ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে রেস্তোরাঁ, হাঁটার পথ নির্মাণের আয়োজন চলছে। এ গল্প কি তারই প্রতিবাদ?
সুন্দরপুর গ্রামের ঠিক মাঝখানটাতে প্রাচীন এক বটগাছ। ঠিক কত প্রাচীন সেটা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারে না — গ্রামের বুড়ো বাসিন্দারা বলে, তাদের তিন-চার পুরুষ আগের মানুষেরাও দেখেছে এই গাছ। সেই মতো হিসেব করে সবাই ধরে নিয়েছে এই গাছের বয়স কম করে হলেও তিনশ বছর।
বিরাট এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে গাছটির শেকড়-বাকড়। কোথাও ঝুরি ঝুলছে। কোথাও ঝুরিগুলো জড়ো হয়ে থামের মতো দাঁড়িয়ে আছে। গাছের নিচে এখানে-সেখানে অজস্র ঝোপঝাড়ও আছে ছড়িয়ে। চারপাশে ঝোপঝাড় ঘিরে থাকায় মানুষ ওদিকে খুব একটা যায় না। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মাঝে মাঝে খেলতে খেলতে চলে আসে। নান্নু কবিরাজ আসে গাছগাছড়া খুঁজতে। আবার নানান রকম গায়ে কাঁটা দেওয়া গল্পও শোনা যায় বটতলা নামে খ্যাত ঐ জায়গাটিকে ঘিরে। কাজেই খুব দরকার না পড়লে কেউ ওদিকের পথ মাড়ায় না। যে কারণে এই বুড়ো বটগাছটিকে ঘিরে গজিয়ে উঠেছিল আলাদা একটা পৃথিবী, আলাদা এক রাজ্য। যে রাজ্যের বাসিন্দা মানুষ না, পশুপাখি। অবশ্য পাখিরাই মূল বাসিন্দা।
সেই রাজ্যে মানে পশুপাখির রাজ্যে হঠাৎ একদিন খুব শোরগোল পড়ে গেল। পাখিরা ডাকাডাকি ভুলে এ-ডালে ও-ডালে জটলা পাকিয়ে খুব চিন্তামগ্ন হয়ে বসে রইল। কেউ কেউ গম্ভীর আলোচনায় ব্যস্ত রইল। সেইসঙ্গে ফড়িং, প্রজাপতি, গেছোব্যাঙ, রক্তচোষা, বেজি এরাও নিথর গুম হয়ে রইল। বিষয়টা হলো, লোকমুখে শোনা যাচ্ছিল, তাদের এই রাজ্যটিকে মানে বটগাছটিকে কেটে ফেলা হবে। কেটে এখানে রেললাইন বানানো হবে। তাই এই রাজ্যের বাসিন্দাদের খাওয়া-ঘুম-গান সব স্তব্ধ হয়ে গেছে। গাছ কাটলে তারা যাবে কোথায়! তাদের কত পুরুষের স্মৃতি মেশানো এই গাছ, এই বসতি!
এ নিয়েই কদিন ধরে তারা আলোচনা করে বেড়াচ্ছে- ভাবছে কী করে তাদের রাজ্যকে, বাপ-দাদার ভিটেকে রক্ষা করা যায়। কারও কণ্ঠে গান নেই, সুর নেই, ছুটে বেড়াচ্ছে না কেউ, এমনকি খাবারের খোঁজে যাওয়ার কথাও ভুলে গেল ওরা। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! কিছু একটা তো করতে হবে! তাই পাখিরা শলাপরামর্শ করতে শুরু করল। অন্য প্রাণীদের সাথেও কথা বলল। দু-তিনদিন কেটে গেল এভাবেই। অবশেষে ঠিক হলো, তারা একটি সাধারণ সভা করবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুদিন পরই অনুষ্ঠিত হলো পাখিদের সাধারণ সভা। সভার সভাপতি চিল আর প্রধান আলোচক শকুন।
খুব চিন্তিত মুখে শকুন বলল, ‘গাছ আমাদের জীবনের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ সেসব তো খুব পুরনো কথা, মানুষ পুস্তকে এরকম পড়ে। পাখিরাও কি মানুষের কম উপকার করে! সকালে ডাকাডাকি করে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়, ফলের বীজ এখান থেকে ওখানে ছড়িয়ে দেয়- তাতে করে নতুন গাছ জন্মায়। আর এই যে শকুন মানুষের গরু মরে গেলে সেগুলো খেয়েদেয়ে পরিষ্কার করে দেয় সেটাও কি কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ! চলাচলের জন্য রেললাইন অবশ্যই প্রয়োজনীয়, আমরা সেটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু সেটা তো অন্য কোথাও-ও করা যেতে পারে। আমাদের বসতি কেটেই কেন করতে হবে!’
বিশেষজ্ঞ হিসেবে কোকিলও আলোচনায় অংশ নিল। সে বলল, ‘এই যে আমাদের কত বন্ধু আজ হারিয়ে গেছে, দূরদেশে চলে গেছে আমরা কি তাদের কখনো ফিরে পাব আবার! মৌমাছিরা মধু জোগাড় করবে ফুলের গাছ নেই, মাছরাঙা-বক মাছ খাবে সে ডোবা-ই নেই! মাছ থাকবে কোথায়! আমরা কষ্টেসৃষ্টে এই গাছটায় এসে নিরিবিলিতে আস্তানা গেড়েছিলাম। তাতেও মানুষের সইছে না। মানুষের কা-কারখানা দেখলে মনে হয় পৃথিবীটা যেন শুধু তাদেরই, আমাদের নয়! বাকিরা যদি পৃথিবীতে না থাকে তাহলে যে তারাও হেসেখেলে জীবন কাটাতে পারবে না সেটা তারা বোঝেই না! মুশকিল হলো কে তাদের বোঝাবে!’
এরমধ্যে বাজপাখি এসে আলোচনায় যোগ দিল। সে কোকিলের আলোচনার সূত্র ধরেই বলতে শুরু করল, ‘মানুষ বোঝে না এমন না। তাদের মধ্যে অনেকেই বুঝতে পারে। অনেকেই আমাদের নিরাপত্তার কথা ভাবে, আমাদের জীবন বাঁচানোর জন্য লড়াই করে। কিন্তু তাদের কথা শোনে কে!’
আমরা যে ধর্মঘটটা করতে চাচ্ছি সেটা কীভাবে, কেন এবং আমরা কী চাই- এই বিষয়গুলো একটা কাগজে লিখে আমরা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।
একপাশে চুপচাপ বসেছিল একটা বাবুই পাখি। সে এই রাজ্যের নতুন বাসিন্দা। থাকার মতো একটা ছোটখাটো বাসাও সে বানিয়েছে এর মধ্যে। তার ঠিক পরের ডালেই ছোট্ট একটা মৌমাছির চাক। সেই চাকের ভেতর থেকে হঠাৎ করে বেরিয়ে এলেন রানি মৌমাছি। সভায় যোগ দিয়ে বললেন, ‘আমাদের কথাই ভেবে দেখো না! আগে আমরা গাছে গাছে ঘর বানাতাম। হরদম চোখে পড়ত আমাদের। এখন কি আর আমাদের তেমন দেখা যায়! কালেভদ্রে একটা দুইটা গাছে আমাদের দেখা মেলে। কারণ আমাদের খাবার নেই। আগে কত ফুলের বাহার ছিল। সেগুলো এখন কই! সারা বছর ধরে আমরা বসে থাকি শীতের জন্য। কারণ তখন সরিষা ফুল ফুটবে। তাছাড়া আর ফুল কই! খেয়ে না খেয়ে গ্রামের ভেতর একটা গাছে যাও বা ছিলাম তাও টিকতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত এই গাছটাতে ঠাঁই নিয়েছি। সেটাও ওদের সইছে না!’
একটু থেমে রানি মৌমাছি আবার শুরু করেন, ‘আর শুধু আমার কথাই বা বলি কেন। এই যে, বাবুই ভায়া কী সুন্দর ঘর বানায়। অথচ আজ তার ভাগ্য দেখো! উঁচু তালগাছের মাথায় সে ঘর বানাত, এখন সেই তালগাছই নেই। কেন নেই? কারণ মানুষ বেশি লাভের আশায় সেসব গাছ কেটে ভিনদেশি গাছ লাগিয়েছে, নয়ত গাছ সাবাড় করে সেসব জায়গায় ঘরবাড়ি, কলকারখানা বানিয়েছে। মানুষ কী বোকা! এ কথা তাদের কে বোঝাবে আমাদের বিপদ মানে তাদেরও বিপদ! বেচারা বাবুই বাধ্য হয়ে কলাগাছে বাসা বানাল। সেটাও কি আর মানুষের সয়! হাতের নাগালে তার সুন্দর বাসাটা পেয়ে একজন খুলে নিয়ে গেল ঘরে ঝুলিয়ে রাখবে বলে। সাথে নিয়ে গেল বাবুইয়ের চারখানা ডিম। সে-ও তো দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর এই বটগাছে এসে আস্তানা গেড়েছে।’
রানি মৌমাছির দীর্ঘ বক্তব্যের পর হঠাৎ সবাই চুপ হয়ে গেল। নিজেদের পরিণতি নিয়ে তারা সবাই চিন্তিত। বেশ অনেকটা সময় চুপচাপ কেটে যাওয়ার পর শকুন আলোচনার সমাপ্তি টেনে বলল, ‘এভাবে মানুষ শুনবে না, বুঝবে না। তাদের বোঝাতে হবে। হাতেনাতে বোঝাতে হবে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে আমরা না থাকলে তাদের কী পরিণাম হয়।’
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হলো, তারা ধর্মঘট ডাকবে। ধর্মঘটের ব্যাপারটা তারা জেনেছিল তাদের বাপ-দাদার কাছে। একবার নাকি খুব যুদ্ধ হয়েছিল এ দেশে, তখন তারা ধর্মঘট হতে দেখেছে। পরেও দেখেছে, তবে সেই যুদ্ধের গল্পটাই সবার মনে আছে।
সিদ্ধান্ত হয়, পরদিন থেকেই শুরু হবে তাদের ধর্মঘট- সকালে কোনো পাখি ডাকবে না, কোনো পাখি ফল খেয়ে বীজ ছড়াবে না, শকুন মৃত গরু খেয়ে সাফ করে দেবে না। মোদ্দাকথা হলো, মানুষকে কোনোরকম সহায়তা তারা করবে না। কিন্তু মুশকিল হলো তারা যে ধর্মঘট করছে এই খবরটা তো আগে মানুষের কাছে পৌঁছুতে হবে। পৌঁছুনোর কাজটা কেমন করে করা যায়! শেষ পর্যন্ত চিলই পথ বাতলে দিল। সে বলল,
‘আমরা লিফলেট বানাতে পারি।’
যারা চিলের মতো জানাশোনা নয় তারা বুঝল না লিফলেট কী। চিল বহু দেশ ঘুরেছে। বড়ো বড়ো শহরে নিয়মিত যাতায়াত তার, তাই সে জানে অনেক কিছু। সে সবাইকে বুঝিয়ে বলল,
‘আমরা যে ধর্মঘটটা করতে চাচ্ছি সেটা কীভাবে, কেন এবং আমরা কী চাই- এই বিষয়গুলো একটা কাগজে লিখে আমরা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি। আমরা যেহেতু কাগজের ব্যবহার জানি না তাই আমরা গাছের পাতাতেই লিখে ফেলতে পারি। তারপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে একটা করে পাতা ফেলে দিয়ে আসব।’
সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল। এর মধ্যে একজন জানতে চাইল,
‘কিন্তু আমরা লিখব কীভাবে!’
চিলই ফের পথ বলে দিল,
‘বটফল ভিজিয়ে প্রথমে লাল রঙটা বের করব। তারপর সেই রঙে ঠোঁট চুবিয়ে পাতার ওপর লিখব। সে কাজটা না হয় আমিই করে দিলাম।’
সভা শেষ হওয়া মাত্রই কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেল। পাতায় পাতায় লিফলেট লেখা হলো। পাখিরা ঠোঁটে করে নিয়ে গেল মানুষের বাড়ি। গাঁয়ের সব বাড়িতেই পৌঁছে গেল পাখিদের ধর্মঘটের খবর। মানুষেরা তো অবাক। পাখিদের ধর্মঘট! সাত জন্মেও তো কেউ কোনোদিন এমন কথা শোনেনি। কেউ কেউ সত্যি সত্যি ভাবনায় পড়ে গেল। কেউ বা আবার হেসে উড়িয়ে দিল।
পরদিন কিন্তু সবাইকে সত্যি ভাবনায় পড়তে হলো। কারণ সেদিন সবাই ঘুম থেকে উঠে দেখল দুপুর বারোটা বাজে।
সকালে কারও ঘুম ভাঙেনি। এমনকি প্রবীণ যে মানুষগুলো কাকডাকা ভোরে উঠে পড়েন তারাও আজ জাগতে পারেননি। কারণ আর কিছুই না- আজ সকালে কোনো পাখি ডাকেনি। তাই সময়ের হিসেব বুঝতে পারেনি কেউ।
তার পরদিন গৃহস্থের ঘরের গরু মরে গেল। শেয়াল, শকুনে খেয়ে নেবে এই ভরসায় গৃহস্থ মরা গরুটাকে ফেলে রাখল মাঠের পাশে কিন্তু কেউ ছুঁয়েও দেখল না। পচে দুর্গন্ধ ছড়াল চারপাশে। মানুষ নাক চেপে চেপে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেল আর বলল,
‘আজকাল শেয়াল-শকুনরা কি মরা গরু খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে নাকি! কদিন ধরে গরুটা এখানে পড়ে পড়ে পচছে!’
আরেকজন বলল,
‘খাবে কী, ওরা তো ধর্মঘট করেছে। মানুষকে কোনোরকম সহযোগিতা করবে না।’
এরকমভাবে কেটে গেল বেশ কিছু দিন। সত্যি বলতে মানুষদের খানিকটা যেন অসুবিধেই হলো। যদিও তারা মুখে সেরকমভাবে কিছু বলল না। তবে আরও কিছু দিন পর কেউ কেউ বলতে আরম্ভ করল,
‘নাহ্! এভাবে তো চলতে পারে না!’
একজন দুজন করে অনেকের মুখেই এরকম শোনা যেতে থাকল। তারপর একসময় সবাই একযোগে বলল,
‘কিছু একটা বিহিত করতেই হবে।’
সবাই মিলে গেল গাঁয়ের মোড়লের কাছে। তাকে বোঝাল যে, রেললাইনটা বটগাছ বরাবর না করে গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে করা যায়। তাতে সবদিকই রক্ষা হয়।
সুন্দরপুর গ্রামের মোড়ল রইসুদ্দীন সব শুনে বলল,
‘সবই বুঝলাম কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তো আমি নিতে পারি না। এগুলো তো সব ওপরের ব্যাপার-স্যাপার।’
নিতাই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘হুজুর, তা বটে হুজুর। কিন্তু আপনি তো তাদের কাছে সুপারিশ করতে পারেন। তাদের বুঝিয়ে বলতে পারেন। তারা নিশ্চয়ই আপনার কথা রাখবে।’
মোড়ল মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল,
‘ঠিক আছে দেখি কী করা যায়…’
পাখিরাও এসব খবরের আঁচ পেয়ে গেল। তারা টানটান উত্তেজনায় অপেক্ষা করছে কী হয় দেখার জন্য। সত্যি বলতে, মানুষদের অসহযোগিতা করতে গিয়ে তাদের নিজেদেরও তো কম অসুবিধা হচ্ছে না। না খেয়ে না গান গেয়ে তারাই বা বেঁচে থাকে কী করে!
তিন দিন পর তারা খবর পেল মোড়ল শহরে গিয়েছে বিষয়টা নিয়ে বড়ো বড়ো মানুষদের সাথে আলাপ করতে।
পাখিরা অপেক্ষা করতে থাকল। অপেক্ষা করল মানুষেরাও। আরও দু-দিন পর রইসুদ্দীন ফিরে এলো। পাখিরা তো আর মোড়লের কাছে উড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারছে না, ‘কী খবর আনলে রইসুদ্দীন?’
তাই ওরা অপেক্ষাই করল। বিকেলের দিকে হঠাৎ ওরা দেখল পশ্চিম পাড়ার ঝন্টু দৌড়ে আসছে বটগাছের দিকে। ওরা উৎসুক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। ঝন্টু একেবারে কাছে এসে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে বলল,
‘শোনো পাখিরা, এই বটগাছটা কাটা হচ্ছে না। তোমরা এখানেই থাকবে। রেললাইন হবে অন্য কোথাও।’
সব পাখি একযোগে ডেকে উঠল। মৌমাছিরা মৌচাক ছেড়ে বটগাছের মাথার ওপর ভোঁ ভোঁ শব্দ করে ঘুরপাক খেতে থাকল। গ্রামের মানুষও শুনতে পেল সেই কলধ্বনি। তাদের কাছে মনে হলো, বহুদিন পর জীবন ফিরে পেল সুন্দরপুর।