সাহিত্যে গবেষণা ।। পর্ব ২

মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম কবি, গবেষক এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। মূলত ইংরেজিতে লিখে থাকেন। বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন গবেষণা-পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য তিনি লিখবেন গবেষণা বিষয়ক ধারাবাহিক গদ্য। আজ প্রকাশিত হলো লেখাটির দ্বিতীয় পর্ব

 

গবেষণার কাজটি অত্যন্ত কঠিন, আবার খুব কঠিন নয়। কঠিন, কারণ এর জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এবং আরো আরো সময় ব্যয় করতে হয় গবেষণার জন্য। পড়তে হয় প্রচুর, পড়তে হয় একাগ্রচিত্তে। এখানে বলে নেয়া ভালো যে, গবেষণার জন্য যা যা প্রয়োজন তার মধ্যে ব্যাপক পড়াশোনার কাজটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করবেন, সে বিষয়ে অনেক অনেক বই এবং প্রবন্ধ পড়তে হবে। তারপর সময়। ভালো গবেষণা করার জন্য কত সময় যে ব্যয় করতে হয় তার হিসেব নেই। অন্যান্য অনেক আরাম-আয়েশের কাজগুলো থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হবে।

 

অর্থাৎ গবেষণার জন্য কুয়ালিটি সময় ব্যয় করতে হবে। তার মানে এই নয় আপনি নিজেকে বঞ্চিত করছেন। সব কাজ করেও গবেষণার কাজটিও সুন্দরভাবে করা যায়। শুধু প্রয়োজন সদিচ্ছা আর সময়ের সদ্ব্যবহার। নোট করুন ‘সদিচ্ছা’ আর ‘সময়ের সদ্ব্যবহার’। ‘সদিচ্ছা’ এবং ‘সময়ের সদ্ব্যবহার’ গবেষণার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গভীর প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ এ দু’টোর অনুপস্থিতি মানে হলো গবেষণার কাজ প্রায় অসম্ভব। তবে নিজেকে প্রস্তুত করে একটু গুছিয়ে নিলে গবেষণা অসম্ভব নয়।

 

তারপর আপনাকে একটা কাঠামোর মধ্যে কাজ করতে হবে। যাচ্ছে তাই লিখতে পারবেন না। কাঠামো রপ্ত করার জন্যও আবার পড়তে হবে। এরপর রয়েছে ভাষাগত দক্ষতা। এসবের প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে পরবর্তী সময়ে বিশদ আলোচনা করব। যাহোক এখন বলি কেন কঠিন নয়। ওই যে বললাম, সদিচ্ছা, পরিশ্রম, পজিটিভ মানসিকতা, ‘সেলফ মোটিভেশন’, অদম্য স্পৃহা আপনাকে আপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহযোগিতা করবেই। প্রচুর পড়াশুনা করে যদি আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারেন, আপনি কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলেন।

কারণ দুর্বল বা নামকাওয়াস্তে গবেষণা করা থেকে না করার সিদ্ধান্তই শ্রেয়তর।

শুরুর দিকে নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনার গবেষণা করা কেন প্রয়োজন। গবেষণা না করলে কী হয়? যদি করতেই হয় তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে গভীরভাবে। চারদিকে একটু তাকিয়ে দেখুন। আপনার আশেপাশে বা আপনার পাশের দেশ বা উন্নত দেশগুলোর দিকে। কারা কী করছেন? কারা কী নিয়ে গবেষণা করছেন? যারা ভালো গবেষণা করছেন তারা কোথায় প্রকাশ করছেন? গবেষণা জগতে তাদের অবস্থান কোথায়? তারপর ধীরে ধীরে বুঝতে চেষ্টা করুন আর সিদ্ধান্ত নিন আপনার মধ্যে গবেষণা করার আগ্রহ জন্মাচ্ছে কিনা। আপনি দেখুন কারো দ্বারা উদ্বুদ্ধ হতে পারছেন কিনা।

 

এমন কোন গবেষক আছে কিনা যিনি আপনাকে দারুণভাবে উৎসাহিত করছেন, অগ্রসর হওয়ার জন্য। এ উৎসাহ সরাসরি হতে হবে তা নয়। তার লেখা আপনাকে উদ্বুদ্ধ করছে কিনা। সবকিছু ঠিক থাকলে এমতাবস্থায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন আপনি গবেষণা করবেন। আর যদি কোনভাবেই উৎসাহিতবোধ না করেন, তাহলে থেমে যাওয়াই ভালো, কারণ দুর্বল বা নামকাওয়াস্তে গবেষণা করা থেকে না করার সিদ্ধান্তই শ্রেয়তর। যেহেতু গবেষণার কাজটি অত্যন্ত সিরিয়াস কাজ, আপনাকে সেভাবে ঢেলে সাজাতে হবে নিজেকে। তার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন — মানসিক এবং শারীরিক। আর এ ক্ষেত্রে মোটিভেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষণার জন্য ‘সেলফ মোটিভেশন’ অত্যন্ত জরুরি।

এখন বলতে চাই মোটিভেশন নিয়ে। গবেষণার জন্য ‘সেলফ মোটিভেশন’ অত্যন্ত জরুরি। আপনি যদি নিজে থেকে গবেষণা করার জন্য আগ্রহী হয়ে না উঠেন বা অনুপ্রেরণা না পান বা গবেষণা করতে আনন্দবোধ না করেন, এ কাজটি করা আপনার জন্য কঠিন হবে। কাজটি করতে আগ্রহবোধ না করলে সামনের দিনগুলো কোনভাবেই মসৃণ হবেনা। আর গবেষণার জন্য ভালোলাগা বা ভালোবাসা রীতিমত অক্সিজেনের সামিল। কাজটিকে যদি ভালোবাসতে না পারেন, আপনি এগুতে পারবেন না। নিজেকে নিজে অনুপ্রাণিত করতে হবে। যদি বুঝতে পারেন, গবেষণা আপনার ‘কাপ অভ টি’ নয়, তবে অন্যভাবে নিজেকে গড়ে তোলার উপায় আছে। যেহেতু এ লেখাগুলো গবেষণা বিষয়ক, আমি শুধু সেখানেই আলোকপাত করতে চাই।

 

এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার, আপনাকে কখনো কখনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। সেটা কেমন? যেমন ধরুন আপনাকে কেউ কেউ গবেষণার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করতে পারে বা গবেষণা সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলতে পারে। ডাইরেক্টলি বা ইন্ডাইরেক্টলি বলতে পারে ‘এসব করে কী লাভ’। ‘সিম্পলি গেট মোর স্পিরিটেড টু মোভ ফরওয়ার্ড’। তার অর্থ হলো আপনি আপনার কাজটি করতেই চান, যে যাই বলুক। সেটা হলো আপনি গবেষণা চালিয়ে যেতে চান, কারণ আপনি জানেন, গবেষণা করতে আপনি ভালোবাসেন। এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে কথা না বাড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ। বরং আরেকটু বেশি অনুধাবন করুন, আপনাকে আরো ভালো কাজ করতে হবে।

 

আপনি যখন গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন, আপনি দেখেশুনে ও বুঝে কাজটি করছেন। সুতরাং আপনাকে সামনে যেতে হবে, পিছানো যাবে না। সেজন্য আপনাকে স্থির করতে হবে নিজেকে কোথায় দেখতে চান। একটা লক্ষ্য স্থির করে নিতে পারেন। আগামী কয়েক বছরে কী কী বিষয়ে কাজ করবেন। কোথায় সাবমিট করবেন। মনে রাখবেন ‘নাথিং ইজ ইম্পোসিবল ইফ ইউ আর মোটিভেই্টেড অ্যান্ড ডিভোটেড’।

 

এক্ষেত্রে মাঝপথে অনেক বাধা-বিপত্তি আসতে পারে। যেমন আপনি লিখছেন, কিন্তু আপনার মনমত হচ্ছে না। সাবমিট করছেন, কিন্তু ‘রিজেক্টেড’ হচ্ছেন। যতই চেষ্টা করছেন, ভালো জায়গায় প্রকাশিত হচ্ছে না। এরকম অবস্থায় হতাশা চলে আসার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আমি বলব হতাশ হবেন না। হাল ছাড়বেন না। আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। ভালো কিছু অর্জন করার জন্য লেগে থাকতে হবে, আর অপেক্ষা করতে হবে অনেক অনেক দিন। ‘ধৈর্য’ ধরতে হবে। নোট করুন ‘ধৈর্য’। গবেষণা জগতে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার আছে।

 

এমতাবস্থায়ও নিজেকে প্রাণবন্ত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, হতাশা আপনাকে পিছিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং অনুপ্রাণিত হোন। অনুপ্রেরণা নানাভাবে আসতে পারে। নিজের অন্তর্জগতের বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে। যে ভাবনাটি আপনার ক্ষতি করছে বা আপনাকে পিছিয়ে দিচ্ছে তা ভাববেন কেন? ঠিক এমন পরিস্থিতিতে ভালো কিছু প্রবন্ধ পড়তে পারেন। যে প্রবন্ধগুলো ভালো জার্নালে প্রকাশিত হয় সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ুন, আর দেখুন তাতে কী আছে যার জন্য সেগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে, প্রকাশিত হচ্ছে। আর আপনারটিতে কোন কোন বিষয়ের ঘাটতি রয়েছে যার জন্য আপনি স্পেইস পাচ্ছেন না। বেশ কিছু ভালো লেখা পড়লে এবং সেগুলো আপনার লেখার সাথে মিলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন আপনাকে আর কী কী করতে হবে। ঘাটতিগুলো নিয়ে ভাবুন। নিজের উৎকর্ষ সাধনে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করতে হবে। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত আপনাকে নিজের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে। ভালো কিছু করার জন্য পরিশ্রমের বিকল্প নেই।

 

কীভাবে নিজের লেখা উন্নত করা যেতে পারে, আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোর উপযোগী করে তোলা যায়, তা নিয়ে অনেক কথা বলতে হবে। সুতরাং পঠন, ড্রাফট, লেখা, রিভিশন, এডিটিং, প্রুফরিডিং, সাবমিশন, রিজেকশন-একসেপ্ট্যান্স, কপিএডিটিং, প্রোডাকশন, পাবলিকশেন — এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বলব পরবর্তী পর্বগুলোতে। তবে এ মুহূর্তে শুধু এটা বলি যে, হতাশা গবেষণার জগতে ভয়ানক ব্যাধি — যা দূর করা আপনার জন্য অবশ্যকর্তব্য, কারণ তা না হলে আপনি অগ্রসর হতে পারবেন না। এখানে বলে নেয়া যেতে পারে, একাডেমিক জায়গায় এ-কথাটি জোরেসোরে উচ্চারিত হয় : ‘পাবলিশ অর পেরিশ’। কথাটা গবেষণার গুরুত্ব বুঝাতে বলা হয়ে থাকে। হতাশ হয়ে পড়লে পাবলিশ করতে পারবেন না, আর পাবলিশ করতে না পারলে একাডেমিক লাইফ অর্থবহ হবে না। সুতরাং আমি বলতে চাই, ‘পাবলিশ ওয়েল, সার্ভাইভ ওয়েল’।

(চলবে)

3 মন্তব্যসমূহ

  1. প্রাবন্ধিক মহোদয়কে অশেষ ধন্যবাদ গবেষণার মূল ধাপগুলো ধরিয়ে দেয়ার জন্য। আজকাল এই কথাগুলোই সহজে শুনতে পায় না শিক্ষার্থীরা। তারা উপলদ্ধি করতে পারে না যে কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাকে গবেষক হওয়ার জন্য সাহায্য করবে। কিংবা গবেষক হওয়ার জন্য কোন বৈশিষ্ট্যকে পরিচর্যা করে শাণিত করে নেয়া দরকার। ধন্যবাদ প্রাবন্ধিক মহোদয়।

  2. লেখায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ আছে। তবে ইংরেজি শব্দ ইংরেজিতে লিখে বন্ধনীতে এর বাংলা দিতে পারেন। বাংলা না দিলেও সমস্যা নেই।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here