বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।
২০
ছোটোবেলা প্রায় প্রতি ঈদেই দাদাবাড়ি যেতাম। ঈদের ছুটি কাটাতাম শেরপুরেই। আমার নানাবাড়িও শেরপুর। দাদাবাড়ির তুলনায় নানাবাড়ি কমই যাওয়া হতো। মা’রা ছয় বোন। আমাদের কোনো মামা নেই। বোনদের মধ্যে সারাক্ষণ মনোমালিন্য চলতেই থাকে। সামান্য ছুতা পেলেই তাদের ঝগড়া-ঝাটি। আবার সহজেই সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে সাধারণ পরিস্থিতিটা হিংসার আর মনোমালিন্যেরই। নানা-নানি বেঁচে ছিলেন যতদিন ততদিনই যাওয়া পড়তো। তা-ও মাঝে মাঝে। বাবা শেরপুর গেলে ফলমূল কিনে দিয়ে আসতেন। খোঁজ খবর নিতেন। মা কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে আসতো। বোনদের মধ্যে মা চার নম্বর। নানা মারা যাওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই নানি মারা যায়। আমাদের বড় তিন খালা আগে থেকেই বাপের ভিটায় থাকে। খালুদের মধ্যে বণিবনার অভাব থেকেই খালাদের মধ্যে সম্পর্কেও অবনতি। অবশ্য এত স্পষ্ট করে বলাও যায় না। খালাদেরও দোষ আছে। তাদের তিনজনের মধ্যে কারো সঙ্গেই সম্পর্ক ভালো না।
লাউ কাটতে গিয়ে দাদির হাত কেটে গিয়েছে। বাবা দাদির ওপরে খেপাখেপির পর্ব শেষ করে মা’র ওপরে খেপেছে। মা কেন তাকে কাটতে দিলো। আসলে বাবার অবস্থান এখানে দুর্বল। এটা বাবাও জানে। দাদিকে কেউ বলে কয়ে কিছু বোঝাতে পারে না। কাজ ছাড়া সে থাকতেও পারে না। এখানে মা’র কোনো ভূমিকা নেই। মা-ই বরং দাদির নির্দেশনায় চলে। কাজ করতে গেলে এরকম একটু-আকটু হবেই। এই ঘটনার শেষ কোথায় হবে, আমি জানি। মা’র ওপরে খেপাখেপির এক পর্যায়ে দাদি খেপে যাবে বাবার ওপর। বাবা তখন মিউ মিউ করতে করতে সাবধানে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নেবেন।
ঘর এখন ভরা ভরা। বাবা-মা দুজনের মুডই ভালো। সেমিস্টার ফাইনাল দিয়ে রিয়া এখন বাসায়। চার-পাঁচদিন হবে এসেছে। সারাদিন ঘুমানো আর হাই ভলিউমে টিভি দেখাই তার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কয়দিন গেলেই দাদির সঙ্গে তার ঝগড়া শুরু হবে। মা-ও বিরক্ত হবেন তার আচরণে। ঠিকঠাক মত খাওয়া নেই, গোসল নেই। দরজা বন্ধ করে ঘুমায়। আর টিভি দেখে। গোসল যদিও করে — করবে রাতে। দাদির কাছে এসব চলবে না। দাদিকে সে ফাঁকি দিলেও এই সব আচরণ মা’রও অপছন্দ। বড় হচ্ছে। বিয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে। এসব করে কাটালে চলবে না। রান্নাবান্নায় মাকে তার সাহায্য করা উচিত। এই হল দাদির বক্তব্য। মাকে সে রান্নায় সাহায্য করছে — এ বাড়িতে — এটা কেউ স্বপ্নেও দেখবে না। অবশ্য সাহায্য করার দরকারও নেই।
হিয়া এখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। সামনে তার টেস্ট পরীক্ষা। নিজে থেকেই বেশ সিরিয়াস হয়ে ওঠেছে। ও কি ভয় পাচ্ছে? পরীক্ষার সময় অনেকেই ভয় পেতে শুরু করে। ঘাবড়ে যায়। কী পড়বে কী পড়বে করে পড়তেই পারে না। মনে আছে, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার সামনে ভয়ে কেমন সাধু হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে মনে হত মাদার তেরেসা। সবার জন্য হৃদয়ে ভালোবাসা তৈরি হতো। প্রচুর নফল নামাজ পড়তাম সেই সময়। খুব ভালো লাগতো। পরীক্ষার দিনগুলো খুব ভালো কাটে। কত কিছু পড়ার আগ্রহ জাগে। মনে হয় বইগুলোকে খুব অবহেলা করা হয়েছে। পরীক্ষা শেষ হলে আবারও নতুন করে এগুলো পড়বো। শেখার আছে অনেক কিছু। পরে আর পড়া হয় না। সেই আবেগ আর থাকে না। মনটাও আর বিশুদ্ধ থাকে না। হিয়া তাহলে বিশুদ্ধ সময় কাটাচ্ছে। দারুণ সময়।
বিভাসকে নিয়ে আমার শেরপুর যেতে ইচ্ছে করে। গ্রামে গ্রামে ঘুরবো। সুন্দর বিকালগুলো কাটাবো তার সঙ্গে। গ্রামের চা-স্টলগুলোতে বসে চা খাবো। দোকানের বেঞ্চে বসে সাধারণ মানুষগুলোর সঙ্গে টিভি দেখবো। কী মজা! মানুষ আমার খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে সেই মানুষগুলোকে যারা আমাকে চেনে না। চেনা মানুষগুলো বিরক্তিকর। তাদের প্রতি আমার আকাঙ্ক্ষা থাকে, আমার প্রতি তাদের চাওয়া-পাওয়া থাকে। চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বের মানুষই সুন্দর। সুন্দর তাদের চোখমুখ। শেরপুরের সময়গুলোই আমার স্মৃতিতে আরামদায়ক। শহরের স্মৃতিগুলো কেমন জরাপাল্টা তারের মত। গ্রামের স্মৃতি পাকানো সুতার মত। এখন শুধু কুরবানির ঈদগুলোতে শেরপুর যাই। কুরবানির ঈদ আমার ভালো লাগে না। সবাই ব্যস্ত থাকে কুরবানি নিয়ে। ঠিকঠাক ঘুরাঘুরিটা হয় না। তবু ঈদ উপলক্ষে শেরপুর যাওয়ার মধ্যেই একটা আনন্দ আছে।
গতকাল বিভাসকে স্বপ্নে দেখেছি। তার সঙ্গে কোথাও যাচ্ছি আমি। আমাদের যেন বিয়ে হয়েছে। আমরা স্বামী-স্ত্রী। এটুকুই মনে আছে। বিভাসকে বলিনি এখনো। ইমরান বলে, মানুষের স্বপ্ন হল অচেতন মনের অবমুক্তি। উদাহরণ দিয়ে বলে। বলে, যে কামনাগুলো আমরা চরিতার্থ করতে পারি না। সেগুলো আমাদের মনের গভীর স্তরে গিয়ে লুকায়। স্বপ্নে তারা প্রকাশিত হয়। এতে মানুষ স্বাভাবিক থাকে। নয়তো অবদমনের চাপে মানুষ অসুস্থ হয়ে যেতো। স্বপ্নে সবকিছু প্রতীকায়িত হয়ে যায়। প্রতিটি নাম, শব্দ, দৃশ্য সেখানে প্রতীক হিসেবে কাজ করে। স্বপ্নে কেউ যদি সাপ দেখে তারও একটা অর্থ থাকে। ইমরানকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মানুষ স্বপ্নে সাপ কেন দেখে? বলেছিলাম, স্বপ্নে আমিও সাপ দেখি। কেন দেখি? এটা কি খারাপ কিছু? উত্তরে আবারো সে কঠিন কঠিন কথা বলা শুরু করেছিলো। শেষপর্যন্ত আমার কথার উত্তরই সে দেয়নি। বলেছিলাম, ‘বলো না, এটা কি খারাপ কিছুর ইঙ্গিত?’ আমার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয় সে। বলে, স্বপ্ন দেখার মধ্যে ভালো-খারাপ বলে কিছু নেই।
প্রতিটি বস্তু নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে। কারণ তারা আমাদের জীবনেরই অংশ। বিভাস বলে যায়। বলে, ইমরান ভালো বলতে পারবে। ইমরানের মার্কস বলে, মানুষের নিজস্ব শরীরের বাইরেও তার শরীর থাকে। মার্কস তাকে বলে অজৈব শরীর। তোমার ঘরের নরম বিছানাটাও তোমার শরীর। তোমার খাটের নিচে ঘুরে বেড়ানো তেলাপোকাটাও তোমার অংশ। তাদের স্বরূপ সম্পর্কে জানলেই কেবল তাদের সঙ্গে সঠিক আচরণটা তুমি করতে পারবে। তারা তোমাকে, তোমার চিন্তাকে অবিন্যস্ত করে দেবে না। তোমার ঘরে সাপ ঢুকলে তুমি এলোমেলো হয়ে যাও। কারণ সাপকে তুমি চেনো না। সাপ তোমাকে চেনে না। এই ঘরটা তো পৃথিবীরই অংশ, সাপ তো পৃথিবীরই অধিবাসী। তুমি যদি জঙ্গল কাটতে পারো, তবে সাপ কেন তোমার ঘরে ঢুকতে পারবে না? সবকিছুর মূলে হলো জ্ঞান। মানুষ যখন বাতাসকে জানতে পেরেছে, তখন বাতাসে প্লেন ভাসাতে পেরেছে। যখন জলকে জেনেছে, তখন জলে জাহাজ ভাসাতে পেরেছে। যখন নিজেকে জানবে, তখন নিজেকে জীবনের ঊর্দ্ধে মেলে ধরতে পারবে। ইমরান অবশ্য তর্ক করবে আমার সঙ্গে — বিভাস বলে — তার মতে জীবনের ঊর্দ্ধে বলে কিছু নেই। হয়তো নেই। জীবনই হয়তো জীবনের ঊর্ধ্বে।
দুইজন একসঙ্গে হলে সারাক্ষণ তর্ক করে। আমি হয়ে যাই রেফারি। আমি উপলক্ষ মাত্র। আমাকে আশ্রয় করে তারা তর্ক করে। ইমরান খুব এগেসিভ। মনে হয় এই বুঝি ঝগড়া শুরু করবে। তেমনি বিভাস খুব ধীর স্থির। খুবই আশ্চর্যের বিষয় হল, তারা দু’জনেই দু’জনকে পছন্দ করে। খুব পছন্দ করে। আমার মনে হয়, ইমরান যা বলে তা সে বিশ্বাস করে না, বা বিশ্বাস করতে চায় না, সে বিশ্বাস করতে চায় বিভাসের কথা। তেমনি বিভাসও যা বলে তা সে বিশ্বাস করে না, বা বিশ্বাস করতে চায় না, সে বিশ্বাস করতে চায় ইমরানের কথা। ইমরানের কথাকে বিভাস শ্রদ্ধা করে। অবশ্য সে সবার কথাকেই শ্রদ্ধা করে। এটাও তার একটা গুণ। অনেককেই দেখেছি অপরকে ছোটো করে কথা বলে। বিভাস এটা কখনোই করবে না। আসলে তার মত কেউ হয় না। আর এ মানুষটাকেই আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। ভেতরে ভেতরে আমার খুব গর্ব হয়। সারা দুনিয়ার কাছে বিভাস হয়তো কিছুই না। আরেকজন হয়তো তার চেহারাও পছন্দ করবে না। কিন্তু আমার কাছে সে অনেক কিছু।
তার মানে বিভাসের সঙ্গেই আমার বিয়ে হচ্ছে। স্বপ্নে তো তাই দেখলাম। এবং এটা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিভাসের কাছে স্বপ্ন এতো হালকা বিষয় নয়। সে খুব গুরুত্ব দেয়। স্বপ্নের কথা বললে খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। টিভিতে ফেয়ার এন্ড লাভলির অ্যাড হচ্ছে। বাবাকে মেয়ে বিয়ে দিতে চায়। মেয়ে বলে, আগে নিজের একটা চাকরি, আরও কী কী তার অর্জন করা বাকি আছে। সেই সব অর্র্জন করা শেষ হলে — সেই ছেলেটার সমান হলে — তারপরে বিয়ে করবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, স্কুলের চাকরিটা আমার হবে। হওয়ার মত পরীক্ষা আমি দেইনি। তবু হবে। চাকরি হওয়ার মত পরীক্ষা তো এখানেও দেইনি, তবু তো হয়েছে। তার মানে হতে পারে। সব মিলিয়ে আশা তৈরি হয়েছে আমার মধ্যে। মা খুব আশা করে বসে আছে। মার কথা হলো, বাসার একদম সামনে, এরচেয়ে ভালো নাকি আর হয় না। এমনিতেও মা আমার প্রতিদিনের জার্নিতে খুব বিরক্ত। আমার মনে হয়, তার মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ তৈরি হয়েছে। তার ধারণা সংসারের কথা চিন্তা করেই আমি কষ্ট করে চাকরিটা করছি। এটা বললে অবশ্য তাদের বোঝার কথাও নয়, চাকরিটা আমি কেন করছি। আর এখন চাকরিটা আমার ভালো লাগে। এখান থেকে যে আমি এতকিছু পাবো, তা ভাবিনি। আমি এখন মুক্ত। আমার মন কোথাও আবদ্ধ হয়ে নেই। চাপা পড়ে নেই শোভন নামের কোনো পাথরের নিচে। আমি এখন হালকা। পালকের চেয়েও হালকা। আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিভাস। ভাইভাতে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল ‘লায়লা’ শব্দের অর্থ কী? আমি পারিনি। ‘লায়লা’ মানে রাত। তাহলে ‘বিভাস’ শব্দের অর্থ কী? অভিধান খুলে দেখলাম ‘বিভাস’ শব্দের অর্থ হল : উজ্জ্বল প্রকাশ; রাত্রিকালীন রাগিনীবিশেষ। কী আশ্চর্য! কী দারুণ মিল আমাদের দুজনের নামের।
: কী করো তুমি?
: পড়ছি।
: গতরাতে স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে। কী দেখেছি জানো?
: কী?
: দেখি যে, আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমরা ঘুরতে গিয়েছি কোথাও। সবাই আমাদের দেখছে।
বিভাসই আমাকে বলেছিল, ‘লায়লা’ মানে হচ্ছে রাত। ভাইভার আদ্যোপান্ত শুনে সে বলেছিল, চাকরিটা আমার হবে। তবু তার কথা আমার বিশ্বাস হয় না। কে জানে হয়তো আমাকে খুশি করার জন্য বলেছে। কখনো আবার মনে হয় হতেই তো পারে। আবার মনে হয়, হবে না। ভাবছি নিজের এলোমেলো ভাবটা গুছিয়ে ফেলতে হবে। অগোছালো চিন্তা খুব হতাশা তৈরি করে। বিভাস বলে, গোছানো বা এলোমেলো জীবন বলে কিছু নেই। সবকিছু নিজের চিন্তায়। গৌতম বুদ্ধ নাকি বলেছেন, আমরা যা চিন্তা করি, আমরা তাই। আর তাতেই পরিণত হই। গোছানো বা এলোমেলো এটা দৃষ্টির তারতম্য মাত্র। কারো কাছে পৃথিবী খুব স্থির ও শান্ত। কারো কাছে উত্তাল। আসলে শান্ত মনই পৃথিবীকে শান্ত দেখে। তেমনি উত্তাল হৃদয় পৃথিবীকে উত্তাল কল্পনা করে।। জ্ঞান জীবনের প্রতি গোছানো দৃষ্টি দিতে সহায়তা করে। যদি গোছানো বলে কিছু থাকে। কেননা, তা আপেক্ষিক। গোছানো বলতে কিছু তখনই থাকে যখন এলামেলো বলে কিছু থাকে। গোছানো এলামেলোকে জন্ম দেয়। এলোমেলো জন্ম দেয় গোছানোকে। দুইয়ে মিলে জগৎ। দুইয়ে মিলে জীবন। জীবন তাই গোছানোও নয়, এলোমেলোও নয়।
: বলো তো, ‘বিভাস’ মানে কী?
: বিভাস একটা রাগিনীর নাম। রাতের রাগিনী।
আমি আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, ও মা! তুমি দেখছি জানো! খুব সুন্দর নাম — জিজ্ঞাসা করলাম — কে রেখেছে? বললো, তার মা। মা? তার মুখ থেকে ‘মা’ শব্দটা শুনতে ভালো লাগলো। বাবা যখন দাদিকে উল্লেখ করে কথা বলেন কারো সঙ্গে তখন এভাবে ‘মা’ উচ্চারণ করেন।
: তুমি তো কখনো তোমার বাবা মা’র বলো না আমাকে! জিজ্ঞাসা না করলে তুমি কিছুই বলো না!
: আমি যখন পেটে। রাতে মা’র ঘুম হত না। জেগে থাকত সারা রাত। বই পড়ত। গান শুনত। আর কোত্থেকে নাকি হাস্নাহেনার তীব্র গন্ধ আসত। তীব্র গন্ধ। মা ঠিক করেছিল মেয়ে জন্মালে নাম রাখবে হাস্না। মা চাইতো তার মেয়ে হোক। তাই নাম ঠিক করে রেখেছিল। ছেলে হবে ভাবতেই পারেনি। ‘বিভাস’ শব্দটির অর্থ মা জানতো না। অভিধানে দেখল এটি একটি রাগিনী। রাগ আর রাগিনীর পার্থক্য জানো? বলোতো কী?
: জানি না। তারপর?
: রাগের স্ত্রী হল রাগিনী। সংগীতশাস্ত্রে রাগ আছে ছয়টি। এই ছয়টি রাগের ছত্রিশটি রাগিনী। তার মধ্যে একটির নাম বিভাস।
: তোমার মা’র কথা বলো। শুনতে ভালো লাগছে।
: মা দেখলেন ‘বিভাস’ নামটি স্ত্রীবাচক হলেও শোনায় পুরুষবাচক। রাত জাগতে জাগতে তখন তার রাত ভালো লেগে গেল। এতই ভালো লেগে গেল যে রাতের রাগিনীকে উনি এড়াতে পারলেন না। ঠিক করলেন ছেলে হলে তার সন্তানের নাম হবে বিভাস।
‘কী দারুণ! এতো একদম বইপত্রের গল্পের মত!’ — আমি বললাম — ‘তোমার মা নিশ্চয়ই খুবই রুচিশীল মানুষ ছিলেন?’ বিভাস চুপ করে থাকল। আমি তার চুপ থাকার অর্থ বুঝলাম না। বললাম, তোমার মা’র সম্পর্কে আমি অনেক অনেক কথা জানতে চাই বিভাস। তোমার মত একজন সন্তানের যিনি মা, তার সম্পর্কে জানার আমার অনেক আগ্রহ। প্লিজ, আমাকে বলো। আমি সত্যিই জানতে চাচ্ছি। ভদ্রতা করে বলছি না।
: মা’র নাম শিউলি। মোছাম্মত শিউলি বেগম। বেগম কাদের বলে, বলোতো? মুসলমান সম্ভ্রান্ত মহিলাদের বলে বেগম। রুচির দিক দিয়ে মা সত্যিই সম্ভ্রান্ত ছিল। খাটাশ টাইপের ছিল আমার নানা। সম্ভবত মাকে জন্ম দিতে গিয়েই খরচ হয়ে গেছে তার সব গুণ।
মানে কী? ওর মাথাটাথা ঠিক আছে তো! কী বলছে এসব। মজা করছে না তো! নাকি পরীক্ষা করছে আমাকে!
বিভাস হাসল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছি। মনে হচ্ছে ভিন্ন দুনিয়ার কোনো কাহিনি। এখানকার প্রতিটি চরিত্রের কোনোটিই জাগতিক নয়। এরা ভিন্নজগতের বাসিন্দা সবাই। এরা কোনোদিন এই মর্ত্যরে বাসিন্দা ছিলেনও না। আমি শুধু হ্যাঁ, হুঁ বলে শুনে যাচ্ছি বিভাসের কথা।
: শিউলি আমার পছন্দের ফুল। কী শান্ত আর সুন্দর। হাতের তালুতে একটি শিউলি রাখলে কেমন জীবিত লাগে দেখেছো? মা ছিল কালো। আমি হয়তো শিউলি ফুলকে কালোই দেখি। মা একটি বেসরকারি কলেজের শরীরচর্চার শিক্ষিকা ছিলেন। এমপিওভুক্ত। পরে সেটি সরকারি হয়। অনেকই তাকে বাংলার শিক্ষিকা মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত ছিলেন মা। বাসায় বড়সড় ছবি টানালেন রবীন্দ্রনাথের। এ-নিয়ে বেশ ঝামেলাও হল। কিছুদিন সেই ছবি রাখা হল উল্টে। পরে আবার মা নিজেই সোজা করে দিলেন। এরপর থেকে সোজাই রয়ে গেল। মা বলতেন, নজরুলকে তিনি বুঝেন না।
‘আচ্ছা, তুমি কি সবসময়ই এমন? মানে ছোটো বেলা থেকেই এমন? এমন বলতে এখনকার মত? কেমন ধীর-স্থির-সববোঝোটাইপ?’ তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। ও হাসে। বলে, কেন আমি কি সবজান্তা ভাব নেই? বললাম, ‘ঠিক তা না। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই একদিনেই সব বুঝতে শেখোনি?’ ‘না, তা তো অবশ্যই না।’ আমার কথা স্বীকার করে নেয় বিভাস। ‘তারপর বলো, তোমার মা’র কথা বলো?’
: আমার বড়বোনটা দেখতে হয়েছে মা’র মত। চেহারা ঠিক মা’র মত নয়। চাল-চলন আর অঙ্গভঙ্গি একদম মা’র মত। মা’র মত হাসে। রাগ করে। মা খুব মেধাবী ছিলো। আর ও হয়েছে গাধা। না গাধা নয়। ওর মেধা আমি বুঝতে পারি না। ওর নাম শিপ্রা। তার কথা কি কোনোদিন বলিনি তোমাকে?
: নিজে থেকে তুমি কি কখনো আমাকে কিছু বলো? এখন যে জিজ্ঞাসা করছো?
: শিপ্রা করিম। নামটা কেমন? বাবা রেখেছে এই নাম। শিপ্রা একটা নদীর নাম। প্রাচীন নদী। ও ফর্সা হয়েছে। বাবার মত। আমার বাবার নাম মো: শামসুল করিম। ওকালতি করতেন। উকিলদের ভালো মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। উনার বেলাতেও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। বাবাকে বেশিদিন পাইনি। বাবা যখন মারা যায় আমি তখন ছোটো। সেভেনে পড়ি।
: কীভাবে মারা গেলেন উনি?
: স্ট্রোক নাকি করেছিল। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা যায়। আমার দাদা তখনও বেঁচে ছিলেন। দাদিও বেঁচে ছিলেন। কিন্তু উনি বাবার আসল মা নন। দাদার দুই বিয়ে। আমাদের আসল দাদি যখন মারা যায় বাবা তখনো বিয়েই করেননি। আমাদের দাদিকে আমরা দেখিনি। দাদি বলতে আমরা দ্বিতীয় দাদিকেই বুঝি। আমাদের কাছে তিনিই প্রথম। তোমাকে তো বলেই চলেছি। এসব আমাদের নিজেদের ইতিবৃত্ত। তোমার ভালো লাগছে?
বললাম, খুব ভালো লাগছে। তোমার মা’র কথা বলো। তোমার মাকে আমার দারুণ একজন মানুষ মনে হচ্ছে। বেশি বেশি উনার কথাই বলো।
: আলাদাভাবে কেউ দারুণ হয় না। সবাই দারুণ। দারুণভাবে দেখতে জানতে হয়। আমি এরকম ছিলাম না। আমি ছিলাম তোমার শোভন। শোভনের চোখেই জগৎ দেখতাম। শোভনও হয়তো বাসা থেকে টাকা নিতো বেশি বেশি। উড়াতো যাচ্ছেতাই করে। তোমাকে পাবার আগে পাড়ায় যেতো। ‘পাড়া’ কি জানো? পতিতালয়। আমরা কয়েকজন নাম দিয়েছিলাম শ্বশুরবাড়ি। আমার বন্ধুদের যখন মাসে তিন হাজার টাকা হলেই চলতো, তখন আমার লাগত ছয় হাজার। এই-সেই কোর্সের কথা বলে টাকা নিতাম। কিছুদিন গাঁজাও খেয়েছি। জিনিসটা ভালো। খারাপ না। আবার কখনো শুরুও করতে পারি।
মানে কী? ওর মাথাটাথা ঠিক আছে তো! কী বলছে এসব। মজা করছে না তো! নাকি পরীক্ষা করছে আমাকে! আমি কী বলি! কেমন একটা থ্রিল ফিল হচ্ছে তার কথায়। একদম বানানো গল্প। নাটুকে গল্প। সিনেম্যাটিক!
: আমি এজন্যই তোমাদের বুঝতে পারি, দিয়া। আমরা একই। আমরা যাপন করছি একই জীবন।ঈশ্বরের জীবন। ঈশ্বর তোমারামার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। জীবন যাপন করে। পাড়ায় যায়। সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ে। আমার একজন বান্ধবী ছিলো। চটপটে আর স্মার্ট বান্ধবী। গার্লফ্রেন্ড আর কি! রোমানা। তার নামের শেষে ছিল ‘না’। অথচ আমার সব কথাতেই ও বলতো ‘হ্যাঁ’। ‘গালফ্রেন্ড’ শব্দটাকে পরে আমি অপছন্দ করতে শিখেছি। এরচেয়ে বান্ধবী শব্দটাই আমার পছন্দ। বান্ধব থেকে বান্ধবী। ‘পরাণের বান্ধব রে/ বুড়ি হইলাম তোর কারণে।’ জানো কার গান? শেখ ওয়াহিদ। বিসিএসে এসেছিল। তখন পারিনি। আমার প্রথম প্রস্তাবেই রোমানা রাজি হয়। নিজেকে সে সমর্পণ করে আমার কাছে। আমার উচিত ছিলো তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করা। কিন্তু আমি তা করিনি। করতে পারিনি। করার ক্ষমতা আমার ছিলো না। শুনতে তোমার ভালো লাগছে, দিয়া? আমি তোমাকে বিরক্ত করতে চাই না।
: বলো। শুনছি।
: আমার মধ্যে যখন ভাঙন শুরু হয়েছিল। বিদ্যমান অবস্থার ভাঙন। পারিবারিকভাবেও আমি তখন ব্যাপক ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখনই সে আমার ব্যাপারে অনেক কথা জেনে যায়। সরাসরি সে জিজ্ঞাসা করে আমাকে। আমি তখন ঠিক এই সব সমস্যার সমাধান করার অবস্থাতেও ছিলাম না। আমি স্বীকার করলাম সব। আমার ওপরে আনীত সকল অভিযোগ। ও খুব কষ্ট পেয়েছিলো। অনেক কষ্ট পেয়েছিলো। যতটা আমি ভেবেছিলাম, ও ছিল তারচেয়ে শতগুণ ভালো একটি মেয়ে। আমার আসলে যেকোনো একজন সুন্দরী মেয়ে হলেই চলতো। প্রেম করার জন্য। মজা নেওয়ার জন্য। কিন্তু যেকোনো সুন্দরী মেয়ে সে ছিলো না। সে একটি ফুল ছিল। কেবল আমি ছিলাম না প্রাণদায়ী প্রকৃতি। একটি সুন্দর ফুলকে পাবার উপায় তাকে বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে ফেলা নয়। ছিঁড়ে হাতে নিয়ে পিয়ে পিষে ফেলা নয়। পিষে ফেলে গন্ধ নিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা নয়। আমি তাই করেছিলাম।
: আমি কি তোমার মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছি? বিভাস?
: না। আসাদুল্লাহ খাঁ গালিব নামে একজন কবি আছেন। তুমি তাকে চেন?
: না।
: বহুবছর আগে আমার মত তিনিও একই উপলব্ধিতে পৌঁছে ছিলেন। কী লিখেছিলেন জানো?
‘ফুলবাগিচার রূপ দেখতে চাই, আবার ফুল তুলতেও চাই —
হে বসন্তের স্রষ্টা আমার মন পাপী॥’
: জানো, রোমানা আমাকে ত্যাগ করেনি। কীভাবে যেন আমাদের দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেলো। সোজা কথা তাকে আমি ধ্বংস করেছি। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছি তাকে। সে ছিল স্বর্ণখ-। তাকে গলিয়ে উজাড় করে দিয়েছিলাম। দেউলিয়া করে দিয়েছিলাম আমি। তার সমস্ত কিছুকে পুনরায় স্বর্ণে পরিণত করার জন্য আমি সাধনা শুরু করি। শুরু করি পরশপাথর হওয়ার সাধনা। আমাকে বদলে দিয়েছিলো আমার মা। মায়ের মৃত্যু। নিজেকে চিনতে শিখি আমি। চিনতে শিখি রোমানাকে।
তোমার জন্য খারাপ লাগছে, বিভাস। এসব কথা তো বলোনি কোনোদিন! কোনোদিন অবশ্য জানতেও চাইনি। শুধু নিজের ভালোলাগা-মন্দলাগা চাপিয়ে দিয়েছি তোমার ওপর। ‘এগুলো ঘটনামাত্র। কাহিনি। কাহিনি দিয়েই মানবজন্ম গড়া। কেবল আমার নয়। সকলের ঘটনা এখানে। একেকজন মানুষ চলমান কাহিনির অংশ মাত্র। প্রতিটি কাহিনিই মূল্যবান। কাহিনির মূল্যোদ্ধার করাতেই জীবনের সার্থকতা। সাধনা এটাই। কাহিনি বোঝা সহজ নয়। যে কাহিনি বোঝে সে নিজেকে বোঝে। যে নিজেকে বোঝে, সে ভগবানকে বোঝে।’ বিভাস হাসে। বলে, এসব তার কথা নয়। শাস্ত্রের কথা। আমিও হাসি। খুব ঘুম পাচ্ছে আমার।
পড়ুন ।। কিস্তি ১৭