গাছের কবিতা

গাছ প্রকৃতির পরম এক অংশ। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় গাছ প্রসঙ্গে অসংখ্য কবিতা লিখিত হয়েছে। কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক মুম রহমান উপহার দিয়েছেন বেশ কিছু অনুবাদ কবিতা।

চিত্রকর্ম : তিনটি গাছ, ১৯৬৩, র‌্যাম্ব্রান্ডট

তৃণলতা এবং বৃক্ষাদি মানিয়া চলে তাঁহারই বিধান। (সুরা আর রাহমান, আয়াত ৬)
এমনকি যে কুঠার তাকে ধ্বংস করে তাকে ছায়া দিতে বন কোন কার্পণ্য করে না। (গৌতম বুদ্ধ)

কে জানে, গাছের সঙ্গে সভ্যতার কোন সংঘর্ষ আছে কি না! কিন্তু আমরা তো দেখি, অবলীলায় গাছ কেটে দালান হয়। গাছ কেটে কাগজ হয়, গাছ পুড়িয়ে ইট হয়। গাছ কমে, কলকব্জা বাড়ে। কিন্তু বুকের ভেতর থেকে কি সবুজের তৃষ্ণা কমে? গাছের কাছে যাওয়ার ক্ষুধা কি কমে?
চোখের কাছে গাছ ছিলো না, তাই একটু ঘুরে এলাম গাছের কবিতার কাছে। এই ভ্রমণের সঙ্গী হোন আপনারাও প্রিয় পাঠক।

 

ওক গাছ
মাৎসু বাসো

ওক গাছটি
আগ্রহী নয়
চেরি ফুল ফোটাতে।

 

মাৎসুও চুমেনো ব্যাসো জাপানের ইদো যুগের সবচেয়ে বিখ্যাত কবি। তার জীবতকাল থেকে আজ পর্যন্ত তিনি হাইকু ঘরাণার অণু কবিতার মহত্তম গুরু হিসাবে স্বীকৃত। জাপানের বহু ঐতিহ্যবাহী স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা ঐতিহাসিক ফলকে তার কবিতা লেখা থাকে। তিনি হাউকুর পাশাপাশি রেন্কু, ধরণের কবিতা লিখেছেন। উল্লেখ্য, হাইকু জাপানের ঐতিহ্যবাহী কবিতার ধরণ। তিন লাইনের এই কবিতায় প্রথম লাইন ও শেষ লাইনে ৫টি সিলেবল এবং মাঝের লাইনে ৭টি সিলেবল থাকে। লাইনগুলোতে অন্তমিল থাকে না। রেনকু বা হাইকাই বা রেনেগা হলো হাস্যরসাত্মক পদ্য। রেনগা নামের জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী কাব্যধারা থেকেই এর জন্ম।

 

যদি ছোটরা নেহাত গাছ হতো
মাহমুদ দারবিশ

গাছটি হলো আরেকটি গাছের বোন কিংবা তার ভালো প্রতিবেশি। বড়জন ছোটজনের প্রতি স্নেহশীল, যতটুকু ছায়া দরকার তা দিয়ে যায়। লম্বাজন স্নেহশীল খাটোজনের প্রতি, তাকে রাতে সঙ্গ দেয়ার জন্য পাখি পাঠায়। কোন গাছ অন্য গাছের ফলকে আক্রমণ করে না আর যদি একটা গাছ নিস্ফলা হয় তবে অন্য গাছেরা তাকে নিয়ে মস্করা করে না। একটা গাছ আরেকটা গাছকে আক্রমণ করে না এবং কাঠুরিয়াকে অনুকরন করে না। যখন একটা গাছ নৌকা হয় তখন সে সাঁতরাতে শিখে যায়। যখন সে একটা দরজা হয় সে তখন গোপনীয়তা সংরক্ষণ করতে থাকে। যখন সে একটা চেয়ার হয় তখন সে তার মাথার উপরে থাকা একদার আকাশকে ভুলে যায় না। যখন সে একটা টেবিল হয়ে ওঠে তখন সে কবিকে কাঠুরিয়া না-হওয়ার শিক্ষা দেয়। গাছ হলো ক্ষমাশীল আর যত্নশীল। সে ঘুমায় না, স্বপ্নও দেখে না, তবে সে স্বপ্নদর্শীর নিগুঢ়তা গচ্ছিত রাখে, দিবারাত্রি দাঁড়িয়ে থাকে পাহারা দেয়, পথিক আর আকাশকে শ্রদ্ধা জানায়। গাছ হলো দণ্ডায়মান উপাসনাকারী, উপরের দিকে নিবেদিত। যখন সে ঝড়ে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে তখনও সে মহিমান্বিতভাবে ঝোঁকে, একজন নানের মতো, চোখ থাকে উর্দ্ধে সদাই। অতীতকালে কবি বলেছিলেন, ‘কেবল তরুণেরা যদি পাথর হতো’। উনার বলা উচিত ছিলো, ‘ কেবল তরুণেরা যদি গাছ হতো!’

 

প্যালেস্টাইনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ আরব বিশ্বের সেরা কবিদের একজন। তাঁর একাধিক কবিতায় প্যালেস্টাইন এসেছে ইডেন বা স্বর্গের প্রতীকে, তিনি সেখান থেকে বিতাড়িত, আবার সেখানে ফিরে যাবেন, এমন উচ্চারণ করেছেন বারবার। তাঁর কবিতা ভীষণ আবেগি এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। তিনি একই সঙ্গে প্রেমিক ও রাজনীতি সচেতন। বহু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি, একাধিক সাহিত্য ম্যাগাজিন সম্পাদনাও করেছেন। তার অসংখ্য কবিতা মার্সেল খলিফ, রিম কেলানি, মাজিদা ইল রুমি, আহমেদ কুবোরের মতো বিখ্যাত আরব সুরকাররা সুর দিয়েছেন। আরবদের কাছে এইসব কবিতা জাতীয় সঙ্গীতের মতোউ উদ্দীপক। মার্কিন এবং সুইস সুরকাররাও তার কবিতা নিয়ে কাজ করেছেন।

 

জানালা
চেস্লাভ মিলোস

যখন আমি ভোরের বেলা জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম আর দেখেছিলাম একটা তরুণ আপেল গাছ
উজ্জলতায় স্বচ্ছ।

 

আর আমি যখন সন্ধ্যায় আবার বাইরে তাকিয়েছিলাম,
একটা আপেল গাছ বোঝাই
ফলের ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

 

হয়তো অনেক বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু আমি
মনে করতে পারি না কিছুতেই আর
আমার ঘুমের মধ্যে কী ঘটেছিলো।

 

নোবেল বিজয়ী পোলিশ কবি চেস্লাভ মিলোস (১৯১১-২০০৪) আমেরিকান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লাভিক ভাষা পড়াতেন। তার জন্ম হয়েছিলো লিথুনিয়াতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামের বিশটি কবিতা লিখে তিনি সবার নজরে আসেন। পরবর্তীতে তিনি কূটনীতিবিদ হিসাবে প্যারিস ও ওয়াশিংটনে চাকরি করে। তার ‘দ্য ক্যাপটিভ মাইন্ড’ শিরোনামের প্রবন্ধ সংকলনটি স্টালিন বিরোধী ক্লাসিক রচনার মর্যাদা পায়। ১৯৮০ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

 

এলম গাছ
লুইজ গ্ল্যুক

সারাদিন আমি পৃথক করতে চেষ্টা করি
কামনা থেকে প্রয়োজনকে। এখন, অন্ধকারে,
আমি কেবল আমাদের জন্য তিক্ত বেদনা অনুভব করি,
আমরা নির্মাতারা, বনের পরিকল্পনাকারীরা,
কারণ আমি দেখছিলাম কেবল
স্থির হয়ে এই এলম গাছগুলোকে
আর দেখছিলাম কী উপায়ে তারা সৃষ্টি করে
এই সব মোচড় পাকানো আকার, অটল গাছ
আছে বেদনায়, আর তারা বুঝতে পেরেছিলো
অন্য কোন আকৃতি নয় তারা কেবল পাকানো আকার তৈরি করবে।

 

লুইজ এলিজাবেথ গ্ল্যুক (১৯৪৩-) বহু পুরস্কারে ভূষিত সমকালের অন্যতম মার্কিন কবি। তিনি ১৯৯৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘দি ওয়াইল্ড আইরিস’-এর জন্য। ২০০৩-২০০৪ সালে আমেরিকার ‘পোয়েট লোরিয়েট’ হয়েছেন। ১৯৯২ সালে ‘ওয়াইল্ড আইরিশ’ ১৯৯৯ সালে ‘ভিটা নোভা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য বিংহাম পোয়েট্রি প্রাইজ এবং দ্য নিউইয়ার্ক বুকস এওয়ার্ড, ২০০৪ সালে ‘ফেইথফুল এণ্ড ভার্চয়াস নাইট’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি। তাকে ২০২০ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে, ‘তার সন্দেহাতীত কাব্যিক কণ্ঠের জন্যে যার তীব্র সৌন্দর্য ব্যক্তির অস্তিত্বকে সার্বজনীন করে তোলে।’ ব্যক্তিগত বিষাদ, সূক্ষ্ম মনোজাগতিক বিশ্লেষণ, পুরাণ- উপকথা-প্রবচন Ñ ইত্যাদি মিলিয়ে তার কবিতা এক ভিন্ন গভীরতা তৈরি করে। তবে এইসব উপকরণের ব্যবহারের পাশাপাশি তিনি ভাষার ক্ষেত্রে সরল এবং প্রাণবন্ত। ফলে তিনি সাবলীল আর স্বচ্ছন্দ শব্দ ব্যবহারে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক বিশ^কে তুলে ধরেন একান্ত দক্ষতায়।

 

বন্ধ্যা কমলা গাছের গান
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা

কাঠুরিয়া,
আমার ছায়াটি কেটে ফেলুন।
আমাকে মুক্ত করুন অত্যাচার থেকে
নিজেকে এই ফলহীন দেখা থেকে।
আমি কেন আয়নার মধ্যে জন্ম গ্রহণ করলাম?
দিনের আলো আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে
তার সব নক্ষত্রপুঞ্জি নিয়ে।
আমি নিজেকে দেখে বাঁচতে চাই না।
আমি স্বপ্ন দেখবো বীজ আর পোকাদের
বদল ঘটবে আমার স্বপ্নেই
আমার পাতা আর পাখিদের ভেতরেই।
কাঠুরিয়া,
আমার ছায়াটি কেটে ফেলুন।
আমাকে মুক্ত করুন অত্যাচার থেকে
নিজেকে এই ফলহীন দেখা থেকে।

 

বিংশ শতকের কাব্য জগতে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬) এক উজ্জ্বল তারকার নাম। স্প্যানিশ এই কবি, নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক গৃহযুদ্ধের শুরুতে ফ্যাসিস্ট বাহিনীর হাতে নিহত হন। এমনকি তার মৃতদেহও আর পাওয়া যায়নি। তার কথিত কবরটিও শূন্য। অথচ লোরকা কবিতাপ্রেমীদের পূর্ণ করে দিয়েছেন অতি অল্প কিছু রচনাতেই। কবিতার পাশাপাশি তার নাট্যত্রয়ী ‘ব্লাড ওয়েডিং’, ‘ইয়ারমা’ এবং ‘হাউজ অব বার্নাডা এলবা’ খুবই আলোচিত।

 

পাম গাছটি
বেট্রল্ট ব্রেখট

গাঁয়ের পথে দাঁড়িয়ে আছে একটা পাম গাছ,
সে বড় ছোট, কারো মানতেই ইচ্ছা করে না।
তার চারপাশে বেড়া আছে,
যাতে কেউ তাকে মাড়িয়ে দিতে না-পারে।
ছোট্ট গাছখানি বাড়তে পারে না,
হ্যাঁ, সে বাড়তে চায়!
কেউ তাকে নিয়ে কথা বলে না,
সে বড় অল্প সূর্যের আলো পায়।

কেউ মানতে চায় না যে এটা একটা পাম গাছ
কারণ এ গাছে একটাও পাম ধরেনি কখনো।
তবু সে একটা পাম গাছ;
তুমি পাতা দেখেই তা বলতে পারবে।

 

ইউজিন বেট্রল্ট ব্রেখট (১৮৩৮-১৯৫৬) নাট্যকার হিসেবেই অধিক পরিচিত হলেও তার কবিতা, তার নাটকের মতো অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তার নাটকেও তিনি প্রচুর কবিতা, গান ব্যবহার করেন। বিশ^ নাটকে নয়া ভঙ্গি ও তত্ত্ব প্রতিষ্ঠাটা বেট্রল্ট ব্রেখট সর্ব অর্থেই একজন প্রতিবাদী চেতনার মানুষ। তার নাটকের দল বার্লিন অঁনসম্বল আজও বিশে^র অন্যতম সেরা নাটকের দল। দেশে বিদেশে অসংখ্য ভাষায় তার ‘দ্য ককেসিয়ান চর্ক সার্কেল’, ‘গুড উইম্যান অব সো’জোয়াইন, ‘দ্য থ্রি পেনি অপেরা’, ‘গ্যালিলিও’ ইত্যাদি মঞ্চস্থ হয়। তার কাব্য সংকলনও বহু ভাষায় অনূদীত হয়েছে।

 

পাতা ও গাছ
এডনা সেন্ট ভিনসেন্ট মিল্যে

কবে তুমি শিখবে, আমার আপন আমি,
একটা জীবিত গাছে মৃত পাতা হতে?
স্ফুটনোন্মুখ, উচ্ছ্বসিত, উদ্ভেদী শক্তি,
সবুজ পরিহিত, তবে দীর্ঘায়িত নয়,
পুষ্টি টানছে হাওয়া থেকে,
অন্য পত্রাবলী আর তুমিও নেই সেথায়,
হয়তো বা অঙ্কুরিত হবে, আর শরতের আহ্বান
করবে পিঙ্গল, ঝরে যেতে তৈরি তো তুমি?
এই কাণ্ডটি কি নিশানা নয়
ছোট্ট আর কম্পিত তোমার ছদ¥বেশের?
শেষপ্রান্তের শাখাগুলি কি ইশারা নয়
প্রজ্ঞা আর সত্য আরোহনের?
আর এই বিশাল অশনি নিমজ্জিত হয়
দেখে পার্শ্বত এক সোনালী চোখে
এক ঝলকে একটি গাছকে, কী দীর্ঘ আর গর্বিত হয়
পত্রগুলোকে মেঘের ছায়া দিয়ে।

 

এইখানে, আমি ভাবি, হৃদয়ের আর্তি:
গাছটি, পাতাটির চেয়ে শক্তিশালী নয়,
দৃঢ় করে তার শেকড় আর ছড়ায় তার চূড়া
আর দাঁড়িয়ে থাকে; তবে দিনের শেষে খর্ব হয়।
সেই হাওয়ার শীর্ষ কেউ উঠতে পারবে না সেথায়।

 

স্বল্প সময়ে নিষ্পেষিত হয়
বাছুরদের দুধ খাওয়ার পথের ধারে।
একটা পাতা সম্ভাব্য উড়ুক্কু ভাবনায় রত,
যে হাওয়াকে শ্রবণ করে আর অপেক্ষা করে তার পালা আসবার
সব কিছুই শেখায় যা একটা গাছ শিখতে পারে।
সময় সেই পেলবতাকে লোহাকাঠ বানাতে পারে।
দীর্ঘতম কাণ্ডটি যা সদা দাঁড়িয়েছিলো,
সময়ে, কোন স্বপ্নকেই না পুষে রেখে,
হামাগুড়ি দেয় শেকড়ের পাশে নিদ্রার তরে।

1 COMMENT

  1. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষ নিধনের সিদ্ধান্তকারীরা যদি এ লেখাটি পড়তো……!

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here