ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড ।। কিস্তি : ১৫

সূত্র : জেনম্যান আফ্রিকান সাফারি

নগুগি ওয়া থিওঙ্গো সাহিত্য ও রাজনীতির দুনিয়ায় চেনা একটি নাম। তাঁর বিখ্যাত বই Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (1986)। ঔপনিবেশিক রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বোঝার দারুণ প্রতিনিধি-পুস্তক এই বই। বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন শিবলী নোমান

প্রাসঙ্গিকতার সন্ধান

 

এই প্রতিবেদনটি পুরোপুরিভাবে সচেতনতাপূর্ণ ছিল এ ব্যাপারে যে, মানুষের সামাজিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার জন্যে সাহিত্য হলো একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। তাঁরা সাহিত্যকে দেখেছিল একটি কর্তৃত্বশীল শ্রেণি, বর্ণ বা জাতির মূল্যবোধে সাধারণ মানুষকে জায়গা করে দেয়ার আদর্শিক কৌশলের একটি অংশ হিসেবে। আফ্রিকার উপর কর্তৃত্ব করতে সংস্কৃতির একটি উপাদান হিসেবে সাহিত্যকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ পাওয়া যায় সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষত উপনিবেশবাদে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল :

একটি মহাদেশ হিসেবে আফ্রিকা ঔপনিবেশিক শোষণ, অবদমন ও মানবিক অবমূল্যায়নের শিকার হয়েছে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাকে শেখানো হয়েছে ইউরোপকে তার শিক্ষক ও মানব সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে দেখতে, যেখানে সে হলো শিক্ষার্থী। এর ফলে পশ্চিমা সংস্কৃতি আফ্রিকার শিখন পদ্ধতির কেন্দ্রে চলে আসে, আর আফ্রিকান পদ্ধতিগুলো পেছনে পড়ে রয়। আফ্রিকা তার মানুষের কাছে একদম অপরিচিত ও প্রাসঙ্গিকতা নেই এমন বিষয়গুলোকে খুব সরলভাবে গ্রহণ করে নেয়। এভাবেই আফ্রিকার সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিকে অবমূল্যায়ন করা হয় আর তার মানুষদের পরিচিত করা হয় আদিম ও অসভ্য হিসেবে। ঔপনিবেশিকদের মূল্যবোধগুলোকে আলোর নিচে রাখা হয় আর এর ফলে এক নতুন আফ্রিকান গড়ে উঠে যারা তাদের প্রকৃত চিত্রকে অস্বীকার করে এবং নিজেদের সৃজনশীল শক্তির উপর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি প্রদর্শিত করে।১৭

লেখকগণ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতার যুগে এসেও এমন পাঠ্যক্রম দেখে যেখানে উপনিবেশকে জারি রাখার চাহিদাই পূরণ করা হচ্ছিলো।

 

স্বাধীনতার দশ বছর পরও আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম যে, দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদেরকে বর্তমান সময়ের চাহিদার প্রেক্ষিতে অর্থহীন অপরিচিত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। বিদ্যালয়ের প্রায় সবগুলো বই বিদেশি লেখক দ্বারা রচিত। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ সালে ইএএসিই১৮ পর্যায়ে বিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো ৫৭টি নাটকের ভেতর মাত্র একটি ছিল আফ্রিকান। এটা খুবই স্পষ্ট ছিল যে আমাদের শিক্ষার্থীদের তাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক ও ভৌত পরিবেশের সাথে পরিচিত করানোর জন্যে খুব সামান্য কিছুই করা হতো।১৯

তাঁরা এ বিষয়েও সচেতন ছিলেন যে, রচনা ও লেখকদের সম্ভাবনা ও গঠন বিষয়ে একটি সাহিত্য পাঠ্যক্রম যতটাই এগিয়ে যাক না কেন, চলমান জাতীয় মুক্তি প্রক্রিয়ায় সাহিত্যকে একটি আদর্শিক উপাদান হিসেবে দেখা ও শিক্ষাদান ছাড়া এর প্রভাব সীমাবদ্ধই থাকবে। উপসংহারের একটি অংশে তাঁরা লিখেছেন :

কনফারেন্স থেকে উদ্ভূত তিনটি প্রধান মূলনীতি ওয়ার্কিং কমিটির আলোচনা ও এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রণয়নে দিকনর্দেশনা দিয়েছে।

ক) বিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি সংজ্ঞায়িত ও উন্মোচন করতে ঐ মানুষদের সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর দ্বারা মানসিক বিষয়গুলোকে নির্ধারণ করা যায় ঠিক যেভাবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে আফ্রিকার ঔপনিবেশিক সরকারগুলো করেছিল।

খ) একটি যথাযথ শিক্ষানীতিই শিক্ষার্থীদেরকে সবার আগে তাদের নিজেদের সমাজের সংস্কৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে অধ্যয়নের সুযোগ দেয়; আর তারপর তারা অন্যান্য সমাজের সংস্কৃতি ও পরিবেশ অধ্যয়ন করতে পারে।

গ) বর্তমানে যে শিক্ষাদান করা হয় তাকে ইতিবাচক ও কেনিয়ার ভবিষ্যতের জন্যে সৃজনশীল শক্তিসম্পন্ন করতে হলে একে অবশ্যই চলমান জাতীয় মুক্তি প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ন অংশ হিসেবে দেখতে হবে।২০

কনফারেন্স ও এর থেকে আসা সুপারিশের ফলে আবারও নরকের দরজা খুলে গিয়েছিল, যা ছিল ১৯৬৮-৬৯ সালের বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিতর্কেরই পুনরাবৃত্তি। কিন্তু এবার বিতর্কটি পরিণত হয়েছিল জাতীয় বিতর্কে। কিছু কিছু সংবাদপত্র সাহিত্য বিতর্ক নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ তুলে ধরেছিল, একেবারে প্রতিকূল মতবাদ থেকে আবেগপূর্ণ অঙ্গীকার পর্যন্ত। বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, সত্তরের দশকের প্রথম দিকে বিদ্বজ্জন ও শিক্ষকগণ মার্ক্সিস্ট, কমিউনিস্ট অথবা র‌্যাডিকেল তকমা পেয়ে কারাগার ও বন্দিশিবিরে প্রেরিত না হয়েই এমন বিতর্ক করতে পারতেন এবং কেনিয়ার মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও নিজেদের সংগ্রামের ইতিহাসের অভিজ্ঞতা ঘোষণা করতে পারতেন। তার পরও এই প্রস্তাব এবং কেনিয়া, পূর্ব আফ্রিকা, আফ্রিকা, তৃতীয় বিশ্ব ও বাকি বিশ্বের নতুন প্রেক্ষাপট প্রতিফলিত করা এই মডেল পাঠ্যক্রমকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সহজভাবে গ্রহণ করেনি। ক্ষমতাসীনদের শিক্ষাসংক্রান্ত এলাকায় এগুলো পরিণত হয়েছিল চলমান বিতর্ক ও সংগ্রামের বিষয়ে। পুনরায় একটি কনফারেন্সের মাধ্যমে এই প্রস্তাবগুলো আরও বেশি শক্তিশালী ও আলোচিত হয়ে উঠেছিল এবং ১৯৮১ সালেও বিষয়টি ছিল বিতর্কিত। ১৯৮২ সালে কতিপয় রাজনৈতিক অংশ দ্বারা সাহিত্য বিভাগের এমন পাঠ্যক্রমকে মার্ক্সিস্ট আখ্যা দেয়া হয়। কেনিয়াকেন্দ্রিকতা বা আফ্রোকেন্দ্রিকতাকে এখন মার্ক্সবাদের সমান মনে করা হচ্ছিলো।

 

আমি নিশ্চিত নই আজ সেই প্রস্তাবটিকে গ্রহণ করা হয়েছে কি না। আমার মনে হয় মৌখিক সাহিত্যের মতো কিছু উপাদানকে বিদ্যালয়ের সাহিত্য পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় বিতর্কটি এখনও চলছে। যদিও একে প্রায়ই এমন মনে করা হয়, কিন্তু প্রাসঙ্গিকতার সন্ধান বা পুরো সাহিত্য বিতর্কটি কখনোই আসলে এই রচনা বা ঐ রচনা, এই লেখক বা ঐ লেখক এমন গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপার ছিল না। এটি আসলে ছিল আজকে আফ্রিকায় পড়ানো হয় এমন বিষয়াদি যেমন সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, কলা ও সমাজবিজ্ঞানের অন্য সকল বিষয়ে পাঠদানের দিকনির্দেশ। অন্য কথায় বিতর্কটি ছিল ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার উত্তরাধিকার ও আফ্রিকান মস্তিষ্কে এটি যে চিন্তা প্রোথিত করে দেয় তা নিয়ে। নব্য-ঔপনিবেশিকতার সাথে সম্পর্ক ভাঙতে ইচ্ছুক এমন আফ্রিকার শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন দিকটি গ্রহণ করা উচিত? কোন দর্শন দ্বারা এটি পরিচালিত হবে? এটি ‘নতুন আফ্রিকান’-দের নিজেদের ও তাদের বিশ্বকে কিভাবে দেখাতে চায়? কোন ভিত্তির মাধ্যমে, আফ্রোকেন্দ্রিক না ইউরোকেন্দ্রিক? তখন তাদের কোন কোন বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে হবে, কোন ক্রমে ও প্রেক্ষাপটে? সেসব বিষয়কে তাদের কাছে কে ব্যাখ্যা করবে, একজন আফ্রিকান না একজন অ-আফ্রিকান? যদি আফ্রিকান হয়, তাহলে কোন ধরনের আফ্রিকান? ঔপনিবেশিক বিশ্বদৃষ্টি গ্রহণ করেছেন তেমন একজন, না কি দাসসুলভ চেতনা ভেঙে মুক্ত হতে চাচ্ছেন এমন একজন? আর বিদ্যমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা স্থিতাবস্থার জন্যে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার নিহিতার্থই বা কী? একটি নব্য-ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা কি সম্ভব? এটি কি আসলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নব্য-ঔপনিবেশিকতার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে না?

 

প্রাসঙ্গিকতার সন্ধানে এসব সুপারিশ সফল হবে কি হবে না তা আসলে নির্ভর করে সংস্কৃতি, শিক্ষা ও ভাষা প্রশ্নে সরকারের সার্বিক নীতিমালা এবং আজকের আফ্রিকার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রক্রিয়ার কোথায় ও কিভাবে এটি দাঁড়িয়ে আছে তার উপর।

 

১৯৭৪ সালের বিদ্যালয়ে পঠিত সাহিত্যের জন্যে দেয়া প্রস্তাবসমূহের ভাগ্য যাই হোক না কেন, ‘নাইরোবি লিটারেচার ডিবেট’-এর মূল্যবোধ, ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি আজ কেনিয়া, আফ্রিকা ও তৃতীয় বিশ্বের দ্বন্দ্বমূলক সামাজিক শক্তিগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে এবং এগুলো দার্শনিক শ্রেণিগত ও জাতীয় ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নগুলোকে এক জায়গায় এনেছে।

 

ছয়

প্রাসঙ্গিকতার জন্যে জাতীয় ভিত্তির স্তর নিয়ে কেনিয়ার বুদ্ধিজীবী মহলে দুইটি দ্বন্দ্বমূলক ধারা তৈরি হয়েছে, বিশেষত ইতিহাস, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে।

 

একটি ধারা সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহ্য এবং ঔপনিবেশিকতা ও নব্য-ঔপনিবেশিকতায় নিজেদের খুঁজে পায়। আর তারা সাম্রাজ্যবাদের ভেতরই কেনিয়ার উন্নয়নের শক্তিগুলোকে দেখতে পান। যত দ্রুততার সাথে পশ্চিমের কাছে কেনিয়া তার নিজস্ব পরিচয় হারিয়ে নিজের ভাগ্য সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের কাছে জমা রাখবে তত তাড়াতাড়ি তার উন্নয়ন ঘটবে ও বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার দিকে সে গতিময়তা প্রাপ্ত হবে। রাষ্ট্রীয় বুদ্ধিজীবীদের একটি দলের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করার ধরনে এই ধারাটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যারা তাদের লেখায় খোলামেলাভাবে ঔপনিবেশিকতার প্রশংসা করেন। রাষ্ট্রীয় এই বুদ্ধিজীবীরা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের দুঃসহ অবস্থা থেকে কেনিয়ার মুক্তির জন্যে কেনিয়ার সকল জাতীয়তার মানুষের নায়কোচিত ও দেশপ্রেমিক সংগ্রামকে উপহাস করে থাকেন। তাদের মতে ওয়াইইয়াকি, কইতালেল, মে কাতিলিলি, মারকান সিং, গামা পিনটোর প্রতিরোধের ঐতিহ্য, দেদান কিমাথি ও দ্য কেনিয়া ল্যান্ড অ্যান্ড ফ্রিডম আর্মি (মাউ মাউ) যে ঐতিহ্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে সেই ঐতিহ্য নয়, বরং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে সহযোগিতামূলক ঐতিহ্যই স্বাধীনতা নিয়ে এসেছে। রাষ্ট্রীয় এই বুদ্ধিজীবীদের মতে কেনিয়ার ইতিহাস ও প্রগতির শুরু হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ থেকেই। সাম্রাজ্যবাদই কেনিয়াকে তৈরি করেছে। এসব বুদ্ধিজীবীদের মতে আফ্রিকার দ্রুতগতির উন্নয়নের জন্যে এসব নব্য-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোই হলো মডেল রাষ্ট্র।

 

অন্য ধারাটি সকল জাতীয়তার প্রতিরোধের ঐতিহ্যে নিজেদের খুঁজে পান। কেনিয়ার সাধারণ নারী ও পুরুষের কর্মকাণ্ডের ভেতর এটি কেনিয়ার ইতিহাস ও প্রগতির ভিত্তি দেখতে পায়। কারাগার, বন্দিশালা কিংবা নির্বাসনে থাকা কেনিয়ার বুদ্ধিজীবীরা যারা কেনিয়া এবং কেনিয়ার চাহিদাকে সর্বাগ্রে স্থান দেন — আর নিশ্চিতভাবেই এরা রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তি নন –তারাই এই ধারার সদস্যদের সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। তাদের মতে, অর্থনীতি (তা জাতীয় পুঁজি ও উদ্যোগে কর্তৃত্বপূর্ণ পুঁজিবাদেও), রাজনীতি ও সংস্কৃতির জাতীয় প্রেক্ষাপটগুলোই হলো সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক জাতীয় প্রেক্ষাপট পাওয়ার জন্যে গণতন্ত্র হলো সবচেয়ে ন্যূনতম আবশ্যিকতা, যেখানে বিস্তৃত পরিসরের মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আওয়াজ উত্থাপন করা যায়। তাদের জন্যে সূচনা বিন্দু হলো একটি গণতান্ত্রিক কেনিয়া, এই কেনিয়া হলো ভাষা, সংস্কৃতি, সংগ্রামের গৌরবান্বিত ইতিহাস, বিপুল প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদে পূর্ণ সকল জাতীয়তার কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির কেনিয়া। এই সূচনা বিন্দু থেকে তারা আফ্রিকা, তৃতীয় বিশ্ব, ইউরোপ ও আমেরিকার অপরাপর মানুষের ঐতিহ্য ও সংগ্রামের সাথে নিজেদের যুক্ত করার জন্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি থেকে তারা আরও যুক্ত হতে পারে সমগ্র পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের শক্তিসমূহের সাথে যারা প্রতিনিয়ত সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের উপর মরণাঘাত হানছে। জাতীয় ভিত্তি থেকে শুরু হওয়া আফ্রিকার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অধ্যয়ন সহজেই যুক্ত হতে পারে বিশ্ব সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক ধারাগুলোর সাথে। তাদের মতে প্রাসঙ্গিকতার সন্ধান একাকীত্ববাদের দিকে আহ্বান নয় বরং তা হলো মানুষের ভেতর সমতা, ন্যায়বিচার, শান্তি ও প্রগতির জন্যে গণতান্ত্রিক ও সামাজিক সংগ্রামের আন্তর্জাতিকতার ভিত্তি হিসেবে জাতীয় মুক্তির স্বীকৃতি। তাদের মতে, নব্য-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র হলো প্রগতি ও উন্নয়ন থেকে আফ্রিকার নেতিকরণ। সাম্রাজ্যবাদ ও নব্য-ঔপনিবেশিকতার পরাজয়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদ এবং জাতির উৎপাদিকা শক্তির মুক্তির মাধ্যমেই আফ্রিকার প্রকৃত প্রগতি ও উন্নয়নের শুরু হতে পারে। কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চাহিদা ও কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে জাতীয় বিষয়াদিই হলো বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে উড্ডয়নের প্রয়োজনীয় ভিত্তি, যা হলো আগামী দিনের আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সম্প্রদায়।

ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকতার দার্শনিক ও শ্রেণিগত ভিত্তি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমালোচকদের হিসেবে একজন শিক্ষক, প্রভাষক, ব্যাখ্যাকারী বা বিশ্লেষক সবাই শ্রেণিভিত্তিক সমাজের একটি পণ্য।

নাইরোবি লিটারেচার ডিবেট এবং এর থেকে উদ্ভূত পক্ষে-বিপক্ষের প্রাচুর্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া আজকের কেনিয়ায় এই দুই ধারার অগ্নিগর্ভ সংগ্রামকেই প্রতিফলিত করে। আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস বিদেশি না জাতীয়?–এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো সাম্রাজ্যবাদী ও বিদেশি বিষয়াদিকে স্পষ্টভাবেই প্রত্যাখ্যান করে আলিঙ্গন করেছিল গণতান্ত্রিক ও জাতীয় বিষয়াদিকে। স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো ১৯৬৩ সালে  সাম্রাজ্যবাদী ও নব্য-ঔপনিবেশিকতার রক্ষকগণ অবতীর্ণ হয়েছিলেন রক্ষণাত্মক ভূমিকায়।

 

সাত

নাইরোবি লিটারেচার ডিবেট প্রাসঙ্গিকতার জাতীয় গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে স্পষ্টতই আলাদাভাবে নির্দেশ করতে পেরেছিল; সাথে ইঙ্গিত দিতে পারলেও সফলতার সাথে এই প্রাসঙ্গিকতার দার্শনিক ও শ্রেণিগত ভিত্তিকে আলাদাভাবে নির্দেশ করতে পারেনি।

 

ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকতার দার্শনিক ও শ্রেণিগত ভিত্তি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমালোচকদের হিসেবে একজন শিক্ষক, প্রভাষক, ব্যাখ্যাকারী বা বিশ্লেষক সবাই শ্রেণিভিত্তিক সমাজের একটি পণ্য। জন্মসূত্রে তথা পরিবার বা পিতা-মাতার পেশার ভিত্তিতে প্রতিটি শিশু কোন না কোন শ্রেণিতে বেড়ে উঠে। শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা কর্তৃত্ববান শ্রেণির সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও বিশ্বদৃষ্টি নিয়ে বেড়ে উঠে, এসব সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও বিশ্বদৃষ্টি তাদের জন্মগত বা পারিবারিক শ্রেণির সাথে মিলতেও পারে, আবার নাও মিলতে পারে। তারা তাদের সময়ের শ্রেণি সংগ্রামের কোন একটি পক্ষ বেছে নিতে পারে। আর এভাবেই সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা তাদের দার্শনিক অবস্থান বা বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি এবং তাদের শ্রেণিগত সচেতনতা বা অসচেতনতার দ্বারা প্রভাবিত হয়।

 

প্রথমেই আসে দার্শনিক ভিত্তি। মানুষের অবস্থান ভাববাদী না বস্তুবাদী? তাদের চিন্তা ও কার্যকরণের উৎস দ্বান্দ্বিক না অধিবিদ্যাগত? তারা কি মূল্যবোধ, চিন্তা ও অপার্থিব গুণাবলিকে বস্তুগত বাস্তবতার উপরে স্থান দেন? তারা কি বাস্তবতাকে স্থির মনে করেন না কি একে মনে করেন সদা পরিবর্তনশীল? তারা কি যে কোন বস্তু, পদ্ধতি ও ঘটনাকে সম্পর্কিত মনে করেন না মনে করেন এগুলো প্রতিটি স্বতন্ত্র? যেহেতু ধর্ম ও সংস্কৃতির অন্যান্য এলাকার মতো সাহিত্যও প্রাকৃতিক ও মানব সম্প্রদায়ের বিশ্বের প্রতিফলন, তাই একজন ব্যক্তি বা সমালোচকের বাস্তব জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত বাস্তবতার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাদের উপর দারুণ প্রভাব ফেলে।

বিষয়টি আরও বেশি সত্য শ্রেণিগত সহানুভূতি ও পরিচয়ের ক্ষেত্রে।

 

একজন ব্যক্তি যিনি বাস্তব জীবনে মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করা মানুষদের বিষয়ে সন্দেহপ্রবণ, তিনি অবশ্যই উপন্যাসে থাকা এমন চরিত্রের ব্যাপারেও হবেন সন্দেহপ্রবণ। একজন ব্যক্তি যিনি বাস্তব জীবনে শ্রেণি, শ্রেণি সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিরোধ, বর্ণবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, প্রতিক্রিয়াশীল বনাম প্রগতিশীল সহিংসতা বিষয়ক কথাবার্তায় অসহিষ্ণু, তিনি অবশ্যই সমানভাবে অসহিষ্ণু হবেন এমন কোন শৈল্পিক বিষয়ের প্রতি যেখানে এসব বিষয় কর্তৃত্বপূর্ণ। সমালোচনার মতো সৃজনশীল রচনাতেও একটি আদর্শিক সংগ্রাম রয়েছে। একজন সমালোচকের বিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি, তার কোন শ্রেণির প্রতি সহানুভূতি ও মূল্যবোধ চিনুয়া আচেবে, সেমবেন ওসমান, ব্রেখট, বালজাক, শেক্সপিয়ার, লু সুন, গার্সিয়া মার্কেজ অথবা অ্যালেক্স লা গুমাকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করবে।

 

প্রাসঙ্গিকতার সন্ধান বিষয় পছন্দ করার চেয়ে বেশি কিছুর প্রতি আহ্বান জানায়। বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চিতভাবেই এর উপর কোন ধরনের আইনাধিকার থাকতে পারে না। তবে এসব পছন্দ, বাচনভঙ্গি ও মূল্যায়নের শ্রেণিগত আদর্শিক ধারণা সম্পর্কে সচেতন থাকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রাসঙ্গিকতার পছন্দ ও একটি বৈশিষ্ট্যের মূল্যায়ন জাতীয়, শ্রেণিগত ও দার্শনিক ভিত্তি দ্বারা নির্ধারিত হয়। এসব বিষয়াদিই কেনিয়ার বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাহিত্য পাঠদানের প্রাসঙ্গিকতার সন্ধানের ক্ষেত্রে উদ্ভূত বিতর্কের ভিত্তিমূল।

 

পড়ুন ।। কিস্তি ১৪

ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড ।। কিস্তি : ১৪

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here