মামুন অর রশীদের কবিতাগুলো প্রকৃতপক্ষে শহুরে জীবনের জার্নাল; মোহ ও মায়ায় ভরা মধ্যবিত্তের প্রেম ও কাম, প্রজ্ঞা ও বাসনার বিস্তার ঘটেছে কবিতাগুলোতে।
পারভার্ট সিরিজ
১
যে পাপগুলোর জন্য বেঁচে আছি
যে পাপগুলোর জন্য বেঁচে আছি সেগুলো প্রকাশ্য এবং মধুর।
লুকিয়ে তোমার কাছে ছুটে যেতে নিষেধ করেছে যেসব কিতাব
সেসবের পাতায় পাতায় বিষ ও বিষাদ, আর যে প্রতিবেশীরা
ইথিকস নিয়ে হাজির হবে ওরা মূলত দারোয়ান, ওঁদের চোখে-মুখে
গিবত। এই যে সেদিন, বার থেকে বেরিয়ে, যখন দুজনে মিল্কিওয়েতে
হাঁটছিলাম আর হাঁটতে হাঁটতে অনেক সংকোচ নিয়ে তোমাকে বলেছিলাম,
যদি তুমি আশকারা দাও, তোমাকে পাওয়ার জন্য খুনোখুনি হবে,
আর তখনি তোমার চোখে শুকতারার মতো ঝিলিক, হতে পারে
আমার প্রতি তাচ্ছিল্য বা প্রশ্রয়। অথচ আমি বুঝেছি, এর জন্য
আমার বেঁচে থাকার দরকার।
তাই তোমাকে নিয়ে যাব প্লুটো। ফ্রাসটেটেড বাঙালি থেকে দূরে।
সেখানে আমরা পাপ করব, মধুর, প্রকাশ্যে। এর জন্যই আমরা
বেঁচে আছি।
২
যে কথাগুলো নির্ভয়ে বলতে পেরেছিলাম আর তুমি হেসেছিলে
এই বর্ষা তোমাকে শিখিয়েছে কীভাবে পিয়ানো হতে হয়,
মানুষ বেজে উঠতে পারে মেঘ ও মেঘহীন; তুমিও আঙুলকাতর,
সর্বনাশা সন্ধ্যায় ডুব দাও মগ্ন প্রেমিকের গ্লাসে। তুমি শিখে
গেছ, মগ্নতার কোনো ঋতু নেই, এই বর্ষা যে চিঠিগুলো
পোস্ট করে তোমাকে জাগাতে, সেগুলো সাদাকাগজ, তবু তুমি
জেগে ওঠো বৃষ্টি ও বৃষ্টিহীন। আমিতো প্রেমিকের পাশে তোমার
সন্ধ্যাভরা চোখে মরিচের মতো লাজ দেখতে চাইনি; মাথা নিচু
করে হেঁটে চলে গেছি অনেক তাড়ার ভান করে। আমিতো শুধু
তোমার সংকোচ ভাঙার শব্দ শুনতে চেয়েছিলাম বর্ষায়।
বিশ্বাস করো, আমি ভীষণ সৎভাবে চেষ্টা করেছি, তোমার
প্রেমিকের হাঁটার ভঙ্গি অনুকরণ করার, এমনকি তাঁর জুতার রং,
শার্টের হাতা গুটানোর উদাসীনতা। ওর কাছে আমার অপরাধবোধের
শেষ নেই। আমার মফস্বলগন্ধা চলাফেরা তোমার স্বপ্নের ভিতর
ঢুকতে পারে কিনা জানি না। তবু, ভীষণ বর্ষায় বুড়ো মহিষের সারারাত
দাঁড়িয়ে থাকা রোগের মতো আমার জেদ,
তোমাকে পাওয়ার।
৩
আমি আসলে কোথাও নেই, লুকিয়ে থাকতে দেয়াশলাই
বাক্সে প্যারেডের সিপাহির মতো সোজা, রাতকানা হয়ে
বুড়ো হারিকেনের ঘোলা চিমনির ভিতর, আরও নিরীহ
জায়গা, একটা রঙচটা পোস্টবাক্সের অন্ধকারে লুকিয়ে
আমি রাত দেখতে চেয়েছিলাম। প্রচুর জিরাফের দেশে
আমি কণ্ঠ হারিয়েছি শৈশবে।আমার মুখ মুছে দিয়েছে
কিছু নাগরিক ইরেজার।তবু আমার নার্সিসাস ফুলে
মুগ্ধতা ।
কোথাও নিজের নাম না দেখে আমি দেয়ালে লেখা
স্লোগানগুলোর বর্ণ এলোমেলো করে আমার নাম তৈরির
চেষ্টা করি, কখনো পিতার বা পিতামহের ডাকনাম,
সম্ভব না হলেও আমার পাড়ার সন্দেশবিক্রেতার। সত্যি
বলছি, আমি আসলে কোথাও নেই। আমি ভুলভাল
গায়েবি জানাযার মতো নিজেকে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছি
একটা হিজল ফুলের ঘ্রাণের ভিতর। একটা ধুঁকতে থাকা
হলের টিকিটমাস্টারের মানিব্যাগে লুকানোর জায়গা
পেয়েছিলাম, কিন্তু ডাকটাররা আজকাল রুগির রক্তের
চেয়ে নার্সের ঠোঁটের মাপজোক বেশি করে বলে আমি
শরমে সবুজ মাছের চোখে ফিরে যেতে চেয়েছি। একটা
প্রবল মহুয়া আমার শেষ আশ্রয় ছিল, সেখানে শুধু তারা
তাড়ানো আলো আছে। আলো পরিধি থেকে সত্যি
আমি আজ খেদানো, এমনকি তোমার নেইলপলিশের
দৃষ্টিসীমা থেকে।
৪
মাছবাজারে গিয়ে দেখি ওরা শুয়ে আছে, ওদের
চোখ, আমার মরা ভাইদের চোখের মতন চেয়ে আছে।
প্রিয় মাছেরা, দাওয়ের সামনে তোমাদের কণ্ঠহীন চিৎকার
কানে আসে কেন? মাছঅলা লোকটা কেমন তোমাদের
গরাত করে কেটে পিছ পিছ করে দিলো, আমিও তোমাদের
আঁশের গন্ধভরা টাকাগুলো গুনে নিলাম। তোমাদের রক্তের
রং ভুলিয়ে দেয় ফ্রাইপ্যান থেকে আসা বাসনার চিন্তা।
এখন বুঝি, মা কেন তাজা মাছের কথা বলে?
তাজা মাছেরা কস্তুরী। তোমরা মরে থেকো জল ছাড়াবার পর
এমনি এমনি। না হলে থাইকো মেলার মাটির টিয়াদের মতন।
এই সেদিন, মাছেদের সঙ্গে সাঁতার কেটেছিলাম লাল চোখে,
নদীর জলে। সেদিন ওরা বলেছিল, আমাদের গলার মতো
তোমাদের আঙুল দাওয়ের কাছে নত, কতো মিল! আসো
সাঁতার কাটি, আসো উৎসব করি।
এরপর ভাতভরা পাত থেকে মাছের ঝোলকে তীব্র গোলাপজল
লাগছে। এখন মা আমাকে আর তাজা মাছের কথা বলে না।
জার্নাল ১২ জুন ২০১৯
৫
কাউকেই মনে পড়ছে না,
বেতফুলের পাতা দিয়ে বাঁশি বাজিয়ে
বিস্মিত করে দিয়েছিল নানাবাড়ির যে রাখাল,
তার মুখও মনে পড়ছে না।
এমনকি এই শহরে যাদের কাছে ঠকেছি,
তাদের অনেকদিন মনে রাখার কথা ছিল।
আজ তাদের খুঁজে পাচ্ছি না।
আমার এক ব্যাংকার বন্ধু বিপ্লব করবে বলে
সারারাত গল্প করেছিল এঙ্গেলসের,
তার একটা আবছা শার্টের বাইরে
আর কিছু মনে পড়ছে না।
আর সেই রাজকন্যারা যারা মূলত
ভালোবাসার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল,
আজ তাদেরও মনে পড়ছে না।
তবে, যে গৃহপালিত পশুদের
আদরে আদরে বড় করে খেয়ে ফেলেছে আমার আত্মীয়রা,
জবাই করার আগেও তাদের চোখে ছিল কৃতজ্ঞতা,
আর মালিকের প্রতি বিশ্বাস,
সেই পশুদের মুখ অনেক দিন ভুলে থেকেছিলাম ,
আজ তাদের মনে পড়ছে কেন?
জার্নাল ২৯ জানুয়ারি ২০২১
৬
আর জীবনই তোমাকে ডিপ্রেশনের দিকে নিয়ে যাবে, তুমি খেলবে সারারাত,
দুলবে পরের দিনভর, পরের রাত, তারপর কোনো এক ঝিমুনির ভিতর মনে পড়তে
পারে বোকা** আমার মতো কড়ইগাছগুলোকে। তোমার জীবন ভরে সুবাস আর কমলা
রংঙের মতো আনন্দ নিয়ে তুমি ডিপ্রেশনের দিকে যাবে। শুধু চেকইন দিতে যে মেয়েরা
চারুকলায় যায়, তাদের ভেতরে চুমু খাওয়ার বাসনা জাগাতে আমি মোহাম্মদপুর থেকে
রিকশায় উঠে বলি, এসো এসো আমার ঘরে এসো। ওখানে আমি তোমাকে
চাঁপাটাপা ফুল দিয়ে মূলত **তে চাই ক্যানভাসে। অথচ কী দারুণ কানের দুলের পাশে তিল
তোমার তুমি দেখিয়ে বেড়িয়েছ ইন্সটায়।
জার্নাল ২১ জানুয়ারি,
এসএফও, সান ফ্রান্সিসকো
৭
আমারতো হওয়ার কথা ছিল একটা জংলার বনরুই, নত মাথা।
সবচেয়ে উজ্জ্বল ফুল তুলে আনা মেয়েদের বাড়ির পাশে কী দারুণ
ফার্ন জন্মে। মেয়েরাও কীভাবে ঋতু আর লাবণ্য নিয়ে বেড়ে উঠেছে।
এই বিস্ময়ে ঘোরে সুবোধ পারভার্ট আমি, জংলায় ফিরে যেতে চাই।
আমারতো জন্মই হয়েছিল সেই ছবিটির ভেতরে উড়বে বলে, শিকারী
আমাকে বন্দুক তাক করে রাখবে, পাকড়া ধনেশ আমি আর তুমি
পাখা মেলে উড়ব, উড়তে উড়তে মরবার আগে ফ্রেমে। কী দারুণ!
আমার হওয়ার কথা ছিল, সেই সংশয়ী, যে মূলত নার্সকে বলবে না,
আমার শোয়া দরকার, দ্রুত মরে যাওয়ার বদলে হলেও শান্তি দরকার।
আর বেডের পাশের ওষুধগুলো কখনোই সৃষ্টিকর্তার বিপক্ষে নয়।
আমি জলরঙ-এ যে মফস্বল এঁকে তার ভেতর ঘুরতে পারি সেখানে
এখন হেমন্তের রাত। আমি ঘুরব। পুরনো মানুষের কোত্থেকে
চলে আসবে, এমন কী সেই সন্দেশ বিক্রেতা, যে মূলত জাদুগর।
দাদি আমার মাথায় সরিষা তেল দিয়ে দেবে। আর নদী থেকে
কবে হারিয়ে যাওয়া বোয়ালটাই হয়তো নিয়ে এসে এক জেলে বলবে,
জীবনে এমন দারুণ রাত আর নেই, বেশি দাম না। আমার হয়তো
মাঝির বউকেই ভালো লেগে যাবে, পারভার্টের কাছে সব একই।
আর যদি এসময় পুরনো মৌলভির আজান ভেসে আসে,
তাহলে সাফ সাফ ভদ্রলোক। কিছু গুনাহর বদলে কিছু জলের গন্ধ
পেতে পারি কি-না হয়তো জানা যাবে না।
আমার চাষ করার কথা ছিল একটা দোলনচাঁপা বাগান।
০২ ডিসেম্বর ২০১৯
একজন প্রাজ্ঞ পণ্ডিত ও পরিশ্রমী গবেষক হয়েও কী করে যে মধ্যবিত্ত মেকি নাগরিকদের অন্তর্দহনের স্বরূপ এত সূক্ষ্মভাবে অনুধাবন করে তাকে সাবলীল বয়ানে উপস্থাপন করতে পারেন মানুন অর রশীদ তা ভাবতে গেলে আমরা বিস্ময়ের নিঃসীম জগতে বিলীন হই।
চিন্তা আর চর্চার ফসল। ভালো লাগে সহজ স্বীকারোক্তি।