বীজ ।। কিস্তি : ১৫

বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।

 

১৭

মশারির কোণার দিকটায় একটু ছেঁড়া। মাকে বললেই সেলাই করে দেবে। বলবো বলবো করেও বলা হচ্ছে না। অবশ্য এদিক দিয়ে মশা ঢুকে বলে মনে হয় না। ভাঁজের মধ্যেই থাকে। অন্যান্য দিন মশারি খাটাই একেবারে ঘুমানোর আগে আগে। আজকে খাটিয়ে ফেলেছি। ভালো লাগছে না। ইমরানকে এত কথা বলা উচিত হলো কিনা, বুঝতেছি না। ও তো আর বিভাস নয়। ও যদি এখন বলে বেড়ায় এসব। ছেলেদের কাছে শুরুতে প্রেমিকাকে মনে হয় দেবী। সম্পর্ক না-টিকলে বেশ্যা হতে সময় লাগে না। নিজের ওপরে খুব রাগ হচ্ছে। রাগ না, ঘেন্না না, কেমন দেউলিয়া মনে হচ্ছে নিজেকে। কেন ইমরানকে আমার বলতে হবে এসব! ও কে? ওর সঙ্গে আমার কীসের সম্পর্ক! একদম ভালো লাগছে না। এমন কেন হয় আমি বুঝতে পারি না। নিজের ওপরে একদম কন্ট্রোল নেই আমার। বিভাসের মত হলে কতই না ভালো হতো।

: কী করো তুমি?

: পড়ছি। তোমার কী খবর, বলো তো?

: ভালো লাগছে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। কেন জানি খুব কান্না পাচ্ছে আমার।

ও বুঝতে পারে, আমার মন খারাপ। কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি। তবু জিজ্ঞাসা করে না, কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি? কারণ সে জানে, আমি নিজেই তা বলবো। বলবো বলেই ফোন দিয়েছি। আমি বললাম তাকে। ইমরানকে আজ কী কী বলেছি। ইমরান কেমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু জিজ্ঞাসা করছিলো। আমার হাত ধরেছে সে। বলেছে, আমাকে সে ভালোবাসে। সে আমার পাশে থাকবে। আমি তাকে বলেছি তোমার কথা। বলেছি যে, সে ভুল করছে। এমনকি বলেছি যে, বিয়ে করতে যাচ্ছি আমরা। ও বলে, আমার জন্য সে অপেক্ষা করবে।

বললাম, ‘আমার সত্যিই ভুল হয়ে গেছে, বিভাস। মনে হচ্ছে, তাকে এসব-কথা বলা মোটেই উচিত হয়নি আমার।’ বিভাস জানতে চায়, কী ভুল হয়েছে? আমি তার প্রশ্ন বুঝতে পারি না। ও পরিষ্কার করে জানতে চায়, আমি কেন মনে করছি যে, আমার ভুল হয়েছে? ভুল হলে কোথায় হয়েছে? বললাম, ও যদি এখন সবাইকে এসব বলে বেড়ায়! বিভাস হাসে।

: ইনসিকিউর লাগছে?

: ঠিক ইনসিকিউর না। আমি আসলে জানি না। আমার কেমন ভালো লাগছে না। ওকে আমার খুব একটা সুবিধার ছেলে মনে হচ্ছে না।

: যে ভালোবাসে তাকে ভালোবাসতে না-পারলেও ঘৃণা অন্তত কোরো না। কিছু হয়নি। নিশ্চিন্ত থাকো। ইমরানকে আমি চিনি।

 

বিভাসের সঙ্গে কথা আসলে হচ্ছে না। আরও খারাপ লাগতে শুরু করেছে। আসলে এসব কথা আমি বলতে চাইনি। মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে আসলো। কে জানে, হয়তো এগুলোই আমার মনের কথা। নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে। বুঝতে পারছি, ইমরানকে নিয়ে এভাবে চিন্তা করাটা ঠিক হয়নি। আসলে ও খুবই ভালো একটা ছেলে। আমি জানি। মাঝে মাঝে মনে হয়, ওকে নয়, আমি যেন ওর দারিদ্র্যকেই ভয় পাই। বিভাসকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ও যে আমার হাত ধরেছে, তুমি কি কিছু মনে করেছো?’ জবাবে এমন উচ্চস্বরে সে হাসল, আমার কেমন ভয় লাগলো। ঘাঁটালাম না তাকে।

: এখন তোমার কেমন লাগছে?

: আরও বেশি খারাপ। তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

আমার উত্তর শুনে একটু চুপ করে গেল সে। আমি বললাম, ‘হ্যালো, শুনতে পাচ্ছো?’ ও ‘হুম’ বলে জবাব দিল। লাইন কাটে নি।

: একটু চিন্তা করে বলো তো? সত্যিই কি তোমার এই ইচ্ছাটা করছে?

: মানে?

: মানে, আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তোমার?

: এই প্রশ্ন করলে কেন? আমি কি বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলছি?

আসলে ঠিক ওকেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছা করছে, বিষয়টা তা নয়। কথা শুনেই কি সে বাক্যে নিহিত অসাড়তা টের পেয়ে গেছে? সবকিছু এত সহজ তার কাছে? কিন্তু তার প্রশ্ন শুনে সত্যিই মেজাজ খারাপ হয়েছিল আমার। কোনো একটা কিছু জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছা করছে আমার। এখন মনে হচ্ছে মাকে। এখনকার মা নয়, ছোটোবেলার মাকে।

: ইমরান সম্পর্কে যা জানো, বলো, এক এক করে সব বলতে থাকো?

: কেন?

: তোমার মন ভালো করে দিব। যাও। এই তো চাচ্ছো তুমি?

: আগে বলো, আমাকে তুমি ঐ কথা কেন বললে?

: কোন কথা?

: ঐ যে বললে, তোমাকে জড়িয়ে ধরার কথা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলেছি।

বিভাস হাসলো। ও শুধু হাসে। ওর মত হাসতে পারাটা নিশ্চয়ই খুব আনন্দের! ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলেই সব তালগোল পাকিয়ে যায় আমার। হয় রাগ লাগে, নয়তো বাচ্চাদের মত করে কথা বলতে থাকি। অনেক সময় তা-ই বলি, যা বলতে চাই না। নিজেও যা বিশ^াস করি না, বা করতে চাই না। সেগুলোই বলি। এমনি এমনিই বলি।

: তোমার আমার সম্পর্কের রকমটা আলাদা।

: কীসে আলাদা শুনি?

: তুমি জানো।

: না, আমি জানি না। তুমি বলো?

চুপ করে গেল সে। এটা তার উত্তর। মাঝে মাঝে তার এসব চুপ-করা-উত্তরে গাটা আমার একদম জ¦লে। মেজাজ ঠিক রাখা দায়।

সেক্স করার কথা আমি ভাবতে পারি না। গোসল করার সময় তাকে যদি সাবান মেখে দিতে বলি সে দেয় না। তাকে খুঁজে পাই না কোথাও। হ্যাঁ, তাকে আমি মিস করি।

একদিন অফিস শেষে বিভাসকে নিয়ে উত্তরায় ফিরছিলাম। দারুণ একটা দিন ছিলো। কী যে ভালো লাগছিলো বাসে। আবহাওয়াটাও ছিলো চমৎকার। বৃষ্টি হওয়াতে বাইরে ছিল ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা একটা ভাব। চারপাশে জ্বলছিল অসংখ্য আলোর প্রাযুক্তিক জোনাকি। জোনাকিগুলোর একেকটাকে ধরে মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন ঘাড় ভেঙে খুঁটির মাথায় গেঁথে দিয়েছে। পুঁতে রেখেছে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর। এরই নাম শহর। জানালা খুলে দিয়েছিলাম। হু হু করে বাতাস এসে চুল এলোমেলো করে দিচ্ছিলো। উড়নাটা মাথায় জড়িয়ে নিয়েছিলাম হিজাবের মত। ডান পাশে ভ্যানিটি ব্যাগটি রেখে বা-হাতটি রেখেছিলাম বিভাসের হাতে। বিভাসের গা থেকে কড়া কফির গন্ধ আসছিলো। নিশ্চয়ই এই ফ্লেভারের কোনো পারফিউম বাজারে থাকার কথা নয়। তার সবকিছুই কেমন অদ্ভুত। সিটে হেলান দিয়ে ঘুমানোর ভঙ্গিতে পড়ে আছি আমি। খুব ভালো লাগছিলো আমার। বাসে অন্ধকার। চোখ সওয়া অন্ধকার। ভাড়া তোলার সময়, আর যাত্রী নামলেই কেবল আলো জ¦লে। বিভাসের ডান-হাতটা নিয়ে আমি আমার উরুর ওপর রাখলাম। ‘দিয়ার শহরে তোমাকে স্বাগতম।’ বেসামাল স্পন্দনে আমার হৃদয় কেঁপে কেঁপে ওঠল। এই কম্পনধ্বনি তাকে স্বাগত জানালো। আমার শহরে তার প্রবেশের আগমনী বাদ্য। হাতটি সে সরিয়ে নিলো না। হৃদয়ের অভিবাদন সে গ্রহণ করলো। আমার আহ্বানকে সম্মান জানালো বিভাস। চোখ বন্ধ করে আমি অপেক্ষা করছিলাম তার জন্য। প্রতিটা মুহূর্ত আলাদাভাবে আমি অপেক্ষা করছিলাম তার জন্য। প্রার্থনা করছিলাম, এই যাত্রা যেন দীর্ঘ হয়। জ্যামে আটকে থাকুক বাস। ঝুম বৃষ্টি নামুক। নেমে আসুক অন্তহীন অন্ধকার রাত। গভীর রাতে বিভাসের হাত ধরে আমি ফিরতে চাই। বাসার সবাই জানুক আমার চারপাশে এই ছেলেটা একটা ব্যারিকেড তৈরি করে রেখেছে। ভালোবাসার ব্যারিকেড। আমাকে সে মুক্ত রেখেছে সমস্ত প্রতিকূলতা থেকে। সেই মুহূর্তে আমার প্রতিটি কোষের প্রার্থনা ছিলো এই।

 

ফাঁকা রাস্তায় শাঁ শাঁ গতিতে বাস ছুটছে। অন্ধকার রাস্তা। বাসে অন্ধকার। বিভাসের হাতই জ্যামে আটকে রইলো। আমি অপেক্ষা করছি তো করছিই। জ্যাম আর ছাড়ে না। বিরক্তিকর জ্যাম। একবার মনে হলো, ও কি লজ্জা পাচ্ছে? আমি ওর হাতটা আরও গভীরে টেনে নিলাম। ও সরিয়ে নিলো না। ওকে আমি যেখানে রাখলাম, সেখানেই ও পড়ে রইলো। পরে রাগ করে নিজেই সরিয়ে দিয়েছিলাম তার হাত। রাতে একচোট ঝগড়াঝাটি হলো। যখন যা মনে এসেছিলো, তাই বলে ঝগড়া করেছিলাম আমি। জবাবে ও শুধু হেসেছিলো। হাসি দিয়ে সে ঝগড়া করেছিলো আমার সঙ্গে। তার আমার সম্পর্ক সত্যিই আলাদা। সত্যিই তাকে বিয়ে করার কথা আমি ভাবতে পারি না। সেক্স করার কথা আমি ভাবতে পারি না। গোসল করার সময় তাকে যদি সাবান মেখে দিতে বলি সে দেয় না। তাকে খুঁজে পাই না কোথাও। হ্যাঁ, তাকে আমি মিস করি। বিভাসের মতে, এই মিস করা আসলে বিভাসকে মিস করা নয়, যে-কোনো পুরুষকে মিস করা। সে আমার কাছে যে-কোনো পুরুষ নয়। যে-কাজ তাকে ছাড়া হবে না, সেই কাজটুকুই কেবল সে করতে আগ্রহী। বলেছে, আমি তাকে বিয়ে করতে চাইলে, সে করবে। তার কোনো বিশেষ পছন্দ নেই। খুব সাধারণ কোনো মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হবে। সে জানে। যদি জানতে চাই, আমি কি সাধারণ না অসাধারণ? বলে, সাধারণ। তার উত্তর শুনে আমার খুশি লাগে না। নিজেকে সাধারণ ভাবতে কার ইচ্ছা করে? যদি বলি, তুমি সাধারণ না অসাধারণ? চুপ করে থাকে। হাসে। জোর করে ধরলে উত্তর দেয়। বলে, সাধারণ।

 

ইমরানকে নিয়ে যা যা ভাবি, বিভাসকে আমি সব বললাম। গুছিয়ে বলতে পারলাম না। যখন যা মনে এলো, তাই বললাম। বললাম, আমার পরিবারের কথা। বাবা-মার কথা। তাদের ইচ্ছার কথা। আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রতি আমার আকাক্সক্ষার কথা। বললাম, ফেসবুকে দেখা ইমরানের পরিবারের কথা। তাদের দারিদ্র্যের কথা। তাদের দারিদ্র্যকে যে আমি ভয় পাই কেবল এই কথাটা বললাম না। না-বলে কেমন অশান্তি-অশান্তি লাগছিলো। পরে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো পয়েন্ট উল্লেখ করার মত করে তা-ও বলে দিলাম। অবশ্য যতটা গুরুত্ব দিয়ে আমি বললাম। ততটা গুরুত্ব দিয়ে শুনলো না বিভাস। খুব সাধারণ একটা কথার মতই সে গ্রহণ করলো।

: জানো, একটা জিনিস শিখলেই সমস্ত কিছু শেখা হয়ে যায়?

: কী সেটা?

: সত্যিই জানতে চাও?

: হ্যাঁ, চাই। সত্যিই চাই। বলো।

বিভাস বললো, ভালোবাসা। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি কি ভালোবাসতে জানি, বিভাস?’ উত্তরে সে বললো, ‘এ-প্রশ্ন নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে হয়।’ বললাম, ‘তুমি কি জানো? ভালোবাসতে?’ উত্তরে সে চুপ করে থাকলো। বললাম, ‘প্লিজ, আমাকে শেখাও না! শেখাবে?’ উত্তরে সে চুপ করে থাকলো। সবকিছু শূন্যে ঠেস দিয়ে ঝিমাতে লাগলো। মাথার ওপরে শাঁ শাঁ শব্দে অবিরাম ফ্যান ঘুরছে। নাকি বাইরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে! লাইন কেটে গেছে কি? আমার হৃদয়ে ‘হ্যালো’ বলার শক্তিটাও আর অবশিষ্ট নেই।

 

শুনশান একটা জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি আমি। ফ্রক পরে আছি। মাটিতে ঘন-সবুজ পাতলা ঘাস। সারি সারি ধবধবে সাদা ইট পোঁতা। এটা ক্রস। খ্রিস্টানদের গোরস্থান এটা। বাবার হাত ধরে আছি আমি। ‘বিসিএসে টিকতে হলে পড়তে হবে ভালো করে’ বাবা বললো। বললো, ‘খুব ভালো করে দেখো, এক-জায়গায় তো বারবার আসা হবে না।’ আমি খুব মনোযোগ দিয়ে ইটগুলোতে লেখা একেকটা নিয়োগ-বিজ্ঞপ্তি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগলাম। প্রতি সপ্তাহে এখানে নতুন নতুন নিয়োগ-বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। হাসি হাসি মুখ করে কোত্থেকে শিবানি আসলো। ওর বিসিএসে হয়েছে। ও খুব খুশি। লাল শাড়িতে তাকে মহিলাদের মত দেখাচ্ছে। আমার খুব কষ্ট লাগছে যেন আমার সঙ্গে কথাই বলতে চায় না শিবানি। বললাম, পড়লে কার না হয়? ও বললো, বিয়ে করা খুব সহজ। অন্ধকার হলেই বিয়ে করতে মজা। হাত বাড়িয়ে কী একটা এগিয়ে দিলো আমার দিকে। বলল, ‘নে খা!’ নারিকেলের সাদা তক্তি। ধবধবে সাদা। বললো, বাসর রাতে সব মেয়েকেই খেতে হয়। আরও কী কী সে বললো। ফিসফিস করে বললো, ‘জামাই আমাকে গরম গরম জিলাপি খাওয়ায়।’ শিবানির কথা শুনে ভিজতে শুরু করলাম আমি।

 

পড়ুন ।। কিস্তি ১৪

বীজ ।। কিস্তি : ১৪

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here