বীজ ।। কিস্তি : ১৭

বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।

 

১৯

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর অনেক বদলে গেছি। বদলে যাওয়াই জীবনের ধর্ম। ফার্স্ট ইয়ারেও নামাজ পড়তাম নিয়মিত। ফজর নামাজ কাজা পড়তাম। এখন পড়ি না। নামাজ পড়তে শুরু করতে হবে। নামাজ পড়লে শান্তি লাগে। দিনটা পূর্ণ লাগে। মাঝে মাঝে ভাবি। ভেবে অবাক লাগে। মনে শুকরিয়া হয়। খালাতো ভাইবোনদের জীবন থেকে কত আলাদা আমাদের জীবন। কত গোছানো আমাদের জীবন। বাবা-মাকে কোনোদিন ঝগড়া করতে দেখিনি আমরা। অথচ আমারই মায়ের আপন বোনদের ছেলেমেয়ে তারা। পারিবারিক অশান্তির মধ্যেই যাদের জন্ম। বেড়ে ওঠা। অশান্তিই তাদের জন্ম ও কর্মক্ষেত্র। কিছুদিন পরপরই শুনতাম খালা-খালুর ঝগড়া। ছাড়াছাড়ি। দুই খালুতে ঝামেলা। কত কী? খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা আলাদা হয়ে পড়েছি তাদের থেকে। সম্পর্কটা অনেকটাই হাই-হ্যালো ধরনের। জীবনটাই তাদের নানা সংকেটে ভরা। আমার এক খালাতো বোনের বিয়ে দেওয়া হল ঋণ-ধার করে। ছয় মাস না-যেতেই ঝগড়াঝাটি মারামারি শুরু হয়ে গেল। তারপর মামলা। এখন ডিভোর্স নিয়ে বাপের বাড়িতেই আছে। তিন নম্বর খালার মেয়ে। আবার হয়তো বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। মনে হয়, ওরা আমাদের কেউ নয়। অনেক দূরের সম্পর্ক আমাদের। অথচ তা তো নয়। এতো জটিলতার মধ্যেও ওরা কত স্বাভাবিক।

 

বালিশের পাশেই পড়ে আছে বইটা। The essential Rumi । ট্রান্সলেশনস বাই Coleman Barks । এতে কি বিভাসের গন্ধ আছে? নামটাও লেখা নেই কোথাও। কয়েকটা চরণ দেখি দাগানো। কে দাগিয়েছে এগুলো? বিভাস না জেসমিন দি’? ছোটোবেলা ছেলেদের কোনো বই ধার নিলে দরজা বন্ধ করে আমি তা দেখতাম। ছেলেদের গন্ধ পাবার চেষ্টা করতাম। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় একটা ছেলে ভর্তি হলো আমাদের সঙ্গে। নাম ছিল ফাহাদ উদ্দীন। টিচাররা খুব আদর করতো তাকে। কারো সঙ্গেই তেমন একটা কথা বলতো না সে। স্কুলে আসতো গাড়ি দিয়ে। ড্রাইভার এসে ক্লাসরুম পর্যন্ত দিয়ে যেতো। ফাহাদকে ‘স্যার’ বলে ডাকতো। খুব ভালো লাগতো শুনতে। আমারও খুব ‘ম্যাডাম’ ডাক শুনতে ইচ্ছা করতো। রিয়া তখন ছোটো। ওকে শিখিয়ে দিতাম, আমাকে ম্যাডাম বলতে। ও বলতো ‘ম্যাডাম’। আমরা ম্যাডাম ম্যাডাম খেলতাম। গাড়ি থেকে আমি নামতাম, রিয়া আমাকে বলতো বসেন ম্যাডাম। এটা ছিল আমাদের গোপন খেলা। বড়দের সামনে কখনো করতাম না। ফাহাদকে আমার খুব ভালো লাগতো। ফর্সা ও বেশ মোটাসোটা ছিলো সে। আমি ছিলাম একদম হ্যাংলা। তখন মনে হতো, মোটা হওয়া মানেই ধনী হওয়া। ধনীরাই মোটা হয়। ক্লাসের সবাই বুঝতো তারা অনেক বড়লোক। তার বাবা বড় অফিসার। সবাই তার সঙ্গে সমীহ করে কথা বলতো। আমি বলতাম না। মনে হত, আগ বাড়িয়ে আমি কথা বলতে যাব কেন? ও বলতে পারে না? একদিন সে সত্যিই আমার সঙ্গে কথা বললো। বললো, তার অনেক গল্পের বই আছে। আমাকে সে দিতে চায়। জিজ্ঞাসা করেছিলো, আমি কি নেবো? এরপর থেকে তাকে আমার ভালো লেগে যায়। মনে হতো ও অনেক ভালো। তার মত ভালো আর কেউ হয় না। ওর মনে কোনো হিংসা নেই। গোপন একটা ডায়েরিতে আমি তার নাম লিখে রাখি। সেটা আমাকে হিরা চাচা দিয়েছিলো। অনেক ভেতরের গোপন থেকে আরও গোপন একটা পৃষ্ঠায় আমি লিখে রেখেছিলাম :  F + D । সারাদিন ফাহাদের কথা মনে হতো আমার। বাবার সঙ্গে কখনো বেরোলে, রাস্তায় কোনো দামি গাড়ি দেখলেই মনে হতো এটার ভেতরে নিশ্চয়ই ফাহাদ আছে।

 

আজ বুধবার। বিকালটা সচরাচর বাসায় কাটাই না। খেলাম। পেঁয়াজ দিয়ে ডিম ভুনা করেছে মা। মসুরের ডাল। ডালের বড়া। ডালটা চমৎকার হয়েছে। খুব মজা করে খেলাম। ছোটোবেলা ডিম ভুনা খুব পছন্দ করতাম। কুসুম দিয়ে থকথকে করে ভাত মেখে ডিমের শক্ত সাদা অংশ দিয়ে খেতে ভালো লাগতো। এখন কুসুম খাই না।

 

বিছানায় শুইতেই খুব আরাম লাগলো। কেমন যেন লাগছে। একদম ফাঁকা হয়ে আছে ভেতরটা। মনে হচ্ছে, এই জীবনের উদ্দেশ্য কী? প্রতিদিন অফিসে যাই আসি। এর মানে কী? এভাবেই কি চলবে? বিয়ে যদি করতেই হয় বিয়েটা করে ফেলা উচিত। বিয়ে তারপর সন্তান। সন্তান মানুষ করা। এই তো ধারাবাহিকতা। আমি মার মত হয়ে ওঠবো আরেকজন মা। মা একদিন মারা যাবে। আমার সন্তানের সন্তান হবে। সবকিছু কেমন অদ্ভুত। প্রতিদিন এই ক্যালেন্ডারটা দেখি। আসলেই কি আমি সব দেখছি নাকি এগুলো একটা ভ্রম। সবাই কি আমার মতই একটি নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের ফাঁদে পড়েছে? নাকি আমিই কেবল এমন। আমি কী চাই, আমি জানি না। কী পেলে সুখী হব, জানি না। আমি কিছুই জানি না। কোনো কিছুর কি আসলে কোনো মানে আছে? এই যে আজ পরীক্ষা দিলাম। এই চাকরিটা যদি আমার হয়ই। কী বদলে যাবে এতে? বিভাসের কথাই কি ঠিক নয়, সব চাকরিই এক। বিভাস সম্পর্কে আমি কতটুকু জানি। একটুও না। কখনো জানতেও ইচ্ছা করেনি। ও তো কেবল ও-ই নয়। ওর পরিবার আছে। পরিবারের সুখ-দুঃখ-হতাশা আছে। সবসময় তার কাছে নিজের দুঃখ উগড়ে দিয়েছি। চাপিয়ে দিয়েছি নিজের চাওয়া। কোনোদিন জানতেও চাইনি তার সম্পর্কে। তার পরিবার সম্পর্কে। চোখের সামনে কত বিষয়ই জানতে চাই না। দেখতে চাই না। এই যে আমার মা। তার সম্পর্কে আমি কতটুকু জানি। বাবা সম্পর্কে কতটকু জানি। তাদেরও একটি জীবন আছে। পরিকল্পনা আছে। অপ্রাপ্তি আছে। আমরা তার কতটুকু জানি। মাকে কি কোনোদিন ভালো করে দেখেছি। তাকিয়ে থেকেছি তার মুখের দিকে? তাকাইনি। কী অস্থিরতা আমার। কেন এতো অস্থিরতা? জানি না। জগতের সবকিছু কেমন শান্ত। ধীর। স্থির। আমি এতো অস্থির কেন? বিভাস কত কথাই বলে। একদিন প্রশ্ন করলাম, তোমার সঙ্গে থাকতে আমার ভালো লাগে কেন? ও বলে, সে নাকি আমার বিপরীত, তাই ভালো লাগে। আমি বললাম, উল্টা বললে তুমি। আমি যেমন চাই, তুমি তেমন। তাই তোমাকে এতো ভালো লাগে।

ইমরান প্রতিনিয়ত আমাকে ফোন করে। সে কষ্ট পাচ্ছে খুব। তার কষ্টের কারণ আমার যৌনতা।

অনেক কথা সে বলে। সুন্দর সুন্দর কথা। বলে, যে নিজেই তৃষ্ণার্ত সে কারো তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে না। তৃষ্ণার্ত কেবল তৃষ্ণাই বিতরণ করতে পারে। কারণ তার আছে কেবল তৃষ্ণা। তার কাছে উপচে পড়া তৃষ্ণা। বিভাস তৃপ্ত। তাই সে আমাকে তৃপ্তি বিলায়। সে কি সত্যিই তৃপ্ত? সে অস্থির নয়? বিভাস যা বলে, তার সব কথা কি সে বিশ^াস করে? এসব কথা সে কোথায় পেয়েছে? সে কি সুখী? তার সম্পর্কে আমি জানতে চাই। তার বাবা-মা সম্পর্কে আমি জানতে চাই। সবকিছু সম্পর্কে আমি জানতে চাই।

 

রুমির কবিতা আমি বুঝতে পারি না। আর যা বুঝি তাকে মনে হয় সাধারণ কথা। বইটা আনার পর থেকে প্রথম দশ-পনেরো পৃষ্ঠাতেই ঘুরপাক খাচ্ছি আমি। এমন কী আর আছে এতে? বিভাসের কাছে শুনলে মনে হয় না-জানি কী!

Who looks out with my eyes? What is the soul?

I cannot stop asking.

If I could taste one sip of an answer,

I could break out of this prison for drunks.

I didn’t come here of my own accord, and I can’t leave that way.

Whoever brought me here will have to take me home.

এখানেও প্রিজন কথাটা আছে। বারবার পড়লাম। তাই তো আজ খুব ভালো লাগছে কথাগুলো। কী দারুণ! আমার মনের কথাগুলোই যেন বলছে। আমি বুঝতে শুরু করেছি। হ্যাঁ, আমি বুঝতে শুরু করেছি। কী বুঝেছি বলতে পারবো না কাউকে। কিচ্ছু বলতে পারবো না। কিন্তু আমি বুঝেছি। কিছু একটা বুঝেছি। কী নেশা ধরিয়ে দেয় প্রতিটি শব্দ। প্রতিটি উচ্চারণ। এর পরের কবিতাটা থেকেই বিভাস আমাকে দুইটা পঙক্তি শুনিয়েছিলো।

 

খুব ভালো লাগছে আমার। এই ভালো লাগা আমার চেনা নয়। এ অন্য ধরনের ভালো লাগা। কেমন শান্তি শান্তি ভালো লাাগা। বিশুদ্ধ অনুভূতি। অনেক ক্লান্তির পর আরামদায়ক ঘুমের মত ভালো লাগা। শৈশবের মত ভালো লাগা। আমার সারাটা শৈশব কেটেছে অনুতাপ করে। মনে হয়েছে খোদা আমাকে পছন্দ করেন না। আমি এক ছেলের সঙ্গে বউ-জামাই খেলেছি, এটা আমার অপরাধ। আমার যৌবন কাটছে অনুতাপ করে। খোদা আমাকে পছন্দ করেন না। শোভনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি আমি। এটা আমার অপরাধ। যৌনতাই অপরাধ। যৌনতাই আমার সমস্ত অপরাধের মূল। কেন মূল আমি জানি না। কেন অপরাধ আমি জানি না। বিভাস বলে যৌনতা বলে কিছু নেই। যৌনতার জন্য আলাদা কোনো অপরাধ নেই। যদি অপরাধই হয় তাহলে মানুষের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য আছেই বা কেন? উত্তরে আমি বলি, একে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। হেফাজত করতে হবে। এটাই পরীক্ষা। বিভাস কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। আমি চাই ও কিছু বলুক। কিন্তু বলে না। আমি চাই সে আমার উত্তরকে চুরমার করে দিক। কিন্তু সে করে না। আমার উত্তরে আমি সন্তুষ্ট নই। কিন্তু সন্তুষ্ট হওয়ার মত উত্তর আমি জানি না। আমার মনে হয়, বিভাস তা জানে। কিন্তু সে তা বলে না। কেন বলে না, আমি জানি না। সে তো কিছু বলার জন্যই আমার সঙ্গে মেশে। তবু কেন বলে না? আমি কি প্রস্তুত নই? তাহলে কীভাবে আমি প্রস্তুত হবো? আমি কি প্রস্তুুত হচ্ছি?

 

ইমরান প্রতিনিয়ত আমাকে ফোন করে। সে কষ্ট পাচ্ছে খুব। তার কষ্টের কারণ আমার যৌনতা। সে নাকি তাকে মোকাবেলা করছে। কেন করছে, কেন তাকে মোকাবেলা করতে হবে, আমি জানি না। আমাকে সে একই প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞাসা করে। আমি উত্তর দেই। এতে নাকি আমার মেন্টাল প্রোগ্রেস হচ্ছে। হয়তো হচ্ছে। এতে তার লাভ কী হচ্ছে? আমি জানি না। হয়তো হচ্ছে। জীবন একমাত্রিক নয়। বহুমাত্রিক। নদী একটাই কিন্তু তার স্রোত একটা নয়। জীবনের সত্য একটা নয়। তেমনি অপরাধও একমাত্রিক নয়। জীবনকে সমগ্ররূপে দেখতে পারাই জ্ঞান।

Every prophet sought out companions.

A wall standing alone is useless,

But put three or four walls together,

And they’ll support a roof and keep

The grain dry and safe.

When ink joins with a pen, then the blank paper

Can say something. Rushes and reeds must be woven

To be useful as a mat. If they weren’t interlaced,

the wind would blow them away.

ফাহাদ আমাকে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্দেরসেনের একটা বই দিয়েছিলো। খুব সুন্দর ও চমৎকার ছিলো বইটা। মনে হয়েছিলো বইটা খুব দামি। এত দামি একটা বই পেয়ে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। গুণে গুণে এক সপ্তাহ পরেই বইটা আমি তাকে ফেরত দেই। ফেরত দেওয়ার সময় তাকে বলি, গল্পগুলো খুব সুন্দর। যদিও গল্পগুলোর একটাও আমি পড়িনি। ফাহাদ বলেছিলো, এটা সে আমাকে দিয়ে দিয়েছে। আমি বলেছিলাম, না আমার লাগবে না। ও দুঃখিত হয়েছিলো। পরে আমার অনেক খারাপ লেগেছিলো। ওকে দুঃখ দিয়ে। ও এখন কেমন আছে? কোথায় আছে? তাকে আমার দেখতে ইচ্ছা করে। শোভন যখন আমার পিছে পিছে ঘুরতো, তখন আমার মনে হতো, ফাহাদ বড় হয়ে দেখতে হয়তো শোভনের মত হয়েছে। ফাহাদ উদ্দীন লিখে ফেসবুকে আমি অনেক সার্চ দিয়েছি। অনেক ফাহাদ আসে। কিন্তু তারা অন্য ফাহাদ। নকল ফাহাদ। কিন্তু আসল ফাহাদকেই কি আমি চিনি? যে আসল ফাহাদকেই চেনে না। সে কী করে নকল ফাহাদ চিনবে?

 

আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছেন রুমি। শব্দগুলো স্পন্দিত হচ্ছে আমার কাছে। আমার সামনে তারা জড় বস্তুর মত অন্তত পড়ে নেই। আমি বুঝতেছি। কিছু একটা বুঝতেছি। আমি না-থাকলে বিভাস কার সঙ্গে তার কথাগুলো বলতো। বিভাস না-থাকলে কে বলতো আমাকে এতো কথা। আমি জানি না, আমার কী প্রয়োজন। কিন্তু আমার মধ্যে দানবের মত হা করা একটা অভাব আমি অনুভব করছি। অনেক কিছু জানার অভাব। আজকের মত আর কোনোদিন তাকে অনুভব করিনি।

 

পড়ুন ।। কিস্তি ১৬

বীজ ।। কিস্তি : ১৬

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here