সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন পঞ্চাশের দশকের কবি শঙ্খ ঘোষ। প্রজ্ঞা ও কাব্য, জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের দারুণ যুগলবন্দিত্ব ঘটেছে তাঁর কবিতা ও ব্যক্তিত্বে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন কবি উন্মেষ ধর।
২০০৫ সাল, যখন ১২-র ক্লাস শেষ করব, তখনই কবিতা পড়ার তুমুল তারুণ্যে পরিচয় কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে, কবিতা ‘যমুনাবতী’। পরিচয় হলো, কিন্তু আত্মীয়তা হতে আমার লাগল আরও দুই বছর । সিরাজগঞ্জের মতো মফস্সল শহরে পরীক্ষার পুলসিরাত উত্তীর্ণ হওয়ার নির্দেশনামূলক পুস্তক ছাড়া কোনো বই-ই আদতে মেলে না। বছর দুই পরে রাজশাহীর নিউমার্কেটের লাইব্রেরিতে পেয়ে গেলাম শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা বইটি । পাতা উলটে ভূমিকা-অংশে একটা বাক্যে চোখ আটকে গেল, ‘সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার।’ এর চেয়ে সরল করে কবিতা নিয়ে আর কী বলা যায় ? এই উক্তির সঙ্গে মানানসই এডওয়ার্ড সাইদের একটি উক্তি উল্লেখ করা জরুরি, যা এখন প্রবাদতুল্য`Speaking Truth to Power’। সাইদ বলেছেন, ‘ক্ষমতাবানের মুখের উপর অকপটে সত্য উচ্চারণ করাই বুদ্ধিজীবীর দায়’ (Representations of the Intellectual : The Reith Lectures) । শঙ্খ ঘোষ সম্ভবত কবিকে ঠিক এই ভূমিকাতে রেখে বলেছেন কথাটা। কবি তাই, তাঁর কাছে ভাষিক কারবারি নন শুধু, বরং অনেক বেশি সামাজিক-রাজনীতিক ডিসকোর্সে অংশগ্রহণকারী। কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর কালের রাজনীতির ক্ষমতা-কাঠামোর বিষমতাকে কবিতার ভাষায় অনুবাদ করে সাইদ বর্ণিত বুদ্ধিজীবীর ভূমিকাটি পালন করেছেন ।
সেই ২০০৭ সালে বিকেলে মেসে ফিরে নির্জন, কনে দেখা আলোয় একের পর এক পড়ে ফেলেছিলাম শঙ্খ ঘোষের কবিতা । দিনগুলি রাতগুলি থেকে শুরু করে বাকি সব । গদ্য পড়েছি আরও বছরখানেক পরে । বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে । প্রথম পড়েছিলাম গদ্যের বই কবির অভিপ্রায়, তারপর কবিতার মুহূর্ত । শেষোক্ত বইয়ে জানা গেল কবিতার জন্মরহস্যের সমাচার; পাওয়া গেল সৃজনের বহিরঙ্গ বিবরণ। যদিও এ বহিরঙ্গতা কবিতা পড়ায় ভূমিকা রাখে সামান্যই । তবু কবিতার যেখানে দাবি তার শব্দবাহী অন্তরঙ্গতার আবিষ্কার, সেখানে এ জানা কবিতার শারীরচিত্র দৃশ্যমান করে তোলা কেবল। পাঠক মাত্রেরই লক্ষ্য থাকে শব্দমধ্যগত যে আঁধারিত প্রদেশ, যে অপঠিত অংশ (যাকে জাঁক দেরিদার ভাষায় বলে ‘aporia’), তাকে আলোকমূর্ত করা, তাকে পড়া।
দার্শনিক পরিবেশনা শঙ্খের কবিতায় অলক্ষ্যে প্রধান ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে, ‘অবাধ প্রগলভতা’ কোনো প্রশ্রয় পায় নি।
কবি যখন লেখেন, তখন তো মূলত কবিতার ডিসকোর্সের মধ্যেই তাকে লিখতে হয় । বহিরঙ্গের চাপ (যাকে বলা যেতে পারে জীবনী ধরে কবিতাপাঠ) কবিতার সেই ইতঃপ্রস্তুত ডিসকোর্সকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে । শব্দের গায়ে লেগে থাকা অভিধানগৃহীত অর্থের স্খলনই কবিতার নিজস্ব দুস্তর বলে গণ্য। কবিতার রসিক কারবারি শঙ্খ ঘোষ এসব কথা মাথায় রেখে কবিতার মুহূর্ত-এ বিবৃত এক-এক গল্পকে বলেছেন কবিতার ‘সূচনাবিন্দু’ । কবিতাকে বহু পাঠের স্তর থেকে একস্তরী হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে ভূমিকাংশেই শঙ্খ জানিয়েছেন এ কথা। দার্শনিক পরিবেশনা শঙ্খের কবিতায় অলক্ষ্যে প্রধান ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে, ‘অবাধ প্রগলভতা’ কোনো প্রশ্রয় পায় নি।
শঙ্খ ঘোষের প্রবন্ধসাহিত্যের বড়ো অংশই আদতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-নাটকের নানান অভিক্ষেপ ও বিচ্ছুরণের চিন্তাসূত্রের হদিস এবং ব্যাখ্যান। এ কাজ বুদ্ধদেব বসুও করেছেন, তবে এ দুই মনীষীর চিন্তনপ্রণালীর ফারাক আছে। একটু পরেই পাড়ছি সে কথা । শঙ্খ ঘোষের পাঠ করার ধরনটা ব্যাখ্যামূলক, বিশ্লেষণনির্ভর নয়। তা তিনি রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করুন, অথবা সমকালীন/দূরকালীন স্বভাষী বা বিভাষী কোনো কবি বা সাহিত্যিককে। তাঁর সাহিত্যপাঠ অনেকটা রবীন্দ্রনাথের পাঠপদ্ধতির অনুরূপ। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ‘সাহিত্যের বিচার হচ্ছে সাহিত্যের ব্যাখ্যা, সাহিত্যের বিশ্লেষণ নয় । … অবশ্য সাহিত্যের ঐতিহাসিক বিচার কিংবা তাত্ত্বিক বিচার হতে পারে। সেরকম বিচারের শাস্ত্রীয় প্রয়োজন থাকতে পারে, কিন্তু তার সাহিত্যিক প্রয়োজন নেই।’ (‘সাহিত্যবিচার’) ভালো/মন্দ-লাগা এমন সরল সিদ্ধান্ত-নির্ভর পাঠ শঙ্খের স্বভাববিরুদ্ধ। নাকচধর্মী পাঠ তাঁর পছন্দ নয়। তিনি বরং পাঠের আনন্দকে ক্রমাগত সম্প্রসারিত করে আনেন বৌদ্ধিক প্রদেশে, যেখানে একটি পাঠের সঙ্গে আরও দশটি পাঠ মিলিয়ে কোনো টেক্সটের ব্যাখ্যা হাজির করেন। পাঠশাস্ত্রের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘Intertextul Reading’।
শঙ্খ সীমানির্ধারণী উপায়ে কোন টেক্সটকে পড়েন নি; আদর্শিক কর্তৃত্বের জোরে কোন পাঠকে দ্বিধাগ্রস্ত করা বা বর্জনের ঘোষণা করা এ তাঁর প্রত্যয়বিরোধী; তুলনায় একপ্রকার আত্মগত পাঠই তাঁর পাঠপদ্ধতির মৌল স্বভাব, সে তরিকাতেই কোনো লেখকের রচনা পড়ে ফেলেন।
তাঁর রবীন্দ্রনির্মাণ (তাঁর ভাষায় ‘সৃষ্টি’ বটে) বিষয়ে উল্লিখিত সূত্র থেকে কথা বলা যেতে পারে। প্রত্যেক রবীন্দ্রপাঠই তাঁর আত্মগত পাঠ, সমগ্র রবীন্দ্রনির্মাণ-ই আদতে তাঁর আত্মিক বয়ান (আত্মগত বা আত্মিক বলছি; ব্যক্তিগত বা ব্যক্তিক বলছি না, এ দুয়ের মধ্যে তাত্ত্বিক পার্থক্য করছি, Subject আর Person-এর মধ্যে যে পার্থক্য) । বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথকে বিচার করেছেন (কবি রবীন্দ্রনাথ) পশ্চিমা মনীষাকে প্রমাণরেখা বরাবর ধরে (যে বয়ান কলকাতার জ্ঞানকাণ্ডে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিল), শঙ্খ ঘোষ বলছেন ‘বুদ্ধদেব বসুর রবীন্দ্রভাষ্য রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বুদ্ধদেবকেই ধরিয়ে দেয় বেশি ’। বস্তুত শঙ্খ ঘোষ বুদ্ধদেবের রবীন্দ্রবিচারের পদ্ধতিকেই সমস্যায়িত করেছেন, দেখিয়েছেন বুদ্ধদেব ব্যবহৃত প্রযুক্তির সীমানির্দেশী ভঙ্গি, যা রবীন্দ্রপাঠকে কী করে সমগ্র থেকে ‘আপাত-বিযুক্ত’ ও টুকরো টুকরো করে ফেলে (‘বুদ্ধদেবের রবীন্দ্রনাথ ১’, ‘বুদ্ধদেবের রবীন্দ্রনাথ ২’)।
শঙ্খ ঘোষ তাঁর প্রথম যৌবনেই জেনেছেন রবীন্দ্রবিরোধিতা আধুনিকতাবাদের প্রমুখ শর্ত, শুনেছেন বুদ্ধদেব বসুর ঘোষণা ‘The Age of Rabindranath is over.’ (আমাদের কবিতাভবন) । যেন সে কালের ‘এপিস্টেম’ হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার । এই বিগ্রহভাঙা (Iconoclast) প্রবণতা শঙ্খ ঘোষ পরিণত যৌবনে দেখেছেন তাঁর ‘কমরেডদের’ মধ্যে (যাঁরা সবাই কোনো-না-কোনোভাবে বুদ্ধদেবের বয়ানের দ্বারা আবিষ্ট) — সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘তিনজোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্ররচনাবলি লুটোয় পাপোশে‘ (‘পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া কিছুই থাকে না’)। এই জারি-থাকা কর্তৃত্ববাদী বয়ানের মধ্যে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার না-করে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর চিন্তার গড়নও রৈবিক ছায়ায় আবরিত। আদতে তাঁর রবীন্দ্রসামীপ্য, চিন্তার ক্রমবিকাশে রবীন্দ্রপ্রভাব ঘটেছে একই ঘরানার (School) চিন্তার অনুশীলনের ফলে।
উনিশ শতকে ঔপনিবেশিক আয়তনে বৌদ্ধিক চর্চার কার্যত ফল হলো চিন্তনপ্রণালীর দুই স্কুলের ভাগ বা গঠন – ১. অ্যাংলিসিস্ট ও ২. অরিয়েন্টালিস্ট। রবীন্দ্রনাথ চিন্তার এই দ্বিবিভাজনের মধ্যে একটা সমঝোতা তৈরি করে নিয়েছিলেন তাঁর মতো করে, যা ছিল সংস্কৃত, পরিশীলিত; এবং ঝোঁক মূলত অরিয়েন্টালিস্ট স্কুলের দিকে অধিক। নব্য সে ঘরানা সুগঠিত, শৃঙ্খলিত বিদ্যায়তনিক রূপ নিল রবীন্দ্রসাহিত্যের দিগন্তবিস্তারী প্রভাবের কারণে, শঙ্খ ঘোষ এই ঘরানারই জ্ঞানতত্ত্বে ধ্যান দিলেন। তাই রৈবিক জ্ঞানতত্ত্ব শঙ্খের চিন্তাগুচ্ছের মর্মের সংবাদ নিলেই দেখতে পাওয়া যায়। তিনি আবার তাঁর এক-অন্ত রবীন্দ্রনাথকে নির্মাণ (/সৃষ্টি) করেছেন খোদ রবীন্দ্রনাথের প্রযুক্তির ব্যবহার্যতা বাড়িয়ে; তারই সাক্ষ্য হিসেবে যে কেউ পড়তে পারে নিবন্ধ দামিনীর গান-এ ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ গানের ব্যাখ্যা। সে লেখাতেই দামিনীর ( রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস চতুরঙ্গ-এর নায়িকা) অন্তিম উক্তিকে বিশদ ভাবনার খোরাক করে তুলেছেন ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ গানের অ-পূর্ব যোগ ঘটিয়ে। শঙ্খের নির্মিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো তিনিও সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী ছিলেন না, তাঁর ছিল রবীন্দ্রনাথেরই মতো ‘সর্বগ্রহণের উন্মুখতা’ । শঙ্খের রবীন্দ্রভাষ্যের মধ্যে গঠিত হয়ে আছে, পরিকল্পিত হয়ে আছে তাঁরই স্বধর্ম। তাই তাঁর রবীন্দ্রনির্মাণ বা রবীন্দ্রভাষ্যকে একটু আলংকারিক করে বলা যায়, এ তো শঙ্খেরেই আয়না মাত্র।
দার্শনিক পরিবেশনা শঙ্খের কবিতায় অলক্ষ্যে প্রধান ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে, ‘অবাধ প্রগলভতা’ কোনো প্রশ্রয় পায় নি। তাঁর কালের অন্যান্য কবির থেকে ফারাক তো এখানে যে, বিপুল উচ্ছ্বাস (প্রথম কবিতাগ্রন্থ দিনগুলি রাতগুলি, নিহিত পাতালছায়া), সুতীব্র সংবেদনা (আদিম লতাগুল্মময়, মূর্খ বড়ো সামাজিক নয় ,বাবরের প্রার্থনা), দুর্দমনীয় সংক্ষোভ (পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ), তির্যক শ্লেষকে ( মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, লাইনেই ছিলাম বাবা) শব্দের মধ্যে সংহতকরণের এক আশ্চর্য দক্ষতা তাঁর ছিল। শব্দই যেহেতু তাঁর একমাত্র বর্ম (কবি মাত্রেরই বর্ম), তাই শব্দের সঙ্গে শব্দ ঘষে তিনি অনুভূতিকে দিয়েছেন দার্শনিক মাত্রা । বস্তুবিশ্বকে অবিরত দেখা, তাঁর কবিতায় যা হয়ে ওঠে ‘দৃষ্টি’ :
আমাদের দেখা যখন দৃষ্টি হয়ে ওঠে, তখনই আমাদের সামনের ওই গম্যমান মানুষটি পর্যন্ত সবটাই ভিন্ন আর সত্য এক রূপ নিয়ে জেগে উঠতে থাকে আমাদের সামনে । (দেখার দৃষ্টি)
কবিতায় তাঁর ভাবাদর্শিক বুননকে খোলাসা করলেই বোঝা যাবে দর্শনশাস্ত্রের কী নির্বাধ যাতায়াত সেখানে।
যাপিত জীবনে খরচ করা নানা মামুলি শব্দকে ব্যবহারিক অর্থের অতিরিক্ত দ্বিগুণ অর্থমর্যাদা দিয়েছেন শব্দগুলির দ্যোতনাকে পুনর্নির্মাণ করে, রীতিমতো সেসব শব্দগুলির একটা তাত্ত্বিক স্তর তৈরি করে নিয়েছেন তাঁর দুর্দান্ত ব্যাখ্যানকৌশল প্রয়োগ করে এবং দর্শনশাস্ত্রের ভাষিককাঠামো দখল থাকার সুবাদে। তাই জার্নাল বইয়ের প্রথম রচনা ‘মুহূর্ত’ পড়া পাঠকমাত্রেরই জানা আছে, ‘মুহূর্ত’-এর মতো কালবাচক পদ কী করে ইন্দ্রিয়প্রভাবিত তীক্ষ্ণ রূপ পেতে পারে । রবীন্দ্রনাথের জ্ঞানতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে এক তত্ত্বসৌধ গড়েছেন দেখা-স্পর্শ-জানার মতো ইন্দ্রিয়নির্ভর ক্রিয়াকর্ম দিয়ে (দেখার দৃষ্টি)। কবিতায় ‘আমি’, ‘তুমি’র মতো নিত্য ব্যবহৃত সর্বনামেরও একটা তাত্ত্বিককাঠামো গড়ে তুলেছেন এ আমির আবরণ বইয়ে, পরে এই পদ্ধতিকেই অগ্রভাগে রেখে বই করেছেন রণজিৎ গুহ, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্ভবত তাঁর বইটি প্রকাশিতব্য এখনও)।
রবীন্দ্রনাথের মতোই পুব-পশ্চিমের মধ্যে একটা সমঝোতার চলন ছিল শঙ্খের। তবে নিজ অঞ্চলের আলোকেই তাঁর চক্ষু দুটি মুগ্ধ হয়ে ফুটে উঠেছে; আমার ধারণা, ‘স্থানীয় আধুনিকতা’র নির্মাণ, তাকে প্রশস্ত করার তত্ত্বগত বাসনা ছিল তাঁর (পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডের অনুসৃতির দিকে তেমন জোর ছিল না শঙ্খের) । প্রমাণ : তাঁরই অনুবাদ-বই বহুল দেবতা বহু স্বর-এ প্রথমেই রেখেছেন অনেকগুলো সাঁওতালি কবিতার অনুবাদ (শঙ্খ বলেন ‘অনুসর্জন’), ভারতীয় কবিতার অনুবাদ, এর পরে বিভাষী অন্যান্য কবিকে স্থান দিয়েছেন (সম্ভবত তুলনামূলক পাঠ তৈরি করতে)। ‘রুচির সমগ্রতা’–য় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের সঙ্গে মিলে করেছেন প্রতীচ্য কবিদের কবিতার অনুবাদ-সংকলন। কবি আল্লামা ইকবালকে তিনি পছন্দ করতেন। অনুবাদ করেছেন ইকবালকে, লিখেছেন প্রবন্ধ ‘নীৎসে ও ইকবাল’। ছাত্র আদনান মাহমুদ মনে করিয়ে দিল, শঙ্খের যাওয়ার দিনেই (২১ এপ্রিল) চলে গিয়েছিলেন তাঁর কবি ইকবালও ১৯৩৮ সালে । কী আশ্চর্য সমাপতন ! উনিশ শতকে প্রস্তাবিত, গড়ে ওঠা লিবারেলিজমকে পছন্দ করতেন, তাই ভিন্নরুচির অধিকার-এর পক্ষে কথা বলেছেন, বহুস্বরের পক্ষে সর্বদা ছিলেন উচ্চকণ্ঠ – তাঁর একটি কবিতাগ্রন্থের নাম বহুস্বর স্তব্ধ পড়ে আছে ।
শঙ্খ ঘোষ ২১শে এপ্রিল নিঃশব্দ হলেন, রেখে গেলেন তাঁর বর্মখানি । ‘সমস্তটা মিলিয়ে আদ্যন্ত একটি-যে নাটক গড়ে’ তোলার বাসনা ছিল সমগ্রদর্শী শঙ্খের, সে নাটকটি তাঁর মৃত্যুতেই যেন পূর্ণ অবয়বপ্রাপ্ত হলো ।
ভালো লিখেছেন। কবি শঙ্খ ঘোষের অন্তরাত্মাকে এক নিমেষে অনুভব করা যায়। প্রাবন্ধিককে ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ, তিয়াশা দি ! আপ্লুত হলাম !
চমৎকার লাগলো প্রিয় সুমন। আরও কতক বার পড়তে হবে। উপকার পেয়েছি বেশ। উনাকে জানতাম না।
উদ্দীপিত হলাম ! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে !
চমৎকার লিখেছো উন্মেষ! শঙ্খ ঘোষের লেখা, তাঁর মানসজগৎ, বিভিন্ন কালপর্বে তাঁর কবিতার অন্তর্গত নির্যাসটুকু দু’এক কথায় হাজির করা, তাঁর রবীন্দ্রভাবনা, কাছাকাছি সময়ে বা একটু আগে-পরে অন্যদের রবীন্দ্রভাবনার সাথে তুলনামূলক বিচার, সর্বোপরি তাঁর লেখায় সমাপতিত দার্শনিকতা নিয়ে এত ছোট পরিসরে এতকিছু লেখা বড় কম কথা নয়! তোমাকে কুর্নিশ! শঙ্খ ঘোষ নিজে প্রাচ্যলগ্ন হলেও তাঁর আলোচনায় প্রতীচ্যের সাম্প্রতিক কালের সাহিত্যভাবনার তত্ত্বগুলোকে তুমি অবহেলা করো নি। দেরিদা তো আছেই, আভাসে ইঙ্গিতে যেন বাখতিনকেও দেখতে পেলাম। তাতে লেখাটি আরও ঋদ্ধ হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।
আমার বোধ হয় একটাই প্রান্তিক আপত্তি এই লেখায়। বুদ্ধদেবের রবীন্দ্র বিরোধিতা সাধারণভাবে যেমন করে হাজির করা হয়, তার সবটুকু হয়তো সত্যি নয়। এমনকি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ইংরেজি উদ্ধৃতিটিও সঠিক নয়, যদিও অমৃতবাজার পত্রিকা এভাবে লিখেই জল ঘোলা করেছিল। ১৯৩৮ সালের প্রগতি লেখক সংঙ্ঘের সম্মেলনে পড়া সেই লেখাটিতে বুদ্ধদেব বলেছিলেন, “The age that produced Rabindranath was over.” তবে হ্যাঁ, বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের সমালোচনা করেছেন, ‘চোখের বালি’র সমালোচনা করেছেন, গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের সমালোচনা করেছেন। ‘চোখের বালি’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিজেও স্বীকার করেছেন তিনি যথেষ্ট সাহসী হতে পারেন নি।
সব মিলিয়ে আমি বলবো, তোমার এই প্রবন্ধটি অসাধারণ, কবি শঙ্খ ঘোষের প্রতি এক অনন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি।
হ্যাঁ, কাকুমণি, ঠিক বলেছ; আমি এখানে এটা ভুল করে ফেলেছি । ‘আমার কবিতাভবন’-এ বুদ্ধদেব বসু উল্লিখিত উক্তির আগে ‘অমৃতবাজার খেলিয়েছে’ কথাটা চোখ এড়িয়ে গেছে আমার । বুদ্ধদেবের আদত-বক্তৃতাটি নেপাল মজুমদারের ‘ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে পড়েছিলাম, মনে পড়ছে, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যে যুগ রবীন্দ্রনাথকে সৃষ্টি করেছে, বহুদিন আগেই তা অতিক্রান্ত হয়েছে ।’ দুর্দান্ত বলেছ তুমি ! তোমার মন্তব্যটি আমার সামান্য লিখন-অভিজ্ঞতার বড়ো সংযোজন হয়ে রইল । তোমাকে আমার সহস্র কুর্নিশ, কাকুমণি ।
দারুণ এক পাঠ-অভিজ্ঞতা। পরিমিত কথায় এক চমৎকার শঙ্খ-উন্মোচন। বেশ ভালো লাগল, উন্মেষ।
এটা অভাবনীয় ছিল ! প্রিয় কবির মন্তব্য, এটা বড়ো অর্জন বটে । অনেকানেক ধন্যবাদ আপনাকে !
শঙখ ঘোষ ফাদওয়া তুকানের একটা কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। নাম ‘চিরদিনের প্যালেস্টাইন’। এই কবিতাটা কোথায় পাবো বলতে পারেন ??