বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে সহজিয়ায় কিছু মূল্যায়নধর্মী ও রূপরেখামূলক লেখা প্রকাশ করা হবে। আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের ৫০ বছরের অর্জনের ইতিহাসকে চিহ্নিত করা। আজ ছাপা হলো বাংলাদেশের থিয়েটার বিষয়ক একটি লেখা। লিখেছেন মনিরুল ইসলাম রুবেল।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে বিশেষ করে মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে খুব উল্লেখ্যোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। রাজনীতি-সমাজ সচেতনতা, যুদ্ধ-পরবর্তী দেশের নানান সংকট, সামাজিক অস্থিরতা-সংকট-হতাশা, নতুন সমাজ তৈরির আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি বিষয় তখনকার নাটক ও থিয়েটার চর্চায় প্রাধান্য পেতে লাগলো। অধিকাংশ নাটকের দল প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বা সমাজ-চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তাদের নাট্যচর্চাকে জারি রাখার ঘোষণা দিল।
এই সময়ে বিভিন্ন নাট্যকারগণ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বপ্ন-হতাশাকে অবলম্বন করে বেশ কিছু নাটক রচনা করেন এবং এসব নাটক সারাদেশের নাট্যদল মঞ্চস্থ করে। এছাড়াও সামাজিক অস্থিরতা-শ্রেণিবৈষম্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ নতুন সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে রচিহত হয়েছে আরো অনেক নাটক। আবদুল্লাহ আল মামুনের শপথ, এখনও ক্রীতদাস; মামুনুর রশীদের ওরা কদম আলী, ওরা আছে বলেই; সেলিম আল দীনের বাসন, কীত্তনখোলা; আবদুল্লাহেল মাহমুদের সাত পুরুষের ঋণ, এস এস সোলায়মানের এই দেশে এই বেশে, সৈয়দ শামসুল হকের যুদ্ধ এবং যুদ্ধ ইত্যাদি এ ধারার উল্লেখযোগ্য নাটক।
আর এসবরে পাশাপাশি আগের ধারাবাহিকতায় পুরাণ ও ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়েও নাট্ক রচনা ও প্রযোজনা তৈরির চর্চা অব্যাহত থাকে। যেমন, মমতাজউদদীন আহমেদের স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা, সেলিম আল দীনের শকুন্তলা, সৈয়দ শামসুল হকের নুরলদীনের সারাজীবন, আবদুল্লাহেল মাহমুদের নানকার পালা, সাঈদ আহমদের শেষ নবাব, মামুনুর রশীদে লেবেদেফ ইত্যাদি।
বাংলাদেশের প্রথম সারির নাটকের দল ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাটকের চর্চা শুরু করে। মৌলিক নাটক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত নাটকের পাশাপাশি তারা পৃথিবীর নানা ভাষার বিখ্যাত সব নাট্যকারদের নাটককে আশ্রয় করে তাদের থিয়েটার চর্চা চালিয়ে যেতে থাকে। আরেকটি জনপ্রিয় দল ‘আরণ্যক’ রাজনীতি সচতেন মৌলিক নাটকের চর্চায় স্বতন্ত্র অবস্থান নিশ্চিত করে। এছাড়া শক্তিশালী দল ‘থিয়েটার’ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উপজীব্য করে সমাজের নানা অসঙ্গতি-বৈষম্য-স্বপ্ন বিনির্মাণের সংকট ইত্যাদিকে প্রধান করে তাদের নাট্য রচনা ও প্রযোজনা নির্মাণে সচেষ্ট থাকলেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো : কেন? তবে কি মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের শপথ থিয়েটারের চর্চায় অব্যাহত ছিল সেসব পূরণ হয়ে গেছে? যে ক্রোধ-হতাশা প্রকাশ পেত সেসব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে? মুক্ত হয়েছে সকল সামাজিক-রাজনৈতিক দায় থেকে? নিশ্চয়ই তা নয়! তবে?
অন্যদিকে আরেক মহীরুহ দল ‘ঢাকা থিয়েটার’ প্রাচ্যদর্শনের সন্ধানে, দেশজ ধারায় নিজস্ব নাট্য-আঙ্গিক অবলম্বন করে আরেক স্বতন্ত্র ধারার সূচনা করলেন। এই প্রধানতম দলগুলির পাশাপাশি ঢাকা ও ঢাকার বাইরের আরো অনেক দলই স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের থিয়েটারকে বহুবর্ণিল ধারায় এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন।
পরবর্তী কালে তারই ধারাবাহিকতায় আরো বিকশিত রূপ দেখা গেল — যখন আশির দশকে এদেশে সামরিক শাসন জারি হয়, যখন স্বৈরাচারী শাসক এদেশের সাধারণ মানুষের বুকে শোষণের ধাবা মেলে ধরে, সেই সময়। এদেশের থিয়েটার অঙ্গন সবচেয়ে বেশি ঔজ্জ্বল্য নিয়ে হাজির হতে থাকে সেই সময়। প্রায় প্রতিটি দল প্রায় প্রতিদিনই প্রসেনিয়ামে ও হাটে-মাঠে প্রতিবাদের নানা ভাষায় তাদের নাটক নিয়ে হাজির হতে থাকে। সেই সময় ছোট-বড়, বিখ্যাত-অখ্যাত সব নাট্যকারই তাদের নাটকে নানাভাবে শাসকের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। দলগুলো নাট্যচর্চায় শোষণের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন। সামরিক স্বৈরাচারী শোষকের পতনে এদেশের থিয়েটারের এই অবদান আজও ইতিহাসের এক আলোকিত অধ্যায়।
সেটা ছিল নব্বইয়ের দশক! তারপর এদেশের রাজনৈতিক ক্যানভাসে হয়েছে নানান পট পরিবর্তন — সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসকদের পতন হয়েছে, গণতন্ত্রী দলগুলো শাসনভার পেয়েছে বার কয়েক! ধীরে ধীরে রাজনীতি ও সমাজ জীবনে অনেক বাঁকবদল অর রূপবদল হয়েছে। তারই পাশাপাশি বদল হয়েছে থিয়েটার চর্চার চেহারাটাও। উজ্জ্বল স্রোত থেকে প্রায় ক্ষয়িষ্ণু এক ধারায় পরিণত হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো : কেন? তবে কি মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের শপথ থিয়েটারের চর্চায় অব্যাহত ছিল সেসব পূরণ হয়ে গেছে? যে ক্রোধ-হতাশা প্রকাশ পেত সেসব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে? মুক্ত হয়েছে সকল সামাজিক-রাজনৈতিক দায় থেকে? নিশ্চয়ই তা নয়! তবে? এখনও তো অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদ্যমান এই সমাজে! এখনও তো মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি! এখনও তো এই দেশের শাসক দল নিশ্চিত করতে পারেনি সাধারণ মানুষের অধিকারসমূহ! তবে কেন স্তব্ধ হয়ে গেছে এ দেশের থিয়েটারের প্রতিবাদী শক্তি? রাজনৈতিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা, সাধারণ মানুষের অধিকার হরণের প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে থিয়েটারকে শক্তিকে ব্যবহারের চর্চা কেন আজ থিয়েটারে অনুপস্থিত? কেন থিয়েটার নামের দর্পণে ‘সমাজ’ এর চেহারা অস্পষ্ট?
আজকের সময়ে থিয়েটারের চর্চাকে আরো বেশি বেগবান করতে, আরো বেশি দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে এই প্রশ্নের অনুধাবন ও সামাধান খোঁজার প্রয়াস নেয়া জরুরি মনে করি। আরো সব জরুরি আলাপও এর মাধ্যমে সূচিত হতে পারে।