প্রচলিত দশকী বিভাজনে আলতাফ শাহনেওয়াজ শূন্য দশকের কবি। এ বছর বেরিয়েছে তার কবিতার বই সহসা দুয়ারে। সহজিয়ার সঙ্গে তার কিছু কথা।
সহজিয়া : মেলায় আপনার নতুন কবিতার বই প্রকাশ পেতে যাচ্ছে — সহসা দুয়ারে। ১৬ পৃষ্ঠার ছোট্ট একটি বই। এ বইয়ের পরিকল্পনা কীভাবে করলেন? কেন করলেন?
আলতাফ শাহনেওয়াজ : আদতে এই বইয়ের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এ বছর বই করারই কোনো পরিকল্পনা ছিল না আমার। গেল ২০২০-এ প্রথমা প্রকাশন থেকে আমার দীর্ঘ কবিতার বই সামান্য দেখার অন্ধকারে বের হয়। তার আগের বছর বাতিঘর থেকে বের হয় কলহবিদ্যুৎ। ফলে ভেবেছিলাম, এবার আর কোনো বই করব না। তাই বই করার কোনো প্রস্তুতিও নিইনি। হ্যাঁ, ‘প্রস্তুতি’ কথাটি সচেতনভাবেই বলেছি। আমার প্রত্যেক বইয়ের ক্ষেত্রে আলাদা রকম প্রস্তুতি থাকে। শুধু কিছু কবিতা থরে-বিথরে সাজিয়ে মলাটবন্দি করলাম, এমন বই করতে আমি নারাজ। আমি মনে করি, একজন কবির কাছে তার একেকটি বই হলো তার একেকটি স্বতন্ত্র জগৎ। ফলে যেহেতু আমার ভেতরে এই সব বিবেচনা বোধ কাজ করে, তাই একটি বই করার ক্ষেত্রে ভেতরে ভেতেরে আমার খানিকটা প্রস্তুতি লাগে। যে কারণে বই করতে আমার সময়ও লাগে।
যা হোক, এবার যেহেতু আমার কোনো বই হবে না, সেহেতু বেশ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু ‘অভিযান’-এর প্রকাশন কবি মনিরুজ্জামান মিন্টু ঝামেলাটা বাঁধালেন। এ মাসের ৪ তারিখে আমাকে তিনি ফোন করে অনুরোধ করলেন, এক ফর্মার একটা পাণ্ডুলিপি দেন ভাই। তো, তাঁকে বললাম, এমন কোনো পাণ্ডুলিপি তো আমার নেই। তিনি তবুও বললেন, দেখেন তার পরেও।
এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল—বাসার একটা পুরোনো বস্তা খুলতে গিয়ে আমার একটা কবিতার খাতা পেয়ে গেলাম। এই খাতাটি আদতে হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি, কোথায় রেখেছিলাম, তা মনে করতে পাচ্ছিলাম না।
২০০৮ সালে এই খাতায় কবিতা লিখতাম। তখন পড়তাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং থাকতামও সেখানে। তো, অকস্মাৎ সেই পুরোনো খাতা এবং পুরোনো কবিতাগুলো আমাকে বেশ স্মৃতিকাতর করে দিল। ওই খাতায় তখন সহসা দুয়ারে নামে বেশ কিছু সিরিজ কবিতা লিখেছিলাম। তবে যখন লিখেছিলাম, তার থেকে বারো বছর পরে ২০২১-এ এসে সেই কবিতাগুলো যখন আবার পড়লাম, উপলব্ধি করলাম, এই লেখাগুলোর ভেতরে কোথায় যেন একটা প্রচ্ছন্ন বেদনার পাশাপাশি একটা শান্তি শান্তি ব্যাপারও আছে। এখানে বলা দরকার, সহসা দুয়ারে-এর মধ্যে যে জগত আছে, কবিতার সেই জগতে আমি এখন আর বসবাস করি না। কিন্তু আশ্চর্য, কবিতাগুলো এখনো আমাকে আক্রান্ত করছে তো! এখনো, এই সময়ে দাঁড়িয়ে এ কবিতার প্রাসঙ্গিকতা আছে তো! পড়তে পড়তে মনে হলো, সেই ২০০৮ সালে বুঝে-না-বুঝে এখনকার সমকালকে কেন লিখেছিলাম আমি? নাকি আমাদের জীবনে সময়ের কিছু কিছু অভিব্যক্তি স্থির, অনড়? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। মূলত তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, সহসা দুয়ারে সিরিজের কবিতা নিয়ে একটি ছোট্ট বই হতেই পারে। তা ছাড়া, গদ্য কবিতা নিয়ে একটি বই করার ইচ্ছাও আমার ছিল ভেতরে ভেতরে।
সবকিছু যখন এক মোহনায় মিলে গেল, সে সময় ২০০৮-এর লেখাগুলো ২০২১-এ দাঁড়িয়ে খানিকটা পরিমার্জন করলাম, মানে পুরোনো লেখাগুলোতে একটু লেপাপোছা করলাম। এভাবেই গ্রন্থিত হলো সহসা দুয়ারে। আমার ফেলে আসা ভাষা ও কাব্যজগৎ আবার আমাকে জড়িয়ে ধরল। বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে এখানে এটা বলা দরকার যে, ‘সহসা দুয়ারে’ শিরোনামের আমার সিরিজ কবিতার বইটি বেরিয়েছে গেল ২৩ মার্চ, ‘অভিযান’ প্রকাশনী থেকে। আমর একুশে বইমেলায় ‘অভিযান’-এর স্টলে (স্টল নং: ৯৩) এটি এখন পাওয়া যাচ্ছে।
অনেকটা অচেতনভাবেই লিখেছিলাম। এক ধরনের বিস্ময়াকুল বেদনার ধারাভাষ্য পাওয়া যাবে কবিতাগুলোতে। কেন এই বেদনা? তখন যেন পৃথিবীর সব ভার একাই কাঁধে নিয়েছিলাম আমি।
সহজিয়া : এই বইয়ের স্বাতন্ত্র্য কী? আপনার অন্য বইগুলোর সঙ্গে তুলনা সাপেক্ষে যদি বলেন…
আলতাফ শাহনেওয়াজ : স্বাতন্ত্র্য ব্যাপারটি নিজের মুখে বলা তো কঠিন। তারপরে তা যদি অন্য বইয়ের সাপেক্ষে তুলনা করতে হয়, সেটা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। আমি শুধু বলতে চাই, সহসা দুয়ারে-এর কবিতাগুলোর মধ্যে এমন এক সুরেলা এবং অর্ন্তভেদী জগত আছে, যা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর।
বলতে পারি, গভীর এক ব্যক্তিগত ক্ষরণ ও ক্ষত এই কবিতাগুচ্ছের জন্মদাত্রী। কী আচ্ছন্নতা দিয়ে যে তখন কবিতাগুলো লিখেছিলাম! অনেকটা অচেতনভাবেই লিখেছিলাম। এক ধরনের বিস্ময়াকুল বেদনার ধারাভাষ্য পাওয়া যাবে কবিতাগুলোতে। কেন এই বেদনা? তখন যেন পৃথিবীর সব ভার একাই কাঁধে নিয়েছিলাম আমি।
আগেই বলেছি, সে সময় আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। জাহাঙ্গীরনগরের নিসর্গ ও পরিবেশ তো অভূতপূর্ব—স্নিগ্ধ, সুরেলা ও সংগীতময়, সেসবের প্রভাব হয়তো আছে কবিতাগুলোর পরতে পরতে। আর সে সময় ক্যাম্পাসের হলে বসে খুব ক্লাসিক্যাল মিউজিক শুনতাম আমি—ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, ওস্তাদ বাড়ে গুলাম আলী, বিদুষী কিশোরী আমানকর—এঁদের। এসব শুনতে শুনতে কেন যেন সে সময় মনে হয়েছিল, ক্লাসিক্যাল মিউজিকে যেমন এক ধরনের ভাষাকে পেরিয়ে যাওয়ার বিষয় রয়েছে, কবিতাতে কি তা সম্ভব? ভাষাকে পেরিয়ে এক ধরনের গুমরে ওঠা ভাষা বা কথার কাছে পৌঁছানো? সেই চেষ্টাও বোধ করি এই গুচ্ছের মধ্যে পাওয়া যাবে।
অবশ্য সত্যি বলতে, এসব আগে ভেবে তারপর কবিতা লেখা, এমন তো আর হয় না। ভাবনাগুলো হয়তো মনের মধ্যে ছিলই। অবচেতনেই সেই ভাবনার ভেতর ডুব দিয়েছিলাম আমি—এমনটাই হওয়ার কথা।
সহজিয়া : সহসা দুয়ারে — ‘দুয়ার’ কি বিশেষ কোনো প্রতীকী অর্থ বহন করছে?
আলতাফ শাহনেওয়াজ : আক্ষরিক অর্থ দিয়ে আর যা-ই হোক, কবিতা কি রচনা করা যায়, যখন পাশাপাশি বসা কবিতা শব্দগুচ্ছ নিজেরাই নতুন অর্থ উৎপন্ন করে!
তাই এটা বলতেই চাই যে, সহসা দুয়ারে-এর ‘দুয়ার’-এর অবশ্যই আলাদা ব্যঞ্জনা আছে। সেটা কী? জগৎ হতে পারে। জীবনও হতে পারে। আবার সুরের যে তান, তা-ও হওয়াও অসম্ভব না। কথা হলো, যাঁর কাছে অর্থটি যে মাত্রায় ধরা দেবে, যে ছবিতে হাজির হবে, তিনি সেভাবেই একে আলিঙ্গন করবেন।
সহজিয়া : টানা গদ্যে লেখা কবিতা নিয়ে আপনার ভাবনা কী? অনেকে এ ধরনের কবিতাকে কাব্যিক দুর্বলতা ঢাকার উপায় বলে ধরে নেন… এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য শুনতে চাই।
আলতাফ শাহনেওয়াজ : সার্থক গদ্য কবিতা লেখা কিন্তু আদতেই খুব কঠিন, যদি কেউ সৎ থেকে তা লিখতে চান। কেননা, গদ্য কবিতার তো কোনো নির্দিষ্ট ছাঁদ-ছঁক নেই। আর এখানে যেহেতু প্রচলিত ছন্দসমূহ অতো কঠোরভাবে অনুসরণ না করলেও চলে, ফলে গদ্য কবিতায় বাক্যের সুর, সংগতি রক্ষা করে অনুভূতিময় একটি অর্থের দ্বারে পৌঁছানোই বড় বিষয় বলে মনে হয় আমার কাছে। মূল বিষয়টি হলো, একটি কবিতায় — আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে গদ্য কবিতায় আপনি কী বলতে চাচ্ছেন এবং কীভাবে বলতে চাচ্ছেন—এগুলো প্রধান হয়ে ওঠে বলে মনে হয় আমার কাছে। লাগামহীনভাবে অনেক কিছুই তো বলা যায়, কিন্তু আপনি কি অনেক কিছু বলবেন, না বিশেষ কিছু বলবেন—গদ্য কবিতা বা ছন্দে লেখা কবিতা—যা-ই হোক না কেন, সেটা আপনাকেই নির্ধারণ করতে হবে। আর কবিতাতেও যে কোনো কোনো সময় গোজামিল দেওয়ার কৌশল খাটানো যায় না, এমনও তো নয়। তবে সেই সিদ্ধান্ত অবশ্য কবিকেই নিতে হয়—তিনি কী করবেন, কবিতাটি যাতে আপানাতে শেষ হয়, সেজন্য অপেক্ষা করবেন, নাকি কৌশল খাটিয়ে কবিতাটি সমাপ্ত করে ফেলবেন। আশা করি, আমার এসব কথার মধ্য দিয়ে আপনি আপনার উত্তরগুলো এর মধ্যেই পেয়ে গেছেন।
সহজিয়া : আপনার কবিতায় অনেক সময়ই সুর, সঙ্গীতের প্রসঙ্গ থাকে। কেন?
আলতাফ শাহনেওয়াজ : থাকে নাকি! তাহলে তো ভালোই। আমি তো সবসময় এটাই চেয়েছি। প্রথম থেকেই আমি এটা মানি যে, কবিতার ক্ষেত্রে সংগীতময়তা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। আপনি বড় কবিদের কবিতা পড়েন, দেখবেন কবিতা ও সংগীত সেখানে একাকার। হ্যাঁ, কবিতাতে মিউজিক্যালিটি অবশ্যই একটি ব্যাপার। কে কীভাবে কবিতায় তা যোজনা করবেন, তা একান্ত তার বিষয়। বাংলা কবিতার ঐতিহ্যকে মনে রেখে আমি আমার মতো করে চেষ্টা করি। সুর তো আর চোখে দেখা যায় না, তা অনুভব করতে হয়। কবিতাও কিন্তু তাই। ফলে সুর আলাদাভাবে নয়, কবিতার ভেতরে সুর ওই কবিতার আত্মার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়।
সহজিয়া : আপনার কবিতায় সমকালবিষয়ক তৎপরতা বেশ চোখে পড়ে। এটা কি সহসা স্পষ্ট হলো? নাকি এই প্রবণতা আপনার কাব্যিক চেতনার মৌলিক অংশ?
আলতাফ শাহনেওয়াজ : ঠিক বলতে পারব না। আমি এভাবে ভাবি না। আদতে এ প্রশ্নের উত্তরে কী বলা যায় তাই ভাবছি। যে জীবন আমি যাপন করি, যে বাস্তবতার মুখোমুখি আমি প্রতিনিয়ত হই, আমার কবিতা হয়তো তার মধ্য থেকেই উৎসারিত হয়। এখন সেখানে যদি সমকালের কোনো প্রসঙ্গ হাজির হয়, হবে। আবার সমকালের লেজে লেজ জোড়া দিয়ে যদি পুরাতন সময়ও সেখানে আলো ফেলে, ফেলবে। আমি এমনই ভাবি। না ভুল বললাম, কবিতা যখন লিখি, সে সময় এসব কিছুই মাথায় থাকে না।
সহজিয়া : রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ উপস্থাপনা কবিতাকে বিনষ্ট করে। এ ধরনের একটি মত বহুদিন ধরেই বঙ্গীয় কবিতাবলয়ে প্রচলিত। বিশেষ করে আধুনিকতাবাদীরা এরকম ভেবে থাকেন। আপনার ভাবনা কী?
আলতাফ শাহনেওয়াজ : দেখুন, কবিতাকে কোনো বর্গে ভাগ করতে আমার সায় নেই। আবার ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের প্রতি আমার আস্থাও কম। মনে মনে যত তত্ত্বই আমরা খাঁড়া করি না কেন, দেখবেন যে, দিন শেষে কবিতার কাছে আমরা কিন্তু কবিতাই পেতে চাই। চাই একটা এমন অভিঘাত, যা আমার জীবনকেও একটু দুলিয়ে দেবে, তাই না? একজন কবি কোন চমকপ্রদ পন্থায়, কীভাবে পৃথিবীকে দেখলেন ও বুঝলেন — সেই কথা, তাঁর একান্ত বলার কথাটি কীভাবে তিনি বলেন বা বলবেন, সেটাই আমার কাছে সব সময় প্রধান বিবেচ্য।