘দোস্তো বিয়ে করতে যাচ্ছি। টিপস দে। জামাইয়ের সঙ্গে কী কী করতে হবে? আর কী কী করা যাবে না?’

 

মোজাম্মেলের বক্তব্য হল, শান্তা আপু বিভাসকে পটানোর ধান্দায় আছে। আমার এ-ব্যাপারে কেয়ারফুল হওয়া উচিত। যদি বিভাসকে আমি পছন্দ করে থাকি। যেমনটা আগে ওকে বলেছিলাম। এবং ও যতটা আমাকে বুঝতে পারে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন কী হয়েছে? বলে, শান্তা আপু বিভাসকে নিয়ে বেডে যাওয়ার ধান্দায় আছে। আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আমি জানি কিনা, শান্তা আপুর যে ডিভোর্স হয়েছে? বললাম, হ্যাঁ, জানি তো। বললাম, শান্তা আপু একটু মাস্তি টাইপ। মাঝখানে খুব ভেঙে পড়েছিলো। আমিই চাইছিলাম, বিভাস তাকে একটু সময় দিক। তার মানসিক অবস্থাটা যেন একটু ভালো থাকে। মোজাম্মেলকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা, শান্তা আপুর বিষয়ে বিভাসের কী মত?’ বলে, ‘বিভাস দা’র কথা আলাদা। উনি একটু অন্যরকম লোক। কিন্তু হাজার হলেও পুরুষ তো?’

 

মোজাম্মেলের কথাগুলোকে কত সরল মনে হচ্ছে! অথচ সত্য। ওর জায়গা থেকে ওর কথা ঠিক। আমি তার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। সে কেমন আছে? জলী কেমন আছে? বললো, ভালো। বললাম, তোমাকে আমি পছন্দ করি মোজাম্মেল। বললো, জানি। ওর আসলে এটাই বলা উচিত যে, সে জানে। যে সারা দুনিয়ার খবর নিয়ে বেড়ায়। নিজের খবর তাকে তো রাখতেই হবে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ইমরানকে নিয়ে তোমার ধারণা কি একই রকম আছে?’ বলে, ‘ঐটা একটা তারছিঁড়া। বেশি বুঝা স্বভাব আছে। সবকিছুতেই এক লাইন বেশি না-বুঝলে ওর টেংরা মাছ হজম হয় না।’ হাসতে হাসতে মরি। ওর যা কথা। ইমরানকে বলেছি, তুমি আগাও। বলেছি, মোজাম্মেলের সঙ্গে একটা আলাপ আছে। ওকে গিয়ে বইটই দেখতে বলেছি। মোজাম্মেলকে বললাম, ‘ধরো, ইমরানের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। কেমন হবে?’ ভেবেছিলাম, ও অবাক হবে। অথবা ইমরানকে উড়িয়ে দিয়ে একটা ডায়লগ ছাড়বে। বললো, ‘কেমন আবার হবে? সব একই বুঝলা?’ আমি ইয়ার্কি করতে ছাড়ালাম না। বললাম, ‘মনে হয়, কয়েকটা বিয়া কইরা দেখছো? সেই অভিজ্ঞতা থেকে বললা?’ উত্তর দিল না সে। বললো, ‘ও বেশ মেধাবী ছেলে। ভাল করবে।’ বুঝলাম ইমরানকে নিয়ে বলছে। ‘মনে করো, তোমার কোনো অ্যাফেয়ার নেই। আমার তো নেই-ই। তাহলে কি আমরা একে অপরের প্রেমে পড়তাম?’ তাকে জিজ্ঞাসা করলাম। কেন জানি জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করলো। বলে, ‘হয়তো পড়তাম। তবে আমাদের মধ্যে ঝগড়া হতো খুব। সম্পর্ক টিকতো না।’ আমি হাসলাম। ও নিজেও হাসলো। বললাম, ‘কেন ঝগড়া হতো? এখন কি আমরা ঝগড়া করি?’ জবাব দিলো না। অন্য প্রসঙ্গ তুললো। পাটোয়ারী তাকে টার্গেট করেছে। ইংলিশ ভার্সনকে তার ঘাড়ে চাপাতে চায়। সে নাকি দুই পায়ে খাড়া। কিন্তু তার ঝামেলা অন্য। বলে, ‘আমার নোঙ্গর তো আরেক জায়গায় পোঁতা।’ সে যোগ করে, ‘শালা পাটোয়ারী একটা মাল। তার প্ল্যান হল, ভবিষ্যতে মেয়ের জামাইকে এই ব্যবসা বুঝিয়ে দিয়ে সে ভিন্ন ব্যবসা দেখবে।’

 

বিভাসকে ফোন দিলাম। কোথায় আছে? সে শান্তা আপুর সঙ্গে। জানালাম, আমি আর ইমরান আছি। আজ আর তাহলে দেখা হচ্ছে না। আমি চলে যাবো। টায়ার্ডও লাগছে।

 

ইমরানকে জায়গা মতোই পেলাম। ওকে নিয়ে সবাই একটা ধাক্কা খায়। কোথায় যেন চট করে একটা খটকা লাগে। খটকাটা ঠিক কোথায় তা বোঝা সহজ নয়। বেশ কঠিন। আমি বুঝতে পারি না। বিভাস বুঝতে চায় না। ইমরান নিজেরটা নিজে কীভাবে বুঝবে? কী একটা বই কিনেছে সে। বললাম, দেখি? বইটা আমার হাতে দিলো। পুনরুজ্জীবন। লেখক লেভ তলস্তয়। বললো, তলস্তয় তার প্রিয় লেখক। তার গুরু। ভগবানের মত শক্তিশালী একজন লেখক। সবার কলম যেখানে থেমে যায়, তলস্তয় সেখান থেকে শুরু করে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখে। বললাম, ‘চা খাবে? সংক্ষেপে ‘না’ জবাব দিলো। বললো, ‘চলো, তোমার সঙ্গে উত্তরা যাবো।’ বললাম, ‘এত তাড়া কীসের? তাহলে, টিসএসসির দিকে চলো। কিছুক্ষণ বসা যাক।’ ভিড়াভিড়ি তার ভালো লাগে না। ওর একটু নির্জনতা দরকার। উত্তরায় নেমে বরং গল্পগুজব করা যাবে, সে বলে। বললাম, ‘কোথায়?’ বলে, ‘সেই রেস্টুরেন্টটাতে বসবো, চলো। দেখবে বাসে আজকে আমরা দুইটা সিটই পাবো।’ আমি বললাম, তাই? কী বাচ্চাদের মত সে! কী ললিপপ মার্কা তার চাওয়া। হাতে দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লো বলে মনে হলো। ‘এই, বৃষ্টি আসছে তো! তোমার যাওয়ার দরকার নেই। আরেকদিন। তুমি ভিজে ভিজে ফিরবে আমার খুব খারাপ লাগবে।’ না সে যাবে। যাবেই। বললাম, চলো। আমার কেমন হাহাকার লাগছে ভেতরে। মাঝে মাঝেই এমন লাগে। আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আমি জানি না, আমি কী চাই। আমি জানি না, কী চাইতে হয়, কেন চাইতে হয়। আমার কান্না পাচ্ছে। ইমরানের জন্য খারাপ লাগছে আমার। তাকে আমি কষ্ট দিচ্ছি কেবল। বিনিময়ে সে আমাকে ভালোবাসছে। আমি জানি না, ভালোবাসা কী? ভালোবাসার বিনিময়ে কী দিতে হয়?

গলার স্বর আরও নামিয়ে, ফিসফিস করে বললাম, ‘তোমার কি আমার সঙ্গে সেক্স করতে ইচ্ছা করে না, ইমরান? আমাকে ছুঁইতে ইচ্ছা করে না?’ আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বললো, না।

রাস্তা পার হবো। ভিড়। জ্যাম লেগে আছে। ইমরানের কাছে ঘেঁষে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ভালোবাসা কী ইমরান? রাস্তার ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। মনে হল নিশ্চিৎ মুডটা নষ্ট করে দিয়ে এবার সে কঠিন গদ্যে লেকচার শুরু করবে। শুরু করবে বুর্জোয়া-পেটি বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েত। আমার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, ‘আমি জানি না, দিয়া। তবে জানা উচিত। আমি জানতেও চাই।’

 

শেষের দিকে দুইটা সিটই আমরা পেলাম। ওহ্ শান্তি। ভালো লাগছে। একটু ক্লান্তও। জিজ্ঞাসা করলাম ‘খুশি? ইমরান?’ মুচকি হাসল। সে খুশি। সে কি বিভাসের মত হাসলো? ‘আচ্ছা ইমরান, বিভাসের সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হয়, তোমার খারাপ লাগবে?’ গলার স্বরটা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। ও বললো, ‘না, খারাপ লাগবে না।’

: কেন খারাপ লাগবে না?

: জানি না।

: তোমার ঠিকই খারাপ লাগবে। তুমি বলছো না। আমি জানি।

: জানো, বিয়ে একটা সামাজিক প্রথা। এটা ¯্রফে সম্পত্তি আর মালিকানার বিষয়। প্রেম-ভালোবাসার সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক নেই। ইতিহাসের সকল পর্বে বিয়ে এমন ছিলো না। একজন নারীকে যে একজন পুরুষেরই হতে হবে এমন নিয়ম ছিলো না।

 

তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলাম। গলার স্বর নামিয়ে নিলাম। বললাম, ‘এসব পুস্তকের কথা রাখো।’ গলার স্বর আরও নামিয়ে, ফিসফিস করে বললাম, ‘তোমার কি আমার সঙ্গে সেক্স করতে ইচ্ছা করে না, ইমরান? আমাকে ছুঁইতে ইচ্ছা করে না?’ আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বললো, না।

: কেন? কেন ইচ্ছা করে না?

: আমার কেন জানি মনে হয়, তোমাকে স্পর্শ করলে, তোমার মধ্যে থেকে তুমি উড়ে যাবে। তোমাকে আমার কাছে দেবী মনে হয়। মনে হয় তোমাকে স্পর্শ করতে নেই। স্পর্শ করলে তুমি আর তুমি থাকবে না, যে-কোনো নারী হয়ে ওঠবে।

: তোমার আর বিভাসের মধ্যে কোথায় যেন মিল আছে?

: মিল নেই। বলো, সম্পর্ক আছে।

: কী সম্পর্ক?

: প্রেমের সম্পর্ক। দেবতা আর অসুরের মধ্যে যে প্রেম থাকে সেই রকম প্রেম। বৈপরীত্যের প্রেম। বৈপরীত্যের প্রেমই হল আসল প্রেম। ঈশ্বর আর শয়তানের প্রেম যেমন। তুমি জানো, সমস্ত প্রেমের সার হল ভগবান আর শয়তানের প্রেম।

: এগুলো নিশ্চয় তোমার কথা নয়?

: হা হা হা। হ্যাঁ। আমার কথা নয়।

 

বৃষ্টি আসবে না। মেঘ কেটে গেছে। বাতাস বইছে। জানালা একটু চাপিয়ে দিলাম। ক্ষুধা ক্ষুধা লাগছে। কী খাওয়া যেতে পারে আজকে! স্যুপ আর অন্থন। কাজুনাট সালাদ। সালাদটা ভালোই লাগে। ইমরানকে আজ আমি খাওয়াবো। আর হয়তো দশ-পনেরো মিনিট লাগবে। এয়ারপোর্টের এই অংশটা দারুণ। মনেই হয় না বাংলাদেশে আছি।

এ-নিয়ে এই রেস্টুরেন্টটাতে আজ তৃতীয়বারের মত যাচ্ছি। অথচ এখনও এর-নামটাই দেখা হয়নি। কী একটা প্যাঁচ দিয়ে লেখা। এত কষ্ট করে কে পড়তে যাবে।

: কী খাবে ইমরান? খুব ক্ষুধা লেগে গেছে। কেন জানি কফি খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কফি খাবো না। কফি খেলে বাসায় গিয়ে আর কিছু খেতে পারবো না।

ইমরান বললো, আমার যা ইচ্ছা। আমি স্যুপ আর অন্থন দিতে বললাম। ওয়েটার জিজ্ঞাসার করলো, আর কিছু? বললাম, খাওয়া শেষ হলে দুইটা কফি দেবেন। চিনি কম। একদম কম। ওয়েটারটাকে চেনা চেনা লাগলো। এরা হয়তো এখানে পার্টটাইম কাজ করে। দেখা যাবে, স্থানীয় কোনো কলেজে অনার্স বা ডিগ্রী পড়ছে। জেসমিন দি’কে নিয়ে এখানে নয় রাস্তার ওপারের আরেকটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। ‘জেসমিন দি’কে ইদানিং কেমন মনমরা লাগে।’ আমি বললাম।

: জেসমিন দি’ অসুস্থ। বিভাস দা’কে বলছিল, কী একটা ইউরিনাল ইনফেকশন টাইপ নাকি হয়েছে।

: খুব সিরিয়াস কিছু?

: খুব সিরিয়াস হলে তো আর অফিস করতো না।

হঠাৎ করেই নীরবতা নেমে এলো। একদম চুপ। দুজনেই। আমারও কিছু বলতে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু এরকম চুপচাপ বসে থাকাটা কেমন অস্বস্তিকর। লোকে ভাববে ঝগড়া হয়েছে আমাদের মধ্যে। আমিই নীরবতা ভাঙলাম।

: ছেলেগুলো বোধহয় এখানে পার্ট-টাইম চাকরি করে। দেখতে শুনতে তো স্মার্টই লাগে। অনার্স বা ডিগ্রি-টিগ্রি পড়ে হয়তো।

 

ইমরান চুপ। চুপ করেই থাকলো সে। গ্লাসের মধ্যে রাখা চামচ আর টিস্যুর দিকে গভীর মনোযোগে সে তাকিয়ে আছে।

: জানো, আমার মুরগি বিক্রি করার অভিজ্ঞতা আছে! তখন আমি স্কুলে পড়ি। আমাদের ওখানে চৌধুরী বাজার নামে একটা জায়গা আছে। বাজার। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেখানে আমি মুরগি বিক্রি করেছি। এখনো মনে পড়ে, এক বিক্রেতা আমাকে ধমকে সরে দাঁড়াতে বলেছিল। আমার জন্য অসুবিধা হচ্ছিল তার বিক্রির। সবাই আমার হাতের মুরগিগুলোরই দাম করছিলো। কেবল ভাবছিলাম, আমার স্কুলের বন্ধুরা কেউ এখন যদি দেখে ফেলে? তারা জেনে যাবে, আমরা খুব গরিব। কি যে লজ্জা লাগছিলো! জানো, ক্লাসে একটা প্রশ্নকেই খুব ভয় পেতাম আমি। এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে উঠলে নতুন নতুন স্যাররা ক্লাস নিতো। স্যাররা নাম জিজ্ঞাসা করতো। জিজ্ঞাসা করতো, বাবা কী করে? অন্যদের যখন জিজ্ঞাসা করতো তখনই আমার হৃদকম্পন শুরু হয়ে যেতো। আমি ছিলাম গভ্ট স্কুলের ছাত্র। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। তুমি কী জানো, আমার বাবা কী করতো?

 

ইমরানের প্রশ্নে আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বললাম, ‘দেখো, বাবা কী করে এটা বড় কথা নয়। তুমি কী করো, এটাই হচ্ছে আসল কথা।’ মনে হয় না, আমার কথা সে কানে তুললো।

: একটা মুদি দোকানে আব্বা ম্যানেজারি করতেন। বলতাম, আব্বা একটা মুদি দোকানে কাজ করে। আমার ফ্রেন্ডদের বাবারা কেউ ছিলেন শিক্ষক। কেউ ব্যাংকার। শুনতেই ভালো লাগতো। মনে হতো, আব্বা যদি ব্যাংকার হতো। আমাদেরও যদি হাফ-বিল্ডিং বাড়ি থাকতো।

 

আজকের স্যুপটা দারুণ হয়েছে। একদম পারফেক্ট কম্বিনেশন। বললাম, ‘সবার অবস্থা সবসময় একরকম থাকে না।’ ও হাসলো। ও কি আমার কথাকে সান্ত¡না মনে করছে? স্বান্তনা নয়। সিরিয়াসলিই বলছি।

: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমার এই হীনমন্যতা কাটে। নিজেকে আমি মেনে নিতে শিখি। ওহ্! কী যে সুখ, দিয়া! কী যে সুখ নিজেকে ভালোবাসতে পারার! আমি বুঝতে শুরু করলাম, গরিব হওয়া কোনো অপরাধ নয়। মানুষ তার নিজের কারণেই গরিব হয় না। আরও অনেক কারণ এখানে নিহিত থাকে। আমি অন্তর দিয়ে স্বীকার করতে শুরু করলাম আমার পরিবারকে। আমাকে গড়ে তোলার পেছনে তাদের অবদানকে। আব্বাকে ভালোবাসতে শুরু করলাম আমি। মাকে-ভাইকে-বোনকে। মনে হলো পৃথিবী সুন্দর। তবে এই সৌন্দর্য এমনি এমনি আসবে না। একে আনতে হবে লড়াই করে। এর জন্য দরকার সংগ্রাম। সংগ্রাম মানে শুধু মারামারিই নয়। আরও অনেক কিছু। এখন যদি সারা দুনিয়া আমাকে আমার পরিবারকে গরিব বলে হেলা করে তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।

 

ইমরান হাসছে। খুবই প্রাণবন্ত হাসি। বলে, ‘অবশ্য আক্ষরিক অর্থে আমি আর এখন গরিব নেই। মাসে বাইশ হাজার টাকা ইনকাম করা লোক গরিব হতে পারে না। তুমি দেখো, এরচেয়ে অনেক ভালো কিছু আমি করবো। এই যে তোমাকে আজকে বললাম। তুমি সন তারিখ লিখে রাখতে পারো।’ আমি বললাম, ‘আমিও তাই চাই।’ যোগ করলাম, ‘আচ্ছা, আমাকে নিয়ে তোমার প্ল্যান কী, ইমরান? বলো তো? এভাবেই চলবে?’

: তোমাকে আমার ভালো লাগে, দিয়া। এই ভালোলাগার মূল্য আছে। তাই আমি মূল্য দিই। আমার আচরণে তুমি হয়তো বুঝতে পারো। আমি যেটা করবো, তা হল, অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। তারপর সময় বুঝে একদিন তোমার ফ্যামিলির কাছে প্রস্তাব পাঠাবো। অবশ্যই তোমার অনুমতি নিয়ে। যদি নিষেধ করো, তাহলে পাঠাবো না। তখন দেখে শুনে অন্য কোনো একজনকে বিয়ে করে ফেলবো। জীবন এতো জটিল নয়। সহজ। জলের মত সহজ। বিভাস দা’ কী বলে জানো? ভালো থাকতেই হবে কেন? তাই তো! ভালো থাকতে চাওয়াটাই খারাপ থাকার মূল কারণ।

: জানো, তোমার প্রতি আমার ফিলিংসটা আমি আসলে বুঝি না, কী যে চাই, কেন মিশি, আমি জানি না। একদম জানি না। অদ্ভুত না?

: আসলে আমাকে তোমার ভালো লাগে। আমি জানি। এটা স্বীকার করতে তুমি ভয় পাও। অবশ্য কেন ভয় পাও, তা জানি না।

 

পড়ুন ।। কিস্তি ১৮

বীজ ।। কিস্তি : ১৮

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here