বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।
১৮
সবাইকে বলে-কয়ে বেরোলাম বাসা থেকে। মাকে নিয়ে এক ঝামেলা। তাকে আসলে জানানোই উচিত হয়নি। সবকিছুতেই এমন সিরিয়াস! মেজাজ খারাপ হয়। পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়ে রেজাল্ট পজিটিভ হলেই কেবল তাকে বলা উচিত ছিল। বিরক্তিকর ব্যাপার। এমডি স্যার বলেছিলো, ভাইভাতে আমি খুব নার্ভাস থাকি। অর্থাৎ, নার্ভাস হওয়া যাবে না। রিকশা থেকে নেমেই ফোন করবো বিভাসকে। আপাতত এই কাজটাই বাকি আছে। হলেই প্রিপারেশন কমপ্লিট।
কড়কড়া রোদ ওঠেছে। ব্যাগে ছাতা এনেছি। এনেছি রোদের জন্য নয়। হুটহাট বৃষ্টিও হচ্ছে কিছুদিন যাবৎ। বাসা থেকে রিকশায় যেতে পনের-বিশ মিনিটের দূরত্ব। নয়টা পনেরোতেই বেরিয়েছি। ভাইভা দশটায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ভাইভা ঠিক টাইমে শুরু হয় না। তবু আগে যাওয়া ভালো। মা’র একটা শাড়ি পরেছি। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম এটা পরবো। উপলক্ষ ছাড়া শাড়ি সচরাচর পরা হয় না। শাড়ি পরেছি বলেই রিকশা নিলাম। নয়তো হেঁটেই যেতাম। হেঁটে গেলে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে যাওয়া যায়।
অন্যান্য দিন এই সময়ে অফিসে ঢুকতাম। দেখতাম বিভাস আর শান্তা আপু বসে গল্প করছে। জেসমিন দি’কেও পাওয়া যায়। ইমরান তো বিভাসের কথার বাঁধা কাস্টমার হয়ে গেছে। বিভাসকে সে ছাড়ছেই না। অথবা বিভাসই চাচ্ছে ইমরানকে। শান্তা আপুর সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেছে বিভাসের। সেই সঙ্গে ইমরানেরও। এতে অবশ্য আমি খুশি। শান্তা আপুর জন্য এই সময়ে বিভাসের সঙ্গটা জরুরি।
বিভাসের কাছ থেকে জালালুদ্দিন রুমির বইটা নিয়েছি। কী মনে করে একদিন চাইলাম। জেসমিন দি’র কাছে ছিলো বইটা। তার কাছ থেকে আমি নিয়েছি। বিভাসের মুখে শুনে মনে হলো, না-জানি কী! খুবই সাদামাটা সব কথা। আহামরি কিছুই পেলাম না। ভালোও লাগলো না। পড়েই ছিলো, খুব একটা পড়াও হয়নি। ভাইভার প্রিপারেশন হিসেবে রুমির বইটাও একটু নেড়েচেড়ে দেখলাম। যদি কাজে লাগে।
ছুটি নিয়েছি আজ। এমডি স্যারকে বলেছি, জরুরি একটা কাজ পড়েছে বাসায়। স্যার ভেবেছেন, নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে পাত্রপক্ষ বাড়ি আসবে। তার কথাবার্তায় এই ধরনের একটা সুগন্ধ ছিলো। এমডি স্যারের জন্য আমার মায়া হয়। তাকে খুব আপন লাগে। বাবার মত লাগে। উনি তো আমার বাবার বয়সীই। আমার বয়সী উনার একটা মেয়েও আছে।
: বিভাস? অফিসে? এই শোনো, এই যে আমি স্কুলের গেটে নামলাম। তুমি শুভকামনা রাইখো, প্লিজ। তুমি শুভকামনা রাখলেই হবে।
: হ্যাঁ, অফিসে। যা বলি, আগে মন দিয়ে শোনো। প্রথম কথা হলো, শুভকামনা বলে আলাদা কোনো কামনা নেই। যারা পরীক্ষা দিতে এসেছে তারা সবাই কারো না কারো শুভকামনা নিয়েই এসেছে। দ্বিতীয় কথা হলো, চাকরিটা যদি পেতে চাও, নিজের বেটারটা দাও। তিন নম্বর কথা হলো, তুমি যা না তা হওয়ার ভান কোরো না। যাও।
: একটু টেনশন অবশ্য লাগছে। বিশেষ করে মা খুব সিরিয়াস হয়ে ওঠেছে। তার কথা হলো বাসার কাছে।
: আমার মনে হচ্ছে, তোমার হবে। তোমার বাসা যে উত্তরায় এখানে এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। এছাড়া ঢাবির স্টুডেন্ট। নেবেও বেশ কয়েকজন। সুতরাং আশা করতে পারো।
ভেতরে ভেতরে কেমন অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো। মনে হলো আগেই চলে এসেছি। একজন মহিলাকে বেশি ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আজকে যে ভাইভা হবে সেটা কোথায়?’ পিয়ন গোছের কেউ একজন হবে। পোশাক-আশাকে তাই মনে হল। মহিলাটি আমাকে দেখিয়ে দিল কোনদিকে যেতে হবে। খুবই পরিচ্ছন্ন সবকিছু। গোছানো। অভিজাত একটা ভাব সহজেই চোখে পড়ে। গিয়ে দেখি একটা রুমে আমার মত আরও অনেকেই বসে আছে। সেখান থেকে অ্যাপ্লিকেন্টদের ডেকে নেওয়া হবে। অ্যাপ্লিকেন্টদেরই একজন হাজিরা শিটে আমাকে স্বাক্ষর করতে বললো। স্বাক্ষর করলাম। সৌজন্য খাতিরে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, সে কোন ইউনিভার্সিটির? বললো, জাহাঙ্গীরনগর। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, আমি কোন ইউনিভার্সিটির? বললাম, ঢাবি। ঢাবির কথা শুনে পাশ থেকে এক ছেলে জানতে চায়, আমি কোন সেশনের? সে-ও ঢাবির, দশ-এগারো সেশন, বাংলা বিভাগ। গড়গড় করে নিজেই নিজের পরিচয় দিলো। হুজুর টাইপ। পাঞ্জাবি-পায়জামা, হালকা দাঁড়ি। সত্যি বলতে কি, কারো সঙ্গেই আমার, তখন কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো না।
চমৎকার একটা পেইন্টিং ঝুলছে দেয়ালে। রাজ-রাজরাদের দরবারের ছবি। বিশাল সাইজের। বিশালত্বের কারণেই কিনা, চমৎকার মানিয়েছে দেয়ালে। ফুলদানিটাও অসাধারণ। সবকিছুর মধ্যেই কেমন একটা প্রভাববিস্তারকারী ভাব। এরকম একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার মধ্যে সত্যিই একটা বিশেষত্ব আছে। কাউকে অন্তত বলা যাবে যে, অমুক প্রতিষ্ঠানে আছি। গাইড বই কোম্পানির কথা কাউকে আসলে বলা যায় না। বলতে হয়, একট প্রাইভেট জবে আছি।
ভেবেছিলাম ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই হয়ে যাবে সব। পনেরো থেকে ষোল জনের মত উপস্থিত। ভাইভার জন্য ডাকেওনি সবাইকে। অথবা আসেনি। অ্যাপ্লিকেন্টদের কেউ একজন আলাপ করছিলো, তার এক পরিচিত আপা এখানে চাকরি করে। জয়েনিং-এই নাকি ফোর্টির কাছাকাছি স্যালারি আসে। বললো, মেয়েদের প্রায়োরিটি দেয়। রেশিও সিক্সটি-ফোর্টি। শুনলাম আজকেই রেজাল্ট দিয়ে দিবে। তারপর ডেমো ক্লাসের জন্য ডাকবে আরেকদিন। কেউ একজন বলতেছে, ডেমো ক্লাস নেয় না। ভাইভাতেই নাকি গান-আবৃত্তি এসব যাচাই করে নেয়।
কেমন ভালো লাগছিলো না। এসিতে শীত লাগছিলো আমার। হালকা বমি বমি লাগছিলো। সকালে তাড়াহুড়া করে খেয়েছি। ঠিক হয়নি। বিভাসের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ভরসা পাচ্ছি না। কবে জানি ও বলতেছিলো, ভবিষ্যতের কাছে পৌঁছতে হয় নিজেকেই। পৌঁছালেই কেবল অর্থপূর্ণ হয় ভবিষ্যৎ, নতুবা নয়। বিভাস বললো, তার মনে হচ্ছে, চাকরিটা আমার হবে। তারপরও আমার টেনশন কমছে না। এর মানে কী? এর মানে হলো, বিভাসের কথাই ঠিক। ভবিষ্যতে পৌঁছতে হয় নিজেকেই।
ভাইভা শুরু হয়ে গেছে। ঠিক টাইমেই শুরু হলো। একেকজনকে অনেকক্ষণ ধরে রাখছে। চোখ-মুখ কালো করে হতাশ হয়ে বেরোচ্ছিলো সবাই। কেউ বলে, তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, নাচ জানেন? কাউকে আবৃত্তি করতে বলেছে। পারেনি। আমিও কোনোটাই পারি না। ভেতরটা একদম ফাঁকা হয়ে গেলো আমার। ভেতর থেকে হারমোনিয়ামের শব্দ আসছে। বমি বমি ভাবটা প্রবল হচ্ছে আমার। এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের উপায় একমাত্র বিভাস। আর দুইজনের পরেই আমি। ফোন করারও উপায় নেই। সোফা থেকে ওঠা মোটেই উচিত হবে না। বিভাসকে এসএমএস করলাম :
Khub tension lagce, Bibhash. Bomi bomi lagce. Kicchu valo lagce na. R 2 joner porei ami. Mone hocce porikkha na dei. Tumi ki bolo? Tumi ja bolbe tai.
বিভাস তার জবাব লিখে পাঠালো :
Jodi mone hoy porikkha debe na, very good, diyo na. Majhe majhe nijer icchake gurutto dite hoy. Jodi voy peye thako, porikkha theke palate chao, tahole take tomar face kora uchit. Jake Voy pao tar theke palate nei. Palano jay o na. Viva dite esheco, cinema to dekhte ashoni. Eto valo lagte hobe keno? Bomi ashle bomi korbe. Somossha to dekhina.
সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। এটাই প্রিন্সিপাল স্যারের রুম। প্রশস্ত সুন্দর। বড় টেবিল। টেবিলের অপর পাশটাতে অর্ধবৃত্তাকারে পাঁচজন লোক বসে আছে। ভদ্রলোক বলাই ভালো। বেশ সুখী সুখী চেহারা। খোশগল্প করছিলেন। তাদের প্রত্যেকের সামনেই নাস্তার প্লেট। কিছু কাজু বাদাম, কয়েক ফালি আপেল, কয়েক কোয়া কমলা, আর একটা ছানার সন্দেশ।
প্রিন্সিপাল স্যার আমার সার্টিফিকেটগুলো দেখছিলেন। অ্যাপ্লিকেন্টদের কেউ একজন বলেছিলো, সোজাসুজি চেয়ারে প্রিন্সিপাল স্যার বসা। তিনি নাকি বেশ ভালো লোক। কোনো দুই নাম্বারি নাই। যে ভালো করবে, তার চাকরি হবে। কোনো এমপি-মন্ত্রীর ফোনে কাজ হবে না। পাশ থেকে একজন জিজ্ঞাসা করলো ‘লায়লা’ নামের অর্থ কী? আমি চুপ করে থাকলাম। আমাকে হেল্প করার ভঙ্গিতে আরেকজন বললেন, ‘আলিফ লায়লা’ আছে না ‘আলিফ লায়লা’। তিনি সুর করে বললেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আলিফ লায়লা’ কী? বললাম, জানি না, স্যার। শুরুতে যিনি প্রশ্ন করেছিলেন, বললেন, ‘শুধু সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? সাহিত্য পড়তে হবে, কবিতা পড়তে হবে।’ প্রিন্সিপাল স্যার কোনো কথাই বলছেন না। একবার শুধু মাথা উঁচু করে আমাকে দেখলেন।
১ম ভদ্রলোক : ‘জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু, / গা খানি তার শাঙন মাসের যেমন তমাল তরু।’ কার কবিতা? বলো তো?
আমি : সরি, স্যার।
১ম ভদ্রলোক : আচ্ছা, আমি তোমাকে অপশন দিচ্ছি। ১. আল মাহমুদ ২. কাজী নজরুল ৩. জসীম উদ্দীন।
আমি : জসীম উদ্দীন।
২য় ভদ্রলোক : ভেরি গুড। এই তো পেরেছো। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তুমি তো পারছো। বলো তো, জসীম উদ্দীনের কোন কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি আছে?
১ম ভদ্রলোক : আচ্ছা, তুমি নক্সী কাঁথার মাঠ বানান করে লিখ।
৩য় ভদ্রলোক : জসীম উদ্দীন নামটাও বানান করে লিখ।
আমি ‘নকশী কাথার মাঠ’ আর ‘জসীম উদ্দীন’ বানান করে লিখলাম। উনারা দেখলেন, লেখা ঠিক আছে কিনা! ‘তোমার রেজাল্ট তো ভালো!’ প্রিন্সিপাল স্যার বললেন। সোজা আমার দিকে তাকিয়ে। ‘চাকরি হলে তো তোমরা থাকো না।’ জিজ্ঞাসা করলেন, বাসা উত্তরার কোথায়? আমার স্থায়ী ঠিকানাও উত্তরায় দেওয়া। বললাম, সাত নম্বর সেক্টর। বাবা কী করেন? বাবা সম্পর্কে বললাম। অন্যান্যেরা তখন নাস্তা করছেন। গল্পগুজব করছেন। ৩য় ভদ্রলোক আপেল খেতে খেতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
৪র্থ ভদ্রলোক : মার্কসের নাম শুনেছো? তার পুরো নাম কী?
আমি : কার্ল হেইনরিশ মার্কস।
৪র্থ ভদ্রলোক : তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ, পুঁজি। ‘পুঁজি’ বলতে এখানে কী বোঝানো হয়েছে? টাকা-পয়সা-গহনা?
আমি : ‘পুঁজি’ এখানে টাকা পয়সা নয়। ‘পুঁজি’ একটা সম্পর্ক।
৩য় ভদ্রলোক : ‘পুঁজি’ জিনিসটা আমি ঠিক বুঝি না। মার্কস একটু প্যাঁচিয়ে ফেলেছেন। আমাকে একটু বুঝিয়ে দাও তো বিষয়টা কী?
আমি : ‘পুঁজি’ হল এক ধরনের উৎপাদন-সম্পর্ক।
৩য় ভদ্রলোক : তা তো বুঝলাম। কিন্তু উৎপাদন-সম্পর্কটা আবার কী?।
আমি : সরি, স্যার।
আরও অনেক প্যাঁচালেন। আমি উত্তর দিতে পারলাম না। সমানে ‘সরি’ বলতে থাকলাম। ১ম ভদ্রলোক বললেন, ‘সাহিত্য পড়তে হবে বুঝলে! বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে সমানে কোট করতেন।’ বললেন, ‘বলো, বঙ্গবন্ধু কোন ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট ছিলেন?’ সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘বাংলা ডিপার্টমেন্টের’। তিনজনই হা হা করে হেসে ওঠলেন। প্রিন্সিপাল স্যার তাকালেন আমার দিকে। বুঝলাম, আমার উত্তর ভুল হয়েছে। ২য় ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, ‘আমাদের প্রাইম মিনিস্টার কোন বিভাগের ছিলেন?’ চুপ করে ছিলাম কিছুক্ষণ। এমন ভাব করলাম যেন উত্তরটা জানি, কিন্তু মনে করতে পারছি না। বললাম, ‘সরি, স্যার’।
খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম আমি। উদ্ধার করলেন, ২য় ভদ্রলোক। আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন স্যারের নাম বললেন। জিজ্ঞাসা করলেন, চিনি কিনা? বললাম, ‘চিনি। উনি আমাদের প্রিয় স্যার।’ ৩য় ভদ্রলোক মনে হলো খুশি হলেন। বললেন, ‘জিজ্ঞাসা করবে, মোশতাক আহমেদ নামে কাউকে চেনেন কিনা?’
কীভাবে যে সময়গুলো কেটে গিয়েছে টেরই পাইনি। বেরোতেই ঝেঁকে ধরলো সবাই। একজন বললো, ‘আপা, আপনার হয়ে গেছে। আমি ড্যাম শিউর। সবচেয়ে বেশি সময় রেখেছে। পঁয়ত্রিশ মিনিট। মানে বুঝছেন!’ একজন জিজ্ঞাসা করে, কী কী ধরেছে? বাকিরাও দেখি উন্মুখ হয়ে আছে। বললাম, ‘সব তো মনে নেই। জসীম উদ্দীনের নামের বানান ধরেছিল।’ একজন বললো, ‘মাঝখানে হস্ চিহ্ন বসবে। হস্ চিহ্ন দিয়েছেন তো?’। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটে যাচ্ছিলো সব।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি ট্রায়াল দিই না। পারফেক্ট সাইজটা আমি জানি। সন্দেহ হলেই কেবল একটু দেখে নেই। প্রথম প্রথম খুব লজ্জা লাগতো। ট্রায়াল দিতে। মনে হতো সবাই দেখছে।
একটু বসলাম। সার্টিফিকেটগুলো ঠিকঠাক করে ব্যাগে ভরে নিলাম। নেটে ঢুকে দেখলাম : দুইটা বানানই আমার ভুল হয়েছে। নক্সী বানানে ‘শ’ হবে না, কাঁথা বানানে ‘চন্দ্রবিন্দু’ আছে। উদ্দীন বানানে ‘দ-এ দ’ আলাদা হবে, মাঝখানে হসন্ত বসবে। ভালো লাগছিল না। বেরিয়ে পড়লাম। রেজাল্ট আজকে দেবে না, পড়ে এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে।
বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। হাঁটতে ভালো লাগছে। অনেকদিন একা একা হাঁটা হয় না। কেউ না কেউ সঙ্গে থাকেই। একা হাঁটার মধ্যে আলাদা ব্যাপার আছে। অনেক চিন্তা এসে ভর করে। ইমরানকে ফোন দিলাম। ওদের সবাই এখন অফিসে। কাজে ব্যস্ত। প্রথমবার ফোন ধরলো না। পরে ইমরান-ই ব্যাক করলো। বললাম, ‘তোমাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। চাকরি হোক আর না হোক, তোমাকে আমি খাওয়াবো।’ বললাম, তার ফেসবুকের পোস্টগুলো কীভাবে আজ মান-সম্মানটা বাঁচিয়েছে। মার্কসের পুরো নাম, তরুণ বয়সের ছবি, তার বিখ্যাত বই পুঁজি, ‘পুঁজি’ কী? আমার এসব যাবতীয় জ্ঞানের উৎস তার ফেসবুকের ওয়াল। বললাম, আজ ভাইভায় তথ্যগুলো খুব কাজে লেগেছে।
একটু আড়ঙে ঢু মারবো ভাবছি। অবশ্য ক্ষুধাও লেগে গেছে। চারটার মধ্যে বাসায় ফিরলেই হচ্ছে। এরমধ্যে না-হয় হালকা কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে। মাকে ফোন দিলাম। বললাম, ভাইভা শেষ। হয়েছে মোটামুটি। বললাম, বাবাকে বলতে। মা’র কথা হলো, আমার হবে। তার দোয়া আছে। মার সঙ্গে কথা বলে খারাপ লাগাটা আরও বেড়ে গেলো। বেশ হতাশ লাগছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রশ্নটা পারা উচিত ছিল। মাকে বললাম, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরবো।
জামা কেনার ক্ষেত্রে একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় আছে। প্রথমবার আটাশশো ছাপ্পান্নো না কত দিয়ে জানি একটা জামা কিনেছিলাম। আড়ঙ থেকে। তবু ঈদে। মনে হলো, আটাশশো! আটাশশো টাকাকে মনে হয়েছিলো অনেক বেশি টাকা। আসলেই অনেক বেশি। একটা জামার দাম আটাশশো টাকা। মুখের কথা নয়। একবার একটা জামা কিনলাম চার হাজার সাতশ’ টাকা দিয়ে। এর পরে দেখি পাঁচের কম কোনোটা পছন্দই হয় না। ঈদে কিনলে বাজেট ছয়-সাত পর্যন্ত চলে যায়। কারো কারো পুরো মাসের বেতন। জেসমিন দি’দের বাসায় যে মহিলা — ঘর মুছে, কাপড় ধোয়, বাসন-কোসন মাজে, তরি-তরকারি কেটে দেয় — এক কথায় ঘরের সব কাজই করে। তার বেতন দুই হাজার টাকা। কবে যেন ইমরান বলতেছিল, দেশ যত উন্নত হয় গরিবরা নাকি আরও গরিব হতে থাকে। যদিও তার কথার অধিকাংশই আমি বুঝি না। সহজ কথা জটিল করে বলাই তার কাজ।
হালকা নীল রঙের একটা জামা পছন্দ হলো। অফ হোয়াইট সালোয়ার। মনে হচ্ছে মাপে একটু ছোটো হবে। আমি এরচেয়ে এক সাইজ বড় চাইলাম। খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেলো — নেই। মেয়েটা বললো ট্রায়াল দিয়ে দেখতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি ট্রায়াল দিই না। পারফেক্ট সাইজটা আমি জানি। সন্দেহ হলেই কেবল একটু দেখে নেই। প্রথম প্রথম খুব লজ্জা লাগতো। ট্রায়াল দিতে। মনে হতো সবাই দেখছে। তামান্নাকে দাঁড় করিয়ে রাখতাম দরজায়। হঠাৎ করে কেউ যেন ঢুকে পড়তে না-পারে।
দাম কমই আছে। নিজের কাছেই অবাক লাগে। তিনহাজার সাতশ’ টাকাকে বেশি দাম মনে হচ্ছে না। ট্রায়াল দিয়ে দেখলাম বুকের দিকটা চাপ দিয়ে ধরে। কমফোর্টেবল না। সাইজে না-মিললে আসলে পরাও হয় না। কিনে শুধু শুধু ফেলে রাখা। এছাড়া ছেঁড়েও তাড়াতাড়ি। বিভাস বলে, পোশাক হতে হবে কমফোর্টেবল। ও খুব ঢিলেঢালা পোশাক পরে। তাকে মানিয়েও যায়। এখন আর কিনতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে, মাপে না-হয়ে ভালই হয়েছে। আরেকদিন আসা যাবে।
পড়ুন ।। কিস্তি : ১৫