ওঠো, হে বন্ধু, ভাই ভাই জান
একহাতে অস্ত্র আর হাতে প্রাণ
রক্তফাগুন আনে যে আগুন
কখন যে জ্বলে ক্ষোভ নিদারুণ
কখন দুলেছে সপ্তসিন্ধু, তুমি তো জানো না বন্ধু।
(লেখক অজ্ঞাত, গানের বাহিরানা, হেমাঙ্গ বিশ্বাস)
যেকোন শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষ একসময় দাঁড়িয়ে যায়। তাকে দাঁড়াতে হয় জীবনের প্রয়োজনে, সময়ের প্রয়োজনে। মানুষের মধ্যে স্বাজাত্যবোধ ও স্বাতন্ত্র্যবোধ একদিনে জন্ম নেয় না। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার পূর্বে মানুষের মননে পরাধীনতার বোধ জন্ম নেয়। ব্যক্তিক দ্রোহ যখন সাধারণ মানুষের চিন্তায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে তখন তৈরি হয় গণজাগরণ, তা থেকে জন্ম নেয় গণবিক্ষোভ, একসময় তা রূপ নেয় সশস্ত্র সংগ্রামে। আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছি, কিন্তু তার পূর্বে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য জাতি প্রস্তুত হয়েছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে এই মাটিতে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সূচিত হয় তার অন্যতম শক্তি ছিল ব্যাপক জনসমর্থন। প্রতিটি ন্যায্য আন্দোলনে সর্বস্তরের জনগণকে শামিল করার জন্য ব্যাপক প্রচারণা ও জনসংযোগ করতে হয়েছে। বিক্ষোভমুখর সেই উত্তাল দিনগুলোতে সাধারণ জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত করতে, প্রতিবাদী করতে, গণসংগীত সবসময়ই অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। এই আলোচনাতে আমরা দেখবো কিভাবে গণসংগীত ও গণসংগীত শিল্পীরা আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে জাতিরাষ্ট্র বিনির্মাণে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
সংগীত শব্দটি আমাদের কাছে খুবই পরিচিত। সুর ও বাণীর সম্মোহন কেউ এড়াতে পারে না। কিন্তু যখন ‘সংগীত’ এর পূর্বে ‘গণ’ শব্দ যুক্ত হয়, তখন ‘গণসংগীত’ শব্দটি অন্য ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। গণসংগীতের সংজ্ঞায়নের জন্য এর উৎপত্তি ও বিকাশের ধারাটি আলোচনা করা প্রয়োজন। গণসংগীতকে ‘জাগরণের গান’, ‘দ্রোহের গান’ ও ‘মুক্তির গান’ ইত্যাদি নামেও গাওয়া হয়। গণসংগীত হচ্ছে সঙ্গীতের এমন একটি ধারা যার মাধ্যমে সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগ্রত করা যায়। গণসংগীতের সূচনাকাল নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে।
‘বলতে গেলে রুশ বিপ্লবের পর থেকেই ‘গণ’কথাটা দ্রুত সামনে আসতে থাকে। বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে ম্যাক্সিম গোর্কি যে তত্ত্ব তুলে ধরেন তার সঙ্গে সঙ্গেই ‘গণসাহিত্য’ বা ‘গণসংগীতের’ ধারণা বিশ্বব্যাপী একটা রূপ নিতে থাকে’ (শামসুজ্জামান ও কল্যাণী, ২০০৮: ১৫)। চিন্মোহন সেহানবীশ এর মতে গণসংগীতের পরিকল্পনা ওয়াই সি আই সংগঠকদের মাথায় এসেছিলো চীনে প্রচারিত জাপানী আগ্রাসনবাদ বিরোধী গণসংগীতের অনুকরণে (প্রাগুক্ত: ১২)। আমাদের এই ভূখণ্ডে গণসংগীতের পরিচয় ঘটে ত্রিশের দশকের শেষে। চল্লিশের দশকের শুরুতে তা স্বাধীনতাকামীদের দ্বারা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এবং শিক্ষিত সমাজে পরিচিতি পায়। গণসংগীতের উদ্ভব নিয়ে আলোচনায় প্রবাদপ্রতিম গণসংগীত রচয়িতা ও শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেন ‘স্বদেশ চেতনা যেখানে গণচেতনায় মিলিত হয়ে শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতার ভাবাদর্শের সাগরে মিশলো সেই মোহনাতেই গণসংগীতের জন্ম।’ (হেমাঙ্গ, ১৯৫৯: ১৫১)।
গণসংগীত রূপগতভাবে দেশীয় হবে, হেমাঙ্গ বিশ্বাস এই বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে ‘গণসঙ্গীতে মেহনতি মানুষের আন্তর্জাতিক সহমর্মিতার বাণী থাকবে, কিন্তু তার অজস্র রূপগত আত্মীকরণের মাধ্যমে তাতে থাকবে দেশীয় আইডেনটিফিকেশন’ (প্রাগুক্ত)। আমাদের এই ভূখণ্ডে ‘গণসংগীতের ‘গণ’বলতে বোঝায় অধিকার সচেতন, প্রতিবাদী বা শ্রেণিচেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ। কিন্তু গণসঙ্গীত এর মূল উদ্দেশ্য হলো অধিকার অসচেতন মানুষকে সংঘবদ্ধ ও জাগ্রত করে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যুক্ত করা। গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীরের মতে ‘গণসঙ্গীত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রেরণা, সাহস। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, ক্রোধ, ঘৃণা, সমস্যা, সংকট, দাবি এবং আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরে সুরের বলিষ্ট ঝংকারে’ (ফকির, ২০১০: ২৫)।
এই বঙ্গভূমিতে সৃষ্ট গণসংগীতের প্রধানত দুটি ধারা পরিচিতি পায়। একটি শহুরে সংগীত অপরটি গ্রামীণ সংগীত। গ্রামীণ সংগীতের ধারাটির নেতৃত্বে ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিনয় রায়, নির্মলেন্দু চৌধুরী, খালেদ চৌধুরী, নিবারণ পণ্ডিত, গোপাল নন্দী, হেমন্ত দাশ প্রমুখ। অপরদিকে নাগরিক ধারাটির নেতৃত্বে ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, সুজাতা রায় প্রমুখ। ১৯৪৩ সালে তৎকালীন ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয় আইপিটিএ বা ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন যা ভারতীয় গণনাট্য সংঘ নামে পরিচিত। এই গণনাট্য সংঘের কর্মীরা গণসঙ্গীত রচনা ও প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।
বাঙালিদের মধ্যে গানের মাধ্যমে প্রতিবাদের রীতি অনেক পুরোনো। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদে সমাজের শোষিত মানুষের ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে। ১৮৭৫ সালে নবীনচন্দ্র সেন লিখলেন ‘চাহি না স্বর্গের সুখ নন্দন কানন/ মুহূর্তেক পাই যদি স্বাধীন জীবন।’ মুকুন্দ দাশের কথা কে না জানে। স্বদেশী গায়ক মুকুন্দ দাস স্বদেশী গানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গান ‘বান এসেছে মরা গাঙে খুলতে হবে নাও/তোমরা এখনও ঘুমাও’। মুকুন্দ দাসের অন্য একটি বিখ্যাত গান ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে/ মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।’
বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে স্বদেশী গানের ভূমিকা অনবদ্য। বঙ্কিমচন্দ্র, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের অনেক গান আন্দোলন-সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। স্বদেশী গানের ক্ষেত্রে বিপ্লবের স্পর্শ যার হাত ধরে এসেছে তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী নজরুল ইসলামের অনেক গান ‘গণসংগীত’ হিসাবে ১৯৪৭ পরবর্তী সময়েও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। আলোচনায় পরবর্তী কালে নজরুলের কয়েকটি বিখ্যাত গানের উল্লেখ থাকবে। অনেক গবেষক স্বদেশী গানকে গণসংগীত না বললেও স্বদেশী গান যে আমাদের গণসংগীতের ভিত্তি তা সবাই স্বীকার করেছেন। প্রয়োগের দিক বিবেচনায় অনেক স্বদেশী গান ও গণসংগীতের মধ্যে পার্থক্য পাওয়া যায় না।
১৯৪৭-১৯৭১ এই সময়টাতে আমরা বাংলার জনগণ উপনিবেশিত হিসাবে শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছি। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ ও দমন-পীড়নের প্রতিবাদে ও প্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে আন্দোলন ও সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এই সময় প্রতিবাদমুখর বাঙালির প্রতিটি আন্দোলনে গণসঙ্গীত শক্তি দিয়েছে, সাহস দিয়েছে, আন্দোলনে প্রাণসঞ্চার করেছে। গণসংগীতের ভূমিকা নিরূপণ করতে গিয়ে ফকির আলমগীর পুরো সময়কে ১৯৪৭-১৯৫৪, ১৯৫৪-১৯৫৮, ১৯৫৮-১৯৬৫, ১৯৬৫-১৯৬৯, ১৯৬৯-১৯৭১ এই পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন (প্রাগুক্ত: ১৭)।
এদেশের সোঁদা মাটি-জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষের চিন্তার আদল পাকিস্তানি বেয়াকুফ শাসকরা যে বুঝতে পারেনি সে অজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৫২ সালে। এই ভূখণ্ডের মানুষের আইডেনটিটি তৈরি হয় যে বাংলা ভাষা দিয়ে সেই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দিয়ে পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের অস্তিত্বে আঘাত হেনেছিল। একুশে ফেব্রুয়ারির মর্মান্তিক ঘটনার উপর প্রথম গণসংগীত আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। প্রথম সুর দেন আব্দুল লতিফ, পরবর্তী সময়ে সুরারোপ করেন আলতাফ মাহমুদ।
২১ শে ফেব্রুয়ারির উপর লেখা অন্যান্য গণসংগীতের মধ্যে গাজীউল হকের রচনায় এবং নিজামুল হক সুরারোপিত ‘ভুলব না, ভুলব না একুশে ফেব্রুয়ারি, ভুলব না/ লাঠি গুলি আর টিয়ার গ্যাস/ মিলিটারি আর মিলিটারি ভুলব না।” উল্লেখ্য এই গানটি বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে প্রথম ১৯৫৩ সালের প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয়। আব্দুল লতিফের কথা ও সুরে ১৯৫৩ সালে রচিত — ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়/ ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়।’ এই গান বাঙালির অস্তিত্বের শিকড়ে নাড়া দেয়। ‘একুশে ফেব্রুয়ারির গণজাগরণে শামিল হয়ে গান লিখেছেন, রমেশ শীল, সত্যেন সেন, সিকানদার আবু জাফর, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, হাসান হাফিজুর রহমানসহ আরো অনেকে’ (প্রাগুক্ত: ৫৪)।
গণসংগীত সর্বাধিক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিভাগ ছিল দুটি তথ্যবিভাগ ও সঙ্গীতবিভাগ।
১৯৫৪ সারের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পূর্বে বিভিন্ন জনসভায় যে গণসংগীত পরিবেশিত হয় তার মধ্যে ‘মন্ত্রী হওয়া কি মুখের কথা/ যদি না বোঝে জনতার ব্যথা’, আব্দুল লতিফের বিখ্যাত গান ‘ও হক লাটগিরি নেয় না তোদের দুঃখে/ তাও কি তোদের মনে নাই/ হকের দলে আয়রে সব ভাই’ উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৭ সালের ৯-১০ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে মাওলানা ভাসানী আহূত পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলনে গণসংগীত পরিবেশন করেন শাহ আব্দুল করিম, রমেশ শীল, হরলাল রায়সহ অন্যান্য শিল্পীরা। রমেশ শীল গাইলেন ‘মন দেহ পাকিস্তানে থেকে স্বাধীন হইলি কৈ/ বিদেশী মূলধনে রাষ্ট্র স্বাধীন কিসে হৈ। (মকসুদ ১৭)।
১৯৬১ সালে ‘ছায়ানট’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নতুন উদ্দীপনা তৈরি হয়। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা পেশ করার ফলে পূর্ববাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র হয়। ১৯৬৭ সালে গণসংগীতকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াসে কামাল লোহানী ও হাসান পারভেজের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’ ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করলে বাঙালিরা আরো বিক্ষুব্ধ হয়। এ সময়ে কবি সিকানদার আবু জাফর লিখেন তাঁর স্মরণীয় গণসংগীত ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’।
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যূত্থানের পূর্বমুহূর্তে অন্য একটি গণসংগীত খুব জনপ্রিয় হয়। গানটি হলো ‘ও বিলাই (বিড়াল)/ রুই মাছের মাথা খাইওনা/ শেখের হাতে লাঠি/ থাবা আর বাড়াইও না।’ এ সময়টাতে আলতাফ মাহমুদ ও অন্যান্যদের কণ্ঠে সলিল চৌধুরীর ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা/ আজ জেগেছে সেই জনতা’, নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, ‘এই শিকল পরা ছল, মোদের এই শিকল পরা ছল’ ইত্যাদি গান আন্দোলনকে আরো বেগবান করে।
গণসংগীত সর্বাধিক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিভাগ ছিল দুটি তথ্যবিভাগ ও সঙ্গীতবিভাগ। ‘সঙ্গীত শাখার প্রধান কাজ ছিল উদ্দীপনামূলক গান প্রচার করে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর প্রেরণা জোগানো এবং উদ্বিগ্ন স্বদেশ বাসীর মনোবল বাড়ানো (শাকুর, ২০০৭: ১৩০)। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গণসংগীত শিল্পীদের দ্বারা অজস্র গণসংগীত পরিবেশিত হয়েছে, তন্মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো। আপেল মাহমুদের ভরাট কণ্ঠে গাওয়া ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’এবং ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’গান দুটি কোন বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করেনি! গান দুটির গীতিকার যথাক্রমে গোবিন্দ হালদার এবং গাজী মাজহারুল আনোয়ার। গোবিন্দ হালদারের লেখা ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ এবং ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা ও অংশুমান রায়ের কণ্ঠে ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি’, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, মাকসুদ আলী সাঁইয়ের লেখা ও গাওয়া ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের শ্মশান করেছে কে?’ আবু বকর সিদ্দিকের ‘ব্যারিকেড বেয়নেট বেড়াজাল’ সমগ্র জাতিকে সংগ্রামে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। রাজাকার-আলবদর ছাড়া দেশের সকল জনগণ ঐক্যবদ্ধ ছিলো মুক্তির সংগ্রামে। গণসংগীত শিল্পীরা সব সময় দেশের আপামর শোষিত-নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠকেই ধারণ করেছিলেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পৌঁছে আমাদের মুক্তিসংগ্রামে সবার অবদান স্বীকার করা, স্মরণ করা প্রয়োজন। গণসংগীত কোন একটি আন্দোলনকে উদ্দেশ্য করে রচিত হলেও তা একসময় প্রতীকী রূপ ধারণ করে। এই অস্ত্র সব সময় শোষকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি। যারা কণ্ঠ দিয়ে, কলম দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করেছেন তাঁদের স্মৃতির প্রতি অনিঃশেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রিয় গণসংগীতজ্ঞ কবির সুমনের দুটি লাইন উদ্ধৃত করে শেষ করতে চাই —
…দিন বদলের স্বপ্নটাকে হারিয়ে ফেলো না
পাল্টে দেবার স্বপ্ন আমার এখনো গেলো না
হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে
দেখা হবে তোমায় আমায় অন্য গানের ভোরে
সহায়ক বই
১। গানের বাহিরানা, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, প্যাপিরাস কলকাতা ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ (১৯৫৯)
২। বাঙালির মুক্তির গান, আবদুশ শাকুর, মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৭
৩। কাগমারী সম্মেলন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রথমা প্রকশান ২০১৭
৪। গণসঙ্গীত ও মুক্তিযুদ্ধ, ফকির আলমগীর, অনন্যা ২০১০
৫। গণসঙ্গীতের অতীত ও বর্তমান, ফকির আলমগীর অনন্যা ২০০১
৬। বাংলার গণসংগীত, শামসুজ্জামান খান, কল্যাণী ঘোষ, বিজয় প্রকাশ ২০০৮
৭। হাজার বছরের বাংলাগান, সম্পা. মোনায়েম সরকার, আগামী প্রকাশনী, ২০১৪