ছবি আঁকতে কে না পছন্দ করে! নিশ্চয়ই তোমরা সবাই ছবি আঁকতে পছন্দ কর? ছোটবেলার আদর্শলিপি বই, অ আ ক খ শেখার সাথে সাথেই তোমাদের আঁকা-আঁকির পর্বটিও শুরু। বড় ভাই, আপুদের বই, দরকারি নোট অথবা বাবার অফিসের প্রয়োজনীয় কাগজে, মায়ের মাসিক হিসেবের খাতায় ছবি কেনা এঁকেছ? তোমার আঁকা-আঁকি থেকে বাদ যায়নি সফেদ দেয়ালটিও। তোমার এ দুরন্তপনা স্বভাবের জন্য বকুনিও শুনতে হয়েছে বড়দের।
আঁকা-আঁকি যাই কর না কেনো, এর যেন কোন মূল্যই নেই বড়দের কাছে! তারা সবসময় গুরুত্ব দেন পড়াশোনায়। তাই বলে একেবারেই গুরুত্ব দেন না এটাও পুরোপুরি সত্য নয়। তোমার আঁকা ভালো ছবির মৃদু প্রসংশাও তাঁরা করেন। তবে, তাদের জোরটা বরাবরই থাকে তোমার পড়াশোনায়। তাই বলে কি তুমি আঁকবে না? নিশ্চয়ই আঁকবে।
আজ তোমাদের কাছে এমন একজনের গল্প বলব, যিনি ছোটবেলায় তোমাদের মতই আঁকতে ভালোবাসতেন। কোন বাধাই তাকে এই আঁকা-আঁকির জগৎ থেকে আলাদা করতে পারেনি। রংতুলি আর মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকেছেন একের পর এক ছবি। এই ছবিই তাঁকে একদিন এনে দিয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। অনুমান করতে পারছ, কার কথা বলছি ? বলছি, আমাদের সবার প্রিয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কথা।
বাংলাদেশের শিল্পকলা জগতের পুরোধা ও পথিকৃৎ ছিলেন জয়নুল আবেদিন। এই চিত্রশিল্পী ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলা) কেন্দুয়ায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তাঁর বাবা তমিজউদ্দীন আহমেদ পেশায় ছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর। মা জয়নাবুন্নেছা খাতুন ছিলেন গৃহিণী।
ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত স্বভাবের। কিশোর বয়সের চঞ্চলতা তাঁর মধ্যে ছিল না। চুপচাপ ও শান্ত স্বভাবের এই ছেলেটিকে গ্রামের সবাই ভালবাসতো। ঠান্ডা স্বভাবের জন্য পাড়া-প্রতিবেশীরা ভালোবেসে তাঁর নাম দিয়েছে ঠান্ডার বাপ। গ্রামের বউ-ঝিরা ঠান্ডার বাপকে অনেক আদর করে। তাদের বানানো নকশি পিঠা খেতে দেয়। পিঠা নয়, ঠান্ডার বাপের দৃষ্টি আটকে থাকে পিঠার নকশায়। খেলাধুলার চেয়ে তার বেশি ভালো লাগতো নদীর দৃশ্য, মাঝির গান। ভাটিয়ালি গান ছিল তার খুব প্রিয়। কুমার বাড়িও তার যাতায়াত ছিল। কুমার যখন মাটির হাঁড়ি, কলসিতে নানা রকম নকশা আঁকত, তখন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখত কুমারের আঁকা নকশা। মাঝে মাঝে নিজেই বসে যেত মাটির হাতি-ঘোড়া-পুতুল তৈরি করতে। এভাবেই আঁকা-আঁকির প্রতি ভালোবাসা জন্মায় ঠান্ডার বাপের মনে।
ঠান্ডার বাপের আরও একটি নাম হলো টুনু। কেউ কেউ টুনু মিয়া বলেও ডাকে। টুনু মিয়া একবার স্টেটসম্যান পত্রিকায় ছোটদের ছবি আঁকা প্রতিযোগিতার খবর দেখে। ছবি আঁকতে তাঁর ভালোই লাগে। প্রতিযোগিতার জন্য এঁকে ফেলল ছবি। কিন্তু ছবি এঁকে পড়ল মহা বিপদে। কীভাবে পাঠাবে ছবি ? টাকার প্রয়োজন, ছবিটিই বা কেমন হলো! নানা কথা ভেবে বিছানার নিচেই রেখে দিল ছবিটি। কিছুদিন পর টুনুর বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় স্টেটসম্যান পত্রিকা সাথে নিয়ে আসে। পত্রিকায় টুনুর আঁকা ছবি ছেপেছে। বিছানার নিচের ছবিগুলো টুনুর বাবাই পাঠিয়েছিল পত্রিকায়। পত্রিকায় নিজের আঁকা ছবি দেখে টুনু খুশিতে আত্মহারা। আজ টুনুর খুশি দেখে কে!
একবার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইংরেজি ক্লাস নেয়ার সময় টুনুর ইংরেজি বইটি চাইলেন। টুনু পড়ল মহা বিপদে। কারণ বইয়ের সমস্ত ফাঁকা আংশে নানা আঁকি-ঝুঁকিতে ভরা। কিন্তু স্যারকে বই দিতেই হলো। স্যার সমস্ত বই উল্টে-পাল্টে দেখলেন। ক্লাস শেষ করে বললেন তোমাকে বইটি পরে ফেরত দিচ্ছি। টুনু আরও ভয় পেল। স্যার মনে হয় তার উপর রেগে আছেন। পরদিন থেকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। টুনু স্কুলে আসছে না দেখে কিছুদিন পর প্রধান শিক্ষক নিজেই গেলেন টুনুর বাড়ি। জিজ্ঞেস করলেন স্কুলে না যাওয়ার কারণ কী? টুনু ভয়ে ভয়ে সত্য কথাই বলল। স্যার তার কথা শুনে মৃদু হাসলেন এবং বললেন তুমি যে ছবি আঁকার ভয়ে স্কুলে যাচ্ছ না আমি সেই ছবির প্রশংসা করার জন্যই তোমাকে খুঁজছি। এবার টুনুর ভয় পালাল। আনন্দে ভরে উঠল মন।
ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকা ছিল তাঁর পছন্দের বিষয়। গাছ-পালা, পশু-পাখি, নদী-নারী, ফুল-ফল, প্রকৃতির নানা বিষয় নিয়ে ছেলেবেলাই আঁকা-আঁকি করতেন। শিক্ষাজীবনের প্রথমে তিনি ময়মনসিংহের “পন্ডিতপাড়া পাঠশালা”, তারপর “ময়মনসিংহ জিলা স্কুল” পরে “মৃত্যুঞ্জয় হাই ইংলিশ স্কুলে” পড়াশোনা করেন। জয়নুল আবেদিন শিশু বয়সেই Bombay Cronicle পত্রিকা আয়োজিত নিখিল ভারত শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের গৌরব অর্জন করেন। শিল্পকলার প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ও ভালোবাসা ছিল। কিশোর বয়সেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কলকাতার গভর্ণমেণ্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য বন্ধুদের সাথে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তখন তাঁর বয়স ষোল বছর।
ছবি আঁকার নেশা তাঁর মধ্যে এতই বেশি ছিল যে, ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত দেননি। জয়নুল আবেদিনের মা সন্তানের এই আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে তাকে কলকাতার গভর্ণমেণ্ট স্কুল অব আর্টস-এ পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে দেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৩৮ সালে ড্রইং এন্ড পেন্টিং বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রী সমাপ্ত করেন। জয়নুল আবেদিন গভর্ণমেণ্ট স্কুল অব আর্টস-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালে বাঁশের সাঁকো নামক একটি জলরঙ চিত্রের জন্য প্রশংসিত হন এবং ১৯৩৮ সালে নিসর্গ-দৃশ্য শীর্ষক জলরঙ চিত্রমালার জন্য সর্বভারতীয় প্রদর্শনী প্রতিযোগিতায় গভর্ণরের স্বর্ণ পদক লাভ করেন। এমনকি তিনি আর্টস স্কুলে পড়ার সময়ই উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নেয়া শুরু করেন।
মজার একটি ঘটনা আছে জয়নুল আবেদিনের। তখন তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র। প্রায়ই বিকেলে কবি সুুফিয়া কামালের বাসায় আড্ডা দিতেন। যাতায়াত করতেন ট্রামে। ট্রামে যাতায়াতের সময় যদি কোন কিছু আঁকার চিন্তা মাথায় আসত তখনই ট্রামের টিকিটের অপর পৃষ্টায় তা এঁঁকে ফেলতেন এবং এগুলো সুফিয়া কামালের ছোট্ট ছেলে শামীমকে দিতেন। একবার ভাবো তো আঁকা-আঁকির প্রতি শিল্পাচার্যের কতো ভালোবাসা ছিল!
পরবর্তীকালে তিনি শিল্প জগতে দিতে থাকেন নিজের অমূল্য সব কীর্তিগুলো। রংতুলি দিয়ে ক্যানভাসের বুকে দেশ, মাটি ও মানুষের চিত্রই তুলে ধরেন। প্রিয় শিল্পীর এমনই কিছু বিখ্যাত চিত্রকর্মের নাম জানতে পারলে কেমন হয়! তাঁর চিত্রকর্মের নাম : দুর্ভিক্ষ, সংগ্রাম, বিদ্রোহী, ঝড়, কাক, ম্যাডোনা-৪৩, মনপুরা-৭০, মই, কালবৈশাখী, নবান্ন ইত্যাদি। তিনি আদিবাসী সমাজের প্রতি আগ্রহ নিয়েও ছবি এঁকেছেন, যাতায়াত করেছেন সাঁওতাল পরগণায়। সাঁওতাল শিশু ও নারীদের চিত্র আঁকেন। সাঁওতাল রমণী, সাঁওতাল দম্পতি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
মূলত জয়নুল আবেদিন খ্যাতনামা হন পঞ্চাশের মন্বন্তরের চিত্রকলার জন্য। ১৯৪৩ সালে ভয়াবহ এক দুুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বাংলা ১৩৫০ সনে এই দুুর্ভিক্ষ হয় বলে একে পঞ্চাশের মন্বন্তর বলে। এই দুুর্ভিক্ষে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। খাদ্যের জন্য মানুষ হাহাকার করতে থাকে। অনাহারি মানুষের এই করুণ দৃশ্য জয়নুল আবেদিনকে আলোড়িত করে। তিনি রং-তুলি আর স্কেচের ছোঁয়ায় মন্বন্তরকে তুলে রাখেন তাঁর আপন ক্যানভাসে। তাঁর আঁকা ঐ স্কেচ গুলোই আজও পঞ্চাশের মন্বন্তরের সচিত্র দলিল হয়ে আছে।
বলা যায় বাংলাদেশের শিল্পকলা ইতিহাসের শুরু জয়নুল আবেদিনের হাতে। শিল্পকলা সূচনার ইতিহাসপর্বটি মোটেই সহজ ছিল না। শুরুতে শিল্পের সাথে মানুষের সম্পৃক্ততা, সাধারণের কাছে শিল্পকে পরিচিত করানোর কাজটি ছিল দুঃসাহসিক ব্যাপার। কারণ তখন আঁকা-আঁকির বিষয়টিকে ধর্মীয়ভাবে ভালো চোখে দেখা হতো না। তবুও তিনি শিল্পকে প্রতিষ্ঠার জন্য অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় গভর্ণমেণ্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশে শিল্পচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা করেছেন। খ্যাতনামা শিল্প ব্যক্তিত্ব কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, হাশেম খান, আমিনুল ইসলাম, রশিদ চৌধুরী এরা প্রত্যেকেই এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা সবই ছিল শিল্পকলা নিয়ে। চিত্রশিল্পের উন্নতির জন্য তিনি গড়ে তোলেন নানা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় (পূর্ব নাম গভর্ণমেণ্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট), সোনারগাও লোকশিল্প যাদুঘর। তাছাড়া তাঁরই একান্ত প্রচেষ্টায় বর্তমান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। গুণী এ শিল্পী ১৯৭২ সালে হয়েছিলেন বাংলা একাডেমীর সভাপতি। তিনি ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি-লিট উপাধিসহ নানাভাবে সম্মানিত হয়েছেন দেশ-বিদেশে।
বাংলাদেশের চিত্রকলা জগতের এই মহান পুরুষ ১৯৭৬ সালে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে লন্ডনে পাঠানো হলেও পুরোপুরি সুস্থ হবার সম্ভাবনা ছিল না। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। হাসপাতালে অসুস্থাবস্থায়ই তিনি তাঁর জীবনের শেষ চিত্রকর্মতরুণ-তরুণীর মুখ আঁকেন। শিল্প জগতের এই মহান মানুয় ১৯৭৬ সালের ২৮মে ঢাকার শাহবাগে পি. জি. হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
জয়নুল আবেদিনের শিশুকাল থেকে পরিনত বয়সের বিবরণ সত্যি অনবদ্য।চেষ্টা অব্যাহত রাখ, ইনশাআল্লাহ তুমিও একদিন খ্যাতির শিখরে আরোহনকরবে।