বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে সহজিয়ায় কিছু মূল্যায়নধর্মী ও রূপরেখামূলক লেখা প্রকাশ করা হবে। আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের ৫০ বছরের অর্জনের ইতিহাসকে চিহ্নিত করা। আজ ছাপা হলো বাংলাদেশের সাহিত্য বিষয়ক একটি লেখা। লিখেছেন মনিরুল ইসলাম।
বাংলাদেশের সাহিত্য ৫০ বছরে পা দিয়েছে। ৫০ বছর কম সময় নয়। এই সময়ের মধ্যে এর নিজস্ব রূপ ও স্বর গড়ে ওঠার কথা। হয়তো তা উঠেছেও, অথবা উঠছে। তা না-হওয়ার তো কারণ দেখি না। বাংলাদেশের সাহিত্যের বয়স যদিও পঞ্চাশ হলো এর লিগ্যাসি কিন্তু পঞ্চাশ বছরের নয়। কেউ বলবেন হাজার বছরের কথা। কেউ হয়তো আপত্তি করবেন সেই কথায়। কারণ, যে সাহিত্যকে আমরা চিনি তার তো জন্ম হয়েছে উনিশ শতকের কলকাতায়। তাহলে, হাজার বছরের প্রসঙ্গ আসে কেন! আর এই যে পঞ্চাশ বছর ধরে — স্বাধীন বাংলাদেশের জমিনে — আমরা সাহিত্যটাহিত্য করছি এর ফল কী হলো! প্রশ্নটাকে এইভাবেও উত্থাপন করা যায়, জনজীবনে সাহিত্যের ভূমিকাটা আসলে কী! ‘সাহিত্য’, এই নাম-পরিচয় নিয়েও কিন্তু তর্কের শেষ নেই। তাছাড়া, সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়েও চালু আছে বিস্তারিত তর্ক। বাংলাদেশের সাহিত্যের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই এলোপাতাড়ি বিতর্কগুলো উসকে দেয়াই এই লেখার উদ্দেশ্য। বর্তমান জমানায় সাহিত্য যে আর অবিসংবাদী ভূমিকায় নেই, খোঁচা দিয়ে হলেও, বাংলাদেশের সাহিত্যকে তা তো মনে করিয়ে দিতে হবে।
বিচ্ছিন্নতা
কোনো কিছু সৃষ্টি করতে গিয়ে মানুষ সেখানে তার আয়ুকেই খরচ করে। অর্থাৎ, শ্রম-প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত ব্যক্তি তার আয়ুকেই – তার জীবনকেই – সেখানে বিষয়ে রূপান্তর করে। কোনো সৃজনশীল তৎপরতায় জীবন এভাবেই বিষয়গত হয়ে ওঠে। ব্যক্তি যা সৃষ্টি করে তার মধ্যে সে থাকে। থাকে খোদ তার জীবন। ফলে, জীবন আরেকটি আলাদা সত্তা হয়ে উঠল। মার্কস একে শ্রমের ‘অবজেক্টিফিকেশন’ বলেন। বলেন, এতে আসলে শ্রমের ‘রিয়েলাইজেশন’ ঘটে। তার কাছে, ‘The realization of labour is its objectification. (Marx, 2007: 78)’। আর শ্রম তো খোদ জীবনই। জীবনেরই তা আর্থনীতিক নাম। তাই, জীবনের বাস্তবায়ন মানেই – মার্কসের কাছে – জীবনের ‘বিষয় হয়ে ওঠা’। জীবনের এই ‘বিষয় হয়ে ওঠা’র শর্তেই বিচ্ছিন্নতা নিহিত থাকে। আইন-আদালত, ধর্মকর্ম, নীতি-নৈতিকতা, দর্শন ও বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্য সবক্ষেত্রে এই একই নিয়ম লক্ষ্য করেছেন মার্কস। এগুলো তার কাছে একেক ধরনের ‘প্রোডাকশন’ মাত্র। যার দ্বারা তিনি শ্রমের বিচ্ছিন্নতা মেপেছেন। ফলে, শিল্প-সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞান, মার্কসের কাছে, মানব-জীবনের বিচ্ছিন্নতা-নির্ণায়ক।
রবীন্দ্রনাথ কিন্তু উল্টা কথা বললেন। বললেনও বেশ সুন্দর করে। ‘যে দেশে সাহিত্যের অভাব সে দেশের লোক পরস্পর সজীব বন্ধনে সংযুক্ত নহে; তাহারা বিচ্ছিন্ন।’ তার মতে, সহিত শব্দ থেকেই সাহিত্য নামটার উৎপত্তি। ফলে, ধাতুগত অর্থেই এখানে মিলনের ভাবটা নিহিত থাকে। আরও পরিষ্কার করে বললেন, এই মিলন কেবল ভাবে-ভাবে, ভাষায়-ভাষায় ও গ্রন্থে-গ্রন্থে নয়। একইসঙ্গে তা মানুষের সঙ্গে মানুষের, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের ও দূরের সঙ্গে নিকটের মিলন। অত্যন্ত অন্তরঙ্গ এই মিলন। বললেন, এই যোগসাধন সাহিত্য ব্যতীত আর কিছু দিয়ে সম্ভব নয় (রবীন্দ্রনাথ, ২০০৭: ৪৫৫)। বিচ্ছিন্নতাকে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, সংশ্লিষ্ট সমাজে সাহিত্যের অভাব হিসেবে। আর মার্কস সাব্যস্ত করলেন বিচ্ছিন্নতার ফসল। ফলে, আলাদা করে সমাজে সাহিত্য নামের প্রতিষ্ঠানের বিকাশ মার্কসের চোখে নেতিবাচক রূপে ধরা পড়লো। রবীন্দ্রনাথ ঐদিকে ধরেই নিয়েছিলেন সমাজে বিচ্ছিন্নতা ছিলো। বিচ্ছিন্নতা আছে। এবং তিনি এর প্রতিকার দেখলেন সাহিত্যে। মার্কসের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের এই চিন্তাকে উড়িয়ে দেওয়ার কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ যে এভাবে ভেবেছেন তারও একটা লিগ্যাসি আছে। রোমান্টিকরা সাহিত্যকে এভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। জগতের নিঃসাড় বাস্তবতার প্রতিবাদ হিসেবেই সৃজনশীল কল্পনাশক্তিকে আশ্রয় করেছিলেন তারা। ফলে, অসাড় বাস্তবতা জীবনে যে বিচ্ছিন্নতা গড়ে দেয়, রোমান্টিকদের কাছে, সাহিত্য ছিলো তাকে অতিক্রম করার উপায়।
মার্কস ও রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যকে দুইটি পৃথক জায়গা থেকে দেখেছেন। ফলে, মার্কস দেখতে পেয়েছিলেন তার উৎপাদনের পদ্ধতি। আর রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন ভাবাদর্শ হিসেবে। এক-ধরনের চেতনা হিসেবে। তাই তো তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘আমাদের দেশে কিসে অনেক লোক এক হয়? ধর্মে। সেইজন্য আমাদের দেশে কেবল ধর্মসাহিত্যই আছে (রবীন্দ্রনাথ, ২০০৭: ৪৫৭)।’ সাহিত্যকে ভাবমণ্ডলরূপে দেখতে পেরেছিলেন বলেই তার প্রসারিত তলে সংস্থাপিত সমাজের ঐক্যমঞ্চ রবীন্দ্রনাথের কাছে এতোটা স্পষ্ট ছিলো। সম্ভবত সাহিত্যের পরিধিতে কার্যকর ক্ষমতাটুকু কোনোভাবে তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। যাইহোক, সংস্কৃতির এই বিচারটুকু মার্কস করেছিলেন শ্রেণির ধারণা দিয়ে। ফলে, তার চোখে সংস্কৃতি ধরা পড়েছিলো শ্রেণিবিশেষের স্বার্থগত ‘আইডিয়োলজি’ সংরক্ষণ ও তা প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে। অনেকেই ইদানিং বলেন, মার্কসের এই দেখার ভঙ্গিটার সমালোচনা করেন। তাদের কথা হলো, সমাজের আর্থনীতিক ভিত্তিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে, মার্কস, সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রক ভূমিকাটাকে তুলনামূলক খাটো মূল্য দিয়েছেন। ফলে, এক-ধরনের ‘আর্থনীতিক নিয়তিবাদ’-এ তার পা আটকে যায়। আর একারণেই, বিকশিত পুঁজিবাদী সমাজে বিপ্লবের অপ্রাসঙ্গিকতা মার্কসীয় পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা যায়নি।
আন্তোনিয়ো গ্রামশি এই পরিসরেই ‘হেজেমনি’র প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। এটি অব্যাহত শোষণ ও তার পরিপ্রেক্ষিতে না-ঘটা-বিপ্লবের মধ্যেকার ফাঁকটুকু ভরাট করে। যার সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট সমাজে হাজির এক-রকম সম্মতির ভিত্তিতে শাসন (শোষণ) চিহ্নিত করা যায়। কোনো নির্দিষ্ট সমাজে যে-ধরনের ‘আইডিয়োলজি’ শাসক বর্গের স্বার্থ সংরক্ষণ করে, অপরাপর গোষ্ঠীকে, তা গেলানোর মাধ্যমেই হেজেমনি কার্যকর হয়। এর প্রভাবেই শোষিতদের কাছে শাসকবর্গের আইডিয়োলজিকে মনে হয় স্বাভাবিক ঘটনা। অন্যায়কেই, শোষণকেই, নিপীড়নকেই নির্ঝঞ্ঝাট বাস্তবতার মতো লাগে। হেজেমনি শাসকশ্রেণির ভাবাদর্শকেই জনগণের সংস্কৃতি হিসেবে হাজির করে। আর রবীন্দ্রনাথ যে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগসাধনের কথা বলেন, এই জনসংস্কৃতিই কেবল সমাজে তাকে কায়েম করে তোলে। আসলে মূল্যবোধ, নীতি-আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি ও বোঝাপড়াসমূহের এই কার্যকর নেটওয়ার্কটাকেই আমরা সংস্কৃতি নামে চিনি। এটিই মানুষগুলোকে সামাজিক এককে গ্রন্থিত ও সচল রাখে।
শিল্প, সাহিত্য, দর্শন ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোই হেজেমনিক সমাজ কায়েমের মোক্ষম হাতিয়ার। এগুলোর দ্বারাই মূলত সমাজের বিভিন্ন বর্গের মানুষদের শাসকদলের ‘আইডিয়োলজি’ গেলানোর কাজটা করা হয়। ‘হেজেমনি’ বাস্তবায়নে মিডিয়া-শিল্প-সাহিত্য পালন করে থাকে নির্বাহী দায়িত্ব। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সাহিত্যের এই হেজেমনিক স্বভাব সম্পর্কে একদম ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তাই সংস্কৃতির মধ্যে যোগসাধনের ক্ষমতাটা ঠাহর করতে পারলেও এর হেজেমনিক চেহারাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। সাহিত্যের উপরে তাই এমন গা ছেড়ে বেমালুম হেলান দিয়েছিলেন। আর কোনো পক্ষ হয়তো বলবেন, রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে সক্রিয় ছিলেন তার গোষ্ঠীগত স্বার্থ-সংরক্ষণের ‘আইডিয়োলজি’ উৎপাদনে। এবং তিনিও ছিলেন সেই বুর্জোয়া ভাবাদর্শের প্রচার ও প্রসারের কাজে আত্মনিবেদিত কর্মী। এইভাবে বলাটা যদিও বেয়াদবের মতো বলা হবে। তবে, কখনো কখনো সত্যি কথা কিন্তু বেয়াদবির মতোই শোনায়। যদিও তখন হয়তো বেয়াদবিকে দোষাবহ জ্ঞান করে সত্যকে একেবারে বর্জন করা চলে না। কথা হলো, সাহিত্য যে সমাজের বুর্জোয়া অংশের ভাবাদর্শ প্রচারের বাহন, এটা অস্বীকার করা কি এতোই সহজ!
বাংলাদেশের সাহিত্য এটি স্থানিক বা ভৌগোলিক পরিচয়ই হোক। কোনোমতেই তা যেন আদর্শিক পরিচয়ে না গড়ায়। বাংলাদেশের স্বর একইসঙ্গে পৃথিবীরও স্বর। এ-কথা ভুললে চলবে না। এবং এভাবেই সে অপরাপর স্বরের সঙ্গে পরস্পর সম্পর্কিত। বাংলাদেশ নামে তার নিজস্ব অভিমুখিতা তো থাকবেই। অভিমুখিতা আর আদর্শ এক জিনিস নয়। আদর্শ থাকলেই তাকে হেফাজত করার দরকার পড়ে।
ধর্ম
‘সাহিত্য’ আসলে কী! এর পরিচয় কী উপাদানগত, নাকি পদ্ধতিগত! সাহিত্য কি গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটক! নাকি পঠন-পাঠনের এটি একটি পদ্ধতি! কেউ চাইলেই কি যেকোনো টেক্সটকে সাহিত্য হিসেবে পড়তে পারবে! এই ধরনের জিজ্ঞাসাকে এখন আর বেহুদা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। বিশেষ করে এগলটন যখন একবার কথাগুলোকে তর্কের বাজারে চাওড় করে দিয়েছেন। ‘সাহিত্য’ বলতে অপরিবর্তনীয় ও অখণ্ড কিছু কি আছে! কোনোকালে কি আদতে ছিলো এমনকিছু! টেরি এগলটন, তার বইয়ে, এই ধরনের প্রশ্নগুলোকে খুব খাতির করেছেন। এর ফল মন্দ হয়নি। সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ সংক্রান্ত নানা দিক এতে উন্মোচিত হয়েছে। আবিষ্কৃত হয়েছে সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আর সাহিত্য যে ধীরে ধীরে বিকশিত একটি দৃষ্টিভঙ্গি এই দিকেও আলাপটি এগিয়ে গেছে বহুদূর।
সাহিত্যকে প্রায়ই স্থান-কাল নিরপেক্ষ ক্যাটেগরি বলে ভ্রম হয়। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একে বর্ণনা করা হয় এক-রকম সর্বজনীন চেহারায়। কিন্তু সাহিত্য কি কোনো ইতিহাস ও শ্রেণি নিরপেক্ষ ক্যাটেগরি! বর্তমানে একে আমরা যে-অর্থে বুঝি, তা তো বেশিদিনের পুরোনো কোনো বোঝাপড়া নয়। এগলটন বলছেন, ‘it was invented sometime around the turn of the eighteenth century(Eagleton, 2008: 16)’। এবং এর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলো ক্ষমতার তৎকালীন সামাজিক বিন্যাস ও সমাজে কার্যকর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্কের ধরন। এগলটন দেখলেন, উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে, ইংরেজি সাহিত্যের বিকাশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধর্মের ব্যর্থতা। বৈজ্ঞানিক নানা উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের প্রাবল্যে, মধ্য ভিক্টোরীয় যুগে, ধর্ম তার নিয়ন্ত্রক ভূমিকা হারাতে থাকে। শাসক শ্রেণির কাছে যা মোটেই সুখের বিষয় ছিলো না। কেননা, ধর্মই তখন তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতো। ধর্মের মাধ্যমেই সমাজে জারি থাকতো হেজেমনি। সাধারণ মানুষ গিলতো, বা তাদেরকে গেলানো হতো, নানাবিধ ধর্মীয় আখ্যান। এর মাধ্যমেই সমাজে বিরাজ করতো শাসকশ্রেণির আদর্শ। কেননা, ধর্মীয় বিন্যাসেই সংরক্ষিত ছিলো শাসকদের জন্য সুবিধাজনক অবস্থান। তাছাড়া, শ্রেণিপেশা নির্বিশেষে সমাজের বিভিন্ন বর্গের মানুষদের একই ভাবমণ্ডলের নিচে ধরে রাখায় ধর্মের অবদান ছিলো তুলনারহিত। এর ক্ষয়, ফলে, শাসনক্ষমতার আসন্ন পতনকেই বরং সূচিত করেছে।
ফলে, ধর্মের ব্যর্থতায় শাসকবর্গের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিলো। কিন্তু, তাদের হাতের নাগালেই ছিলো বিকল্প। ইংরেজি সাহিত্য। ইংরেজি সাহিত্য তখন ধর্মেরই অনুরূপ জায়মান আরেক ডিসকোর্স। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। এই কথার প্রমাণ দিতে এগলটন অক্সফোর্ডের ইংরেজি সাহিত্যের এক পুরোনো প্রফেসরকে উদ্ধৃত করেন। তার নাম জর্জ গর্ডন। গর্ডনের আহ্বান:
England is sick… English literature must save it. The Churches (as I understand) having failed, and social remedies being slow, English literature has now triple function: still, I suppose, to delight and instruct us, but also, and above all, to save our souls and heal the state. (Eagleton, 2008: 20)
বিষয়গুলো আলোচনা করতে গিয়ে, এগলটন, কোনো প্রকার রাখঢাক করলেন না। বিস্তারিত আলোচনা করলেন। তার ভাষায়, সাহিত্য ছিলো শ্রমিকশ্রেণির মগজ ধোলাইয়ের হাতিয়ার। সেই কাজে ব্যবহৃত এক উত্তম পানিপড়া। এগলটন বিশ শতকের আরেক লেখকের বরাত দিলেন। সেই লেখকেরও ছিলো খোলামেলা কথা: ‘Deny to working-class children any common share in the immaterial, and presently they will grow into the men who demand with menaces a communism of the material.(Eagleton, 2008: 21)’। আরও বহু বহু উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন তিনি। ইংরেজি সাহিত্য সকলের মধ্যে সহমর্মিতা বাড়াবে। এটি খুলে দেবে সত্যের দুয়ার। এটি হ্যান করবে, এটি ত্যান করবে! সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে গড়ে উঠবে জাতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অহংকার। ইত্যাদি চমকপ্রদ কতো কথা! যা আমরা এখন শ্রেণিকক্ষে ভরপুর আওড়াই।
আর সাহিত্য যেহেতু নীরবে-নিভৃতে পাঠটাঠ করার বিষয়, ফলে, এর দ্বারা শ্রমিকদের যৌথ সহিংসতা কমে আসবে। তারা হবে ঠান্ডা স্বভাবের। জনগণের আসলে কী দরকার! তাদের তো দরকার এটা জানা যে, রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের কী সম্পর্ক! কাকে বলে সুনাগরিক! এবং কীভাবে তা হওয়া যায়! তার কী দায়-দায়িত্ব! রাষ্ট্রের জন্য একজন সুনাগরিকের কী কী ত্যাগ করবে! আর সেই ত্যাগের কী মহিমা! মজার বিষয় হলো, অ্যাকাডেমিক বিষয় হিসেবে ইংরেজিকে কিন্তু প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য করা হয়নি, করা হয়েছিলো মেকানিকস ইনস্টিটিউটগুলোতে, শ্রমিকদের কলেজে। অর্থাৎ, সাহিত্য পেলো এইসব গুণাবলি শেখানোর কাজ। শিখিয়ে-পড়িয়ে গোমূর্খদের তা মানুষ করবে।
ইংরেজি সাহিত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে, ১৮৯১ সালে লিখিত এক সমীক্ষায়, এই ধরনের কথাই ওঠে আসে। সেখানে লেখা হয়, ‘they need also to be impressed sentimentally by having the presentation in legend and history of heroic and patriotic examples brought vividly and attractively before them. (Eagleton, 2008: 22)’। ফলে, ধর্মের মতো সাহিত্যও আবেগ আর অনুভূতি নিয়ে দারুণ খেলা দেখাতে শুরু করলো। এর ফল দাঁড়ালো চমৎকার। অন্যদিকে সাহিত্যের পরিসরও সংকুচিত হতে হতে বিশ্লেষণী চিন্তার একদম বিপরীত কিছুতে গিয়ে ঠেকলো। বর্তমানে আমরা যেমন দেখি, পরিষ্কার জিনিসকে ঝাপসা করাই সাহিত্যের গুরুদায়িত্ব। তার উপজীব্য হয়েছে বস্তাভরা ভাবলুতা। কার্যকরী চিন্তাকে এখানে সতীন সমতুল্য জ্ঞান করা হয়। এমনকি আমরা এ-ও দেখেছি, দর্শন, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য চর্চার চেয়ে কীভাবে, এই ভারতবর্ষে, সাহিত্যচর্চা গুরুত্ব লাভ করেছে। এবং কী হয়েছে তার ফল! এতে জনগণের মনোযোগ দরকারি বিষয় থেকে সরে গিয়েছে দূরে। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেছে ভাবগত সত্যের প্রতি আগ্রহ। সহনশীলতা। উদারতা। সাহিত্যের উপজীব্য হয়ে ওঠেছে সময় নিরপেক্ষ সত্য।
কলোনিয়ালিটি
ইংরেজি সাহিত্য অচিরেই ইংরেজদের গর্বের বিষয়ে পরিণত হলো। বেশ ভালোমতোই তা পূরণ করলো শাসকবর্গের আকাঙ্ক্ষা। এমনকি আকাঙ্ক্ষার চেয়েও যেন বেশি কিছু করলো। মেকলের কথা শুনলেই এই ব্যাপারে আর সন্দেহ থাকে না। ব্রিটেনের সাহিত্য সম্পর্কে এক বক্তৃতায় মেকলে বলেন:
I have been requested to invite you to fill your glasses to the literature of Britain; …to that literature which has exercised an influence wider than that of our commerce, and mightier than that of our arms… (Macaulay, 1900:127)
মেকলের কথা ধরে এগোলে বুঝতে কষ্ট হয় না, ব্রিটেনের ঝাণ্ডা হাতে, ইংরেজি সাহিত্য কী করে পেরিয়ে গেছে দেশের গণ্ডি। যা পারেনি অস্ত্র আর বাণিজ্য, সাহিত্য যেন তা-ই করে দেখিয়েছে। মোটেও বাড়িয়ে বলেননি মেকলে। কিন্তু তার বক্তব্যের গভীরতা সম্পর্কে তিনি নিজেই কতোটা ওয়াকিবহাল ছিলেন, তা নিয়ে আলাদা করে কেউ ভাবতেই পারেন। আচ্ছা, সাহিত্য কি তবে কলোনিয়াল ক্যাটেগরি! যা উপনিবেশক ও উপনিবেশিতের মধ্যে ফারাক তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে! এই প্রশ্নের উত্তরও মেকলেই দেবেন। ১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মেকলে যে বক্তৃতা করেছিলেন, সেখানেই এর উত্তর আছে। সেই বিখ্যাত মিনিটে মেকলে বললেন:
It will hardly be disputed, I suppose, that the department of literature in which the eastern writers stand highest is poetry. And I certainly never met any Orientalist who ventured to maintain that the Arabic and Sanscrit poetry could be compared to that of the great European nations. But when we pass from works of imagination to works in which facts are recorded, and general principles investigated, the superiority of the Europeans becomes absolutely immeasurable. (Macaulay, 1952: 349)
ফলে, অপরাপর বিষয়ের মতো সাহিত্যও তো দেখছি কলোনিয়াল ক্যাটেগরি হিসেবে কাজ করেছে। যার সাপেক্ষে ঔপনিবেশিক ইউরোপ নির্মাণ করেছে তার নিজের শ্রেষ্ঠতা। নির্ধারণ করেছে তার চিন্তা ও চেতনার উচ্চমূল্য। উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ায় এভাবেই সাহিত্য পালন করেছে সক্রিয় ভূমিকা।
ইংরেজি সাহিত্য যেমন বাংলা কাব্যের চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছে। কেবল গতরটাই নয়, তা বদলে দিয়েছে কাব্যের মর্মটাও। এখন আমরা কাব্য বলতে যেমন ‘পোয়েট্রি’ বুঝি। কবি বলতে বুঝে নেই ‘পোয়েট’। ভারতবর্ষে কবিকে এমন ‘পোয়েট’ অর্থে বোঝা হতো না। কবি নামের ভেতরই নিহিত থাকতো স্রষ্টার দার্শনিক ও সাধক পরিচয়। এখানে যুক্তিচর্চাও করা হতো কাব্যে। বৈষ্ণব চিন্তকরাও তত্ত্বচর্চা কাব্যেই করতেন। ফলে, কবি পরিচয়টি এখানে ব্যাপক, পোয়েট অর্থে সীমায়িত তো নয়-ই। আর আমাদের মঙ্গলকাব্যের কবিরা তো ছিলেন দেবীর বার্তাবাহক। তারই আদেশে তারা কাব্য রচনা করতেন। আর ভক্তরা সেই কাব্য পাঠে আয় করতেন পুণ্যি। এইসব ‘গালগপ্প’কে গাঁজাখুরি মনে হলে দোষ নেই। কিন্তু চিন্তা প্রক্রিয়ায় ঘটে যাওয়া বদলটাকে ও তার সঙ্গে জড়িত রাজনীতি সম্পর্কেও কান খাড়া থাকা চাই।
আসলে সাহিত্য বর্গটাই তো ইংরেজদের জিনিস। তারা এই বিলেতি জিনিসটাকেই ভারতবর্ষের সমাজে আরোপ করেছেন। যে গ্রন্থ লোকে পুণ্যার্জনের জন্য পাঠ করে, মঙ্গলের উদ্দেশ্যে ঘরে রাখে, তা সাহিত্য হয় কী করে! দেবতাকে তুষ্ট করার লক্ষ্যে আওড়ানো হয় যে শ্লোক, তা আর যাইহোক সাহিত্য নয়। সাহিত্য ‘সেকুলার’ জিনিস। তাই ইউরোপীয়। তাই ভিনদেশি। আর এটি তো কোনো সর্বজনীন ক্যাটেগরি নয়, যাকে সকল দেশে, সকল সমাজে থাকতেই হবে! আমরা কেনো তা মনে করি! ইংরজেদের এই আরোপণের দ্বারা আমাদের সমাজে হাজির জীবনকে যাপন করার স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পকলা ও তা উপভোগের উপায় ধীরে ধীরে বদলে গেছে। বদলে গেছে আমাদের রুচি। ‘সাহিত্য’ নাম ছাড়া আমরা এখন আর সেগুলোকে ব্যাখ্যাও করতে পারি না। এই বিষয়ে আরও গভীর পর্যালোচনা দরকার। দরকার এই সম্পর্ককে নানাভাবে ভেবে দেখার।
ভারতবর্ষীয় চিন্তাজগতে ইংরেজি সাহিত্যের আছড় যে বেশ ভালোমতোই লেগেছিলো, এক মধুসূদনের পাগলামির বর্ণনা দিলেই তা যথেষ্ট হয়। বাঙালিদের মধ্যে সাহিত্য যেহেতু হীনমন্যতা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিলো, মধুসূদনরা তাই সেই থানেই অধিষ্ঠান দাবি করে বসেছিলেন। হতে চেয়েছিলেন তাদের মতো। লিখতেও চেয়েছিলেন ইউরোপীয়দের মতো করে। তাদের কাছে সাহিত্য হয়ে ওঠেছিলো এমন এক-ধরনের মই, যা বেয়ে নিজেকে উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠা করা যায়। অন্যান্য কলোনিয়াল ক্যাটেগরিগুলোও এভাবেই কাজ করেছে। সেগুলোর ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়েছে অনুরূপ প্রবণতা। কলোনাইজাররা যা দিয়ে নিজেদের জোয়ান, মর্দ ও মর্যাদাবান করে তুলেছিলেন, কলোনাইজডরা দেদারছে তারই কেবল অনুকরণ করে গেছেন। ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক। ফানোর এই বইটার নাম এখন আর কে না জানে! যাইহোক, মধুসূদন সম্পর্কে যোগীন্দ্রনাথ বসু লিখছেন:
প্রথমার্জ্জিত সংস্কারের বশবর্ত্তী হইয়া তিনি, পূর্ণ বয়সেও, মিল্টনকে কালিদাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কবি এবং ‘ইলিয়াড’কে ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কাব্য বলিয়া বিশ্বাস করিতেন। পাশ্চাত্য কবিদিগের সহিত তুলনায় আমাদিগের দেশের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কবিদিগকেও তিনি অতি নিম্নস্থানীয় জ্ঞান করিতেন। (যোগীন্দ্রনাথ, ২০১১: ৩৬)
কেবল মধুসূদন কেন, বঙ্কিম নিজেও ইংরেজিতে লিখতে শুরু করেছিলেন। আর এরাই দুইজন বাংলা সাহিত্যের দুই স্তম্ভ। তাদের লেখাপত্র ও তৎকালীন সময় নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। গবেষকদের অধিকাংশই বাংলা সাহিত্যের এ-পর্বে দেখেছেন পাশ্চাত্য প্রভাব। প্রভাব সে তো ভিন্ন আলাপ। গোটা ব্যাপারটাকেই তো মনে হয় নতুন। আর নতুন যদি না-ই হয়, তাহলেও তো বাংলা অঞ্চলের মানুষ ঠিক কোন সূত্রে এসবের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলো, বিনা সন্দেহে তা আরও খতিয়ে দেখার ব্যাপার আছে। কথা যতো রকমেই হোক, বাংলা সাহিত্য যে ইউরোপীয় ছাঁচে গড়া এই বাণী কি অস্বীকারের জো আছে? দেখা যাক, এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ কী বলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন:
ইংরেজি শিক্ষা যে ইংরাজি ভাষা অবলম্বন করিয়া বিস্তৃত হইয়াছে তাহা নহে। বাংলা সাহিত্যই তাহার প্রধান সহায় হইয়াছে। ভারতবর্ষের মধ্যে বাঙালি এক সময়ে ইংরাজ-রাজ্য স্থাপনের সহায়তা করিয়াছিল; ভারতবর্ষের মধ্যে বঙ্গসাহিত্য আজ ইংরাজি ভাবরাজ্য এবং জ্ঞানরাজ্য-বিস্তারের প্রধান সহকারী হইয়াছে। এই বাংলাসাহিত্যযোগ ইংরাজিভাব যখন ঘরে বাহিরে সর্বত্র সুগম হইল তখনই ইংরাজি সভ্যতার অন্ধ দাসত্ব হইতে মুক্তিলাভের জন্য আমরা সচেতন হইয়া উঠিলাম।(রবীন্দ্রনাথ, ২০০৭: ৪৬০)
আমরা কতটুকু সচেতন হইলাম, কি হইলাম না, এই বিবরণী দাখিল করা নিস্প্রয়োজন। কিন্তু এইটুকু তো বলা চলে, রবীন্দ্রনাথ যত সহজে মুক্তির হিসাব মিলিয়েছেন, তা এতো সহজ ছিলো না। যে সর্ষে দিয়ে তিনি ভুত তাড়াবেন ভাবছিলেন, ভুত ঘাপটি মেরে ছিলো সেই সর্ষেতেই। মনোজাগতিক উপনিবেশায়ন নিয়ে চিন্তিত হওয়ার আগেই বাংলা অঞ্চলের এই শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্ক চিরতরে চিন্তা করাই থামিয়ে দেয়।
সাহিত্য
উনিশ শতকের কলকাতায় আলাদা কিসিমের সাহিত্য উৎপাদিত হতে থাকে। প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বের তুলনায় নানা দিক থেকেই যা স্বতন্ত্র। চোখে পড়ার মতো বদলটা ছিলো, উৎপাদন পদ্ধতিতে বদল। সাহিত্য তখন পণ্যে রূপ নেয়। সাহিত্যকর্ম পণ্য হিসেবে বাজারে বিকোতে থাকে। গড়ে ওঠে পেশাদার লেখকের দল। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, ভারতবর্ষের উৎপাদন-ব্যবস্থায় জমি পণ্য হয়ে ওঠে সেই ১৭৯৩ সালেই। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। অর্থাৎ, পণ্যায়ণের সংস্কৃতি ধীরে ধীরেই জমে উঠেছে – হঠাৎ করে নয়। জে. সি ঘোষের লেখায় এই পার্থক্যটা বেশ ধরা পড়ে। তিনি লিখছেন:
But the new literature that begins with the nineteenth century is mostly the work of writers who lived in Calcutta and wrote for urban readers. …Their outlook is less primitive, and their language is more polite. They do not confine themselves entirely to religious themes, and the larger part of their work is indeed secular. …Another thing that differentiates the Calcutta period from its predecessors is the emergence of independent and professional man of letters. With the end of feudalism came the end of the patronage of literature by the royalty and aristocracy, the disappearance of the courtly and priestly writer of old. (Ghosh, 1948: 98-9)
এর ফলে, সাহিত্য বিশ্লেষণে নতুন মাত্রা এসে যোগ হলো – বাজারের চাহিদা ও চাপ। যাকে মাড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব তো হয়েছেই, বর্তমান সময়ে তা-ই বরং নিয়েছে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা। এভাবেই, সাহিত্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে কতগুলো আর্থনীতিক বিষয়। বৃহৎ অর্থে যা সমাজের পুঁজিবাদী ঘরানার উৎপাদনেরই বৈশিষ্ট্য।
সাহিত্য উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় লেখকেরা পালন করেন উৎপাদকের ভূমিকা। প্রকাশকেরা তা ছাপেন, অর্থাৎ, বাজার বুঝে পয়সা বিনিয়োগ করেন। পাঠকেরা পকেটের টাকা খরচ করে বাজার থেকে তা কেনেন। পড়েন। সাহিত্যের বাজার আরও বড়ো, আরও জটিল হওয়ার আগ পর্যন্ত মোটামুটি সরল ছকটা এ-ই। এটা সবসময়ই মনোযোগ দিয়ে দেখার বিষয় যে, কীভাবে এই প্রক্রিয়াটি সচল থাকে। কীভাবে অব্যাহত থাকে এর উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন! মূলত কোন কোন আকর্ষণে সচল থাকে লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের একটি ভারি দল! যে সমাজ যতো বিকশিত, ততই জটিল তার এই উৎপাদন-প্রক্রিয়া। নানান নানান মাত্রা এসে তখন যোগ হয়। তাছাড়া, একসময়কার উপনিবেশিত রাষ্ট্রগুলোর স্বভাব-চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গেলে ঔপনিবেশিক প্রভাবকে তো মাথায় রাখতেই হবে। বাংলাদেশের কথাই যদি ধরা হয়, তাহলে কি ঔপনিবেশিক প্রভাবটাকে বাদ দিয়ে এই হিসাব মেলানো যাবে! অন্যান্য শাস্ত্রের তুলনায় এখানে সাহিত্যকে সমীহের চোখে দেখার পেছনে উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার ভূমিকাটি নগণ্য নয়। এখানে সাহিত্যকে দেখা হয় এক-ধরনের মই হিসেবে, যা বেয়ে নিজেকে উঁচায় তোলা যায়। কেবল নিজেকে নয়, গোটা জাতিকেই বসানো যায় উঁচা পিড়িতে। গড়পড়তা মধ্যবিত্ত লোকদের দোষ দিয়ে কী হবে! বাংলা অঞ্চলের বিখ্যাত মানুষেরাই তো এভাবে ভেবেছেন।
ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রভাবে সাহিত্যচর্চা – দর্শন, বিজ্ঞান ও রাজনীতিচর্চা নয় – বাংলা অঞ্চলে খুব মর্যাদার বিষয়ে পরিণত হয়। যারা সাহিত্যচর্চা করে তারা যেন সমাজে এক ডিগ্রি এগিয়ে। আর যারা করে না তারা অশিক্ষিত, বর্বর ও গড় মানুষই রয়ে গেলো। সাহিত্য এই ভেদ গড়ায় অংশ নেয়। আমাদের সমাজে সাহিত্য করা ব্যক্তি খুব সহজেই পরিবার ও সমাজ থেকে নিজেকে সেরা ও আলাদা ভাবতে শুরু করে। সাহিত্যের উছিলায় নিজেকে সে এলিট মনে করতে শুরু করে। হ্যাঁ, এক্ষেত্রে সে সেই কলোনিয়াল এলিটদেরই লিগ্যাসি বহন করতে চায়। আমাদের দেশে বিজ্ঞানী, দার্শনিক, গণিতবিদ ও রাজনৈতিক নেতাদেরও সাহিত্যিকের কাতারে এনে সম্মান করার রেওয়াজ আছে। বইটই লেখাকে এখানে দেখা হয় খুবই সম্মানের চোখে। বিশেষ করে সাহিত্যটাহিত্য কিছু। গল্প-উপন্যাস-নাটক-কবিতা-প্রবন্ধ। বাংলাদেশে তাই বই লেখার একটা হিড়িক আছে। একটু খোঁজ করলেই দেখা যাবে, এই বাতিক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেই আছে। নানাভাবে আছে। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে লোকে এখানে বই করে। বাড়তি সুবিধা আদায়ের জন্য লোকে এখানে প্রকাশ বই করে। টাকা নয়, অনেকক্ষেত্রে নাম কামানোটাই মুখ্য। প্রচার-প্রচারণার দ্বারা সমাজে একটা জায়গা করে নেওয়াই উদ্দেশ্য। এজন্যেই বলা, নানা মাত্রা এসে যোগ হয় সাহিত্য উৎপাদনে।
সাহিত্য নিয়ে উপরে যা যা বলা হলো, তা হলো মানসিকতার কথা। সাহিত্যকে আমাদের সমাজে কীভাবে দেখা হয় – সেই দেখার নেপথ্যে কী কী অচেতন কারণ থাকতে পারে – তার এক সামান্য চিত্র। একে সমগ্র চিত্র ভাবা ভুল হবে। সমগ্র চিত্র বলে আদতেই কোনো চিত্র আছে কিনা বর্তমানে এ-ও আরেক সন্দেহের বিষয়। যাইহোক, কেউ যদি উপর্যুক্ত কথাগুলোর এই অর্থ করেন যে, বাংলাদেশের সাহিত্যিকেরা বিলাসী ও সম্ভ্রান্ত জীবন যাপন করছেন, সমাজে সাহিত্যের ভূমিকা পুরোটাই অশুভ, তাহলে তা ভুল হবে। কথাগুলোর উদ্দেশ্য তা প্রমাণ করা নয়। সাহিত্য, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্য, মোটেই ‘ডমিনেন্ট ডিসকোর্স’ নয়। ঐ অর্থে কোনোকালেই তা ছিলো কিনা সন্দেহ। আর ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভাগগুলোই যে অ্যাকাডেমিতে দাপিয়ে বেড়ায় বা বেড়াচ্ছে তা বুঝতে এখন আর মগজ খাটাতে হয় না। সেই তর্ক আলাদা। তাছাড়া, আন্দোলন-সংগ্রামে সাহিত্যের ভূমিকা-টূমিকার কথা মনে রেখে কোনো পক্ষ যদি জেদ করেন, তা-ও অপ্রাসঙ্গিক হবে।
টেক্সট
সাহিত্যকে আমরা যেমন, ইংরেজি সাহিত্যের আদলে, গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধ ও কবিতায় ভাগ করে ফেলেছি তা এক-ধরনের ‘অথোরিটারিয়ান’ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। কোন ‘টেক্সট’ কে কীভাবে পড়বে তা আরেকজন নির্ধারণ করে দেওয়ার কে! এই ধরনের আরোপণ স্বতঃস্ফূর্ত পাঠে স্পষ্ট ব্যাঘাত ঘটায়। ইউরোপীয়রাই এখন এই নিয়ে কথা তুলেছে। যেকোনো ধরনের সংহত বয়ানের তারা এখন বিরোধিতা করে। কারণ, অন্য বয়ানগুলোর তা টুঁটি চেপে ধরে। পশ্চিমা পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্ট চিন্তায় এই ঘরানার অথোরিটারিয়ান পাঠের বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। আমরা যাকে ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ নামে চিনি। যেখানে চিন্তা-প্রক্রিয়ায় হাজির থাকা কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়। এক-রকম উৎখাত করা হয় তাকে। গড়ে দেওয়া হয় পঠন-পাঠনের ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’। বাংলাদেশের সাহিত্যের এই ধরনের দার্শনিক প্রস্তাবগুলোর মুখোমুখি হওয়ার বয়স তো হয়েছেই।
প্রচলিত অর্থে যাকে ‘উপন্যাস’ বলা হচ্ছে, কাহিনি ও ঘটনার সুনিপুণ বর্ণনা উপভোগ করার জন্য কেউ তার দ্বারস্থ হতেই পারেন। তাই বলে কি সামাজিক মনস্তত্ত্ব অনুসন্ধানী আরেকজন পাঠক তার কাছে ঘেঁষতে পারবেন না! কেউ কি তাকে পড়তে পারবেন না ঘটনার সামাজিক দলিল হিসেবে! যদি তা পারেনই তাহলে তো একের সঙ্গে অপরের পাঠের মিল থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর যদি তা না-ই থাকে তাহলে, এই সকল অসম্ভাবনার ভিড়ে কী করে সেই টেক্সটটির একটি সংহত পরিচয় থাকতে পারে! যদি বলা হয়, নাম দিতে হয় বলে দেওয়া, তাহলে এ হবে আরেক ফাঁকির কথা। কেননা, এই নাম দেওয়া-দেওয়ি মোটেই নিরীহ নয়। কোনোকালেই তা নির্বিষ ছিলো না। বাংলা সাহিত্য সমালোচনার আদালতে এই হওয়া না-হওয়ার মামলা দেখেই আমরা বড়ো হয়েছি। কার লেখাটা উপন্যাস হয়েছে, কারটা হয়নি, এই নিয়ে চলেছে অফুরান তর্ক। এর সঙ্গে সাহিত্যিকদের প্রভাব ও প্রতিপত্তির বিষয়ও জড়িয়ে থাকে। বিষয়টি তখন আরও জট পাকিয়ে যায়।
ফলে, অঙ্গ ভাগাভাগির ক্ষেত্রেই কেবল ষোল আনা তৎপর থাকলে চলবে না, তার পরবর্তী খোঁজ খবরও রাখা চাই। শুধু ‘উপন্যাস’ কেন, গল্প-কবিতা ইত্যাদি পরিচয়ের আড়ালেও এক-ধরনের কর্তৃত্ব প্রকাশ পায়। সংকট একই। বিশেষ ধরনের পাঠভঙ্গিকে তা সুবিধা দেয় ও অন্য পাঠগুলোকে নাকচ করে। ফলে, টেক্সটে নিহিত সম্ভাবনাময় অপরাপর পাঠগুলো এক্ষেত্রে গৌণ হয়ে যায়। এমনকি তাদের বর্ণনা করার জন্য উপযোগী ভাষাও আর মেলে না। এই ধরনের আঙ্গিক বিভাজন লেখকের সৃজনশীলতার ক্ষেত্রেও সমান চাপ সৃষ্টি করে। এইসব নানা কারণেই সাহিত্য এখন সংকটের মুখে। এই সংকট তার পরিচিতি ও পঠন-পাঠনকেও অস্থির করে তুলেছে।
উপর্যুক্ত তর্কগুলো তো অমূলক নয়। তাই, পঞ্চাশ বছরে পেরিয়ে আসা পথের দিকে ফিরে দৃষ্টিতে এগুলোই বড়ো হয়ে দেখা দিলো। সব শেষে এই কথাটি না বললেই নয়, বাংলাদেশের সাহিত্য এটি স্থানিক বা ভৌগোলিক পরিচয়ই হোক। কোনোমতেই তা যেন আদর্শিক পরিচয়ে না গড়ায়। বাংলাদেশের স্বর একইসঙ্গে পৃথিবীরও স্বর। এ-কথা ভুললে চলবে না। এবং এভাবেই সে অপরাপর স্বরের সঙ্গে পরস্পর সম্পর্কিত। বাংলাদেশ নামে তার নিজস্ব অভিমুখিতা তো থাকবেই। অভিমুখিতা আর আদর্শ এক জিনিস নয়। আদর্শ থাকলেই তাকে হেফাজত করার দরকার পড়ে। তার জন্যে লাগে লাঠিয়াল বাহিনি। তাছাড়া, আদর্শ তো পরিবর্তনশীল, আদর্শ তো বহু। আদর্শের এই পরিবর্তনশীলতা ও বহুত্ব এক-রকম আদর্শহীনতারই ইঙ্গিত দেয়। ‘সাহিত্য’ পরিচয়টার ক্ষেত্রেও কি এই একই কথা খাটে না!
সহায়ক বইপত্র:
১। যোগীন্দ্রনাথ বসু, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, দে’জ পাবলিশিং, ২০১১, কলকাতা।
২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রবন্ধসমগ্র, সময় প্রকাশন, ২০০৭, ঢাকা।
৩। Terry Eagleton, Literary Theory An Introduction, Wiley India Pvt. Ltd, 2008, India.
৪। J. C. Ghosh, Bengali Literature, Oxford University Press, 1948, London.
৫। Thomas Babington Macaulay, Miscellanies, vol. 2, The Riverside Press, Cambridge, 1900, Boston and New York.
৬। Thomas Babington Macaulay, Speeches By Lord Macaulay, Oxford University Press, 1952, London.
৭। Karl Marx, Economic and Philosophic Manuscript of 1844, Trans. Martin Milligan, Dover Publication, 2007, New York.