বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে সহজিয়ায় কিছু মূল্যায়নধর্মী ও রূপরেখামূলক লেখা প্রকাশ করা হবে। আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের ৫০ বছরের অর্জনের ইতিহাসকে চিহ্নিত করা। আজ ছাপা হলো ভাষা-পরিস্থিতি বিষয়ক একটি লেখা। লিখেছেন তারিক মনজুর।
কতদূর এগোলো বাংলা ভাষা? কিংবা ভাষা কি আদৌ এগোয়? ভাষার জন্ম যদি হতে পারে, মৃত্যু যদি থাকতে পারে, তবে ভাষার অগ্রসরণও সম্ভব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ৫০ বছর পার হয়েছে। ভাষাচর্চা আর ভাষাচিন্তায় কতটুকু এগিয়েছে বাংলা ভাষা, দেখা যাক।
প্রমিত বাংলা
এই পঞ্চাশ বছরে সবচেয়ে নতুন আর সবচেয়ে জনপ্রিয় শব্দ হয়েছে ‘প্রমিত বাংলা’। এটি এমন এক ভাষিক মান, যা অর্জন করা আদতে কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অন্যভাবে বলা যায়, আসলে কেউই প্রমিত ভাষায় কথা বলে না। তবু, আমাদের বিশিষ্ট জনেরা মনে করেন, তিনি প্রমিতভাষী। আর তাই, উপভাষী ব্যক্তির উচ্চারণ তাঁর কানে সয় না। এমনকি, প্রমিত উচ্চারণে কথা বলতে না পারার কারণে ব্যক্তি হাসির পাত্র হন, মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর কম পান, আর নিজে সংকুচিত হয়ে থাকেন। এ তো গেলো প্রমিত উচ্চারণের কথা। প্রমিত বাংলা বলতে আরেকটি ধারণা মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে। সেটি হলো, বাক্যে কর্তা-ক্রিয়ার অন্বয় যাই হোক না কেন, ‘শুদ্ধ বানানে’ লিখতে পারাটাই প্রমিত বাংলা!
বাংলা বানান
বাংলা বানান নিয়ে তর্ক কম হয়নি। ‘গরু’ বানানে গ-য়ে ও-কার হবে কি হবে না, ‘ঈদ’ বানানে হ্রস্ব ই-কার কেন হওয়া উচিত, বাংলা একাডেমি কেন নিজেদের বানানে দীর্ঘ ঈ-কার দেয়, এসব তর্কে মানুষ সাগ্রহে অংশ নেন। বানান নিয়ে কথা বলার সময় সবাই খুব সিরিয়াস হয়ে যান। কেউ ভেবেই দেখেন না, আমাদের বানানের আসলে কোনো নীতি নেই। আর নিয়ম বলতে যা যা চালানো হয়, তার মধ্যেই হাজারটা গলদ রয়ে গেছে। তাই বানান ভুল না শুদ্ধ, এ নিয়ে এত প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া ঠিক নয়। বানান দীর্ঘ দিনের প্রথার ব্যাপার। একে নাড়াচাড়া না করাই ভালো। দোকানের সাইনবোর্ডে কয়টা ভুল বানান আছে, এটা না গুনে দেখুন, ওই দোকানে কতটুকু স্বাস্থ্যকর পণ্য বিক্রি হয়। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার খাতায় বানান ভুল করেছে, এর জন্য নম্বর না কেটে বরং দেখুন, সে একটি প্রশ্নের উত্তরে কয়টি নতুন কথা বলতে পারল।
ভাষা মিশ্রণ
বাংলা ভাষায় এত ইংরেজি ভাষার শব্দ কেন, শিশুরা কেন হিন্দি কার্টুন দেখে, বাংলা ভাষায় কেন এত অপপ্রয়োগ ঘটছে — এগুলো আমাদের প্রধান দুশ্চিন্তা হয়ে পড়েছে! এই কথাগুলো পণ্ডিতদের মুখেই বেশি শোনা যায়। অথচ, দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান ও পণ্ডিত ব্যক্তির যৌথ ভূমিকা থাকলে আরও অনেক বাংলা প্রতিশব্দ কিংবা বাংলা পারিভাষিক শব্দ চালু করা যেত। চলমান ভাষা হিসেবে অন্য প্রধান ভাষাগুলোর মতো বাংলাতেও অন্য ভাষার শব্দ ঢুকবে, এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া, আজকের দিনে শিশুরা বহুভাষিক পরিস্থিতির সঙ্গে বড় হয় এবং সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে; ফলে হিন্দি ভাষা নিয়ে এত আতংকের কিছু নেই। আর ভাষার অপপ্রয়োগ বলে আদৌ কিছু নেই, এটা অন্তত সত্তর বছর ধরে পৃথিবীর ভাষাবিজ্ঞানীরা মেনে নিয়েছেন।
সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার
সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার হবে, এমনটা আশা করেছিল সবাই। রাস্তার সাইনবোর্ডগুলো বাংলায় হবে, ব্যাংকের চেক বাংলায় লেখা হবে, চাকুরির আবেদনপত্র, জীবনবৃত্তান্ত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আন্তঃযোগাযোগ বাংলায় হবে, এমন আশা ছিল। শুধু আশা নয়, একটি সফল ভাষা-আন্দোলনের পর আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, এবার উচ্চশিক্ষায়, আদালতে আর আন্তর্জাতিক যোগাযোগেও বাংলা প্রাধান্য পাবে। কিন্তু নিজেদের স্বপ্ন-বৃক্ষে নিজেরাই কুড়াল মেরেছি। ওই গাছটাকে ডালপালা মেলতে দেইনি। উপরন্তু স্বপ্ন-বৃক্ষে ইংরেজি সাইনবোর্ড গেড়েছি পেরেক দিয়ে। এখন মনে করি, ইংরেজি ভাষা না শিখলে পিছিয়ে পড়তে হবে। তাই সন্তানকে ইংরেজি ভার্সনের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন বাংলার শিক্ষকেরাও! শিক্ষকরা যে-কোনো অর্থেই গরিব; পয়সা থাকলে ইংরেজি মাধ্যমেই হয়তো পড়াতেন।
বাংলা সাহিত্য
বাংলা ভাষাকে অবলম্বন করে বাংলা সাহিত্য এগিয়েছে অনেকখানি। বাঙালি ইংরেজি-অনুরাগী; অথচ ইংরেজিতে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ করতে উৎসাহী নন মোটেও। ফলে, বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিক পরিচিতি ঘটছে না। বিদেশীদের মধ্যে কেউ কেউ বিছিন্নভাবে বাংলা সাহিত্য নিয়ে চর্চা করছেন, কিন্তু আমাদের সাহিত্যের বিশ্বায়ন এভাবে সম্ভব নয়। অন্য ভাষার সাহিত্য বাংলায় বরং বেশ ভালোই অনুবাদ হয়েছে। এর ফল হয়েছে ভালো-মন্দ দুরকমই। ভালো ফল এই, অন্যদের সাহিত্যচর্চর ধরন-ধারন বোঝা গেছে। আর মন্দ হয়েছে এই, বাংলা ভাষার নিজস্ব ধরন আর সাহিত্যের সরল আঙ্গিক ভুলে আমরা সাহিত্যের ভাষা ও ভঙ্গিকে অযথা জটিল করেছি।
বাংলাদেশে বসে আপনি চিনা ভাষা শিখতে পারবেন; পারবেন ফরাসি, হিস্পানি, জাপানি ভাষা শিখতে। অবশ্য পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক ভাষা এখন মোবাইলের অ্যাপসের মাধ্যমেও শেখা যায়। কিন্তু দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা শেখার প্রতিষ্ঠান খুঁজে পান না বিদেশিরা।
পশ্চিম বাংলার অনুকরণ
পশ্চিম বাংলার প্রধান ভাষাও বাংলা। বাংলা ভাষাকে পশ্চিম বাংলায় টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না, এই নিয়ে ওখানকার বিজ্ঞজনেরা সন্দেহ পোষণ করেন। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বাংলা ভাষাকে রক্ষার দায়িত্ব বর্তেছে বাংলাদেশের ওপর। দাদারাও তাই মনে করেন। কিন্তু আমাদের কাজেকর্ম দেখে মনে হয়, আমরা অনেক ক্ষেত্রেই পশ্চিম বাংলাকে অনুসরণ করে চলেছি। যেমন, সমস্ত যুক্তবর্ণকে ঐহিত্য ভেঙে স্বচ্ছ করার দাবি তোলা হচ্ছে। ষ্ণ, হ্ম, জ্ঞ ইত্যাদি যুক্তবর্ণকে হাতে লেখার সময় ভেঙে লিখতে দেখছি অনেককে। বানানের নিয়মেও পশ্চিম বাংলার অনুকরণে দীর্ঘ ঈ আর দীর্ঘ ঊ-কে বনবাসে পাঠাতে চলেছি। উচ্চারণ অভিধানে ‘শ্মশান’ শব্দের উচ্চারণ লিখি ‘শঁশান্’; অথচ আমরা উচ্চারণ করি ‘শশান্’। ক্রিয়াপদের প্রমিত রূপ বলতেও আমাদের নিজেদের কিছু নেই।
জাতিসংঘের ভাষা
জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ছয়টি। ইংরেজি, রুশ, ফরাসি ও চিনা — এগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী শক্তিদের, যারা একইসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। পরে হিস্পানি ও আরবিকে যুক্ত করা হয়েছে। জাতিসংঘের সপ্তম ভাষা হিসেবে বাংলাকে সংযোজনের ব্যাপারে আলোচনা চলছে অন্তত দশ বছর ধরে। এই আলোচনাকে আলোচনা না বলে আবেগের বহিঃপ্রকাশ বলা ভালো। কারণ, এটা নিয়ে আমরাই শুধু কথা বলছি, আর কেউ নয়। বাংলা পৃথিবীর বড়ো ভাষাগুলোর একটি, এই যুক্তিতে প্রথমে ধুয়া তোলা হয়েছিল, বাংলাকেও জাতিসংঘের ভাষা করতে হবে। পরে মাঠে নেমে দেখা গেল, এটি বিশাল অর্থায়নের ব্যাপার। আরেকটি কথা কেউ বলে না, সেটি হলো, শুধু টাকা ঢাললেই জাতিসংঘ বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দিতে পারবে না। কারণ, বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অবস্থানও ভালো নয়। অন্যভাবে বলা যায়, বিশ্ব-অর্থনীতি আর বিশ্ব-রাজনীতিতে বাংলা ভাষা কোনো গুরুত্ব বহন করে না।
বিদেশিদের বাংলা শেখা
বাংলাদেশে বসে আপনি চিনা ভাষা শিখতে পারবেন; পারবেন ফরাসি, হিস্পানি, জাপানি ভাষা শিখতে। অবশ্য পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক ভাষা এখন মোবাইলের অ্যাপসের মাধ্যমেও শেখা যায়। কিন্তু দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা শেখার প্রতিষ্ঠান খুঁজে পান না বিদেশিরা। নেই বাংলা শেখার অ্যাপসও। তবু বিদেশিরা বাংলা শুনে বুঝতে পারেন, বাংলা মুখে বলতে পারেন। বোঝা আর বলার এই সক্ষমতা অর্জিত হয় দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে বাস করার কারণে। বাংলা পড়তে, লিখতেও শিখে যান একরকম নিজের উদ্যোগে। আমাদের স্বার্থেই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দেশে দেশে বাংলা শেখানোর কাজটি করতে হবে। বাংলা ভাষার প্রতি বিদেশিদের আগ্রহী করে তোলার কাজ এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কাজ সমান্তরালে চালাতে হবে।
উপভাষা
পৃথিবীর সমস্ত ভাষারই উপভাষা আছে। আমাদের স্কুলপাঠ্যতে উপভাষা বলতে অঞ্চলবিশেষের ভাষাকে বোঝানো হয়ে থাকে। অথচ উপভাষা শুধু আঞ্চলিক ভাষা-বৈচিত্র্য নয়, এটি একইসঙ্গে সমাজের মানুষের শ্রেণিগত, পেশাগতসহ সব ধরনের ভাষা-বৈচিত্র্যকে নির্দেশ করে। সূক্ষ্মতর অর্থে, প্রত্যেকটি মানুষই এক একটি উপভাষা বহন করেন। ভাষার ‘প্রমিত’ মানে পৌঁছানোর ব্যাপারটি তাই তাত্ত্বিকভাবে অসম্ভব। যাঁরা নিজেদেরকে প্রমিতভাষী মনে করেন, আমি নিশ্চিত, তাঁদের প্রত্যেকের উচ্চারণে প্রমিত-মান অনুপস্থিত। প্রমিত উচ্চারণ বলতে শুধু ধ্বনির মহাপ্রাণতা-অল্পপ্রাণতা কিংবা ঘোষত্ব-অঘোষত্ব বজায় রেখে উচ্চারণ করা বোঝায় না। এর সঙ্গে স্বরধ্বনির যথাযথ উচ্চারণ, অনুনাসিকতা, এমনকি ভাষার স্বরতরঙ্গ ও ঝোঁকও জড়িত। বাংলাদেশের কেন্দ্র যদি হয় ঢাকা, তবে ঢাকার মৌখিক ভাষাকে আদর্শ মান হিসেবে ধরা উচিত ছিল। কিন্তু অনেকখানি সময় আমরা পাড়ি দিয়ে ফেলেছি। এখন তাই নতুন আদর্শ নির্ধারণ করা ঠিক হবে না।
ক্ষুদ্র ভাষাসমূহ
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ভাষা আছে চল্লিশটির মতো। এর মধ্যে খুমি, পাত্র, লুসাই, মুন্ডাসহ অন্তত চৌদ্দটি ভাষায় কথা বলে এক হাজারের নিচে মানুষ। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সমস্ত শিশু বহুভাষিক পরিস্থিতির মধ্যে বড় হয়। বাংলা ভাষা তার গোষ্ঠীর বাইরে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। ফলে, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে তারা বাংলা ভাষাতে সহজেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুশিক্ষার্থীর জন্য মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেছে। প্রকল্পে নেয়া হয়েছে পাঁচটি ক্ষুদ্র ভাষা। আপাতভাবে এটি ভালো উদ্যোগ মনে হয়। কিন্তু আদতে তা নয়। একটি ছোট অঞ্চলে বহু ভাষার মানুষের অবস্থান থাকতে পারে। এ কারণে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বহু ভাষার ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। আর যদি নীতিগতভাবে কাউকে ছোট ভাবা না হয়, তবে প্রতিটি ক্ষুদ্র ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে!
একটি চলমান ও স্থায়ী ভাষা-কমিটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এঁদের কাজ হবে নিয়মিতভাবে পরিভাষা, বানান, উচ্চারণ, অভিধান আর শুদ্ধি-অশুদ্ধির যাবতীয় প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার জবাব দেওয়া। প্রতিটি বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার কারিকুলাম ও সিলেবাসে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
বাংলা বিভাগ
বাংলাদেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নামে একটি বিভাগ আছে। ওগুলোতে বাংলা পড়ানো হয়। বাংলা পড়ানো হয় মানে বাংলা সাহিত্য পড়ানো হয়। বাংলা ভাষারও যে উচ্চতর পঠন-পাঠন আছে, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষকেরাও মানতে পারেন না। তাঁদের উপলব্ধি অনেকটা এ রকম: ‘বাংলা ভাষা শিখতে চাও? বেশ! ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হও।’ আর ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে যাঁরা ভর্তি হন, তাঁরা পাশ্চাত্য কাঠামোয় ভাষার বিশ্লেষণ ও তত্ত্বের কিছু প্রাথমিক ধারণা লাভ করেন মাত্র। বাংলা ভাষার সঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানের সম্পর্ক অনাবিষ্কৃত থেকে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, বাংলা সাহিত্য পড়েও আসল কাজ হচ্ছে না। আমরা আসলে, আসল কাজটাই কী, তা জানি না। নইলে, সব ধরনের পরীক্ষায় কেন প্রশ্ন করব: বাংলা গদ্যের জনক কে? অদ্বৈত মল্লবর্মন কোন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন? লালসালু কার লেখা? ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা বাংলা গদ্যের পথটা চিনতে পারিনি; অদ্বৈত মল্লবর্মনের বেড়ে ওঠার সংগ্রাম বুঝতে পারিনি; পারিনি লালসালুর মজিদের টিকে থাকার কষ্টটা জানতে।
সময় চলে যায়, তবে ফুরিয়ে যায় না। পাকিস্তান আমলে যে স্বপ্ন দেখেছে বাঙালি, আজ বাংলাদেশে সেই স্বপ্ন পূরণের সব সুযোগ রয়েছে। বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, নজরুল ইনস্টিটিউট এবং এ রকমের প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে আবার বলি, শুদ্ধ বানান শেখানো আর উচ্চারণ শেখানোর মধ্যে উদ্যোগগুলো সীমিত রাখলে চলবে না। বাংলা ভাষার সম্প্রসারণে আসল কাজের কাজটি করতে হবে। পুরাতন বাংলা সাহিত্যের খোঁজ করতে হবে নতুন উদ্যোগে। বিদ্যমান বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিক মূল্যায়ন চালাতে হবে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যৌথ সমন্বয়ে।
একটি চলমান ও স্থায়ী ভাষা-কমিটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এঁদের কাজ হবে নিয়মিতভাবে পরিভাষা, বানান, উচ্চারণ, অভিধান আর শুদ্ধি-অশুদ্ধির যাবতীয় প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার জবাব দেওয়া। প্রতিটি বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার কারিকুলাম ও সিলেবাসে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচি এমন হবে যাতে দু লাইন নিজের মতো লেখার যোগ্যতা অর্জিত হয়। ইংরেজি ভার্সনের তামাশা বন্ধ না করলে শিক্ষার্থীর নিজের ভাবনা-দক্ষতা নষ্ট হয়ে যাবে। আর, ভাষার প্রতি আবেগ শুধু স্কুলে স্কুলে শহিদমিনার বানানো আর খালি পায়ে ফুল দেয়ার মধ্যে সীমিত রাখলে চলবে না। আবেগকে কাজে লাগিয়ে স্কুলে স্কুলে বাংলা সংসদ গড়ে তোলা দরকার। আবৃত্তি, নাটক, গান, নাচসহ সব ধরনের সাংস্কৃতিক চর্চা চালাতে হবে। গল্প-উপন্যাস-কবিতার মুক্ত আলোচনা গড়ে তুলতে হবে। কাব্যচর্চা আর গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখায় উৎসাহিত করতে হবে। আরও অনেক কিছুই করার আছে। কিন্তু যা কিছু করার দরকার নেই, আমরা তা-ই করে চলেছি!
“আমরা বাংলা গদ্যের পথটা চিনতে পারিনি; অদ্বৈত মল্লবর্মনের বেড়ে ওঠার সংগ্রাম বুঝতে পারিনি; পারিনি লালসালুর মজিদের টিকে থাকার কষ্টটা জানতে।”- এজন্য দায়ী কে? কেউ বাংলায় অনার্স ভর্তি হয়েছে শুনলেই নাক সিটকানোর রহস্য কি? বাংলায় পাশ করে ভালো চাকরি পেলে অন্যরা অবাক হয় কেন? এ সবের উত্তর খুঁজে তার সমাধানের পথ পাওয়া প্রয়োজন।