গীতা দাস একজন সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মী। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকায় তার কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ছোটগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখবেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে। আজ প্রকাশিত হলো কিস্তি ৩।
চাকমা ছোটগল্প গ্রন্থ অজগর -২
বিপম চাকমার ছোটগল্পের বই অজগর–এর ১১টি গল্পের মধ্যে ‘ইঁদুর’ ও ‘পিতৃত্ব’ গল্প দুটি ছাড়া অন্যান্য গল্পে সংখ্যালঘুর যাপিত জীবনের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। দশম গল্প ‘অজগর’ নিয়ে পর্যালোচনা ইতঃপূর্বে সম্পন্ন করা হয়েছে। এ কিস্তিতে গল্পের সূচি অনুসারে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য গল্পগুলোর পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হল।
কাঠের খোঁজে
গল্পটিতে হাতির আক্রমণে মৃতের সৎকারের জন্য কাঠ পাওয়া যাচ্ছে না। যেদিকেই যায় সেদিকেই দখলের সীমানা পোঁতা। অরণ্যবাসী সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর বনাধিকার হারানোর কথাই গল্পটির মূল উপজীব্য। লেখক সরাসরি ভূমি বেদখলের, বন বেদখলের চিত্র ও এর ফলে জনজীবনের ভোগান্তির পরিস্থিতি সার্থকভাবে চিত্রায়িত করেছেন। যে বন-জঙ্গল থেকে হাতি এসে আক্রমণ করে তার গাছ-গাছালির গভীরতা সহজেই অনু্মেয়। অথচ সেই বনের ভেতরে বসবাস করেও হাতির আক্রমণে মৃতের দেহ সৎকারের জন্য কাঠের অভাব। বনের মানুষের বনের উপর অধিকার নেই। সবই বেদখলের ইতিকথা। অধুনাকালে Unclassed State Forest Community Land-এর অস্তিত্ব যে আর বিরাজমান নেই এ সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এ গল্পটিতে।
এ গল্পে পাঁচ মুঠি নামে একটি লৌকিক পরিমাপের পরিচয় পাই। ‘সে উপলক্ষে আশপাশের গ্রামের লোকজনকে পাঁচ মুঠি (হাতের মুঠির সাহায্যে শুয়োরের ওজন বের করার এক ধরনের আনুমানিক এবং প্রায় নির্ভুল পদ্ধতি) শুয়োর জবাই করে দাওয়াত খাওয়ানো হয়েছিল।’ (চাকমা, ২০১৭, ১৩) অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে লোকবিশ্বাসের কথাও এ গল্পে রয়েছে। ‘ভদ্রস্থ কোন উপায় না দেখে লাশ কলা পাতা আর বুনো লতা দিয়ে বেঁধে সোজা গ্রামের শ্মশানে নিয়ে তোলা হয়। অপঘাতে মৃত্যু আর গ্রামে ঢোকান হয় না।’ (চাকমা, ২০১৭, ১৫) গল্পের শুরুতেই ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখের বর্ণনা পাই- ‘ঘুমের বিষে চোখ দুটো কোকিলচোখ।’ (চাকমা, ২০১৭, ৯) আর একজন ঝগড়াটে নারীর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে পাই ‘ক্যাসেট মানে শান্তিমনির মা। মহিলার জিহ্বা অত্যন্ত চঞ্চল এবং দ্রুতগামী। কোন কারণে একবার মুখ থেকে শব্দ নিঃসরণ শুরু হলে আর থামতে চায় না। সেই কারণে ক্যাসেট বলে পাড়া জুড়ে তার এই ফুলেল নাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।’ (চাকমা, ২০১৭, ১০) হাস্যরসের মাধ্যমে লেখক ঝগড়াটে নারী চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। ধনঞ্জয় বংশগত কার্বারী হওয়ার আভিজাত্যের মাশুল দেয়। অন্যের থেকে আলাদা হতে সে ঘরে ঝকঝকে টিনের ছাউনি দেয়, কিন্তু গরমে ‘আভিজাত্যের মর্ম হাড়ে হাড়ে টের পায়।’ (চাকমা, ২০১৭, ১১) কার্বারীর শ্রেণি থেকে বিচ্যুত হয়ে অভিজাত হওয়ার মাশুল দেয়াকে লেখক বেশ তীর্যকভাবে উপস্থাপন করেছেন।
লোকশ্রুতি ছিল যে জুমের উপর দিয়ে হাতি যাওয়া হলো সৌভাগ্যের লক্ষ্মণ, আর এখন হাতি মানে আতঙ্ক। এও যেন রূপকের আশ্রয়ে বনভূমি আগ্রাসনের কথা। পাহাড়ি জনপদের প্রায় সব ভূমি এখন ব্যক্তিমালিকানাধীন ইজারা দেয়া। তাই বনভূমির জনপদে দুই ঘন্টায়ও একজন মৃতকে সৎকার করার মতো কাঠ সংগ্রহ করা যায়নি। এই কাঠ না পাওয়ার মধ্যেই গল্পটি শেষ হয়েছে। ‘তখনই তাদের খেয়াল হয়, তাইতো! তারা অনেকদূর চলে এসেছে। চিতার জন্য কাঠ খুঁজতে এভাবে তো অনন্তকাল হাঁটা যায় না। ফিরতে হবে, বিকেল প্রায় শেষ, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।’ (চাকমা, ২০১৭, ১৫)
অরণ্যবাসী সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর এ প্রতীকী সন্ধ্যার আর অবসান হয়নি।
ফলি মাছের অভাবে চন্দ্রমোহনের ছেলেরা মারা গেল
এ গল্পটি একটি Allegory বা রূপক লেখা। বসন্তকালে জলবসন্তের প্রকোপে কোকিলের কুহু ডাককে মানুষের কাছে ‘উহু’ মনে হয়। মানুষ কোকিল নিধনে ব্যস্ত হয়। চন্দ্রমোহনও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কোকিল মারার পর তার দুই যমজ ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। চন্দ্রমোহন ছেলেদের অসুস্থতায় প্রচলিত সহজলভ্য যে ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতি তা প্রয়োগে আগ্রহী। ‘ফলে চন্দ্রমোহন গতানুগতিক চিকিৎসার দ্বারাই আরোগ্য লাভের চেষ্টা করতে লাগলো– খেতে হবে কেদাবাত্তা শাকের ঝোল, গোসল করতে হবে দেশী নিম পাতা সিদ্ধ পানি দিয়ে এবং পথ্য হিসেবে তেল বিহীন ফলি মাছ আর ফোস্কা শুকিয়ে আসার সময় গরুর দুধ’। (চাকমা, ২০১৭, ১৮) কিন্তু এ সবই দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়। আগে যারা অসুস্থ হয়েছিল তারা কেদাবাত্তা ও নিম পাতা শেষ করে ফেলেছে। গরুর দুধ পাহাড়ে সাধারণভাবেই পাওয়া যায় না। কিন্তু হ্রদে ফলি মাছেরও আকাল। অবধারিতভাবে ছেলেদের মৃত্যুর পর চন্দ্রমোহন হ্রদের মাছ নিধনে নিজেকে নিয়োজিত করে।
গল্পে বর্ণিত অঞ্চলের সমাজের চোখে অপ্রকৃতস্থ চন্দ্রমোহন বাজার থেকে বিষ আনতে বাধা পেলেও প্রতিশোধ নিতে অস্ত্রের তথা মাধ্যমের অভাব নেই। পাহাড় থেকে এক প্রকার বিষলতার রস দিয়ে মাছ মারা অব্যাহত রাখে। ‘পাহাড়ী জঙ্গলে ‘মেইল লতা’র (এক ধরনের লতা যার শেকড়ের রস পানিতে মিশালে মাছ মরে যায়।) কোন অভাব নেই।’ (চাকমা, ২০১৭, ২১) গল্পটির মাধ্যমে লেখক যেন প্রকৃতির প্রতি মানুষের বিরূপ আচরণের নেতিবাচক প্রভাবকে উপস্থাপন করেছেন। কোকিল প্রকৃতির প্রতীক। কেদাবাত্তা শাক আর দেশি নিম পাতার আকাল মানে হল, প্রকৃতিতে যা পাই তা খেয়ে সাবাড় করে ফেলার চর্চা। এ নেতিবাচক দিকে পাঠকের মনোযোগকে নিয়ে যেতে লেখক সফল হহয়েছেন বলা যায়।
হ্রদে বহুল আকাঙ্ক্ষিত ফলি মাছ না পেলেও বিদেশি নাইলোটিকা আছে ঝাঁকে ঝাঁকে। এ নাইলোটিকা বিদেশি মাছের প্রতীকে আগ্রাসন। এ হল সেই মাছ, যা খেয়ে ছেলেদের জলবসন্তের ফোসকা বাড়ে। আর নাইলোটিকার প্রতি চন্দ্রমোহনের ক্ষোভ বাড়ে। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সে হ্রদ থেকে ঐ জাতীয় মাছ ধরে কেটে হ্রদের জলেই ভাসিয়ে দেয়। তার ছেলেরা পরবর্তী সময়ে মারা যায়। আর সন্তান জন্মদানে অক্ষম স্ত্রী নিয়ে চন্দ্রমোহনরা এভাবেই নির্বংশ হয়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার খবর তো ঐতিহাসিক সত্য। তবে শুধু মানুষ চন্দ্রমোহনরা নয়, পাহাড়ের প্রকৃতিও ধ্বংস হচ্ছে। চন্দ্রমোহন এবং প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে। গল্পটিতে প্রতীক ও রূপকের আশ্রয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস, এর প্রতিশোধ এবং পার্বত্য অঞ্চলে নাইলোটিকারূপী বাইরের শক্তির শক্ত অবস্থানের বয়ান রয়েছে।
শব্দ–নিষিদ্ধ রাত বিষয়ক অন্তহীন খেলা
বইটির তৃতীয় গল্পটি যেন মহাযুদ্ধকালীন পরিস্থিতির রূপায়ণ। এক পাহাড়ি গ্রামের লোকজন দুর্বৃত্তদের ভয়ে লোকালয়ে রাত কাটাতে পারে না। রাতে বনে জঙ্গলে রাত কাটিয়ে দিনে নিজ গ্রামে ফিরে আসে। শেষ পর্যন্ত এক রাতে ঐ গ্রামে আগুন দেয়ার ঘটনায় গল্পের পরিসমাপ্তি।
এই গল্প আমাদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির কথা মনে করিয়ে দেয়। আনার নিজের পরিবারের সাথে একটা কুঠুরিতে লুকানো জীবন। আর সুধাংশুদের গ্রামের সবার প্রতি রাতে শব্দহীন যাত্রা, তবে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান। এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপদের শব্দ-নিষিদ্ধ রাত নিয়ে শিশু মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ‘হতাশ হয়ে নেতানো বেলুনের মত চুপসে যায়। তাদের জগৎটা বড়দের জগত দ্বারা বিশ্রীভাবে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা পড়ে।’ (চাকমা, ২০১৭, ২৪) এর প্রভাবে স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যালঘুর পরবর্তী প্রজন্ম ভাঙা মনোবল, দুর্বল চিত্ত নিয়ে বড় হচ্ছে। এমন প্রজন্ম সৃষ্টি যেকোনো সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করারই সক্রিয় প্রয়াস।
গল্পের চরিত্র সুধাংশুর মাধ্যমে বিপম চাকমার পর্যবেক্ষণে পাহাড়ি জনপদের কিছু দৈনন্দিন শব্দের সন্ধান পাই। প্যাঁচার ‘কুঞুক কুঞুক’ ডাক, বসন্ত বাউড়ির ‘নয় ছয়, নয় ছয়’ এবং কুকুরের বিলাপ ধ্বনি ‘আঞোই আঞোই উ উ উ’। বাংলা ভাষায় বিপম চাকমার উপহার ‘কুঞুক’ ও ‘আঞোই উ উ উ’ শব্দবন্ধগুলো। লেখক পাহাড়ি জনপদের মানুষের অসহায়ত্ব সামাজিক পশু ও প্রকৃতির ছোঁয়ায় মমতা ভরে একটি চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। ‘তবু কুকুরগুলো পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি ভুলে গিয়ে একে অন্যের সাথে কামড়া-কামড়ি করে নিষ্ঠুরভাবে রাতের সমস্ত গোপীয়তা ফাঁস করে দেয় আর আর্দ্র মাটিতে পাছা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে এমন করুণ সুরে “আঞোই, আঞোই উ-উ-উ” শব্দে বিলাপ করে উঠে যে, পাহাড়ের উপত্যকাব্যাপী আতঙ্কের একটা অসহ্য ভয়ংকর শীতল স্রোত বয়ে যায়। তখন লোকজন নিজেদের অন্তরের গভীরে সবচেয়ে বেশি অসহায়ার বিপন্নবোধ করতে থাকে। তাদের মনে হয় জীবনের অস্তিত্ব একফোঁটা পানি হয়ে কোন একটা নুয়েপড়া পাতার সুঁচালো আগায় ঝুলছে। যেন নিঃশ্বাসের বাতাস লাগলেও ঝরে যাবে।’ (চাকমা, ২০১৭, ২৫)
তের বছর বয়সী আনা ফ্রাঙ্ক তার দুই বছর দুই মাস ব্যাপী দিনলিপিতে কৈশোরে দেখা ইহুদিদের উপর নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের কিছু খণ্ড চিত্র তুলে ধরেছিল। রাতে বাতি জ্বালানো যেত না, দিনে জানালা খোলা যেত না। আর বিপম চাকমা চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের সুধাংশুর তিন-চার বছর বয়স থেকে সাত-আট বছর বয়স পর্যন্ত শব্দ-নিষিদ্ধ রাতের কথা বলেছেন। গল্পের চরিত্র সুধাংশু শব্দে খুব মনোযোগী। আনা ফ্রাঙ্কের পরিণতি মৃত্যুতে আর সুধাংশুদের জীবনের পরিণতি নেই। আছে শিশু সুধাংশুর মনে শব্দ-নিষিদ্ধ অন্তহীন খেলায় অদৃশ্য প্রতিপক্ষের সাথে লড়াইয়ের আকাঙ্ক্ষা। ‘ফলে তার অতৃপ্তির বোধটা বেড়ে গিয়ে খেলার প্রতি আগ্রহ দিন দিন উপরের দিকে উঠতে উঠতে আকাশের বাপ্তিতে ছড়িয়ে পড়ত।’ (চাকমা, ২০১৭, ২৩)
সুধাংশুদের গ্রামে আগুন লাগিয়ে পুড়ছে; এভাবে গল্পটি শেষ হয়। কিন্তু শব্দহীন নিষিদ্ধ রাত থেকে মুক্তির কোন ইঙ্গিত মিলে না। ‘যেদিকে তাকিয়ে মনে হয় পা রাখা যাবে সেটাই যেন পথ। তারা ছুটতেই থাকে। তারা জানে না কতদূর গেলে এই শব্দ-নিষিদ্ধ রাতের বীভৎস শব্দগুলোকে অতিক্রম করা যাবে এবং শব্দ-নিষিদ্ধ রাতের খেলার অন্তহীনচক্র থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।’ (চাকমা, ২০১৭, ২৭) শব্দ-নিষিদ্ধ রাতের শেষ হয়নি এবং সুধাংশুদের জীবনের গল্পও “শেষ হয়ে হইল না শেষ”। এখানেই সংখ্যালঘু জীবনের বিষাদময়তা। ‘… ভেতরে বাইরে লৌকিক এবং অলৌকিক উভয় দুনিয়ার বিধাতার কাছে নালিশ জানাতে জানাতে ছুটতে থাকে।’ (চাকমা, ২০১৭, ২৭)
লৌকিক এবং অলৌকিক উভয় দুনিয়ার বিধাতার মধ্যে সংখ্যালঘুদের জীবনে লৌকিক দুনিয়ার বিধাতারাই প্রত্যক্ষভাবে বেশি শক্তিশালী। তারা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলসহ অন্যান্য জনপদে, দুনিয়ার অনেক দেশে বিভিন্ন সংখ্যালঘু জীবনের নিয়ামক। লেখক তাদের জীবনের দু:সহ সময়ের এক চিরন্তন অসহায়ত্বের চিত্রায়ন করেছেন এ গল্পে।
চাইঞুরুই বাজারে কোন মুচি ছিল না
বইটির এ চতুর্থ গল্পে লেখক একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। এ গল্পে পাহাড়ি জনপদে সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতি, কূটকৌশল, ক্ষমতার অপব্যবহারে স্থানীয় সংখ্যালঘু জীবনকে দুর্বিষহ করার চিত্র রূপায়িত হয়েছে। জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করা একটি এনজিও অফিসের একজন নাইটগার্ডের জীবনের গল্প বিধৃত করা হয়েছে গল্পটিতে। ‘নাইট গার্ড হয়েও প্রায়ই দিনের বেলায় পূর্ণ ডিউটি দিতে তার কোন আপত্তি ছিল না বরং এতে সে আনন্দ পায় বলে মনে হয়।’ (চাকমা, ২০১৭, ৩০) কিন্তু নাইটগার্ড হয়েও রাতে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। এখানে অফিসের সাথে আবাসিক ব্যবস্থা। কর্মীরা তখন নেশাগ্রস্থ লাল চোখকে ভয় পায়। মারমা ভাষায় তার কাছে গালির মর্মার্থ থাকে দুর্বোধ্য। যেদিন নেশা করে না সেদিন ওখানকার কর্মীদের সাথে গাল-গল্প করে।
গল্পটির কাহিনি সংক্ষেপ হলো এমন, এক ব্যক্তি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে সেগুন বাগানে ঢুকলে সে চুরির দায়ে গ্রেফতার হয়। তার স্ত্রী তাকে ছুটিয়ে আনতে গেলে সরকারি চাকরিজীবীর লোভের শিকার হয়। পরে ওই লোককে চাকরি দেয় এবং তার স্ত্রীকে ভোগ করে। ঐ সরকারি চাকরিজীবী ঘটনাচক্রে লোকটিকে এক জোড়া পুরানো ছেঁড়া জুতা উপহার দেয়। ঐ এলাকায় তখন কেউ জুতা পড়ে না। চাইঞুরুই বাজারে কোন মুচি নেই বলে পাশের রাণীর হাটে জুতা সেলাই করাতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এগুলো চুরির মাল বলে এবং রাঙামাটিতে জেল খাটে। ঐ সরকারি চাকরিজীবী লোকটিকে জেল থেকে ছাড়িয়ে দেয়ার কথা বলে তার স্ত্রীকে নিয়ে রাঙামাটি যায় এবং তাকে বোরকা পরিয়ে এক হোটেলে উঠে। পরের ঘটনা গতানুগতিক শোষণের কৌশলী ইতিবৃত্ত। ফরেষ্ট বিভাগের সরকারি চাকরিজীবী তার স্ত্রীর সব খরচের দায়িত্ব নেয় এবং বদলির সময় তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আর স্বামীটি সাধারণ ক্ষমায় পনের বছর পর জেল থেকে বের হয়ে জীবিকা হিসেবে নাইড গার্ডের চাকরি শুরু করে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রটির মূল অপরাধ ছিল– ‘হাগু করে পরিস্কার হওয়ার জন্য সেগুন পাতা ছিঁড়লে একজন ফরেষ্ট গার্ড তা দেখে ফেলেছিল।’(চাকমা, ২০১৭, ৩৪)
নাইড গার্ড চিংহলা মং-এর গল্পটি পড়ে মনে হয়, এ যেন পাহাড়ি প্রান্তিক নৃগোষ্ঠী জীবনের করুণ কাহিনি নিয়ে সংবাদপত্রের ফিচার। লেখক এর প্রতিশোধ নিতে অভিশাপ নামে অতিলৌকিকতার আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া তো মানসিক শান্তির আর উপায় নেই! যেমন- ‘কার অভিশাপ? লোকজনের চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাসের। সেই কান্না ও দীর্ঘশ্বাস থেকেই প্রতিটা গাছে একটা করে ভূত জন্ম নিয়েছিল। তারা ফরেস্টারদের তাড়া করতো।’ (চাকমা, ২০১৭, ৩১) তাছাড়া, বিপম চাকমা প্রান্তিক নৃগোষ্ঠীর নারীদের নিয়ে ফরেস্টারদের তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরিরত সরকারি লোকজনের লোলুপতা স্পষ্টভাবেই রূপায়ণ করেছেন। ‘গোসলের জন্য তোলা বালতির পানিতে মহিলার মুখ তার সাথে মুচকি মুচকি হেসে তামাসা করতে লাগল।’ (চাকমা, ২০১৭, ৩২) তবে গল্পে উত্তম পুরুষের বর্ণনায় তার চাকরির কাহিনি, বিশেষ করে বেসরকারি সংস্থা সম্পর্কে বিষোদগার বাতুলতা মনে হয়েছে। এ বাড়তি মেদের প্রয়োজন ছিল না। এতে ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য খানিকটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে বৈ কি!
পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় বাঙালিসহ বারটি নৃগোষ্ঠীর বসবাস এবং প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এক নৃগোষ্ঠীর লোকজন অন্য নৃগোষ্ঠীর ভাষা পরিপূর্ণভাবে বোঝে না। এ গল্পটিতে ভাষা-বৈচিত্র্যের উল্লেখ পাই। ‘কাকে উদ্দেশ্য করে যেন সমানে গালাগাল করতে থাকে। আমরা যার এক বর্ণও না বুঝার কারণে মারমা ভাষাটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ভাষা বলে ভাবতে থাকি।’ (চাকমা, ২০১৭, ৩০)
মল ত্যাগ করে পরিষ্কার হওয়ার মতো একটি স্বাভাবিক ও সামান্য ঘটনার জের যে একজন সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে সারা জীবনের জন্য অস্তিত্বহীন জড় পদার্থ করে রাখতে পারে এ গল্প তারই উদাহরণ। লেখক নিশ্চয়ই তাঁর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকেই এ গল্পের ঘটনা সংগ্রহ করেছেন বলে অনুমেয়।
মাটি
বইটির পঞ্চম গল্প একটি জমিকে আগলে রাখার কাহিনি। ফিত্তিচান নামক এক মাটিপ্রেমীর কথা নিয়েই এ গল্প। যদিও সে এ মাটি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারে না।
জমির মাটি নিয়ে তার অস্তিত্বের সংকট। ইটভাটার কবল থেকে তার জমির মাটি বাঁচাতে সে বদ্ধপরিকর। ফিত্তিচানদের কাছে মাটি- ‘এই জমি শুধু যে অন্নদাতা তা তো নয়, সংসারের লক্ষ্মীও। যে লক্ষ্মী অন্ন দেয় তাকে কি বিক্রি করতে আছে?’ (চাকমা, ২০১৭, ৩৭) কিন্তু পাশের জমির মালিক মনীন্দ্র নিজের মাটি ধরে রাখতে পারে না। ছেলের অসুস্থতায় মাটি বেচতে বাধ্য হয়। অসহায় প্রান্তিক নৃগোষ্ঠীর সহায় কেউ কোথাও নেই। ‘স্বয়ং বিধাতার একটা উস্কানিতেই যেন প্রবল বৃষ্টির পাহাড়ী ঢলে ফুলে ওঠা খরস্রোতা ছড়ায় গিয়ে ঝাঁপ দিলো।’ (চাকমা, ২০১৭, ৩৭) খরস্রোতা ছড়ায় ঝাঁপ দেয়ার মতো পরিস্থিতি সংখ্যালঘুদের জীবনে অহরহ ঘটে থাকে। এখানে এর ব্যতিক্রম নয়।
সংখ্যাগুরুদের রাজনৈতিক বুলি হলো– বাংলাদেশ ‘homogeneous বা সমশ্রেণীভুক্ত’ মানুষের দেশ। সাধারণত Homogeneous বা সমশ্রেণীভুক্ত পরিচয় দিয়ে জাতিগত সংখ্যালঘুদের আলাদা অস্তিত্বকে অস্বীকার করার একটা কৌশল প্রয়োগ করা হয়। এটি যে সঠিক নয় এর ইঙ্গিত এ গল্পে রয়েছে। ‘ফিত্তিচান বাংলা বলতে বোঝেই কেবল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা আর শ্রমিকরা এটাই কম বুঝে। এরা নাকি মাটি কাটার জন্য সুদূর রংপুর থেকে এসেছে।’ (চাকমা, ২০১৭, ৩৮)
এ গল্পে আলাদা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের নমুনা বাঁশের লম্বা হুঁকো নিয়ে বাঙালি শ্রমিকের আগ্রহের বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক। ‘এর মধ্যে তরুণ বয়সী একজন শ্রমিক এগিয়ে আসে। ফিত্তিচানের হাতে থাকা বাঁশের লম্বা হুঁকোর প্রতি তার উৎসাহ।’ (চাকমা, ২০১৭, ৩৮) কারণ বাঁশের হুঁকো শ্রমিকের রংপুর এলাকায় নেই। যদিও সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হয়নি। মাটি কাটার এই শ্রমিকের সাথে তার বিড়ি আর হুঁকোর ঘটনায় বুঝা যায় ফিত্তিচান –‘পরাজয়ে ডরে না বীর’।
এ গল্পটি পাহাড়ি এলাকায় বেনিয়াদের দৌরাত্ম্যের ইতিহাসের অংশ। ইটের ভাটার মাটির জন্য ভৌগোলিক কাঠামোই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। ফিত্তিচান নিজের জমির মাটি বেচতে নারাজ, কিন্তু চারদিকের মাটি কাটার প্রভাবে তার জমির ক্ষতি হয়। একবার ক্ষতিপূরণ পেলেও আর পায় না। জমির মাটি বিক্রির চাপ ফিত্তিচানের নিজের ছেলেদেরসহ চারদিক থেকে আসলেও সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। কিন্তু অবশেষে হার মানতে হয়। বোঝা যায়- ‘প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এলে উপুর হয়ে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে প্রণাম করে। ক্ষমা চায় মাটির কাছে। তার পর বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।’ (চাকমা, ২০১৭, ৪১) ক্ষমা চাওয়া মানেই যে মাটি বিক্রি করে ফেলা তা আর পাঠকের বুঝতে বাকি থাকে না। এভাবেই ফিত্তিচানেরা নিজেদের মাটি হারায়, শিকড় ছিঁড়ে ফেলতে বাধ্য হয় এবং তাদের পরিচয়ও রূপান্তরিত হয়।
(চলবে । অজগর গল্পগ্রন্থের অবশিষ্ট গল্পগুলোর পর্যালোচনা পরবর্তী পর্বে। )
তথ্যসূত্র
চাকমা, বিপম। ২০১৭। অজগর। ঢাকা: তিউড়ি।
পড়ুন ।। কিস্তি : ২
::: গবেষণাধর্মী লেখাজোখা কিন্তু বেশ নিরস হয়। কিন্তু এ লেখা অন্য জাতের, অন্য ধাচের। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সাহিত্য বা মাইনর লিটারেচারের ধার বুঝতে চাইলে এই লিখা সংগ্রহে রাখতে হবেই। উত্তর কাঠামোবাদী চিন্তক জিল দেল্যুজ এই সাহিত্য ধারার নাম দিয়েছেন বিকামিং লিটেরেচার বা সম্ভাব্য সাহিত্য। সত্যিই, সংখ্যালঘু সাহিত্যর তলদেশে যে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক স্রোত বইতে থাকে, তা বুঝে নেয়া প্রয়োজন। আমাদের গীতা ম্যাডাম বেশ চমৎকার ভাবে এর সুত্র ধরিয়ে দিয়েছেন। উনার কাছ থেকে এমন আরও কাজ আশা নয় দাবী করছি।????