কবি বিনয় মজুমদারের সাহিত্য ও জীবনের নানা দিক নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে একটি সংকলন এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার। সম্পাদনা করেছেন এহসান হায়দার ও স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তী। বিপুল আয়তনের এই বইটি ধরে আছে সম্পূর্ণ বিনয় মজুমদারকে। বই প্রসঙ্গে কথা হলো এহসান হায়দারের সঙ্গে।
সহজিয়া : কবি বিনয় মজুমদারকে নিয়ে সম্প্রতি বিরাট এক আয়োজন করেছেন। আমি বলব এপিক অ্যান্থলজি — বিনয়কে নিয়ে কেন এই আয়োজন?
এহসান হায়াদার : আমি এ প্রশ্নের উত্তরে একটু শুরু থেকেই বলি, বিনয় আমার প্রিয় কবি, তো প্রিয় কবির প্রতি বিশেষ আবেগ কাজ করাটা স্বাভাবিক। প্রথম যখন বিনয় মজুমদার পাঠ শুরু করি — সে অনেক দিন আগেকার কথা। বিনয়কে ঠিক বুঝতে পারতাম না, কিন্তু বিনয় ভালো লাগতো। বিনয়ের কাব্যজগত আমার নিকট প্রচণ্ড যৌক্তিক মনে হতো, তবুও বিনয়কে বুঝতে পারিনি। এরপর বিনয়কে নিয়ে একটি লেখা তৈরি করি (ঐ ঘটনার অনেক বছর পরে) — ‘বিনয় ভাবনার দুর্বলতা’ শিরোনামে, সেখানে পাঠকের নানান ভালো কথার সঙ্গে সঙ্গে গালমন্দও শুনতে হয়েছিল আমায়। এরপরই সিদ্ধান্ত নিই বিনয়কে নিয়ে কাজ করার; কিন্তু ভাবনাটি ছিল ক্ষুদ্র পরিসরে করবার একটি আয়োজন। ধীরে ধীরে বিনয় সম্পর্কে আরও নতুন নতুন তথ্য জানতে পারি কাজে ঢুকে। তখন কলকাতায় স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে আলাপ হলো, কথা হলো — সে তখন পিএইচডি গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত। কাজ করার জন্য বলেছিলাম ওকে, সেও রাজি হয়ে গেল এক কথায়। তারপর কাজ করতে করতে অনেক দিন হয়ে গিয়েছে, ৫ বছর পর বের হলো বিনয়কে নিয়ে এ গ্রন্থ।
সহজিয়া : ভাবা যায়, ১০৩ ফর্মার প্রাইম সাইজের একটি বই! বাংলা ভাষার এক কবিকে নিয়ে এ ধরনের বই সম্পদনা করার লোকের ঘাটতি তো আছেই। প্রকাশ করার সংস্থা খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। কীভাবে সম্ভব হলো?
এহসান হায়াদার : হ্যাঁ, ১০৩ ফর্মার প্রাইম সাইজের বই; বাংলা ভাষায় এমন বৃহৎ সম্পাদনা গ্রন্থ আরও রয়েছে আমি যতোটা জানি, কিন্তু সে সকল গ্রন্থ পরিকল্পনা, সজ্জা ও লেখা নির্বাচনের দিক থেকে এ গ্রন্থের মতো নয়। এ গ্রন্থের পরিকল্পনাটিই সম্পূর্ণ আলাদা; মিলবে না অন্যদের কাজের সঙ্গে কোথাও, এমনকি স্মারকগ্রন্থগুলিও এমনি করে করা হয় না। ফলে কাজটি করা ছিল একটি চ্যালেঞ্জ, যেমনটি ভেবেছিলাম তেমনটি করতে পেরেছি শেষাবধি এটি আমার মনে হয়। সম্পাদনার লোকের কথা বললে, আমি একটি কথাই বলবো — কাজ করার মধ্যে নিজের একটি স্বপ্ন থাকলেই সম্পাদক কেবল কাজটি করতে পারেন এবং সৎভাবে কাজটি করার মানসিকতা থাকলে অনেকেই এর চেয়েও ভালো কাজ করতে পারবেন বলে মনে করি।
এ কাজের শুরুতেই একটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছিল — ঐ প্রতিষ্ঠানের মালিক কাজটি করতে চেয়েছিলেন, একটি চুক্তিও হয়েছিল সে ভদ্রলোকের সঙ্গে। তার কথা মতে পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার পর, কাজটি তিনি সম্পন্ন করে ফেলেছেন প্রুফ দেখার প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলেছিলেন, কিন্তু প্রকাশক হিসেবে কিনা জানি না — তিনি কথা রাখেন নি। তিনি সময়ক্ষেপণ করেন অনেক মাস, বছরও অতিক্রান্ত হয়। এরপরে আমি উনার নিকট থেকে পাণ্ডলিপি ফেরৎ নিই, যাই আরেকটি বড় প্রকাশনা সংস্থার নিকট — তারা তো কাজটি দেখে বিরাট খুশি, করবেনই এমন ঘটনাবহুল কাজ। কিন্তু শেষমেশ গড়িমসি করছিল। এরপরে আমি সিদ্ধান্ত নিই নিজেই প্রকাশ করবো। তারপর তো ‘আশ্রয় প্রকাশন’ এগিয়ে এলো, একেবারেই নতুন প্রকাশনা সংস্থা। এঁরা আমার চাহিদা ও রুচিকে মূল্যায়ন করেছেন। যেভাবে চেয়েছিলাম তাই-ই হয়েছে। কৃতজ্ঞতা উনাদের প্রতি।
সহজিয়া : কী কী আছে এই সংকলনে? বইটির রূপরেখা সম্পর্কে জানতে চাইছি…
এহসান হায়াদার : সংকলনে কী কী আছে বিষয়ে এককথায় উত্তর দিয়েই বলি, আস্ত মানুষ বিনয় মজুমদার রয়েছেন। বিজ্ঞান ও গণিত, সাহিত্য ও ইতিহাস, সমাজ ও দর্শন, প্রকৃতি ও প্রেম, তর্ক-বিতর্ক — এর সবটিই নিয়ে এ বই। রূপরেখা বলবার তো কিছু নেই এভাবে, তবে পাঠক বা আগ্রহীরা গ্রন্থটি একবার দেখবেন, ভালো না লাগে তো রেখে দেবেন এ কথাটিই বলার রয়েছে, তখনই রূপরেখা বুঝে যাবেন আশা করছি।
সহজিয়া : সম্পাদনা রীতি বা পদ্ধতি কী ছিল আপনাদের?
এহসান হায়াদার : সম্পাদনার ক্ষেত্রে আমরা প্রাধান্য দিয়েছি লেখার তিনটি দিক : ক. লেখার মান বিচার খ. লেখকের বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি গ. লেখার মধ্যে নতুনত্ব ও যৌক্তিকতা।
প্রথমত. প্রতিটি লেখা হাতে আসার পরে তা পাঠ করে এর মূল্যায়ণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত. লেখায় লেখকের বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও বলার ভঙ্গিটি ছিল দেখার প্রধান বিষয়। এটি লেখককে স্বাতন্ত্র্য রূপ দেয়। যদি কোনো লেখক সমাজে বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন অনেকের মধ্যে তা তার লেখার বিশেষ ভঙ্গির কল্যাণেই বলতে হবে। এছাড়া প্রতিটি লেখা পাঠে বিরক্তি তৈরি হয় কি না, সেই দিকটিও মাথায় রেখেছিলাম। তৃতীয়ত, লেখক যে লেখাটি পাঠালেন তার মধ্যে নতুনত্ব কোথায়, লেখক নতুন কী বললেন — তার ব্যাখ্যায় যৌক্তিকতা কতটুকু, সৃজনশীলতা কতটা প্রকাশ পেয়েছে লেখায় — এ সমস্ত বিষয়গুলি মাথায় রেখে বিচার করতে হয়েছে লেখা গ্রন্থে রাখা না রাখা।
এক্ষেত্রে অনেক পরিচিতজনদের লেখা আমাকে ফেলতে হয়েছে। দেখা গিয়েছে দেশের প্রতিষ্ঠিত কবি, অধ্যাপক, প্রবাসী কবি কিংবা পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপক পপুলার কবি-ও ছোটকাগজ সম্পাদক, বাণিজ্যিক পত্রিকার সম্পাদক রয়েছেন যাদের লেখা রাখতে পারিনি। এঁরা মিডিয়ায় বেশ ক্ষমতাধরও, আমি ওঁদের লেখা মান বিচারে রাখতে পারিনি, এটি সত্যি দুঃখজনক ছিল আমার জন্য। বরং নতুনরাই জায়গা করে নিয়েছেন তাদের লেখা দিয়েই।
এই বইয়ের লেখক-নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরেকটা দিকও মাথায় রেখেছিলাম। সেটি হল সময়ের ব্যাপকতা এবং পরিবর্তিত ও পরিবর্তনশীল সময়ের দেখায় বিনয়ের অবস্থান। সহজে বললে বিনয়ের অগ্রজ, বিনয়ের সমসাময়িক, বিনয়ের অনুজ ও অনুজতর কবিতাকার-অধ্যাপক-কবিতাপ্রাণ মানুষরা বিনয়কে কীভাবে দেখছেন। সেই দেখাগুলির মধ্যে আদৌ কোনও মিল রয়েছে কিনা বা প্রভেদ থাকলে কী প্রভেদ রয়েছে। কতটা ভক্তি, কতটা প্রেম, কতটা অন্ধত্ব, কতটা বিশ্লেষণী আলো রয়েছে। কেন-না সময়চক্রে প্রেম-ভক্তির নিক্তি বদলে-বদলে যায়। তাই এই বইতে অনূর্ধ্ব পঁচিশ লেখকের লেখা রয়েছে। আবার অশীতিপর লেখকের লেখাও রয়েছে। এই যে লেখকদের বয়ঃক্রমের ভিতরে প্রায় ছয় দশকের ব্যবধান, তা অনেক বলার আদল, বলার বদল ধরে রেখেছে।
সহজিয়া : এই বইয়ে সম্পূর্ণ বিনয় কি উপস্থিত? কীভাবে উপস্থিত?
এহসান হায়াদার : দেখুন বিনয় সত্যিকারে কোথাও উপস্থিত কী আজ? আমি আশি এবং নব্বই দশকের কয়েকজন কবির নিকট লেখা চেয়েছিলাম, তাদের কেউ একজন (ভদ্রলোকের নাম উল্লেখ না করেই বলি) জানতে চেয়েছিলেন, ‘আমার বিনয় নিয়ে অনুসন্ধান শেষ হয়েছে কী?’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘আপনি কবিতা লিখছেন আঠাশ বছর, শ্রেষ্ঠ কবিতাটি কী লিখতে পেরেছেন আজঅব্দি? ঐটা লেখার জন্যই তো এখনও লিখছেন। তেমনিই বিনয় অনুসন্ধান শেষ হয় না, কখনও কোনো প্রকৃত কবিকে নিয়ে অনুসন্ধান শেষ হয় না। মানুষ যতোদিন আত্মকেন্দ্রিক থাকবে, ততোদিন এমন প্রশ্নই উঠে আসবে। দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই বোধহয় মূল বিষয় সকল ক্ষেত্রে। ফলে কর্ম বিচারও মানুষের ওপর নির্ভর করে। বিনয়ের লেখা আমি যেভাবে মনে করছি, আপনি আরও বড় কিছু ভাবতে পারেন। তাঁর দর্শনের দিকটিও আপনাকে চমকাতে পারে।’
এই বইটি বিনয়কে নিয়ে রচিত, সম্পাদনার ক্ষেত্রে ত্রুটি রাখতে চাইনি এবং কোথাও কোনো দুর্বল লেখার ছাপও রাখতে চাইনি। বিনয়ের জন্ম থেকে মৃত্যুবধি ও তাঁর ভাবনার জগত পাঠকের নিকট তুলে দিয়েছি, এখন বিচার্য পাঠকের নিকটই।
সহজিয়া : অনেকের বিনয় সম্পর্কিত মূল্যায়ন উপস্থাপিত হয়েছে বইটিতে। মূল্যায়নের ধরনগুলোর ভেতর কী ধরনের বৈচিত্র্য পেয়েছেন?
এহসান হায়াদার : এ গ্রন্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি গদ্য আরেকটি গদ্য থেকে ভিন্ন। বিশ্লেষণ, বলার ভঙ্গি, বিষয় মূল্যায়নের সবটাতেই ভিন্নতা রয়েছে। তবে একটি লেখা পাঠ শেষে অন্যটিতে প্রবেশ করলেই লক্ষ্য করা যাবে পূর্বের লেখাটির সঙ্গে এটির একটি সংযোগ রয়েছে। ফলে পাঠে এক রকম আনন্দ মিলবে। সম্পূর্ণ গ্রন্থ তো একদিনে পাঠও সম্ভব হবে না, লেখাগুলি পাঠ শেষে দেখা যাবে — একটি বিনয় বৃত্ত তৈরি হয়েছে; যেখানে বিনয়ের জীবন, দর্শন এবং সমাজ-ভাবনা ও অবক্ষয় এসে ভিড় করে। পরিশেষে, পূর্ণাঙ্গ বিনয় মজুমদার হাজির হয়েছেন। বাংলাদেশেরই এক বন্ধু লিখেছেন, ‘আমার পড়ার টেবিলে বিনয় মজুমদারের খয়েরি রংয়ের বই পড়ে আছে’, আমি এই পড়ে থাকাকেই বৈচিত্র্য দেখি।
কবিতার অ্যানাটমি করতে গেলে তথ্য, তত্ত্ব ও সত্যের সমানভাগ লাগে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যাকে ‘সম্মিলন’ বলে। এখন এই সম্মিলনের দৃষ্টান্ত সবসময় সবযুগেই বিরল।
সহজিয়া : বাঙালিদের মধ্যে, বিশেষ করে বাংলাদেশে, অধ্যাপকীয় সমালোচনা এবং অ-অধ্যাপকীয় — যেখানে প্রধানত কবিদের রাজত্ব — সমালোচনা রীতি ও পদ্ধতিতে বেশ পার্থক্য দেখা যায়। আপনি তো মোটা দাগে দুই ধারাকেই নিয়েছেন। বিনয় মজুমদারকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে বিদ্যায়তনিক সমালোচনা ও অবিদ্যায়তনিক সমালোচনার কোনো পার্থক্য নজরে পড়েছে?
এহসান হায়াদার : দেখুন, অধ্যাপকীয় দেখা এবং অ-অধ্যাপকীয় দেখার মধ্যে একটা পার্থক্য থাকে, আছে। দু-তরফই আসলে এক্সট্রিমিস্ট। (এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, আমি বাংলা ভাষার উচ্চমেধাসম্পন্ন অধ্যাপক এবং বাংলা ভাষারই উচ্চমেধাসম্পন্ন অ-অধ্যাপক কবি বা কবিতাপ্রাণ শিল্পী মানুষদের কথা বলতে চাইছি। নিম্নমান নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।) অধ্যাপক প্রধানত তথ্যের ভাঁড়ার তৈরিতে মন দেন, তথ্য খুঁটে বা তথ্যের বালি চেলে তত্ত্বের হদিশ পেতে চান; আর অ-অধ্যাপক জন ভিত বানান সহজ সত্যের। কিন্তু বলবার এটাই যে, এই দুই দেখাই অসম্পূর্ণ, অংশদৃষ্টি।
কবিতার অ্যানাটমি করতে গেলে তথ্য, তত্ত্ব ও সত্যের সমানভাগ লাগে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যাকে ‘সম্মিলন’ বলে। এখন এই সম্মিলনের দৃষ্টান্ত সবসময় সবযুগেই বিরল। সকলেই তো আর জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, হুমায়ুন কবির, আহমদ শরীফ, অরুণ মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শিশিরকুমার দাশ, সেলিম আল দীন, হুমায়ুন আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ হন না। যাঁরা একইসঙ্গে অনন্য সাহিত্যিক একইসঙ্গে দুরন্ত অধ্যাপক। তাই এই বইতেও লেখকদের দেখায় ও লেখায় এই ফারাক রয়েছে। লেখকদের কেউ অধ্যাপক (শিক্ষক), কেউ অ-অধ্যাপক (কবি-প্রাবন্ধিক প্রমুখ) সুজন। আর এই ফারাকটুকুই জাস্টিফাই করেছেন কবি-অধ্যাপকেরা। তাঁদের নাম করছি না। সকলেই প্রায় চেনেন। ব্যিায়তনিক এবং অ-বিদ্যায়তনিক ফাঁরাকটা লেখার ধরনেই বুঝে যাবেন আশাকরি। অতএব বিনয়বিষয়ক মিসিং লিঙ্ক খোঁজার জন্য অন্য বইতে হাত বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে বলে আমার মনে হয় না।
সহজিয়া : অনেকে মনে করেন, ফিরে এসো, চাকাই বিনয়ের প্রথম ও শেষ স্মরণযোগ্য রচনা। আপনার কী মনে হয়?
এহসান হায়াদার : ফিরে, এসো চাকা — গ্রন্থটি আসলে পাঠকের আবেগের নিকট বন্দি, বিশ্লেষণ নয়, আবেগ দিয়েই যেন পরিমাপ করা হয় এমন। বিনয়ের অন্যান্য রচনার দিকে দৃষ্টিপাত করলেই একথা আরও পরিষ্কার হয়, কেননা — বিনয়ের ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, ‘বাল্মিকীর কবিতা’, ‘আমিই গণিতের শূন্য’, ‘আমি এই সভায়’, ‘নির্মাণের খসড়া’-সহ আরও চমৎকৃত হওয়ার মতো কিছু রচনা রয়েছে যার কিছু প্রকাশিত কিছু অপ্রকাশিতও এখনঅব্দি, এছাড়া গণিত বিষয়ে বিনয় মজুমদারের ভাবনাও চমৎকৃত করে আমাদের।
সহজিয়া : যদি বলি বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের স্মৃতি ও শ্রুতিতে কবি বিনয় মজুমদারের চেয়ে ব্যক্তি বিনয় মজুমদার প্রধান হয়ে উঠেছে, আপনি কী বলবেন? আমি বলতে চাইছি, আমাদের দেশের একটি প্রবণতা হলো ব্যক্তির কাজের চেয়ে ব্যক্তির কিংবদন্তি নিয়ে বিভোর হয়ে থাকা। বিনয়ের ক্ষেত্রেও কি সে রকম ঘটেছে?
এহসান হায়াদার : কিছুটা সেই রকমই কাজের শুরুতেই তা মনে হয়েছিল, কিংবদন্তির গল্প। পরে দেখা গিয়েছে, বিনয় তাঁর জীবন, যাপন সকল কিছুতেই ছিলেন কর্মজ্ঞ এক পুরুষ। যাঁর মস্তিস্কে ছিল গণিত আর মননে ছিল কবিতা। ফলে বিনয়কে নিয়ে নানান জনে নানান রকম গল্প বলবেন, কেউ বলবেন বিনয় প্রচণ্ড রাগী লোক ছিলেন, বিনয়কে নিয়ে প্রেমের গল্প যেমন রয়েছে! তেমনি সোনাগাছিতে যাওয়া নিয়ে চর্চা রয়েছে। সাহিত্যবোদ্ধারা তো অনেকেই বলেন, প্রেমে শেষ হয়ে গেল, এতো বড় মেধা! কী আশ্চর্য আবিষ্কার তাদের, ধন্যি ধন্যি করা ছাড়া উপায় নেই এ নিয়ে।
তবে কিংবদন্তি বাদে, কবি বিনয়, গণিতজ্ঞ বিনয় এবং ব্যক্তি বিনয় সত্যিই এক ‘বিস্ময়কর সময়, বিস্ময়কর সৃষ্টি’। ভাবুন, সেই সময়ের কলকাতায় রুশ ভাষা জানা এবং একই সঙ্গে সায়েন্স জানা একমাত্র মানুষ ছিলেন বিনয়, তিনি পাঁচটি বই মূল রুশ ভাষা থেকে এবং একটি বই ইংরেজি ভাষা থেকে অনুবাদ করেন, কিন্তু অনুবাদকের নামের স্থানে বিনয়ের নাম ছিল না, প্রকাশক ছিলেন ন্যাশনাল বুক এজেন্সি (এন বি এন)। বইগুলির নাম ছিল, ‘অতীতের পৃথিবী’, ‘মানুষ কি করে গুনতে শিখল’, ‘সেকালের বুখারায়’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘বায়ুমণ্ডল’ ও ‘আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (এটি কেবল ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছিলেন)’। একটি মানুষ গণিত কষছেন, নতুন ভাবনার কবিতা লিখছেন, সে সকল কবিতা সময়কে স্পর্শ করে এ-তো বিস্ময়!
সহজিয়া : আমি মনে করি, বাংলা কবিতাকেন্দ্রিক সম্পদনার ইতিহাসে বইটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আর তাই আগাম জেনে রাখতে চাই, সংকলনটির বিশিষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা কী?
এহসান হায়াদার : সে তো বলা মুশকিল, ঐতিহাসিক ঘটনা কিনা এই বই প্রকাশ হওয়ার বিষয়টি। তবে একটি কথা বলা যেতে পারে, তা হলো নিশ্চিত একটি ভালো কাজের জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা এবং কাজ করে যাওয়াটিই মুখ্য, সফলতা আপনাতেই আসবে।
সংকলনটির বিশেষ দিক যদি বলতে হয় তবে বলবো, এই বইটির মধ্যে দিয়ে ১৯৩৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর-এ প্রবেশ করবেন; কেননা বিনয় মজুমদারের জন্ম ঐ সময়টিতে। আমি বিনয়ের জীবনের পর্বের কথা বলছি, বর্মা (মায়ানমার), ফরিদপুর (বাংলাদেশ), পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, ঠাকুরনগরের শিমুলপুর। এই যে বিনয়ের জন্ম বর্মা মুল্লুকে, তারপর বাংলাদেশ, দেশভাগ, বিনয়ের শিক্ষাজীবন, পাঠপর্ব, ভাষা শিক্ষা, সাহিত্যচিন্তা, হাংরি আন্দোলন, সিগনেট প্রেস, জনার্দন চক্রবর্তীর কন্যা — ঘটনাবহুল কত কী, সব পেছনে ফেলে বিনয় একা। গণিতের বিনয়, বিনোদিনী কুঠির বিনয়, সম্পূর্ণ একার জীবন; তবুও যেন আমাদের মাঝে রয়ে যান তিনি তাঁর কর্মে ও কর্মের নিরিখে। চেষ্টা করেছি, এই সংকলনে বিনয়ের সম্পূর্ণ সময় এবং বিনয়ের লেখার বিশ্লেষণের সমস্ত দিক উন্মোচন করতে, সেটি পেরেছি কিনা তা পাঠক বলবেন। আর সীমাবদ্ধতা আসলে সাময়িক একটি দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতিটি কাজের শেষেই এই দৃষ্টিভঙ্গি জাগ্রত হয়।
পরিশেষে, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই ‘সহজিয়া’ সম্পাদক সুমন সাজ্জাদকে যিনি এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করলেন।
বই সম্পর্কিত তথ্য
গ্রন্থ : এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার
সম্পাদনা : এহসান হায়দার ও স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তী
প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত
বইয়ের সাইজ : প্রাইম সাইজ (বোর্ড বাইণ্ডিং, কাপড় জেল)
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮২৪
পাঠকের দাম : ১৪৫০ টাকা
প্রকাশনা : আশ্রয় প্রকাশন
প্রকাশকাল : এপ্রিল ২০২১
করোনাকালীন সময়ে গ্রন্থটি পেতে যোগাযোগ করুন :
আশ্রয় প্রকাশন : ০১৫৬৮ ২০০৮২৫, ই- মেইল : ash.bookspro@gmail.com