ইলিয়াডে’র দেবতারা

বর্তমান জমানায় মাটির এই পৃথিবীতে, দেবতাদের হরহামেশা আনাগোনার খবর আর পাওয়া যায় না। কখনো যদি কেউ নিজেকে দেবতা বা নবি বলে দাবি করেও বসে, আস্থাহীন মানুষ আর তাদের ভাওতাবাজিতে বিশ্বাস করে না। অবশ্য সুপ্রাচীন কালের বাস্তবতা বদলে গেছে অনেকখানি, তার সাথে বদলে গেছে দেবতা ও মানুষের গুণগত ও অবস্থানগত ফারাকও। প্রাচ্যের দেবতা আর পশ্চিমা দেবতাদের শক্তি-ক্ষমতা, চরিত্রধর্ম ও আবাসের আবার ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। তবে দুই প্রান্তের দেবতাদের বাসস্থানের যে কল্পনা করা হয়েছে, তাতে উভয়ক্ষেত্রেই পর্বতের উল্লেখ পাওয়া যায়। একপক্ষের ঠিকানা যদি হয় হিমালয়, তাহলে অপর পক্ষের ঠিকানা অলিম্পাস। তবে মানুষের কল্পনায় দেবতাদের এই বাসস্থানের ধারণার বদল হয়েছে বহুলাংশে। শক্তি-ক্ষমতাও অভিন্ন থাকে নি। চারটি জাত মহাকাব্যে অজস্র দেবতাদের উল্লেখ এবং মাটির পৃথিবীতে জাগতিক বিষয়-আশয়ে তাদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকার বিবরণ রয়েছে। ইলিয়াড মহাকাব্যে যে সকল দেবতাকে হাজির হতে দেখা যায়, তাদের ক্রিয়াকর্ম ও আচরণের স্বরূপ কেমন ছিলো, তা একটু তলিয়ে দেখা যাক।

 

ইলিয়াড মহাকাব্যে যে ঘটনা বা যুদ্ধের বর্ণনা করা হয়েছে, তার নেপথ্যের কাহিনিতে রয়েছে দেবতা। সাগরপরি বা জলদেবী থেটিস (দেবরাজ জিউস এবং তার ভাই সমুদ্র দেবতা পসেডন যার প্রেমে পড়েছিল, পরে প্রমিথিউসের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে ক্ষান্ত হয়েছিল) ও মারমিডনের রাজা পেলেউসের বিবাহকে কেন্দ্র করে (এই দেবী ও মর্ত্যের রাজা দম্পতির সন্তানই গ্রিকপক্ষের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা একিলিস, স্বর্গীয় সুরক্ষা ও আনুকূল্যে যার শক্তি ও সামর্থ্য অসীম)। বিবাহে সকল দেবতা দাওয়াত পেলেও, কলহের দেবী এরিস বঞ্চিত হলো। রুষ্ট দেবী নিমন্ত্রিত দেবদেবীদের মাঝে একটি সোনার আপেল ছুঁড়ে দিলো। আপেলটির গায়ে লেখা ছিলো ‘শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর জন্য’ এবং এটি গিয়ে পড়লো তিন দেবী হেরা, অ্যাথিনি ও আফ্রোদিতির মাঝখানে। কে সেরা সুন্দরী — এ নিয়ে শুরু হয়ে গেল কলহ। শেষে জিউস সুন্দরী নির্মাণের ভার কোনো মানবের উপর দেয়ার পরামর্শ দিলে, তারা তা মেনে নেয়।

 

যে মানব এই নির্ণয়ের ভার পেয়েছিল, সে-ই প্যারিস। নির্ণয় নিজের পক্ষে নেয়ার জন্য তিন দেবীই প্যারিসকে প্রলোভন দেখালো। হেরা সাম্রাজ্যের, অ্যাথিনি জ্ঞানী হওয়ার এবং আফ্রোদিতি পৃথিবীর সেরা সুন্দরীর সাথে বিয়ে করানোর প্রলোভন দেখালো। যুদ্ধ কিংবা জ্ঞানী হওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহী সুদর্শন প্যারিস আফ্রোদিতির হাতেই সোনার আপেল তুলে দিলো। এই ঘটনার পরে প্যারিস ও আফ্রোদিতির প্রতি হেরা ও অ্যাথিনি চিররুষ্ট হয় (যার ফলে পরবর্তী কালে তারা দুজন প্রবলভাবে গ্রিকপক্ষ অবলম্বন করে)। আফ্রোদিতি কথা রাখতে গিয়েই পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মেনেলাউস-পত্নী হেলেনকে প্যারিস কর্তৃক অপহরণ করায়। ফলে ট্রোজান ও গ্রিকদের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

 

জলপরি থেটিস, দেবী হয়েও এক মানবের সাথে বিবাহে আবদ্ধ হয়েছিল। থেটিসের পুত্র হয়েও একিলিস দেবতা নয়, মানুষ। দেবী আফ্রোদিতি ও মর্ত্যমানব অ্যাংকাউসিজের পুত্র ঈনিয়াস, সেও দেবতা নয়, মানুষ। আমাদের প্রাচ্য মিথে দেবী গঙ্গা মর্ত্যের রাজা শান্তনুকে বিয়ে করেছিল। তাদের পুত্র ভীষ্ম মহাবীর ছিলো। দেবতা ও মানবী এবং দেবী ও মানব — উভয় ক্ষেত্রেই উৎপন্ন সন্তান হয়েছে মানুষ। দেবতা ও মানুষের শ্রেণিগত ফারাকই হয়তো এর নেপথ্যের কারণ হয়ে থাকবে। দেবীদের মানব বিবাহের নজির খুব বেশি না হলেও প্রাচ্য পাশ্চাত্য উভয় পুরাণেই পাওয়া যায়। তবে মানবীর গর্ভে দেবতার ঔরসে সন্তান উৎপাদনের দৃষ্টান্ত উভয় অঞ্চলের পুরাণেই প্রচুর পরিমাণে লক্ষ করা গেছে। প্রাচ্যের পঞ্চ পাণ্ডব ও কর্ণের কথা আমাদের জানা আছে।

রামায়ণ কিংবা মহাভারতের যুদ্ধে দেবতাদের প্রভাব ও ভূমিকা থাকলেও ইলিয়াড মহাকাব্যের দেবতাদের মতো নির্লজ্জ অংশগ্রহণ সেখানে লক্ষ করা যায় না।

পাশ্চাত্য মিথে বলা হয়, স্পার্টার রাজা টিন্ডারিউসের স্ত্রী লিডা ও জিউসের মিলনের ফলে হেলেনের জন্ম। রাজা প্রায়ামের পূর্বপুরুষ দার্দানুসও জিউসের পুত্র। ট্রয় পক্ষের ‍যোদ্ধা সার্পেডনও তার পুত্র। ইলিয়াডে দেবরাজ জিউসের ঔরসে জন্মানো মানবসন্তানের আধিক্য দৃষ্টিগোচর হয়, যেমনটা প্রাচ্য দেবরাজ ইন্দ্রের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। ট্রয়ের যুদ্ধে মানবের হাতে সার্পেডনের মৃত্যু হয়। জিউস তাকে প্রতিহত করতে যেন ব্যর্থই হয়। চাইলেই যেন দেবরাজ সব করতে পারে না। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ঘোরানোর জন্য উভয় পক্ষের যোদ্ধারাই জিউসকে দায়ী করে এবং এক পর্যায়ে যুদ্ধের চালক হিসেবে জিউসকেই প্রধান হিসেবে মনে হলেও শেষপর্যন্ত যুদ্ধের ভাগ্যনিয়ন্তা থাকেনি। দেবরাজ জিউসও সমগ্র মহাকাব্য জুড়ে দ্বিধান্বিত। সে কখনো ট্রয় পক্ষ, কখনো-বা গ্রিক পক্ষ অবলম্বন করে। একবার দেবতাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে, পরে আবার দেবতাদের খুশিমতো পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধে সামিল হতে বলে। এমনকি নিয়তিও যেন দেবতার হাতে নেই। জিউসের ইচ্ছানুসারে ট্রয় ধ্বংস হওয়ার কথা নয়। তবুও তা ধ্বংস হয়। প্রিয় সহযোদ্ধা প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যুর পর প্রতিশোধপরায়ণ একিলিস সম্পর্কে জিউস বলে, ‘তার সহযোদ্ধার মৃত্যুতে সে এমনি শোকাহত যে, সে নিয়তির বিধানকেও উপেক্ষা করে ট্রয়নগরীর ধ্বংস সাধন করবে।’ (হোমার, ২০০৮: ১৮৪)

 

একিলিসের মৃত্যু প্যারিসের তীরের আঘাতে হলেও, মিথে বলা হয় প্যারিসরূপী অ্যাপোলোই মূলত তাকে হত্যা করে। অথবা বলা হয়, প্যারিসের নিক্ষিপ্ত তীর অ্যাপোলোই একিলিসের গোড়ালি বরাবর চালনা করেছিল। হেকটরের মৃত্যুতে দেবী অ্যাথিনির চক্রান্ত দায়ী ছিলো।

 

মানে, ইলিয়াড মহাকাব্যের কাহিনির আগাগোড়ায় দেবতার সক্রিয় অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়। রামায়ণ কিংবা মহাভারতের যুদ্ধে দেবতাদের প্রভাব ও ভূমিকা থাকলেও ইলিয়াড মহাকাব্যের দেবতাদের মতো নির্লজ্জ অংশগ্রহণ সেখানে লক্ষ করা যায় না। দেবরাজ ইন্দ্র দান গ্রহণের ছলে কর্ণের বর্ম বা কবচ-কুণ্ডল নিয়েছিল বটে, তবে যুদ্ধে সরাসরি কোনো দেবতার অংশগ্রহণ সেখানে ছিলো না। কিন্তু ইলিয়াডে দেখা যায়, দেবতারা দুই দলে ভাগ হয়ে ট্রয়ের যুদ্ধে সামিল হচ্ছে। মহাভারতে মানবের গর্ভে জন্ম নেয়া কৃষ্ণকে দেবতার মর্যাদা দেয়া হলেও (যদিও মানুষের ধর্ম অনুসারে তাকেও মরতে হয়েছিল) ইলিয়াডে মানুষকে তেমন মহিমা প্রদানের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না।

 

আসলে প্রাচ্য মহাকাব্যে মানুষের ক্ষমতার তুলনায় দেবতাদের ক্ষমতাকে অনেক বড় করে দেখানো হয়েছে। কিন্তু ইলিয়াড মহাকাব্যে দেবতার ক্ষমতাকে আকাশচুম্বী কোনো কিছু ভাবা হয় নি। মানুষের সাথে তাদের প্রধান পার্থক্য এই যে, দেবতারা অমর আর মানুষ মরণশীল। এর বাইরে যে পার্থক্য, তা ধ্রুব নয়। অধিক ক্ষমতাধর অস্ত্রশস্ত্রসমেত সামরিক বাহিনির সাথে আমজনতার তুলনাটা এখানে দেয়া যেতে পারে। কখনো কখনো সামরিক বাহিনিও যেমন বলবান কিংবা চতুর কোনো সাধারণ মানুষের কাছে হেরে যেতে পারে, তেমনি ইলিয়াড মহাকাব্যেও কখনো কখনো দেবতারা মর্ত্যের যোদ্ধাদের কাছে হেরে যায়। যুদ্ধে ডায়োমিডাস দেবী আফ্রোদিতিকে বর্শা দিয়ে আঘাত করে এবং আঘাত পেয়ে দেবী চিৎকার করতে করতে পলায়ন করে। ‘ডায়োমিডাস তখন চিৎকার করে বললেন, শোনো দেবী, তুমি যদি আবার তোমার বিচরণভূমি ছেড়ে আমাদের যুদ্ধের ময়দানে নাক গলাতে আসো তাহলে তুমি কিন্তু রেহাই পাবে না। তোমাকে এমন শিক্ষা দেব যাতে ভবিষ্যতে যুদ্ধের কথা শুনে তোমার বুক ভয়ে কেঁপে উঠবে।’ (হোমার, ২০০৮: ৭৩)। ডায়োমিডাসের পরাক্রম রুখতে সেদিন অ্যাপোলোকে দেবতাদের অমরত্বের দোহাই দিতে হয়েছিল।

যে-সময়ের ঘটনা (খ্রিস্টপূর্ব তেরো শতক) ইলিয়াড মহাকাব্যে স্থান পেয়েছে, সে-সময়ে দেবতাদের মধ্যযুগীয় দেবতাদের মতো অতি দূরের অমিয় অলৌকিক ক্ষমতাধর কোনো সত্তা হিসেবে ভাবা হতো না। খ্রিষ্টপূর্ব এক হাজার বছর আগের সে সময়ে, শক্তি-সামর্থ্যে মানুষের চেয়ে তুলনামূলকভাবে উন্নত প্রজাতি হিসেবেই দেবতাদের কল্পনা করা হয়েছিল। পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, পত্নী-সহচরী ইত্যাদি সমেত দেবরাজ জিউসের পারিবারিক ঠিকুজির যে নমুনা পাওয়া যায়, দেবতাদের গোত্র-শ্রেণি বিভাজন, ভাগ-বাটোয়ারা, ঈর্ষা-ক্ষোভ-প্রতিহিংসাপরায়ণতা, ছলচাতুরীর আশ্রয়, নিজেদের মধ্যে মারামারি ইত্যাদির যে-বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে এমন অনুমান অসঙ্গত নয়। ইলিয়াড মহাকাব্যে দেবতাদের আচরণ ও কর্ম এ-কথাকেই সত্যতা দান করে। ক্রোনাস স্বর্গের প্রাচীন দেবতা ছিল; জিউস, পসেডন, হেডস ও হেরার পিতা। তাকে সিংহাসনচ্যুত করে জিউস রাজা হয় এবং হেরাকে বিয়ে করে। প্রাচ্য মিথে দেবতাদের সাথে দৈত্য-দানবের লড়াইয়ে দেবরাজের আসন কখনো কখনো ছাড়তে বাধ্য হওয়ার কথা জানা যায়, দেবতারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে এমনটা ঘটিয়েছে বলে জানা যায় না। ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়ে প্রসঙ্গক্রমে দেবতাদের সংবাদবাহিকা আইরিসকে পসেডন বলে —

জিউস হতে পারেন শক্তিশালী, তিনি যা করতে পারেন তার চেয়ে বেশি গর্ব করেন। সম্মানের দিক থেকে আমিও তাঁরই সমকক্ষ। আমাদের একই মায়ের গর্ভে জন্ম। স্বর্গ-মর্ত্য আমাদের তিন ভ্রাতার দায়িত্বে প্রদান করা হয়েছে। আমরা এটা নিয়ে ভাগ্য পরীক্ষায় নামলে আমার ভাগে পড়ে সমুদ্র, হেডসের ভাগ্যে পড়ে পাতালপুরী কিন্তু এই অলিম্পাস আর পৃথিবী সবারই যৌথ সম্পত্তি। তিনি যেন তাঁর নিজের অংশ নিয়েই খুশি থাকেন, আমার উপরে যেন তিনি কর্তৃত্ব করতে না আসেন। (হোমার, ২০০৮: ১৪৭)

ইলিয়াডে দেখা যায়, মানুষ তাদের বিপদে-আপদে ও প্রয়োজনে দেবতাদের শক্তি-সামর্থ্যের সাহায্য চাইতো। দেবতারাও তাদের রুচিমতো মানুষের পাশে দাঁড়াতো। গ্রিক পক্ষের যোদ্ধারা জিউসকে স্মরণ করলে সে তুষ্ট হয়ে তাদের পক্ষে যায়, আবার ট্রয় পক্ষ তাকে তুষ্ট করলে, ট্রয়পক্ষকেও সাহায্য করে। থেটিসের অনুরোধে দেবতা হেফেস্টাস একিলিসের জন্য বর্ম-ঢাল-বর্শা তৈরি করে দেয়, অ্যাপোলোর অনুরোধে তাতে ত্রুটিও রাখে। আবার রাজা প্রায়ামের পিতা লাওমিডনের কথায় প্রধান সমুদ্র দেবতা পসেডন ও অ্যাপোলো ট্রয়ের প্রাচীর নির্মাণ করে দেয়, অথচ ট্রয় যুদ্ধে গ্রিকপক্ষ অবলম্বন করে।

 

এই মহাকাব্যে দেবতাদেরকে অদৃশ্য সুদূরের বলে মনে করা হয়নি। স্বর্গকে উন্নত বিদেশ-বিভূঁইয়ের মতো মনে করা হয়েছে, যেটা আছে বলে অনুন্নত দেশের লোকেরাও জানে, কিন্তু চাইলেই যাওয়া যায় না, বিশেষ পাস লাগে, পয়সা লাগে। এই মহাকাব্যে দেবতাদের সাথে মর্ত্যের যোগাযোগ ছিলো সশরীরে, দৈববাণী বা অলৌকিক কোনো উপায়ে নয় (তবে যুদ্ধক্ষেত্রে সাহায্যের বার্তা দেবতারা কখনো কখনো ঈঙ্গিত বা ইশারায় দিয়েছে)। একিলিসের কাছে প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যুর খবর জিউসের কাছে থেকে নিয়ে পৌঁছে দেয় থেটিস। কাব্যের শুরুর দিকে আগামেমনন জোর করে একিলিসের বন্দিনী ব্রিসেইসকে নিয়ে যাওয়ার পর, একিলিসের মাতা থেটিস পুত্রের দুঃখ নিবারণের দাবি নিয়ে জিউসের কাছে যায়। একিলিসকে সে বলে, ‘অলিম্পাস পর্বতের শিখরে গিয়ে আমি দেবরাজ জিউসকে তোমার সব কথাই নিবেদন করব। কিন্তু বর্তমানে জিউস তাঁর সহচর অন্য দেবতাদের নিয়ে ইথিওপিয়াতে এক ভোজসভায় আমন্ত্রিত হয়ে গেছেন। বারো দিন পরে আসবেন তিনি।’ (হোমার, ২০০৮: ৪৬)। থেটিসের বিয়েতেও দেবতারা নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিল। মানুষের নিমন্ত্রণে দেবতারা সশরীরে উপস্থিত হতো। দেবতা ও মানুষের অলৌকিক দূরত্ব তখন ছিলো না। এটিও লক্ষণীয় যে, মানুষের মতোই দেবতা জিউসও নির্দিষ্ট সময়ের আগে ফিরতে পারবে না। এমনকি তাদের দৃষ্টিকেও সর্বত্রগামী ভাবা হতো না। ‍যুদ্ধদেবতা অ্যারেস ট্রয়যু্দ্ধ পর্যবেক্ষণ করার কালেও নিজ পুত্র এসকাফালাসের মৃত্যুকে দেখতে পায় নি।

 

রাগ-ক্ষোভ-ঈর্ষা নিয়ে দেবতারা এই মহাকাব্যে যেভাবে হাজির হয়েছে, তাতে কখনো কখনো মানুষের হীনম্মন্যতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। নানা ছদ্মবেশ ধরে উস্কানি দিয়ে তারা দুপক্ষের যোদ্ধাদের ভুল পথে চালিত করে, যুদ্ধকে প্রভাবিত করে। ষড়যন্ত্রে তারা ওস্তাদ। অর্থাৎ কোনো দেবতা যে-পক্ষ অবলম্বন করে, কেবল সে-পক্ষকেই সাহায্য করে না, তার সাথে বিপক্ষকে ছলনার দ্বারা পরাভূত করে। ট্রয়ের যুদ্ধ মানুষের হলেও ইলিয়াড মহাকাব্যে যু্দ্ধটা যেন দেবতা ও মানুষের। প্রিয় সহযোদ্ধার মৃত্যুর পর একিলিস তার মায়ের কাছে ‘দেবতা  ও মানবের মাঝে জেগে উঠা এই লড়াইয়ের অবসান’ (হোমার, ২০০৮: ১৭৫) চেয়েছিল। যুদ্ধের সাথে দেবতারা এতটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছিল যে, এক দেবতা অন্য দেবতাকে শারীরিক আঘাত করতেও ছাড়ে নি।

 

এমনকি মর্ত্যের যোদ্ধাকে অন্য দেবতাকে আঘাত করতে প্রলুব্ধ করেছে। অ্যাথিনির কথায় ডায়োমিডাস আফ্রোদিতিকে ও অ্যারেসকে বর্শা দ্বারা আঘাত করেছিল। আবার দেবতাদের নিজেদের মধ্যকার ঝগড়ায় অ্যাথিনিকে তাক করে বর্শা নিক্ষেপ করে যুদ্ধদেবতা অ্যারেস। তা বিফল হলেও অ্যাথিনির ছোঁড়া পাথরের আঘাতে কুপোকাত হয় অ্যারেস। তাকে বাঁচাতে এসে অ্যারেস পত্নী আফ্রোদিতিও নাজেহাল হয়। তাকে সজোরে বুকে আঘাত করে অ্যাথিনি। সবচেয়ে বেশি ঈর্ষাকাতর, রাগী ও শক্তিশালী দেবী মনে হয় হেরাকে। হেরা জিউসের পত্নী। স্বামীর সাথেও সে ছলনা করে। সাজসজ্জায় মোহিনী হয়ে মিথ্যা কথায় জিউসকে ভুলিয়ে কামতাড়িত করে শেষে নিদ্রাদেবীর সহায়তায় ঘুম পাড়িয়ে দেয়। পরে এই চক্রান্ত জিউস বুঝতে পেরে ক্রোধান্বিত হলে হেরা মিথ্যাচার করে বলে, ‘আমি টাইফা নদীর পানি স্পর্শ করে আমাদের দাম্পত্য শয্যার নামে শপথ করে বলছি, পসেডন আমার কথায় গ্রিকদের সহায়তা করে ট্রয়বাসীর ক্ষতিসাধন করেনি।’(হোমার, ২০০৮: ১৪৫)। দেবতাদের সাথে মারামারিতে সে অরণ্যদেবী আর্টেমিসের তীর-ধনুক কেড়ে নিয়ে ধনুক দিয়ে আঘাত করেছিল।

 

সমগ্র মহাকাব্য জুড়েই দেবতারা হাজির থেকেছে। তাদের আচরণ ও ভূমিকা মানুষের চেয়ে বিশেষ কোনো দিক দিয়ে যে আলাদা, এই মহাকাব্যে অন্তত তেমনটি দেখানো হয় নি। অমরত্বের মহিমা ছাড়া দেবতার আলাদা মহিমা নেই। তাদের সীমাবদ্ধতা সুস্পষ্ট হয়েছে এই কাব্যে। কাব্যের শেষদিকে এসে ট্রয়বাসীর থেকে জিউসের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কারণ হিসেবে হোমার জানান, ‘কারণ তিনি এটা ভালো করেই জানতেন যে, কোনো দেবতাই গ্রিক কিংবা ট্রয়দের সহায়তা প্রদান করতে পারবে না।’ (হোমার, ২০০৮: ১২৭)। প্যারিস যেমন বলে ‘মানুষ ইচ্ছে করলেই সব করতে পারে না, কারণ মানুষের শক্তিরও সীমাবদ্ধতা আছে’, (হোমার, ২০০৮: ১৩৬) এই মহাকাব্যে দেবতাদের প্রসঙ্গেও এ-কথা সমান সত্য। আসলে সেসময়ে দেবতাকে মানব প্রজাতি থেকে সুদূরের বলে ভাবা হতো না। অমরত্বের মহিমাই তাদের বিশেষ গুণ, যা মানুষ থেকে তাদেরকে আলাদা করেছে। এই বৈশিষ্ট্য ব্যতীত দোষগুণে মানুষের সমান্তরালেই দেবতার কল্পনা করা হয়েছে।

 

মূল গ্রন্থ

হোমার (২০০৮)। দ্য ইলিয়াড (খুররম হোসাইন অনূদিত)। ফ্রেন্ডস বুক কর্নার, ঢাকা।

1 COMMENT

  1. ইলিয়াডের দেবীদের নিয়ে এতটা মানবিক বিশ্লেষণ অন্য কোথাও নেই।ধন্যবাদ, প্রিয় স্যার(সঞ্জয় বিক্রম), ????

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here