বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য ।। কিস্তি : ৪

গীতা দাস একজন সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মী। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকায় তার কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ছোটগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখবেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে। আজ প্রকাশিত হলো কিস্তি ৪

চাকমা ছোটগল্প গ্রন্থ অজগর

বিপম চাকমার রচিত অজগর ছোটগল্প গ্রন্থের বাকি পাঁচটি গল্প পর্যালোচনা করে সুপারিশের মাধ্যমে চাকমা নৃগোষ্ঠীর দ্বিতীয় ভাষায় রচিত ছোটগল্প বিষয়ক পর্যালোচনার পরিসমাপ্তি করা হবে এই পর্বে।

 

ইঁদুর

বইটির ষষ্ঠ গল্পটির শুরু একটা চমক দিয়ে, ‘ইঁদুরটার মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছিল। তাকে খাঁচা-ফাঁদে আটকানোর উদ্দেশ্য ছিল মেরে ফেলা। কিন্তু সে বেঁচে গেল।’ (চাকমা, ২০১৭, ৪২)। অর্থাৎ অবশেষে মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হয়। কারণ বুদ্ধের শিক্ষা — ‘পাণাতিপাতা বেরমণী সিকখাপদং মমাদিযামি।’ (চাকমা, ২০১৭, ৪২)। গল্পে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র প্রীতিময়ের প্রেম, শিক্ষা, চাকরির পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল খাটা, প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে, দুর্নীতিতে পারিপার্শ্বিক প্রভাব, বিয়ে সম্পর্কিত ধারণা ও পারিবারিক ভূমিকা, ধর্মীয় আচরণ – এ সকল বিষয়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্রেরই প্রতিফলিত হয়েছে, তবে চরিত্রের অবস্থান লেখকের নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ।

 

লেখক হয়ত নিজের এ গণ্ডি থেকে বের হতে চাননি। প্রীতিময় নিজের শুভবুদ্ধিতে চাকরির পরীক্ষায় প্রক্সি না দেয়ার পক্ষে থাকলেও বাবাসহ পারিপার্শ্বিকতার চাপে মামাতো ভাইয়ের জন্য প্রক্সি দিতে গিয়ে সে জেল খাটে। জেল থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরেই টের পেলো– ‘ক্যাম্পাসে যখন ফিরল রুমের দরজা খোলার সাথে সাথে তিন মাসের বদ্ধ অনভ্যস্ত হাওয়া তাকে চেনে না বলে জানল।’ (চাকমা, ২০১৭, ৪৮) লেখক জেলখাটা লোকের সাথে সামাজিক অসহযোগিতার ইঙ্গিত ‘হাওয়া’র মাধ্যমে প্রতীকীভাবে এঁকেছেন। বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চায় জেলখাটা লোক সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের চিরাচরিত বহি:প্রকাশ ঘটেছে।

 

বুদ্ধদেবের শিক্ষায় ইঁদুরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া থেকে বিরত থাকা প্রীতিময় জেল থেকে বের হয়ে দেখে– ‘একটা ইঁদুর তার মূল্যবান সব সার্টিফিকেট কুচি কুচি করে কেটে নরম গদির বিছানা বানিয়ে আঙুলের ডগার সমান ছয়টা গোলাপী রঙের বাচ্চা দিয়েছে। ইঁদুর সম্পর্কে মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বীভৎস বোধটা তার মধ্যে আবার ফিরে এল। সাথে মনঠেঙানো বিদ্বেষ। তার ইচ্ছে হল পায়ের তলে সবকটাকে একেবারে পিষে ফেলে। কী ভেবে ফাইলটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।’ (চাকমা, ২০১৭, ৪৮) এখানে প্রীতিময়ের শুভ ও অশুভ চেতনার দ্বন্দ্ব। পরে মনের কোণে শুভবুদ্ধির উদয় হলেও অশুভ শক্তির কাছে পরাজিত হয়। যদিও আজন্মের শিক্ষা ছিল– ‘পাণাতিপাতা বেরমণী সিকখাপদৎ সমাদিযামি। অর্থাৎ প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।’ (চাকমা, ২০১৭, ৪২) তবে ‘ছানাগুলো কুড়িয়ে এনে মা ইঁদুরের কাছে ফিরিয়ে দেবে ভাবতে ভাবতে প্রীতিময় রুমের বাইরে পা ফেলতেই দেখতে পেল কয়েকটা কাক ছানাগুলোর উদ্দেশ্যে মেহগিনি গাছের ডাল থেকে ড্রাইভ দিয়েছে।’ (চাকমা, ২০১৭, ৪৮) কাজেই ইঁদুর ছানাদের আর রক্ষা করা যায়নি। চারদিকের অশুভ শক্তির মধ্য থেকে শুভ শক্তিকে ধারণ-লালন-অনুসরণ করা কঠিন; মানবজীবনে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার এই নেতিবাচক প্রভাব গল্পটিতে অঙ্কিত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনপদে সামরিক বাহিনীর অত্যাচার, বহিরাগতদের আগ্রাসন, প্রকৃতি ধ্বংস, নতুন বেনিয়াদের ভূমি দখল, সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষমতার অপব্যবহার – এসব বিপম চাকমার গল্পের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

পিনোনহাদি

বই এর এ সপ্তম গল্পটিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের শ্রেণি বৈষম্যের কাহিনি চিত্রিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর প্রতি পাক আর্মিদের অবস্থানেরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পাক আর্মিদের হাত থেকে রক্ষা পেতে এক তথাকথিত অভিজাত চাকমা নারীর বাঙালি পোশাক শাড়ি বর্জন করে নিজ সংস্কৃতিতে প্রত্যাবর্তন করার ঘটনা এ গল্পের প্রতিপাদ্য। চাকমা পোশাক পিনোন (চাকমা মেয়েদের নিম্নাঙ্গের) এবং হাদি (বক্ষবন্ধনী হিসেবে ব্যবহার্য কাপড়) সংগ্রহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গল্পের ঘটনা আবর্তিত। পাক আর্মিদের কাছে নিজের অবস্থানকে চাকমা হিসেবে প্রতিভাত করার জন্য তালুকদার গিন্নি শেষ পর্যন্ত ছলে-বলে-কৌশলে চাকমা পোশাক অন্যের কাছ থেকে রীতিমত ছিনিয়ে আনে। এই ঘটনার মাধ্যমে গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। লেখক গল্পের শেষ বাক্যটিতে শ্রেণি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য একটা সংলাপে প্রকটভাবে চিত্রায়িত করতে সক্ষম হয়েছেন। গল্পে পেটিবুর্জোয়াদের ভূমিকা রাখা তালুকদার গিন্নি, জোর করে অন্যের জন্য বোনা পিনোন-হাদি নিয়ে আসার সময়– ‘তিনি মনে করলেন, বাদি মিলা মা বুঝি ভয় পাচ্ছে, পাছে সোভাগ্য লালের বউ না আবার তাকে চোর সাব্যস্ত করে। তাই তিনি সান্ত্বনার সুরে বললেন—না না তোকে চোর বলবে কেন? তোর যে চুরির কোন অভ্যাস নেই একথা আমরা কি সবাই জানি না? বলবি ডাকাতি হয়ে গেছে। তোর তো ডাকাত হওয়ার শক্তি বা সামর্থ কোনটাই নেই, নাকি?’ (চাকমা, ২০১৭, ৫৩)

 

তথাকথিত অভিজাতদের নিজ সংস্কৃতির অবহেলা সুখকর না হলেও চিরচরিতভাবেই নিজস্ব কূটকৌশলে তা উতরে যায়। পোশাক সংস্কৃতির অংশ। নিজস্ব পোশাক পরিধান করতে বাধ্য হবার প্রেক্ষাপট নেতিবাচক হলেও গুরুত্বটি লেখক ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছেন। সংখ্যালঘুদের মধ্যেও শ্রেণিগত অবস্থান অধঃস্থিত সংখ্যালঘুর জীবনকে যে আরও অতিষ্ঠ করে তোলে তা গল্পটিতে স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে। এ গল্পে কয়েকটি চাকমা শব্দের ব্যবহার ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। শব্দগুলো বাংলা ভাষায় সংযোজিত হলো। যেমন- পিনোন ও হাদি হলো পোশাকের নাম। চাকলা বলতে বোঝায় এলাকা। বাড়ির সামনে সম্প্রসারিত বাঁশের মাচার নাম ইজোর, যা রাঙামাটিতে প্রায় বাড়িতেই রয়েছে।

 

কুত্তামারা মেজর

বইটির অষ্টম গল্পের নামটি থেকেই এর উপজীব্য বোঝা যায়। কুকুর নিধন নয়, কুত্তামারা। একেবারে স্থানীয় জনপদের মুখের ভাষার গন্ধভেজা গল্পের শিরোনাম। গল্পটি এক মেজরের কাণ্ডকাহিনি নিয়ে লিখিত। পাহাড়ি জনপদে মেজরের এক অপারেশনে ‘কুত্তা’ বাধার সৃষ্টি করেছিল এবং এজন্য মেজর গুরুতর আহতও হয়। পরবর্তী সময়ে প্রতিশোধ নিতে মেজর কুকুর নিধন অভিযানে নামে। জয়মনির শিশুসন্তানের কুকুর ছানার প্রতি অসীম ভালোবাসা। এবং এই ভালোবাসার দাম দিতে গিয়ে জয়মনিকে অনেক ভুগতে হয়। আর শিশুসন্তানের মানসিক সুস্থতার জন্য জয়মনির স্ত্রীকে মেজরের পোশাকের রঙের পিনোন পরা বন্ধ করতে হয়।

 

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যেক নৃগোষ্ঠীর বিশেষ নকশা ও রঙের পোশাকসহ নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশের মতো এখানেও সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা দুরূহ। গল্পের ‘অজগর সদৃশ পোশাকে কিছু লোক স্থানে স্থানে অস্ত্র হাতে, কেউবা বসে, কেউবা দাঁড়িয়ে আছে।’ (চাকমা, ২০১৭, ৫৯)। এই বাক্যটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা সদস্যদের উপস্থিতি নিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতার উদাহরণ। এখানে ইঙ্গিতে অজগরের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিচয় বর্ণিত হয়েছে। ‘জয়মনির শরীরের ঘা শুকিয়ে গেলো কিন্তু তার ছেলেটার দেখা দিলো নতুন একটা উপসর্গ, কালো কিংবা কালো-ডোরাকাটা কোন কিছু দেখলেই এখন আঁতকে ওঠে। ফলে গাঢ় নীল আর কালো রঙের সুতো দিয়ে বোনা তার মায়ের নিম্নাঙ্গে পরনের সব কাপড় অর্থাৎ পিনোনগুলো ঝোলায় ভরে তুলে রাখতে হয়েছে।’ (চাকমা, ২০১৭, ৬০)

 

গল্পটি এখানেই শেষ হলে গল্পের মাধুর্য ও সৌন্দর্য বজায় থাকতো। ছোটগল্পের ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ আমেজটি বহমান থাকত। নিজস্ব সংস্কৃতির নকশা করা পিনোন পরতে পারবে না, এ বেদনাবোধই মন ছুঁয়েছিল। লেখক হিসেবে তাঁর নির্মোহতাও বজায় থাকত। কিন্তু পরে যুক্ত করেছেন আরও দুটি বাক্য ‘জয়মনি চিন্তা করতে লাগলো সারা জীবনের জন্য তার স্ত্রীর পিনোন পরা কী বন্ধ হয়ে গেল? সে তো শাড়ি পরতে জানে না।’ (চাকমা, ২০১৭, ৬০) শাড়ি পরা প্রসঙ্গ টেনে অন্য একটা নৃগোষ্ঠীর প্রতি টিপ্পনির প্রয়োজন ছিল না। তবে অন্যভাবেও বিষয়টি দেখা যায়। এ যেন লেখকের লেখনির মাধ্যমে সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতির উল্লেখ করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের শাব্দিক প্রতিশোধের প্রয়াস। গল্পে আলংকারিক বাক্য ‘বুকের ভেতরটা অপরাধবোধের মাঝারি কুয়াশায় ঢেকে গেল।’ (চাকমা, ২০১৭, ৫৭) পড়ে পাঠক নিজের মনেই কুয়াশায় ভেজার স্পর্শ পায়।

 

চাচার জীবনের শেষ দুঃস্বপ্ন

বইটির নবম গল্পটির সারমর্ম এইরকম। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে চাচার মন খারাপ। কিন্তু এ দুঃস্বপ্নের কথা কাউকে জানাতে পারেননি। চাচা প্রায়শই বিভিন্ন মিটিংয়ে যেতেন। গ্রামের যে কোনো মিটিংয়ে চাচার জন্য একটা সম্মানিত স্থান ছিল। দুঃস্বপ্ন দেখার পরদিন মেজর সাহেবের মিটিং ছিল। কিন্তু চাচা ঐ মিটিংয়ে গিয়ে অন্যান্য গ্রামবাসীর সাথে হত্যার শিকার হন। তার দুঃস্বপ্নের কথা আর জানা হয় না। গল্পের উত্তম পুরুষটিকেও এখন মাঝে মাঝে মিটিংয়ে যেতে হয়। তাই চাচার দুঃস্বপ্নের বিষয়টি তার মধ্যে চোরা আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

 

গল্পটি পড়ে বোঝা যায় এ দুঃস্বপ্ন ঘুমের মধ্যে আসেনি। জাগরণে ও সচেতন মানসে এর বসবাস। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সময়ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৩২টি অস্থায়ী সেনাক্যাম্প ছিল। প্রতিশ্রুতি মতো ‘জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসারসাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিনজেলা সদরে এবং আলীকদম, রূমা ও দীঘিনালা) ব্যতিত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ীনিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময়-সীমা নির্ধারণ করা হইবে।’ (পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সহিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির স্বাক্ষরিত চুক্তি, ১৭। (ক), ১৯৯৭) অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাক্যাম্পের শক্তিশালী, দুঃসহ ও সহিংস অবস্থান দাপ্তরিক ও ঐতিহাসিক সত্য। এ সত্যকে ভিত্তি করেই কোনো একটা সহিংস ঘটনার করুণ বয়ান পাওয়া যায় এ গল্পে।

 

দুঃস্বপ্নকে চাচা স্বপ্ন ভাবতে চাইলেন। মেজর সাহেবের মিটিংয়ের ইতিবাচক পরিণতির আশা জাগানিয়া ভাবনা থেকেই হয়তোবা দুঃস্বপ্নকে স্বপ্ন ভাবা। যদিও দুঃস্বপ্ন শেষ পর্যন্ত জীবনের শেষ দুঃস্বপ্নই ছিল। ঐ জনপদের চাচার মতো সচেতন শিক্ষিতরা ভালো করেই জানেন যে মেজর সাহেবের মিটিংয়ে যাওয়া মানেই অমঙ্গলের ইঙ্গিত ও দুঃস্বপ্ন। এর আভাস চাচিও জানেন বলে দুঃস্বপ্নের কথা শুনতে চাননি এবং মিটিংয়ে যেতে মানা করেছিলেন। উনিও জানেন মিটিংয়ে ভীতিপ্রদ কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু মেজর সাহেব প্রত্যেক ঘর থেকে একজন করে যাওয়ার আদেশ দিয়েছেন। এ আদেশ উপেক্ষা করার উপায় নেই।

 

পুরো গল্প জুড়েই পাহাড়ি জনপদের জনজীবনের দৈনন্দিন যাপিত জীবনের ছাপ। ‘বাড়ির ছেলেমেয়ের দল ছোট ছুড়ি শুটকী দিয়ে মরিচ ভর্তার সাথে লোহার কড়াইয়ে গরম করা কড়কড়া ভাত খেতে চাচার সাথে বসে গেলাম।’ (চাকমা, ২০১৭, ৬২) কাঁচা মরিচের ভর্তা পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর উপাদেয় একটি খাবার। খাদ্যাভাসের এ উল্লেখ, ছড়ার পানিতে গোসল করা, শুঁটকির মৌ মৌ গন্ধে মুখরিত পরিবেশ, মেজাঙ, ভাতজরা বান ফুল, বিজু, নাগেশ্বর ফুল, সাতদিন্যার শ্রাদ্ধ – এসব পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিচিত পরিবেশের প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র। গল্পের শেষে টীকাতে মেজাঙ শব্দটির ব্যাখ্যা রয়েছে এবং বাংলা ভাষার ভাণ্ডারে মেজাঙ শব্দ যুক্ত হলো। ‘মেজাঙ মানে বাঁশের বেত দিয়ে তৈরি টি টেবিলের মত আসন যেখানে বাসন তুলে ভাত খাওয়া হয়।’(চাকমা, ২০১৭, ৬৮)

 

পিতৃত্ব

বইটির শেষ গল্প ঐতিহাসিক ঘটনাকে ভিত্তি করে লোকশ্রুতিমূলক নৈতিক শিক্ষার গল্প। আঙ্গিকের দিক থেকে এটি একটি উপরূপক (Parable) গল্প। রাজার ছেলে রাজাকে বন্দী করে রাজা হয়। পরে নিজের ছেলে হওয়ার পর বাবার কদর বুঝতে পারে। ‘সন্তান বুঝি পিতার কাছে এমনই প্রিয়। একথা চিন্তা করে অজাতশত্রুর মনের মধ্যে চরম অপরাধ বোধের জন্ম হল।’ (চাকমা, ২০১৭, ৮০) কিন্তু রাজপুত্রের মধ্যে শুভ বোধ জাগলেও সংশোধনের আর সময় ও সুযোগ পায়নি। ইতোমধ্যে রাজা মারা যায়।

 

এ গল্পের ভাষাও অন্য গল্প থেকে আলাদা। যেমন : ‘নারী ও সিংহাসন/ এ দুয়ে অপেক্ষা/ মুর্খের দর্শন।’ (চাকমা, ২০১৭, ৭৬) অথবা ‘তরুণ বলেই সে এখনও জীবন ও পৃথিবী সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। তাকে মুগ্ধ করে প্রথমে মস্তকাবরণী (টুপি) হয়ে মাথায় বসা, তারপর মাথার খুলিতে রূপান্তরিত হয়ে মগজ দখল করে নেয়া।’ (চাকমা, ২০১৭, ৭৫) কিংবা শিক্ষাগুরু উপদেশ, ‘শান্ত মন নিয়ে সত্যকে আলিঙ্গন করতে হয় জান না?’ (চাকমা, ২০১৭, ৭৭) চাকমা ভাষায় এ ধরনের লোকগল্প রয়েছে। বিশ্বসাহিত্যে কাফকা ও বোহের্স এ ধরনের উপরূপক লিখেছেন।

 

*   *  *

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনপদে সামরিক বাহিনীর অত্যাচার, বহিরাগতদের আগ্রাসন, প্রকৃতি ধ্বংস, নতুন বেনিয়াদের ভূমি দখল, সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষমতার অপব্যবহার – এসব বিপম চাকমার গল্পের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর মনের উপরে কারফিউ দেয়া পরিস্থিতির সফল রূপকার। বইটিতে ‘পিনোন-হাদি’ গল্পের তালুকদার গিন্নি ছাড়া সক্রিয় ও বলিষ্ঠ অন্য কোনো নারী চরিত্র নেই; যে চরিত্র গল্পের প্রকৃতি বিন্যাসে কোনো ভূমিকা রেখেছে। তালুকদার গিন্নি জৈবিক পরিচয়ে নারী হলেও তথাকথিত অভিজাত শ্রেণির প্রতিভূ হিসেবে কাজ করেছে। আর ‘মাটি’ তো সম্পূর্ণরূপে নারী চরিত্র বর্জিত গল্প। বিপম চাকমার অভিজ্ঞতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জীবনযাপনে নারীর ভূমিকা, অবস্থা ও অবস্থান যেন জড় পদার্থের মতো। নারীদের যেদিকে টানা হয় তারা সেদিকে যায়, যেখানে ফেলে রাখে সেখানেই থাকতে অভ্যস্ত, যেমন করে রাখে তেমন করেই থাকে। নারীদের এ অবস্থানে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু, বাংলাদেশের, পৃথিবীর সব নারীই সমগোত্রীয়! বিপম চাকমাকে সংখ্যালঘু নারীর নিজস্ব সত্ত্বা প্রকাশে সক্ষম কোনো চরিত্র সৃষ্টিতে ভবিষ্যতে আগ্রহী হওয়ার আহ্বান করা যেতে পারে। অজগর বইয়ে ‘ইঁদুর’ ও ‘পিতৃত্ব’ গল্প দুটি ছাড়া বাকি গল্পগুলোতে নিজ জনপদের সমস্যা, অবিচার, অসহায়ত্ব বিস্তৃত পরিসরে প্রকাশ করার তাগিদ ও বেদনা থেকেই যেন এ সাহিত্য রচনা।

 

আদি ব্যবস্থায় যারা জীবন-যাপন করে তাদের কিছু বিশ্বাস, প্রথা, সংস্কার, মতভেদে কুসংস্কার, সামাজিক রীতিনীতি রয়েছে যা ঐ জীবনের প্রতি বিশ্বস্ত ব্যক্তিমাত্রই অস্বীকার করতে পারে না। এ বিষয়ে নিজস্ব সমাজ ও সংস্কৃতি সচেতন ব্যক্তি বিপম চাকমার লেখায় সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের প্রকাশ পাওয়া যায়। তিনি নির্মোহভাবে বিশ্বাস, প্রথা, সংস্কার ও কুসংস্কারের উৎস খুঁজেছেন এবং অনেক সময় এসব উঠে যাওয়ার যৌক্তিক কারণও ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন- কুঞ্জবালার বিয়ের পর জুমের উপর দিয়ে হাতি চলে যাওয়া নিয়ে ‘সবার মনে একটা দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, কুঞ্জবালা ভাগ্যবতী। সুতরাং বাবা-মা,পরিবারের সমস্ত কাজই কুঞ্জবালার হাত দিয়েই সূচনা করা শুরু করলেন। কুঞ্জবালার স্পর্শ ছাড়া যেন কিছুই পূর্ণতা পেত না। পরিবারের ইতিহাসে ১৫ বছরের মধ্যেই বিশ্বাসটা প্রথায় পরিণত হয়।’ (চাকমা, ২০১৭, ১৪) কোকিলের কুহু ডাককে লোকজন উ-হু ভেবে জলবসন্তের প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী করে কোকিল নিধন করে। ‘কোকিল জাতের সৌভাগ্য বলতে হবে যে এই জন্য যে, ঘটনাটা অনেক বেশি আধুনিক কালের ফলে জল বসন্তের প্রাদুর্ভাবের সাথে লোকজনের কানে শোনা কোকিলের ‘উহু’ ডাকের অদৃশ্য সম্পর্ককে ঘিরে গড়ে উঠা গুজব শেষ পর্যন্ত কোন কুসংস্কারে পরিণত হয়নি এবং ফি বছর কোকিল নিয়ম মোতাবেক ‘কুহু’ শব্দে ডেকে গেলেও জল বসন্তের প্রাদুর্ভাব আর না ঘটায় লোকজন অদৃশ্য সম্পর্কের কথাটা নিজেদের অজান্তে ভুলে গেছে।’ (চাকমা, ২০১৭, ১৭)। প্রচলিত আরেকটি ধারণা হলো, কুকুরের ডাকের সাথে অমঙ্গলের একটা যোগসূত্র রয়েছে; যা বিভিন্ন গল্পে উঠে এসেছে।

 

বিপম চাকমার বাংলা বানান নিয়ে আরও সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং বাক্যে ‘নি-কে আলাদা শব্দ হিসেবে ব্যবহার যথাযথ নয়। যেমন- হয় নি, খায় নি, আসে নি, করে নি, যায় নি। সূচিতে গল্পের নাম ‘পিনন-হাদি’ আর ভেতরে ‘পিনোন-হাদি’। আশা করা যায় এ ধরনের ভুল-ভ্রান্তি দ্বিতীয় মুদ্রণে থাকবে না।

 

বিপম চাকমার বসবাস গল্পগুলোর পটভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক কাঠমোর ভেতরে। তাঁর জন্ম ও বেড়ে উঠা জাতিগত বৈষম্যের আবহে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের অত্যাচারের ঘটনার বহুমাত্রিকতা তাঁর উপলব্ধির গভীরে আলোড়িত ও আন্দোলিত করেছে। এ নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। এজন্য এমন ঘটনার প্রকাশ অন্য জাতিসত্ত্বার কলমে প্রকাশিত হয়নি। সাহিত্য সমালোচকরা এজন্যই বলেন, ‘হেমিংওয়ের সাহিত্যে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও যুদ্ধ-পরবর্তী নিঃসঙ্গতা বা হতাশার কথা যেভাবে এসেছে তিনি নিজে যুদ্ধসৈনিক না হলে হয়ত সেভাবে আসত না।’ (হোসেন, ২০১৯, ২২) তেমনি বিপম চাকমার লেখায় চট্টগ্রামের পার্বত্য জনপদের জীবনের অসহায়ত্ব ধ্বনিত ও অনুরণিত হয়েছে।

 

বিপম চাকমা দ্বিতীয় ভাষা বাংলায় নিজ সমাজের সমস্যা সাহিত্যের মাধ্যমে মূল জনস্রোতের পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। তাঁর মাতৃভাষায় (চাকমা ভাষায়), কিন্তু চাকমা ও বাংলা উভয় বর্ণমালায় এ গল্পগুলো অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন। এতে চাকমা ভাষার সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে এবং ঐ ভাষার সাহিত্যের ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। চাকমা ভাষায় কিন্তু বাংলা বর্ণমালায়ও এ সাহিত্য অনূদিত হওয়া উচিত এজন্য যে চাকমা জনগোষ্ঠী মাতৃভাষায় কথা বললেও সংখ্যালঘু হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষিত নয়। প্রকৃত অর্থে, সবাই সাধারণত সে সুযোগ পায় না। কাজেই নিজ ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে অবগত করানোর জন্য এ উদ্যোগ গ্রহণ অতীব প্রয়োজনীয়। এ ধরনের কাজ সরকারীভাবে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, বাংলা একাডেমি বা জেলা উন্নয়ন বোর্ড প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বা এমনকি ব্যক্তি উদ্যোগেও সম্পন্ন হতে পারে।

 

(চলবে। পরবর্তী পর্ব — চাকমাভাষীর রচিত বাংলা উপন্যাস)

 

তথ্যসূত্র

চাকমা, বিপম। ২০১৭। অজগর। ঢাকা: তিউড়ি

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সহিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির স্বাক্ষরিত চুক্তি, ১৯৯৭, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

হোসেন, মোজাফ্‌ফর। ২০১৯। পাঠে বিশ্লেষণে বিশ্বগল্প: ছোটগল্পের শিল্প ও রূপান্তর । ঢাকা: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

আগের লেখারায়হান শরীফের কবিতা
পরের লেখামসনদ-এ-রুমি ।। কিস্তি : ৮
গীতা দাস
গীতা দাসের জন্ম নরসিংদী জেলার সদর উপজেলায়। তিনি একজন সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মী হিসেবে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই লেখালেখি করছেন। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকায় তার কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ছোটগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়াও অনলাইনে পরিচালিত বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি সাহিত্য বিষয়ক অনুসন্ধান ও সাহিত্য সমালোচনা তার নিয়মিত আগ্রহের বিষয়।

2 মন্তব্যসমূহ

  1. গল্পগুলো পড়া নেই; অথচ বিশ্লেষণ পড়ে মনে হচ্ছে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি পাহাড়ি সমাজের জীবন। গবেষককে ধন্যবাদ এমন চমৎকার বিশ্লেষণ আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here