ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড ।। শেষ কিস্তি

নগুগি ওয়া থিওঙ্গো সাহিত্য ও রাজনীতির দুনিয়ায় চেনা একটি নাম। তাঁর বিখ্যাত বই Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (1986)। ঔপনিবেশিক রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বোঝার দারুণ প্রতিনিধি-পুস্তক এই বই। বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করেছেন শিবলী নোমান। আজ প্রকাশিত হলো শেষ কিস্তি

 

আট

নাইরোবি লিটারেচার ডিবেট ও প্রাসঙ্গিকতার সন্ধান মূলত আজকের পৃথিবীর বড় বড় সামাজিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে মানুষ কোথায় দাড়াবে সে সম্পর্কে এক ধরনের দ্বান্দ্বিকতা। সাম্রাজ্যবাদের যুগে আমরা আসলে কোথায় গিয়ে দাড়াই? অসমতার ভিত্তিতে গঠিত একটি সমাজে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে থাকি? আমরা কি নিরপেক্ষ থাকতে পারি? আমাদের পাঠাগার ও বিদ্যায়তনিক জায়গাগুলোতে জমাট বেঁধে থাকতে পারি? নিজের সাথে বিড়বিড় করতে পারি এই বলে যে, আমি একজন সার্জন মাত্র; আমি একজন বিজ্ঞানী, আমি একজন অর্থনীতিবিদ; অথবা আমি শুধুই একজন সমালোচক, শিক্ষক বা প্রভাষক? টু দ্য স্টুডেন্টস অফ দ্য ওয়ার্কার্স’ অ্যান্ড পিজেন্টস’ ফ্যাকাল্টি কবিতায় ব্রেখট বলছেন :

তোমার বিজ্ঞান হবে মূল্যহীন, তুমি দেখবে

আর শিক্ষা হবে নিষ্ফলা; যদি খোঁজ করো

যদি না তুমি তোমার বোধ ব্যবহার করো

মানবজাতির সকল শত্রুর বিরুদ্ধে।২১

অথবা ড্যানিশ শ্রমিক শ্রেণির প্রতি তাঁর কবিতায় :

আর সেখানেই তোমরা

শ্রমিকের দল, যেহেতু তোমরা শিখো আর শেখাও

সৃজনশীলতার সাথে সকল সংগ্রামে নিজেদের ভূমিকা রাখতে পারো

যা তোমাদের সময়ের মানুষের ভূমিকা, সাহায্য করে

অধ্যয়নের গাম্ভীর্য আর জ্ঞানের আনন্দের মাধ্যমে

সংগ্রামকে সকলের অভিজ্ঞতা ও

ন্যায়বিচারকে অনুরাগে পরিণত করতে।২২

গুয়েতেমালার শহীদ কবি অটো রেনে কাসতিলো যেমন দেখিয়েছেন তাঁর কবিতা অ্যাপলিটিক্যাল ইন্টেলেকচুয়ালস-এ, সেভাবে একদিন যদি আমাদের দেশের সাধারণ নারী-পুরুষ জেগে উঠে ও প্রশ্ন করে যে যখন আমাদের জাতি ধীরে ধীরে শুকিয়ে মরছিল ‘ছোট ও একাকী মিষ্টি এক আগুনের মতো’, যখন তারা প্রশ্ন করবে :

তোমরা কী করছিলে যখন গরিবরা

ভুগছিল, যখন তারা

পুড়ে যাচ্ছিলো

জীবন ও কোমলতাসমেত?২৩

আমরা যারা সাহিত্য, ইতিহাস, কলা, সংস্কৃতি, ধর্ম পড়াই তাদের তখন গর্বের সাথে উত্তর দিতে পারতে হবে। ঠিক ব্রেখটিয় বুদ্ধিজীবীর মতো আমাদের বলতে পারতে হবে যে আমরা সাধারণের জ্ঞানের পর্যায়ে সংগ্রামকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলাম আর চেষ্টা করেছিলাম ন্যায়বিচারকে সকলের অনুরাগে পরিণত করতে।

কিন্তু আফ্রিকায় ভাষা, সাহিত্য, থিয়েটার, কবিতা, কল্পকাহিনী ও বিদ্যায়তনিক পড়ালেখার নতুন দিকের খোঁজ করা আসলে সাম্রাজ্যবাদের নব্য-ঔপনিবেশিক পর্যায়ের বিরুদ্ধে আফ্রিকার মানুষের সামগ্রিক সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

নয়

নাইরোবি লিটারেচার ডিবেট একটি চলমান বিতর্ক। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ আফ্রিকায় এই বিতর্ক বিদ্যমান। এটি বিদ্যমান ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। এশিয়া ও লাতিন আমেরিকাতেও এর অস্তিত্ব রয়েছে। সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা। শিল্পের প্রাসঙ্গিকতা। সংস্কৃতির প্রাসঙ্গিকতা। কোন সাহিত্য, কোন শিল্প, কোন সংস্কৃতি, কোন মূল্যবোধ? এই বিতর্ক একই দেশে বহুসংখ্যক জাতির ভাষার উপস্থিতির বিষয়টিকে কেনিয়ার ক্ষেত্রেও পুরোপুরি সমাধান করতে পারেনি। ১৯৬৮-৬৯ ও ১৯৭৪ সালের কনফারেন্সের অস্থায়ী সমাধানের এবং এই বিতর্কের ভাষিক মাধ্যম এখনও ইংরেজি। অর্থনীতি ও রাজনীতির বৃহৎ পরিসরের বাইরে গিয়ে ভাষার প্রশ্নটিকে সমাধান করা সম্ভব নয়। আমরা কেমন সমাজ চাই তার উত্তর না দিয়েও এই সমাধান সম্ভব নয়।

 

কিন্তু আফ্রিকায় ভাষা, সাহিত্য, থিয়েটার, কবিতা, কল্পকাহিনী ও বিদ্যায়তনিক পড়ালেখার নতুন দিকের খোঁজ করা আসলে সাম্রাজ্যবাদের নব্য-ঔপনিবেশিক পর্যায়ের বিরুদ্ধে আফ্রিকার মানুষের সামগ্রিক সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি এমন এক পৃথিবীর জন্যে সংগ্রামের অংশ যেখানে অন্যের রোগের উপর আমার স্বাস্থ্য নির্ভর করে না; অন্যের জীবাণুবাহী শরীরের উপর আমার পরিচ্ছন্নতা নির্ভর করে না; আর আমার মানবিকতা নির্ভর করে না অন্যের সমাধিস্থ মানবিকতার উপর।

 

১৫০ বছর আগে, বার্লিন কনফারেন্সেরও ৪০ বছর আগে, একজন জার্মান দার্শনিক বুঝতে পেরেছিলেন কিভাবে শ্রমিক ও গরিবদের থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে মানব সম্পর্কগুলোকে প্রভাবিত করা হয় :

আনুগত্য থেকে অনানুগত্য, ভালোবাসা থেকে ঘৃণা, ঘৃণা থেকে ভালোবাসা, সদগুণ থেকে অনাচার, অনাচার থেকে সদগুণ, দাস থেকে প্রভু, নির্বুদ্ধিতা থেকে বুদ্ধিমত্তা এবং বুদ্ধিমত্তা থেকে নির্বুদ্ধিতায় চলাচলে… ভীরু হয়েও যে সাহসিকতা কিনতে পারে সেই সাহসী।২৪

তিনি দেখেছিলেন একটি নতুন বিশ্বের স্বপ্ন যেখানে সম্পর্কগুলোর ভিত্তি চুরি করা সম্পদ নয় বরং মানবিক গুণাবলি যা থেকে আমাদের ভেতরের আরও আরও মানবিক গুণাবলিকে আহ্বান জানানো হয় :

মানুষকে মানুষ আর তার সম্পর্কগুলোকে মানবিক ধরা যাক, তখন আপনি ভালোবাসার বিনিময়েই ভালোবাসা পাবেন, বিশ্বাসের বিনিময়ে বিশ্বাস ইত্যাদি। যদি আপনি শিল্প উপভোগ করতে চান তাহলে আপনাকে একজন শিল্পসচেতন ব্যক্তি হতে হবে। আপনি যদি অন্য মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চান, আপনাকে অন্য মানুষকে উদ্দীপ্ত ও উৎসাহী করে তোলার মতো প্রভাবশালী হতেই হবে। মানুষ এবং প্রকৃতির সাথে আপনার সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিটির থাকতে হবে আপনার প্রকৃত ব্যক্তিগত জীবনের নির্দিষ্ট অভিব্যক্তি, যা আপনার ইচ্ছার সাথে সম্পর্কিত। যদি আপনি ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে না পারেন তাহলে তা হলো দুর্ভাগ্য; কারণ যদি আপনার ভালোবেসে ভালোবাসা থেকে বিপরীত দিক থেকে ভালোবাসা তৈরি না হয়, যদি প্রীতিপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে আপনার জৈবিক অভিব্যক্তি আপনাকেও একজন প্রীতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিতে পরিণত না করে, তাহলে বলতেই হয় যে আপনার ভালোবাসা আসলে নির্বীজ।২৫

কথাগুলো ভ্যাটিকানের কোন জার্মান পোপ নয় বরং ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে বলেছিলেন কার্ল মার্ক্স। আর তিনিই আরেকটি দ্বান্দ্বিকতা ছুড়ে দিয়েছিলেন সকল বিদ্বজ্জন, সকল দার্শনিক, সকল পণ্ডিত ও আর সকলের প্রতি যারা তাদের ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ভেতর থেকে বিশ্বকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন।

দার্শনিকগণ আজ পর্যন্ত পৃথিবীকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন :

মূল বিষয় হলো, একে কিভাবে বদলানো যায়।২৬

একে পরিবর্তন? এর অর্থ হলো আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার ‘দুর্দশাগ্রস্ত পৃথিবী’-র মানুষের সেই লক্ষ্যের সাথে ছন্দবদ্ধ থাকা যার মাধ্যমে তারা সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক কিংবা এর চেয়ে বেশি সূক্ষ্ম কিন্তু দুর্বিনীত নব্য-ঔপনিবেশিক ধরন থেকে মুক্ত এক নতুন অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক বিন্যাসের জন্যে সংগ্রামে রত। এটি হলো সকল গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শক্তির আজকের পৃথিবীকে বদলের হৃদয়ানুভূতি যা একদা বর্ণিত হয়েছিল ব্রেখটের স্পিচ টু ড্যানিশ ওয়ার্কিং-ক্লাস অ্যাক্টরস অন দ্য আর্ট অব অবজার্ভেশন কবিতায় :

আজ সর্বত্র, শততলাবিশিষ্ট শহরগুলো থেকে

সাগরের উপর, দাগ কেটে যাওয়া মানুষ ভর্তি জাহাজ

একাকী গ্রামগুলো পর্যন্ত, ছড়িয়ে গিয়েছে সেই কথা যে

মানব সভ্যতার ভাগ্য একমাত্র মানুষেরই হাতে। আর তাই

আমরা এখন তোমাদের জিজ্ঞেস করি, আমাদের সময়ের

পাত্ররা – প্রত্যাখ্যানের সময় ও সীমাহীন ওস্তাদি

পুরো প্রকৃতির, এমনকি মানুষের নিজেরও – অবশেষে

তোমাদের নিজেদের বদলের ও আমাদের মানবসভ্যতার বিশ্বকে দেখানোর

এটি আসলে যেমন: মানুষের দ্বারাই তৈরি আর পরিবর্তনের জন্যে প্রস্তুত।২৭

জাতীয়, গণতান্ত্রিক ও মানব মুক্তি; আফ্রিকান সাহিত্যের ভাষার রাজনীতি নিয়ে এই বই আসলে এসব বিষয়েই লেখা। আমাদের ভাষা পুনরাবিষ্কার ও পুনরারম্ভের আহ্বান হলো মুক্তির দাবিতে অবিচল আফ্রিকা ও বাকি বিশ্বের লাখো বিপ্লবী ভাষার ভেতর আত্মিক পুনর্সংযোগের আহ্বান। এটি হলো মানবসভ্যতার প্রকৃত ভাষার পুনরাবিষ্কারের আহ্বান, যা হলো সংগ্রামের ভাষা। এই ভাষাই হলো সার্বজনীন ভাষা যা আমাদের ইতিহাসের সকল ধ্বনি ও শব্দে প্রোথিত। সংগ্রাম। সংগ্রাম ইতিহাস তৈরি করে। সংগ্রাম আমাদের তৈরি করে। সংগ্রামের ভেতরই রয়েছে আমাদের ইতিহাস, আমাদের ভাষা আর আমাদের সত্তা। এই সংগ্রাম শুরু হয় আমরা যেখানে আছি সেখান থেকেই; আমরা যা করি তার ভেতরই; আর তারপর আমরা সেই লাখো মানুষের অংশে পরিণত হই একদা মার্টিন কার্টার যাদের দেখেছিলেন স্বপ্ন দেখার জন্যে না ঘুমিয়ে বরং পৃথিবীকে বদলে দেয়ার জন্যে স্বপ্ন দেখতে।

 

টীকা ও সূত্র

২১ ব্রেখট, কালেক্টেড পয়েমস, মিথুইন সংস্করণ, পৃ. ৪৫০, টু দ্য স্টুডেন্টস অব ওয়ার্কার্স’ অ্যান্ড পিজেন্টস’ ফ্যাকাল্টি, ৫-৮ —লেখক

২২ পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৮, স্পিচ টু ড্যানিশ ওয়ার্কিং-ক্লাস অ্যাক্টরস অন দ্য আর্ট অব অবজার্ভেশন, ১৬০-৬ —লেখক

২৩ পুরো কবিতাটি পাওয়া যাবে রবার্ট মার্কেজ সম্পাদিত ল্যাটিন আমেরিকান রেভোল্যুশনারি পোয়েট্রি, নিউ ইয়র্ক ও লন্ডন, ১৯৭৪ —লেখক

২৪ কার্ল মার্ক্স, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি, ১৮৪৪ —লেখক

২৫ পূর্বোক্ত —লেখক

২৬ কার্ল মার্ক্স, ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিস নাম্বার ১১ —লেখক

২৭ ব্রেখট, কালেক্টেড পয়েমস, মিথুইন সংস্করণ, পৃ. ২৩৪, ৩৫-৪৩ —লেখক

 

পড়ুন ।। কিস্তি ১৫

ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড ।। কিস্তি : ১৫

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here