সহজিয়ায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সালাউদ্দিন শুভ্রর উপন্যাস অন্যমনস্ক দিনগুলির কয়েক কিস্তি। ২০২১ সালের বই মেলায় উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। শুভ্র লিখেছেন বই হয়ে ওঠার গল্প।
আমার ষষ্ঠ বই, তৃতীয় উপন্যাস অন্যমনস্ক দিনগুলি। উপন্যাসটা লেখার শুরুর সঙ্গে হালকা হলুদ রঙের একটা ডায়রির যোগাযোগ আছে। বাসায় কী যেন গোছাতে গিয়ে ডায়রিটা পেয়েছিলাম অনেক আগে। আমাদের বাসায় সবসময় ডায়রি আসত বাবা ব্যাংকে চাকরি করার সূত্রে। আমিও ভাবতাম যে ডায়রি লেখব। কিন্তু কখনো লেখা হতো না। হাতের লেখা খারাপ বলে লেখতাম না। ওই ডায়রিটা পাওয়ার পর ভাবলাম লেখব। আমাদের সন্তান গহন হওয়ার দিনগুলো, ওর নাম দেওয়া, তারপর ধীর ধীরে তার বেড়ে ওঠা- এটা নিয়ে লেখব ভাবলাম। নিজের হাতের লেখার একটা স্মারক থাকুক-এমনটাই ভাবনা ছিল। যদিও লেখা আর হয়ে উঠছিল না।
আমার জন্য লেখালেখি খুব টাফ। কিছুতে সময় কার যায় না। এর মধ্যেই করোনার লকডাউন শুরু হয়ে গেল। ডায়রির কথাও ভুলে গেলাম ততদিনে। এই মহামারীর সময়টার সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে কিছুদিন গেল। তখন মনে হলো মহামারি নিয়ে লেখি। কত মহামারির কথা শুনেছি। একজন লেখক হিসেবে সেই সময়টাকে ধরে না রাখলে কেমন হয়! এই ভাবনা থেকে লেখার শুরু। তারপর কীভাবে কীভাবে যেন লেখায় ডায়রি ঢুকে গেল। উপন্যাসটা ল্যাপটপে লেখতে শুরু করলেও মাঝপথে একটু সমস্যা হলো। ল্যাপটপ বাদ দিয়ে হালকা হলুদ সেই ডায়রিতেই লেখতে হলো কয়েকটা অধ্যায়। পরে সেই লেখা একজনকে দিয়ে কম্পোজ করালাম। ডায়রিতে লেখার জন্য কলম খুঁজে পাচ্ছিলাম না বাসায় গভীর রাতে। খুঁজতে খুঁজতে কোথায় যেন বিয়ের সময়ে গিফট দেওয়া কলম পেলাম। বিয়ে হয়েছে তাও আট-নয় বছর। বিয়েতে কেউ কাউকে কলম গিফট করে বলে দেখি নাই।
আমার তখন প্রথম বইটা বের হয়েছে মানবসঙ্গবিরল। গল্পের বই। সেই হিসাবে আমাকে লেখক হিসাবে কেউ ভাববে তা মনেই হয় নাই। কিন্তু আমাকে কে যেন অনেকগুলো কলম দিয়েছিল বিয়ের গিফট হিসাবে। নিশ্চয় সে আমাকে লেখক হিসেবে ট্রিট করেছিল। কে দিয়েছিল আমি জানি না। চায়নিজ কলম। লেখা ভালো। দীর্ঘ কয়েক বছরে আমার উপন্যাস লেখার জন্য বিয়ের সময়ের উপহার পাওয়া সেই কলম খুঁজে পাব-এর চেয়ে লেখার স্বার্থকতা কী থাকতে পারে! আমার উপন্যাসেও বিয়েতে গিফট পাওয়া একটা ডায়রির ঘটনা আছে।
অন্যমনস্ক দিনগুলি লেখতে গিয়ে আমি দুটো বিষয় খেয়াল করেছি এবার। এর একটা হলো উপন্যাস লেখার নিজস্ব একটা পদ্ধতি থাকে সব লেখকের। বিশ্বের বা বাংলা ভাষার অনেক বড় বড় লেখকের বেলায়ও এমনটা দেখা যায়। আমার বেলায় আমি দেখেছি প্রথমে একটা ড্রাফট দাঁড় করাতে হয়। এটা ঠিক কাঠামো না, প্রথমে পুরো কাহিনীর শুরু থেকে শেষটা আমাকে লেখতে হয়। এরপর সেটা এডিট করতে হয়। প্রথমবার এডিট শেষে আগের দুই উপন্যাসে আমি দেখেছি যে কাগজে আরেকবার পড়লেই নিজের ভেতর সন্তুষ্টি আসে। এবার তা এল না। এবার কাগজেও একবার দেখার পর আরো প্রায় দু’বার আমাকে দেখতে হয়েছে স্ক্রিনে। তারপর মোটামুটি একটা সন্তুষ্টি এল। ফলে আমি বুঝে গেলাম আমাকে এডিট অংশে বেশি সময় দিতে হবে।
এবারের উপন্যাসটায় আমার মনে হয়েছে পাঠক অন্যরকম এক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পাবেন। তারা যেখান থেকে শুরু করবেন সেখান থেকে ঘটনা একের পর এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট হাজির করবে।
এবার উপন্যাস লেখতে গিয়ে আমি ফিওদর দস্তয়েভস্কি থেকে শুরু করে ফ্রডরিক নিৎশে পর্যন্ত পড়েছি। মাঝখানে অমিয়ভূষণ মজুমদার, কমলকুমার মজুমদার পড়েছি। সাধারণত আমি উপন্যাস লেখার সময় জীবনানন্দ দাশ বা কমলকুমার পড়ে থাকি। কমলকুমারের উপন্যাসের কাব্য বা গভীরতা আমার ভালোলাগে নিজে লেখালেখির সময়টাই। আমি এর দ্বারা প্রভাবিত হতে চাই বা সেখান থেকে কিছু নিতে চাই তা না। বরং চিন্তা যেন ডাইভার্ট না হয় সে জন্য এগুলো পড়ি। পুরো বই-ই যে পড়ি তা না। উল্টে-পাল্টে দেখতে থাকি অবসরে। এবার যেটা হয়েছে, এই পড়াপড়িটা বেড়েছে। লেখতে লেখতে মনে হয়েছে, দেখি তো একটু তলস্তয় পড়ে… এমন।
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটা মনে হলো, একটা উপন্যাস শেষ না করলে আরেকটা উপন্যাসের দিকে যাওয়া যায় না। তখন অলিখিত উপন্যাস গুতাতে থাকে, আমাকে লেখ, আমাকে লেখ-এমন করতে থাকে। সে লেখতে থাকা উপন্যাসের ভেতর ঢুকে যায়। এই অবস্থায় লেখককে পড়ে যেতে হয় অনেকটা ক্যাওয়াজের মধ্যে। টালমাটাল নৌকার মতো তখন হাল ধরে রাখার একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়। একটা উপন্যাস লেখার পর লেখকের একটা ধাপ অতিক্রম হয়। আগের উপন্যাস না লেখলে তিনি পরের উপন্যাসে যেতে পারেন না। নিজেকে আরো বিস্তৃত ও গভীর পরিসরে নিয়ে যেতে পারেন না।
এবারের উপন্যাসটায় আমার মনে হয়েছে পাঠক অন্যরকম এক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পাবেন। তারা যেখান থেকে শুরু করবেন সেখান থেকে ঘটনা একের পর এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট হাজির করবে। এর বেশি কিছু আর উপন্যাস নিয়ে বলব না।
উপন্যাসটার প্রকাশক হাওয়ালাদার। স্টল নম্বর ৫৭০ (ক, খ, গ)। এ ছাড়া রকমারিতে পাওয়া যাবে। বইটার প্রচ্ছদ করেছেন আনিসুজ্জামান সোহেল। আর সহজিয়া সম্পাদক সুমন সাজ্জাদ ভাই এ উপন্যাস লেখার পেছনে অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করেছেন। তাকে ধন্যবাদ। তার কারণে লেখার একটা তাড়া ছিল।
পড়ুন । ১ম কিস্তি