আজ ২৫ শে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মোৎসব উপলক্ষে সমকালীন গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হামীম কামরুল হক কিছু জরুরি প্রশ্নের মোকাবিলা করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন : রবীন্দ্রনাথ লইয়া আমরা কী করিব? প্রশ্নটি অনেক পুরনো হলেও প্রতি বছরই জবাব তৈরি হয় ভিন্ন রকমের। দেখা যাক হামীম কী বলেন।
১
শিরোনামে ‘এ’ শব্দটা দিয়ে শুরু করলে, এতে একটা ঠাট্টার সুর লাগে, স্বরও কেমন উঁচু হয়ে ওঠে। বঙ্কিমের ‘ধর্ম্মতত্ত্ব’ গ্রন্থের এক বিখ্যাত উক্তি ‘‘এ জীবন লইয়া কি করিব?’’ লেভ তলস্তয়ের ‘A Confession’ রচনার এক জায়গায় আছে,‘‘…and if there is only one answer to the eternal question of life—why do I live? what is the purpose of my life?’’ তাহলে, কেন আমি বেঁচে আছি? আমার এই জীবনের উদ্দেশ্য কী? — জীবনের চিরায়ত ও আদি অন্তহীন এ প্রশ্নের উত্তরেই তৈরি হয় আমাদের জীবন। কিন্তু কজনইবা নিজের জীবনের শুরুতে অন্তর-গভীরে এমন প্রশ্ন তোলেন? বা তোলার সাধ্য রাখেন?
‘এ জীবন’-এর চেয়ে ‘এ রবীন্দ্রনাথ’ তো আলাদা। যদি হতো ‘এ রবীন্দ্রনাথ লইয়া আমরা কী করিব?’ তাহলে ‘এ’-র ব্যাখ্যা দিতে হয়। কোন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমরা কী করতে চাই? সাধারণ ধারণা এই যে, রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তি হিসেবে একজনই, কিন্তু তাঁর ব্যাপ্তিতে তিনি হয়ে ওঠেন ‘নানা রবীন্দ্রনাথের মালা’। জীবনের এমন কোনো দিক নেই যে রবীন্দ্রনাথে তাঁর ছাপ খুঁজে পাওয়া যাবে না। — এটা হলো রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ঢালাও কথা। আবার সেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেই এর ঠিক বিপরীত চিন্তা অনেকেই করে থাকেন। তিনি এটা করলেন না কেন? ওটা করলেন না কেন? তিনি ‘খামোখা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান বানাতে গেলেন কেন? মুসলমানদের নিয়ে তিনি আলাদা করে গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ কিছু লিখে গেলেন না কেন? — এমন অনেক অভিযোগ অনুযোগ এবং হাজারো প্রশ্নও জাগে তাঁকে নিয়ে।
কেউ কেউ বলেন:‘কীভাবে বাঁচতে হবে?’ — এই শিক্ষাই সবচেয়ে ভালো করে পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের কাছে। যেমন, অন্নদাশঙ্কর রায় লেখেন,‘‘প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠকীর্তি তাঁর জীবন। তাঁর অন্যান্য কীর্তি বিস্মৃত হয়ে যাবার পরও তাঁর এই কীর্তিটি জীবিত মানুষের আন্তরিকতম যে-জিজ্ঞাসা — ‘ কেমন ভাবে বাঁচব?’ — সেই জিজ্ঞাসার একটি সত্য ও নিঃশব্দ উত্তর হয়ে চিরস্মরণীয় হবে।’’
শিবনারায়ণ রায় রবীন্দ্রনাথের চেয়ে গ্যোয়েটেকে এগিয়ে রেখেছিলেন। একমাত্র তিনিই রবীন্দ্রনাথের চেয়ে সাহিত্যিক-প্রতিভা হিসেবে জগতে অগ্রসর। এর কিছু কারণও হাজির করেছিলেন। যেমন বলেছিলেন, ‘মানুষ’ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস আমাদের অজানা। যে ‘মানুষ’টি সারাজীবন ভালোবাসা নিয়ে এত এত কবিতা, গান, নাটক, ছোটগল্প-উপন্যাস লিখে গেলেন, সেই ব্যক্তিটির জীবনের নারী ও প্রেমের একান্ত অভিজ্ঞতার সংবাদ তিনি সযত্নে প্রচ্ছন্ন রেখেছেন।
যেমন বলেছিলেন, শুচিতার মোহ তাকে পেয়ে বসেছিল। আমরাও টের পাই যে, নিজের বিশুদ্ধতাকে তিনি নিজের চেয়ে কম ভালোবাসতে না। আমরাও জানি যে, রবীন্দ্রনাথ নিজেই স্পষ্ট করে বলেছেন, অন্যরা ‘ভালোবাসা’ বলতে দৈনন্দিন জীবনে মিলেমিশে একে অপরের লগ্ন হয়ে যে ‘ভালোবাসা’ বাসে, তাঁর কাছে ‘ভালোবাসা’ অর্থ তা নয়।
ভালোবাসার প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ বোধ হয় — রূপ থেকে স্বরূপ এসেও তা পেরিয়ে অরূপে পৌঁছে যান। কাছের ও চেনা রবীন্দ্রনাথ — দুম করে হয়ে যান সুদূরের এবং অচেনা। ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ গানে যখন বলেন, ‘‘আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা’ — তখনটা হঠাৎ করে যে চেনা বাস্তবতার চেনা উঠান ছেড়ে বিষয়টি এমন জায়গায় চলে যায়, তা হয়ে ওঠে অধরা।
তাঁর রচনার বহু দিক নিয়েই সঠিক বিচার আলোচনার অবকাশ এখনও বিপুল। আর সে কাজটি তাঁকে ভক্তি দিয়েও সম্ভব নয়, বিরক্তি দিয়েও সম্ভব নয়।
মনে হতেই পারে, এবং হওয়ার কারণও আছে যে, রবীন্দ্রনাথের মূল ধরনই হলো ‘সাবলাইমে’ পৌঁছে যাওয়া। ফলে রবীন্দ্রনাথের রচনার অনেক আনুভূমিক (হরাইজন্টাল) দিক থাকলেও তাঁর মূল গতি আসলে উল্লম্ব-ঊর্ধ্বমুখী (ভার্টিক্যাল)। বোধ করি, একেই লোকে ‘আদর্শবাদী’ রবীন্দ্রনাথ ভুল করেন। এজন্যই তাঁর মধ্যে শুচিতার মোহ দেখে থাকেন। শিবনারায়ণ লিখেছেন,‘‘…রবীন্দ্রনাথ যতই প্রকাশের ক্ষমতা অর্জন করেছেন, ততই জীবনের নানা জটিল এবং দুষ্প্রকাশ্য অভিজ্ঞতাকে আদর্শবাদী শুচিতার মোহে পাশ কাটানোর মনোভাব তাঁর মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছে। এতে মানুষ হিসেবে তাঁর কতটা লাভ বা ক্ষতি হয়েছে জানি না, কিন্তু লেখক হিসেবে যা লোকসান হয়েছে, তা অপূরণীয়। জীবনকে সমগ্রভাবে স্বীকার করতে না শিখলে আর যাই হওয়া সম্ভব হোক, প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিক হওয়া অসম্ভব।’’ রায় মহাশয়ের মতে, এ কারণে ‘‘অসামান্য সৃষ্টি-ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তিনি এমন কিছু লিখে যেতে পারলেন না, যা সাহিত্যমূল্যে ‘‘মহাভারত’’ অথবা ‘‘অডিসি’’, ‘‘ইনর্ফানো’’ অথবা ‘‘কিং লীয়ার’’, ‘‘ফাউস্ট’’ বা ‘‘ওঅর অ্যান্ড পীস’-এর সমতুল্য।’’ এবং তাঁর মতে, এই দুর্বলতা মূলত উপন্যাসে প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, অশুচির প্রতিবিম্বতে রবীন্দ্রনাথে নেই বা থাকলেও তা পরিমাণে কম। ফলে যাকে কিনা বলে নেতিবাচকভাবে জীবনকে দেখার প্রখর এক ‘অমঙ্গলবোধ’’-এর বিপরীতে থাকা রবীন্দ্রনাথ বা শেষাবধি ‘‘বিশুদ্ধবাদী’’ রবীন্দ্রনাথ, যিনি নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে সাহিত্যকে বাঁচাতে পারেননি। যদিও গ্যোয়েটের সঙ্গে, শেক্সপিয়রের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে তাঁদের পাশপাশি রবীন্দ্রনাথের নানান দিকের সাদৃশ্য দেখাতে অনেক বেশি প্রমাণ মন্তব্য ও বিচার-সিদ্ধান্ত ছিল শিবনারায়ণ রায়। তিনি কোনোভাবেই রবীন্দ্রনাথকে ‘ন্যূন’ সাহিত্যব্যক্তিত্ব বলতে রাজি নন, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তিনি যে অভিযোগ রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে তুললেন তা দিয়ে তিনি তথাকথিত রবীন্দ্রবিদ্বেষীদের হাতে একটা তুরুপের তাস তুলে দিয়েছেন — এটাও ভাবার সুযোগ নেই। কারণ শুরুতেই তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন — জগতে সাহিত্যিক প্রতিভার বিচারে একমাত্র গ্যোয়েটেই আছেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে এগিয়ে।
২
তাঁকে নিয়ে আমাদের নতুন একটা বিচারে নামা দরকার। রবীন্দ্রনাথের মূল প্রবণতা হলো উল্লম্ব(ভার্টিক্যাল) — সে বিষয়টি বস্তুগতভাবে বোঝানোও মনে হয় কঠিন। সাধারণ জীবনের চাওয়া-পাওয়াওয়ালা মানুষরা আনুভূমিক (হরাইজেন্টাল) জীবনযপন করেন। কিন্তু মরমীসাধকরা যাপন করেন উল্লম্ব-জীবন। ঊর্ধ্বমুখী জীবন। যেখানে প্রেম ভালোবাসা, দয়া মমত্ব আর সাধারণ স্তরে থাকে না, তা অন্যলোকে, অন্য আলোকে পৌঁছে যায়, যেটা ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।’ — দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ বস্তুগত চাওয়া-পাওয়া পেরিয়ে সেখানে পৌঁছাতে পারে খুব কম মানুষ। বিশেষকরে মরমীবোধ না থাকলে সেটি ঘটবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ এক বিশেষ ধরনের আধ্যাত্মিকতা। যে-আধ্যাত্মিকতা নান্দনিকতা, এমন কি সেই শ্রেণির বৈজ্ঞানিকতার সঙ্গেও মিলে যায়, যার রহস্য এখনও ভেদ করা যায়নি। অসীম অনন্তে ছড়ানো এই মহাবিশ্বের মহাকাশে মহাঅনুভব দিয়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে আমাদের নিয়ে যেতে পারেন।
৩
শ্রেণিমানসিকতার বিচারে রবীন্দ্রনাথ শ্রমজীবীশ্রেণির কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারেন নি — এমন অভিযোগও কম নেই। — একথা যারা বলেন, তাদের রক্তকরবী নাটকটি নতুন করে পড়তে বলা ছাড়া উপায় কী! পুঁজিবাদী সমাজ কীভাবে চলে? যেখানে মানুষ পরিণত হয় সংখ্যায়, ফলে ন্যায় ও মানবঅস্তিত্ব পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে হলে কী কী দরকার? রাজা ও জনগণের মাঝখানের আমলাতন্ত্র ও মধ্যস্বত্ব ভোগীদের কীভাবে উৎখাতের ডাক দিতে হয়? — এ নাটকে সেসব একরকম বলাই হয়ে গেছে। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে রক্তকরবীর মতো বামপন্থী এবং একইসঙ্গে সার্থক সাহিত্যকীর্তি খুব বেশি নেই। (কারো কারো মতে, এ নাটক বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেখক আপটন সিক্লেয়ারের একটি রচনা থেকে ‘মেরে দেওয়া’। আত্মস্থ করা বা আত্তীকরণকে হীনভাবে দেখাটা কি প্রবল এক আত্মতৃপ্তির সহগামী? রবীন্দ্রনাথকে ছোট করে কি আমরা বড় হতে পারব?) যেমনটা প্রাচীন বাংলাসাহিত্যের চর্যাপদের বেলায়ও ভাবা সম্ভব। ক্ষুৎকাতর আর শ্রেণিভেদের শিকার হওয়া মানুষদের প্রতীকী বাস্তবতায় বৌদ্ধসিদ্ধাচার্যরা যা দিয়ে গেছেন, বাংলা সাহিত্য কেন, বিশ্বসাহিত্যে এর তুলনামেলা ভার। চর্যাপদই জগতের প্রথম বামপন্থী/মার্কসবাদী সাহিত্য — বলতে পারি কি? কিন্তু মজার ব্যাপার হলো চর্যাপদ বলি কি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যই বলি, ঐতিহাসিক বস্তুবাদে বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ দিয়ে তাদের কতটা ধরা যাবে? পেছনে ধর্মীয় পটভূমি আছে যে!
বলাবাহুল্য, ইতিহাসকে চেনা, উৎপাদনব্যবস্থাকে বোঝা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রবিচার বলি কি সমাজবিচারের বেলায়ও বলি, মার্কস একটি মেথড (পদ্ধতি) দিয়ে গেছেন। প্রণালী(সিস্টেম) নয়। পদ্ধতিতে মুক্ত (ওপেন) একটা ধরন থাকে; প্রণালী (সিস্টেম) সেখানে হয় বদ্ধ (ক্লোজড)। এদিকে মার্কসের দেখানো যে-পদ্ধতিতে সাহিত্যবিচার বা জীবন-ভুবন বিচার করা যাবে, রবীন্দ্রনাথকে সে-পদ্ধতিতে করা যাবে কি? দুজনেই বিচিত্রগামী, কিন্তু সর্বত্রগামী নন — বললে কি খুব বাড়িয়ে বলা হবে? রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সেই রাষ্ট্রেশাসন পদ্ধতি নিয়ে সব কিছু বলে যেতে পেরেছিলেন কি মার্কস? আন্তনিয়ো গ্রামশিকে অনেক কিছু যোগ করতে হয়েছে, যোগ করেছেন লুই আলথুসেরও। গেয়র্গে লুকাচকে হতে হয়েছে ‘সাহিত্যবিচারের মার্কস’। তাঁরা মার্কসবাদকে নানান দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, আরো সমগ্রতার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও সেই সমগ্রতার দিকে সাহিত্যকে নিয়ে যেতে তিন বাড়ুজ্জে (বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিক থেকে সতীনাথ) ভূমিকা পালন করেন নি?
কবিতায় যিনি তথাকথিত রবীন্দ্ররিরোধিতায় নামেননি, সেই জীবনানন্দ প্রবলভাবে রবীন্দ্রানুরাগী হয়েই হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন এক কাব্যভুবনের সৃষ্টিকারী। আমাদের প্রশ্ন হলো, একজন মানুষই কি সব কিছু সম্পর্কে সব কিছু বলে যেতে পারেন? তাহলে পরের মানুষজনের কাজ কী থাকতে পারে? বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন বলেই জীবনানন্দ সম্ভব হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন বলেই দেবেশ রায় সম্ভব হয়েছিল। সম্ভব হয়েছিল, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক থেকে শহীদুল জহিরদের আসা। (এদেঁর কেউ যদি রবীন্দ্রনাথের বিপরীত দিকে থেকেও থাকেন, তবুও।)
৪
এবার মজাটা হলো, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরেকটি দলও আছে, যারা মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ প্রায় সব কিছুই বলে গেছেন, ফলে আমাদের আর তেমন কিছু বলবার নেই, লিখবার নেই। যদিও কিছু থেকে থাকে, সেসবের পরিমাণ অতি সামান্য। — এটিও রবীন্দ্রনাথকে ভুল বোঝার আরেক দিক। ভক্তি দিয়ে মুগ্ধতা দিয়ে মজে গেলে এই পরিণতি হয়। যে-অভিযোগ শিবনারায়ণ রায় করেছেন, সেটি পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ পড়লে মনে হতে পারে প্রায় ভিত্তিহীন। পুর্ণেন্দু লিখেছেন, ‘‘যে দিক থেকেই দেখি না কেন, বুঝে নিতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয় না যে রবীন্দ্রনাথ কলকাতাকে চিনে নিয়েছিলেন নতুন কালের জয়যুদ্ধের কুরুক্ষেত্র-রূপে, স্তাঁদাল কিংবা বালজাক যেভাবে চিনে নিয়েছিলেন প্যারিসকে।’’ এ গেল উপন্যাস নিয়ে একবিন্দু কথা, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি নিয়ে বলতে গিয়ে আমাদের পড়তে হয়, পুর্ণেন্দুর ভাষ্যে, ‘‘অবনীন্দ্রনাথ তাঁর রবিকাকার ছবিকে বলেছিলেন, ভলক্যানিক ইরাপ্সন। রবীন্দ্রনাথের চৈতন্যে সেই আগ্নেয়গিনি কবে কীভাবে গড়ে উঠেছিল, আমরা সঠিক ইতিবৃত্ত জানি না। শুধু বলতে পারি, হ্যাঁ গড়ে উঠেছিল বটে।’’
পুর্ণেন্দু নিজের রবীন্দ্রপাঠে আমাদেরও কিছু সূত্র দিয়ে গেছেন। যেমন বলেছিলেন, যাতে ধরা পড়ে রবীন্দ্রনাথ যা ও যেভাবে বলেছেন, তার সঙ্গে তার বলতে চাওয়ার ধরনটা বুঝতে না পারলে, এবং নিজের আকাশভারা মন ও মনন তৈরি না করলে রবীন্দ্রসত্তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া কঠিন। যেমন :
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।
পুর্ণেন্দুর মতে, এখানে যদি ‘শান্তি’ বদলে ‘শক্তি’ পড়ি, ‘‘তা হলেই যেন তাঁর আজীবনের রক্তক্ষতময় সংগ্রামের উৎসকে ছুঁয়ে ফেলি।’’ — ফলে রবীন্দ্রনাথের পাঠে নিজের অন্তর্বয়ান যদি যোগ না হয়, তাঁকে পাওয়া হয় না, বোঝাও হয় না।
সবচেয়ে বড় কথা, রবীন্দ্রনাথকে পড়ব কি কেবল তাঁকে পেতেই? সেই সঙ্গে যদি আমাকেই না পাই তো রবীন্দ্রনাথ পাঠ সম্পন্ন হয় না। একদিকে প্রবল আবেগ, অন্যদিকে নির্লিপ্ততা, কোথাও কোথাও তাঁর কাজকে চরম নির্মমতাও মনে হতে পারে, যেমনটা আবদুশ শাকুর ‘রবীন্দ্রনাথের অনুজ্জ্বল অঞ্চল’ (কলকাতা থেকে যা ‘রবীন্দ্রনাথও মানুষ ছিলেন’ নামে প্রকাশিত) বইয়ের নানান প্রবন্ধে পেশ করেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পক্ষে-বিপক্ষে বা নিরপেক্ষ হয়ে বললেও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পুরোটা বলা হয় না; কোথাও কোথাও তাঁর আবেগের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়, কোথাও যেতে হয় ছুটে; কোথাও তাঁর বিশ্লেষণের সঙ্গে মতবিরোধে লিপ্ত হতে হয়, কোথাও করতে হয় প্রত্যাখ্যান। ফলে বিশ্বের এই জটিলতম সাহিত্যিক-সত্তাটিকে যাচাই-বাছাই করা ততোধিক জটিল হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত মনে পড়ে, পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখক-ঔপন্যাসিক গুণময় মান্না বিরাট এক বই লিখেছিলেন ‘রবীন্দ্ররচনার দর্শনভূমি’। সেখানে তিনি তাঁর দর্শনকে অস্তিত্ববাদী দর্শনের ভূমিতেই দেখতে চেয়েছেন। পেয়েছেন মিল, কিন্তু তা প্রচলিত অস্তিত্ববাদও নয়। লক্ষণীয় তিনি ‘রবীন্দ্রনাথের দর্শনভূমি’ বা ‘রবীন্দ্রনাথের দর্শন’ বলেননি, বলেছেন তাঁর ‘রচনা’র দর্শনভূমি।
হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ, আমাদের আঘাত হয়ে দেখা দিয়ে সে-আগুন আলো হয়ে জ্বলে উঠুক। সেখানে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সেখানে অনেক ভ্রান্তির মোচন হবে, অনেক স্বস্তির দহন ঘটবে।
গুণময় মান্না লিখেছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ এক মানবিক অস্তিত্ব ও মানব অস্তিত্ব সম্বন্ধেই তিনি লিখেছেন। বছর দশেক আগে কথাটা যখন মনে এসেছিল, প্রথমে বিশ্বাস হতে চায়নি — এতই সহজ! তবু এক রবীন্দ্রনাথকে খেলাবার ওই হচ্ছে চাবি। সাধক বিশ্বসত্য দর্শনের জন্য যখন বিশ্বের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দিশাহারা হতে থাকেন, তখন গুরু বলেন, নিজেকে জানো — এক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি: রবীন্দ্রনাথকে সামনে রাখো। রাখাটা সহজ ও দুরূহ। কারণ রবীন্দ্রনাথকে কোনো ঐকান্তিক মতবাদে ধরবার উপায় নেই — তাঁর মুক্তরূপ এতটাই যে উল্টে তিনি হয়ে যান সব মতেরই কাজী, অর্থাৎ মানুষের গতিপথে যত রকমের অবস্থান-সম্ভবনা হতে পারে, সব জায়গাতেই তিনি একবার করে দাঁড়িয়ে পড়েন। আর রবীন্দ্রনাথের মতো মানবাস্তিত্বের এমন সামগ্রিক রূপকার আর ক’জন আছেন। তাই দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ মূলত এক অস্তিত্বসাধক হয়েও তিনি হিতবাদী ধ্রুববাদী সহজবাদী বিশ্বাত্মবাদী গতিবাদী উজ্জীবনবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি।’’ তিনি পাঠককে মনে করাতে চান যে, ‘‘এই গ্রন্থে যথাতথ অস্তিত্ববাদের আলোচনা নিছক প্রাসঙ্গিক, আমাদের প্রয়াস রাবীন্দ্রিক অস্তিত্ববাদ উদ্ঘাটনেরই লক্ষাভিমুখিন।’’
ফলে, প্রচলিত অস্তিত্ববাদের আদলে পাওয়া রবীন্দ্রনাথ নন; ওই দর্শনের কিছু সূত্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মিলে গেলেও এটি তাঁর মতো করে গড়ে ওঠা এমন এক মনোভূমিজাত দর্শন যা হয়ে ওঠে ‘রাবীন্দ্রিক অস্তিত্ববাদ’। এক অর্থে তো জগতের সব লেখকই কম-বেশি অস্তিত্ববাদী লক্ষণ সম্পন্ন। তবে গুণময় একেবারে নিশ্চিত দাগিয়ে দিতে চাননি মনে হয়, এই মতটিকে আরো যাচাই করার মুক্ত পরিসর রেখেছেন।
বলতে পারি, এটা একটা সর্তকতামূলক অবস্থান। কারণ ওই যে, রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিসত্তা ও সাহিত্যিকসত্তা দুটোরই জটিলতা ভেদ করার দিকে গেলে বেশিরভাগেরই আরো জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এজন্যই আমাদের টের পেতে হয় — এক ধরনের বিশিষ্ট স্বচ্ছ সজীব, সরল মন ও মনন ছাড়া রবীন্দ্রনাথ নিয়ে নানান জনের নানান বিভ্রম মোচন করা যায় না।
কবিতায় রোমান্টিক, সংগীতে মরমী/মিস্টিক, ছোটগল্পে বাস্তববাদী, উপন্যাসে আদর্শবাদী, প্রবন্ধে দার্শনিক, নাটকে সব কিছু মিলে (রোমান্টিক+ বাস্তববাদী+আদর্শবাদী+দার্শনিক+ মরমি সেই সঙ্গে আধুনিকবাদীও), চিত্রকলাও আধুনিকবাদী — এমন একটা সরলীকরণের দিকে আমরা রবীন্দ্রপাঠকে নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু দেখা যাবে পদে পদে সব কিছুর সঙ্গেই সব কিছু জড়িয়ে আছে, যেমনটা আমরা নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বললাম। মনে রাখা ভালো যে, রবীন্দ্ররচনার বড় অংশ জুড়ে নাটকের অবস্থান (যে-নাটক সম্পর্কে কারো কারো মত হলো, তাঁর একটি নাটকও নাটক হয়নি। কারণ এ মত যারা পোষণ করেন, তিনি নাটক বলতে যা বোঝেন, রবীন্দ্রনাথের নাটকে সেই নাটক পান না।) আর কেবল প্রতীক ও সংকেতিক ইত্যাদি তকমায় দাগিয়ে দিয়ে তাঁর নাটক সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না।
এভাবেই রবীন্দ্রনাথ ভুল পাঠের শিকার হন। কেবল কি নাটক? তাঁর রচনার বহু দিক নিয়েই সঠিক বিচার আলোচনার অবকাশ এখনও বিপুল। আর সে কাজটি তাঁকে ভক্তি দিয়েও সম্ভব নয়, বিরক্তি দিয়েও সম্ভব নয়। সঠিক যুক্তি ও বিচিত্র পরিপ্রেক্ষিত মিলিয়েই তাঁকে তাঁর রচনার অখণ্ডবোধে পাঠ করলে হয়ত রবীন্দ্রপাঠ নতুন মাত্র পাবে। বলা বাহুল্য, এটাও শেষ কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ যেন এক বিরাট পাথুরে পর্বত, তাতে আঘাত না করলে আরোহণ সম্ভব নয়। তাঁর ভাষা দিয়েই বলতে হয়, ইনি রবীন্দ্রনাথ, এঁর ‘‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?/ আঘাত হয়ে দেখা দিলে, আগুন হয়ে জ্বলবে।’’
হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ, আমাদের আঘাত হয়ে দেখা দিয়ে সে-আগুন আলো হয়ে জ্বলে উঠুক। সেখানে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সেখানে অনেক ভ্রান্তির মোচন হবে, অনেক স্বস্তির দহন ঘটবে।