বীজ ।। কিস্তি : ১৪

বীজ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এক তরুণীর তীব্র সংবেদনা; পর্যবেক্ষণশীল চোখ দিয়ে সে দেখেছে নিজের ভেতর ও বাহির। মনিরুল ইসলামের লেখা এই উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে সমকালীন জীবনের অন্দরমহলে।

 

রঙচঙা একটা শার্ট পরে এসেছে মাজহার ভাই। যাত্রার দলে যেমন উৎকট রঙের কস্টিউম পরা হয় অনেকটা সেরকম। বললাম, ‘কী ব্যাপার মাজহার ভাই, শুটিং আছে নাকি? এমন উড়াধুড়া শার্ট পরেছেন?’ শুনে খুশি হয়ে গেল। ভাবলো প্রশংসা করে বলেছি। পছন্দ হয়ে গেছে, কিনে ফেলেছেন। এই তার জবাব। লোকটা সহজ সরল। উনাকে আর আগের মত অসহ্য লাগে না। অসহ্য লাগতে লাগতে হয়তো সয়ে গেছে। অথবা উনি আসলে তেমন লোকই না। বুঝতে পারি না। চাহনির সমস্যা এখনো আছে। এটা সম্ভবত উনার বিল্ট-ইন। কথাবার্তায় পরিমিতিবোধ এখনো নেই। তবে তার কিছু ভালো দিকও আবিষ্কার করা গেছে এতোদিনে।

বললাম, ‘মাজহার ভাই, আপনার বিয়ের দাওয়াত এখনো খাওয়াননি।’ – যোগ করলাম – ‘কবে খাওয়াবেন তাহলে। বলেন?’ উনার ওয়াইফকে নিয়ে আসবেন ঢাকায়। এখন যেখানে থাকেন ওটা একটা মেসের মত। কয়েকজন মিলে থাকেন। সবাই চাকরিজীবী। জানালো, রিমার সঙ্গে তোমাদের কথা আমি আলাপ করি। রিমা উনার ওয়াইফের নাম। আনন্দমোহনে বোটানিতে অনার্স। চাকরি-বাকরির প্রিপারেশন নিচ্ছে। ঢাকায় চলে আসবে। বাসায় একদম পড়াশোনা হয় না।

 

অফিসে খুব চাপ যাচ্ছে। এটা বোঝা যায় বিরক্তির মাত্রা থেকে। বিরক্তি যখন চরমে সকলের আলোচনার বিষয় তখন কে কবে চাকরি ছাড়ছে এই নিয়ে। তার মানে অফিসে লোড যাচ্ছে খুব।

সঠিক টাইমেই এসেছি। ঢুকেছি সাড়ে নয়টার দিকে। পাটোয়ারী দেখেছেও আমাকে। তবু রুমে ডেকেছে। সচরাচর এরকম হয় না। স্টাফদের সঙ্গে বেহুদা প্যাঁচাল পাড়ার লোক উনি না। আমার মনে হয় বসদের আসলে পাটেয়ারীর মতই হওয়া উচিত। নয়তো প্রতিষ্ঠান টেকানো মুশকিল। প্রতিবছর কত নিত্যনতুন প্রকাশনী যে গজাচ্ছে। বাজারে আসছে বাহারি নামের গাইড। এই বাজারে প্রতিযোগিতা করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা চাট্টিখানি কথা না।

 

এর মধ্যে মোজাম্মেলের কাছ থেকে নতুন তথ্য জানা গেছে। পাটোয়ারীর নাকি মেয়ে আছে একটা। দেখতে শুনতে ভালো। একটু ঢঙ বেশি, এই যা সমস্যা। মায়ের মত চেহারা পেয়েছে। মোজাম্মেল আবার নির্দিষ্ট করে দেয়। কারণ তার মতে, পাটোয়ারীর চেহারা শেয়ালের মত। তার মত চেহারা হলে, এই মেয়ের সারাজীবন অবিবাহিত থাকতে হতো। ঘটনা হলো, বিভাসকে পাটোয়ারীর খুব পছন্দ। অনেকদিন থেকেই নাকি পছন্দ। পাটোয়ারী চায় বিভাসের সঙ্গে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিতে। কিন্তু বিভাস এতো সহজ জিনিস না। সে জালে ধরা দিচ্ছে না। আর পাটোয়ারীও মুখ ফুটে বিভাসকে কিছু বলতে পারছে না।

 

পাটোয়ারী কি আমাকে দিয়ে বিভাসকে কিছু বলাতে চায়? এতো সাংঘাতিক ব্যাপার! মানে কী? আমি কি আমার প্রেমিকের বিয়ের ঘটক হতে যাচ্ছি নাকি? একটা ব্যাপারে আমার খুব রাগ হলো। বিভাস কেন এ-ব্যাপারে আমাকে কিছু বললো না? এতো সিরিয়াস একটা ঘটনা! আর আমাকে কিনা জানতে হলো, মোজাম্মেলের কাছ থেকে। আমি একধরনের অপমানিতই বোধ করলাম।

 

পাটোয়ারীর রুমে যাওয়ার সময় শান্তা আপুর সঙ্গে দেখা। কথা হলো না। সে-ও বললো না কিছু। হয়তো ওয়াশরুমে গিয়েছিলো। তাকে দেখে খুবই মনমরা লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো বাজে সময় পার করছে। মানসিক এক ঝড়ের মধ্যে দিয়ে সে যাচ্ছে। হ্যাঁ তাইতো, মনে হলো, এই রাস্তা তো আমার চেনা। আমার উচিত এই পথে তাকে সঙ্গ দেওয়া। অবশ্যই উচিত। তার কি পারিবারিক ঝামেলা চলছে? খুব বেশি মাত্রায় চলছে? খারাপ লাগছিলো আমার। মনে হচ্ছিল তার সঙ্গে আমি একদম অকৃতজ্ঞের মত আচরণ করে চলেছি। সে আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতো বা এখনও করে। অথচ আমি এখন কথা বলি না বললেই চলে। আমি স্থির করলাম। যা কিছুই হোক। পাটোয়ারী আমাকে ধমকালেও, আমার কান্না আসলেও রুম থেকে বেরিয়েই তার সঙ্গে গিয়ে আমি কথা বলবো। বলতেই হবে। খোঁজ নিতে হবে তার। সে কেমন আছে? সে আমার বোন।

‘আসবো স্যার?’ কোনো জবাব নেই। দরজাতেই আমি দাঁড়িয়ে আছি। ডাবলু ভাইয়ের হাতে চায়ের সরঞ্জামাদি। দেখলো আমি দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। ‘স্যার রুমে নেই?’ জিজ্ঞাসা করলাম। ডাবলু ভাই সোজা রুমে ঢুকে গেল। আমাকে বললো ভেতরে গিয়ে বসতে। স্যার ওয়াশরুমে। স্যারের ওয়াশরুমটা অ্যাটাচ্ড। ভেতর থেকে ফ্লাশের আওয়াজ আসছে। এরমধ্যেই দরজা খুলে বেরোলেন। তখনো আমি দরজাতেই দাঁড়িয়ে। ওয়াশরুমের দরজার ছিটকিনি লাগাতে লাগাতেই বললেন, ‘লায়লা? আসেন, আসেন।’ এমডি স্যার আমাকে লায়লা বলে ডাকেন। লম্বা-চওড়া একজন মানুষ। ইন করে শার্ট পরেছেন। পায়ে বেগুনি স্যান্ডেল। স্যান্ডেলের চেয়ে পা বড়। ফর্সা পা। বেশ ফর্সা। পায়ের আঙ্গুলে কালো কালো চুলের গোছাও দেখা যাচ্ছে। ফুলপ্যান্টের নিচের অংশটা ভাঁজ করা। হাত মুছতে মুছতে চেয়ারে বসলেন। বললো, ‘বসেন। বসেন।’ আমি বসলাম। আমাকেও চা দিতে বললো। ডাবলু ভাই আমাকেও চা দিলেন। আমি বললাম, ‘স্যার আমি চা খেয়েছি।’ সচরাচর এমন হয় না। মানে কখনোই হয় না। আমাদের জন্য চায়ের আলাদা ব্যবস্থা আছে। নিশ্চয়ই স্যার ভিন্ন কোনো আলাপ করবেন। আন-অফিসিয়াল। আমি শিউর। মনে হলো বেশ ভাল মুডেও আছেন। মোজাম্মেল তাহলে সত্যি কথাই বলেছে।

: বাসার সবাই কেমন আছেন, লায়লা? বাবা? মা? ভাইবোন? আমি যদি ভুল না করি, আপনারা তো তিন বোন। তাই না?

: জি স্যার। জি স্যার। সবাই ভালো আছে, স্যার। আপনি কেমন আছেন স্যার?

 

পাটোয়ারীর রুমটা কেমন ডাক্তারদের চেম্বারের মত। সব স্পন্সরড জিনিসে ভরপুর। ক্যালেন্ডার থেকে শুরু করে দেয়ালে ঝোলানো পেইন্টিংটা পর্যন্ত আরেকজনের দেওয়া। মানে কোম্পানির। রুমটা তবে গোছানো। এজন্যই ভালো লাগে। এসিটা একটু কমিয়ে দিলেন। ডাবলু ভাই নেই। থাকার কথাও নয়। কাজ শেষ হয়েছে মানে গেট আউট। তার ওপর এই নির্দেশনা জারি থাকে। ফ্যানের শাঁ শাঁ শব্দ হচ্ছে। চুপ করে আছি। বিব্রতকর একটা পরিস্থিতি। বুড়ো বয়সে পাটোয়ারীর ভীমরতি ধরলো নাকি। অনেক বস আছে, নারী সহকর্মী-পরিবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করে। কাজ না-থাকলেও অযথা ডেকে এনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রুমে আটকে রাখেন। পাটোয়ারীই নীরবতা ভাঙলো। ‘কোনো অফিসিয়াল বিষয় নয়, লায়লা। নাথিং টুবি ওরিড। অর হেসিটেইশানও বলা যায়।’ বলে হাসলেন। খুব মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। বিব্রত লাগছিলো আমার। চোখ সরিয়ে নিয়ে আমি এদিকোদিক তাকালাম। বললেন, ‘আপনি কিন্তু আমাদের ভাইভায় ভালো করেননি। আমার মনে আছে। ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। সহজ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন না। বারবার সরি বলছিলেন। মনে আছে আপনার?’ আমার দিক থেকে চোখ সরাচ্ছেন না। তাকিয়েই আছেন। কিন্তু চোখে খারাপ কিছু নেই। বুঝতে পারছি। স্যারের চোখগুলো কি বাবার মত? না, বাবার মত না।

আমি হাসলাম। বললাম, ‘জি স্যার। মনে আছে।’ আসলে আমার মনে পড়ছিলো না। ভাইভার দিনটার কথা মনে পড়ছিলো। কী প্রশ্ন করেছিলো, পেরেছিলাম কি পারিনি, তা মনে পড়ছে না। শাড়ি পরে এসেছিলাম সেদিন। মনটাও বিমর্ষ ছিল খুব। রাতে তামান্নাদের মেসে ছিলাম। শাড়ির রঙটাও মনে পড়ছে, একদম হালকা কলাপাতা রঙের। একদম হালকা। জামদানি একটা শাড়ি। তামান্নার খুব পছন্দ হয়েছিল শাড়িটা। আবেগে বলে ফেলেছিলাম, চাকরি হলে তোকে দিয়ে দিব। কিন্তু তার এতো পছন্দ হওয়ায় শাড়িটার প্রতি আমারও টান বেড়ে গিয়েছিল। পরে আর দেইনি। তামান্নাও বলেনি কিছু।

‘ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। সেটা যে আপনার বেটার ভার্সন না, আমি বুঝতে পেরেছিলাম।’ বলে থামলেন। থেমে থেমে কথা বলাই উনার অভ্যাস। ‘ভাইভাতে অবশ্য বেটারটা দেওয়া যায় না। আপনার রেজাল্ট ভালো।’ আবারও থামলেন। ‘আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ অবশ্য ছিল।’ — বললেন — ‘সেটাই আসল কারণ কিনা!’ হাসলেন। এবার সুন্দর করে হাসলেন। ‘সেই-কারণেই আপনাকে ডেকেছি আজ।’ স্যার থামলেন। এখানে উনার থামাই উচিত। নয়তো আমাকে ডাকার মত নাটকীয় ঘটনাটা একদম পানসে হয়ে যায়।

 

স্যার খুব গুছিয়ে কথা বলেন। আমি ধরেও ফেলেছিলাম, কী নিয়ে কথা বলবেন উনি। কিন্তু কথাবার্তা বেশ জটিল পথ ধরে এগোচ্ছে। কূল-কিনারা দেখছি না। আমাকে একদম অবাক করে দিয়ে স্যার বললেন, আমি দেখতে নাকি উনার মায়ের মত। আমাকে দেখলে উনার মায়ের কথা মনে পড়ে। আজকে স্যারের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। তাই আমাকে রুমে ডেকেছেন। আমার সঙ্গে একটু গল্প করবেন। এই তার পরিকল্পনা। উনার দুই মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়েদের একজন আমারই বয়সী। বললেন, আমিও উনার মেয়ের মতই। স্যারের কথা শুনে কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। চুপচাপ বসেছিলাম।

 

থেমে থেমে ধীরে সুস্থে বলে যাচ্ছিলেন তিনি। খুব কষ্ট করে মানুষ করেছেন মা। শুনেছি গোপনে মানুষের বাসায় কাজও নাকি করেছেন। ছেলেকে জানাতেন না। বাবা মারা গিয়েছিলেন। অবশ্য মারা না-গেলেও অবস্থা একই থাকতো। কিছু করতেন না তিনি। প্যারালাইজড ছিলেন। মা-ই সংসার চালাতো। হাঁস পালতো। মুরগি পালতো। বিড়ি বাঁধতো। ব্যাগ সেলাই করতো। ঠোঙা বানাতো। সব জানতো মা। ‘ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম বছরটা যে কীভাবে সামলেছে, আমার কাছে তা এখনো রহস্য।’ — বললেন — ‘তখনই বোধ হয় মানুষের বাসায় কাজ করেছে।’ মুখে হাসির কঙ্কাল ঝুলিয়ে রেখে কথা বলছেন স্যার। ভাবলাম, কাঁদতে না শুরু করে। কাঁদলে সর্বনাশ। দেখা যাবে আমিও কেঁদে ফেলেছি। এমনিতেই ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি। পরে টিউশনি করতে শুরু করেন। বলতে গেলে পুরো টাকাই বাসায় পাঠিয়ে দিতেন। সেই টাকাতেই সংসার চলতো। পড়াশোনা চলতো ভাইবোনদের। ‘জানেন লায়লা, যখন অনেক টাকা আসতে শুরু করলো, তখন থেকেই শুরু হল মা’র অসুস্থতার পর্ব।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তার চোখ মোটেই ছলছল করছে না। বরং শুকনো খটখটে। বয়স হলে চোখের পানি কি শুকিয়ে যায়? মার্বেলের মত গুটি গুটি তার চোখ। মোজাম্মেল কেন যে শেয়ালের মত বলে। স্যার বলেই যাচ্ছেন। কী যে হয়েছিল! কিছুই খেতে পারতো না। অনেক কিছু খাওয়া নিষেধ হয়ে গেলো। যা পছন্দ করতো। যে মানুষ সারাজীবনে খেলোই না, তার খাওয়ার ওপরে আবার নিষেধ কীসের। যা পছন্দ করে স্যার তা নিয়ে যেতেন। যদি খায়। একটু খায়। হঠাৎ আমার মনে হলো। স্যার কাঁদছে। এটা অদৃশ্য কান্না। বাক্যগুলোকে স্পর্শ করলে দেখা যাবে ভেজা। চোখ দিয়ে নয়, ভাষা দিয়ে তিনি বিসর্জন করছেন অশ্রু। একদম গোপনে। বিভাস ঠিক বুঝতে পারবে। আরও ভালো করে বুঝতে পারবে।

‘ওয়াশরুমের ভেন্টিলেটরের ফোঁকরে দেখবে সবসময় একটা বুড়ো টিকটিকি বসে থাকে। আমি যখন পায়জামা খুলি তখন সে চোখ বড় বড় করে হা করে তাকায়। এটা সিক্রেট। কাউকে বলো না।’

স্যারের জন্য আমার খুব মায়া হলো। এই লোকটাকেই কিনা আমরা সবাই মিলে ঘৃণা করি। সবকিছুই কেমন অদ্ভুত। বিভাস কি এই কারণেই আমাদের দলে যোগ দিতো না? ও কি স্যারের এই রূপটাকেও চেনে? বিভাস কি আমাদের সকলের চেয়ে বেশি দেখে? আমার খুব ভালো লাগছিলো, গর্ব হচ্ছিলো বিভাসকে নিয়ে। বারবার মনে হচ্ছিলো, ও আমার বিভাস। কেমন জানি লাগছে আমার। মনে হচ্ছে, একটুতেই কেঁদে ফেলবো।

 

দুপুরের ব্রেকের সময় হতে বেশি বাকি নেই। সোজা শান্তা আপুর ডেস্কে গেলাম। ডেস্কগুলোর ডেকোরেশন অনেকটা সরকারি ব্যাংকের মত। চেয়ারে না-বসে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। গলা জড়িয়ে ধরলাম তার। ফিসফিস করে বললাম, ‘কী হয়েছে বলো? মন খারাপ করে থাকো কেন?’ এমন উদ্ভট আচরণ সে আশা করেনি। করার কথাও নয়। চেয়ারে বসে থেকেই ঘাড় উঁচিয়ে তাকালো আমার দিকে। আমার কোনো কন্ট্রোল ছিল না নিজের ওপর। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। টুপটাপ কয়েক ফোঁটা হয়তো পড়েও গেলো। শান্তা আপুই ভয় পেয়ে গেলো। তার চোখে-মুখে প্রশ্ন, হলো কী আমার? আমাকে সে চেয়ারে বসালো। জেসমিন দি’ সবই দেখছে। কিন্তু ঘটনা বুঝতে পারছে বলে মনে হলো না। সেদিকে খেয়ালও ছিলো না আমার। আমি অবশ্য ভাবিনি যে চোখে পানি চলে আসবে। এটা এমডি স্যারের ইফেক্ট হতে পারে। অথবা সবটা মিলিয়ে। বললো, আগে বল, তোর কী হয়েছে? পাটোয়ারী কিছু বলেছে? আমি মাথা নেড়ে না বললাম। বললাম, ‘তুমি মন খারাপ করে থাকো কেন? আমাকে বলো, তোমার কী হয়েছে? তুমি আমার বোনের মত। আজ থেকে তুমি আমার বোন।’ আমি একদম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। আবেগে ভিজিয়ে একাকার করে দিলাম সব। আমাকে সামাল দিতে দিতেই তার অস্থির অবস্থা।

 

নিজেকে সামলে নিলাম আমি। বললাম, ‘বলো, আমাকে বলতেই হবে, কয়েকদিন যাবৎ কেন তুমি এতো মনমরা হয়ে থাকো?’ আমার প্রশ্নের জবাবে গলার স্বর নামিয়ে আনলো সে। জানালো, হাজব্যান্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না। গত সপ্তাহে ডিভোর্স হয়েছে। হাজব্যান্ডের ফ্যামিলি, এমনকি তার হাজব্যান্ডের আচরণও তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না। তবু সে চাচ্ছিলো না, রিলেশনটা নষ্ট হয়ে যাক। দুই ফ্যামিলি থেকেই ডিসিশানটা ঠিক হয়েছে। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কারণ হলো, তার সন্তান না-হওয়া। তার শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের ধারণা তার সমস্যার কারণেই বাচ্চা হচ্ছে না। এমনকি তার হাজব্যান্ডেরও ধারণা, তার থাইরয়েডের সমস্যার কারণেই বাচ্চা হচ্ছে না।

 

আবারও বিমর্ষ ভাবটা তার মধ্যে ফিরে এলো। এতক্ষণ ছিলো না। তার স্বামীর মত সে-ও হয়তো তাই মনে করে যে, থাইরয়েডের কারণেই তাদের বাচ্চা হচ্ছে না। আমার কেন জানি তার হাজব্যান্ডের নাম জানতে ইচ্ছা করলো খুব। বললাম, তোমার হাজব্যান্ডের নাম কী? আমার প্রশ্ন শুনে সে অবাক হলো। না-হেসে পারলো না। বললো, তুই তো দেখি ভালোই উদ্ভট। অবশ্য সে আর এখন তার স্বামী নয়। বললো, তার নাম ছিল সবুজ। বললাম, পুরো নাম বলো। আমাকে থাপ্পড় দেওয়ার ভঙ্গি করলো সে। বললো, শাহীন আলম সবুজ। বললাম, তুমি তাকে ভালোবাসো না, আমি শিউর। তুমি চাচ্ছিলে তোমাদের সম্পর্কটা থাকুক, কারণ তোমার ফ্যামিলিকে তুমি সোশ্যালি ঝামেলায় ফেলতে চাও না। ঠিক কিনা বলো? শান্তা আপু হাসলো। বললাম, তোমার সঙ্গে বিশেষ একজনের পরিচয় করিয়ে দিবো আমি। কে? চোখে-মুখে গভীর প্রশ্ন নিয়ে সে তাকালো আমার দিকে।

‘ওয়াশরুমের ভেন্টিলেটরের ফোঁকরে দেখবে সবসময় একটা বুড়ো টিকটিকি বসে থাকে। আমি যখন পায়জামা খুলি তখন সে চোখ বড় বড় করে হা করে তাকায়। এটা সিক্রেট। কাউকে বলো না।’ — নিচু স্বরে বললাম — ‘এটা দুষ্টামি না। আমি সিরিয়াস।’ সে কি হকচকিয়ে গেল! আমি নিজেও বুঝতে পারছি না — কী থেকে কী বলছি আমি। আপু হয়তো ধরে নিলো এটা আমার দুষ্টামি। আমি কন্টিনিউ করলাম, ‘তাকে সামান্য একটা টিকিটিকি মনে করা তোমার উচিত হবে না।’ কী ভেবে বললাম, নিজেই জানি না। কিন্তু বললাম বেশ গুরুত্ব দিয়েই। প্রসঙ্গ পাল্টে এবার বললাম, ‘তুমি নিজেও তাই মনে করো যে, তোমার কারণেই তোমার সন্তান হচ্ছে না, তাই না? এটাকে মাথা থেকে তাড়াও, নয়তো একফোঁটা শান্তিও তুমি পাবে না। দেখো, বলে রাখলাম।’

 

তার চোখে-মুখে মনমরা ভাবটি আর নেই। কে জানে আবার হয়তো ফিরে আসবে। আমি চাই না-আসুক। আমি জানি আমার এই চাওয়াটা সুন্দর। কিন্তু ঘটনা কোনো সুইচ-বাটন নয় যে, প্রার্থনা তাকে অন-অফ করতে পারে। ঘটনা একটা প্রক্রিয়া। প্রার্থনা তাকে সুন্দর রূপ দিতে পারে মাত্র। অথবা তা-ও পারে না। প্রার্থনা মাত্রই ঈশ্বরের চিন্তার বিপরীত চিন্তা। কেননা, ঈশ্বর যা চায় তা বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য কোনো প্রার্থনার প্রয়োজন নেই। কার কথা এগুলো? এগুলো কি বিভাসের কথা? বিভাস কবে বললো, তা মনে পড়ছে না। নয়তো আমারই। আমি কি বিভাস হয়ে যাচ্ছি? বিভাসের কথাগুলো কি একের পর এক জীবন্ত হয়ে ওঠছে আমার মধ্যে?

খেতে গিয়ে দেখা হল সবার সঙ্গে। শান্তা আপুকে স্বাভাবিক লাগছে। জেসমিন দি’ জানতে চাইলো, কী এতো গোপন কথা হলো আমাদের দুজনের মধ্যে। আমি বললাম, শান্তা আপুর সঙ্গে আমি বোন পেতেছি। এখন থেকে আমরা চার বোন। শান্তা আপু ঘোষণা দিলো, আমার নাকি মাথা খারাপ টাইপ কিছু একটা হয়েছে।

 

মোজাম্মেল একটা হারামি। তার সব কথা বানোয়াট। তাকে পেলে আমি ধরবো। কে তাকে বলেছে, এমডি স্যারের মেয়ে একটাই? মোজাম্মেলকে হাসি-খুশিই দেখাচ্ছে। মোরগ পোলাও সে পছন্দ করে। আজ সোমবার। সোমবারের আইটেম থাকে মোরগ-পোলাও। তার ঠোঁটের কোণায় খাবারের দানা লেগে আছে। এটা বিশ্রী লাগে আমার কাছে। ইঙ্গিতে আমি দেখালাম। ও মুছে নিলো। বিভাসের চুলগুলো আরও বড় দেখাচ্ছে। আমি বলেছি না-কাটাতে। ওকে অন্যান্য দিনের মতই লাগছে। আসলে কাকে কেমন লাগবে তা আমার ওপরই নির্ভর করে। কাকে আমি কোন চোখে দেখবো তার ওপর। এটাও হয়তো কোনোদিন বলেছিল বিভাস। অথবা তা আমারই কথা। অফিস ছুটির পর ইমরানকে অপেক্ষা করতে বললাম। বললাম, কথা আছে। এমনিতেই সে অপেক্ষা করতো। তার এই অপেক্ষাটাকে এখন মূল্যবান করে দিলাম আমি।

 

বিভাসের কথা তবু আমি বুঝতে পারি। ইমরানের কথা একদম বুঝি না। হয় সে শিশুদের মত সরল ভাষায় কথা বলে অথবা পুস্তকের কঠিন গদ্যের ভাষায়। জেসমিন দি’ চা খেতে চাইলো। শান্তা আপুও তাদের দলে। বিভাসের সঙ্গে শান্তা আপুর একটা সেশন দরকার। এখানে জেসমিন দি’র না-থাকাটাই বরং ভালো। তাদের কাছ থেকে আমি বিদায় নিয়ে নিলাম। আমি, ইমরান আর মোজাম্মেল। ইমরান চুপচাপ। মোজাম্মেলই কথা বলে যাচ্ছে। কেমন ফুরফুরা লাগছিলো আমার। মোজাম্মেল পাটোয়ারীকে নিয়েই পড়ে আছে। সরকার গাইড বইয়ের ওপর কড়াকড়ি শুরু করেছে। পাটোয়ারীর নামে মামলা হয় হয় করেও হয়নি। ঢাবিরই কোন এক আমলের ছোটো ভাই আছে পাটোয়ারীর। প্রশাসনে। তাকে ধরে নাম কাটিয়েছে।  মামলা না-হলেও উৎকোচ গুণতে গিয়ে শালার প্যান্ট ছিড়ে যেতো। বললাম, ‘তোমার এসব কথা বানানো। এটা এখন পানির মত পরিষ্কার। তুমি বললে, এমডি স্যারের মেয়ে একটাই। কিন্তু উনার তো মেয়ে দুইটা।’ হার মানার বান্দা সে নয়। হাসে। তার মানে আমার অভিযোগ সত্যি। সে মেনেও নিয়েছে। বলে, ‘বিয়ের বয়সী তো একটাই। আরেকটা ছোটো।’ আমি আসলেই অবাক হলাম। ও তো দেখি খোঁজ জানেই। বললাম, ‘সামাদের কী হল, বলোতো? খুব তো বললে, এমডি স্যারের ছেলে। ও এখন কোথায়?’ জবাব তার রেডি। আমার কথায় সে মাইন্ডও করে না। বলে, ‘ও! তুমি তাহলে ঘটনা জানো না।’ এরপর সে ঘটনা জানাতে শুরু করে। সামাদকে পাটোয়ারী নিয়ে এসেছিল ম্যানেজার বানানোর কথা বলে। কিন্তু সামাদের তো পড়াশোনা তেমন নেই। পাটোয়ারী তাকে ম্যানেজার কেমনে বানায়। আর সামাদও দেখলো তার কাজ হলো চা-টানা। এ নিয়ে শুরু হলো দেন দরবার। পরে পাটোয়ারী তাকে পল্টন ট্রান্সফার করেছে। পল্টনে তার টেইলার্স আছে একটা। সামাদ সেখানে ম্যানেজারি করে। বলল আমাকে একদিন নিয়ে যাবে।

‘আমি তোমাকে এ-কথা জানালাম কেন জানো? যেহেতু তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমার মনে হয়েছে তোমাকে আমার এসব জানানো উচিত। তোমার জানা উচিত যে আমি মেয়েটা সুবিধার না। খারাপ একটা মেয়ে। বুঝতে পেরেছো?’

তার গল্পে মুগ্ধ না-হয়ে উপায় নেই। কোনটা যে বানানো, আর কোনটা সত্যি তা বলা মুশকিল। বললাম, ‘আচ্ছা, বলোতো, পাটোয়ারী আমাকে পছন্দ করে কেন?’ এবার সে ভড়কে গেল। বোঝা গেল আমাকে নিয়ে তার গল্প নেই। এই প্রশ্ন তার কমন পড়েনি। খুব সিরিয়াস হয়ে গেল সে। একটু ভাবলো, কী বলবে। খুব গুরুত্বপূর্ণ মত দেওয়ার ঢঙে বললো, ‘পাটোয়ারী তোমাকে পছন্দ করে, কারণ তোমার মধ্যে সে তার মেয়েকে খুঁজে পায়। তার মেয়েটা তো ইংলিশ ভার্সন। এটা তার পছন্দ না। সে চায় মেয়েটা তোমার মত হোক।’ আমি হাসলাম। যেন আমি আমলেই নিলাম না তার কথা। কিন্তু তার কথায় আমি যারপরনাই কনভিন্সড। আমি জানি এমডি স্যার কেন আমাকে পছন্দ করে। স্যার নিজেই বলেছে। কিন্তু মোজাম্মেল যে শুধু তার ইনট্যুইশন দিয়েই এতদূর পৌঁছে যেতে পারে! এটা আমার কল্পনাতেই ছিল না। আমার কাছে খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার এটা। যদিও এমডি স্যারের মেয়েকে আমি দেখিনি, তবু মনে হল, তার কথা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক।

 

মোজাম্মেলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ইমরানকে নিয়ে ক্যাম্পাসের পথ ধরলাম আমরা। হাঁটতে ইচ্ছা করছিলো না। রিকশা নিলাম। ইমরানের সঙ্গে প্রথম রিকশায় ওঠা। ও ভাবতে পারেনি যে আমি রিকশা নিবো এবং ওকে নিয়েই ওঠবো। ও খুব জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। হাসি পেলো আমার। আমি আরাম করেই বসলাম। তার গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে। খুব ড্যাশিং ফিল হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল ইমরানকে পেছন থেকে ধরে বসি। বিভাসকে যেমন ধরি। এই ধরনের অনুভূতিগুলোর আমি কোনো ব্যাখ্যা পাই না। কেন ইমরানকে স্পর্শ করতে ইচ্ছা করবে আমার, আমি তো তাকে ঐ অর্থে ভালোও বাসি না? তাহলে কি আমি খারাপ-টাইপ মেয়ে? ‘খারাপ’ কি জিনিস? কে খারাপ? কেন খারাপ?

 

ইমরান ভাড়া দিয়ে দিতে চাইলো। আমি না বলায় জোর করলো না। আমতলায় বসলাম। যথারীতি জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে সবাই। খুব মজা লাগলো আমার। সুবিধাজনক জায়গাগুলো সব দখল। সুবিধা বলতে সর্বোচ্চ কতটা আড়াল আদায় করা যায়। সুবিধাজনক জায়গা আমাদের দরকার নেই। একটু নিরিবিলি জায়গা হলেই চলবে। ¯্রফে কথা বলার জন্য। হঠাৎ মনে হলো, আমি আসলে কার জুটি? মোজাম্মেলের? বিভাসের? নাকি ইমরানের? অবশ্য মোজাম্মেলের সঙ্গে আমতলায় কখনো বসিনি। ইমরানের সঙ্গে আজকেই প্রথম। বিভাসের সঙ্গে বসা হয় প্রায়ই। ইমরানের নাকি খুব ভালো লাগছে আমার সঙ্গে। সারাক্ষণ আমার কথা তার মনে হয়। যেকোনো তুচ্ছ ঘটনাও আমার সঙ্গে তার শেয়ার করতে ইচ্ছা করে। খুব বলতে ইচ্ছা করলো, ‘এই পথ আমার চেনা, ইমরান।’ বললাম, ‘তোমাকে কি বলেছিলাম? শোভন নামের একটা ছেলের সঙ্গে আমার অ্যাফেয়ার ছিল?’ ও বললো, ও জানে। বললাম, কতদূর জানো? আমার প্রশ্ন বুঝতে পারলো না সে। ঘাবড়ে গেলো। বলার টোনটাও আমার সঠিক ছিলো না। স্বরটাকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। বললাম, শোভনের ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে কিছু আলাপ আছে আমার। এই জন্যই এখানে আসা। আর কিছু নয়। বললাম, তার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিলো। যথারীতি ফিজিক্যাল সম্পর্কও। জিজ্ঞাসা করলাম, আগে তার কোনো অ্যাফেয়ার-ট্যাফেয়ার ছিলো কিনা? ‘না, ছিলো না।’ আসলেই ও বাচ্চা একটা ছেলে। বললাম, জানোতো, এখনকার সময়ের প্রেম মানেই ফিজিক্যাল রিলেশন।  তা এক সপ্তাহের হোক। অথবা একবছর। আমার কথা নয়। বিশেষজ্ঞদের কথা।

 

বুঝতে পারছি, চোখমুখ শুকিয়ে যাচ্ছে তার। বেচারা হয়তো প্রেমের মৃদুমন্দ মিষ্টিকথার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। এখন দেখছে কোনো প্রশ্নই কমন নয়। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে মানুষের চেহারা যেমন হয় তাকে তেমন দেখাচ্ছে। নিজেকে আমার খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির কেউ মনে হলো। আমিই তো সেই সোর্স এই মুহূর্তে যা তাকে ধ্বংস করছে। নষ্ট করে দিচ্ছে তার ব্লাডসেলগুলোকে। ইমরানের হয়তো গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বারবার ঢোক গিলছে সে। চুপ করে আছে। বলছে না কিছু। ঠিক এই কষ্টটাই কি আমি পেয়েছিলাম? নিঃসন্দেহে এর চেয়ে বেশি? ও এত কষ্ট পাচ্ছে কেন? ও হয়তো আমাকে সত্যিই চায়। মনে-প্রাণে চায়। বললাম, ‘আমি তোমাকে এ-কথা জানালাম কেন জানো? যেহেতু তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমার মনে হয়েছে তোমাকে আমার এসব জানানো উচিত। তোমার জানা উচিত যে আমি মেয়েটা সুবিধার না। খারাপ একটা মেয়ে। বুঝতে পেরেছো?’ ইমরান জিজ্ঞাসা করলো, ‘কতবার সেক্স করেছো তোমরা?’ আমি হাসলাম। বললাম, ‘পাঁচবার আর পাঁচশবারের মধ্যে তুমি কি কোনো পার্থক্য দেখো?’ নিজের বক্তব্যে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। কথাটা আমার নয়, বিভাসের। রাতের পর রাত আমি কেঁদেছি। ও শুধু এই একটি কথাই আমাকে বোঝাতে চেয়েছে যে, পাঁচবার আর পাঁচশোবারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমি তার আধ্যাত্মিক কথা বুঝতাম না। অথচ আজ কি সহজে বুঝে গেলাম। ইমরান ডিটেইল ঘটনা জানতে চাইলো আমার কাছে। বিভাসকে কতদিন বলতে চেয়েছি, খুব বেশি আগ্রহ সে দেখায়নি। অথচ ইমরান জানতে চাচ্ছে। বিভাস বলেছিলো, ইমরান আর সে বিপরীত। হ্যাঁ, বিপরীত।

 

আমি তাকে বিস্তারিতই বললাম। প্রথমদিনের ঘটনা বললাম। আরও বিস্তারিত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইল ইমরান। সে জানতে চায় দরজা খোলার শব্দটা কেমন ছিল? ফ্ল্যাটের রঙটা কেমন ছিল? আমি বললাম, সব তো আর মনে নেই। পরে যখন মনে পড়লো বললাম, সিলভার রঙের তালা ছিলো। ছিটকিনি লাগানোর পর শোভন কী করলো? আমার মনের অনুভূতি কেমন ছিলো? আমি তাকে বললাম। কী রঙের ব্রা পরেছিলাম আমি। যখন সেক্স করতে রাজি হচ্ছিলাম না, শোভন কী কী বাক্য বলেছিলো? সব জানতে চাইলো সে। আমার লজ্জা লাগছিলো। কেন তাকে আমি বলবো। অথচ আমি বলছিলাম। বলার তাগিদ বোধ করছিলাম। জানি না কেন! যেখানে আমার লজ্জা লাগে সেখানটাই অনেকবার করে শুনতে চায় সে। আমার ভেতর থেকে সব খুঁড়ে বের করতে শুরু করল সে। জিজ্ঞাসা করলো, আমার তলপেটের নিচের অংশটা কি পরিষ্কার ছিলো? তার প্রশ্ন শুনে লাল হয়ে গেলাম আমি। কিন্তু কেন জানি মনে হলো, এটাও জরুরি একটা প্রশ্ন। আমার তা ফেইস করা উচিত। বললাম, হ্যাঁ, ছিলো। শেভ করার সময় কী কী ভাবছিলাম আমি — সব জিজ্ঞাসা করলো সে। বললাম, মনে নেই। পরে যা মনে হলো, বললাম। গোয়েন্দাদের মত সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করছিলো সে। কিন্তু কেন? মাঝে মাঝে আমার বেশ বিরক্ত লাগছিলো। আবার ভালোও লাগছিলো। এই কথাগুলোই বিভাসকে আমি বলতে চেয়েছিলাম। বলেওছিলাম। কিন্তু ইমরানের মত প্রশ্নের তীক্ষ্ণ আঘাতই আমার প্রাপ্য। ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলাম আমি। রক্তাক্ত হওয়ার আনন্দ পাচ্ছিলাম আমি। শরীরের ক্ষত থেকে পুঁজ নিঃসরিত হওয়ার আনন্দ। সে জিজ্ঞাসা করে আমার ভালো লেগেছিলো কিনা? বললাম, ‘না, ব্যথা পেয়েছিলাম।’ পরে ভালো লেগেছিলো কিনা? বললাম, ‘হ্যাঁ, লেগেছিলো।’ খুব না মোটামুটি? বললাম, ‘এক-ধরনের ভয় কাজ করতো। মোটামুটি।’ নিজে থেকে আমার কখনো মিরপুর যেতে ইচ্ছে করতো কিনা? বললাম, ‘তাকে আমি চাইতাম, কিন্তু ওখানে যেতে ইচ্ছা করতো না আমার।’ তার প্রশ্ন আর শেষ হয় না। কোটি কোটি প্রশ্ন তার। ছেলেটাকে কি আমি পাগল বানিয়ে দিলাম? কষ্টে নীল হয়ে যাচ্ছে সে। এত কষ্ট মনে হয় আমিও পাইনি।

বললাম, আমাকে উঠতে হবে ইমরান। ওর দিকে তাকাতে পারছি না আমি। আমি মোটেই বুঝতে পারিনি যে, এত কষ্ট ও পাবে। কষ্টই যদি পায় তাহলে বাদ দিক। আর ওর সঙ্গে তো আমার কিছু নেই। আমার হাত ধরলো সে। আমি ছাড়িয়ে নিলাম না। বললো, আমাকে সে ভালোবাসে। অনেক বেশি ভালোবাসে। সে আমার পাশে আছে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুবই কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে কষ্টে মরে যাবে। আমাকে যেন সে তার কষ্টের সময়গুলোতে পাশে পায়। আমি কী বলবো, বুঝতে পারছি না। আমার পাশে তাকে যে দরকার নেই। এই মুহূর্তে এ-কথা তাকে বলতে পারলাম না।

 

আমাকে সে ছাড়লো না। উত্তরা পর্যন্ত সঙ্গে এলো। বেচারা দাঁড়িয়েই এলো অর্ধেক রাস্তা। সিট ফাঁকা ছিলো না। ফাঁকা হলো সেই উত্তরার কাছাকাছি এসে। বাকি রাস্তাটা একসঙ্গেই এলাম। বললাম, সে আসলে ভুল করছে। মনে করিয়ে দিলাম, বিভাসের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা। বললাম, আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাসায় আমি বলেছি বিভাসের কথা। মনে হলো না, এসব কথা ওর কানে গেলো। বাস থেকে নেমেও তার কথা শেষ হয় না। আমার জন্য তার ভালোবাসার নাম নাকি অপেক্ষা। আমার জন্য সে অপেক্ষা করবে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here