হিমেল বরকতের ‘‘পথ-কবিতার বিলুপ্ত ভুবন’’ : অপাংক্তেয় পংক্তির খোঁজে

পথ-কবিতার বিলুপ্ত ভুবন ।। লেখক : হিমেল বরকত ।। প্রকাশক : বৈভব ।। মার্চ ২০২১, ঢাকা

 

আধুনিক বাংলা কবিতা যে-সকল প্রবণতা দ্বারা চিহ্নিত করা হয় সেখানে পথ-কবিতার কোনো স্থান নাই। কিন্তু বাংলা কবিতার ধারা চিহ্নিত করতে গেলে পথ-কবিতা স্ব-মহিমা নিয়ে হাজির হয়। যদিও তা নিরক্ষর, অশিক্ষিত, আধা-শিক্ষিত মানুষের মাঝে বিরাজ করে কিংবা যারা এর রচয়িতা তারা যেমন ‘গ্রাম্য’ কিংবা ‘ক্ষ্যাত’ তেমনি যারা এর ভোক্তা তারাও সমপর্যায়ের। ফলে এই শ্রেণিটির বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত যে-শ্রেণিটি কাব্যকলা, সাহিত্য, সংস্কৃতিচর্চারত তারা এই পথ-কবিতাকে তাদের পর্যায়ভুক্ত করেনি। ফলে ‘দুখিনি মায়ের পোলা’ হিসেবে পথ-কবিতা কবিতার ‘মূলধারা’য় আসন পায়নি। তার ঠিকানা হয়েছে লোকসাহিত্য।

 

মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা পথ-কবিতার রচয়িতা তারা এটা নিয়ে কখনোই আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগে না, যতটা ভোগে তাদের মূলধারায় স্থান না-দেনেওয়ালারা। ফলে বলা যায়, পথ-কবিতার উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ই নিরেট শিল্পমনা পরিচয়টা নিয়েই উপস্থিত হয়েছে।

 

অকাল প্রয়াত কবি, গবেষক হিমেল বরকত পথ-কবিতা নিয়ে গবেষণা করেছেন যা পথ-কবিতার বিলুপ্ত ভুবন নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখায় উল্লিখিত বইটি নিয়ে আলোচনা এবং ভবিষ্যতে পথ-কবিতা নিয়ে আরও যে-ধরনের গবেষণা হতে পারে সে-বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। পথ-কবিতার বিলুপ্ত ভুবন বইটি মোট তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত : ক. পথ-কবিতার পরিচিতি, খ. বিষয়-বৈচিত্র্য, গ. গঠনশৈলী।

আলোচ্য গ্রন্থে গবেষক উল্লেখ করেছেন, ঔপনিবেশিক শিল্পদর্শনর প্রভাবে ‘মূলধারা’র সাহিত্যের সঙ্গে যে বিচ্ছিন্নতার বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকে, সেই সময় থেকেই প্রান্তিক মানুষের সাহিত্য-ভোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে পথ-কবিতা।

পথ-কবিতার পরিচিত পর্বে হিমেল বরকত পথ-কবিতার একটি সংজ্ঞার্থ দাঁড় করিয়েছেন — যা ভাট কবিতা, হাটুরে কবিতা, পথুয়া কবিতা, পথের কবিতা, শিকুলি স্থানভেদে বিভিন্ন নামে পাওয়া যায়। এখানে পথ-কবিতার মুদ্রিত রূপ কত প্রাচীন তা সম্পর্কেও গবেষকদের মতামত তুলে ধরা হয়েছে। আরেকটি বিষয়ে গবেষক ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে পথ-কবিতা রচনায় মুসলিম কবিগণই অগ্রগণ্য, হিন্দু কবিদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা হতে পারে যে, কেন পথ-কবিতা রচনায় হিন্দু কবির সংখ্যা খুবই কম। অথচ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায় যে, মঙ্গলকাব্য, কবিগান এসবে হিন্দু কবিদের আধিপত্য। আবার পথ-কবিতার মধ্যে মধ্যযুগের কাব্য সাহিত্যের প্রভাব বিদ্যমান। ফলে যে-সকল হিন্দু কবিগণ পথ-কবিতা রচনা করেছেন তারা দেবদেবী নির্ভর বিষয়-আশয় থেকে বের হতে পারেনি। কিন্তু মুসলমান কবিগণ বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে পথ-কবিতা রচনা করেছেন। হিমেল বরকত আলোচ্য গবেষণাগ্রন্থে পথ-কবিতাকে নিম্নোক্ত বিষয়ে বিন্যস্ত করেছেন :

১.রাজনীতি : ক. দেশীয়
খ. আন্তর্জাতিক
২. সামাজিক সচেতনতা
৩. প্রাকৃতিক দুর্যোগ
৪. প্রেম
৫. বিশিষ্ট ব্যক্তি/স্থান/এতিহ্য/স্থাপনা
৬. অপরাধ ও শাস্তি বিষয়ক
৭. অলৌকিক ঘটনা
৮. চাঞ্চল্যকর
৯. ধর্মীয়/আধ্যাত্মিক/নীতিকথামূলক
১০. বিবিধ

এই বিষয়গুলো নিয়ে রচিত পথ-কবিতা আর ‘মূলধারা’র কবিতা নিয়ে একটি তুলনামূলক গবেষণা হতে পারে। বিশেষ করে রাজনীতি, সামাজিক সচেতনতা আর প্রেম বিষয়ক কবিতা নিয়ে। এক্ষেত্রে গবেষক একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন যে, মূলধারার কবিরা যখন ব্যক্তিবিচ্ছিন্ন ভাবনাকেই কবিতার ভেতর তুলে ধরেছেন তখন পথ-কবিরা সামষ্টিক ভাবনাকেই কবিতার ভেতর উপজীব্য করেছেন। গবেষক আরও বলেন :

বাংলাদেশের ‘মূলধারা’রর কবিতায় পাকিস্তানি শাসকের বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই মূল প্রতিবাদ কেন্দ্রীভূত থেকেছে। অপরদিকে, পথ-কবিতায় অর্থনৈতিক শোষণের স্বরূপ ও জনজীবনের বিপর্যস্ততা বিস্তৃত পরিসরে উপস্থিত। কবিতায় বক্তব্যগত এই প্রভেদের কারণ উভয়ের শ্রেণিগত অবস্থান। মধ্যবিত্ত-নাগরিক কবিগোষ্ঠীর কাছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনই গুরুত্বপূর্ণ উঠেছে, অন্যদিকে জীবনাভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ প্রভাবে পথ-কবিদের কাছে নিম্নবর্গের জীবনের অসহায়ত্বই প্রধান বিবেচ্য বলে গণ্য হয়েছে।

একই বিষয়কে ‘মূলধারা’র কবি ও পথ-কবিগণ যে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে হাজির করেছেন তাতে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রভাব কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা হতে পারে। এবং এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে যে, এই পথ-কবিগণ মাতৃভাষায় কবিতাচর্চা করেছেন ফলে তাদের দ্বারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বিরোধী এক ধরনের লড়াই জারি থাকে। যার ফলে তারা তাদের কবিতায় অর্থনৈতিক বিষয়টাকেই প্রাধ্যান্য দিয়েছেন। ফলে পথ-কবিতায় খুব সহজ সরল শব্দচয়নের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, শোষণ, শাসন এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। এক্ষেত্রে পথ-কবিদের রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পর্কে পরিচয় পাওয়া যায়। অর্থাৎ বলা যায় যে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত না হলেও তারা রাজনীতি সচেতন। এই রাজনীতি সচেতনতার ফলেই একাত্তর সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধে নিরক্ষর নিম্ন পেশাজীবী ও কৃষক শ্রেণির অংশগ্রহণ সম্ভব হয়েছিল।

 

গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে পথ-কবিতার গঠনশৈলী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। গবেষক এখানে দেখিয়েছেন যে, পথ-কবিতায় মূলত প্রাক-ঔপনিবেশিক কালের শিল্পাঙ্গিককেই ধারণ করে বিকশিত হয়েছে। ‘মূলধারা’র সাহিত্যের সঙ্গে এখানেই তাদের ফারাক ঘটেছে। তারা প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কাব্যাঙ্গিকেই পথ-কবিতা চর্চা করেছেন। আবার সুরের ক্ষেত্রে পয়ার, সস্তা, পঞ্চপদী প্রভৃতি সুর ব্যবহার করা হয়েছে। পথ-কবিরা বন্দনার ক্ষেত্রেও মধ্যযুগের কবিদের অনুসারী। ফলে বাংলা কাব্যের মধ্যযুগের ধারাটা পথ-কবিতার মধ্যে অনেকাংশে টিকে আছে। ফলে মধ্যযুগের কাব্য যদি ‘মূলধারা’র সাহিত্য হিসেবে আসন পায় তাহলে পথ-কবিতা কেন পাবে না তা গবেষণার দাবি রাখে।

 

আলোচ্য গ্রন্থে গবেষক উল্লেখ করেছেন, ঔপনিবেশিক শিল্পদর্শনর প্রভাবে ‘মূলধারা’র সাহিত্যের সঙ্গে যে বিচ্ছিন্নতার বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকে, সেই সময় থেকেই প্রান্তিক মানুষের সাহিত্য-ভোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে পথ-কবিতা। মুদ্রিত হলেও এসব কাব্য হাটে-বাজারে-পথে-প্রান্তে বহু জমায়েতের ভেতর পাঠ ও গীত হতো। কাব্য-পরিবেশনের ক্ষেত্রে প্রাক-ঔপনিবেশিক এই পদ্ধতি নিরক্ষর গণমানুষকেও সাহিত্য-ভোগের আস্বাদ দিতে পেরেছে। ফলে গণমানুষের সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তা-ই পথ-কবিতা। আর এই গণমানুষের সাহিত্য পথ-কবিতাকে আমাদের সাহিত্য হিসেবে নির্দিষ্ট পরিচয়ের সঙ্গে ‘মূলধারা’র সাহিত্য ও পাঠ্যসূচিতেও স্থান দেওয়া দরকার।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here