কবি জাকির জাফরানের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়। এপিকধর্মী এই কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে আমরা কোনো তাত্ত্বিক আলোচনায় যাব না। কারণ এই কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে ইতোমধ্যে বহু সারগর্ভ আলোচনা হয়েছে। আলোচনা করেছেন দেশের খ্যাতিমান কবি-লেখকগণ। আমরা শুধু দেখতে চাই নারী ও জ্যোৎস্না দুই বোনের মতো এক মহাশক্তিরূপে কীভাবে আর্বিভূত হয় এই বইয়ে। আমাদের এই অনুসন্ধান সীমাবদ্ধ থাকবে ১-১২ সংখ্যক সনেটের মধ্যেই। যদিও গ্রন্থটি ৬৬টি সনেটে সম্পূর্ণ হয়েছে।
পৃথিবীর প্রথম সেই জ্যোৎস্নাকান্তি যারা দেখেছিল,
তোমার হাতেই আমি স্বপ্নপোড়া তাদের করোটি
তুলে দেবো, তুমি আজ গোত্রপ্রধান তাদের। বলো,
কে ছিল প্রথম নারী খোঁপায় যে গুঁজেছিল ফুল!
পৃথিবীতে প্রথম কে জ্যোৎস্না দেখেছিল? কে জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে বলেছিল ‘অপরূপ’। আমরা জানি না। কিন্তু কবি জানেন। জানেন বলেই তিনি তাদের করোটি তুলে দেন এক নারীর হাতে এবং নারীকে তিনি সম্মানিত করেন তাদের গোত্রপ্রধান হিসেবে। কে এই নারী? এই নারী আজকের নারী। এই নারী শুধু জননী। এই গোত্রপ্রধান নারীকে আমরা ভাবতে চাই প্রথম নারী হিসেবে। এবং তিনি চিরজীবিত। জাতিস্মরও। এই নারীই জন্ম দেবে জ্যোৎস্নাপ্রিয় সন্তান-সন্ততি। আর, যেহেতু তিনি জাতিস্মর, তাই তার কাছে কবি জানতে চাইবেন,
কে ছিল প্রথম নারী খোঁপায় যে গুঁজেছিল ফুল!
দিঘিজলে স্মিত মুখ দেখে নিজেকে সে ভেবেছিল
অনন্তবিহারী আসমান—…
যেন জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য আবিষ্কারক সম্প্রদায়েরই কেউ, কোনো নারী, প্রথম খোঁপায় ফুল গুঁজেছিল।
শরীর নিয়তি নয় নারী, জাগো, চোখ তুলে দেখ—
বাউরি বাতাস বয় হৃৎপিণ্ডে, বয় প্রত্নস্মৃতি।
প্রথম জ্যোৎস্না-দেখা, প্রথম খোঁপায় ফুল-পরা সম্প্রদায়ের জননী যেন আজ আর জননী নয়। মানুষ তাকে একটা শরীরে পরিণত করেছে। শরীরসর্বস্বতা থেকে নারীকে উদ্ধার করে আবারো কবি তাকে রোপণ/স্থাপন করতে চান সেই ভূমিতে/আসনে, যেখান থেকে বিচ্ছুরিত হবে সেই প্রথম আলো। আমরা আবার সেই মানুষে পরিণত হব, যে-মানুষ মাটির। জ্যোৎস্নার। ফুলের।
জ্যোৎস্নাসম্প্রদায় কাব্যগ্রন্থে জ্যোৎস্না ও নারী দুই শক্তির নাম। দুই মায়াবী জাদুবল। এই শক্তি আমাদের জাগায়।
জ্যোৎস্নাসম্প্রদায় পড়তে-পড়তে কল্পনায় ভেসে উঠেছে একটি দৃশ্য। দৃশ্যটি এমন : অতীত নামে একটি খনি খোঁড়া হচ্ছে। খুঁড়ছেন কবি নিজেই। খনিটি ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর সেই অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে বাংলা, যেখানে বাংলাদেশ। খনি থেকে তিনি তুলে আনছেন স্মৃতি। যেন তিনি অতীত। যেন তিনি জাতিস্মর। যেন আজকের মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছেন সেই স্মৃতি। সেই অতীত। যে-মানুষেরা অন্ধ। বধির। মূক। স্মৃতিহারা। ম্যানিকিন। তারা হাঠাৎ জেগে উঠছে সকল প্রকার প্রতিবন্ধিকতা ভুলে আবারও জীবনের প্রতি। আর আকাশ খুঁজছে মাথার উপর, খুঁজছে সেই জ্যোৎস্নাকান্তি। অভিভূত হচ্ছে। যেন এই প্রথম তারা আকাশ দেখছে। যেন এই প্রথম জ্যোৎস্না দেখছে। কবি দেখাচ্ছেন :
আশ্বিনের শুক্লা শুরু হলে, সহস্র মাইলব্যাপী
আতপ চালের শুভ্র গুঁড়ি দেখ উড়ছে আকাশে
ভাবিনি কখনো জ্যোৎস্নার রঙ আতপ চালের শুভ্র গুঁড়ির মতো। জ্যোৎস্না আর আতপ চালের গুঁড়ির এই চিত্রকল্প আমাদের কল্পনায় ভাসিয়ে তোলে বহুকাল আগের জীবন। যে জীবন আমরা যাপন করেছি, করে ডুবিয়ে দিয়েছি কালের অতলে। কবির এই ইমাজিনেশন-শক্তি আমাদের পুনরায় পৃথিবীর জীব ভাবতে বাধ্য করে। বাধ্য করে ফিরে যেতে মাটির কাছাকাছি। যে-মাটিকে আমরা ঢেকে দিয়েছি ইটে-পাথরে। আর এইসব স্মৃতির আঘাতে—
…অতঃপর একদিন সত্যি সত্যি।
পথে পথে চর্যা কুড়াতে কুড়াতে দেখি সামনেই
কান্নার কৈলাস। দেখি কবি হতে চলেছে বালক।
এই কবি পূর্ণিমায় মরে যায়। তারে ভ্রমর বাঁচায়। আর—
আবার সে সারারাত পিষ্ট হয় চাঁদের চাকায়।
‘চাঁদের চাকা’? মনে হচ্ছে চাঁদ এক যান আর আমরা তার নিচে সৌন্দর্যে মোহিত। মরে যাচ্ছি, তবু মরণের কথা মনে আসছে না। যেন চন্দ্রাহত। চাঁদে পাওয়া। কিন্তু এই সৌন্দর্য অবলোকনের গভীরে থাকে এক গূঢ় জন্মবেদনা। তাই আমাদের দরকার হয় ‘গোপন কান্নার এক ঘর’।
গোপন কান্নার এক ঘর থেকে দেখা গেল চাঁদ।
গোত্রমাতা বসে আছে দেখি জ্যোৎস্নাকুঞ্জের ভিতর।
চন্দ্রাহত, কান্নার ঘরের অধিবাসী কবি চলে যান সেই গোত্রমাতার কাছে। কারণ :
…নারীর মুখই তার পানশালা—
কখনও যেখান থেকে ফেরে না কোনোই চন্দ্রালোক।
কবি দেখেন :
শুক্লা-দ্বাদশী চাঁদের নিচে তসবিহ পড়ে
বৃক্ষ ও পাথর, শিলাখণ্ড শূন্যে দুলে ওঠে যেন।
জ্যোৎস্নাসম্প্রদায় কাব্যগ্রন্থে জ্যোৎস্না ও নারী দুই শক্তির নাম। দুই মায়াবী জাদুবল। এই শক্তি আমাদের জাগায়। জাগায় মাটির প্রতি। কৃষির প্রতি। প্রেমের পাখির প্রতি। কবিতা তার চেয়ে বেশি কী করে? ‘লেট দেয়ার বি লাইট’-এর মতো এক উচ্চারণ যেন কবি জাকির জাফরানের জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়। ফুল না ফুটলেও আমরা যেমন বসন্তকে পাই কবিতায়, কল্পনায়। সুভাষে। পাখি না থাকলেও আমরা যেমন টের পাই কল্পনায়, কবিতায় ‘পাখিসব করে রব’। তর্কালঙ্কারে। কানন ও কুসুম কিছুই না থাকার পরও কল্পচোখে যেমন দেখতে পাই, ‘কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল’। ঠিক তেমনি খুন হয়ে যাওয়া ‘আতপ চালের গুঁড়ির মতো’ জ্যোৎস্নাকে আমরা টের পাই, উপভোগ করি। জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়ে। কবি লিখেন :
বেদনার বাঁকা পথে আমি হাঁটি এ তনাই নিয়ে
মাছের পেটের নীল আঁশটে জ্যোৎস্নায় চলো যাই,
ইউনুস নবি যেখানে ঘুমায়—সেই চন্দ্রিমাগহ্বরে
কৃষির অনন্ত ফাঁদ পাতা আছে কি না দেখে আসি।
জ্যোৎস্না যেন মানুষের বেদনারও সহোদর। দুঃখের আধার। আমাদের সোনালি দুঃখ সে ধারণ করে তার রুপালি শরীরে।
সবুজ ব্লাউজ কারো যদি ওড়ে শিমের মাচাঙে
কৃষির সমস্ত ব্যথা তবে চন্দ্রালোকে বৃদ্ধি পাবে।
এবং পরক্ষণেই শক্তিরূপে দেখা দেবে। চাঁদ। চাঁদের আলো। চাঁদের আলোর আহবানে জ্বলে উঠবে বিপুল পৌরুষ। বিপুল শক্তি। যে শক্তির স্পর্শে গাছের জন্ম হতে থাকবে। নারী এসে চুম্বন করবে সেই পুরুষের ঠোঁট। যে-পুরুষও গাছের বীজের সদৃশ এক বীজ। মানব সন্তনের পিতা। যেন চাঁদের আলোর প্ররোচনায় শুরু হবে মানুষের চাষ। দুইজন মানব-মানবীর চুম্বনে। ভালোবাসায়।
হেঁয়ালি চাঁদের ডাকে পাথরে প্রেমের ভূমা জ্বলে।
গুহা থেকে দেখেছিলে এক পেয়ারা গাছের নিচে
জেগে উঠেছিল আরো ছোট ছোট গাছ—সেই থেকে
বীজের ধারণা নিয়ে তুমি বুঝি চুম্বন করেছ
জলজান্তা পুরুষের ঠোঁট।…
কিন্তু মানব চাষ বন্ধ হয়ে গেছে কোথাও। সবখানে। মরে গেছে জ্যোৎস্না। পরের সনেটে আমরা টের পাই সভ্যতার পতনের খবর।
…আজ ময়ূরাক্ষী নদীর পানিতে
এক নেড়ি ইঁদুরের পা-ধোয়া জগতে আধো-সাদা
জোছনা পড়েছে, যেন এক জালুয়া মেয়ের সাথে
বনিবনা শেষে গুহায় ফিরে যাচ্ছে দ্রাবিড় যুবক।
এখানে ‘জোছনা’ বানানটিও লক্ষণীয়। যেন জ্যোৎস্না তার জৌলুশ হারিয়েছে। হারিয়েছে মানবজমিও তার গড়ে তোলা কৃষি সভ্যতার অহংকার। অন্য এক বিধ্বংসী সভ্যতার স্বপ্ন-চিন্তা-কল্পনা তাকে আবারো ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গুহায়। ভালোবাসাবাসি শেষ হলো যেন। শেষ হলো স্বপ্নের।
এর পর থেকেই কবি যেন নতুন এক স্বপ্ন রচনার দিকে যাত্রা করেন। যে-যাত্রায় এসে মিশতে থাকে, কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, ‘‘…বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, লোকজ ইতিহাস, ঐতিহ্য, বাংলার রাজনৈতিক কাঠামো, বাঙালির বীরত্বগাথা ও রাষ্ট্রচিন্তা, চর্যাপদের আবহ, গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলি, বাংলার আলোকস্তম্ভতুল্য ব্যক্তিদের নাম ও কর্ম, বাংলার কৃষক ও প্রান্তিক মানুষের আবহমান বেদনা, প্রেমের সঙ্গে কৃষি ও মিথের আশ্চর্য মিথস্ক্রিয়া, ধর্ম, সুফিবাদ ও বাউলিয়ানা, সর্বোপরি শক্তি ও সৃজনের প্রতীক এক নারী চরিত্রকে কেন্দ্রে রেখে নারীজাগরণের স্বপ্নের ওপর ক্রমাগত জ্যোৎস্নার প্রক্ষেপণ…।’’