থার্টিভাইভ না তার্টিপাইব?

এই প্রশ্ন আমার নয়। ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একটি জাতীয় পর্যায়ের সেমিনারে ছিলাম। একজন গুরুত্বপূর্ণ বক্তা প্রশ্নটি তুলেছিলেন। ৩৫ সংখ্যার ইংরেজি উচ্চারণ কী হবে — থার্টিভাইভ, না তার্টিপাইব? সবাই জানেন কোনটি হবে। তবু তিনি এই কথা তুলেছিলেন এটা বোঝাতে যে, আমাদের উচ্চারণ হয় না, আমরা অনেক ভুল উচ্চারণ করি। প্রমিত উচ্চারণ না করতে পারার বেদনা রয়েছে অনেকের। আঞ্চলিক উচ্চারণ-বৈচিত্র্য আর ব্যক্তিবিশেষের উচ্চারণ-পার্থক্য নিয়ে কিছু ধারণা সবার স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

 

ভাইভাবোর্ডে অনেক প্রতিযোগীকে মার খেতে হয় শুধু উচ্চারণের কারণে। মুখের ভাষায় আঞ্চলিক শব্দ ও উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্য আমাদের বিশুদ্ধ কান মেনে নিতে পারে না। আবার, লেখার খাতায় বানান ভুলের জন্য শিক্ষার্থীকে নম্বর অনেক কম পেতে হয়। ডিকশনারির ব্যতিক্রম হলেই আমাদের চশমা-পরা চোখ সয় না। উচ্চারণ ও বানান ছাড়া বুঝি আর কিছু নেই ভাষার যোগ্যতা পরীক্ষার!

চাইলেও ব্যক্তি পারে না তার সব শব্দের উচ্চারণকে প্রমিত করতে।

শুনতে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু ভাষা-ব্যবহারকারীর কেউই আসলে একশ ভাগ ‘বিশুদ্ধ’ বা ‘প্রমিত’ উচ্চারণ করতে পারে না। এমনকি, বাংলাদেশ টেলিভিশন কিংবা বাংলাদেশ বেতারের কোনো উপস্থাপকও পারেন না উচ্চারণের মান পুরোপুরি বজায় রাখতে। আসলে, এটি সম্ভবও নয়। তবু মোটামুটি একটি অবস্থাকে আমরা প্রমিত বলে মেনে নিই।

 

একেক অঞ্চলের মানুষকে একেক রকম উচ্চারণ-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একটি জীবন্ত ভাষার আঞ্চলিক উচ্চারণ-বৈচিত্র্য থাকা স্বাভাবিক। ব্যাপারটি শুধু শব্দগত নয়। ভাষায় ব্যবহৃত বাক্যের স্বরতরঙ্গও এলাকাভেদে আলাদা হয়। একটি বড় ভাষার অনেকগুলো উপভাষা থাকে। তবে উপভাষা শুধু অঞ্চলগত ব্যাপার নয়। বিভিন্ন শ্রেণির, বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের ভাষা আলাদা হয়। শিক্ষার পার্থক্য, অর্থনৈতিক পার্থক্য, বেড়ে ওঠার পার্থক্যও ভাষাকে আলাদা করে দেয়। এগুলোও উপভাষাগত ব্যাপার। এসব কারণে বলা হয়ে থাকে, একটি ভাষার প্রতিটি মানুষ আলাদা আলাদা উপভাষা বহন করে।

 

চাইলেও ব্যক্তি পারে না তার সব শব্দের উচ্চারণকে প্রমিত করতে। উচ্চারণ কর্মশালার মধ্যে সব মনুষকে যদি একসঙ্গে আনা যায়, তবে খানিকটা কাজ হতে পারে। কিন্তু অতীতে কোনো ভাষায় এ রকম নির্দিষ্ট উচ্চরণে বাধ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এই প্রকল্প বা কর্মশালা আদৌ সম্ভব নয়, সবাই বুঝতে পারেন। তাহলে, আমার কথা, অন্যের যে-কোনো উচ্চারণকে মেনে নিন। কোনো উচ্চারণকে ভুল বলে চিহ্নিত করার দরকার নেই। একে উচ্চারণ বৈচিত্র্য হিসেবে গ্রহণ করুন।

 

যারা নিজেদের উচ্চারণকে অধিকতর প্রমিত করতে চান, তাদের জন্য কিছু পরামর্শ দিয়ে রাখি। নইলে, কণ্ঠশীলনের লোকদের কাছে আমি অপরাধী হিসেবে গণ্য হব। উচ্চারণে কিছু বিষয় সতর্ক হোন। ১. অ ধ্বনিকে ও বলবেন না। চোরকে চুর, আলোকে আলু বলবেন না। ২. ছ, জ — এ দুটি ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিভকে মূর্ধা কিংবা দাঁতের কাছে আনবেন না। জিভকে তালুতে রাখুন। ৩. ধ্বনির মহাপ্রাণতা সম্পর্কে সচেতন হোন। খবরকে কবর, ঘরকে গর বলবেন না। ৪. ক্রিয়াপদের উচ্চারণে কোরছি, খাইছি, আসতাছি, পড়তেছি, বলছিলাম প্রভৃতির বদলে করেছি, খেয়েছি, আসছি, পড়ছি, বলেছিলাম প্রভৃতি ব্যবহার করুন।

 

উচ্চারণে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বাংলা ৭টি স্বরধ্বনিকে বার বার আওড়ান। বাংলা ৭টি স্বরধ্বনি এই ক্রমে বলবেন: ই, এ, এ্যা, আ, অ, ও, উ। এবার বিপরীত ক্রমে বলুন: উ, ও, অ, আ, এ্যা, এ, ই। এগুলো উচ্চারণের সময় জিভ ও ঠোঁটকে পুরোপুরি কাজে লাগান। বেশি বেশি করে আবৃত্তি শুনুন। নিজে জোরে জোরে কবিতা ও গদ্য পড়ুন। কোনো একটি বিষয় নিজে সুন্দর করে বলার চেষ্টা করুন। শুধু আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে নয়, অনানুষ্ঠানিক পর্যায়েও সুন্দর করে উচ্চারণ করুন। ছোট ছোট বাক্যে কথা বলুন। বক্তব্য স্পষ্ট রাখুন। আর আত্মবিশ্বাস রাখুন।

 

ভাইভাবোর্ডে যেসব বিশেষজ্ঞ থাকেন, দোহাই তাঁদের, প্রার্থীর শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে যাচাই করুন। উচ্চারণকে নয়।

আগের লেখাবীজ ।। কিস্তি : ১৭
পরের লেখাজহির খানের কবিতা
তারিক মনজুর
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক। তাঁর আগ্রহের এলাকা ভাষা, ভাষাশিক্ষা, শিক্ষাদান ইত্যাদি। লেখক হিসেবে শিশুকিশোর উপযোগী রচনা লিখেছেন প্রচুর। বেশ কিছু বই বেরিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি বাংলা ভাষা বিষয়ে লিখে থাকেন। তিনি পিএইচডি গবেষণা করেছেন বাংলা বানান বিষয়ে। বাংলাদেশে বানান বিষয়ক গবেষণার ইতিহাসে এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here