গত ১৩ মার্চ, মতান্তরে ১৪ মার্চ ছিল কবি জসীমউদ্দীনের মৃত্যুদিবস। তাঁর কবিতা ও কাব্যভাষার স্বাতন্ত্র্য ও সৌন্দর্য প্রসঙ্গে লিখেছেন এ সময়কার অনুসন্ধানী গবেষক ও প্রাবন্ধিক কুদরত-ই-হুদা।
জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) বাংলা কবিতার ইতিহাসে যা-যা দিয়ে একটা স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছেন তার মধ্যে নিজস্ব একটা কবিভাষা অন্যতম। নিজস্ব কবিভাষা খুব কম কবির থাকে। অথবা বলা যায়, নিজস্ব কাব্যভাষা ছাড়া কেউ বড় কবি হন না। কাব্যভাষা হচ্ছে একজন কবির ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্বের গুণেই একজন কবির কবিতা কানে গুঞ্জরণ তুললেই অথবা রসনায় উঠলেই কান ও রসনা স্বাতন্ত্র্যে সাড়া দিয়ে ওঠে। শুধু সাড়া নয়, মাথার মধ্যে, আস্বাদনের অনুভূতির মধ্যে, ওই নির্দিষ্ট কবির অবয়বকে মূর্ত করে তোলে। জসীমউদ্দীনের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য। তাঁর যে-কোনো কবিতা নাকের কাছে নিলেই কবিতার ভাষার মধ্যে এমন একটা আলাদা মৌ-মৌ গন্ধ থাকে যে, যে-কেউ বলতে পারে, এ তো জসীমউদ্দীনের কবিতা!
কাব্যভাষার স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি কেবল আধুনিক যুগের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সাথে যুক্ত নয়। বরং এটি জড়িত কবির উচ্চারণের স্বাতন্ত্র্যের সাথে। জীবনকে দেখার ভঙ্গির সাথে। ভাষা দর্শনের সাথেও সম্পর্কিত বটে। ফলে মধ্যযুগ, যাকে আমরা বলি সবার একইরকম ভাবনার যুগ, সেই মধ্যযুগের কবিদের মধ্যেও কাব্যভাষায় বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করা যায়। ষোড়শ শতাব্দীর মঙ্গলকাব্য ধারার কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্যভাষা আর সপ্তদশ শতকের রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারার কবি আলাওলের কাব্যভাষার মধ্যে ব্যাপক ফারাক। এই পার্থক্য কেবল কালগত আর বিষয়গত নয়; ভাষা, জীবন সম্পর্কিত বোধ আর ঝোঁকের পার্থক্যও বটে। একইভাবে আলাদা করে দেখানোর প্রয়োজন হয় না আলাওল, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, দৌলত উজির বাহরাম খাঁ আর ভারতচন্দ্রের কাব্যভাষাকে। কিন্তু আলাদা করা দুরূহ হয়ে পড়ে পুঁথিসাহিত্যের একজন কবির কাব্যভাষা থেকে একই সাহিত্যধারার আরেকজন কবির কাব্যভাষাকে। একারণে সেখানে কাব্যিক ব্যক্তিত্ব সাধারণত কেউ খুঁজতে যায় না। সেখানে সবার দৃষ্টি থাকে কাহিনির জমজমাট আয়োজনের মধ্যে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)-কে যদি তাঁর সমকাল বা পরের অন্য কোনো কবিদের থেকে অন্য কোনো কিছুতে আলাদা করা না-ও যায়, তবুও কাব্যভাষার দিক থেকে অবশ্যই আলাদা করা যাবে। মাইকেল বাংলা কবিতার ইতিহাসে তাঁর বিরাট কাব্যপ্রতিভার পাশাপাশি একটি স্বতন্ত্র কাব্যভাষার জন্যই হয়ত ব্যক্তিত্ববান হয়ে থাকবেন। মাইকেলের মতো জসীমউদ্দীন সম্পর্কেও আমরা একই কথা বলতে পারি। কিন্তু কোন বিশেষ ভাষাবৈশিষ্ট্য জসীমউদ্দীনকে বাংলা কবিতার ইতিহাসে আলাদা করেছে তার খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা থাকবে এই লেখায়। প্রয়োজনে ইতিহাসের আলো-আঁধারিতেও প্রবেশ করব মাঝে-মধ্যে।
ভাষার দিক থেকেও তিনি এতকালের সংস্কৃতের কৃত্রিমতার জগদ্দল পাথরকে ঠেলে পাশে সরিয়ে রেখেছেন। ডুব দিয়েছেন ‘প্রাকৃতের’ মুক্তার সাগরে।
এক
জসীমউদ্দীনের কাব্যভাষার বিশেষত্ব বোঝার জন্য আমাদের যাওয়া দরকার একটু পেছনে। অন্তত ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতে, প্রয়োজনে আরো আগে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলা ভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্য বাংলা বিভাগ খোলা হলো ১৮০১ সালে। সেই বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হলেন ভারতে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রসার ঘটাতে আসা ইংরেজ পাদ্রি উইলিয়াম কেরি (১৭৬১-১৮৩৪)। তাঁর অধীনে বাংলা বিভাগে নিযুক্ত হন আট জন পণ্ডিত-মুন্সি। এসব পণ্ডিত-মুন্সিকে বলা হলো শিক্ষার্থীদের জন্য টেক্সট লিখতে। এবং বলা হলো, অবশ্যই এসব টেক্সট লিখতে হবে গদ্যে। কারণ, এতকাল বাংলা ভাষায় সাহিত্য পদবাচ্য যাকিছু রচিত হয়েছে তার সবই হয়েছে পদ্যে। অর্থাৎ কবিতার আঙ্গিকে।১
একথা সবারই জানা যে, যেকোনো ভাষার কবিতা রচিত হয় ওই ভাষার সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত রূপের মধ্যে। কবিতার ভাষা সব সময় ইশারায় কথা বলে। ছন্দের শাসন আবশ্যিকভাবে শব্দের ও বাক্যের ভাঙচুর আর কাটছাঁটকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। কবিতার স্বভাবই ছোট জায়গার মধ্যে বড় কথা বলা। একারণে কবিতা নিজভাষার মানুষের কাছেও অনেক সময় আপাত দুর্বোধ্যতার ধোঁয়াশা তৈরি করে। ফলে অন্য ভাষার মানুষের পক্ষে কবিতা পড়ে ভাষা শেখা প্রায় অসম্ভব। অন্য ভাষার মানুষের ভালোভাবে কোনো ভাষাকে বাগে আনার জন্য সব সময় দরকার হয় ওই ভাষার একটা বিধিবদ্ধ রূপ। এই বিধিবদ্ধ রূপ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় আনুষ্ঠানিক (formal) গদ্যে। একারণে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের বলা হলো গদ্যে বই লেখার জন্য।
কিন্তু শুধু গদ্য হলে তো আর চলবে না। এর মধ্যেও ফ্যাকড়া আছে। কারণ, মৌখিক ভাষার কাছাকাছি যে বাংলা গদ্য ষোড়শ-সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে গড়ে উঠেছে সে তো খুব বেয়াড়া, চটুল; ইংরেজদের ভাষায় ‘অশুদ্ধ’। ইংরেজের পক্ষে আয়ত্তে আনা খুবই দুষ্কর। তার গতিবিধি বড় অস্থির। ফলে, ফোর্ট উইলিয়াম থেকে প্রকাশিতব্য বাংলা গ্রন্থগুলো কোন গদ্যে লিখিত হবে সে এক বড় সমস্যার ব্যাপার। কিন্তু সমস্যা খুব একটা হলো না। কারণ, ইংরেজ সাহেবরা ইতোমধ্যে সংস্কৃত নামক এক ভাষা ‘আবিষ্কার’ করে ফেলেছেন। সংস্কৃতভাষার ধ্রুপদি গ্রন্থগুলোর পঠন-পাঠন, এ-বিষয়ক বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান উৎপাদন, সংস্কৃত ঘেঁষা অভিধান রচনা, সংস্কৃত ব্যাকরণের ছাঁচে ফেলে বাংলা ব্যাকরণ রচনা, গ্রিক ও ইংরেজির সাথে সংস্কৃত ভাষার সম্পর্ক আবিষ্কার এবং মুদ্রণ সংস্কৃতির প্রচলনের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতের আধিপত্যকে এরই মধ্যে মোটামুটি স্থায়ী রূপ দিয়ে ফেলেছেন। শুধু তাই নয় এ-বিষয়ক সম্মতি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে আঠারো শতকের শেষাংশেই ইংরেজ সাহেবরা সংস্কৃত ভাষাচর্চার এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন। (মোহাম্মদ আজম ২০১৪ : ১৩৪-১৩৫) ফলে, বাংলা গদ্যকে ইংরেজ অফিসারদের কাছে আরো কাঠামোবদ্ধ করার জন্য বাংলার ভেতরে সংস্কৃত ভাষার নানা খাচলত আর শব্দকে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। (সুকুমার ২০০৪ : ১৫৩) কারণ, ইংরেজরা আগেই লক্ষ করেছিল যে, মৌখিক বাংলা ভাষার চেয়ে সংস্কৃত নামক ভাষাটি খুবই বিধিবদ্ধ। এজন্য নিয়োগও দেয়া হয়েছিল মূলত সংস্কৃত-জানা পÐিত-মুন্সিদের। এঁদের অনেকের বাংলায় ভালো দখলই ছিল না। ফলে, এই পণ্ডিত-মুন্সিরা বাংলা গদ্যের শুরুতেই যতটা বাংলা করলেন তারচেয়ে বেশি করলেন সংস্কৃত।২ এতে বাংলা ভাষা বা গদ্য ‘বিধিবদ্ধ’ হলো, ইংরেজদের শেখার উপযোগী হলো। কিন্তু বাংলা ভাষার মূল স্বভাব থেকে তা অনেক দূরে সরে গেল। শুধু গদ্য কেন, বাংলা কবিতাও ভাষার ওই সংস্কৃতশাসিত রূপটাকেই মান্য করে পরবর্তী সময়ে চলতে থাকল। বাংলা ভাষার এই আদিপাপকে — রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন original sin — অনেকেই শনাক্ত করেছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই। প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩), কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০), শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯২৮), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) প্রমুখ রীতিমতো বিদ্রোহ করলেন উপনিবেশের কোলের মধ্যে থেকে বেড়ে ওঠা এই বাংলার বিরুদ্ধে।৩ পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)-ও কবিতা লিখতে গিয়ে উপলব্ধি করলেন যে, তাঁর ভাবের চালচলন আর ভাষার চলনবলন ঠিক মিলছে না। তাঁর ভাব যতটা প্রাকৃত কবিতার প্রচলিত ভাষাকাঠামোটি ততটাই সংস্কৃতশাসিত। তিনি সহজেই টের পেলেন, এই ভাষাটা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত-মুন্সিরা সংস্কৃতের ল্যাবরেটরিতে হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে বানিয়ে তুলেছেন। কিন্তু ততদিনে বাংলা ভাষার ওই রূপটি এতটাই পোক্ত হয়ে গিয়েছে৪ যে, এর কাছে নতি স্বীকার করা ছাড়া অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকই বিকল্প বের করতে পারেননি। অথবা বলা ভালো চাননি। হাতে গোনা দু-চারজন বিকল্প বের করলেও সেই বিকল্পকে ‘উন্নত রুচির অনুকূল নয়’ বলে কলকাতার ‘উন্নত রুচির’ উপনিবেশিত মনের বাবু-সাহিত্যিক-সমাজ গ্রহণ করেননি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসামান্য প্রতিভা দিয়ে ওই উপনিবেশায়নের শিকার বাংলা ভাষাটিকেই পিটিয়ে-পুটিয়ে যতটা সম্ভব স্থিতিস্থাপক আর গ্রহিষ্ণু করে নিলেন। নিজের কাজ চালানোর মতো একটা প্রাইভেট পথ তৈরি করে নিলেন। তিনি যেমন বাঁধানো পথকে মেনেছেন আবার কোথাও কোথাও তার তোয়াক্কাও করেননি। একারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্য অনেক কারণের মতো বাংলা ভাষাকেও পরিশোধন আর যেকোনো ভাবের প্রকাশক্ষম করার জন্য চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু বাংলা গদ্য আর কবিতার ভাষার ইতিহাস মোটাদাগে ওই সংস্কৃতশাসিত রূপকেই মান্য করে পথ চলেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত গ্রন্থের এই মান্য-বাংলাকে ‘সংস্কৃত বাংলা’ বলেছেন। (রবীন্দ্রনাথ ১৪০২ : ২৩৯-২৪০) সংস্কৃত শব্দবহুল আড়ষ্ট ক্রিয়াপদের এই সাধুভাষাকে অসৎ উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ এও বলেছেন যে, ‘মাতৃভাষাকে সে প্রবঞ্চনা করেছে’। (রবীন্দ্রনাথ ১৪০২ : ২৬৯) ভাষার এই পথচলায় বাংলা কবিতার কবিদের খুব একটা সমস্যা হয়নি। কারণ, অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক উপনিবেশিত চিন্তা আর রুচির কারখানায় মনমগজে বেড়ে উঠেছেন। ফলে, ঔপনিবেশিক রুচির একটা ভাষাভঙ্গি, যা ইতোমধ্যে ‘এলিট ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে এসেছে, তাতেই তাঁদের কাব্য-কবিতার চাষাবাদ চলেছে। এই প্রতাপশালী, এলিট ও মান্য-ভাষাটি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলদের হাতে নাড়াচাড়া খেলেও প্রথম ব্যাপক ধাক্কা খেল জসীমউদ্দীনে এসে। তিনি জীবনবোধ আর সাহিত্যরুচির ক্ষেত্রে ইউরোপ-আগত জীবনবোধ ও সাহিত্যরুচিকে মাথায় তোলেননি। ভাষার দিক থেকেও তিনি এতকালের সংস্কৃতের কৃত্রিমতার জগদ্দল পাথরকে ঠেলে পাশে সরিয়ে রেখেছেন। ডুব দিয়েছেন ‘প্রাকৃতের’ মুক্তার সাগরে।
দুই
জসীমউদ্দীন তাঁর কবিতায় উপনিবেশায়নের শিকার তৎসম শব্দবহুল বাংলার পরিবর্তে তদ্ভববহুল ‘প্রাকৃত বাংলা’ ব্যবহারে অধিক মনোযোগী হয়েছেন।৫ তদ্ভব শব্দের এমন বহুল আর অনায়াস ব্যবহার তাঁর আগে বাংলা কবিতায় খুব কম হয়েছে। একটু ঠোঁট কাঁটার মতো বললে বলতে হবে, কম হয়েছে নয়, হয়-ই-নি। শুধু তদ্ভব বলি কেন, আঞ্চলিক শব্দের হামেশা ব্যবহারেও জসীমউদ্দীনের কবিতা বিশিষ্ট। তাঁর কবিতা তদ্ভব আর আঞ্চলিক শব্দের অপূর্ব লীলাক্ষেত্র। আদতে মূলধারার সাহিত্যিক ভাষা সবসময় তার শক্তিটি কিন্তু সঞ্চয় করে থাকে আঞ্চলিক শব্দভাণ্ডার থেকে। বড় কবি আঞ্চলিক শব্দের ভাণ্ডার থেকে বিচিত্র শব্দকে মুক্ত করে তাকে পংক্তিভাজন করেন। এতে সাহিত্যিক ভাষার শেকড়-বাকড়ে রসসঞ্চারিত হয়। সাহিত্যিক ভাষা তাকত লাভ করে। বড় কবিরা এভাবে ভাষাকে নিষ্প্রাণতা থেকে বাঁচিয়ে তোলেন। একথা সাহিত্যের পাঠক মাত্রই জানেন যে, মাইকেল থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত, এমনকি নজরুলও, তাঁদের লেখায় অভাবিতভাবে বিচিত্র আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার করেছেন। আঞ্চলিক ভাষা হচ্ছে একটা ভাষার মজুতকৃত রসদ। বাংলা কবিতায় এই রসদের যিনি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন তিনি জসীমউদ্দীন। অন্য যাঁরা এই রসদের ব্যবহার করেছেন তাদের অবস্থা অনেকটা ‘মাঝে মাঝে গেছি আমি ওপাড়ার ধারে’র মতো। কিন্তু জসীমউদ্দীন ভাষাচেতনার দিক থেকে ‘ওপাড়ার’ই লোক।
বাংলা ভাষা ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে-কাঠামোপ্রাপ্ত হয় সেই ভাষাকাঠামোর সাথে উপনিবেশিত সাহিত্যিককুলের ভব্যতার বা শ্রেণিচেতনার একটি বিষয় ক্রমে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। একথা আগেই বলা হয়েছে। ফলে, এই শ্রেণিটি ভাষার ‘উন্নত’ রূপের সাথে খুব একটা আপোশ করতে চাননি। ওই বিশেষ ভাষারূপের বাইরে আঞ্চলিক ও মৌখিক শব্দসমাহারে গঠিত ভাষাকে তারা ভাষার ‘অবনমন’ বা ‘পতন’ বলে মনে করতেন। নিজেকে ঘৃণার অপর নাম ঔপনিবেশিক মন। একারণে প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাষাকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪)-সহ সংস্কৃতবাদী আধুনিক শিক্ষিতরা প্রায় সবাই মনে করতেন ‘অশ্লীল’, ‘অসুন্দর’, পিতাপুত্রে একত্রে পড়ার অনুপযোগী। (বঙ্কিমচন্দ্র ১৪১৭ : ৩২১/২) জসীমউদ্দীন বাংলা ভাষা সম্পর্কিত ওই শ্রেণিচেতনাকে একপ্রকার ভেঙে দিয়েছিলেন। তাঁর কাব্যভাষায় তদ্ভব আর আঞ্চলিক শব্দের অতিরিক্ত আস্কারাই বাংলা কবিতার ‘মূলধারার’ ভাষার শ্রেণিচেতনায় আঘাত করেছে। বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ তদ্ভব শব্দের সাথে আঞ্চলিক শব্দের মিশ্রণে ভিন্ন জাতের ও শ্রেণিচেতনার কাব্যভাষা বাংলা কবিতায় জসীমউদ্দীনের বড় অবদান। উদাহরণ দেখা যাক :
চৈত্র গেল ভীষণ খরায়, বোশেখ রোদে ফাটে,
এক ফোঁটা জল মেঘ চোঁয়ায়ে নামল না গাঁর বাটে।
ডোলের বেছন ডোলে চাষীর, বয় না গরু হালে,
লাঙল জোয়াল ধুলায় লুটায় মরচা ধরে ফালে।
কাঠ-ফাটা রোদ মাঠ বাটা বাট আগুন লয়ে খেলে,
বাউকুড়াণী উড়ছে তারি ঘূর্ণী ধূলি মেলে।
মাঠখানি আজ শূনো খাঁ খাঁ, পথ যেতে দম আঁটে,
জন্-মানবের নাইক সাড়া কোথাও মাঠের বাটে;
শুক্নো চেলা কাঠের মত শুক্নো মাঠের ঢেলা,
আগুন পেলেই জ্বলবে সেথায় জাহান্নামের খেলা।
দর্গা তলা দুগ্ধে ভাসে, সিন্নী আসে ভারে;
নৈলা গানের ঝঙ্কারে গাঁও কান্ছে বারে বারে। (জসীম ২০১৭ : ১৯)
চৈত্রের গ্রামের বর্ণনা এটি। বর্ণনার ভাষার মধ্যে এইভাবে যথেচ্ছ আঞ্চলিক আর তদ্ভব শব্দের ব্যবহারের মধ্যেই জসীমউদ্দীনের নিজস্ব স্বাক্ষরটি লুকিয়ে আছে। এই ভাষাই জসীমউদ্দীন। এই ভাষার অনুপস্থিতিই পল্লী নিয়ে লেখা অপরাপর কবিদের থেকে জসীমউদ্দীনকে আলাদা করেছে। অন্যদের বিষয়ানুষঙ্গ গ্রামীণ কিন্তু ভাষাটি রাবীন্দ্রিক বা পরিশোধিত। অথবা বলা যায়, অন্যরা ভাষাকে ‘উন্নত’ স্তর থেকে খুব বেশি মাটিতে নামিয়ে আনার ঝুকি নেননি। অথবা পারেননি। কিন্তু জসীমউদ্দীন নিয়েছিলেন এবং পেরেছিলেন। ফলে, তাঁর ভাষার মধ্যে দেখা দিয়েছে একটা অনায়াস ভঙ্গি আর গতি।৬ জসীমউদ্দীনের কবিতার এই গুণকেই কি রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করে বলেছিলেন সহজভাবে কবিতা লেখার ক্ষমতা! তাই হবে হয়ত। কারণ, ভাষাই তো বিষয়ের এমন অনাড়ম্বর প্রকাশকে সম্ভব করে তুলেছে। এই গুণ জসীম অর্জন করেছিলেন, গ্রাম্য কবিদের কাছ থেকে, যাদের কবিতার শেকড় গাড়া আছে মূলত পল্লীর আঞ্চলিক আর মৌখিক ভাষার শব্দভাণ্ডারের মধ্যে।
জসীমউদ্দীনের কবিতায় আঞ্চলিক ভাষার শব্দ ও তদ্ভব শব্দের ব্যাপকভিত্তিক ব্যবহারকে অনেকে পল্লী নিয়ে কাজকারবার করার ফল বলে মনে করেন। তা তো বটেই। কারণ, বিষয় ভাষাকে বেশ খানিকটা প্রভাবিত করে। কিন্তু এই প্রভাব উপরিতলের প্রভাব। কবিভাষার ব্যাপারটা এত সরল নয়। অন্তত আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসের গতিবিধির ওপর নজর রাখলে জসীমউদ্দীনের কবিতায় এই ধরনের শব্দব্যবহারের তাৎপর্যটি বোঝা যাবে।
রুচি, ভাষা, হৃদয়ের কথা — সবদিক থেকেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছিল অনুপস্থিত। এবিষয়ে জসীমউদ্দীন ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন। এই শ্রেণিকাণ্ডজ্ঞানের বিষয়টি জসীমউদ্দীনের নানা কবিতায় বিচিত্র জায়গায় উঠেও এসেছে।
তিন
আধুনিক বাংলা কবিতা মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রায় একক আধিপত্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। এই কবিতার উৎপাদক, ভোক্তা, বোদ্ধা, রসগ্রাহী সবই ওই ইংরেজ উপনিবেশের আনুকূল্যে গড়ে ওঠা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাথে জড়িত। এই কবিতার সাথে, বলা ভালো, সমগ্র সাহিত্যধারার সাথে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক কোনো কালেই ছিল না। কারণ, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার রেনেসাঁস যাকে বলা হয়, সেই রেনেসাঁসের আলো তো সবার ওপর পড়েনি। এই আলো ও আলোকায়নেরও একটা শ্রেণিচরিত্র ছিল।৭ এটা অনেকটা ছিল বাতির নিচে অন্ধকারের মতো।৮ এই অন্ধকারের পরিধিকে যারা বাড়িয়ে তুলেছিলেন তারা বাংলার সিংহভাগ মানুষ; গ্রামীণ ‘অশিক্ষিত’ মানুষ। ফলে, স্বভাবতই ওই ‘আলোকায়নের’ দীপ্তিতে ক্ষুদ্রবৃত্তের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির সমবায়ে ইউরোপীয় শিক্ষাদীক্ষা থেকে পাওয়া রুচির একটা কাঠামো দাঁড়িয়েছিল। সেখানে এই সিংহভাগ মানুষের কোনো প্রবেশাধিকার এবং স্বত্ব কোনোটাই ছিল না। রুচি, ভাষা, হৃদয়ের কথা — সবদিক থেকেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছিল অনুপস্থিত। এবিষয়ে জসীমউদ্দীন ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন। এই শ্রেণিকাণ্ডজ্ঞানের বিষয়টি জসীমউদ্দীনের নানা কবিতায় বিচিত্র জায়গায় উঠেও এসেছে। লক্ষ করা যাক গ্রামের ‘অশিক্ষিত’, ‘আলোকায়ন’ থেকে দূরে থাকা এক রাখাল এবং তার বেদনাকে কীভাবে তিনি আলাদা করলেন শিক্ষিত ও ‘আলোকায়নের’ দ্যুতিপ্রাপ্তদের থেকে :
মাঠের রাখাল, বেদনা তাহার আমরা কি অত বুঝি?
মিছেই মোদের সুখ-দুখ দিয়ে তার সুখ-দুখ খুঁজি।
আমাদের ব্যথা কেতাবেতে লেখা, পড়িলেই বোঝা যায়;
যে লেখে বেদনা বে-বুঝ বাঁশীতে কেমনে দেখাব তায়?
অনন্তকাল যাদের বেদনা রহিয়াছে শুধু বুকে,
এ দেশের কবি রাখে নাই যাহা মুখের ভাষায় টুকে;
সে ব্যথাকে আমি কেমনে জানাব? তবুও মাটিতে কান;
পেতে রহি যদি কভু শোনা যায় কি কহে মাটির প্রাণ!
মোরা জানি খোঁজ বৃন্দাবনেতে ভগবান করে খেলা,
রাজা-বাদশার সুখ-দুঃখ দিয়ে গড়েছি কথার মেলা।
পল্লীর কোলে নির্ব্বাসিত এ ভাইবোনগুলো হায়,
যাহাদের কথা আধ বোঝা যায়, আধ নাহি বোঝা যায়;
তাহাদেরই এক বিরহিয়া বুকে কি ব্যথা দিতেছে দোল,
কি করিয়া আমি দেখাইব তাহা কোথা পাব সেই বোল?
— সে বন-বিহগ কাঁদিতে জানে না, বেদনার ভাষা নাই,
ব্যাধের শায়ক বুকে বিঁধিয়াছে জানে তার বেদনাই। (জসীম ২০১৭ : ৩৪)
কবিতাংশে জসীমউদ্দীন বিনয়বশত নিজেকে ‘মূলধারার’ অর্থাৎ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কবিদের কাতারে দাঁড় করিয়ে তাঁর যুক্তিগুলোকে খাড়া করেছেন। তিনি খুব সুস্পষ্টভাবে বলতে চেয়েছেন ‘তাহাদের’ অর্থাৎ রাখালদের সুখ-দুঃখের বোলের সাথে ‘আমাদের’ অর্থাৎ শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির কেতাবের সুখ-দুঃখের বোল বা ভাষার কোনো মিল নেই। আমাদের কেতাবের ভাষা রাজা-বাদশার সুখ-দুঃখের ভাষা। এই কেতাব-পুঁথি থেকে পল্লীর ‘অশিক্ষিত’ ভাইবোনদের নির্বাসিত করা হয়েছে। সুতরাং জসীমউদ্দীন কাব্যের ‘বোল’ বা ভাষার দ্বৈততা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল থেকেই কাব্যরচনায় মনোনিবেশ করেছেন। তিনি দাবি করেননি যে, তিনি সম্পূর্ণভাবে এই কাজটি করতে পেরেছেন। তবু, তিনি ‘মাটিতে কান পেতে’ সেই ভাষাটি বোঝার চেষ্টা করেছেন। এই চেষ্টাই জসীমউদ্দীনকে কাব্যভাষার দিক থেকে এবং এর রাজনীতির দিক থেকে আলাদা করেছে। ফলে, জসীমউদ্দীনের কাব্য-কবিতায় প্রচুর তদ্ভব আর আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কোনো আলগা বিষয় নয়। এটি আধুনিক যুগে একচ্ছত্রভাবে বেড়ে ওঠা উপনিবেশিত শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণির ভাষাকাঠামোর বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদী ও অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতাও বটে। যে-ভাষা আমরা ভুলে গেছি অথবা যে-ভাষাকে আমরা উপেক্ষা করে এসেছি সেই ভাষার পক্ষে এক প্রকার শক্ত রাজনৈতিক অবস্থানও বৈ কি।
কবিতার ভাষা বিষয়ক জসীমউদ্দীনের এই সজ্ঞান অবস্থানকে আধুনিক কবিকুল ও সমালোচকরা উপেক্ষা করেন। তারা বলেন, জসীমউদ্দীন তাঁর কবিতার ভাষার প্রশ্নে ‘আধুনিক’ ছিলেন। তারা ‘আধুনিক’ ভাষা বলতে বোঝান ওই যে উপরে কথিত ‘উন্নত’ ভাষাকে, যে-ভাষার বড় রাস্তা ধরে এগিয়ে গেছে বাংলা কবিতা। কীভাবে, কোন ভাষায় জসীমউদ্দীনকে ভাষার প্রশ্নে আধুনিক বলেন তার একটা খোঁজ-খবর নেয়া যেতে পারে। এজন্য কয়েকজন সমালোচকের মন্তব্য দেখা যেতে পারে।
বিশিষ্ট জসীমউদ্দীন গবেষক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘তিনি কাব্যপ্রকরণ হিসেবে পল্লীকাব্যের শব্দ, উপমা, ছন্দ যথেষ্টই গ্রহণ করলেও, কখনই গ্রাম্যকবিদের মত অমার্জিত ভাষাভঙ্গি ও অপূর্ণাঙ্গ ছন্দের আশ্রয় নেন নি। শব্দ চয়ন, উপমা, রূপক ইত্যাদির প্রয়োগে তিনি আধুনিক শিল্পীসুলভ যথেষ্ট অনুশীলনের পরিচয় দিয়েছেন।’ (সুনীল কুমার ১৯৯৭ : ১৭৬) আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, ‘জসীমউদ্দীনের শব্দ ও ছন্দ ব্যবহারও সুচিন্তিত। শব্দ ব্যবহারে দেখা যায়, জসীমউদ্দীন কিছু গ্রামীণ ও আঞ্চলিক শব্দ প্রয়োগ করেছেন; কিন্তু ক্রিয়াপদ তাঁর সব সময়ই শালীন, সাধুরীতির।’ (আহমাদ মাযহার ২০১৭ : ৩১) তিনি আরো বলেন, আধুনিকতার একটি মূল সূত্র সচেতনতা। এই সচেতনতা জসীমউদ্দীনের কবিতার শব্দ ব্যবহার থেকে শুরু করে তাঁর উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও ছন্দ ব্যবহারের মধ্যে লক্ষ করা যায়। (প্রাগুক্ত ২০১৭ : ৭৩-৭৫) তিতাশ চৌধুরী বলেছেন, ‘মূলত জসীমউদ্দীন পল্লী থেকে কাব্যের মাল-মশলা সংগ্রহ করলেও তাঁর ভাষা পল্লীকেন্দ্রিক নয়। তিনি সুকৌশলে ও যথার্থ দক্ষতায় পল্লীভাষাকে মার্জিত, রুচিশীল ও গ্রহণযোগ্য করে কাব্যের গাঁথুনি দিয়েছেন। তাই তাঁর এ-গাঁথুনিতে এসেছে শিল্পরূপ, প্রয়োগ-কৌশলের আশ্চর্য বর্ণচ্ছটা। মোট কথা, একজন বুদ্ধিদীপ্ত শিক্ষিত নাগরিক কবির চারিত্র্যই তাঁর প্রায় সমগ্র কাব্য-দেহের সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়। (তিতাশ ১৯৯৩ : ৭৪)
উপরের উদ্ধৃতিগুলো প্রকাশ্যে আর ঠারে-ঠোরে কী বলতে চেয়েছে! বলতে চেয়েছে, বাংলা কবিতার দুটি শ্রেণি আছে। এক শ্রেণিতে আছে ‘গ্রাম্যগান’ বা ‘গ্রাম্যকবিতা’। এগুলো ‘অশিক্ষিত’ ‘গ্রাম্য’ কবিদের দ্বারা রচিত। অন্য শ্রেণিতে আছে ‘আধুনিক’ কবিতা। এগুলো ‘শিক্ষিত’ শ্রেণির দ্বারা রচিত। এই দুই শ্রেণির কবিতার মধ্যে ‘আধুনিক’ কবিতা ‘মহৎ’, ‘উন্নত’ আর ‘সচেতন’ প্রয়াস। গ্রামের স্বশিক্ষিত মানুষদের রচনাগুলো ‘অমার্জিত’, ‘গ্রাম্য’ আর ‘অসচেতন’ প্রয়াস। তাদের শব্দচয়ন, ভাষাভঙ্গি ‘গ্রাম্যতা’ আর ‘অসচেতনতা’ দিয়ে ভরা। অর্থাৎ উদ্ধৃতিগুলোর প্রত্যেকটির মধ্যেই আছে টনটনে শ্রেণিচেতনা। বক্তব্যগুলোর গভীরে আছে ‘আমরা’ (self) ও ‘তারা’ (other) চেতনা। এখানে ‘আমরা’ মানে ‘আধুনিক’ নন্দনতত্ত্বের কবি-সাহিত্যিক। আর ‘তারা’ মানে ‘গ্রাম্য’ ‘অসচেতন’ ও ‘অমার্জিত’ নন্দনতত্তে¡র কবি-সাহিত্যিক। উদ্ধৃতিগুলোর ভাবানুবাদ করলে যে-কেউ বুঝতে পারবেন, এই ‘আধুনিক’ শ্রেণিটি ঔপনিবেশিক খাচলতের অধিকারী। তারা আধিপত্যবাদী, বর্ণবাদী ও উন্নাসিক। নিজের নন্দনতত্ত্বকেই সে শ্রেষ্ঠ, রুচিবান, মার্জিত আর উন্নত জ্ঞান করে। এই শ্রেণিটি ঘোষণাবাদী। ইউরোপ যেমন নিজেকে ‘উন্নত’ ও ‘সভ্য’ আর উপনিবেশিতদের ‘অনুন্নত’ ও ‘অসভ্য’ মনে করত — এই শ্রেণির চিন্তাপদ্ধতিও তেমন। হাজার বছর ধরে বাংলা কবিতার যে-ঐতিহ্য লোকগ্রাহ্য ভাষা আর ভাবের ভেতর দিয়ে গণমানুষের উপভোগের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠে মূর্তিমান হয়েছে, সেই মূর্তিকে ‘অমার্জিত’ ‘গ্রাম্য’ আর ‘অসচেতন’ বলে একটিমাত্র ঘোষণায় ভেঙে খানখান করে দেয় ‘আধুনিক’ নন্দনতত্ত¡। কিন্তু বাংলার নিজস্ব যে-ভাবসম্পদ, চিন্তা, দর্শন, জীবনবোধ তা তো এই সাহিত্যধারার ভেতর দিয়েই বেড়ে উঠেছে।
তবে কি জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাষার মধ্যে আধুনিকতা নেই! আছে। কিন্তু সেই আধুনিকতা উপনিবেশের গর্ভ থেকে উঠে আসা আধুনিকতা নয়।
শুধু তাই নয়, উদ্ধৃতিগুলোর মধ্যে এই ‘অমার্জিত’ ‘তারা’দের থেকে ভাষা, ছন্দ ও অপরাপর ব্যাপারে জসীমউদ্দীনকে ‘সচেতনতা’, ‘মার্জিত ও উন্নত রুচি’ ইত্যাদির কথা বলে টেনে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা খুব সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু জসীমউদ্দীন তো কোনোদিন এই দলে ভিড়তে চাননি। এই ‘জাতে’ উঠতে চাননি। তিনি নিজেকে ‘কৃষকের কবি’ বলেও দাবি করেছেন। (জসীম ২০১৬ : ৮১) তাঁকে ‘লোককবি’ বললে তিনি তাতে কোনোদিন অসম্মতি জানাননি। (হেমাঙ্গ ২০১২ : ৪১২) যে দেশে মানুষ বড় (১৯৬৮) গ্রন্থে দেখি তাঁর রাশিয়া ভ্রমণের স্মৃতি। রাশিয়ায় তাঁকে একাধিকবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেসব অনুষ্ঠানে তাঁকে কর্তৃপক্ষ ‘লোককবি’ বলে বারবার সম্বোধন করলে তিনি তা সানন্দে গ্রহণ করেছেন। (জসীম ২০১৬ : ৮১, ৮৬) জসীমউদ্দীনের যাবতীয় সাহিত্যসম্পর্কিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ, আত্মজীবনীমূলক রচনা, স্মৃতিকথা, নাটক, কবিতা, গান ইত্যাদির মধ্যে তো ঠাঁসা আছে এই ‘আধুনিক’, ‘উন্নত’ আর ‘মার্জিত’ বর্গ থেকে আলাদা থাকার বাসনা আর ব্যক্তিত্ব। আধুনিকতার নামে বাংলা অঞ্চলে যে-কাব্যচর্চা হয়েছে তার সাথে তো জসীমউদ্দীন আজীবন সংগ্রামই করেছেন। নিজেকে আলাদা করার জন্য তিনি তো মাইকেল-রবীন্দ্রনাথকেও ছেড়ে কথা বলেননি। আর পাকিস্তান আমল থেকে বাংলাদেশ পর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের ‘আধুনিক’ কবিদের সাথে তাঁর সাহিত্যতাত্তি¡ক বিরোধের কথা কে না জানে। তিনি জনবিচ্ছন্ন ‘আধুনিক’ বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে খুব সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন :
আজ যে জীবনসংগ্রামে বাঙালি ক্রমেই পিছাইয়া পড়িতেছে তাহার কারণ হয়তো নিজের কৃষ্টি ও ট্রেডিশনকে বাদ দিয়া বাঙালি বিদেশীর ভাবধারা আনিয়া নিজেকে বড় করিতে চাহিয়াছিল। দেশের সাহিত্যের পূর্বসূরিদের পথ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া বাঙালি যে সাহিত্য রচনা করিল, তাহাকে বিদেশী ও আন্তর্জাতিক বলিয়া গ্রহণ করিল না। দেশের আপামর জনসাধারণও তাহাদের নিজস্ব সম্পদ বলিয়া স্বীকার করিল না। চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, মুকুন্দরাম সেকালের ছাপাখানাবর্জিত দেশে যতটা লোকস্বীকৃতি পাইয়াছিলেন, একালের কয়জন আধুনিক বাঙালি লেখক ততটা জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছেন’। (জসীম ২০০১ : ৪৫)
শুধু কি ‘বিদেশী ভাবধারা’র আধুনিক সাহিত্যের সমালোচনা করেছেন জসীমউদ্দীন! তিনি সেই ‘আধুনিক’ কাব্যবিচারের মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন যে-মানদণ্ডে তাঁকে ‘আধুনিক’ বলা হয়, আর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর রচনাকে ‘গ্রাম্য’, ‘অমার্জিত’ বলা হয় :
এতদিন সাহিত্য ছিল দেশের বড় লোকদের হাতে। আমাদের বাঙলা-সাহিত্য ত সেদিনও জমিদার ও ডেপুটিদের হাতে ছিল। এঁরা এঁদের শিশুদের কথা ভেবেছেন। তাই এঁদের শিশুদের জন্যে সাহিত্য গড়ে উঠেছে। শিশুদের চাইতেও যে দেশের জনসাধারণ এক বিরাট শিশুর দল রয়েছে, তাদের কথা এঁরা ভাবেনওনি, এদের জন্য সাহিত্যও গড়েননি। শুধু কি তাই? এই দেশের জনসাধারণ নিজেদের আনন্দ দেবার জন্য যে সাহিত্যের নীড়টি গড়ে তুলেছিল, এঁরা রুচি, নীতি এবং সমালোচনার কষাঘাতে তাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছেন। এজন্য এঁদের মহাকালের দরজায় জবাবদিহি করতে হবে। (জসীম ২০০১ : ৩২)
রবীন্দ্রনাথ জসীমউদ্দীনের কবিতা পড়ে তাঁর কবিতার সাবলীলতা এবং ছন্দের সহজ গতির প্রশংসা করেছিলেন। জবাবে জসীমউদ্দীন বলেছিলেন :
ইহা যদি আমার গুণ হইয়া থাকে তবে এই শিক্ষা আমি পাইয়াছি আমার দেশের অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত কবিয়ালদের কাছ থেকে। তাহারাই আমার কাব্য জীবনের প্রথম গুরু। সেই যাদব, পরীক্ষিত, ইসমাইল, হরি পাটনী, হরি আচার্য এঁদের কথা আমি যখন ভাবি আমার অন্তর কৃতজ্ঞতায় অশ্রুসিক্ত হইয়া ওঠে। (জসীম : ২০০৩ : ১৩১)।
উপরের বক্তব্যের কোথাও কি ‘আধুনিক’, ‘সচেতন’, ‘মার্জিত রুচি’র কবিতার সাথে একাত্ম হবার কোনো বাসনা-ব্যাকুলতা জসীমউদ্দীনের মধ্যে দেখা গিয়েছে! তবে তাঁকে কেন ‘আধুনিকের’ দলে টানা! জসীমউদ্দীনের কাব্য-কবিতার ভাষা-ছন্দ তো সে সাক্ষ্য দেয় না। তদ্ভব ও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এ-বিষয়ে কিছুটা ধারণা দেয়া হয়েছে। আরো কিছু উদাহরণ দেখা যেতে পারে। প্রথমেই উদাহরণ দেয়া যাক রাখালী কাব্যের ‘বৈরাগী আর বোষ্টমী যায়’ কবিতা থেকে :
কোথা থেকে এলো রসের বৈরাগী আর বোষ্টমী,
আকাশ হতে নামল কি চান হাসলী পরা অষ্টমী।
‘চেকন চোকন’ বোষ্টমী তার ঝাটরা মাথায় দীঘল কেশ,
খেজুর গাছের ‘বাগড়া’ যেমন পুব হাওয়াতে দুলছে বেশ।
পাছা পেড়ে শাড়িখানি পাছা বেয়ে যায় পড়ে,
বৈরাগী কয়, তারির সাথে ফাঁস লাগায় যাই মরে।
মুখখানি তার ডাগর ডোগর ঘষামাজা কলসখানি,
বৈরাগী কয় গলায় বেঁধে মাপতে পারি গাঙের পানি। (জসীমউদ্দীন ২০১১ : ৩৯)
দেখা যাক একই কাব্যের নাম কবিতা ‘রাখালী’ থেকে —
এই গাঁয়েতে একটি মেয়ে চুলগুলি তার কালো কালো,
মাঝে সোনার মুখটি হাসে আঁধারেতে চাঁদের আলো।
রানতে বসে, জল আনতে, সকল কাজেই হাসি যে তার,
এই নিয়ে সে অনেক বারই মায়ের কাছে খেয়েছে মার।
সান্ করিয়া ভিজে চুলে কাঁখে ভরা ঘড়ার ভারে,
মুখের হাসি দ্বিগুণ ছোটে কোনমতেই থামতে নারে। (জসীমউদ্দীন ২০১১ : ৯)
এই কবিতাংশ দুটির কোথায় ‘আধুনিক কবির সচেতনতা’! আর কোথায় ‘আধুনিক’ কবিতার ‘উচ্চ’ ‘উন্নত’ আর ‘মার্জিত রুচি’! ‘পাছা পেড়ে শাড়িখানি পাছা বেয়ে যায় পড়ে’, অথবা ‘মুখখানি তার ডাগর ডোগর ঘষামাজা কলসখানি’ বা ‘রানতে বসে, জল আনতে, সকল কাজেই হাসি যে তার,’ বা ‘সান্ করিয়া ভিজে চুলে কাঁখে ভরা ঘড়ার ভারে’Ñ এসব চরণের ভাষার ঝোঁক কিছুতেই আধুনিক কবির অর্থাৎ তথাকথিত মূলধারার সাহিত্যের ভাষার সাথে মিলমিশ খায় না। এই ভাষা তো শ্রেণিগত দিক থেকে বেপরোয়া! এই ভাষা দীর্ঘকাল ধরে বেড়ে ওঠা ‘আধুনিক’ কবিতার ভাষাকে পাশকাটিয়ে ওই ‘অমার্জিত’, ‘গ্রাম্য’ ভাষাকেই আলিঙ্গনে উদ্বাহু। আধুনিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোনো ‘আধুনিক’ কবি কি বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া যাবে যার কবিতার ভাষা এমন অনায়াস, সহজ, অকপট আর বিশেষ ভৌগোলিক পরিচয় দ্বারা সুচিহ্নিত! আরো উদাহরণ দেখা যেতে পারে কবির সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘কবর’ থেকে :
গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেত ঝরে,
ফাল্গুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।
পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ,
চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।
আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গা। (জসীমউদ্দীন ২০১১ : ২১)
অনেক খুঁজে ভেবেচিন্তে আমরা ‘কবর’ কবিতার সেই-অংশকে বেছে নিয়েছি যে-অংশে উদ্বায়ী কাব্যিক আবেগ বেশ ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। বর্ণনার ভাষাকে কোনো কবি চাইলে পছন্দ মতো ভাষার রঙে রঙিন করতে পারেন। কিন্তু বিশুদ্ধ আবেগের ভাষা হয় অকৃত্রিম। অর্থাৎ কবির দেখার আর অনুভবের ভাষার জাতটি স্বরূপে প্রকাশিত হয় সেখানে। সেই বিচারে তীব্র আবেগে কাঁপা উদ্ধৃতাংশের ভাষাকে কিছুতেই ‘সচেতন’ ‘নাগরিক মার্জিত রুচির’ একজন আধুনিক কবির ভাষা বলা যাবে না। বরং এই ভাষার মধ্যে একজন ভাবলেশহীন অনায়াসী সহজ কবির সাক্ষাত খুব সহজেই চোখে পড়ে। ‘ফাল্গুনী হাওয়া’, ‘শুনো-মাঠখানি’, ‘মুছিয়া যাইত চোখ’, ‘গাছের পাতার শোক’, ‘আথালে দুইটি জোয়ান বলদ’, ‘হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত’, ‘গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া’, ‘গহীন সায়রে’ — এইসব শব্দগুচ্ছের মধ্যে প্রকাশের ও চয়নের এমন এক সহজিয়া গতি ও ঢং আছে যে, এর ভাষাকে মনে হয় একেবারেই মাজাঘষাহীন বেশি সরল; স্বতোৎসারিত। ঠিক যেন উদাসিনী পল্লীবালার আবেগের মতোই কবিতাংশের ভাষা নিরাভরণ। ভাষার এই ভঙ্গিটি কোনো আধুনিক কবির ভঙ্গি নয়। এর শেকড়বাকড় চারানো গ্রাম্যগান-কবিতার মর্মমূলে। জসীমউদ্দীনের যেসব কবিতাকে মাথায় রেখে আধুনিক সমালোচকরা তাঁর ভাষার মধ্যে ‘সচেতন রুচি’ আর ‘মার্জিত রুচি’র কথা বলেন সেসব কবিতার যে-কোনো জায়গা থেকে উদাহরণ নিয়ে গভীরভাবে লক্ষ করলেই দেখা যাবে এসব কবিতার ভাষা বহিরঙ্গে ও অন্তরঙ্গে সহজিয়া লীলালাস্যে ভরা। এই ভাষার মধ্যে দারুণভাবে উদাসীনতার সুপ্তস্রোত অনুভব করা যায়। আসলে ভাষা বিষয়ে জসীমউদ্দীনের বাড়তি কোনো ভাবনা ছিল না। তিনি এক প্রস্তুত ভাষাতেই কবিতা লিখতেন। যে-ভাষাটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলা কবিতায় বহমান ছিল। এই ভাষাটি প্রস্তুত হয়েছে মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, পুঁথিসাহিত্য, ময়মনসিংহগীতিকা, গ্রাম্যগান আর অগুনতি ‘মূর্খ অশিক্ষিত’ মানুষের জিভের ডগায়।
তবে কি জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাষার মধ্যে আধুনিকতা নেই! আছে। কিন্তু সেই আধুনিকতা উপনিবেশের গর্ভ থেকে উঠে আসা আধুনিকতা নয়। মাইকেলের ধারাবাহিকতার আধুনিকতা নয়। তবে এই আধুনিকতার সিলসিলাটা কী! আগেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, এই ধারাটি প্রাচীনযুগ-মধ্যযুগ হয়ে লোকগাঁথার হাত ধরে বিকশিত হয়েছে নিজস্ব নিয়ম আর স্বভাবে। এই ধারার শেষ কবি বোধ করি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৭৩৩-১৮৫৯)। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তই বাঙালির কাব্যধারার নিজস্ব অগ্রগতি ও আধুনিকতার শেষ কবি। জসীমউদ্দীনের আবির্ভাবের আগেই যাঁকে শেষ ‘খাঁটি বাঙ্গালী কবি’ বলে রায় দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। দুই দিক থেকে তিনি খাঁটি বাঙালি কবি; এক. ‘কথায়’ অর্থাৎ ভাষায়, দুই. ‘মনের ভাবে’। (বঙ্কিমচন্দ্র ১৪১৭ : ৭৬৩) তাঁর পরেই বাংলা কবিতা শুধু নয়, সমগ্র সাহিত্য খাঁটি বাঙালিত্ব থেকে সরে এসেছে। আক্রান্ত হয়েছে ঔপনিবেশিকতা দ্বারা। এই ঔপনিবেশিক সাহিত্য ও এর রুচিকে বঙ্কিম বলেছেন সাহিত্যের ‘হাল আইন’। ঈশ্বরগুপ্ত এই ‘হাল আইনে অনেক স্থানে ধরা পড়েন’ বলে শেষ পর্যন্ত রায় দিয়েছেন ডেপুটি বঙ্কিম। বাংলা কবিতায় অন্তত ভাষা এবং মনের ভাবের দিক থেকে খাঁটি বাঙালিত্বের প্রশ্নে জসীমউদ্দীন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তেরই আধুনিক সংস্করণ; ঔপনিবেশিক আধুনিকতার কোনো লক্ষণের সাথেই জসীমউদ্দীন মিলমিশ খান না। আদতে ঔপনিবেশিক ধারার কবিতার যে-আধুনিকতা তাকে জসীমউদ্দীন আধুনিক বলে মনেই করতেন না। তিনি নিজেকে অন্য আধুনিকতার লোক মনে করতেন :
কবি জসীমউদ্দীন তিরিশ দশক ও ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার আঙ্গিকগত বৈচিত্র্যকে চমকপ্রদ বলে মাঝেমধ্যে স্বীকার করলেও তাদের নির্বাচিত বিষয়বস্তুকে কিছুতেই আধুনিক বলে মানতেন না। এই অস্বীকৃতিই তাঁকে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছিল। আমি যতদূর জানি, এই নৈসঙ্গ (sic) তাঁর অহংকারকে কোনোদিন পীড়িত করে নি। তাঁকে এই বিশ্বাসে আজীবন দৃঢ় থাকতে দেখেছি, বাংলা কবিতার যে ধারার তিনি চর্চা করেছেন তা একদিন প্রবল ও পরাক্রান্ত হয়ে উঠবেই। তিনি বলতেন, এটাই হলো চর্যাপদের ধারা, দেশের মাটি থেকে উঠে এসে আমার হাতে লালন পেয়ে আধুনিক হয়ে উঠেছে। (আল মাহমুদ ২০১৯ : ২২০)
জসীমউদ্দীনের ভাষা ও অপরাপর বিষয়ের আধুনিকতার বিষয়টিকেও এই নিরিখেই বিচার করতে হবে বলে মনে করি।
আলাপ করা যাক, জসীমউদ্দীনের কবিভাষায় ব্যবহৃত ক্রিয়াপদের ব্যবহার নিয়ে। অধিকাংশ সমালোচক বলেছেন তাঁর ক্রিয়াপদ ‘শালীন সাধুরীতির’ এবং ‘অনাড়ষ্ট’। (আহমাদ মাযহার ২০১৭ : ৩১) ক্রিয়ার এই রূপের কথা বলে সমালোচকরা বলতে চান, ভাষার দিক থেকে তিনি ‘মার্জিত’, ‘শালীন’, ‘আধুনিক’ ও ‘সচেতন’ ছিলেন। কিন্তু ক্রিয়ার সাধু চলিত দিয়ে ভাষার মার্জিত-অমার্জিত বিচারের পদ্ধতি খুব সুবিধার নয়। অনেকের ক্রিয়া সাধু কিন্তু ভাষা চলিতের বাড়া। এমনকি কখনো কখনো আঞ্চলিকও বটে। আবার অনেকের ক্রিয়া চলিত কিন্তু ভাষা সাধুর চেয়েও সাধু। সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। আমাদের বলবার বিষয়, জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাষার মধ্যেকার অনেক ক্রিয়াপদ দেখতে সাধু। অর্থাৎ ‘সচেতন’ এবং ‘আধুনিক’। কিন্তু সাধু ক্রিয়ার চরণের অপরাপর জায়গার ভাষার, শব্দের, অনুষঙ্গের ও ভাবের টোনটি এমন যে, সেই ক্রিয়া তখন আঞ্চলিক ক্রিয়া হয়ে যায় বা আঞ্চলিকের স্বাদ দেয়। যেমন, ‘পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ’। এর টোনের মধ্যেই এমন একটা তেরছা মৌখিক ভঙ্গি আছে যে, এই অকৃত্রিম তেরছা ভঙ্গিই চরণের ক্রিয়াগুলো, এমনকি বিভক্তিটিও পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক ভাষার রূপ বলে প্রতীতি জন্মায়। কারণ পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক ভাষায় ক্রিয়াপদের সাধু বা প্রায় সাধু উচ্চারণ হয়ে থাকে। এটি পূর্ব বাংলার ভাষার একটি ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। ফলে উল্লিখিত চরণের ক্রিয়াপদ ‘মুছিয়া’ ও ‘যাইত’ সাধু হলেও এগুলোর সাধুত্ব নষ্ট হয়ে গিয়েছে অসাধু শব্দ, অনুষঙ্গ, ভাব, টোন আর ভঙ্গির ‘গেঁয়ো’ সঙ্গের কারণে। এজন্যেই বলে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। জসীমউদ্দীনের কবিতায় ‘সাধু’ ক্রিয়ার ‘অসাধু’ স্বাদ আর আচরণের উদাহরণ যত্রতত্র পাওয়া যাবে।
আবার জসীমউদ্দীনের কবিতায় ‘অমার্জিত’, ‘অসাধু’, ‘গ্রাম্য’ ক্রিয়ার ব্যবহারও কিন্তু কম না। ‘গরু-দৌড়ের মাঠখানি চাষি লাঙলেতে দেছে ফুঁড়ে’ (জসীমউদ্দীন ২০১৮ : ১৫৬/১), ‘কার লোভে তুই রাজা হলি ভাই মথুরার রাজপাটে’ (জসীমউদ্দীন ২০১৮ : ১৫৬/১), ‘বাঁশির শাসন হেলায় সয়েছি, বুনো ফলে দেছি কর’, (জসীম ২০১৮ : ১৫৬/১) ‘বর্ষার সাথে মিতালি পাতায়ে সোনা ধান করি পুঁজি’, (জসীম ২০১৮ : ১৫৭/১), ‘যে হাসি আজিও গড়ায়ে পড়িছে চাঁদের কলস ভরে’ (জসীমউদ্দীন ২০১৮ : ১৫৬৩/১) ‘রেণুটি তার সারাটি অঙ্গে মাখাইও ধীরে ধীরে’, (জসীমউদ্দীন ২০১২ : ১৬৭/১), ‘তেমনি তাহার মুখের পরে সব সময়ে রইছে আঁকা’, (জসীমউদ্দীন ২০১২ : ১৪৩/১), ‘মাথা সবার সাজিয়ে নেছে রং-বেরঙের টুপির ছায়ে’, (জসীমউদ্দীন ২০১২ : ১৪৩/১), ‘নাই পাটনি নাই তরণী পার হইবার কোনই হেতু’, (জসীমউদ্দীন ২০১২ : ১৪৩/১), ‘দু একটি চুল এলিয়ে পড়ে মাথার সাথে রাখ্ছে ধরে’, (জসীমউদ্দীন ২০১২ : ৫/১) ‘পথ ভুলে কি যায় সে ওগো, ওই মেয়েটি রান্ছে যেথায়’, (জসীমউদ্দীন ২০১২ : ৫/১) ‘দুটি ঠোঁট দেছে সেঁঝো মেঘ-পেষা সিঁদুরের রেখা টানি’ (জসীমউদ্দীন ২০১২ : ১০/১) ‘পরান হইতে পরান পলায়ে ওর পথে মুরছায়’ (জসীমউদ্দীন ২০১২ : ১১/১), ‘বড় ব্যথা রোলো দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই’ (জসীমউদ্দীন ২০১২ : ১৭/১) — এরকম অসংখ্য ‘অশালীন’, ‘গ্রাম্য’, ‘আঞ্চলিক’ ক্রিয়াপদের উদাহরণও দেয়া যাবে জসীমউদ্দীনের কবিতা থেকে। এগুলো একজন কবির কবিভাষার জাত চেনার জন্যে, কবির আধুনিকতা-অনাধুনিকতা বিচারের জন্যে ভালো পদ্ধতি নয়। আসল বিষয় হচ্ছে, কবির ব্যবহৃত ভাষার মূল প্রবণতা, ঝোঁক বা রক্তের ভেতরের নেশা। এই প্রবণতা, ঝোঁক এবং শোনিতাকাক্সক্ষার দিক থেকে জসীমউদ্দীনের কবিভাষা ‘আধুনিক’ কাব্যধারার ভাষা থেকে, ‘উন্নত’ ‘মার্জিত রুচির’ ভাষা থেকে যোজন যোজন দূরে।
এই দূরত্ব খুব সহজে বোঝা যায় তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত তৎসম শব্দের পরিমাণটা দেখে। আমরা জসীমউদ্দীনের কবিতায় ব্যবহৃত তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের পরিমাণ বের করার জন্য পরীক্ষা করে দেখেছি। সেখানে দেখা গেল তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতায় মোট শব্দ সংখ্যা ৯১৬। এর মধ্যে ৫ শতাংশের মতো সংস্কৃত শব্দ। এই ৫ ভাগ সংস্কৃত শব্দের মধ্যেকার ৯৫ ভাগই বহুল ব্যবহৃত। মুখের ভাষাতেই ব্যবহৃত হয়। যেমন, নয়ন, জল, ঊষা, ব্যথা, সন্ধ্যা, শ্বশুর, শূন্য, অঙ্ক, হৃদয়, শরীর, বেদনা, উদাসীন, মরণ, উত্তর, পল্লী, প্রথম, আশিস, মরণ-ব্যথা, ক্ষণ, স্নেহ, মরণ-বীণ, অশ্রু, হতভাগিনী, ব্যথাতুরা, প্রতিমা, দূর, সকরুণ ইত্যাদি। এগুলোকে অভিধান প্রণেতা ছাড়া কোনো ভাষাতাত্ত্বিকই সংস্কৃত শব্দ বলতে রাজি হবেন না। এগুলো বাংলা। বহু ব্যবহারে আর কোনো না কোনো বিকৃতিতে এগুলো প্রায় খাঁটি বাংলার শ্রেণিভুক্ত হয়ে গিয়েছে। ‘কবর’ কবিতায় আদতে অপরিচিত, দুয়ের অধিক পদকে সমাসবদ্ধ করে বানিয়ে নেয়া কোনো সংস্কৃত শব্দই নেই। উচ্চারণ আর বানানের কোনো রকম হেরফের ছাড়া ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দ ‘কবর’ কবিতায় নেই বললেই চলে। এদিক বিচারে ‘কবর’ কবিতাটি খাঁটি তদ্ভব, দেশি আর আঞ্চলিক শব্দের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। জসীমউদ্দীন তাঁর কোনো কবিতাতেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি বা আধুনিক শিক্ষাকে একেবারেই পোছেননি; কোনেদিনই নয়। জনপ্রিয় লোকগাথায়ও ৩৩.২ ভাগ সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বলে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন তাঁর বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিবর্তন বিষয়ক বইয়ে। অথচ জসীমউদ্দীনের কবিতায় সংস্কৃত শব্দের পরিমাণ প্রায় নেই বললেই চলে। আসলে কাব্যভাষার ক্ষেত্রে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে চলে আসা সংস্কৃতবহুল ‘অভিজাত’ আর ‘উন্নত’ ভাষার ধারণার বিপরীতে খাঁটি বাংলা ভাষায় কাব্যরচনার প্রয়াসের দিক থেকে জসীমউদ্দীন ভিন্নজাতের কবি। এক্ষেত্রে তাঁর মিল ওই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সাথে। একেবারে খাঁটি ‘বাঙ্গালী কথা’র কবি। উপনিবেশের গর্ভে বেড়ে ওঠা আধুনিক বাংলা কবিতাধারার কবি তিনি নন কিছুতেই।
চার
আমরা কথা বলছিলাম জসীমউদ্দীনের কবিতায় ব্যবহৃত তদ্ভব আর আঞ্চলিক শব্দের ব্যাপকভিত্তিক ব্যবহার সম্পর্কে। দেখছিলাম ক্রিয়ার রূপ আর তৎসম শব্দ ব্যবহারের সাত-পাঁচ। আরো দেখছিলাম, ভাষার এই বিশেষ ঘরানার রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, প্রচুর তদ্ভব, দেশি ও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার জসীমউদ্দীনের কবিভাষার একটা বাহ্যিক বিষয় মাত্র। জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাষার আসল শক্তি নিহিত তার বাগভঙ্গির মধ্যে। তাঁর কবিতার শব্দব্যবহারকেও অনেকক্ষেত্রে এই বাগভঙ্গি বা বাকরীতিই নিয়ন্ত্রণ করেছে। কী এই বাগভঙ্গি এবং কীভাবে তিনি তাঁর কবিতায় এই বাগভঙ্গির ব্যবহার করেছেন, আর তাতে জসীমউদ্দীনের কবিভাষায় কী বিশেষত্ব দেখা দিয়েছে তা দেখা যাক।
পৃথিবীর প্রত্যেকটি ভাষার একটা নিজস্ব চলন ও বলনরীতি থাকে। সব মানুষের চলার ছন্দ-লয়-তাল-গতি যেমন এক না, তেমনি সব ভাষার চলার ছন্দ-লয়-তাল-গতি এক নয়। ভাষার এই চলনভঙ্গিটি মূলত তৈরি হয় সংশ্লিষ্ট ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের মুখে। কোনো ভাষার মানুষেরা বহুদিন ব্যবহার করতে করতে সংশ্লিষ্ট ভাষার কিছু শব্দের সাথে কিছু শব্দের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যায়। তখন ওই শব্দগুলো ভাষার মধ্যে একসাথে চলাফেরা করে। কখনো এইসব একসাথে চলাফেরা করা শব্দরা একটা পূর্ণাঙ্গ বাক্যগঠন করে। আবার কখনো কখনো বাক্যের একটা অংশ জুড়ে থেকে বাক্যের কাঠামোতে একটা দখলদারি কায়েম করে। এভাবে ক্রমে একটা জনগোষ্ঠীর ভাষার একটা নিজস্ব অনিবার্য চলন ও কথনভঙ্গি দাঁড়িয়ে যায়। এটাই ওই ভাষার বাগভঙ্গি বা বাকরীতি। বাগভঙ্গি বা বাকরীতিতে অংশগ্রহণকারী শব্দগুচ্ছ কখনো আক্ষরিক অর্থ প্রকাশ করে, কখনো আবার বিশেষ অর্থও প্রকাশ করে। যখন আক্ষরিক অর্থকে ছাপিয়ে কোনো শব্দগুচ্ছ বিশেষ কোনো অর্থকে প্রকাশ করে তখন তাকে বাগধারা বলা হয়। বাগধারা ও বাগবিধি একটা ভাষার শোণিতস্বভাবকে ধারণ করে থাকে। বাগভঙ্গি, বাকরীতি বা বাগধারা-বাগবিধি যা-ই বলি না কেন, এগুলোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ভাষার চলন ও বলনস্বভাবটিই মুখ থেকে যায় কলমে। অর্থাৎ সাহিত্যের ভাষায়। যেকোনো ভাষার বড় সাহিত্যিক ভাষার এই চলন ও বলনস্বভাবটিকে সর্বোত্তম ব্যবহার করেই ওই ভাষার বড় কথাশিল্পী বা কবি হয়ে ওঠেন। বলা দরকার যে, ভাষার এই স্বভাব সম্পর্কে বড় সাহিত্যিক ছাড়া সাধারণ সাহিত্যিকরা খুব বেশি সচেতন থাকেন না। এও বলে রাখা দরকার যে, এই বাগভঙ্গির আবার ইতরবিশেষ আছে। আছে এর এলিট রূপ এবং গণ রূপও। সে প্রসঙ্গে আসার আগে জসীমউদ্দীনের কবিতায় ব্যবহৃত বাগভঙ্গি নিয়ে কথা বলা যাক। দেখা যাক, এই বাগভঙ্গি তাঁর কাব্যভাষাকে কী স্বাতন্ত্র্য দান করেছে।
বাংলা বাকরীতি বা বাগভঙ্গির সুপ্রচুর ব্যবহার জসীমউদ্দীনের কাব্যভাষার একটা বড় শক্তি। এই শক্তির পরিচয় আছে তাঁর খণ্ডকাব্য ও কাহিনিকাব্যগুলোর পরতে পরতে। তবে, বাংলা ভাষার কথনরীতির প্রতি দুর্বলতাবশত তিনি অধিকাংশ কবিতা লিখেছেন সংলাপের মাধ্যমে। কাহিনিকাব্যে চরিত্র আছে। ফলে তাতে প্রচুর সংলাপ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর খণ্ড কবিতাও সংলাপে ভরা।৯ তাই কাহিনিকাব্য ও খণ্ডকবিতাগুলোতে ব্যবহৃত ব্যাপকভিত্তিক সংলাপের মধ্যে তিনি খাঁটি বাংলা ভাষার নিজস্ব বাকরীতিকে গ্রেফতার করে ফেলেছেন অবলীলায়। এর ফলে তাঁর ভাষার মধ্যে আমরা দেখতে পাই কখনো বক্তার হাতের ইশারা, কখনো মুখভঙ্গি, কখনো উঠা-বসা-নড়াচড়া। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এটাও জসীমউদ্দীনের কবিভাষার বড় কথা নয়। তাঁর কবিভাষার আসর জায়গাটা নিহিত ভাষাকাঠামোর মধ্যে।
হাজার বছর ধরে কথা বলতে বলতে গ্রামীণ মানুষের কথা বলার ভাষার একটা প্যাটার্ন বা কাঠামো দাঁড়িয়ে গিয়েছে। জসীমউদ্দীন সেই প্যাটার্নটাকেই তাঁর কাব্যভাষায় ব্যবহার করেছেন। এমনকি জসীমউদ্দীনের কবিতায় ব্যবহৃত অনেক উপমা-তুলনার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, সেসব উপমা তুলনা বাক্যের কাঠামোসহ গ্রামীণ মানুষের মুখে দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে। ব্যবহৃত হতে হতে সেগুলো বাকরীতিরই অংশ হয়ে উঠেছে। জসীমউদ্দীনের কবিভাষাটি লোকমুখনির্ভর বাকভঙ্গি সমন্বিত গ্রামীণ ভাষাকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যেমন, ‘কবর’ কবিতায় বৃদ্ধ দাদু নাতিকে তার বোন (বু-জী) সম্পর্কে বলেছেন, ‘বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের ঘরে বনিয়াদি ঘর পেয়ে’। এই বাক্যের পুরোটাই এর শব্দ ও কাঠামোসহ গ্রামীণ জীবনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ। গ্রামীণ জীবনে বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে ‘বনিয়াদি ঘর’ খুব ব্যবহৃত হয়। আর বনিয়াদি ঘর বলতে ‘কাজিদের ঘর’ অর্থাৎ কাজিদের বংশকেও বোঝানোর ও ব্যবহারের রেওয়াজ সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। ফলে জসীমউদ্দীন সেই মৌখিক কথাটিকেই, সাধারণ মানুষের মুখে ব্যবহৃত বাকরীতিকেই শুধু একটু বিন্যস্ত করে নিয়েছেন ছন্দকাঠামোর মধ্যে। অথবা আরো উদাহরণ দেয়া যেতে পারে একই কবিতা থেকে। সেখানে মায়ের মৃত্যুকালীন আকুতি ফুটে উঠেছে তার ছেলের প্রতি, ‘দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষ্মী আমার ওরে/কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা, ছাড়িয়া যাইতে তোরে।’ মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের এই আহাজারির ভাষা একেবারেই জসীমউদ্দীনের নিজস্ব নয়। যুগ যুগ ধরে এই ভাষাতেই (‘দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে’) অসুস্থ অথবা মৃত্যুপথযাত্রী মায়েরা তাদের সন্তানদের বুকে চেপে আহাজারি করেন। আহাজারির এই ভাষার স্ট্রাকচারটাকেই দারুণভাবে কবিতায় পুরে দিয়েছেন জসীমউদ্দীন। অথবা একই কবিতা থেকে উদাহরণ দেয়া যাক কিছু উপমা-তুলনার। ‘এইখানে তোর বু-জীর কবর, পরির মতন মেয়ে’ — চরণটিতে মেয়েকে পরির সাথে তুলনা করা হয়েছে। এই উপমাটি এর শব্দগুচ্ছসহ মৌখিক বাংলার বাকরীতিকে ধারণ করে আছে। কারণ, গ্রামীণ ভাষাকাঠামোর মধ্যে যেকোনো সুন্দর মেয়েকে পরির সাথে তুলনা করার একটা ভাষাগত রেওয়াজ চালু আছে। জসীমউদ্দীন সেই রেওয়াজটিকেই ব্যবহার করেছেন। লক্ষ করা যাক নক্সী কাঁথার মাঠ কাব্যের কিছু অংশ :
শেখ বাড়িতে যেয়ে ঘটক বেকি-বেড়ার কাছে,
দাঁড়িয়ে বলে, “সাজুর মাগো, একটু কথা আছে।”
সাজুর মায়ে বসতে তারে এনে দিলেন পিঁড়ে,
ডাব্বা হুঁকা লাগিয়ে বলে, “আস্তে টান ধীরে।”
ঘটক বলে, সাজুর মাগো মেয়ে তোমার বড়,
বিয়ের বয়স হলো এখন ভাবনা কিছু কর।”
সাজুর মা কয়, “তোমরা আছ ময়-মুরব্বি ভাই,
মেয়ে মানুষ অত শত বুঝি কি আর ছাই!
তোমরা যা কও ঠেলতে কি আর সাধ্য আছে মোর?” (জসীমউদ্দীন ২০১২ : ৬৮/১)
এই ভাষার শেকড়-বাকড় চারানো বাগভঙ্গি আর বাকরীতির সমবায়ে গঠিত গ্রামীণ ভাষাকাঠামোর গভীরে। এই ভাষাকাঠামোটিকেই কবি ছন্দের কাঠামোর খাপে পুরে ফেলেছেন। এখানে ক্রিয়াপদের সাধুতা-অসাধুতার প্রশ্ন, আধুনিকতা-অনাধুনিকতার প্রশ্ন খুবই গৌণ। এই ভাষা খাঁটি বাংলা ভাষা। কেমন বাংলা ভাষা! হাজার বছর ধরে সাধারণ মানুষ তাদের মুখে যে বাংলা ভাষা ব্যবহার করে আসছে এবং আরো বহুকাল ব্যবহার করবে সেই বাংলা ভাষা। ‘আধুনিক সাহিত্য’ এই বাংলা ভাষাকে ভুলে গিয়েছে। জসীমউদ্দীন সেই নির্বাসিত বাংলা ভাষার, ভুলে যাওয়া বাংলা ভাষার কবি। জসীমউদ্দীন যে বাংলা ভাষার মৌখিকরীতির মৌলিক কাঠামো (deep structure)-এর মধ্যে তাঁর কাব্যভাষাকে গড়ে তুলেছেন তার আরো কিছু বিচ্ছিন্ন উদাহরণ দেখা যেতে পারে — ‘মাঝে সোনার মুখটি হাসে আঁধারেতে চাঁদের আলো’, ‘চেয়ে তাহার মুখের পানে রাখাল ছেলের বুক ভেঙে যায়’, ‘সারা বাড়ি খুশির তুফান — কেউ ভাবেনা তাহার লাগি’, ‘মেয়ে-জামাই মিলছে যেন চাঁদে চাঁদে চাঁদের মেলা’, ‘কে যেন দুইটি আয়না ধরিয়া পেতেছে যাদুর ফান’, ‘ফুলেরও আঘাত লাগে যদি গায় কেমনে সহিবে বালা’, ‘পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক’, ‘এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা’, ‘গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে’, ‘কাঁদছিস তুই? কি করিব দাদু! পরান যে মানে না’, ‘বা-জান আমার শরীর আজিকে কি যে করে থাকি থাকি’, ‘গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা’, ‘চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ’, ‘কবর দেশের আন্ধার ঘরে পথ পেয়েছিল খুঁজি’, ‘তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ’, ‘বড় ব্যথা রোলো মা বলিতে তোর দুনিয়াতে কেহ নাই’ ‘জোড় মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু-ছায়’, ‘ভেস্ত নাজেল করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়’, ‘দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে’। মৌখিক বাকভঙ্গি ব্যবহারের উদাহরণগুলো নেয়া হয়েছে রাখালী কাব্যের শুধু ‘রাখালী’, ‘কিশোরী’ আর ‘কবর’ কবিতা থেকে প্রায় দৈব চয়নের ভিত্তিতে। এই ধরনের ভাষাবৈশিষ্ট্য জসীমউদ্দীনের সব কাব্যগ্রন্থেই লক্ষ করা যাবে।
অন্যদের সাথে জসীমউদ্দীনের বাকরীতির পার্থক্য কোথায়? সম্ভবত ভূগোলে আর শ্রেণির বোধে। জসীমের ভুগোলের নাম পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশ। আর শ্রেণির নাম আধুনিক কাব্য-সাহিত্যে অনুপস্থিত গণশ্রেণি। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য একটি উদাহরণ হাজির করা যেতে পারে মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে। তার আগে বলা দরকার যে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা কাব্যে ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রথম সজ্ঞান আমদানিকারক। ভাবে আর ফর্মে তিনি বাংলা কবিতার সাথে আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের সেতুবন্ধ রচনা করেছেন। বলা হয়ে থাকে তিনি মধ্যযুগের ‘মজে যাওয়া’ বাংলা কবিতার নদীকে স্রোতবতী করেছেন। (হুমায়ুন ১৯৯৯ : ২৬৭) সোজাসাপটা কথায়, তিনি বাংলা কবিতার নিজস্ব গতির অভিমুখকে প্রথম ইউরোপীয় আধুনিকতার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। এতে বাংলা কবিতার নিজস্ব আধুনিকতা বা নিজস্ব গতির কী ক্ষতিসাধন হয়েছে বা উপকার হয়েছে সে এক বিরাট বিতর্কই বটে। তবু একথা বলা দরকার যে, তিনি আধুনিক কবিদের মধ্যে সেই বিরলতম কবি, যিনি ইউরোপীয় আধুনিকতার চর্চাটি করেছেন বাংলা ভাষার বাগভঙ্গির জমজমাট ব্যবহারের মাধ্যমে। বাংলা ভাষার বাকরীতিতে ছিল তাঁর একটা অনায়াস দখল। এটি মাইকেলের কবিভাষার একটা বড় শক্তির দিক। মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১) থেকে উদাহরণ দেয়া যাক। উদাহরণটি নেয়া হয়েছে মেঘনাদবধ কাব্য-এর প্রথম সর্গ থেকে। এখানে দূতের মুখে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের ছেলে বীরবাহুর নিহত হওয়ার দুঃসংবাদ শুনে রাবণ হাহাকার করে বলেছেন :
নিশার স্বপন সম তোর এ বারতা,
রে দূত! অমরবৃন্দ যার ভুজবলে
কাতর, সে ধনুর্দ্ধরে রাঘব ভিখারী
বধিল সম্মুখ রণে? ফুলদল দিয়া
কটিলা কি বিধাতা শাল্মলী তরুবরে?
হা পুত্র, হা বীরবাহু, বীর-চূড়ামণি!
কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?
কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি,
হরিলি এ ধন তুই? হায় রে, কেমনে
সহি এ যাতনা আমি? কে আর রাখিবে
এ-বিপুল কুল-মান এ কাল সমরে!
বনের মাঝারে যথা শাখাদলে আগে
একে একে কাঠুরিয়া কাটি, অবশেষে
নাশে বৃক্ষে, হে বিধাতঃ, এ দুরন্ত রিপু
তেমতি দুর্বল, দেখ, করিছে আমারে
নিরন্তর! হব আমি নির্ম্মূল সমূলে
এর শরে! … হায় ইচ্ছা করে,
ছাড়িয়া কনকলঙ্কা, নিবিড় কাননে
পশি, এ মনের জ্বালা জুড়াই বিরলে। (মাইকেল ২০১১ : ৭২ )
লক্ষণীয় যে, কবিতাংশের অধিকাংশ বাক্য ও বাক্যাংশই বাংলা ভাষার বাগভঙ্গিকে দারুণভাবে প্রয়োগ করেই আধুনিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি পাঠকের মনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে গেছে। ‘নিশার স্বপন সম তোর এ বারতা,’ ‘ফুলদল দিয়া কাটিলা কি বিধাতা শাল্মলী তরুবরে?’, ‘কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?’, ‘কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি,/ হরিলি এ ধন তুই?’, ‘হায় রে, কেমনে সহি এ যাতনা আমি?’, ‘কে আর রাখিবে/ এ-বিপুল কুল-মান এ কাল সমরে!’, ‘হায় ইচ্ছা করে, ছাড়িয়া কনকলঙ্কা, নিবিড় কাননে/পশি, এ মনের জ্বালা জুড়াই বিরলে’ — এইসব শব্দগুচ্ছ, চরণাংশ, চরণ ও চরণগুচ্ছ বাংলা ভাষায় নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে শতশত বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং সম্ভবত হতে থাকবে। বাকরীতি বা বাগভঙ্গির উপর্যুপরি ব্যবহারই মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য-এর ভাষারীতির অন্যতম শক্তি।
কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে, মাইকেলের এই বাকরীতির ব্যবহার আর জসীমউদ্দীনের বাকরীতির ব্যবহারের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আছে। পার্থক্যটা ভাষার ওই ভূগোল আর শ্রেণির পার্থক্য। মাইকেলের ব্যবহৃত বাগভঙ্গির মধ্যে ভাংচুর আর ‘সচেতন’ মাজাঘষার লক্ষণ অত্যন্ত প্রকট। মহাকাব্যের প্রয়োজনেই হোক আর ভাষার শ্রেণি সচেতনতার কারণেই হোক আর ঔপনিবেশিক মনস্তত্তে¡র কারণেই হোক মাইকেলের ভাষা সংস্কৃতশাসিত ‘অভিজাত’, ‘উন্নত’, ‘মার্জিত’। তিনি প্রচলিত কথাকেই ‘মার্জিত ভাষারুচি’র একটা মোড়কে ঢেকে উপস্থাপন করেছেন। কারণ মাইকেল তো হিন্দু কলেজের ইয়ংবেঙ্গলের চেতনার উত্তরাধিকারী। অন্য অনেক এজেন্সির মতো এই শ্রেণিটির হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে সংস্কৃতশাসিত বাংলার প্রতিষ্ঠা সহজ হয়েছিল। ফলে ‘বন’ বা ‘জঙ্গলের’ চেয়ে ‘নিবিড় কাননেই’ মাইকেলের ঝোঁক বেশি। ভাষা ও ভাবের প্রশ্নে নির্দিষ্ট ভূগোল বা প্রদেশের ঊর্ধ্বে উঠতেই মাইকেলের আনন্দ। একথা মাইকেলের যেকোনো কাব্যের ভাষা পরীক্ষা করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। বিপরীতে জসীমউদ্দীনের কবিভাষায় জবরদস্তি নেই। মাজাঘষার প্রয়োজনই তাঁর কম হয়। ভাষাকে ‘উন্নত রুচি’র মোড়কে ঢাকার তাগিদ তিনি বোধ করেন না। ভাষায় জসীমউদ্দীনের সাধনা সহজ সুরের সাধনা। ভাষায় পূর্ব বাংলা ভূগোলের চিহ্ন বহন করেই তাঁর বাকরীতি বিশিষ্ট ও অনাড়ম্বর হয়ে উঠেছে। একারণেই বোধ করি জসীমউদ্দীনের কবিতা সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন, ‘তাঁর কবিতা পূর্ব বঙ্গেরই নির্যাস। পূর্ববঙ্গ বাদ দিলে তাঁর কবিতার সামান্যই অবশিষ্ট থাকবে।’ (রণজিৎ ও সাজ্জাদ ২০০৯ : ৯)
জসীমউদ্দীন বাংলা কবিতায় ভাষার প্রশ্নে নিজস্ব আধুনিকতার সাধক। তাঁর সাধনা নিজের কথা নিজের ভাষায় সহজে বলার সাধনা। এককথায় সহজের সাধনা। মানুষের স্বাভাবিক বাকস্ফূর্তিকে তিনি কবিতার ফ্রেমের মধ্যে আঁটাতে পেরেছিলেন। এজন্য তাঁকে কারো কাছে হাত পাততে হয়নি। হাত যদি পাতার প্রশ্নই ওঠে তবে তিনি পেতেছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে, নিজস্ব কাব্য-ঐতিহ্যের কাছে। বিরাট জনগোষ্ঠীর মর্মের ভেতরে থেকেই তিনি তাঁর কাব্যভাষা নির্মাণ করেছিলেন। এদিক বিবেচনায় বলা যায়, তিনি খাঁটি বাঙালি কবি। ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণি ‘ইউরোপীয় ভাবধারার মদিরা’, ঔপনিবেশিক রুচির মদিরা, বহিরাগত আধুনিকতার মদিরা পান করে ‘উন্মত্ত হয়ে’ বাংলা সাহিত্য থেকে যে-ভাষাকে বিসর্জন দিয়েছে, ভুলে গিয়েছে, তিনি সেই ভুলে যাওয়া, বিসর্জিত বাংলা ভাষার কবি জসীমউদ্দীন। জসীমউদ্দীন বাংলা কবিতায় ভাষার ব্যাপারে যুগপৎভাবে আনন্দ আর অশ্রুপাতের অভিজ্ঞতা হয়েই থাকবেন।
টীকা
১. এই মত প্রথাগত ইতিহাসে ব্যাপকভাবে চর্চিত যে, বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগ মানেই পদ্যের যুগ। কিন্তু বাংলা গদ্যের একটা গড়ন মধ্যযুগের ষোড়শ শতকের পয়ারের শাসনের মধ্যেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। রাজকাজে, দলিল দস্তাবেজে আর চিঠিপত্রের মতো প্রয়োজনের জগতে ব্যবহৃত হয়ে ‘বাক্যের গড়ন আর সার্বিক প্রকাশভঙ্গি একটা কাঠামোগত পূর্ণতা পেয়ে গিয়েছিল।’ (মোহাম্মদ আজম ২০১৪ : ১৫৮-১৫৯) আনিসুজ্জামান জানাচ্ছেন, ‘ষোড়শ শতকের শেষদিকে, বিশেষতঃ সপ্তদশ শতাব্দীতে, বৈষ্ণব সহজিয়া সম্প্রদায়ের বিকাশ ঘটেছিল, তাঁরা গদ্যেই তত্ত¡কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন।’ (আনিসুজ্জামান ১৯৮৪ : ১৯-২০) অষ্টাদশ শতকেও এই ধারায় বহু নিবন্ধ ও ধর্মীয় সাহিত্য রচিত হয়েছে। উপযুক্ত গদ্যের নমুনা পরীক্ষা করে দেবেশ রায় মন্তব্য করেছেন, ‘বাংলা গদ্যে ব্রিটিশ প্রভাব কার্যকর হওয়ার আগেই, অন্তত আঠার শতকে, উত্তরবাংলার কোচবিহার থেকে শুরু করে ভাগীরথী-তীর পর্যন্ত গদ্যভাষার একটি রূপ প্রচলিত ছিল।’ (দেবেশ ১৯৮৭ : ১৮) কেমন ছিল সেই গদ্য? এই গদ্য ছিল সমকালীন চলতি বাংলার খুবই কাছের। এখানে আরবি-ফারসি শব্দের সংখ্যা ছিল রীতিমতো প্রচুর। এর কারণ হয়ত মুসলমানি শাসন। কিন্তু ব্যবহারের দিক থেকে আর চলমান জীবনের কর্মপ্রক্রিয়ায় ভাষাটি জমে ওঠার দিক থেকে এতে হিন্দু-মুসলমানের অনায়াস যৌথতা ছিল। শুধু তাই নয়, অনেক গবেষক মনে করেন এই গদ্যের প্রতিষ্ঠায় বাঙালি হিন্দুর অবদানই বেশি। কিন্তু কালপ্রবাহে উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার ধারায় ষোড়শ শতক থেকে বেড়ে ওঠা এই বাংলা গদ্য ‘মুসলমানি বাংলা’ হিসেবে আখ্যায়িত ও চিহ্নিত হয়ে পরিত্যক্ত হয়েছে। (মোহাম্মদ আজম ২০১৪ : ১৬৩-১৬৪)
২. বাংলা গদ্যে সংস্কৃত ভাষার শব্দ কী পরিমাণ ঢুকানো হয়েছিল তার একটা বাস্তবাবস্থা প্রমথ চৌধুরী দারুণ এক ব্যঙ্গের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘আদিশূরের আদিপুরুষ যখন গৌড় ভাষা সৃষ্টি করতে উদ্যত হলেন, তখন তাঁর সংকল্প ছিল যে, ভাষাটাকে বিলকুল সংস্কৃত ভাষা করে তোলেন, শুধু গৌড়বাসীদের প্রতি পরম অনুকম্পাবশত তাদের ভাষার গুটিকতক কথা বাংলা ভাষায় ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছিলেন।’ (প্রমথ ১৯৮৬ : ২৫৬) বাংলা ভাষায় এই অতিরিক্ত সংস্কৃত শব্দের ব্যবহারকে তিনি ‘বঙ্গসরস্বতীর কানে শুধু পরের সোনা পরানো’ বলে সাব্যস্ত করেছেন। এই কাজটিই হয়েছিল সাহেব-পদ্ধতি ঐক্যে নির্মিত হওয়া ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গদ্যে।
৩. প্যারীচাঁদ মিত্র ও কালীপ্রসন্ন সিংহের আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৭) আর হুতোম প্যাঁচার নকশা (১৮৬২)-কে তো প্রমথ চৌধুরী রীতিমতো সংস্কৃত আধিপত্যের বিরুদ্ধে ‘বাঙালির ওড়ানো বিদ্রোহের দুটি লাল পতাকা’ বলে অভিহিত করেছেন। (প্রমথ ১৯৮৬ : ২৮১)
৪. আসলে এই সংস্কৃতপ্রধান গদ্যটি ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই পোক্ত হয়ে গিয়েছিল। গবেষক বলেছেন, ‘১৮১৮ সালে বাংলা সাময়িকপত্র প্রকাশিত হওয়ার আগেই সংস্কৃত-প্রভাবিত বাংলা লেখার রীতি নীতিগতভাবে সর্বজনস্বীকৃতি লাভ করে।’ (গোলাম মুরশিদ ১৩৯৯ : ১৮৫)
৫. জসীমউদ্দীনের কবিতায় তদ্ভব শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘তদ্ভব শব্দ প্রয়োগের দিকেই জসীমউদ্দীনের প্রবণতা। তাঁর কাব্যে এরূপ অজস্র কাব্যপঙ্তি মিলবে, যেখানে জসীমউদ্দীন তৎসম শব্দ প্রায় একরূপ বর্জন করেছেন। জসীমউদ্দীনের সহজ কবিত্বের স্ফূর্তি ঐসব ক্ষেত্রেই বেশী লক্ষ করা যায়।’ (সুনীল কুমার ১৯৯৭ : ২৮২)
৬. আবদুল মান্নান সৈয়দ ঠিকই বলেছেন যে, ‘জসীমউদ্দীনের কাব্যভাষায় আঞ্চলিক শব্দ অক্লেশে মিশে গেছে, বাংলাদেশেরই আঞ্চলিক শব্দ — যেমন তাঁর কাহিনীকাব্যে তেমনি তাঁর গীতিকবিতায়’। (আহমাদ মাযহার ২০১৭ : ৭৫)
৭. বিনয় ঘোষ তো বাংলা অঞ্চলের রেনেসাঁসের দাবিই নাকচ করে দিয়েছেন। প্রথাগত ইতিহাসে যাকে রেনেসাঁস বলে ব্যাখ্যা করা হয় তাকে ঘোষ রেনেসাঁস না বলে বলেছেন, এটাকে বড় জোর ইউরোপীয় সংস্কৃতির সাথে বাঙালির ‘সংস্কৃতিসংঘাতজনিত আদর্শের আদানপ্রদান ও মিশ্রণ বলা যায়।’ তিনি আরে যোগ করে বলেন, ‘এবং এই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ও মিশ্রণও সমাজের অতিসংকীর্ণ উচ্চস্তরে উচ্চবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ।’ (বিনয় ১৪২৩ : ১৮৬) বাংলার কথিত রেনেসাঁস বা নবজাগরণকে তিনি ‘সাময়িক চিত্তচাঞ্চল্য’ বলে আখ্যায়িত করে এর শ্রেণিচরিত্র সম্পর্কে আরো বলেছেন, ‘ইয়োরোপীয় মডেলের কোনো আধুনিক নবজাগরণ বাংলা দেশে অথবা বাঙালী সমাজে হয়নি। আমরা ইয়োরোপীয় বিদ্যা ইংরেজের আমলে শিক্ষা করে সবকিছুই সেই বিদ্যার আলোকে দেখতে ও বিচার করতে শিখেছি। তাই সোডার বোতলের উচ্ছ্বসিত বুদ্বুদের মতো খানিকটা সাময়িক আদর্শগত চিত্তচাঞ্চল্য এদেশের কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে লক্ষ্য করে এবং রেলগাড়ির বাষ্পীয় ইঞ্জিনের শব্দ আর কয়েকটি ক্ষুদে কারখানার ভোঁ শুনে আমরা ভেবেছি আমাদের দেশে ইয়োরোপের মতো রেনেসাঁসের হাওয়া বইছে। আমাদের ভাবনা ভুল, সাদৃশ্যবোধ ভুল। হাওয়া বয়েছিল সমাজের উপরতলার চিলেকোঠার একটি ছোট আধখোলা জানালা দিয়ে। সেই হাওয়া কারও গায়ে লাগেনি, মনে তো নয়ই। নবজাগরণ হ্য়নি, যা লেখা হয়েছে, এখনও লেখা হয়, তা অতিকথা।’ (বিনয় ১৪২৩ : ১৭৯)
৮. অবশ্য অনেকে মনে করেন, রেনেসাঁসের বৈশিষ্ট্যই এই যে, বাতির নিচে অন্ধকারই থাকে। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, ‘পাশ্চাত্য রেনেসাঁস বেশি লোকের কাজ নয়, অল্পসংখ্যক বিদ্বান ও শিল্পীর কাজ। প্রাচীন গ্রীসেও প্রদীপের তলায় ছিল অন্ধকার। অধিকাংশ লোকই ক্রীতদাস বা ধর্মান্ধ।’ (অন্নদাশঙ্কর ২০০৪ : ৭১)
৯. আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর ‘জসীমউদ্দীনের কবিতা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘দেখা যাবে কেবল নক্সী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, সকিনা প্রভৃতি দীর্ঘ কাহিনীকাব্যেই নয়, ‘কবর’, ‘পল্লীজননী’, ‘কাল সে আসিবে ফিরে’ এবং আরো খণ্ড কবিতাতেই জসীমউদ্দীন একটুখানি কাহিনীর বুনন রেখেছেন।’ (আহমাদ মাযহার ২০১৭ : ৩৬)
সহায়কপঞ্জি
অন্নদাশঙ্কর রায় (২০০৪), বাংলার রেনেসাঁস, দ্বিতীয় মুদ্রণ, বাণীশিল্প, কলকাতা।
আনিসুজ্জামান (১৯৮৪), পুরোনো বাংলা গদ্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
আল মাহমুদ (২০১৯), ‘জসীমউদ্দীনের অহংকার’, কালের ধ্বনি (সম্পা. ইমরান মাহফুজ) বর্ষ ১০, সংখ্যা ৮, প্রকাশনা ৯, ঢাকা।
আহমাদ মাযহার (২০১৭), আবদুল মান্নান সৈয়দের জসীমউদ্দীন[সম্পা. আহমাদ মাযহার],অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা।
কুদরত-ই-হুদা (২০১৮), জসীমউদ্দীন, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা।
গোলাম মুরশিদ (১৩৯৯), কালান্তরে বাংলা গদ্য, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
জসীমউদ্দীন ( ২০০১), জসীমউদ্দীনের প্রবন্ধসমূহ, দ্বিতীয় খণ্ড, পলাশ প্রকাশনী, ঢাকা।
জসীমউদ্দীন (২০০৩), জীবনকথা, পলাশ প্রকাশনী, ঢাকা।
জসীমউদ্দীন (২০১১), সুচয়নী, দ্বাদশ প্রকাশ, পলাশ প্রকাশনী, ঢাকা।
জসীমউদ্দীন (২০১২), কবিতা সংগ্রহ ১, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
জসীমউদ্দীন(২১০৬), যে দেশে মানুষ বড়, ষষ্ঠ মুদ্রণ, পলাশ প্রকাশনী, ঢাকা।
জসীমউদ্দীন (২০১৭), নক্সী কাঁথার মাঠ, একবিংশ প্রকাশ, পলাশ প্রকাশনী, ঢাকা।
তিতাশ চৌধুরী (১৯৯৩), জসীমউদ্দীন : কবিতা, গদ্য ও স্মৃতি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
দেবেশ রায় (১৯৮৭), আঠার শতকের বাংলা গদ্য, প্যাপীরাস, কলকাতা।
প্রমথ চৌধুরী (১৯৮৬), প্রবন্ধসংগ্রহ, সংশোধিত পুনর্মুদ্রণ, বিশ্বভারতী, কলকাতা।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৪১৭), বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, ষষ্ঠদশ মুদ্রণ, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা।
বিনয় ঘোষ (১৩২৩), বাংলার নবজাগৃতি, তৃতীয় মুদ্রণ, প্রকাশ ভবন, কলকাতা।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২০১১), মেঘনাদবধ কাব্য, পরিমার্জিত অষ্টাদশ সংস্করণ, মর্ডাণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
মোহাম্মদ আজম (২০১৪), বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ, আদর্শ, ঢাকা।
রণজিৎ দাশ ও সাজ্জাদ শরিফ (২০০৯), ‘ভূমিকা’, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (সম্পা. রণজিৎ দাশ ও সাজ্জাদ শরিফ), সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৪০২), বাংলা শব্দতত্ত্ব, তৃতীয় স্বতন্ত্র সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ, বিশ্বভারতী গ্রন্থবিতান, কলকাতা।
হুমায়ুন আজাদ (১৯৯৯), নির্বাচিত প্রবন্ধ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস (২০১২), হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনাসমগ্র ১, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
সুকুমার সেন (২০০৪), ভাষার ইতিবৃত্ত, নবম মুদ্রণ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় (১৯৯৭), জসীমউদ্দীন, চতুর্থ সংস্করণ, নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, ঢাকা।