মা মাগো তোর মাংস দিয়ে আমি ভাত খাই।
গরম গরম ভাতে তোর মাংসের ঝোল
চর্বি হাড্ডি গিলা ও কলিজা
পেটপুরে খাই আর মোটা হয়ে উঠি!
মা মাগো তোর মাংস আমি রোজ রোজ খাই।
— জফির সেতু
১
মাকে নিয়ে কি কবিতা লেখা যায়? এই উপলব্ধির আগেই মাকে নিয়ে আমার প্রথম কবিতা এবং তা মুখে মুখে রচিত হয়। আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন। কিন্তু কবিতা হয়ে উঠেনি, আর আমি কবিও ছিলাম না তখন। পরে যখন সিরিয়াসলি কবিতায় আসলাম, অনেকবার লেখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। তারপর অনেক বছর পরে, সম্ভবত ২০১১ সালে ‘দুধগাছ’ নামে একটি কবিতা লিখি। অনিবার্যভাবে একটি লাইন আমার ভেতর থেকে উচ্চারিত হয়, ‘দুধগাছ আমার মা!’ তারপর কয়েক মিনিটেই কবিতাটি আমি লিখে ফেলি। আমি কিছুই ভাবিনি কিন্তু কবিতাটি লেখা হয়ে গেল এবং শেষ পঙ্ক্তিতে গিয়ে দেখা গেল বাবাও চলে এসেছে কবিতায়। বাবা এই কবিতায় অনিবার্য ছিল না, কিন্তু অনিবার্য চরিত্র হিসেবেই আসল; যেহেতু বাবা ছাড়া মা হয় না। কিন্তু বাবা আসল মায়ের ঠিক বিপরীতভাবে। কেন আসল সেটা দেখার বিষয়। বাবা কি তাহলে মায়ের বিপরীত সত্তা? অনেক ভেবেছি আমি।
শত শত কবিতা লেখার পরও মাকে নিয়ে কেন কবিতা লেখা গেল না? এটা বড়ো প্রশ্ন। কবে শোক থেকেই যদি শ্লোকের উদ্ভব হয়, যেটা সংস্কৃত আলংকারিকেরা বলে গেছেন; তা হলেও মানলাম আমার মাতৃবিয়োগ হয়নি বলে বলে লেখাও হয়নি। কিন্তু আমার তো মা তিনজন; এর মধ্যে দুজনই গত, তাঁদের নিয়েও তো আমি লিখতে পারিনি কিছু? লেখা অনিবার্য হয়ে উঠেনি। হয়তো কেউ প্রশ্ন করতে পারেন আপনার ফুফু মেহের-উন-নিসা তো আর আপনাকে গর্ভে ধারণ করেননি; কিংবা আপনার শ্বাশুড়ি শাহানারা বেগম? মানলাম কথা, কিন্তু আমি দুজনেরই মাতৃস্নেহ পেয়েছি; দুজনই মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন? আমাকে আলিঙ্গন করেছেন; একজন দুধ-মা ছিলেন, অপরজন আমাকে ছায়া দিয়েছেন। কিন্তু কবিতা আমি লিখতে পারিনি; অনুভূতি স্থবির হয়ে গেছে।
২
ঋগ্বেদ ভারতীয় আদি গ্রন্থ; তাতে অদিতিরূপ মাতাকে পিতার পূর্বে স্তব করা হয়েছে ‘অদিতির্মাতা স পিতা স পুত্রঃ’। গীতায় কৃষ্ণের বন্দনায় অর্জুন সমস্ত আবেগের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মাকেই প্রথম রেখেছেন, ‘ত্বমেব মাতা চ পিতা ত্বমেব, ত্বমেব বন্ধুশ্চ সখা ত্বমেব।’ মনুসংহিতায় মাকে বলা হয়েছে, মা ধরিত্রীর প্রতিমূর্তি অর্থাৎ ‘মাতা পৃথিব্যা মূর্তিস্তু’। তা-ই যদি হয়, আর আমাদের জন্মই যদি হয় মাতৃজঠরে তাহলে আমাদের শরীরজুড়ে মায়ের উপস্থিতি, মায়েরই নতুন রূপান্তর। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে মায়ের শারীরিক সত্তা আর সন্তানের শারীরিক সত্তার মধ্যে তফাৎ তো নেই। মায়ের শরীরজাত সন্তানের রূপান্তরে বাবার অংশদারিত্ব আছে, কিন্তু বাবার তুলনায় মায়ের দাবি হাজারগুণ বেশি। যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সন্তানের পরিচয়ে প্রথমস্থানে রেখেছে মাকে। অথচ পিতৃপরিচয় মিথ্যে হতে পারে, কিন্তু মাতৃপরিচয় অমোঘ।
শুধু জন্ম দিয়ে নয়, লালন-পালনেও বাবার তুলনায় মা শতগুণ বেশি দায় নেন। দায় শব্দটাও মনে হয় বাবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; মাতৃস্নেহ দায় থেকে নয়। এটা সহজাত। মা ভালোবাসবেই, মা সন্তানকে ফেলে যাবে না; যেতে পারে না। সন্তানের অমঙ্গল ও বিচ্ছেদব্যথায় মা বরাবরই পীড়িত থাকেন। বাবা সন্তানকে ত্যাজ্যও করে ফেলতে পারেন, বনবাসে দিতে পারেন, মা পারেন না। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই রামায়ণের কথা। রাম যাবেন বনবাসে, বাবা দশরথ আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু রামের জননী কৌশল্যা কী বলছেন? বলছেন ‘ত্বদ্ বিয়োগান্ন মে কার্যং জীবিতেন সুখেন চ।/ত্বয়া সহ মম শ্রেয়তৃণা নামটি ভক্ষণম্।’ অর্থাৎ তোকে ছাড়া আমার জীবন নিষ্প্রয়োজন, আমি কিছুতেই সুখ পাব না। তৃণলতা খেয়েও যদি তোমার সঙ্গে থাকা যেতে তাও সুখের হতো।’ এই হলেন মা।
মহাভারতের কথা মনে আছে? কৌরবকুল ধ্বংস হলো পাণ্ডবদের হাতে। অন্যায়যুদ্ধের জন্য দায়ী কৌরব দুর্যোধন-দুঃশাসনাদি। শত সন্তানের জননী গান্ধারী সত্যনিষ্ট, ন্যায়ের প্রতীক। যেখানে ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের অন্যায়ে নমনীয় সেখানে গান্ধারী দুর্যোধনকে গর্ভে ধারণ করেও বলেন রাজার উদ্দেশে : ‘শাখাবন্ধে ফল যথা, সেই মত করি/বহুবর্ষ ছিল না যে আমারে আঁকড়ি/দুই ক্ষুদ্র বাহুবৃন্দ দিয়ে লয়ে টানি/মোর হাসি হতে হাসি, বাণী হতে বাণী/প্রাণ হতে প্রাণ? তবু কহি মহারাজ/সেই পুত্র দুর্যোধনে ত্যাগ করো আজ।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) এ তো সম্রাজ্ঞী গান্ধারীর কথা। কিন্তু মাতৃরূপিনী গান্ধারীর কথা মনে আেেছ? যুদ্ধ শেষ, একে একে সব পুত্র ধ্বংস হলো যুদ্ধক্ষেত্রে; জয় হলো যুধিষ্ঠিরাদির। ধর্মপুত্র ছুটে এলেন গান্ধারীর কাছে ক্ষমা চাইতে; যেহেতু শতপুত্রের ঘাতক তিনি। গান্ধারীর পায়ের নিচে বসে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন, গান্ধারীর তো চোখ বাঁধা কাপড়ে। তবু একটা চোখের দৃষ্টি পড়ল যুধিষ্ঠিরের পায়ের আঙুলে; নিমিষেই পুড়ে বিকৃত হয়ে গেল যুধিষ্ঠিরের আঙুল। গান্ধারীর চোখের এই তেজ ছিল ঘৃণার। সন্তানকে হত্যার করার ঘৃণা। কারণ সন্তানের ঘাতকের চেয়ে ঘৃণিত মায়ের কাছে আর কিছু নেই। এই গান্ধারী মা।
সুতরাং একটু ভালো থাকার প্রশ্নে, খাবারের প্রশ্নে, আশ্রয়ের প্রশ্নে; এমনকি খ্যাতির প্রশ্নেও মা সন্তানের কাছে তুচ্ছ হয়ে উঠতে পারেন।
এই যে মাতৃমূর্তি এঁরা সকলে পুরাণকালের, পুরাণের। কিন্তু এ-সকলই বাস্তবমায়েরই প্রতিকল্প। আর এই মায়ের মাতৃবন্দনা সন্তানের পক্ষে কি সম্ভব? আসামে শক্তিপদ ব্রহ্মচারী বলে একজন আধুনিক কবি ছিলেন; তিনি একটা কবিতায় বাস্তবের মাকে প্রতিমূর্ত করেছিলেন, কিন্তু সেটা ছিল মাতৃমূর্তি : ‘সবাই থাকুক ভালো, চারিদিকে শান্ত স্নিগ্ধ চোখ/আলো নিয়ে জেগে থাক, শস্যদানা খুটে নিবি তুই/আমার বুকের দুধে তোর মুখ বারবার ধুয়ে দেবো আয়।’ এ-ই চিরন্তন মাতৃমূর্তি।
সন্তান মায়ের কাছে যেমন বিরূপ হয় না, তেমনি মায়ের কাছে সন্তানের বয়েসও কখনও বাড়ে না।
৩
তবু মাকে উপলব্ধির একটা বিষয় আছে সন্তানের। মায়ের প্রতি সংরাগ, আবেগ ও ভালোবাসা আছে। তার প্রকাশ ও আকুলতাও আদিকাব্যে দেখি আমরা। যেমন রামায়ণে দেখি রামচন্দ্রের মুখে। স্বর্ণলঙ্কায় লক্ষণকে নিয়ে আছেন রামচন্দ্র। লঙ্কা দখল করে নিয়েছেন। কিন্তু তিনি সুখী নন, মা কাছে নন বলে। বারবার মায়ের মূর্তি তার চোখ টলোমলো করছে আর মাকে উপলব্ধি করছেন এভাবে, ‘ইয়ং স্বর্ণময়ী লঙ্কা ন মে লক্ষণ রোচতে/জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গদপি গরীয়সী।’ যেখানে সোনার পুরী, সেখানে মা না-থাকলে সবই অসার। মধ্যযুগের শাক্তপদাবলিতে অঙ্কিত মাতৃরূপ সন্তানের কাছে অসহায়ের সহায় এবং একমাত্র রক্ষাকর্ত্রী। আধুনিক যুগেও সাহিত্যেও সকল আঙ্গিকে মাতৃমূর্তি প্রতিষ্ঠার একটা চেষ্টা অব্যাহত আছে এবং তা একটা সুগভীর উপলব্ধির জায়গা থেকে। এই প্রাচীন, মধ্য কিংবা আধুনিককালে সন্তানের অনুভব মাকে নিয়ে; এই উপলব্ধির ভাষারূপ সত্যি কি দেওয়া সম্ভব? আমার জিজ্ঞাসা সেখানে।
বাংলা লোকগানে একটা কথা আছে। ‘মায়ের এক ধার দুধের দাম/ কাটিয়া মায়ের চাম/পাপোশ বানাইলে ঋণের শোধ হবে না/এমন দরদি ভবে এই মা।’ এটা সত্য কথা, এবং এটা যদি সত্য হয় তাহলে এই মা-সত্তাটিকে টি যথাযথ অনুভব করা সম্ভব? থিওডোর আডোর্নোর একটি কথা বলেছিলেন যে, ‘আশউইচের নরমেধযজ্ঞের পরে কবিতা? অসম্ভব!’ নাৎসিজার্মানির পরিকল্পিত ইহুদিনিধন, হলোকস্ট-গ্যাসচেম্বার ও দাহচুল্লিতে পুড়িয়ে মারার জন্য নিষ্ঠুরতম নিধনক্যাম্পের অভিজ্ঞতা অন্তত মানবসৃষ্ট ভাষায় প্রকাশ-অযোগ্য। সেটা অনুপলব্ধির একটা দিক, এবং অসম্ভবের ব্যাপার। কিন্তু মায়ের মতো ব্যক্তিকে নিয়ে যেখানে উপলব্ধি মুখর হয়ে ওঠার কথা সেখানে প্রশ্নটা আসে কেন? আশউইচের নরমেধযজ্ঞ মানুষকে উপলব্ধিশূন্য করে, আর মাতৃমহিমা উপলব্ধির মতো ক্ষমতাই সন্তান অর্জন করতে পারে না। এমনকি সে-নারী মাও যদি হয়, সেও না। কারণ সন্তান থাকে স্বার্থপর, আর মা স্বার্থহীন। স্বার্থপর/আত্মপরের পক্ষে স্বার্থহীন সত্তাকে পূর্ণ উপলব্ধি অসম্ভব।
তাহলে যে-উপলব্ধ সত্য কবিতায় প্রকাশিত হয়, তা কী? সহজ উত্তর মেটাফর। প্রকাশের একটা উপায়। কিন্তু মাতৃমহিমা কীর্তনের মেটাফর মানবসৃষ্ট ভাষাও তৈরি করতে পারে না। যেটা ব্যবহার হয়, তা কৃত্রিম। কৃত্রিম বলে অর্থহীন হয় এবং কোনও সংবেদই তৈরি করতে পারে না। পারে যে না, তা নারীর ইতিহাস। আমার ধারণা মাকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারলে জগতের সহিংসতা থাকে না। নারীর প্রতি এই পীড়ন থাকে না। কিন্তু সভ্যতায় মাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে, নারীকে অপমানিত করা হয়েছে। মাকে কখনই মর্যাদা দেওয়া হয়নি, বরং সভ্যতার ইতিহাস মানে মাতৃবঞ্চনা ইতিহাস। মাকে কবিতায় যে-গরীয়ান করা হয়েছে, তা একটা মুখোশের বয়ান। মুখোশ যে তার একশটা নজির আছে মানবজাতির ইতিহাসে।
৪
কুসন্তান হয়, কিন্তু কুমাতা হয় না। কুসন্তান মানেই মাতৃবিরূপ। এই বিরূপতা এমনই যে, সন্তান মাতৃঘাতীও হয়। হত্যা বা খুন করার চেয়ে মায়ের কাছে মর্মবেদনা মারাত্মক। হত্যায় মা মারাই যায়, আর বিরূপতা মাকে তিলে তিলে ধ্বংস করে। মাতৃবিরূপতা সকল কালেই ছিল। একালে মানুষের মানবিক গুণাবলি বৃদ্ধি পেলেও মাতৃবিরূপতা কমেনি। পেয়েছে বরং বহুমাত্রিকতা। নগরায়ন হলো মায়ের জন্য এক যূপকাষ্ঠ; সন্তান ও মায়ের চিরবিচ্ছেদ ঘনিয়ে আনে এই নগরায়ন। গ্রাম থেকে শহরে পদার্পণ, প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই, নতুন সংস্কৃতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের মতো ‘বিষাক্ত’ প্রণালিগুলো ঘরের বউয়ের জন্য ভালো হলেও মায়ের জন্য অভিশাপ হয়ে উঠল অন্তত মধ্যবিত্ত বাঙালদের জীবনে। কেননা নতুন প্রণালির জীবনে মা-ই একমাত্র পুরাতনী, অনাধুনিক; কোনও কিছুর সঙ্গেই খাপ খায় না। কারণ মা তো আর ঐতিহ্যকে, সংস্কৃতিকে, প্রথাকে বিসর্জন দিতে রাজি নয়। মা ধারণ করে আছে এই সব পুরাতন অসুখ। নগরসভ্যতায়, মধ্যবিত্তজীবনে, শ্রেণিপরিবর্তনের যুগে মা-ই একমাত্র পরিত্যক্ত, অপ্রয়োজনীয় ও অবহেলার পাত্র।
অথচ বাঙাল যখন নতুন চেতনাধারী হয়, সাবাকলত্ব অর্জন করে বলে ধারণাপোষণ করে; সেই জাতীয়তাবদী আন্দোলনের যুগে মা অন্তহৃত বা পরিত্যক্ত হলেন; সেই জায়গা দখল করলেন বাবা। কীভাবে? মাতৃমঙ্গল বা মাতৃসাধনের স্থলে এলেন নিরাকার ব্রহ্ম; কে না জানে তিনি পুরুষমহিমা। বৈষ্ণবীয় ও শাক্ত মাতৃমূর্তির ওপর ভরসা হারালেন ব্রাহ্মরা, তাই এই চেষ্টা। কিন্তু কথা এখানেই শেষ নয়, বঙ্কিমচন্দ্ররা স্বদেশকে মাতৃমূর্তিরূপে কল্পনা করে জাগরণে মায়ের ওপর ভরসাই করলেন; কিন্তু ওটা পূজাই। আনুষ্ঠানিকতা, অনুষ্ঠান শেষে মা ঘরে ঠাঁই পায় না। নদীর পানিতেই ভেসে যেতে হয় তাকে। মাকে ভর করেই শরীর ও মনের পরাবর্তন বাঙালিজীবনে; স¦রাজ-স্বদেশি, স্বাধিকার, ব্রিটিশ খেদাও, চরকা যা-ই বলি মা-ই ছিল শক্তি; মা-ই ঐক্য হিন্দু-মুসলমানের। ব্রিটিশরা গেল, দেশভাগ হলো; দুইবঙ্গের মধ্যবিত্ত আবার মাকে ছুঁড়ে ফেলল পদ্মা ও গঙ্গায়; দুই নতুন রাজধানীতে নিজেকে যোগ্য করার ইঁদুরদৌড়ে মা ছিটকে পড়ল।
এমনকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনে আত্মরক্ষার আয়ুধ হিসেবেও মাকে দরকার পড়ল যুদ্ধক্ষেত্রে, ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা/আমার দুইচোখে দুই জলের ধারা/মেঘনা-যমুনা।’ যুদ্ধ শেষ হলো, দেশও স্বাধীন হলো; নতুন দেশের নতুন অর্থনীতিতে জেলায় জেলায় নগরায়ন আর কতশত প্রতিযোগিতা; শহরের ছোট্ট ঘরে কিংবা ফ্ল্যাটে মায়ের স্থান তো আর হয় না। এমনকি যে-আর্কিটেক্ট আপনার ফ্ল্যাটের ডিজাইন করে, সেও একটা রেখা আঁকতে পারে না মায়ের জন্য; বিধবা মার দূরে থাকাই ভালো। এছাড়া ঘর নোংরা করার ব্যাপার তো আছেই। ঘরের দামি সোফার সঙ্গে মা ঠিক যায় না। নচিকেতার কবিতায় মায়ের কথা, ‘আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’ সেও অনেক ভাগ্য, কেউ তো ওঠাও পায় না। কিন্তু মায়ের প্রতি সন্তানের এই যে অনোপলব্ধি, অবজ্ঞা ও অবহেলা তাও কিন্তু ‘কুসন্তান’ উপলব্ধি করতে অক্ষম। সুতরাং সে ভালো আছে। নিজের মেয়ের গালে চুমা খেয়ে ‘মা’ ডেকে বেশ ভালোই আছে।
৫
গত চব্বিশে এপ্রিল ফেসবুকের একটা ফিডে অনেকগুলো বাচ্চাসহ একটি মুরগিকে দেখতে পাই। ঝড়োবৃষ্টিতে দুডানার ভেতরে বাচ্চাগুলোকে আগলে রেখে ঝড়বৃষ্টি থেকে রক্ষা করছে। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এই মা। কিছুক্ষণ আগে আমি একটা সংবাদে একজন অসহায় মায়ের একাকী বসে থাকাটাও দেখেছিলাম। এই দুইটি ঘটনা হঠাৎ করে আমার ভেতরে একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। আমি ‘মাকে নিয়ে কবিতা’ শিরোনামে একটি ছোটো কবিতা লিখি। আমার মর্মপীড়া হচ্ছিল বলে আমি কবিতাটি বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে ফেসবুকের ওয়ালে পোস্ট করি। কবিতাটি ছিল এই :
মা মাগো তোর মাংস দিয়ে আমি ভাত খাই।
গরম গরম ভাতে তোর মাংসের ঝোল
চর্বি হাড্ডি গিলা ও কলিজা
পেটপুরে খাই আর মোটা হয়ে উঠি!
মা মাগো তোর মাংস আমি রোজ রোজ খাই।
কবিতার ভাষা স্বাভাবিক ছিল না এবং সেটা বিশেষ শিল্পাঙ্গিকেও লিখিত। যে-দুটি দৃশ্য আমি দেখেছিলাম এবং মায়েদের নিয়ে যে-অভিজ্ঞতা আমার আছে; সেই অভিজ্ঞতার বয়ান দিয়ে যদি কবিতা লিখতে হয় তা হলে আমাকে ‘পুতপুতে’ ভাষা ও শিল্পাদর্শের চেয়ে এমনই একটি ভাষা ও আদর্শ বেছে নেওয়া উচিত ছিল। মন্তব্য করতে গিয়ে কবি আবিদ ফায়সাল যথার্থই লিখেছেন যে, ‘হাংরি কবিতা’। আরও যোগ করেছেন তাঁর মন্তব্যে যে, ‘চোখ ফেটে যায় প্রথম বাক্যের নৈঃশব্দ্য বিলাপে।’ হাংরি আন্দোলন ষাটের দশকের শুরুতে দেশভাগোত্তর বাস্তবতায় পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় সংঘটিত হয়েছিল; মূলত এসথেটিক হলেও এর পরিধি ছিল বহুব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। এটি কাউন্টার কালচালার মুভমেন্টও। এর উৎস ছিল ইউরোপ নয়, আমেরিকা। কলোনিয়াল অ্যাসথেটিক ভাবাদর্শকে উড়িয়ে দিয়ে, নয়া জমানার অ্যাসথেটিকস বিনির্মাণই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। ‘শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতাসৃষ্টির প্রথম শর্ত’ এই ছিল কবিতাবিষয়ে হাংরি ইশতেহার।
আমার দেখা দৃশ্যটি চোখ ফাটার বটে; কবিতাও চোখ ফেটে রক্ত বেরোনোর। কারণ প্রথম পঙ্ক্তিতেই বলা হয়েছে, ‘মা মাগো তোর মাংস দিয়ে আমি ভাত খাই।’ এর চেয়ে জঘন্য কিছু আর হতে পারে না। গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর উপন্যাসে খাওয়ার মতো অবশিষ্ট ‘গু’ দেখিয়েছেন, মাতৃমাংস খাওয়ার সাহসপর্যন্ত করেননি। লাতিন আমোরিকার রাজনৈতিক বাস্তবতায় গু নয়, মাতৃমংসভক্ষণই বরং স্বাভাবিক ছিল। শুধু হাংরিই নয়, শিল্পদর্শনগত বিচারে একে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরাবাস্তববাদী অ্যাসথেটিকসের সঙ্গে একে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে।
শেখ সাদী লিখেছেন, ‘এই রুগ্ন সময়ের কবিতা। নষ্টভ্রষ্ট চৈতন্যের মর্মন্তুদ ভাষা।’ অনেকক্ষেত্রে সময়ও শিল্পচৈতন্য নির্মাণ করে থাকে। যখন সময় রুগ্ন তখন চৈতন্য ভ্রষ্ট হবেই, আর ভাষাও তখন হয়ে ওঠে মর্মন্তুদ। অনেক সময় মর্মন্তুদ ভাষা দিয়ে, পরাবাস্তব চিত্র দিয়ে বাস্তবকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কারণ ভাষার চৈতন্যও রুগ্ন নময় নষ্ট করে দেয়; ভাষা স্বাভাবিকতা হারায়। যেভাবে বিশ্বযুদ্ধকে রূপায়িত করেছিলেন কবি ও শিল্পীরা। বিদ্যুৎ সরকার বিভৎস রসের কথা বলেছেন। তার মতে, ‘নব (নয়) রসের একটা হচ্ছে বীভৎস রস।’ ভারতীয় রসতত্ত্বে এই রস বিশেষ ভাবের, অর্থাৎ ঘৃণা বা কুৎসিত বিষয় থেকে যে ভাব মনোজগতে বিশেষ অবস্থা তৈরি করে। মায়ের মাংস, চর্বি হাড্ডি গিলা ও কলিজা পেটপুরে খাওয়ার মতো ঘৃণার উদ্রেক জগতে কী আর হতে পারে? আমি তেমনই একটা মানুষের নিজের প্রতি তৈরি করতে চেয়েছি। তাই এটি বিভৎস রসের, বিদ্যুতের কথাই ঠিক।
কবিতাটি ওয়ালে দেওয়ার পর আমি এরকম বেশকিছু প্রতিক্রিয়া পাই। কমেন্টবক্সে অনেকে নানধরনের মন্তব্যও করেন। সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু এর বাইরে আমি কটি মোবাইল কল পাই এবং আমার মেসেঞ্জারে অনেকে তাদের বক্তব্য পেশ করেন সেটা নিয়েই আমার বিশেষ কথা। তার আগে সাধারণ মন্তব্যকারীদের বক্তব্য যদি দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, আমাদের সমাজে মা যে অবহেলিত, উপেক্ষিত এবং চিরবঞ্চিত তারা সকলেই স্বীকার করেছেন। শাহাব আল দীন লিখেছেন, ‘দুঃখের দ্রোহী বয়ান।’ ফখর উদ্দিন লিখেছেন, ‘সত্যি।’ কস্তুরবা বীথি লিখেছেন, ‘সত্যি, এই মানুষটাকে আমরা নিজের মতো করে খাই।’ মাহবুবুর রহমান লায়েক লিখেছেন, ‘মায়ের রক্তপিণ্ড, মাংস, চর্বি খেয়ে আমরা কত বড়ো হয়েছি। কিন্তু মা যে হাড্ডিসার!’ ইমাম উদ্দিন ইমন লিখেছেন,‘সত্যি নির্মম লাইন, মায়ের ছোট্ট সন্তানেরা একসময় আদরে বড়ো হয়ে মাকে কষ্ট দেয়’। রাহুল তালুকদার লিখেছেন, ‘কত নির্মম আমরা’। পার্থ সারথী নাগ লিখেছেন, “অনেক আগে প্রকাশিত […] ‘দুধগাছ’ কবিতার ঘ্রাণ পেলাম।” এরকম আরও অনেক মন্তব্য। সঙ্গে আরও দুটি মন্তব্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি রাব্বানী নোমানীর; তিনি লিখেছেন, ‘এই নিমর্মমতাই অলঙ্ঘনীয় সত্য।’ অপরটি; সরকার আশরাফের, ‘শেষপর্যন্ত পড়ে ওঠা মানসিক পীড়ন বই কিছু নয়।’
পাঠক ও মন্তব্যকারীদের সকলেই এই সত্য মেনে নিয়েছেন যে, মায়ের জরায়ুতে ঠাঁই নিয়ে, মায়ের গর্ভে পুষ্ট হয়ে পৃথিবীতে এসে তার স্তন্য খেয়েই আমরা বড়ো হই না; আমৃত্যু মা-ই নানাভাবে নিজেকে উজাড় করে দেন সন্তানের জন্য। কিন্তু সন্তান এব্যাপারে কৃতজ্ঞ থাকা তো দূরের কথা বরং মাকে অপদস্থ, অপমানিত ও বঞ্চিত করে দূরে ঠেলে দেয়। কথাটা সকলের ক্ষেত্রে সত্য এমন নয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মা লাঞ্ছিত হন। আর যাদের কাছে মর্যাদা পান বলে আমরা মনে করি, তারার আসলে দায়টা কাঁধে নেন; দায় কাঁধে নেওয়া এক জিনিশ, আর ভালোবাসা আরেক জিনিশ। কোনও মা-ই চান না দায়ে ঠেকে কেউ তাকে কাঁধে নিক। মায়েরাই যথার্থ ভালোবাসতে জানেন, কিন্তু তারাও ভালোবাসার কাঙাল। তারা যে বঞ্চিত, সে ভালোবাসা থেকেই। কিন্তু কথা হলো কোনটা দায়ে ঠেকে, আর কোনটা ভলোবাসার দান; মায়েরা সেটা ভালো বুঝেন; আর বুঝেন বলে তারা চিরদুঃখী। মায়ের চেয়ে দুঃখী জগতে আর নেই।
৬
রাব্বানী নোমানীর বক্তব্য ছিল ‘এই নির্মমতাই অলঙ্ঘনীয় সত্য।’ কিন্তু কোন নির্মমতা? মায়ের মাংসভক্ষণ নিশ্চয়ই, এবং এর অন্তরালে কথাও আছে। ঘটনাটি নির্মম, এটা সকল দিক থেকে ঠিকই আছে। তবে যে-কথাটি অতিরিক্তভাবে যুক্ত করলেন, সেটাই আসলে তার বক্তব্য বিষয়। মায়ের প্রতি সন্তানের নির্মমতা হচ্ছে এক অলঙ্ঘনীয় সত্য। এখানে দুটো জিনিশ উচ্চারিত হয়েছে ‘সত্য’ এবং ‘অলঙ্ঘনীয়’। এটা না-হয় মানলাম নির্মমতাটা সত্য; কিন্তু অলঙ্ঘনীয় কেন? প্রশ্ন সেখানেই।
মন্তব্যকারী গ্রিক নিয়তিবাদের প্রতি একটা ইঙ্গিত করেছেন। প্রাচীন গ্রিসে নিয়তির বিধানে মানুষের বিশ্বাস ছিল; এখনও অনেকে বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ মানবভাগ্য নিয়তি-নির্ধারিত, ললাট-লিখন। ললাটে যা লেখা আছে তা ধ্রুব; ঘটবেই সেটা। কারণ বিশ্ববিধানকে তো আর লঙ্ঘন করা যায় না। সফোক্লিসের ইডিপাস নিয়তির সন্তান ছিলেন; জন্মের আগেই ডেলফির মন্দিরে এ্যাপোলোর দৈববাণী ছিল মাতাপিতা জোকাস্টা ও লেয়াসের উদ্দশ্যে যে, তিনি পিতৃঘাতী হবেন; মায়ের অঙ্কশায়িনী হবেন। তবুও জন্ম হলো তাঁর; যৌবনে নিজেই শুনলেন এ্যাপোলোর মন্দিরে সেই একই দৈববাণী। করিনথ থেকে পালালেন তিনি নিয়তির বিধান থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু পারেননি; তিনি পিতৃঘাতী হলেন এবং মাকে বিয়েও করলেন। এটাও ছিল নির্মম অলঙ্ঘনীয় সত্য; রাজা লেয়াস, রানি জোকাস্টা আর যুবরাজ ইডিপাস সকলেই নিয়তির বিধানকে মেনে নিতে চাননি। কিন্তু সত্য ধ্রুব হলো বিশ্ববিধানের নিয়মে। ইডিপাসের জীবনে যে-ট্রাজেডি তা এসেছে সত্যের সন্ধানে; টিরেসিয়াসের অভিশাপ ও সাধানবাণী, জোকাস্টার অনুরোধ কিছুই তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারেনি; তিনি সত্য উদ্ঘাটন করতে চেয়েছেন তাঁর রাজ্যে কে এই পাপী বাস করে? এই সত্য-অনুসন্ধান এবং নিয়তির বিরুদ্ধে লড়াইই তাঁকে মনুষ্যত্বের মর্যাদা দিয়েছে, করেছে ট্র্যাজেডির নায়ক। দুঃখভোগ এবং দুঃখস্বীকারের অপরিসীম শক্তি তাঁকে মহিমান্বিতও করেছে। ইডিপাসের প্রতি আমরা করুণা-সিক্ত হই বটে; তবে তাঁকে আমরা সম্মানও করি।
আরেকটা বিষয়; ইডিপাসকে আমরা করুণা করি একাধিক কারণে। এর একটি হচ্ছে আত্মজ্ঞানহীনতা বা অজ্ঞতা এবং অপরটি হচ্ছে অহংকার। আরও কারণ আছে। আত্মহত্যার আগেও জোকাস্টা তাঁকে বলেছে ‘তুমি যেন কখনও না জানো তুমি কে?’
এই অজ্ঞতা আধুনিক মানুষেরও ট্র্যাজেডি। সন্তান মায়ের গর্ভে জন্ম নেবে, মা সন্তানকে লালন করবে; একটা প্রাকৃতিক। নিয়তির বিধানের মতো। এই বিধান শুধু মানুেষর ক্ষেত্রে নয়; আমরা শুরুতে যে-মুরগির কথা বলেছিলাম তার ক্ষেত্রেও এটা সমানভাবে প্রযোজ্য। যে-কোনও প্রাণির ক্ষেত্রেই। তাই এই বৃষ্টিবাদল-ঝড়ে সন্তানদের বুকে আগলে ধরেছে মুরগি-মাতা; নিজেকে রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সেই মুরগির বাচ্চাগুলোও একদিন মাকে ছেড়ে চলে যায়। এটা জৈবিক ধর্ম। আমরা এতে কিছু মনে করি না। এটা ঘটবেই, যেহেতু তারা পশু। তবে মানুষ তো আর পশু নয়। তার মূল বৈশিষ্ট্য মানবসত্তা, মনুষ্যত্ব। মানুষ মনুষ্যত্বের দায় এড়াতে পারে না। মাকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারাটা মনুষ্যত্বের প্রধান একটি দায়।
মা ‘জননী’ বলেই হয়তো তার মধ্যে দেবীত্বের মহিমাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যখন দেবীত্বের মহিমা দেওয়া হয় তখন মা আর লৌকিক থাকেননি। তিনি হয়েছেন পূজার বস্তু। তাকে বরং আরও দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। মা কখনও পূজা চান না; চান সন্তানের সান্নিধ্য ও ভালোবাসা।
আবার মায়ের গর্ভে জন্ম নিতে হবে বলেও এই এই নিমর্মতা অলঙ্ঘনীয়। গর্ভে ধারণ করেন বলে মায়ের বাৎসল্য সহজাত; আর জগতের একদিকে মাতৃপরিচয়, অন্যদিকে সকল পরিচয়। অর্থাৎ মা একটা জাত; যে প্রকৃতি এবং প্রকৃতি বলে নিঃস্বার্থ। অন্য পরিচয়ের একটি সন্তান বলে সেও স্বাভাবিকভাবে স্বার্থপর সাধারণ যে-কোনও প্রাণীর মতো। মায়ের বিপরীতে অন্যসকলে ‘প্রাণিমাত্র’। সুতরাং একটু ভালো থাকার প্রশ্নে, খাবারের প্রশ্নে, আশ্রয়ের প্রশ্নে; এমনকি খ্যাতির প্রশ্নেও মা সন্তানের কাছে তুচ্ছ হয়ে উঠতে পারেন। প্রাণধারনের জন্য প্রাণী এটা করবেই; মা কেননা জন্মদায়িনী। তাই এটাও জগতের বিধান এবং তা অলঙ্ঘনীয়ও। এই অলঙ্ঘনীয় বিধানের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা সন্তানের নেই; আর নেই বলে সন্তান মাতৃসত্তার তুলনায় অধঃমর্ণ। আসলে তুলনাই হয় না।
৭
সরকার আশরাফের কথা ছিল কবিতাটি ‘শেষপর্যন্ত পড়ে ওঠা মানসিক পীড়ন বই কিছু নয়।’ কবিতায় যে-সব চিত্রকল্প ব্যবহার করা হয়েছে তা পীড়াদায়ক এটা আমি অস্বীকার করছি না। এর মধ্যে গভীর একটা ট্র্যাজেডি আছে যে, জননীর মাংস ভক্ষণ করে বেঁচে আছে সন্তান। মানসিক পীড়ন বটে। এই পীড়নটা দিতে চেয়েছেন খোদ সফোক্লিস ইডিপাস নাটকে কিংবা গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ সরলা এরিন্দিরা গল্পে। একজন নায়ককে পিতৃঘাতী ও মাতার অঙ্কশায়িনী করেছেন; অপরজন অর্থোপার্জনের জন্য দিদিমা-কর্তৃক বালিকা নাতনিকে একরাতে শতশত পুরুষের শয্যাসঙ্গী করতে বাধ্য করেছেন। প্রাচীন গ্রিসের বাস্তবতা এবং লাতিন আমেরিকার বাস্তবকতাকে প্রতিমূর্ত করতে এসব মেটাফরের/রূপকের বিকল্প ছিল না। এরিস্টটল তাঁর পোয়েটিক্স গ্রন্থে ইডিপাস নাটকের এই পীড়নকে বলছেন ‘ক্যাথারসিস’। আস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে শরীর থেকে রক্ত বের করে দেওয়ার মতো। না-হলে ভেতরের ক্ষত কিছুতেই সারবে না। আর ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোকে বিশেষত সামরিক শাসন এমনটাই ঝেঁকে বসেছিল যে শাসকরা নিছক জানোয়ারে পরিণত হয়েছিল; জনগণও তাদের কাছে ছিল জানোয়ারতুল্য। নিষ্ঠুর দাদিমাকে করা হয়েছিল এখানে সামরিক-জানোয়ারদের রূপক। জাদুবাস্তবিক পরিবেশ ও চরিত্রসৃষ্টি ছাড়া লাটিন মানুষের ঘুমভাঙানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু ইডিপাস কিংবা সরলা এরিন্দিরার গল্প কি নিছক মানসিক পীড়ন? এছাড়াও এতে কোনও কিছু নেই? হ্যাঁ, এমন মেটাফর বা রূপক মেনে নেওয়া কষ্টকর; তাই বলে কি অর্থহীন? মায়ের সঙ্গে সেক্স করা তো প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার মতো রূপক কিংবা নিষ্ঠুর দাদিমার এইটুকু নাতনিকের শতশত পুরুষের নিচে চিড়াচ্যাপ্টা করা ভয়ানক ব্যাপার। কিন্তু এর চেয়ে তো বড়ো আঘাত হতে পারে না। মানুষের চেতনাকে অপাঘাতে জাগ্রত করাটা কখনও মানবিক হয়ে ওঠে। এমন শিল্পসৃষ্টিও তাই। এরকম আরও শতশত উদাহরণ সাহিত্যের ইতিহাসে আছে। আমি অতি পরিচিত দুটি উদাহরণ দিলামমাত্র।
কিন্তু এটা হয় যে, এমন নির্মম ঘটনা মেনে নিতে না-পারা। মন্তব্যকারীও নিতে পারেননি। এরজন্য মাতৃ-ট্যাবু, ভাষিক-ট্যাবুও।
৮
বলেছিলাম কবিতাটি আপলোড করার পর অনেক পাঠক আমাকে সরাসরি মোবাইল কল করেছেন, আবার অনেকে মেসেনজারে ইনবক্স করে লিখেছেন এই বর্ণনা অসহনীয়; এই রূপক অসহ্য। এটা মেনে নেওয়া যায় না। এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। যেহেতু এসব মন্তব্য ব্যক্তিগত, প্রকাশ্য নয় তাই আমি উদ্ধৃতি থেকে বিরত থাকলাম। কিন্তু তাদের মনের কথা আমি বুঝি; তারা আঘাতটা পেয়েছেন কোথায়? মায়ের মাংসভক্ষণের মতো ঘটনা এতটাই যন্ত্রণাকর যে কল্পনাও করা যায় না। অনেকে হয়তো কল্পনাও করেননি জীবনে; কিন্তু এই সত্য যখন কবিতায় প্রকাশিত হলো তারা সত্যি মুষড়ে যাবেন, এটা স্বাভাবিকও। তবে, আমার কথা হচ্ছে তারা কি কখনও বঞ্ছিত, নিপীড়িত ও অপমানিত মায়ের মুখচ্ছবি কখনও দেখেছেন? কিংবা ভেবেছেন জীবনে? দু-একটা ঘটনা আমি বলি।
আমি যখন স্কুলছাত্র একদিন দেখলাম ওপাড়ার এক মা আসরের নামাজের আগে; নদীতে পশ্চিমমুখী হয়ে দুহাত তুলে মোনাজাত করছেন। তিনি কাঁদছেন হাউমাউ করে। ওই মহিলা বিধবা; আমার বালক মন উৎসুক হলো; নদীপাড়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু তার মোনাজাত থামছে না; শুনলাম নিজের মৃত্যুকামনা করছেন। এই নদীতেই যেন তার মৃত্যু হয়; তিনি যেন পানিতে ভেসে যান।
একসময় তিনি পারে উঠে এলেন; আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কেন মৃত্যু চান চাচি? বললেন, আমার ছেলে আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না। আজ বলেছে আমার কেন মৃত্যু হয় না। বিয়ের পর থেকেই ও আমার সঙ্গে দুর্ব্যহার করে। আমার সঙ্গে কথা বলে না। বলে আমি নাকি ভাত বেশি খাই। আমাকে আর খাওয়াতে পারবে না।
আমি শুনে চুপ হয়ে গেলাম। দৃশ্যটি আমার মনে আছে আজও। তার ছেলেকেও আমি চিনি। স্কুলের মাঠে তাকে ফুটবল খেলতে দেখেছি। পরে খেয়াল করেছি দিনের বেলা তিনি ঘরের বাইরে থাকতেন, যাতে ছেলের চোখে না পড়েন।
আরেকবার এক মাকে দেখি, তিনি কাঁদছেন বাড়ির নিচে। তারপর দেখলাম একবার তিনি ছেলের ঘর ছেড়ে চলে গাছতলায় চলে গেছেন। শুতেন স্বামীর তৈরিকরা গরুঘরের পাশে। তিনিও বিধবা। পেট খারাপ রোগ ছিল তার। ঘন ঘন বাইরে যেতে হয় রাতের বেলা। এক বর্ষারাতে মাকে বাইরে রেখেছে দরোজা বন্ধ রাখে ছেলে। বলেছে, সকালে একসাথে ঘরে আসো। বাইরে এতক্ষণ থাকলে ঘর ভেসে যাবে বৃষ্টির পানিতে। মা সারারাত বারান্দায় কেঁদেছেন। ছেলে ঘরে ঘুমিয়েছে।
একবার রেলস্টেশনে এক নারীকে দেখি, অস্থিচর্মসার। বলি, মা আপনার ছেলেসন্তান নেই? বললেন বাবা আছে, চারজন বেটা। ওরা আমারে দেখে না। বললেন, ওরা মা পেয়ে গেছে। আমাকে আর দরকার নাই।
শহুরে মধ্যবিত্তের ঘরের চিত্র আরও বিচিত্র। হয়তো শহরে ছেলেরা আলিশান বাড়িতে থাকে, কিন্তু মাকে রাখা হয় গ্রামের বাড়িতে। তারা ভাবেন গ্রামে মা ভালো আছেন। আসলে তা কিন্তু নয়। মা দুটো জিনিস চান; প্রতিদিন দেখতে সন্তানের মুখ; আর শুনতে চান সন্তানের সন্তানাদির মুখের বুলি; চান ওদেও সঙ্গ। শহরে অনেক ঘরে মায়েদের পালাক্রমে রাখার ঘটনা স্বাভাবিক। এটা ভালোবেসে যে সকল ক্ষেত্রে তা নয়, দায় এড়াতে পাওে না বলে। কাঁধের বোঝা বলে। লোকে খারাপ বলবে বলে।
আবার পরিচিত এক ঘরে জানলাম, মাকে রাখতে আপত্তি নাই। কিন্তু তিনি তো আলাদা ঘর চান। তা পাই কী করে? বাচ্চাদের পড়ার ঘর ছেড়ে দেবো? তাহলে তো বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
আরবার এক মা হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরতে চান না; আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন? পুুতে দেখতে পারে না। আমি বললাম, কিছু বলতে পারেন না? জানালেন, কিছু বললেই বলে আমার ঘর থেকে বের হয়ে যাও।
আরেক মা বলেছিলেন, যদি জামতাম একে পেটে ধরেছি; বিষ খেতাম।
এসব গল্প নয়; মায়েদের জীবনের কথা। এই জীবন হাজার হাজার। মা জগতে অসহায় এক জীব; সন্তানের জন্ম দিতে দিতে, সন্তানকে বুকের মাংস খাইয়ে এখন হাড্ডিসার। নিস্তেজ।
কিন্তু আমরা মাকে উচ্চাসনে বসিয়েছি। ওই যে ধর্মকে যেভাবে বসাই। ধর্ম বিশ্বাস করি; ধর্ম-কর্ম করি, লেবাসেও ধর্ম, কিন্তু কাজ যা করি তার বেশির ভাগ অধর্মের।
সুতরাং মাকে অপমান করা হবে; মাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, মা ভাঁগাড়ের পাশে থাকবে ঠিক আছে; কিন্তু একে রূপক আকারে প্রকাশ করা যাবে না। ব্যক্তি বা সমাজ এতে আঁতে ঘা লাগে। মায়ের যে ভাবমূর্তি-পূজা তা নষ্ট হয়ে যায়।
মাকে আমরা কীই-বা দিতে পারি? পিপাসার পানি? খাওয়ার জন্য দানা? মাথাগুঁজার ঠাঁই? পরিধানের জন্য বস্ত্র? কিংবা রোগের জন্য পথ্য? হায়! এটা তো আমরা চাকরও দিই। তুচ্ছ যে তাকেও।
কিন্তু এই দিয়েও তো আমরা বলি, দিলাম তো, দিচ্ছি তো। রেখেছি বেশ!
আমার মনে হয় এর মেটাফর হতেই পারে না। কী হতে পারে এর রূপক?
মাকি এ চায়? সত্যি চায় আপনি এ দিন? মনে হয় না।মা কখনও সন্তানে কাছে কিছু দাবি করে না। সন্তান হাসিমুখে যা দেয়, সেটাতেই খুশি। তারচেয়ে খুশি নিজে যদি কিছু দেয়।
সিলভারস্টাইনের সেই গল্পটা মনে আছে? সেই আম গাছ আর ছেলেটার গল্প? আমগাছটার পাতা দিয়ে প্রথমে মুকুট বানাত, ডালে ডালে ঘুরে বাতাস খেত, তারপর আম খেত রোজ রোজ; একদিন এসে বলল ছেলেটা, তার টাকার দরকার। গাছটি সব আম দিয়ে দিল বিক্রি করতে, যাও প্রয়োজন মেটাও। ছেলেটা পরে এলো অন্য দাবি নিয়ে, তার ঘর লাগবে। গাছটা তার সব ডাল দিয়ে দিল, বানাও ঘর। তারপর এলো অপর দাবি নিয়ে, নৌকা বানানোর কাঠ লাগবে; তাও দিল আমগাছটা, কেটে নে আমার কাণ্ডটা। তবু খুশি গাছ, ছেলেটার তো উপায় একটা হবে। কিন্তু নৌকা করে যখন সাগর পাড়ি দেয় ছেলেটা, গাছের বুকের ভেতরটা খচখচ করে ওঠে। বহুদিন পর আবার ফিরে আসে ছেলেটা। গাছটা তখন বলে আয়, ‘কিন্তু এবার যে তোকে দেবার মতো আর কিছুই নেই আমার রে-আমার আমগুলো আর নেই। ডাল নেই, কাণ্ড নেই। কী দেবো তোকে, আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে তোকে কিছু দিতে পারব না বলে? ছেলে বলে আমিও তো বুড়িয়ে গেছি। আমারও শরীরে শক্তি নেই, দাঁতে জোর নেই। আমি এখন খুব ক্লান্ত। আমি শুধু একটু জিরোতে চাই। আর গুঁড়িটা এতে খুশি হয় খুব, ‘তা, বেশ তো, বুড়ি গুঁড়ি আর কিছু না হোক, বসে জিরোবার মতো একটা ভালো জায়গা তো বটেই। আয়, আয়, বোস, জিরিয়ে নে তোর যত খুশি।’ এই আমগাছ তো মা।
এই যে তথাকথিত শিক্ষিত, সেই গুঁড়ি মা-আমগাছ থেকেও স্বার্থ বের করে নেয়। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে অনেকে মিডিয়ায় মা-বাবা ছবি পোস্ট করে দেখবেন। মাকে নিয়ে আদিখ্যেতা দেখবেন। কিন্তু এটা মুদ্রার একটা পিঠমাত্র। আমি অনেককে জানি ফেসবুকে ঘনঘন মায়ের ছবি টাঙানো, কিন্তু মাকে নিজের কাছে এনে রাখেনি চোদ্দো বছরে একরাতও। পঙ্গু মাকে গোসল করিয়ে দেয়নি একটি বারও। অন্ধ মাকে হাত ধরে বাথরুমে নিয়ে যায়নি কোনওদিন। মায়ের দুর্গন্ধযুক্ত মলই তার বমির উদ্রেক করে। তবে, মায়ের সম্পদের হিস্যা বছরে নিতে ভুল হয় না কিন্তু। মা, বলে আমার মেয়েটার/ছেলেটার দরকার। আমি আর কদিন, নে। এমন ঘটনাকে প্রতীকায়িত করা যায় না। এর রূপক হয় না, মেটাফর হয় না। সেই ভাষা কবির নেই। মানুষের অনাবিষ্কৃত সে ভাষা। আবিষ্কৃত হয়নি বলে কবি চান নতুন ভাষার সন্ধান, নতুন রূপক বা মেটাফর যা দিয়ে মানুষের বোধকে জাগাতে পারেন।
৯
কিন্তু এই বক্তব্য জগতের সকল সন্তানের প্রতি নয়। সকল সন্তানই কুসন্তান নয়। মাতৃভক্ত সন্তানের অভাবও নেই জগতে। কিন্তু মাতৃভক্ত সন্তানও মাকে যে পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারে, এব্যাপারে আমি সন্দিহান। আমার কথা হচ্ছে এটা সম্ভবও নয়, আর উপলব্ধি করতে পারলেও তার যথাযথ মূল্য দিতে পারা অসম্ভব। কারণ মাতৃত্বের প্রতিদান হয় না। মাকে রক্ষা করার ক্ষমতা সন্তানের নেই, মা নিজেই একটি শক্তি। মা একাধারে জন্মদাত্রী ও রক্ষয়িত্রী। মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হয়েছে, ‘সমর্থং বা সমর্থং বা কৃশং বাপ্যকৃশং তথা।/রক্ষত্যেব সুতং মাতা নান্যঃ পোষ্টা বিধানাঃ॥’ অর্থাৎ পুত্র সমর্থ বা অসমর্থ যা-ই হোক, কৃশ-স্থূল যা-ই হোক মা তাকে রক্ষা করেন। মা ছাড়া আর কেউ যথাবিধানে পোষণ করে না।
আসলে মা-ই জগতের ঈশ্বর। তাই ঈশ্বর নিয়ে যেমন ট্যাবু আছে; আছে মা নিয়েও। ট্যাবু দিয়ে যেমন ঈশ্বরকে ঢেকে ফেলেছে ধার্মিকেরা; মাকেও নির্বাসনে পাঠিয়েছে ট্যাব্যাক্রান্ত মাতৃভক্তরা। ওদের ঘরে হয়তো মা আছেন, তিনি প্রতিমামাত্র; ঠাকুরঘরে রাখা।
আবার মাতৃভক্তরা মায়ের মাংস প্রতিদিন ভক্ষণ করবেন, তারিয়ে তারিয়ে খাবেন কিন্তু এটা প্রকাশে যত ঝামেলা। এসব প্রকাশ করলে মাকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয় না, মাতৃ-ট্যাবুতে আঘাত লাগে। এ এক মানসিকতা বটে। হাংরি আন্দোলন এ-ট্যাবু ভাঙতে চেয়েছিল; পরাবাস্তবাদী শিল্পতত্ত্বও চেয়েছিল বিকল্প শিল্পতত্ত্ব গড়ে তুলতে। এ শিল্পতত্ত্ব প্রতি-আধুনিকতার। এ যেমন সত্য, আবার মাকে নিয়ে কবিতা লেখাও অসম্ভব। যদি-বা সম্ভব, নীরব ভাষায়। কিন্তু সেটা কবিতা কিনা সন্দেহ আছে।
২৭শে এপ্রিল, ২০২১
সিলেট
আমাদের সমাজে মায়েরা যেমন আছেন লেখাটি তারই দর্পণ। বহুমুখী বিশ্লেষণে লেখাটি ঋদ্ধ।