গীতা দাস একজন সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মী। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকায় তার কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ছোটগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। সহজিয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখবেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে। আজ প্রকাশিত হলো কিস্তি ২।
চাকমা ছোটগল্প গ্রন্থ অজগর -১
সাহিত্যচর্চার মধ্যে কথাসাহিত্য একটি বিশেষ শাখা যেখানে মানুষের জীবনের আবেগীয় কাব্যিক বোধের বাইরে মানবমনের অলিগলির জটিল দিক, প্রাত্যহিক জীবনের টানাপড়েন, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বিশ্লেষণ এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পর্যবেক্ষণ প্রতিফলিত হয়। “কথাসাহিত্য ব্যক্তির মুক্তিপ্রয়াসের আর-একটি উদ্যোগ—আরও ব্যাপক, আরও সংগঠিত এবং আরও দায়িত্বশীল। দায়িত্বশীল বলতে এখানে কর্তব্যপরায়ণতার কথা বলা হচ্ছে না, দায়িত্বশীল মানে এর ঘাড়ে কাজ আরও বেশি, কবিতার চেয়েও এ-পরিধি আরও বিস্তৃত। এর প্রকরণ ছাড়া কবিতার প্রায় যাবতীয় লক্ষ্মণ আত্মসাৎ করেও প্রাথমিক কথাসাহিত্যকে আরও অতিরিক্ত ভার বহন করতে হয়।”[i] সংখ্যালঘু সাহিত্যিকগণ এ ভার কতটুকু বহন করেছেন তা অনুসন্ধান অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশের জাতিগত সংখ্যালঘুরা দেশের অভ্যন্তরে কিছু বিশেষ অঞ্চলে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বসবাস করছে। এদের বৃহত্তর অংশ নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া সেসব অঞ্চলের বাইরে অবস্থানে আগ্রহী নয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষিত গুটিকয় মানুষ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এবং বিদেশেও অবস্থান করছে। বিশেষ অঞ্চলগুলোর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অন্যতম। এ অঞ্চলে এগারটি বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর বসবাস। বাংলা ভাষায় কথাসাহিত্য চর্চার অনুসন্ধানে এ অঞ্চলের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সাহিত্যিকরা প্রথমে আলোচনায় স্থান পাবেন। চাকমা, ত্রিপুরা, মারমা, ম্রো ও বম জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারমূলক আলোচনা এবং বিভিন্ন তথ্যসূত্র পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জানা যায় যে, আধুনিক সাহিত্যচর্চার বিভিন্ন শাখার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীদের বাংলায় রচিত কাব্য ও প্রবন্ধের অনেক বই পাওয়া গেলেও কথাসাহিত্যের প্রসার উল্লেখযোগ্য নয়। বাংলাদেশে বাঙালির পর বৃহত্তর নৃগোষ্ঠী হলো চাকমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে এ নৃগোষ্ঠী উনিশ শতক থেকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহার করছে বলে প্রতীয়মান হয়। এমনকি চাকমা রাজাদের ফরমান বাংলা ভাষায় প্রচার করা হতো।
এ অনুসন্ধানে সর্ব প্রথমে চাকমা নৃগোষ্ঠীর বাংলা ভাষায় রচিত কথাসাহিত্য হিসেবে ছোটগল্প সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা নৃগোষ্ঠীর কুমার কোকনদাক্ষ রায় প্রথম বাংলা ভাষায় ছোটগল্প লিখলেও তাঁর লেখনিতে সংখ্যালঘুর চিত্র প্রতিফলিত হয়নি।[ii] এ লেখক রবীন্দ্রপ্রভায় আলোকিত ছিলেন। তাঁর লেখা ছোটগল্পের নাম থেকেও তা অনুধাবন করা যায়; ‘সুদূরের পিয়াসী’, ‘যে নদী মরুপথে’, ‘আমার জীবন পাত্র উছলিয়া’, ইত্যাদি। কুমার কোকনদাক্ষ রায়ের ছোটগল্পগুলোকে তাই সংখ্যালঘুর সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা যুক্তিযুক্ত হবে না। এই অনুসন্ধানে ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ষাটের দশকে বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা এবং সলিল রায়ের গল্পে প্রথমবারের মতো নৃগোষ্ঠীর যাপিত জীবনের চিত্র পাওয়া যায়।
সংখ্যালঘুর কথাসাহিত্য, অর্থাৎ ছোটগল্প ও উপন্যাস পর্যালোচনার সময় ঘটনা, কাহিনি, চরিত্র চিত্রণ ও পারিপার্শ্বিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মূলস্রোতের কিছু রচনা ও রচয়িতাদের প্রসঙ্গ প্রাসঙ্গিকভাবেই তুলনায় আসবে। পার্বত্য অরণ্যের কোনো সাহিত্যিকের কি সন্ধান পাওয়া যাবে যিনি স্বজাতি, স্বভাষী ও সমকালীন সমস্যা নিয়ে দ্বিতীয় ভাষায় কোনো মহানায়কের চরিত্র সৃষ্টি করেছেন? কিংবা ঐতিহাসিক কোনো বিদ্রোহী বীরকে নিজ রাষ্ট্রে মূলস্রোতের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার উদ্যোগী হয়েছেন? অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয় যে প্রত্যাশিতভাবেই তাঁদের রচিত কথাসাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতার অস্বস্তি, কাপ্তাই বাঁধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নৃগোষ্ঠীদের ভূমিকা, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি অভিবাসন, আগ্রাসন, শান্তিবাহিনী, শান্তিচুক্তি এসব প্রসঙ্গ বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তবে কতটুকু শিল্পমানসম্মতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
একবিংশ শতাব্দীতেও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য সংকলনেই বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর রচিত ছোটগল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মধ্যে রয়েছে গৈরিকা, পার্বত্য বাণী, ঝরণা, গিরি নির্ঝর, বোধিভারতী, বিভিন্ন বিজু সংখ্যা, সংকলন ইত্যাদি। ছাপাখানায় আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রচলন, কম্পিউটারে লেখা কম্পোজ, ফেব্রুয়ারির বই মেলা, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, বাংলা একাডেমির বিভিন্ন প্রকল্প, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা – এসব অগ্রগতি চাকমাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর কথাসাহিত্যে কী অবদান রাখতে পেরেছে ? চাকমা নৃগোষ্ঠীর বিপম চাকমার দ্বিতীয় ভাষা বাংলায় গল্প সংকলন অজগর প্রকাশ করার ক্ষেত্রে উল্লেখ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ যে, তিউড়ি প্রকাশনের সত্ত্বাধিকারী মাইবম সাধন মণিপুরী নৃগোষ্ঠীর। একজন জাতিগত সংখ্যালঘু প্রকাশকের সহযোগিতায় অন্য জাতিগত সংখ্যালঘু লেখকের ছোটগল্পের বই প্রকাশে সুদীর্ঘ প্রায় নব্বই বছরের প্রতীক্ষার পালা শেষ হয়েছে।
*
“পৃথিবীর সমস্ত নির্যাতিত সংখ্যালঘু
যারা অজগর বেষ্টিত।”
— বিপম চাকমা, অজগর, উৎসর্গ পত্র
অজগর কি একটা প্রাণী? সাপের নাম? বিপম চাকমা পাহাড়ি জনপদের মানুষ। বন-জঙ্গল পরিবেষ্টিত স্থানের ভয়ানক প্রাণীর কথা কি বলেছেন ‘অজগর’ নামক গল্পে? নাকি কোনো পরাবাস্তবতার আশ্রয় নিয়েছেন? কিংবা গতানুগতিকভাবে একটা গল্পের শিরোনাম দিয়েই কি বইটির নামকরণ?
বইটির পাতা উল্টানোর আগপর্যন্ত পাঠকের মনে এমন ভাবনার উদয় হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বইটি খুলে উৎসর্গ পত্র পড়লেই সবরকম ভ্রান্তির অবসান ঘটবে। লাইন দুটি পড়লে পাঠকের কাছে এই ‘অজগর’ এর ব্যাখ্যা আর অস্পষ্ট থাকার কথা নয় এবং পার্বত্য অঞ্চলে সংখ্যালঘুর অবস্থা ও অবস্থান বোঝাও তার পক্ষে সহজতর হয়।
অজগর বইটির বিভিন্ন গল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য চিত্রায়িত হয়েছে এবং শোষণ, শাসন, নিপীড়ন ও নিগ্রহের বেদনা বর্ণিত হয়েছে। বইটির বিভিন্ন গল্পের ঘটনা এবং কাহিনির সঙ্গে একবিংশ শতকে বিভিন্ন সাহিত্যিকের চাকমা ভাষায় ও চাকমা নৃগোষ্ঠীর বাংলা ভাষায় রচিত কথাসাহিত্যের বেদনার সুরটি একই লয়ে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, ম্যানিলা চাকমা “চাকমা ছোটগল্প: বিষয় ও শিল্পরূপ” শিরোনামে তার স্নাতকোত্তর অভিসন্দর্ভে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রায় ৫০টির মতো ছোটগল্প সংগ্রহ করে তার মধ্যে বাছাই করা মোট ৩৪টি ছোটগল্প বিশ্লেষণ করেছেন। এর মধ্যে ছয়টি বাংলা ভাষায় ও অন্যান্যগুলো চাকমা ভাষায় রচিত। ম্যানিলা চাকমা তার অভিসন্দর্ভে পানছড়ি-খাগড়াছড়ি-মাটিরাঙ্গা গণহত্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন, “১৯৮৬ সালের ১ মে সংঘটিত হয় এ গণহত্যা। … এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশের চিত্রকে তুলে ধরে সাহিত্যিকরা ইটের পর ইট গেঁথে নির্মাণ করেছেন গল্প কবিতা প্রভৃতি।” এছাড়াও আদিবাসী চাকমা নৃগোষ্ঠীর ভূ-রাজনৈতিক পটভূমি অংশে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, “কোন কোন ছোটগল্পকারগণ ‘কাপ্তাই বাঁধ’ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া উদ্বাস্তু মানুষের চিত্র গল্পে তুলে ধরেছেন।”[iii] ম্যানিলা চাকমা তার বিশ্লেষণে নির্বাচিত গল্পগুলোতে তথাকথিত রোমান্টিকতার কোনো আমেজ পাননি; বরং পেয়েছেন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, আন্তঃধর্ম বিয়েতে দ্বন্দ্ব, আর্মিদের নির্যাতন, শান্তিবাহিনী দমন এবং পাহাড়ের মানুষের জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠার চিত্র।[iv]
‘অজগর’ নামক গল্পটির নামানুসারে বিপম চাকমার গল্পগ্রন্থটির নামকরণ। গল্পটির সারকাহিনি হলো- রঙ্গলালের বউ মিলাবী জুমে কাজ করার সময় এক অজগর সাপ তাকে গিলে ফেলে। সামরিক অফিসার মৃতদেহ সৎকার না করে ঐ অজগরের মাংস দিয়ে সামাজিক ভোজের আয়োজন করে। ভোজের সময় সকলের সামনেই প্রকাশ্যে মিলাবীর বিকৃত উলঙ্গ মৃতদেহ না ঢেকে রেখে দেয়। সামাজিক রীতি হলো প্রিয়জনের মৃত্যুর সাতদিনের মধ্যে মাছ-মাংস না-খাওয়া। কিন্তু অজগর সাপের খোলসের মতো পোশাক পরা কমান্ডার গ্রামবাসীকে মাংস খেতে বাধ্য করে। মিলাবীর স্বামী রঙ্গলালসহ গ্রামবাসী তা মানতে বাধ্য হয়। সাদাসিধে রঙ্গলাল পরে অজগর সাপের সঙ্গীটিকে বাগে পেয়ে বল্লম দিয়ে গেঁথে ফেলে। ঐ সঙ্গীটি অজগর সাপ না অজগর সাপের খোলসের মতো পোশাক পরা মানুষরূপী জন্তু ছিল এ প্রশ্নের উত্তর গল্পে অমীমাংসিতই থেকে যায়।
গল্পের শুরু “গোজেন”-এর ভয় দিয়ে। মাঠেঘাটে যে যেখানে আছে প্রত্যেকে গোজেনের কথা শুনে আতঙ্কে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। কে এবং কী এই গোজেন! এর সাথে পার্বত্য এলাকায় সামরিকবাহিনীর আগ্রাসনের ইতিহাস জড়িত। অজগর সাপের চেয়েও ভয়াবহ এই গোজেনরা। তাদের কৌশলী পরিচয় হলো অজগর সাপের খোলসের রঙের পোশাকধারী। শামসুর রাহমানের পঙ্ক্তিতে :
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা,[v]
বিপম চাকমা শুনালেন অজগরের খোলসের রঙের পোশাক। নিজ পরিবেশ থেকে নেয়া নতুন উপমা, নতুন পরিচয়, নতুন ধরনের অত্যাচার।
গোজেনের ভয়ে যে দৌড়াদৌড়ি তা ‘যেন সদ্য ডিম ফুটে চরতে বেরোনো মুরগির ঝাঁকে চিল পড়েছে। যে যেদিকে পারে প্রাণ নিয়ে পালাল।‘(অজগর, অজগর,পৃষ্ঠা নং ৬৯) এ চিলের দৌরাত্ম্য পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনব্যবস্থা নিয়ে ন্যূনতম খবরাখবর জানা মানুষ মাত্রই জানেন। আর সদ্য ডিম ফোটা মুরগির ঝাঁকে চিল পড়ার উদাহরণে চিল দুই অর্থেই লেখকের পাহাড়ি জীবনের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাপ্রসূত। একটা হলো আক্ষরিকভাবেই সদ্য ফোটা মুরগির বাচ্চার ওপর চিলের আক্রমণ। অন্যটি রূপকার্থে পাহাড়ি জীবনে অজগর সাপের খোলসের মতো রঙের পোশাকধারী বাহিনীর দৌরাত্ম্য। এদের দেখে নৃগোষ্ঠীদের আতঙ্কের জাজ্বল্যমান উদাহরণ হলো গ্রামের কার্বারী অরুনলাল। কার্বারী হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজতন্ত্র কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত পদ এবং এ পদধারী পার্বত্য পাড়ায় বা গ্রামে রাজার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন, যা সর্বজনবিদিত। কিন্তু এ কার্বারী ‘বৃদ্ধ বয়সেও গত রাতে ঊর্ধাঙ্গের কাপড় খুলে হাতপাখা নাড়তে নাড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কমান্ডার সাহেব উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে এ কথা শুনে তার মনে হল সূর্যটা হঠাৎ নপুংসক হয়ে পড়েছে, এখন বুঝিবা মাঘ মাস।’(অজগর, অজগর,পৃষ্ঠা নং ৭২) যেন এক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বিরাজমান! ভয়াবহ মানসিক অবস্থা! সূর্যকে নপুংসক মনে হওয়া যেন অরুনলালদেরই তেজহীন তাপহীন জড়বস্তুতে পরিণত হওয়ার সমতূল্য। এখানে লেখকের জীবনাভিজ্ঞাতারই প্রতিফলন ঘটেছে। গরম আবহাওয়ায় কার্বারী অরুনলালের মাঘের শীতের কাঁপুনি তো সামরিকবাহিনীর কাছে পার্বত্য এলাকার মর্যাদার অধঃস্তনতা।
লেফটেন্যান্ট জহিরের উপস্থিতি ও আদেশে সমাজের সংস্কার, সাংস্কৃতিক চর্চা, সামাজিক প্রথা ও আজন্ম লালিত ধর্মীয়রীতির বিসর্জন দিতে হলো। অজগরের পেট কেটে বের করা মৃত যুবতীর উলঙ্গ দেহ সামনে রেখে সেই রাক্ষস অজগরের মাংস খেতে গ্রামবাসী বাধ্য হলো। অজগরের পেট থেকে বের করা যুবতী নারীর দেহ লোকজনের শালীনতা বোধের উপর একটা সুড়সুড়ি দিতে শুরু করলেও কমান্ডার তা ঢাকতে দেয় না। কমান্ডারের নির্দেশ, ঢেকে দেয়া যাবে না। দেখুক মৃত্যু কত ভয়ংকর, কত বীভৎস। আর যারা কমান্ডারের আদেশ অমান্য করে তিনি তাদের এমন বীভৎস কিছুর সাথেই পরিচয় করিয়ে থাকেন।
অত্যাচার করার ও শাসনের মুঠোয় আনার কী অভিনব কৌশল প্রয়োগ! কমান্ডার ঐ সমাজের সামাজিক রীতি ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস উপেক্ষা করে অজগর সাপের মাংস দিয়েই ভোজের আয়োজন করে। অজগরের মাংস খাওয়া ঐ নৃগোষ্ঠির কাছে আকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু তা সামাজিক রীতি ও চর্চাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। এমন পরিস্থিতিতে কেউই দুয়েক গ্রাসের বেশি খেতে পারে না। মৃত নারীর স্বামী রঙ্গলাল কিছুই খেতে রাজি না হলে দুজন সেপাই দিয়ে জোর করে মুখ ফাঁক করে মুখে খাবার ঠেসে ধরে। এটি ঐ সমাজের ও নৃগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক বিশ্বাসকে ধ্বংস করার সচেতন কৌশল। কমান্ডার জহির নিজের খেয়ালখুশি মতো খেলে। সে খেলার এক নিষ্ঠুর উদাহরণই এ গল্পে রূপায়িত। এ গল্পের কমান্ডারদের চরিত্রের ‘কমান্ডারের সাথে তর্ক করার অর্থ নিজের বিপদের গর্তকে প্রশস্ত করা।’(অজগর, অজগর,পৃষ্ঠা নং ৭১) বিপদের গর্ত শব্দদ্বয়ে লেখকের অলংকার ব্যবহারের প্রয়োগ দেখা যায়।
মৃতকে সৎকার না করে, তার উলঙ্গ দেহ সামনে রেখে রাক্ষসী অজগর সাপের মাংস দিয়ে ভোজের আয়োজন একদিকে কমান্ডার জহিরের নগ্ন ও উৎকট ক্ষমতা জাহির। অন্যদিকে ঐ জনগোষ্ঠীর মানবিকতাকে নিয়ে পরিহাস করা। একটা নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে বিনাশ করার পরিকল্পনা নিয়েই ক্ষমতাবানদের এ আচরণ। ঐ নৃগোষ্ঠীর সংস্কারও ভয়ের কাছে পরাজিত। অজগরের চামড়ার সংগ্রহ করলো কমান্ডার সাহেব। এমন বহু দুর্লভ বস্তু ও বর্বর অভিজ্ঞতা অর্জন পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য, অভ্যাস, সামাজিক রীতিনীতিও চর্চাকে অবজ্ঞা করে। পদদলিত করে। অজগরের গিলে খাওয়া নারীর স্বামী রঙ্গলালের চরিত্র নিয়ে প্রথম লাইনেই লেখক বলেছেন- ‘এ বয়স পর্যন্ত পারিপার্শ্বিক জ্ঞানহারা।’(অজগর, অজগর,পৃষ্ঠা নং ৬৯) এবং এক সময় ‘কেবল রঙ্গলাল সাপটার মতই চুপচাপ এবং তার বেশি নিরীহ ও নির্বিষ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।’(অজগর, অজগর,পৃষ্ঠা নং ৭১) রঙ্গলাল ঘটনার প্রভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না। ‘এরপর থেকে রঙ্গলাল চোখের দৃষ্টিকে দিগন্ত দিয়ে পৃথিবীর বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে প্রাণপূর্ণ পৃথিবীতে আলাদা এক পাথর হয়ে গেল।’(অজগর, অজগর,পৃষ্ঠা নং ৭৩) কিন্তু এ পাথর প্রতিশোধ নেয়। অজগর রূপী – অজগরের মতো পোশাক পরিহিতরা বার বার ফিরে আসে। সঙ্গীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ফিরে আসে মৃত অজগরের জোড়াটা। তবে রঙ্গলাল এবার আর ভুল করে না। অজগরের জোড়া “সাপ” শব্দটিকে গল্পকার উদ্ধরণ চিহ্নের ভিতরে রেখে চমৎকার দ্যোতনার সৃষ্টি করেছেন।
রঙ্গলাল হরিণ-শুয়োর শিকারের বল্লম দিয়ে স্ত্রী মিলাবীকে গিলে ফেলা অজগরের সঙ্গীকে ভূপতিত করে। অজগরের চামড়ার মতো পোশাক পরিহিত জন্তুটি মানুষের মতো বিকট চিৎকার দেয়। মানে মানুষের মতো, মানুষ নয়। ‘রাতের নিস্তব্ধতাকে হতচকিত করে দিয়ে অজগরটা মানুষের মত এক আঁধার চেরা বিকট মরণ-চিৎকার দিয়ে ভূপতিত হল।’(অজগর, অজগর,পৃষ্ঠা নং ৭৩) গল্পের শেষ লাইনটি রূপকের ব্যবহারে সমৃদ্ধ এবং রঙ্গলালের চরিত্রের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি (Twist ending) পড়ে পাঠককে চমকে উঠে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।
বিপম চাকমার কৌশলী বুননে ঘটনা পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে এক স্বাভাবিক গতিতে। যা হবার তা-ই যেন হয়েছে। নিপীড়িত রঙ্গলালরা প্রতিশোধ নিতে জানে। নিজের বউকে হারিয়েছে। বিকৃত মৃতদেহকে উলঙ্গ অবস্থায় সামনে রেখে, সংস্কারকে বিসর্জন দিয়ে রাক্ষস অজগরের মাংস খেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র বল্লমের সুদক্ষ প্রয়োগ করেছে। বউ হারিয়ে বিভিন্ন ঘটনার আকস্মিকতায় শূন্যদৃষ্টির রঙ্গলালের দৃষ্টি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। আসলে কি প্রতিশোধ নিতে পেরেছে? নাকি বাস্তবে না পারার আকাঙ্ক্ষা গল্পে মিটিয়েছে? এখানে লেখক পরাবাস্তবতার আশ্রয় নিয়েছেন।
এক অজগর তার সঙ্গীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এসে শিকার হয়েছে। কিন্তু তার গোষ্ঠীগত অন্যান্য অজগররা যে আবার আসবে, বার বার আসবে। যুগে যুগে আসছেও রঙ্গলালদের নির্মূল করতে, তাদের সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি, বিশ্বাস ও আচারকে ধ্বংস করতে। লেখকরা সে আসা ঠেকাতে পারেন না। কিন্তু লেখায় পরাবাস্তবতার আশ্রয়ে প্রতিশোধ নিতে পারেন। এমনটি হতে পারে বলে পথ দেখাতে পারেন।
জুম চাষে অজগর সাপের আক্রমণের ঘটনা পাহাড়ি জীবনে নৈমিত্তিক বলা না গেলেও অস্বাভাবিক নয়। বন-জঙ্গলে বন্য প্রাণীর সাথে যুদ্ধ করেই যাপন করতে হয় প্রাত্যহিক জীবন। গল্পকার এ প্রাত্যহিকতায় নিপুণভাবে সংযোগ করেছেন রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের প্রহসনের ইতিহাস। বিপম চাকমার লেখায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষায়িত বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে। যেমন- ‘জুমে ঘুরে ঘুরে মিলাবী শসা, ভুট্টা, মারফা ইত্যাদি ফসল তুলছিল আর সে টং-ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল।’ (অজগর, অজগর,পৃষ্ঠা নং ৭০) মারফার হলো শসার মতো এক প্রকার সবজি যা পাহাড়েই হয়। বাঁশের হুঁকোর ব্যবহারও পার্বত্য চট্টগ্রামেই দেখা যায়। সাতদিন্যার শ্রাদ্ধ অর্থাৎ সাতদিনে শ্রাদ্ধ করা ঐ নৃগোষ্ঠীর একটি সামাজিক রীতি।
‘অজগর’ গল্পে লেখকের মাতৃভাষার শব্দগুচ্ছের ব্যবহারে বাংলা ভাষায় যুক্ত হয়েছে গোজেন, কাল্লোং ও খবং শব্দত্রয়। ‘অনেকক্ষণ পর মিলাবীকে ডেকেও কোন সাড়া না পেয়ে খুঁজতে গিয়ে দেখে একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে কাল্লোং (টুকরি) ও মাথায় দেয়া কাপড় ‘খবং’।’ (অজগর, অজগর,পৃষ্ঠা নং ৭০) কাল্লোং শব্দ প্রয়োগে বন্ধনিতে টুকরি, কিন্তু খবং-এর বেলায় যেন লেখক বিচ্যুত। খবং এ কেন উদ্ধরণ কমা? বন্ধনিতে মাথায় দেয়া কাপড় লেখা যেত। তবে গোজেন শব্দের মতো কোনো বন্ধনি বা উদ্ধরণ কমা না দিয়ে শুধু কাল্লোং ও খবং শব্দের প্রয়োগই যথাযথ হতো। টীকা যোগ করা যেত। গোজেন, কাল্লোং, খবং শব্দগুলো চাকমা ভাষা থেকে সংযুক্ত হলো বাংলা ভাষায়।
‘অজগর’ গল্পটি পড়েই বিপম চাকমার লেখনির ধার পরখ করা যায়। দ্বিতীয় ভাষায় ছোটগল্প লিখতে গিয়ে তিনি কখনও বাংলা শব্দের অভাব অনুভব করেছেন বলে মনে হয়নি। ঘটনা উপস্থাপনে ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। তিনি সার্থকভাবে বাংলাদেশের জাতিগত সংখ্যালঘুর আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গল্পটিতে অঙ্কন করতে সমর্থ হয়েছেন।
অজগর বইয়ের দশম গল্প ‘অজগর’। দশম গল্পটি দিয়ে সাহিত্য পর্যালোচনা শুরু করা হয়েছে এবং পরবর্তী পর্বে গল্পের সূচি ধরে ক্রমানুসারে আলোচনা করা হবে।
(চলবে)
[i] আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, “উপন্যাস ও সমাজবাস্তবতা,” সংস্কৃতির ভাঙা সেতু (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৩)
[ii] নন্দলাল শর্মা, আকাশে হেলান দিয়ে (রাঙামাটি: রাঙামাটি প্রকাশনী, ২০০৩)। তবে নন্দলাল শর্মা এক্ষেত্রে ‘উপজাতীয় জনজীবন’ শব্দদ্বয়ের প্রয়োগ করেছেন।
[iii] চাকমা ছোটগল্প : বিষয় ও শিল্পরূপ/ ম্যানিলা চাকমা/বাংলা ভাষা ও সাহিত্য/ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়/২০১৯
[iv] ম্যানিলা চাকমা, সাক্ষাৎকার, জানুয়ারি ২০২১
[v] শামসুর রাহমান, বন্দীশিবির থেকে, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’, (১৯৭২)
পড়ুন ।। কিস্তি ১