দশকী বিভাজনে রায়হান শরীফ শূন্য দশকের কবি। তাঁর কবিতা সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধির কবিতা। ভাষা নিয়ে তাঁর কোনো শুচিবায়ুগ্রস্ত ভাব নেই। কবিতাগুলোকে উঠে এসেছে আমাদের সমকালের চিহ্ন।
দিনযাপন
হাত পিছলে ভেসেছিল যেই তরী
পাল হয়ে এলো অনিকেত শর্বরী।
আকাশের বুকে একলা নিশুতি জ্বলে
জলে ভরেছে চরাচর পলে পলে।
দিক ভেসে যায় এমন প্রেক্ষাপটে
পাখির চোখে একেকটা দিন রটে।
মাছের শেষ নাচ হয়েছে তখন ফিকে
গেঁথেছে জলের প্রথম বড়শিকে।
আমার দিগন্তে রোদের পাহাড় নামে
সবুজ ঘাতক এসেছিল নীল খামে।
প্যান করে যেই বিস্তারে হাত রাখি
আমার সারা গা পতঙ্গে মাখামাখি।
রাত্রির আখ্যান
১. প্রশ্ন
ডানা ঝাপটে ত্রস্ত দিন-রাত।
রুপোর জরি ছিঁড়ে ফেলে ফ্রেমের আকাশ ।
সিথানে নেমে আসে
কতশত রাত্রি পেরিয়ে।
বেদনার সূচে এফোঁড় ওফোঁড় ফুলশিশুরা,
ফিরে কেন যেতে চাও কীট ও ক্লীবত্বের জোনাক-বাগানে?
২. বিলাপ
ভাঁজ করে রাখি দিন ও রাত
নিরাপদে কাটা নোখে।
তাকিয়ে বিদ্রূপ খলবলিয়ে
নাইলোটিকা চোখে?
স্মৃতি-বিস্মৃতির রেণুকণাগুলো
রেখে দিই ছায়া পথে।
কত লক্ষ আলোকবর্ষ পরে
ঝরবে তোমার ক্ষতে?
আকাশভরা জোছনার ভার
চাপা দিল কিছু ঘাসফুল।
রেখে ঢেকে রাখি তাও কেন এত
লাফিয়ে ওঠে ভুল?
৩. রহস্য-গল্প
রাত এক জটাধারী মৌন মুনি-ঋষি
ইশারার ইসকুলে মুগ্ধতার আতর।
নিদ্রা যেন টের পায় তোমার স্বরাজ
জেগে থাকে একরোখা বিদ্রোহী আত্মারা।
হেস্তনেস্ত হবে ভেবে অনুত্তরগুলো
মাথায় পট্টি বেঁধে ঘোরাফেরা করে।
কতটা অজানার ভারে নত হওয়া ভাল
সেই প্রশ্নে সারারাত মুলামুলি চলে।
কতটা অতৃপ্তির খাদে তৃষ্ণা-নদীর জল
গভীর ও বহতা থাকে সে হিসেব চলে।
৪. কাফেলা
নিশুতি রাত বা নিদাঘ দিন
আলোছায়া ভোর, দ্বিতীয় প্রহর —
সব মিলে একটিই মর্মরধ্বনি।
এই ধ্বনি নিয়ে যায় এক প্রত্ননগরীতে — হরপ্পা বা উয়ারী বটেশ্বর বিনা নোটিসে চলে আসে আমাদের চিরচেনা অলিগলিতে। এখানে ওখানে পোঁতা আছে বাক্স-পেটরা-বন্দি কিলবিলে গোখরো। স্মৃতির কবাট খোলা।
এদিকে তাকাও এক ছোবল,
ওদিকে আরেক ছোবল।
রক্ত পড়ে, টুপটাপ বৃষ্টি পড়ে।
ক্ষরণ নিয়ে জলজ্যান্ত মানুষ দিনদিন আরো অচেনা হয়ে ওঠে।
সবাই মিলে যাচ্ছে এক মহাকাফেলায় ভোজ উৎসবে —
কেউ কারুকে চিনে না, নাম জানে না।
৫. দ্রবণ
রাত্রি — গভীরতার এক মোহন দ্রবণ,
ছুঁতে চায় জল আমার ভেতর,
অবাক চোখের এ মাইলস্টোন!
ঈডিপাস
পৃথিবীর চোখে চোখ রেখে দাঁড়াই যেই অসীম সাহসে,
তুমি তার প্রস্তুতিটুকু দেখে ফেলো!
বুঝে ফেলো সমুদয় মুখ ও মুখোশ।
আমার দৃষ্টিতে থাকে দেবদারুর ছায়া,
তাও সূর্যে পোড়াও তোমার চোখ!
তোমার নিয়তি তোমাকে এই বর দিয়েছে।
তোমার মুক্তি নেই…
আনবাড়ি
অভ্যাস পাল্টেছে বিবর্তনের সূত্রেই
এই যেমন হুটহাট দরজা জানলা খোলা রেখে
মানুষ চলে যায় অন্য বাড়ি দুম করে।
জানলায় সাজানো ক্যাকটাস
বাইরে বারবিকিউ কোলাহল!
লনে লনে ছড়ানো বিষ পরিমিত মাত্রায়!
হুড়মুড় অভিযাত্রীরা হলুদ মোজা পরে
কোথায় যায়, কেন যায়?
জানলায় সাজানো অ্যালোভেরা
বাইরে কংক্রিটের সলিড হাতছানি
পথে পথে লিফলেট ছড়ানো আছে শান্তির!
শশব্যস্ত অভিযাত্রীগণ অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে
কত উঁচুতে উঠবে আজ, নামবে কি?
জানলায় সাজানো স্যালভিয়া
বাইরে টিপটপ বিপণী বিতান
দমে দমে ছড়ানো আছে রোমাঞ্চ!
অস্থির অভিযাত্রীরা সুভেনির হাতে
কোথায় ফেরে, কেন ফেরে?
অভ্যাস পাল্টেছে বিবর্তনের সূত্রেই
এই যেমন হুটহাট দরজা জানলা খোলা রেখে
মানুষ চলে যায় অন্য বাড়ি দুম করে, যাবেই তো!
প্রশ্ন
এত আলো ঝলমল উৎসবের সন্ধ্যায় তুমি আমাকে একা ফেলে যাও কেন? ভাস্কর্যের মত স্থিরতায় ধাক্কা লেগে শহরে বেজে ওঠে এক মায়াময় সিম্ফনি! অজস্র শব্দপুঞ্জের ভেতর এক ঝাঁক পাখি ডানা ঝাপ্টাচ্ছে। তুমি দূরে কোথাও তার চিহ্ন কুড়োচ্ছো তড়িঘড়ি। আমার কাছে এখানটায়, এই ভাস্কর্যের পাদদেশে কিংবা সুদূর ওই অলীক মেঘমালার নিচে ধ্বনির যে বিস্তারণ — সে সব মিলে এক দৃশ্যকাব্য। এখানে আদি-ভৌতিক সব দৃশ্যে আর ওখানে কুহক ধ্বনিতে আমাদের চির দ্বীপান্তর! আমরা আমাদের একলা ফেলে কোথায় যাই?
একটা নিস্তব্ধ রাতে তুমি আমার মধ্যে বাজতে থাকো — যেন হাজারটা ঝিঁঝিঁ ডাকছে তারস্বরে একটানা। আমাদের কসমিক শূন্যতা নিয়ে আমরা এখানে-ওখানে, মানুষের ব্যস্ত ছায়ায় জবুথবু দাঁড়াই। শিশুর পেলব ত্বকে রোদ পড়ে মায়াবী হয়ে ওঠে পড়ন্ত বিকেল। ঠোঁটে বয়ে আনে খাদ্যকণা সাবধানী চড়ুই। ধুলোর আস্তরে ঢেকে যায় রঙিন জারুল। এই সব মোহন কোলাজের ভেতর আমিও রয়েছি মিশে ছোপ ছোপ হলুদ, সবুজ।
দৃশ্যকাব্যের পার থেকে, আলোর পরিখা ছেড়ে, জনস্রোতের ঢেউভেঙে, নীল-সাদা আকাশের ভাসমান তুলোর মেঘের নীচে আমাদের কবে কখন দেখা হয়, মুনিয়া? জল ফেলে গেছে ঝড়, পাতা রেখে গেছে ঘূর্ণি, ছায়া মেঘ, একটা গভীর দাগমাটিতে রেখে গেছে ছিমছাম কোশা নৌকা; মুনিয়া, আমরা আমাদের একা ফেলে কোথায় যাই, কেন যাই?
নদীর অতল তলে জলের শব্দ কেমন? বুকের গভীরে থিতিয়ে পড়া আঁধার? পড়ো বাড়ির বন্ধ কবাটের ওপাশে দেয়ালে দেয়ালে কথার কারুকাজ। প্রাচীন সিন্দুকের ঢাকনা খুলে কেউ দেখেনি কি লেখা ছিল অমোঘ বাণীর মত। সারাদিন-রাত মাইম করে কেন ভুলে গেলাম তোমাকে বলার মতো কথা? তোমাকে দেখার চোখ? তোমার পাশে হাঁটার অনায়াস মুদ্রা। আমরা আমাদের অনেক অগোছালো করে কবে আর মিশে যাবো কোন এক মেঘমেদুর প্রশ্নমুখর সন্ধ্যায়? এত এত স্বপ্ন ছেড়ে,আশ্বাস ছেড়ে, নিজেদের নিজস্ব উড়াল ছেড়ে, আমাদের যৌথতা ছেড়ে, আমরা কেন যাই, মুনিয়া? আমরা আমাদের একা ফেলে কোথায় যাই?