গ্যারি সোটোর একগুচ্ছ কবিতা : ২

গ্যারি সোটো আমেরিকান কবি। তাঁর একগুচ্ছ কবিতা অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের কৃষি ও কাব্যপ্রেমী কবি, অনুবাদক ও নাট্যকার বদরুজ্জামান আলমগীর

 

গ্যারি সোটো — কবি বলতে আমাদের কাছে যেমন একটি ভুলোমন, ওড়াকুরা চুল, কাঁধেতে ঝোলানো ব্যাগ — গ্যারি সোটো অমেরিকায় সেই এক কবি। শাহবাগ আজিজ মার্কেটের সিঁড়িতে বসে থেকে সারাদিনে দুটি পুরি, একটি সিঙ্গারার উপর ভর করে হেঁটে যাচ্ছেন সদরঘাট, কী মীরপুর ১২ নাম্বার, কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে স্যান্ডেল পায়ে নীলক্ষেত বাবুপুরা বস্তি; গ্যারি সোটো তেমন আঙুর বাগানের পাশ ঘেঁষে হেঁটে যান — টপাটপ তুলে নেন গোটা কয় আঙুর, হয়তো দুপুরের চাঁছাছোলা রোদ মাথায় ফিরেন আধভাঙা ডেরায় — ফ্রিজ খোলেন আপন খেয়ালে, এ-যেন রেফ্রিজারেটর নয় — খাঁখাঁ গড়ের মাঠ। একবার সোটো তার দরজা খোলেন, আবার বন্ধ করেন, তার মনে হয়, অচিন যাদুমন্ত্র বলে দৈবাৎ কিছু খাবার ফ্রিজে দেখা দিতেও তো পারে! তাঁর দোস্তি গড়ে ওঠে গরিবি হালতের আরো দুই কবি ল্যারি স্পার্কস, আর ফিলিপ লেভিনের সাথে। তিনি বেড়ে ওঠেন মেহিকান কৃষিজীবী পাড়ায়। একদম বনবাদাড়ে ঘুরে বড় হতে থাকা গ্যারি সোটোর কবিতায় কৃষিজীবন, গাছপালা, ফল শস্যাদি ঢোকে পড়ে আপন সহজ দাবি নিয়ে। গ্যারি সোটো জন্মেছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার ফ্রেসনো শহরে, ১২ এপ্রিল, ১৯৫২ সনে।

 

কবরখানার খোঁজে

আমরা জায়গাটি খুঁজে পেতে ড্রাইভ করছিলাম
তালাশ করি একাডেমি গোরস্থান, পেয়ে যাই
ভাঙাচোরা পিচঢালা চত্বর, চারপাশে বেড়ার বেষ্টনী।

 

বিক্ষিপ্ত গরু আছে এদিক ওদিক —
এদের জবরদস্ত মাথা বেড়ার ঘুলঘুলি গলিয়ে
ঝুলে আছে বাইরে, মুখ দিয়ে লালা পড়ছে।
আমরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি
গাড়ির রেডিও বন্ধ করে দিই।

 

মন বলে — আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি।
আমরা উল্টাপাল্টা পাড়ি চালাতে থাকি,
আস্তে আমাদের সম্বিৎ ফিরে আসে — যখন বুঝতে পারি
ঠিকই আছে — এই তো গাড়ির ছায়া।

 

শুকনো ঘাসগুলো কেমন তেলতেলে দেখাচ্ছে, নিদ্রাহীনভাবে পড়ে আছে সিগারেট প্যাকেটের রাঙতা,পানীয়ের কৌটা চ্যাপ্টা, দুমড়ানো মোচড়ানো,
এখানে সেখানে বিস্কিটের টিন, কুকির ডিব্বা।

 

আমরা গাড়ি একপাশে দাঁড় করাই,
গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি — পকেটে হাত ঢুকিয়ে
ইতস্তত হাঁটতে থাকি এবার। পায়ের তলায় কাঁকর থেকে
কেমন একটা শব্দ আসে — কিছুটা বুঁদ হয়ে যাই।
বারটা ছিল শনিবার — আমাদের শহর ফ্রেসনোর শনিবার,
কিন্তু মনে হচ্ছে পায়ের নিচে মাড়িয়ে যাচ্ছি রোববার।

 

আমরা প্রায় কিছুই বলছি না — হাঁটছি।
ওই তো একটা পাখি, আর মনে হলো
কাঁধে কে যেন আলতো হাত রাখে, ছিরিৎ করে রাস্তা ডিঙিয়ে যায় দিব্যি জনা কয় খরগোশ।
আমরা বুঝতে পারি —
কবরখানার কাছাকাছি চলে এসেছি।
রেললাইনের ওপারে দুই পাহাড়ের মাঝখানে মৃতদের পাড়া
ইচ্ছা করলেই তারা উঠে যেতে পারে না,
চলে যেতে পারে না।

 

উপরে প্রখর সূর্য — কী ভেবে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম
এখানেই কী আমাদের আসার কথা ছিল —
কোন চলনদারের পাল্লায় পড়ে এখানে চলে এলাম!
হঠাৎ শিস দিয়ে হাওয়া উতরায়
একটা পাতা কেমন ঝিকমিক করে ওঠে —
একটি অনুমানে নিজেকে বাঁধি — ওই তিনটি ওক গাছ
ওখানে আছে দাঁড়িয়ে।

 

মনে পড়ে, উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছিলাম;
পাহাড়ের মাথায় ব্যাকুল আসতে আসতে, ছুটতে ছুটতে
কোন ফাঁকে ঘাসগুলো এতোটা দিঘল হয়ে ওঠে —
কোমর অবধি এসে ঘাসেরা কানে কানে কথা কয়!

Source Poem : Looking for a cemetery.

 

দূরে যাওয়া

মনে রাইখো আমরা চলে যাচ্ছি

সরে যাচ্ছি ওই দিনগুলো থেকে —

আমরা একটা ঘরে গাদাগাদি করে ছিলাম

ওটা ছিল সাদাইয়া সৎবাপের বাড়ি

মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি ওইসব কথা

যেগুলো নিয়ে সাদা বাবার মন বিগড়ে থাকতো।

 

কিন্তু আমাদের মনের কালশিটে পাকাপাকি

বসে আছে — তুলতে পারি নাই

আঙুলের গেরোয় ময়লা যেমন ভাঁজে ভাঁজে

চিপায় চাপায় কামড় দিয়ে বসে থাকে — সেই রকম

শত সাবানেও পরিস্কার হয় না।

 

আমি আজও ভুলতে পারি না —

তুমি প্রতি রাতেই তীব্র শীতে

কাঁপতে কাঁপতে ঘুম থেকে উঠতে

তোমার হাত দু’টি যেন ভয়ে পেরেক মারা থাকতো!

 

গরমের মাসে আমরা দুই ভাই

সারা বিকাল বাড়ির পিছনে কোদাল মারতাম

আমাদের মুখ কড়া রোদে গনগনিয়ে উঠতো

আমরা হাতে সরাতাম ভনভনে ভেঙ্গুরের পাল —

আমাদের এ সবই একজন নির্বিকার

গাছের ছায়ায় বসে আরামে চেয়েচেয়ে দেখতো-

আমরা মনে মনে ভাবতাম —

 

এইডাই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় খবিশ!

 

ভাই আমার, একমুহূর্তের জন্যও ওইদিনের

কথা ভুলবো না।

 

সময়ের অমোঘ টানে আজ আমরা

একজন থেকে আরেকজন মেলা দূরে।

এই দিনেও বড় ভাবি —

 

নীরবে আপন একটা ঘর —

কাঁচা ভোরে আমার একান্ত কাছে তুমি ঘুমিয়ে আছো

নির্ভয়, ভাইয়ের উৎকন্ঠায়, ভরসায়!

Source Poem : Moving away.

 

মেষপালক

সে যেখানে পা ফেলে সেখান থেকেই

ঘাস ফলফলিয়ে ওঠে

তা-ই পূর্বপুরুষের বসতভিটা।

তার বাম কাঁধে হার্প বাজে অন্তরবীণা

ডান কাঁধে চাঁদ ঢালে অচিন জ্যোৎস্নার বসন্তবাহার।

কোমর ঘেঁষে ঝোলানো ব্যাগে ভরা

মোয়া আলু আর শালগম।

 

করাত কাটা কবন্ধ গাছের দোস্ত সে

আর একজন দুর্ভাগা গৃহহীন পাথর,

চোখে-মুখে উপরওয়ালার বরকতের রোশনাই

ভাঙা ঘরে ধনের আলো হয়তো বা আচানক

বাড়ি ফেরে — সে আশানিরাশার দোলাচলে মগ্ন

সূর্য যেমন ধীরে খোলে নিজের পরিচ্ছদ!

 

চাঁদের ঝিরঝিরে উন্মীলনে উইলো ভাবে

নিজেরই পদকমলে যদি ঢালিয়া দিই মন!

কোন কাড়াকাড়ি নেই, আলগোছে সরাও বৃক্ষলতা

পাবে তার মৌলিক কাঠ, নির্ভুল আগুন,

ঝরে পড়ে জমা হয় পাতার উপর পাতার গিলাপ।

 

যেখানে সে পা ফেলে — পাতা মুষড়ে গোঙায়

তাদের শতছিন্ন মুখের স্বীকৃতি মন্ত্রবৎ তার নাম জপে।

Source Poem : The Shepherd.

আগের লেখাকায়সার হকের কবিতা
পরের লেখাপ্ল্যাকার্ডে নারীবাদ
বদরুজ্জামান আলমগীর
বদরুজ্জামান আলমগীর: কবি, নাট্যকার, অনুবাদক। জন্মেছিলেন ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। পড়াশোনা বাজিতপুরে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বহুদিন দেশের বাইরে- যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় থাকেন। বাঙলাদেশে নাটকের দল- গল্প থিয়েটার- এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; নাট্যপত্রের সম্পাদক। নানা পর্যায়ে আরও সম্পাদনা করেছেন- সমাজ ও রাজনীতি, দ্বিতীয়বার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পূর্ণপথিক, মর্মের বাণী শুনি, অখণ্ডিত। প্যানসিলভেনিয়ায় কবিতার প্রতিষ্ঠান- সংবেদের বাগান-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রকাশিত বই।। আখ্যান নাট্য: নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। কবিতা: পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর। আখ্যান নাট্য: আবের পাঙখা লৈয়া। প্যারাবল: হৃদপেয়ারার সুবাস। কবিতা: নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো, দূরত্বের সুফিয়ানা। ভাষান্তরিত কবিতা: ঢেউগুলো যমজ বোন। ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here